সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

প্রাচীন জাতি-প্রাচীন ভাষা

প্রাচীন জাতি-প্রাচীন ভাষা

তুষার মুখার্জী

মে ৬, ২০২৩ ৫০৭ 15

একটা প্রশ্ন প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে নানা আলোচনায়, প্রাচীনতম ভাষা কী? ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের উত্তরে হয় দুটো, না হয় তিনটি ভাষার নাম পাওয়া যাবে; সংস্কৃত, দ্রাবিড়, মুন্ডারি। এর সঙ্গে কখনও আবার বিচিত্রভাবে যোগ হয় হিন্দি বা সিলেটিও। এমন উত্তরের পেছনে অবশ্যই কয়েকটি কারণ রয়েছে। বাংলায় প্রশ্ন করলে আমরা ধরে নেব ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম ভাষার কথাই জানতে চাওয়া হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার সূত্র ধরে বহুকালের চলা বিতর্কিত ধারণা অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবেই দ্রাবিড় আর সংস্কৃতের নাম আসে, সেই সঙ্গে বর্তমানে হিন্দি আর সিলেটি যোগ হয়েছে মূলত বর্তমানের রাজনৈতিক আবহের ভিত্তিতে। তাই এই তালিকার শেষ দুটো নাম নিয়ে আমরা ভাবছি না। তবে, সবার আগে, উত্তর নিয়ে ভাবতে বসার আগে প্রশ্নটি নিয়েই ভাবা দরকার। এই প্রশ্নে কি জানতে চাওয়া হয়েছে? প্রাচীনতম ভাষা বলতে মৌখিক ভাষা না লিখিত ভাষা?

প্রাচীনতম লিখিত ভাষার নাম জানতে চাওয়া হলে নানা প্রত্নক্ষেত্রে পাওয়া লিখিত নমুনার ভিত্তিতে একটা আনুমানিক উত্তর দেওয়া সম্ভব হতে পারে। উত্তরটা আনুমানিক হবে কারণ আমরা জানি না, আরও কত তথ্য এখনও আমাদের অজানা আছে। তাই বলা যায়, এখন অবধি জানা মতে এই ভাষার প্রাচীনতম লিখিত নমুনা পাওয়া গেছে। তারপরেও সমস্যা থেকেই যায়। এখনও বেশ কিছু লিপিকে আদৌ লিপি বলা হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। অথবা লিখিত ভাষা বলতে ঠিক কি বোঝাতে বা বুঝতে চাইছি সেটাও পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। দক্ষিণ আমেরিকার সুতোয় গিঁট বাঁধা খিপুকে লিখিত ভাষা বলব? খিপু-র মত এমন আরো কত আমাদের চোখের জানার আড়ালে রয়ে গেছে তা তো জানাই হয়নি।

যেহেতু লিখিত ভাষার আগেই এসেছে মৌখিক ভাষা, তাই প্রাচীনতম ভাষা কী, জানতে চাইলে ধরে নেব যে মৌখিক ভাষার কথাই বলা হচ্ছে। মুখের শব্দে নিজের মনোভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করাকেই আমরা মৌখিক ভাষা বলে ধরে নেব। অবশ্যই সেই অন্যজনকে আমার মুখে বলা শব্দের অর্থ আগে থেকে জানতে হবে। আর তাকেও আমারই মত করে মুখে শব্দ করে, আমি বোঝার মত শব্দ করে, তার মনের কথা বোঝাতে হবে। তবেই একে বলা যাবে মৌখিক ভাষা। বহুকাল ধরে মনোভাব বিনিময়ের জন্য কিছু অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করতে করতে কথ্য ভাষার ভাঁড়ারে জমা হতে থাকবে আরো অনেক অর্থবোধক শব্দ-কথা। পরে একসময় অর্থবোধক শব্দভান্ডার বেশ কিছুটা বড় হয়ে তার সাথে ন্যুনতম ব্যাকরণ যোগ হলে তবেই কেবল লিখিত ভাষার জন্ম হতে পারবে। তাই লিখিত ভাষার আগে থাকবে মৌখিক ভাষা। অর্থবোধক শব্দের মাধ্যমে মনোভাব প্রকাশের জন্য অবশ্য মুখের কথা ছাড়াও নানা বাজনা বা যন্ত্র দিয়েও অনেক রকমের শব্দ সৃষ্টি করে মনোভাব প্রকাশ করা সম্ভব। এই আলোচনায় সেই সব কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা শব্দকে মৌখিক ভাষার মধ্যে তো নয়ই, কোন ভাষার মধ্যেই রাখছি না। কারণ এই শব্দগুলো দিয়ে সীমিত কয়েকটি মনোভাব বোঝানো গেলেও আমাদের বহু জটিল মনোভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। তাই এগুলোকে আমরা সাংকেতিক শব্দ বলেই আপাতত পাশে সরিয়ে রাখছি।

ফুসফুস থেকে স্বরযন্ত্রের মধ্য বের করা বাতাস দিয়েই আমাদের মুখের নানা শব্দের সৃষ্টি। ফুসফুসের বাতাস প্রথম পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হয় আমাদের স্বরযন্ত্রে, আর স্বরযন্ত্রের ঠিক উপরে বসে থাকা একটি অশ্বখুরাকৃতি হাইয়েড হাড়ের সাহায্যে। ফুসফুসের বাতাস এই পথে বের হবার সময় তাকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা সৃষ্টি করি নানা স্বর। তারপরের পর্যায়ে সেই স্বরমিশ্রিত বাতাস আরেক দফা নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের জিব, তালু, নাক, ঠোঁটের ব্যবহারে মাধ্যমে। এই শেষের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বরযন্ত্রের থেকে বের হওয়া স্বর মিশ্রিতবাতাসে যোগ হয় ধ্বনি। আমরা এই স্বর আর ধ্বনিকে একসাথে ব্যবহার করে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে অসংখ্য ভিন্ন শব্দের সৃষ্টি করি। এই সৃষ্টি হওয়া শব্দকে মনে রেখে তাকে বারবার ব্যবহারও করতে পারি। শব্দকে মনে রাখা মানে সেই শব্দের বিশেষ অর্থ সহ তার সৃষ্টির গোটা শারীরিক কৌশলটাও মনে রাখা। তারপরে আসবে এই অর্থবহ শব্দকে মনোভাব প্রকাশের প্রয়োজন মাফিক স্মৃতি ভান্ডার থেকে উদ্ধার করে, পরপর সাজিয়ে উদ্দিষ্ট মনোভাব প্রকাশ করা। এই গোটা প্রক্রিয়া অবশ্যই আমাদের মস্তিষ্ক করে ফেলে বলেই আমরা নানা অর্থবোধক শব্দের মালা সাজাতে পারি। মস্তিষ্কের এই গোটা কাজটাই আবার নিয়ন্ত্রণ করে দুটি জিন ফক্সপি-১ ও ফক্সপি-২।

একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একই মনোভাব বোঝানোর জন্য বারবার একই রকমের শব্দ-কথা ব্যবহার করতে থাকলে, সেই শব্দগুলোর প্রতিটির বিশেষ অর্থ সেই জনগোষ্ঠীর সকলেরই স্মৃতিতে জমা হতে থাকবে। তারা শব্দ শুনলে বুঝতে পারবে এই সব শব্দ তাদের পরিচিত। এই শব্দের অর্থ তাদের জানা আছে। আর সকলেরই জানা থাকায় তারাও একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে তাদের মনের কথাও অন্যজনকে বোঝাতে পারবে। এই ভাবেই সৃষ্টি হবে একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব অর্থবোধক শব্দের ভান্ডার। আর এই শব্দের ভান্ডার ব্যবহার করেই সৃষ্টি হবে জনগোষ্ঠীটির ভাষা।

এইভাবে মানুষের মুখ থেকে স্বর ও ধ্বনির সংযোগে যে অর্থবহ শব্দ সৃষ্টি হয়, সেটা আবার প্রায় যথাযথ সৃষ্টি করতে সক্ষম কিছু পাখি। এই অনুকরণ করা শব্দকে কিন্তু আমরা ভাষা বলব না। কারণ পাখি কেবলমাত্র শব্দগুলোই অনুকরণ করে। তার পেছনে থাকা অর্থ বা মনোভাব তাদের বোধগম্য নয় বলে তারা অর্থবহভাবে শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারবে না।

নিয়েন্ডারথল, ডেনিসোভানরা কি কথা বলতে পারত? তাদের নিজস্ব ভাষা ছিল? যেহেতু স্যাপিয়েন্সদের মতই তাদের পরিবার, সমাজ ও সমাজবদ্ধ যাপন ছিল, তাই অনুমান করা যেতেই পারে তাদের মধ্যে পারস্পরিক ভাববিনিময়ও ঘটত। সেই ভাব বিনিময়ের ভাষা কী ছিল, সেটা নিয়ে চিন্তার আগে ভাবতে হবে তাদের কোন ভাষা আদৌ ছিল কি? শারীরিক ভাবে আমাদের মতই নিয়েন্ডারথলদেরও স্বরযন্ত্র-জিব-নাক-তালু-ঠোঁট সবই ছিল। তাই আপাতদৃষ্টিতে তাদের পক্ষে কথা বলা অসম্ভব হবার কথা না। কিন্তু এরপরে এসে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তাদের স্বরযন্ত্রের উপরে বসে থাকা অশ্বখুরাকৃতি হাইয়েড বোনটি আমাদের মত সুষ্ঠু আকৃতির আর একেবারে স্বরযন্ত্র থেকে সঠিক দূরত্বে ছিল না। ফলে তাদের পক্ষে আমাদের মত স্বর ও ধ্বনির যুগপৎ সংযোগ আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না বলেই অনুমান। ধারনা করা হয়, নিয়েন্ডারথলদের পক্ষে ভাষা সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল না ঠিকই, তবে মনোভাব বিনিময়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থবোধক শব্দের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ তারা করতে পারতো না। না পারার কারণ ছিল তাদের হাইয়েড হাড়টি সঠিক আকারে ও অবস্থানে ছিল না। ফলে নিয়েন্ডারথলদের অপেক্ষাকৃত বড় ফুসফুসের বাতাস স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে আমাদের চেয়ে বহুগুণ বেশি জোরে আওয়াজ বের করতে পারলেও হাইয়েড হাড়টি যেহেতু আমাদের চেয়ে খানিকটা উপরের দিকে (তালুর দিকে) ছিল, তাই তাদের পক্ষে স্বর নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন ছিল। কতটা কঠিন ছিল তার একটা আভাস পেতে পারি আমাদের শিশুদের থেকে। সাধারণত শিশুদের জন্মের পরে পরেই হাইয়েড হাড়টি জোড়া লেগে ঠিকঠাক অশ্বখুরাকৃতি পায় না। ফলে জন্ম থেকে ফক্সপি-১ ও ফক্সপি-২ দুটো জিন নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশুটিও শুরু থেকে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। না পারার একটা কারণ অবশ্যই তখনও তার মস্তিষ্কের গঠন অসম্পূর্ণ। কিন্তু আমরা জানি গুছিয়ে কথা বলা দুরে থাকুক, বাচ্চারা একক শব্দও উচ্চারণ করতে পারে না। এই না পারার কারণ, স্বরযন্ত্র উপরের হাইয়েড হাড়টির গঠন অসম্পূর্ণ থাকা। ফলে স্বরযন্ত্রের উপরের হাইয়েড হাড়ের দুর্বল স্বর নিয়ন্ত্রণের ফলে শিশুর গলা দিয়ে প্রথম যে শব্দগুলো বের হয় তা হল হেঁড়ে গলায় হ হা গ গা ধ ধা এমন সব একক স্বর। ক্রমে মস্তিষ্ক গঠনে অগ্রগতি ঘটতে থাকলে তারা একই সাথে একাধিক শব্দ বের করতে পারে। এরপরে ঠোঁট, জিব, তালুর ব্যবহার করে স্বরের সাথে ধ্বনির ব্যবহারও আরম্ভ করতে থাকে। তবে যতদিন না স্বরযন্ত্রের ঠিক উপরে থাকা হাইয়েড হাড়টি সঠিক আকার না পাচ্ছে বা সেটি যতদিন সঠিক জায়গায় না বসছে ততদিন ঠিকঠাক ‘কথা’ বলতে পারবে না। নিয়েন্ডারথলদের মুখের ভাষা ঐ শিশুদের প্রাথমিক অবস্থার ধ্বনি মিশ্রিত স্বরের সরল শব্দেই সীমিত থাকার সম্ভাবনা বেশি। কারণ তাদেরও হাইয়েড হাড়টি যথাযথ আকৃতি ছিল না, আর ঠিক আমাদের মত জায়গাতেও ছিল না।


মানুষরা কি তাদের হাইয়েড হাড়টি বর্তমান আকার আর অবস্থান নিয়েই উদ্ভব হয়েছিল? তারা কি প্রথম থেকেই কথা বলত? বিজ্ঞানীদের এখন পর্যন্ত করা ধারনায় স্যাপিয়েন্সদের উদ্ভব হয়েছিল তিন সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে, তবে একেবারে আধুনিক শারীরিক গঠনের মানুষদের উদ্ভব হয়েছিল আনুমানিক ২ লক্ষ বৎসর আগে। তার আগে তাদের স্বরযন্ত্রের উপরে বসে থাকা হাইয়েড হাড়টি কী অবস্থায় ছিল তা আমাদের সঠিক জানা না থাকলেও অনুমান করাই যেতে পারে, তা ছিল খানিকটা নিয়েন্ডারথলদের মতই। পরে সময়ের সাথে সাথে হাইয়েড হাড়টি তার বর্তমান আকার আর অবস্থানে আসে। সেক্ষেত্র ধরে নিতে পারি ২ লক্ষ বৎসর আগের স্যাপিয়েন্সরা নিয়েন্ডারথলদের মত কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত ভাঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করতে পারত। গুছিয়ে কথা বলতে পারতো না। সেই দুর্দশা কাটে সম্ভবত আজ থেকে দুই লক্ষ বৎসর আগে।

প্রাচীন  ভাষার খোঁজে – প্রাচীন জনগোষ্ঠীর খোঁজ

এবার এই হাইয়েড হাড়ের আধুনিকতম আকৃতি আর অবস্থানের সম্ভাব্য সময় মাথায় রেখেই আমাদের প্রাচীনতম ভাষা খুঁজতে হবে। আর সেই খোঁজের পথে প্রথমেই আমাদের খোঁজ পেতে হবে ঐ ২ লক্ষ থেকে ১ লক্ষ বৎসরের প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে। কারণ ২ লক্ষ বৎসর আগে আধুনিক মানুষের মত দৈহিক কাঠামোর সাথেই তাদের হাইয়েড হাড়টিও যথাযথ আকৃতি নিয়ে সঠিক জায়গায় বসতে পেরেছে। তার ফলে দুই লক্ষ বৎসর আগের সেই মানুষ আমাদের মতই স্বর আর ধ্বনির মিশ্রণে আমাদের মত করে সুনিয়ন্ত্রিত কথা বলা শুরু করেছিল। শুরু করেছিল যদিও, তবু তাদের বহু ব্যবহৃত বহু অর্থবোধক শব্দের ভান্ডার গড়তেও লাগবে লম্বা সময়। যদি ২ লক্ষ থেকে দেড় লক্ষ বৎসর আগে কথার সৃষ্টি হতে থাকে তাহলে তো গোটা মানব জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রায় একই সময়ে শুরু হবে, আর একই ভাষা হবে সবার। কাজেই সেই সময়কার সবার ভাষাই আমাদের প্রাচীনতম ভাষা। তা হলে কোন প্রাচীন জনগোষ্ঠী খুঁজে লাভ কি?

তা ঠিক। কিন্তু ভাষার জন্ম তো মানুষের প্রয়োজনে। সেই প্রয়োজন আবার নিয়ন্ত্রণ করবে ভৌগোলিক পরিবেশ। ভৌগোলিক পরিবেশের সাথে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের থাকে ঘনিষ্ঠতম যোগাযোগ। ফলে ব্যবহার্য অর্থবোধক শব্দের ভান্ডারও পরিবর্তিত হতে থাকবে ক্রমাগত যে কোন জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। তার সাথে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে ভাষার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময়। ফলে খানিক দূরে থাকা ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর শব্দের ভান্ডারে যেমন তাদেরই তৈরি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ জমা হতে থাকবে, তেমনই জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের ব্যবহৃত শব্দের ভান্ডারে যোগ হতে থাকবে অন্য জনগোষ্ঠীর শব্দ ভান্ডারের শব্দও। যোগ হবে নিত্য নতুন শব্দ। আর তার ফলে সবকটি জনগোষ্ঠীর ভাষাও বদলাতে থাকবে। বর্তমান পৃথিবীর মিশ্রিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে হাজার হাজার বৎসর ধরে অর্থবোধক শব্দের বিনিময়ে সবার মধ্যেই ভাষার বদলও ঘটতে থাকবে। এই ভাবে বদলাতে বদলাতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেই প্রাচীন ভাষাটির আর খোঁজ পাওয়া যাবে না। আমরা জানি, ভাষার পরিবর্তন সবচেয়ে দ্রুত ঘটে অন্য ভাষার সাথে আদান প্রদানে। তাই প্রাচীন ভাষার খোঁজ পেতে হলে, চাই এমন জনগোষ্ঠীর খোঁজ যারা ছিল বিচ্ছিন্ন। যাদের ভাষার সাথে অন্য ভাষার আদান-প্রদান হয়নি বা খুবই সামান্য হয়েছে। এমন একটি জনগোষ্ঠীর খোঁজ পেতে হবে যারা ভাষার জন্মলগ্নে, অর্থাৎ আনুমানিক দেড় লক্ষ বৎসর আগে বাকি সব জনগোষ্ঠীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

এমন প্রাচীন আর বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর কথা উঠলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হতে পারে আন্দামানের ওঙ্গে, জারোয়াদের কথা। কিন্তু না, তারা আমাদের এই খোঁজের জন্য যথেষ্ট প্রাচীন না। আমরা জানি, কোন জটিল হিসাব প্রমাণের ভেতরে না গিয়েই জানি ৭০ থেকে ৬০ হাজার বৎসর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে আসা মানুষদের একটি অংশ এই ওঙ্গে, জারোয়ারা। আমাদের দরকার আরও অনেক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর। আমাদের সৌভাগ্য বর্তমানের উন্নত জেনেটিক্স বিদ্যায় আধুনিকতম পদ্ধতিতে করা বিশ্লেষণ আমাদের বলে দিতে পারে কোন জনগোষ্ঠী জেনেটিক্যালি কত প্রাচীন। জেনেটিক্যালি এটা প্রমাণিত যে স্যাপিয়েন্সেদের উৎস আফ্রিকা। আর জিনবিদ্যা ও প্রত্নবিদ্যা যুগ্মভাবে আমাদের বলছে এখন থেকে আনুমানিক ১ লক্ষ ২০ হাজার বৎসর আগে একদল স্যাপিয়েন্স আফ্রিকা থেকে বের হয়ে আসে কিন্তু তাদের অস্তিত্ব হয়ত এখন আর নেই। এরপরে আবার একদল স্যাপিয়েন্স বের হয়ে আসে আফ্রিকা থেকেই আনুমানিক ৭০-৬০ হাজার বৎসর আগে। বর্তমান পৃথিবীর সব মানুষই ঐ ৬০-৭০ হাজার বৎসর আগে বের হয়ে আসা আফ্রিকানদের বংশধর। প্রত্ন-প্রমাণ সহ জেনেটিক তথ্য নিশ্চিত ভাবেই বলছে ঐ দলটিরই বংশধর আমরা। জেনেটিক্সের সূত্রে এই খোঁজের কাজে লেগেছে মাইটোকন্ড্রিয়া। মায়ের থেকে মেয়েতে যাওয়া মাইটোকন্ড্রিয়া এই ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বলা হয় মাইটোকন্ড্রিয়ার জিনের হ্যাপ্লোগ্রুপের উৎস ধরে আমাদের প্রথম জননীদেরও খোঁজ পাওয়া সম্ভব। স্যাপিয়েন্সদের প্রথম জননীর মাইটোকন্ড্রিয়া জিনের হ্যাপলোগ্রুপ ‘এল’। হয়তো এটা কিছুটা সরলীকরণ। কারণ যে মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ টিকে আছে আমরা কেবল তারই কথা জানি। আরও কত ভিন্ন মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপের কত আদি জননীর বংশ বিস্তার ব্যর্থ হয়ে গেছে খুব স্বাভাবিকভাবেই তা জানা থাকবে না। টিকে থাকা এই আদি মাইটোকন্ড্রিয়া জিনের হ্যাপ্লগ্রুপের ‘এল’এর প্রথম জননীরাই দুটো শাখায় ভাগ হয়ে যায় এখন থেকে ২ লক্ষ বৎসর আগে। শাখা দুটো হল ‘এল০’ আর ‘এল১-৬’

মাইটোকন্ড্রিয়া ‘এল১’ শাখায় এরপরে যোগ হতে থাকে ‘এল২’, ‘এল৩’ ইত্যাদি। মাইটোকন্ড্রিয়া ‘এল৩’ শাখা আফ্রিকা থেকে বের হওয়া মানুষদের শাখা। এই শাখায় ক্রমে আরও অনেক শাখা যোগ হবে। তার মধ্যে আমাদের অতি পরিচিত মাইটোকন্ড্রিয়া শাখা হল ‘এম’, ‘এন’, ‘আর’, ‘ইউ’। এরা আমাদের পরিচিত কারণ এই মাইটোকন্ড্রিয়া বাহক জননীরাই ভারতীয়দের জননী। তবে মূলত বেশির ভাগ ভারতীয়েরই জননী হল মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ ‘এম’ এর বাহক।

এখানে ডারউইনের বিবর্তন মতবাদে বানর থেকে মানুষ হলে, সব বানর কেন মানুষ হল না বিতর্কের কেন তা কখনোই হবে না, সেটা মনে রাখলে সুবিধা হবে। এমনিতেই বানর থেকে মানুষ কখনোই হয়নি, ওটা স্রেফ কথার কথা। বাস্তবে কোন বানর জননী কোনকালেই কোন মানব সন্তানের জন্ম দেয়নি, দিতে পারেও না। আবার কোন জীবন্ত বানরও কোনকালে লেজ খসিয়ে দুপায়ে হাঁটতে শুরু করতে পারে না। যে প্রাণীকুলের আমরা সদস্য তাকে একটা গাছের আকারের কিছু ভাবলেই ভুল বোঝার সম্ভাবনা কমে যাব। প্রাণীকুলকে গাছের আকারের সাজালে বানর তার একটি শাখামাত্র। তেমনি গোরিলার মত এপ’রা আরেকটি শাখা। এই এপদের শাখা থেকে আরও শাখা বের হয়েছে। তার থেকে নানা প্রশাখাও বের হয়েছে। এপদের এক শাখায় গোরিলা আছে, আরেক শাখায় আছে শিম্পাঞ্জি। এইভাবে এপদের শাখার আরও শাখা প্রশাখা বের হবার পরে আমরা। আমাদের হোমো শাখা। হোমো শাখারও অনেক ডালপালা বের হয়েছে, তার কিছু টিকেছে কিছুকাল, আর কমজোরি ডালপালাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ভালো মোটা শাখায় এসেছে হোমো ইরেক্টাস। টিকেছে অনেকদিন। ফলে তার থেকে বের হয়েছে আরো অনেক শাখা। এই হোমো-ইরেক্টাস শাখা থেকে বের হবে নিয়েন্ডারথল, ডেনিসোভান, স্যাপিয়েন্স সহ আরও কয়েকটি শাখা। তার মধ্যে কমজোরি শাখাগুলো নেই হয়ে গেছে। শেষ অবধি আমরা স্যাপিয়েন্সরা এখনও টিকে আছি।


এই প্রাণীকুলরূপী গাছে স্যাপিয়েন্স শাখা যেমন আছে, তেমনি বানর, গোরিলা, শিম্পাঞ্জির মত আরও অনেক পোক্ত শাখাও টিকে আছে। যেমন করে একটা গাছে অনেক ডাল ভেঙ্গে যায় আবার অনেক ডাল থাকে, ঠিক তেমনি করে।

মাইটোকন্ড্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে বানর, গোরিলা, শিম্পাঞ্জি, শাখা-প্রশাখার কথা বলতে হল কারণ আধুনিক মানুষের জননীদের মাইটোকন্ড্রিয়ার কথার সাথে তার মিল খুব স্বাভাবিকভাবেই আছে। প্রাণীকুলের ঐ অতসব শাখা-প্রশাখা বের হবার মূলে আছে জেনেটিক বিবর্তন। ধরা যাক, প্রথম স্যাপিয়েন্স শাখার জন্ম আনুমানিক সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগে হয়েছিল। তারও আগে নিয়েন্ডারথল আর ডেনিসোভানরা এসে গেছে। সাড়ে তিন লক্ষ বৎসর আগের স্যাপিয়েন্সদের সেই শাখার গোড়ার কথা ভালোভাবে জানার খুব একটা সম্ভাবনা এখনও নেই। তবে দুই লক্ষ বৎসর আগে প্রাচীন স্যাপিয়েন্সদের থেকেই আসে আধুনিক গড়নের আজকালকার স্যাপিয়েন্সরা – মানে আমরা। এই আধুনিক গড়নের মানুষদের উদ্ভবের সময় সেই অতি প্রাচীন স্যাপিয়েন্সদের মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্সোগ্রুপও দুটো শাখায় ভাগ হয়ে যায়।

মাইটোকন্ড্রিয়ার হিসেব বলে সেই অতিপ্রাচীন এল’ শাখার থেকে বের হয়েছিল ‘এল০’ আর ‘এল১‘ – এই দুই শাখা। এই মাইটোকন্ড্রিয়া ‘এল০’ শাখাটিই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। ‘এল০’ শাখার লোকজন বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে যায় আজ থেকে আনুমানিক দেড় লক্ষ বৎসর আগে। তারপরে তাদেরও প্রশাখা বের হয়েছে। প্রশাখা বের হয়েছে, শাখা বের হয়নি। প্রশাখার সবাই ‘এল০’ মাতৃধারার সন্তান। যেহেতু আমরা এখন ‘এম’, ‘এন’, ‘আর’, ‘ইউ’ এই সব মাইটোকন্ড্রিয়ার শাখা থেকে বের হওয়া প্রশাখার মানুষ, তাই খুব সহজেই বুঝতে পারবো যে ‘এল০’ প্রশাখার মানুষেরা আমাদের চেয়ে প্রাচীন। যেহেতু লোকগুলো প্রাচীন, তাই সম্ভাবনা থাকছে তাদের ভাষাই হবে প্রাচীনতম।

ওঙ্গে জারোয়ারা তো প্রাচীন। তাদের ভাষা কেন প্রাচীন বলছি না? ভারতে আমরা প্রায় সবাই মাইটোকন্ড্রিয়া‘এম’ হ্যাপ্লোগ্রুপের উপগ্রুপের জননীদের সন্তান। ‘এম’ ছাড়াও ভারতে আছে ‘এন’ আর ‘ইউ’। মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ ‘এল-৩’ বা তার কোন উপগ্রুপ ভারতে নেই। এই একটি তথ্যই সরাসরি প্রমাণ করে আমাদের আদি জননী আফ্রিকান। যেহেতু ওঙ্গে জারোয়াদের হ্যাপ্লোগ্রুপ ‘এল-৩’ না, তাই অবশ্যই তারাও আফ্রিকা থেকে বের হয়ে আসা ‘এল-৩’ জননীদের থেকে বার হওয়া অন্য শাখার। সোজা কথায় তারা পরের। অর্থাৎ ওঙ্গে, জারোয়ারা প্রাচীন হলেও ততটা প্রাচীন না। তাদের ভাষা দেড় দুই লক্ষ বৎসর আগের স্যাপিয়েন্সদের ভাষা হবে না।

প্রাচীনতম মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ খুঁজতে আমাদের আফ্রিকাতেই যেতে হবে। যদি আমরা হ্যাপ্লগ্রুপ ‘এল-০’ বা তার উপগ্রুপের বাহকদের দেখা পাই তবে বিনা দ্বিধায় বলতে পারবো তারাই প্রাচীনতম স্যাপিয়েন্স জনগোষ্ঠী। আমাদের সৌভাগ্য তেমন জনগোষ্ঠী আছে। দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকাতে আছে হ্যাপ্লোগ্রুপ ‘এল-০ডি’ আর আছে ‘এল-০কে’ এর বাহক জনগোষ্ঠী। কাজেই আমরা বিনা দ্বিধায় বলতে পারি এই জনগোষ্ঠীই প্রাচীনতম স্যাপিয়েন্স জনগোষ্ঠী। জেনেটিক্স বিজ্ঞানীরা বিশদ বিশ্লেষণের পরে বলছেন এই জনগোষ্ঠী এখন থেকে দেড় লক্ষ থেকে ১ লক্ষ বৎসর আগে বাকি স্যাপিয়েন্সদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

টেবিল – ১

প্রাচীনতার দাবিদার খইসান জনগোষ্ঠী

দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠী এই খইসান জনগোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে। তবে এরা ছাড়াও পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ার হাজদা আর সান্দাওয়ে জনগোষ্ঠীও মূলত খইসান গোষ্ঠীরই লোক।

উপাসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ক্যারিনা এম স্লেবুশ দক্ষিণ আফ্রিকার ১১টি জাতির ২২০ জনের জেনেটিক বিশ্লেষণ (২৩ লক্ষ এস.এন.পি.) করে জানান কম করেও এক থেকে দেড় লক্ষ বৎসর আগে এই খইসান জনগোষ্ঠী বাদবাকি সব স্যাপিয়েন্সদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খইসানরা জিনগত বৈশিষ্ট্যের দরুনই দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু জনগোষ্ঠীর থেকে উচ্চতায় বেশি হয়। অন্য বিজ্ঞানীদের আরেকটি পরীক্ষায় ৪ লক্ষ ২০ হাজার এস.এন.পি. নিয়ে বাকি সবার সাথে তুলনা করে দেখা গেছে খইসানরাই একক মানব জনগোষ্ঠী হিসাবে বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে খইসানরা বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পরে অন্যদের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল নানা কারণে, যার মধ্যে জলবায়ুর পরিবর্তন সম্ভবত প্রধান কারণ। খইসান নয় এমন জনগোষ্ঠীগুলোর জনসংখ্যা কমে যাবার ফলে তাদের জেনেটিক বৈচিত্র্যও কমে যায়। তবে কেন খইসানরা বাদবাকীদের থেকে আলাদা হয়ে যায়, তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। অনুমান করা হয়, জলবায়ুর পরিবর্তনই এর কারণ হতেও পারে। খইসানদের বিচ্ছিন্ন হবার সময়কার আফ্রিকার সম্ভাব্য জলবায়ুর নিরিখে বলা হয় দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা বাদে বাকি গোটা আফ্রিকাতেই তখন বৃষ্টিপাত কমে গিয়েছিল। ফলে অপেক্ষাকৃত বেশি সবুজ দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার দিকে চলে আসে এই খইসান জনগোষ্ঠী। যদিও এখন অবস্থা একেবারে বিপরীত। এখন দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় খইসানদের এলাকায় রয়েছে কালাহারি ছাড়াও নামিবি মরুভূমি।

আনুমানিক এক থেকে দেড় লক্ষ বৎসর আগে, বর্তমান পৃথিবীর গোটা মানবজাতির থেকে আলাদা হয়ে গেছে খইসানরা। অথচ গোটা পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতির সাথে তুলনায় এখনো খইসানদের জেনেটিক বৈচিত্র্য অনেক বেশি। কারণ গোটা পৃথিবীর মানুষদের উৎপত্তি আফ্রিকা থেকে বের হওয়া একটি বা কয়েকটি ছোট দল থেকে। আর খইসানরা জেনেটিক বৈচিত্র্যের অভাবে কখনও ভোগেনি। তবু তারা বর্তমানে কেন সংখ্যায় এত কম? বলা হয়, আজ থেকে চার হাজার বৎসর আগেও দৃশ্যটা ছিল আলাদা। খইসানরা বরাবর অর্ধ-যাযাবর শিকারি-সংগ্রাহক, পরে কিছু বদলেছে পশুপালকে। চার হাজার বৎসর আগে কৃষিকাজে অভ্যস্ত বান্টুদের চাপে খইসানরা কোনঠাসা হতে থাকে। শিকার-সংগ্রহের উপযুক্ত এলাকার অভাবে তাদের জনসংখ্যা কমতে থাকে। খইসানদের জনসংখ্যা কমের একটা কারণ অবশ্যই খইসানদের জীবনযাত্রা। তাছাড়া খাদ্যাভাবে অপুষ্টির শিকার না হলেও তাদের জনসংখ্যা কমই থাকে। তাছাড়া দেখা গেছে খইসানদেরই একটি গোষ্ঠী হল সান গোষ্ঠী। এই সানদের একটি গোষ্ঠীর নাম !কুং। !কুং জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গেছে !কুং নারীরা জননী হতে পারে কেবল ১৬ বৎসর বয়সের পরেই। তারপরেও যেহেতু !কুং জননীরা শিশুদের তিন থেকে চার বৎসর বয়স অবধি স্তন্যদান করে তাই তাদের দুটি সন্তানের মধ্যে তিন থেকে চার বৎসরের ফারাক থাকে হামেশাই। এমন সব নানা কারণের যোগফলেই খইসান জনগোষ্ঠী এখন একটি ছোট জনগোষ্ঠী। তারপরে এখন তো তাদের বাসস্থান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় কালাহারি, নামিবি দুই দুটো মরুভুমিতে; জনসংখ্যা স্বভাবতই কম হবে।

খয়খয়ে আর সান এই দুই জনগোষ্ঠীকে একত্রে বলা হয় খইসান। কিন্তু তারপরেও এই দুটো মোটা ভাগ ছাড়া আরও অনেক উপজাতি জনজাতিতে তারা বিভক্ত। খইসানরা বেশির ভাগ দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকায় থাকলেও এদের মধ্যে সান্দাওয়ে আর হাদজা জনজাতি বর্তমানে আছে পূর্ব-আফ্রিকার তানজানিয়াতে।

টেবিল – ২

খইসানদের জেনেটিক তথ্য ও দৈহিক গঠন

মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপের দিক থেকে খইসানরা হল ‘এল-০কে‘ হ্যাপ্লোগ্রুপের। আর তানজনিয়ার সান্দাওয়েরা হল ‘এল-০ডি’ হ্যাপ্লোগ্রুপের। অর্থাৎ সরল হিসাবে সান্দাওয়েরা হল প্রাচীনতর। খইসানদের সান জনগোষ্ঠী হল কালাহারিতে বসবাস করা ‘বুশম্যানরা’। এই ‘বুশম্যান’ শব্দটি কিন্তু অপমানজনক শব্দ। তাই এদের সান জনগোষ্ঠী হিসাবেই উল্লেখ করা হবে। সানদের মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ ‘এল-০কে’সেই হিসাবে এদের সান্দাওয়েদের থেকে কম প্রাচীন বলতে হয়। কিন্তু এই সানদের ওয়াই-ক্রমোজম হ্যাপ্লোগ্রুপ হল ‘এ’ আর ‘বি’ – যা বলে সানরা প্রকৃতই প্রাচীন।

কালাহারির প্রান্তে বাস করা এই সান জনগোষ্ঠী দেখতে কেমন? এখানে আরেকটা দুরন্ত মোড়। এদের গায়ের রং অন্য আফ্রিকানদের মত ঘন-কৃষ্ণবর্ণ না। এদের গায়ের রঙ হলদেটে বাদামী। তা ছাড়া এদের চোখ মোঙ্গোলিয়ানদের মত। তবে তাদের চোখ দেখতে মঙ্গোলিয়ানদের মত মনে হলেও সেটা কিছুটা ভ্রান্ত মনে হওয়া। আসলে চোখের পাতায় একটা বিশেষ ভাঁজের জন্যই তাদের চোখকে মঙ্গোলিয়ান চোখ মনে হয়। এই চোখে দেখা চোখের ভ্রান্তির জন্য অনেকে প্রশ্ন করেন তাহলে এরাই কি পূর্ব-এশিয় বা মোঙ্গলয়েডদের পূর্বপুরুষ? না তেমন মোটেই না। কারণ পূর্ব-এশিয় বা মোঙ্গলয়েডদেরও মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ ভারতীয়দের মতই ‘এল-৩’ র পরের হ্যাপ্লোগ্রুপ। সানদের মাইটোকন্ড্রিয়া হ্যাপ্লোগ্রুপ ‘এল-০কে’ আফ্রিকা থেকে কখনো বেরই হয়নি। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ বৎসর আগে, বাদবাকি খইসানদের সাথে একই সঙ্গে। এই বিচ্ছিন্ন হবার আগে সব খইসানই কি এদের মত পীতাভ বাদামী দেহত্বকের অধিকারী ছিল? খুব কঠিন প্রশ্ন। কারণ বাকি খইসানরা তো কৃষ্ণবর্ণ ত্বকেরই অধিকারী।


খইসানদের ভাষা বৈশিষ্ট্য

খইসানরা জেনেটিক্যালি প্রাচীনতম আর একক বৃহত্তম জনগোষ্ঠী বোঝা গেল। তাদের ভাষা কি সত্যিই তাদের মতই প্রাচীনতম? এক কথায় হ্যাঁ বলা যাবে না। কারণ আর সব জাতি বা জনগোষ্ঠীর মতই তাদের ভাষাও বদলে গেছে। তাদের ভৌগোলিক পরিবেশ যেমন বদলেছে তারই সাথে তাদের ব্যবহৃত শব্দেরও বদল ঘটারই কথা। তারই সাথে তাদের বিচ্ছিন্নতা তাদের ভিন গ্রহে বাসের মত পুরো বিচ্ছিন্ন রাখেনি। খুব কম হলেও তারা অন্যদের সাথে মেলামেশা করেছে। অন্য জাতির সাথে ভাব বিনিময়ের সময় তাদের ভাষারও বদল ঘটেছে। এখন তো অনেক খইসান ইংরেজি আর জার্মান ভাষায় পুরোই স্বচ্ছন্দ। তাহলে তাদের ভাষাকে প্রাচীনতম বলে ভাবার যুক্তি কোথায়? এটা ঠিক, খইসানদের ভাষাটি দেড় লক্ষ বৎসর ধরে অবিকৃত থাকবে তা কখনও সম্ভব না। তবু তাদের দীর্ঘকালের বিচ্ছিন্নতার দরুন ভাষার কিছু বৈশিষ্ট্য সেই দেড় লক্ষ বৎসর ধরে টিকে থাকতে পারে – যে বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আমরা প্রাচীনতম ভাষা নিয়ে খানিক অনুমান করতে পারি।

সেই বৈশিষ্ট্য হল তাদের কথায় ব্যবহার করা ‘ক্লিক সাউন্ড’। এই ক্লিক সাউন্ড হল জিব, তালু আর দাঁতের সমন্বয়ে বের করা কিছু আওয়াজ, যার সাথে স্বরযন্ত্রের আর তার হাইয়েড হাড়ের গঠন বা ব্যবহারের কোন সম্পর্ক নেই। এমন শব্দ আমরাও অনেক সময় করি। যেমন খুব টক কিছু খেয়ে জিব আর তালু দিয়ে ‘ট্চ’ শব্দ করি। খুব অবাক হলেও এমন শব্দ করি তালু আর জিব দিয়ে। খইসানদের কথার মধ্যে, উচ্চারণের মধ্যে, এমন শব্দ ব্যবহার হয় এখনও। তবে খুব বেশি শব্দ এখন আর শোনা যায় না। তাছাড়া তারা অনর্গল ইংরেজি বা জার্মান বলার সময় এই শব্দ ব্যবহার করে না। তবু নিজেদের ভাষায় কথা বলার সময় ব্যবহার করে ক্লিক সাউন্ড। এখনো তারা ২০ রকমের ক্লিক শব্দ ব্যবহার করে। এমন শব্দ মিশ্রিত কথায় গানও আছে তাদের। এই শব্দগুলোকেই তাদের মৌখিক ভাষার প্রাচীনত্বের প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। কারণ কথার মধ্যে এমন শব্দের ব্যবহার পৃথিবীর আরো কোন ভাষায় নেই। পৃথিবীর নানা মৌখিক ভাষায় শব্দের উচ্চারণে পার্থক্য তার সাথে অভিনবত্ব থাকলেও ক্লিক সাউন্ড নেই।

কিন্তু যদি এমন হয় যে ক্লিক শব্দগুলো তারা অনেক পরে আয়ত্ত করেছিল? খুব একটা অসম্ভব নয়। কিন্তু এই ক্লিক সাউন্ডের ব্যবহার আরেকটি দিকেও ইশারা করে, যা এই শব্দের উৎস প্রাচীনতম বলে ভাবতে সাহায্য করবে। এই ক্লিক সাউন্ডের ব্যবহারে স্বরযন্ত্র আর হাইয়েড হাড়ের ব্যবহারের কোন দরকার হয় না। ফলে যখন মানুষ আধুনিক গঠনের মানুষ হয়নি, সেই দুই লক্ষ বৎসর আগে, যখন হাইয়েড হাড়টি তার আধুনিক আকৃতি আর অবস্থানে ছিল না, তখনও মানুষ আরও বেশি করে ক্লিক সাউন্ড ব্যবহার করেই অনেক অর্থবহ শব্দ সৃষ্টি করতে পারত সহজেই। যদি দুই লক্ষ বৎসর আগে শারীরিক গঠনগতভাবে আধুনিক মানুষের সৃষ্টির আগে, যখন তাদের হাইয়েড হাড়টি ঠিকঠাক ছিল না, এমন অবস্থায় তারা কথা বলতে চায় তবে তাদের জন্য সহজতম পন্থা হবে, স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে খানিক অকেজো হাইয়েড হাড় দিয়ে কিছু স্বর বের করে তার সাথে বেশি করে ক্লিক শব্দ যোগ করে নেওয়া। স্বরযন্ত্র আর হাইয়েড হাড়ের মাধ্যমে এখনকার মত নিপুণ স্বর নিয়ন্ত্রণ না করে বেশি করে ক্লিক সাউন্ড মেশায় তবে তারাও অনেক শব্দই ব্যবহার করতে পারবে। আর সেই শব্দের ভান্ডার তাদের ভাষা সৃষ্টিতে সহায়ক হবে।

কিন্তু প্রাচীন স্যাপিয়েন্সদের হাইয়েড হাড়টি তাদের স্বরযন্ত্রের থেকে বর্তমানের দূরত্বে ছিল না বা তার আকারে গঠনে খুঁত ছিল এমন ধারনা তো কাল্পনিকও হতে পারে। হতেই পারে কাল্পনিক। কিন্তু যেহেতু সেই প্রাচীনকালের নিয়েন্ডারথলদের হাইয়েড হাড়টি যথাস্থানে ছিল না, তাই অনুমান করা যায় স্যাপিয়েন্সদেরও ছিল না। তার সাথে মনে রাখতে পারি, আমাদের জন্মের সাথে সাথে হাড়টি তার যথাযথ আকৃতি পায় না এখনও। এখনও তাকে সময় দিতে হয়।

হাইয়েড হাড়ের সমস্যা পাশ কাটাতে দুই লক্ষ বৎসর আগের মানুষের প্রাথমিক কথা বলার শুরুর সময়ে ব্যবহৃত ক্লিক সাউন্ডের ব্যবহার চালু করবে। আর সেটাই প্রচলিত থাকবে দেড় লক্ষ বৎসর আগের মানুষের মধ্যেও। কারণ রাতারাতি তো হাইয়েড হাড়টি তার আকার অবস্থান বদলায়নি। সেখানেও বিবর্তনের নিয়ম মেনে ঝাড়াই বাছাই পছন্দ অপছন্দের বেড়া টপকে টপকে আধুনিক মানুষের তার চেহারা আর স্থান নেবে দীর্ঘ সময় ধরে। তারই মধ্যে আধুনিক স্বর নিয়ন্ত্রিত ধ্বনিযুক্ত অর্থবহ শব্দে সমৃদ্ধ ভাষার সাথে ভগ্নাবশেষের মত টুকরো টাকরা ক্লিক শব্দগুলোও থেকে যাবে।

যেমন যেমন হাইয়েড হাড় তার আকার অবস্থান বদলাবে, তেমনি করে মানুষ অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারবে। ক্রমে কমে যাবে ক্লিক শব্দের ব্যবহার। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে কথা বলার সময় ক্লিক শব্দ ছাড়াই কথা বলার চলন বাড়তে থাকলে একে অপরের নকল করে ক্লিক শব্দ বাদেই কথা বলতে শুরু করবে।

কিন্তু সেই আমূল পরিবর্তনের আগেই যে খইসান জনগোষ্ঠী আর সবার সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দূরে চলে গেছে তাদের মধ্যে ক্লিক শব্দের ব্যবহারের হার কমলেও তা কমবে অনেক ধীর লয়ে। এই ধীর লয়ে ক্লিক শব্দের কমার দরুনই আমরা এখনো সামান্য হলেও ক্লিক শব্দের ব্যবহার পাই প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর কথা মধ্যে। চিনতে পারি আমাদের সম্ভাব্য প্রাচীনতম ভাষার আভাসটুকু।

তথ্যসূত্রঃ-


1. Hie Lim Kim, AkroshRatan, George E Perry, Alvaro Montenegro, Webb Miller, Stefan C Schuster:  Khoesan Hunter Gatherers,: Article Number 5692 (2014): Published in Nature Communication, Volume-5 4th Dec 2014

2. Ian Steadman: “Khoesan People represent earliest branch off humanity failmily tree.” Published in Wired UK, Science.

3. An Gibbons. “Dwindling African Tribe have been most populous group in on Planet. The Bushman of Kalahari are remnants of a huge Ancestral Population.” Science 4th Dec 2014

4. BrigittePakendorf, Mark Stoneking. “The Genomic Prehistory of people speaking Khoisan Languages.” Published in Human Molecular Genetics as Journal Article in Vol 30 on 1st March 2021

5.  Juli: Khoisan People -The Oldest Human- (Click Language + Mongolian)
Khoisan Language Family-The Click Languages of Africa. You Tube video presentation. https://www.youtube.com/watch?v=xjUoGAi43lI

মন্তব্য তালিকা - “প্রাচীন জাতি-প্রাচীন ভাষা”

  1. খুব সুন্দর সহজ ভাষায় বোঝানো হয়েছে প্রাচীন মানবগোষ্ঠী ও তাদের ভাষা সম্পর্কে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেমন করে যুক্তিসঙ্গত অনুমানের ভিত্তিতে নতুন তথ ও সত‍্যের সন্ধান করে তা বোঝা যায় এবং শেখা যায় এই লেখাটি পড়লে।
    ভাষার সঙ্গে মানুষের দৈহিক গঠন ও জিনের সম্পর্ক নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। সৌভাগ্যের কথা কিছু মানুষ আছেন যাঁরা রাজনৈতিক তরজায় না ঢুকে কেবল জানার জন‍্য গবেষণা করেন। তবে কিন দুঃখের বিষয় গবেষণায় প্রয়োজনীয় অর্থের সন্ধানে এঁদের সেই রাজনীতির কারবারিদের দ্বারস্থ হতে হয়।

    1. ধন্যবাদ। আমিও আপনার সাথে একমত যে এই দিক নিয়ে আরো গভীর স্তরে গবেষণা হওয়া দরকার। আশা করা যাক সেটা হবেও।

  2. It is a wonderful article. I came across some beautiful and mind-blowing information about the language and its origin. It’s a strange feeling that we are all coming from the same roots but still, we are different and mother nature nurtures us according to its moods.

    1. ধন্যবাদ। আমরা আসলেই প্রকৃতির খেয়াল খুশিতে ভর করে আছি। মানুষের কথা বলা দিয়ে তৈরী ভাষা সৃষ্টি মানুষকে এক অসাধারন ক্ষমতা দিয়েছে। আমরা যেন এই ক্ষমতার সুষ্ঠু করতে পারি। কথা বলাই এক বিশাল জটিল প্রক্রিয়া তার সাথে সেই সব কথাকে মনে রেখে প্রয়োজন মত বেছে নিয়ে মনোভাব প্রকাশ করার বিশাল জটিলতার কথা ভাবলে বড় অবাক লাগে।

  3. খুব ভালো লেখা। সমস্যা হল, কিছু কিছু জিনিস হাইপথেসিস করা যায়, কিন্তু তার falsify করার চেষ্টা করা কঠিন। কে প্রথম কথা বলেছিল, এটা হল ঐরকম এক সমস্য।

    1. ধন্যবাদ। ঠিকই বলেছেন ভুল দিকটা পরীক্ষা করে না হটালে সত্যিটা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
      সমস্যা হল কথা বলার কোন পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যাবে না।

  4. প্রত্নতত্ত্ব ও জেনেটিকক্সের উপরে ভর করে প্রাচীন মানুষ ও প্রাচীন ভাষার বিষয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও বোধগম্য ভাষার এই লেখনীটি সত্যিই অসাধারণ হয়েছে।

  5. ভাষা নিয়ে একটা অসাধারণ লেখা পড়লাম । স্বরতন্ত্র গঠন নিয়ে এবং তার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে এর আগে এমন সমৃদ্ধ আলোচনা পড়িনি। ধন্যবাদ লেখককে।

  6. খুব সম্বৃদ্ধ লেখা। অনেক ধন্যবাদ। সম্প্রতি একটি সিনেমায় ( God must be crazy) একজন কালাহারি বুশম্যানকে ব্যবহার করা হয়েছিলো। তার মুখে এই click sound শোনা গিয়েছিল। তখন ভারী অদ্ভুত লেগেছিল। এখন জানলাম এটিই প্রাচীনতম মানবভাষা।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।