সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মাতৃকা দেবী থেকে দুর্গা

মাতৃকা দেবী থেকে দুর্গা

রীনা হাজরা

নভেম্বর ৫, ২০২৩ ৩৭৭ 2

চণ্ডীর প্রাচীন মহিষাসুরমর্দিনী রূপের দুর্গা রূপে প্রতিষ্ঠা

সিন্ধু সভ্যতার যে নিদর্শনগুলো পাওয়া গেছে সেগুলোকে প্রাক আর্য সভ্যতার নিদর্শন বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করে নিয়েছেন। পাথরের দেবী মূর্তিগুলোকে তাঁরা মাতৃকা মূর্তি বলেছেন। এই মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি মাতৃকা মূর্তি দুটি হাঁটু ফাঁক করে বসে আছেন আর তাঁর গর্ভ থেকে একটি বৃক্ষলতা বাইরে বেরিয়ে আসছে। এটিকে তাঁরা শস্য উৎপাদিকা ও প্রজনন শক্তির প্রতীক পৃথিবীর মাতৃমূর্তি বলেছেন। ভারতের মতো পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এই রকম মাতৃকা মূর্তি পাওয়া গেছে।

পরবর্তী যুগে বেদেও পৃথিবীকে স্তুতি করা হয়েছে মাতৃদেবী রূপে। পৃথিবীর এই মাতৃদেবী রূপের সঙ্গে একই সঙ্গে পূজা পেয়েছেন পিতা ‘দ্যৌ’। ঋগ্বেদের এই স্তোত্রগুলোই ‘দ্যাবা পৃথিবী’র স্তুতি।

‘মাতা পৃথিবী মহীয়ং’ বলা হয়েছে ঋগ্বেদের ১।১৬৪।৩৩ সূক্তে। আবার ১।১৮৫।২,১০ এই দুটি সূক্তে দ্যাবা পৃথিবীর কাছে পাপ থেকে মুক্তি ও রক্ষা আর তৃপ্তিকর বস্তুর দ্বারা পালনের প্রার্থনা করা হয়েছে। এমনকী এও বলা হয়েছে আকাশ থেকে নেমে আসা বর্ষা হল দৌ বা পিতার রেতঃ যা মাতা পৃথিবী গর্ভে ধারণ করে শস্য উৎপাদন করেন। ঋগ্বেদের ১।৭২।৯ সূক্তে আদিত্যগণের মাতা অদিতিকেই পৃথিবী বলা হয়েছে।

পরে মাতৃকা বা দেবী মাতার কথা রয়েছে অথর্ব বেদে। পৃথিবীর মাতৃরূপে বর্ণনা রয়েছে অথর্ববেদের ‘পৃথিবীসূক্তে’। অথর্ব বেদের ‘পৃথিবী সূক্তে’ ১২।১।২ মন্ত্রে পৃথিবীকে সর্ব ঐশ্বর্যশালিনী মহিমাময় মাতৃমূর্তি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।

বেদে পুরুষ দেবতারাই ছিলেন প্রধান। মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিরা ছিলেন পুরুষ দেবতাদের মন্ত্রের উদ্গাতা। অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্ও ছিলেন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। ঋগ্বেদের  ‘দেবীসূক্ত’ অম্ভৃণ ঋষির কন্যা সেই বাক দৃষ্ট। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫ সংখ্যক ঋক, ‘দেবীসূক্ত’টি হল সেই মন্ত্র। এখনও শক্তি পূজার সবথেকে প্রাচীন মন্ত্র এই দেবীসূক্ত।

দেবীসূক্তে বলা হয়েছে তিনি সর্বত্র বিরাজমান, সব কিছুকে ধারণ করে আছেন, সব কিছুই তিনি পরিচালনা করেন। তিনিই সর্বব্যাপিনী ক্রিয়াশক্তি। তিনি সর্বশক্তিমান। সেই সর্বশক্তিমানের অনন্ত শক্তিই সর্বক্রিয়া আর সর্বজ্ঞানের মূল কারণ। পরব্রহ্ম আর তাঁর শক্তি অভেদ। কিন্তু শক্তিবাদে সেই অভেদ থেকে পরব্রহ্মের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, পরব্রহ্ম থেকে স্বতন্ত্র সত্তা আর মহিমায়। শক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা হল এই ভাবে। বৈদিক দেবীসূক্তটি পরবর্তী কালে এই ভাবে শক্তিবাদের বীজ হিসেবে গ্রহণ করা হল। (ঋক ১০।১২৫।১থেকে ৮) ঋগ্বেদের ‘রাত্রিসূক্তে’র দেবীও মাতৃরূপী।

দেবী পুরাণে বলা হয়েছে তিনি ‘ব্রহ্মমায়াত্মিকা’, ‘ভুবনেশ্বরী’, তিনি ‘পরমেশলয়াত্মিকা’। এই লয়াত্মিকা রাত্রিই শক্তি। তন্ত্রসাধনায় শিব শক্তি তত্ত্বকে কোথাও কোথাও দিবা রাত্রি তত্ত্ব বলা হয়েছে। (দেবী পুরাণ ১২৭।১৮৩)

ঋগ্বেদে ৩।১৫।১ সূক্তে যজ্ঞাগ্নিকে সকল শক্তির উৎস বলা হয়েছে। তিনিই রক্ষা করেন, তিনি রাক্ষস বা শত্রুকে বিনাশ করেন। সেই রকমই দেবী পুরাণে বলা হয়েছে যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ডের মধ্যস্থ দেবী আয়ু আরোগ্য, বিজয়, ভূমিলাভ, প্রিয়ত্ব, বিদ্যা, সৌভাগ্য, পুত্রাদি দান করেন। তিনিই সকল দেবতার মধ্যে সর্বোত্তমা।

পরবর্তী কালে দুর্গা পূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হয়ে দাঁড়াল যজ্ঞ।

বেদের পরবর্তী ক্রমে আরণ্যকগুলোতে দেবী পরমশক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে শিবকে বলা হয়েছে অম্বিকাপতি। অম্বিকা জগতের মাতা, তিনিই পার্বতী। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের যাজ্ঞিকা উপনিষদের দুর্গা গায়ত্রী মন্ত্রে বলা হয়েছে ‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে, কন্যাকুমারীং ধীমহী, তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ।‘

মাতৃদেবীকে ‘দুর্গি’ অর্থাৎ দুর্গা বলা হয়েছে।

অগ্নি বা সূর্যের কন্যা বৈরোচনী নামে দেবী রূপে তাঁর আর্যীকরণ প্রতিষ্ঠিত হল তৈত্তিরীয় আরণ্যকের নারায়ণ উপনিষদে;

‘তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং

বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।

দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে

সুতরসি তরসে নমঃ।।‘

বাজসনেয়ী সংহিতাতে দেবীর অম্বিকা নামের কথা রয়েছে।

আবার তাঁকে ‘কন্যাকুমারী’ অর্থাৎ কুমারী কন্যা বলা হয়েছে। মহাভারতে তাঁকে মন্দারবাসিনী কুমারী বলা হয়েছে যিনি পর্বতে বাস করেন। অজ্ঞাতনামা গ্রিক লেখকের লেখাতেও দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারীতে তাঁর উপাসনার কথা বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণ ‘কাত্য’ বংশীয় রাজাদের কুলদেবী ‘কাত্যায়নী’র কথা বলেছেন ঐতিহাসিক রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর। তিনি দেবীর কৌষিকী বা কৌশিকী নামের কথাও বলেছেন। মহাভারতেও তাঁর কাত্যায়নী নাম পাওয়া যায়। পরে বরাহ আর বামন পুরাণেও অসুর দমনে কাত্যায়ন ঋষির কন্যারূপে কাত্যায়নীর নিজের শক্তি দুর্গাকে দান করার কথা রয়েছে।

মৈত্রায়নী সংহিতাতে তাঁর গৌরী নামের গায়ত্রী মন্ত্র রয়েছে। কেন উপনিষদে ‘বহুশোভমানা’ দেবী উমার কথা বলা হয়েছে যিনি পরমব্রহ্মকে জানেন, যাঁকে অগ্নি, বায়ু, ইন্দ্র এঁরাও জানেন না। তিনি হৈমবতী অর্থাৎ হিমবৎ বা হিমালয়ের কন্যা। কেন উপনিষদ ৬।৩৮।১-৪ সূক্তে দেবীর সম্বন্ধে বলা হয়েছে,’ যিনি সিংহে, ব্যাঘ্রে এবং সর্পের ভিতরে, যিনি দীপ্তি অগ্নিতে, ব্রাহ্মণে, সূর্যে …’, তিনি ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী। শক্তিরূপিণী উমা সকলকে ব্রহ্মের শক্তি ও মহিমা বর্ণনা করেছেন। এই সিংহবাহিনী উমাকেই শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।

উমা ক্রমশ দুর্গা নামে পরিচিত হলেন। শব্দকল্পদ্রুমে দুর্গ বা দুর্গম নামের দৈত্য, দুঃখ, রোগ, মহাভয় অর্থাৎ সমস্ত দুর্গতিকে যিনি হরণ করেন তিনিই দুর্গা।

মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে (৪।১১) তাঁকে বলা হয়েছে, তিনি দুর্গম ভবসাগরে নৌকাস্বরূপ তাই তিনি দুর্গা। দেবী পুরাণে (৮৩।৬২-৬৩), খিল হরিবংশে (১২০।৩৫) ‘মহাদেবী দুর্গা দুর্গপরাক্রমা’ বলা হয়েছে। দেবী ভাগবতে (৩।২৪।৫-৬), নগর রক্ষাকারিণী বলা হয়েছে। দুর্গাকে এখানে দুর্গরক্ষিণী দেবী রূপেই স্তুতি করা হয়েছে।

মহাভারতে বিরাট পর্বে যুধিষ্ঠিরের দুর্গাস্তব আর ভীষ্ম পর্বে শ্রীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে যুদ্ধের আরম্ভে উপদেশ দিচ্ছেন তখন সেই উপদেশ শুনে অর্জুনের দুর্গাস্তব, এই দুটি দুর্গাস্তব রয়েছে। যদিও এই দুটি দুর্গাস্তবই পরবর্তী সময়ে যোগ করা হয়েছে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন।

এর পর ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, হরিবংশ, মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ণনা করা হয়েছে দেবী চণ্ডীর। দেবী পুরাণে তাঁকে রাত্রি বলা হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘চণ্ডী মাহাত্ম্যে’র প্রথম অধ্যায়ের আঠারোটি মন্ত্রকেও রাত্রিসূক্ত বলা হয়েছে। শাক্ত তন্ত্রের ধারা অনুযায়ী বেদে সেই প্রভাব দেবী অম্বিকা রূপে দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে তাঁকে রুদ্রের ভগ্নী বলা হয়েছে। রুদ্র ক্রমে পরম শিব, মহাদেব হিসেবে স্বীকৃত হলেন।

মার্কণ্ডেয় পুরাণ ও দেবী মাহাত্ম্য রচনার ঐতিহাসিকতা

রাজস্থানের যোধপুর আর বিকানেরের কাছে রয়েছে প্রাচীন দধিমতী বা দধামতো মাতা মন্দির। যোধপুরের ‘দাহিমা ব্রাহ্মণ’রা প্রত্যেকেই দধিমতী মাতাকে নিজের নিজের কুলদেবী বলে মানেন। নাগৌর থেকে কিছুটা দূরে মরুভূমিতে গোঠ আর মাঙ্গলোদ গ্রামের সীমানায় এই মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল সপ্তম শতকের প্রথমে। মন্দিরে পাওয়া গেছে একটি লেখ। লেখতে ‘দাধিয়া ব্রাহ্মণ’দের কথা লেখা হয়েছে যারা এখন দাহিমা বা দাধীচ ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। মন্দিরের এই লেখ প্রায় পুরোটাই গদ্যে লেখা হলেও এগারো আর বারো লাইনে একটি স্তোত্র রয়েছে। লেখর এই স্তোত্র মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মাহাত্ম্য অংশ থেকে উদ্ধৃতি। লেখটির লিপি ‘রাজাধিরাজ যশোধর্মণ বিষ্ণুবর্ধনে’র মন্দসৌর পিলারের লেখর লিপির মতো। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মাহাত্ম্য অংশের এই স্তোত্রটি লেখর একাদশ লাইনে লেখা আছে,

‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে।’

একেবারে নীচে দেওয়া আছে লেখটির তারিখ। প্রচলিত জৈন গ্রন্থ, আর ‘বলভী’‌ রীতিতে তারিখ লেখা হয়েছে। তারিখ শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী ২৮৯ গুপ্তাব্দ। এই তারিখ বিক্রম সম্বত ৬৬৫ অর্থাৎ ৬০৮ সাধারণ বর্ষ। মার্কণ্ডেয় পুরাণের একাশি থেকে তিরানব্বই অধ্যায় পর্যন্ত দেবী মাহাত্ম্য অংশ। তারই একানব্বই অধ্যায়ের নবম শ্লোক অর্থাৎ দেবী মাহাত্ম্যের দশম অধ্যায়ের শ্লোক এটি।

কাজেই যদি মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচিত হবার পরে অন্য কেউ ‘দেবী মাহাত্ম্য’ রচনা করে সংযোজন করে থাকেন তাহলেও সপ্তম শতকের অনেক আগেই তা লেখা হয়েছে।

তাছাড়া গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত চতুর্থ শতকের শেষের দিকে অন্য অনেক মূর্তির সঙ্গে মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডী মূর্তি মধ্যপ্রদেশের উদয়পুরের গুহাতে পাথরে খোদাই করে তৈরি করিয়েছিলেন।

গুহাটির লেখ থেকে জানতে পারা যায় এই মূর্তিগুলো তৈরি হবার পর ৪০১ সালে গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাঁর মন্ত্রীর সঙ্গে পরিদর্শনে এসেছিলেন। এর থেকেও বোঝা যায় তৃতীয় চতুর্থ শতকের আগে থেকেই চণ্ডী পূজা হত।

দেবী মাহাত্ম্য রচনা হয়েছিল পশ্চিম ভারতে নর্মদা নদীর তীরে কোনো জায়গায়, সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। পরে নেপালে ৯৯৮ সালের একটি তালপাতায় লেখা দেবী মাহাত্ম্যের সম্পূর্ণ পু্ঁথি পাওয়া গেছে। দেবী শক্তি হিসেবে চণ্ডী দেবীর পূজার খুব গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হল এই দেবী মাহাত্ম্য। দেবী মাহাত্ম্যকে সপ্তশতী বা চণ্ডী মাহাত্ম্যও বলা হয়। দেবী ভাগবতেও চণ্ডিকার বর্ণনা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছে। বাঙলা আর ওড়িশাতে চণ্ডী খুবই জনপ্রিয় দেবী।

শাক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সবথেকে প্রচলিত শাস্ত্র এই দেবী মাহাত্ম্যে বর্ণনা করা হয়েছে দেবী চণ্ডী বা চণ্ডিকার। ‘চণ্ডী’ শাস্ত্রে অনেক জায়গায় তাঁকে শুধু দেবীও বলা হয়েছে। এছাড়া ভগবতী, পরমেশ্বরী, অম্বিকা নামও তাঁর। কখনও দুর্গা, গৌরদেহা বা গৌরী, কাত্যায়নী বলা হয়েছে। তাঁর অন্য নামগুলোর মধ্যে রয়েছে শিবদূতী, শাকম্ভরী, ভীমা, ভ্রামরী। দেবী মাহাত্ম্যে তাঁকে পার্বতী বলা হয়েছে হিমালয় পর্বতের কন্যা রূপে নয়, পর্বতে বাস করেন তাই তিনি পার্বতী।

‘চণ্ডী’তে ব্রহ্মা দেবীর স্তব করছেন, ‘বিষ্ণু, আমি আর ঈশান শিব, যে তোমার কাছ থেকে শরীর গ্রহণ করেছি, সেই তোমার স্তব করার শক্তি কার আছে?’

‘বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণমহমীশান এব চ।

কারিতাস্তেযতোহতস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান ভবেৎ।’

‘তুমি অখিল জগতের আত্মাস্বরূপ, সকল সৎ ও অসৎ, সব কিছুরই প্রাণময় শক্তিস্বরূপ।’

চণ্ডীতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে দেবীর বিভূতিস্বরূপ বলা হয়েছে। তাঁরা দেবীরই শক্তি। তিনি তাঁদের সকলের উপরে। দেবতাদের অষ্টশক্তিও তাঁরই শক্তি। এতে দেবী চণ্ডী তিনটি ভিন্ন রূপে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম রূপে মধুকৈটভ দৈত্য নিধনে তিনি বিষ্ণুর সহায়তাকারিণী। দ্বিতীয় রূপে মহিষাসুর নিধন তিনি নিজেই করেন, আর তৃতীয় রূপে শুম্ভ নিশুম্ভ দৈত্য বধের সঙ্গে চণ্ড মুণ্ড আর রক্তবীজের নিধনকারিণী রূপও তাঁর। প্রথম রূপে মধুকৈটভ সংহারের সময় তিনি বিষ্ণুর শক্তি, বিষ্ণুর যোগনিদ্রা, মহামায়া। চণ্ডী (১।৫৪)

বিশ্বেশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতি ও সংহারকারিণী ভগবতী হলেও তখন তিনি নিস্ক্রিয়, স্তিমিত। চণ্ডী (১।৭১) মধু কৈটভ দৈত্য বধের জন্য সেই নিস্তরঙ্গ শক্তিকে জাগ্রত করার জন্য ব্রহ্মা স্তব করলেন। ‘জগৎস্রষ্টা, জগতের পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা এমনকী জগৎ গ্রাসকারী বিষ্ণুও তোমার দ্বারাই নিদ্রাবশে অভিভূত হন, সেই তোমার স্তব করার সামর্থ্য কার আছে?’ চণ্ডী ( ১। ৮৩)

এই স্তবে বিষ্ণুর শরীর থেকে দেবী জাগ্রত হলেন। তিনি বিষ্ণুশক্তি। তাঁর জাগরণে বিষ্ণু সক্রিয় হয়ে উঠলেন। যজ্ঞে তিনি স্বাহা, স্বধা, বষট্ কার রূপিণী। তিনি প্রণবরূপা, সাবিত্রী, দেবজননী। তিনি সৃষ্টি স্থিতি সংহারকারিণী, তিনি মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহামেধা, মহাদেবী, মহাসুরী। অসুরদের তিনি তাঁর মহামায়ার দ্বারা বশীভূত করলেন। তাঁর জাগরণে বিষ্ণু যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। মহাকালী রূপে তিনি বিষ্ণুর সহায়তা করলেন। মধু কৈটভ দৈত্যের নিধন হল। এই বর্ণনায় তিনি শিবের সঙ্গে নয় বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত।

তাঁর দ্বিতীয় রূপে তিনি মহিষাসুরমর্দিনী।

মহিষাসুর দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ অধিকার করল। দেবতারা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে বিষ্ণুর কাছে এলেন, তখন বিষ্ণু আর তাঁর কাছে উপস্থিত শিব মহাক্রুদ্ধ হলেন, তাঁদের শরীর থেকে মহা তেজ নির্গত হল। ইন্দ্র আর অন্য দেবতাদের শরীর থেকেও তেজ নির্গত হয়ে সম্মিলিত হয়ে মহা তেজঃপুঞ্জ সৃষ্টি হল। ত্রিভুবন উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সেই তেজ রাশির দীপ্তিতে। তার পর সেই সম্মিলিত তেজঃপুঞ্জ এক অপূর্ব জ্যোতির্ময়ী নারীমূর্তি ধারণ করল। শম্ভুর তেজ থেকে তাঁর মুখমণ্ডল তৈরি হল। দেবতারা সকলে তাঁকে বিশেষ বিশেষ অস্ত্রদান করলেন। সেই জ্যোতির্ময়ী দেবীই মহিষাসুরমর্দিনী দেবী চণ্ডী। সব দেবতারা স্তুতি করলেন দেবী চণ্ডীর। তিনি মহিষাসুর বধ করলেন। পরে দেবী মাহাত্ম্যে বর্ণিত এই মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডী রূপকেই দুর্গা রূপে পূজা শুরু হয়েছিল।

তৃতীয় রূপে শুম্ভ নিশুম্ভ বধের সময়ও দেবতারা হিমালয়বাসিনী দেবীকে ‘দেবীং বিষ্ণুমায়াং প্রতুষ্টুবঃ’ অর্থাৎ বিষ্ণুর শক্তি বা মায়া রূপে আবাহন করে তুষ্ট করলেন। এখানেও তিনি বিষ্ণুমায়া, শিবের শক্তি নন। তাঁর শরীরের কোষ থেকে এক দেবীর সৃষ্টি হল। কৃষ্ণ বর্ণা কৌষিকী বা কৌশিকী বেরিয়ে এলেন, দেবীর গৌরী রূপ আলাদা থেকে গেল। তিনিই দেবী মহালক্ষ্মী।

শশিভূষণ দাশগুপ্তের ‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ বই থেকে পাওয়া যাচ্ছে যে, ঐতিহাসিক রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকরের মতে কুশিক জাতির দেবীর নাম থেকে কৌশিকী দেবীর উৎপত্তি। (পৃষ্ঠা ৬৬)

কৌষিকী দেবী মহালক্ষ্মীকে বললেন, ‘মা, আমার নামকরণ কর।’

কৃষ্ণবর্ণ দেবীর রূপ বর্ণনা করে মহালক্ষ্মী তাঁর নামকরণ করে বললেন,

‘তুমি মহামায়া, মহাকালী, মহামারী, তুমি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, একবীরা, তুমি দুরতিক্রম্য কালরাত্রি। তুমি হরির যোগনিদ্রা।’ মহালক্ষ্মীর অবতাররূপিনী মহাকালী দেবীরই শক্তি।

মহাকালীর স্তব করলেন ব্রহ্মা। এই সময়েই দেবতাদের সপ্ত শক্তি সপ্তমাতৃকা রূপে তাঁরই রূপের অংশীভূত হয়ে যুদ্ধ করলেন। শুম্ভ যখন দেবীকে বিদ্রূপ করল যে অন্যের সাহায্য নিয়ে তিনি যুদ্ধ করছেন, তখন দেবী তাঁদের নিজের মধ্যে সংহরণ করে একাই অসুর নিধন করলেন।

তাঁকে ‘বৈষ্ণবীশক্তিরনন্তবীর্যা’ বলে স্তুতি করেছেন দেবতারা‌। (চণ্ডী একাদশ অধ্যায়ে দেবীস্তুতি)

দেবী মাহাত্ম্যের একাদশ অধ্যায়ে তাঁকে ‘নারায়ণি নমোহস্তুতে’ বলেই বারবার স্তুতি করা হয়েছে। এছাড়া পঁয়ষট্টিটি নমস্কার মন্ত্রের শ্লোকে দেবতারা তাঁকে প্রণাম করছেন, যার প্রথম স্তবটিতেও তাঁকে বিষ্ণুমায়া বলা হয়েছে।

‘যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।’ (একাদশ অধ্যায়)

বিষ্ণুশক্তি ছাড়াও তাঁর আর একটি রূপে তিনি ‘স্বতন্ত্রা’ অর্থাৎ তিনি পরমতোত্ত্ব, অদ্বিতীয়া মহাশক্তি, তিনি সকলের উপরে। তাঁর থেকেই জগতের সৃষ্টি।

উপনিষদে বলা হয়েছে ব্রহ্মই পরম সত্য। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্। শাক্ত মতে তিনিই পরমতোত্ত্ব, সেখানে তিনি পরাৎপর ব্রহ্মস্বরূপা পরমেশ্বরী। সেখানে তিনি অদ্বয় অর্থাৎ তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। এমনকী শিবের শক্তিরূপে শিবের সঙ্গে অদ্বয় ভাবেই তিনি প্রতিষ্ঠিত। চণ্ডীতে (১।৫৮) তাঁকে ‘সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী’ বলা হয়েছে।

দেবী ভাগবত রচনা হয়েছিল দেবী মাহাত্ম্যের পরে। সেখানে বলা হয়েছে অদ্বিতীয়া মহাশক্তির সাত্ত্বিকী, রাজসী আর তামসী শক্তির প্রকাশ দেবীর ত্রিতত্ত্ব মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, মহাকালী রূপে। দেবী ভাগবত (১।৭।৪৫), (১।১৫।৩৪)

বেদের নাসদীয় সূক্তের পুরুষ সূক্তে পুরুষের মতো দেবী ভাগবতে দেবীকেই পরমতোত্ত্ব বলা হয়েছে। দেবী ভাগবত (২।৭।৬১-৬২)।

আবার মহাভারতে মহিষাসুর আর তারকাসুর বধের কথা রয়েছে। সেখানে ইন্দ্র শিবপার্বতীর পুত্র স্কন্দ বা কার্তিকের সাহায্য চাইলেন। এরপর স্কন্দ তাদের বধ করেন। তখনও পর্যন্ত দেবী চণ্ডীকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেখা যায়নি। সম্ভবত পরে কোনো লৌকিক কাহিনী অবলম্বনে মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডীর আবির্ভাব হয়েছিল। চণ্ডী কাহিনীর প্রথম উদ্ভব সম্ভবত বাঙলা অথবা উজ্জয়িনীতে, বলেছেন শশিভূষণ দাশগুপ্ত।

অনেক পরে শিখগুরু গোবিন্দ সিংহ লিখেছিলেন ‘চণ্ডী চরিত্র’। তিনি সেই কাব্যে লিখেছেন, চণ্ডী ছিলেন উজ্জয়িনীর রাজার একমাত্র সন্তান। রাজকন্যা চণ্ডী তাঁর শৌর্য বীর্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

রাজা মারা যাবার পর রাজকন্যা চণ্ডী রাজত্ব করছিলেন। চণ্ডী একদিন নদীতে তাঁর মৃত পিতার তর্পণ করতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র এসে তাঁর সাহায্য চাইলেন। কারণ অসুররা ইন্দ্র আর সব দেবতাকে বিতাড়িত করে স্বর্গ অধিকার করে নিয়েছে। চণ্ডী বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে তাঁর সৈন্যদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করে অসুরদের বিনাশ করলেন। সম্ভবত বিভিন্ন জায়গায় এই রকম লোক কাহিনীর মাতৃদেবী আর চণ্ডী দেবীর অসুরদলনী রূপের কাহিনী একীভূত হয়ে গেছে।

অনার্য আদিবাসীদের পূজিত দেবী সেই সময় থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূলধারার দেবী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বৌদ্ধ তন্ত্রের দেবী রূপেও চণ্ডী যুক্ত হয়েছেন। চণ্ডী দেবীর পূজা বাংলায় অনেক প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছিল। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে কালকেতু আর ধনপতির কথাতে চণ্ডীর কমলেকামিনী রূপের বর্ণনা করা হয়েছে। ষোল শতকের সময় থেকে বাংলায় লেখা হচ্ছিল চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। চণ্ডীমঙ্গলে কালকেতু ফুল্লরা আর ধনপতি সওদাগরের চণ্ডীর পূজা করে তাঁর কৃপা লাভের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে।

এখনও পর্যন্ত পাওয়া সব থেকে প্রাচীন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিটি হল মধ্যপ্রদেশের উদয়গিরি গুহাতে গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রতিষ্ঠিত চতুর্থ শতকের ভাস্কর্যটি। হিমাচল প্রদেশের ইরাবতী বা রাভী উপত্যকায় সপ্তম শতকের শেষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘লক্ষণা দেবী’ নামের চতুর্ভুজ মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। নরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট’ বইতে রাজস্থান, দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন মহিষমর্দিনী মূর্তির আলোচনা করেছেন।

রাজস্থানে মহিষমর্দিনী মূর্তি খুবই জনপ্রিয় ছিল। রাজস্থানের গঙ্গানগরের ভদ্রকালীতে পাওয়া মাটির ফলকে চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি খোদাই করা হয়েছিল। আম্বের মিউজিয়ামের একটি মাটির ফলকে দেখা যায় দেবীর উপরের দুই হাতে ঢাল ও বজ্র, নীচের হাতে মহিষের জিভ টেনে ধরেছেন। উদয়পুরের কাছে একটি অম্বিকামন্দিরে অষ্টভুজা মহিষমর্দিনীর অনেক রকম মূর্তি পাওয়া গেছে। ওশিয়াঁ, আবানেরি, পরনগরে মহিষমর্দিনীর মূর্তি পাওয়া গেছে। এছাড়াও রাজস্থানে অসংখ্য মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে।

আইহোলের বিখ্যাত দুর্গামন্দির ষষ্ঠ‌ সপ্তম শতকে চালুক্যরাজারা তৈরী করিয়েছিলেন। এই মন্দিরের দেওয়ালে অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী দেবীর মূর্তি খোদাই করা আছে।

পল্লব রাজাদের সপ্তম শতকে তৈরী মহাবলীপুরম বা মামল্লপুরমের বিখ্যাত অষ্টভুজা মহিষমর্দিনী সিংহের উপর আরূঢ়। মহিষাসুরের মাথা তখনও মানুষের নয়, মহিষের মতোই, তার হাতে গদা ও তরোয়াল। পরে চোল রাজারাও পল্লব রীতির মতোই অষ্টভুজা মূর্তি তৈরী করিয়েছিলেন। কুম্ভকোনমের নাগেশ্বর স্বামী মন্দিরের মূর্তিটি চতুর্ভুজা। দক্ষিণ ভারতের কোনো কোনো দুর্গামূর্তি মৃগবাহিনী।

পূর্বভারত থেকে অসংখ্য অষ্ট অথবা দশভুজা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। ওড়িশাতেও অসংখ্য মূর্তি পাওয়া গেছে। সেই মূর্তিগুলো দ্বিভুজা থেকে ক্রমে সময়ের সঙ্গে দ্বাদশভুজা রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাতেও অনেক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুর জেলায় নবদুর্গা মূর্তি পাওয়া গেছে যেটির মূল মূর্তি অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি। সেই মূর্তিকে কেন্দ্র করে আরও আটটি ছোটো আকারের ষোড়শভুজা মূর্তি রয়েছে। ওই জেলা থেকে বত্রিশ হাতে অসুর নিধন করছেন এরকম একটি দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে। 

ত্রিপুরার দক্ষিণে মহম্মদপুর থেকে একটি দ্বিভুজা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। মানভূমে মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। ঢাকার কাছে দ্বাদশ শতকের দুটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে। প্রাচীন মূর্তিগুলোতে অসুরকে মহিষের চেহারাতেই তৈরী করা হত। দেবীমূর্তি একাই বধ করেন তাকে। পরে দেবীর বাহন রূপে সিংহ যোগ হল। মহিষরূপী অসুরের দেহ থেকে বেরিয়ে আসা মানুষরূপী অসুরকে বধের মূর্তি প্রচলিত হল। আরও পরে বাংলায় শারদীয় দুর্গোৎসবে মাটির দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ মূর্তি যোগ হল।

মহিষমর্দিনী মূর্তি শুধু ভারতেই নয়, ভারতের বাইরেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উজবেকিস্তানের এক জায়গায় ষষ্ঠ শতকের দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে।

হিমাচল প্রদেশের এক প্রাচীন রাজ্যে দেবী দুর্গার উপাসনা

ইরাবতী উপত্যকার উপরের অংশে অযোধ্যা থেকে এসেছিলেন মারু নামে একজন। তিনি এই অঞ্চলের স্থানীয় রাণাদের হারিয়ে ব্রহ্মপুর রাজ্য স্থাপন করেন ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তাঁদের বংশাবলীতে বলা হয়েছে তাঁরা অযোধ্যার সূর্যবংশীয় অর্থাৎ রামের বংশজ। তাঁর অষ্টম উত্তর পুরুষ মেরু বর্মণ লক্ষণা দেবী নামে মহিষাসুরমর্দিনী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানী ব্রহ্মপুরে যা এখনকার ভারমৌর। অষ্টধাতুর তৈরী এই মূর্তির উপরের ডানহাতে ত্রিশূল। মহিষের উপর দাঁড়িয়ে দেবী ত্রিশূল দিয়ে তাকে বধ করছেন। সপ্তম শতকের শেষের দিকে, ৬৮০ থেকে ৭০০ সালের মধ্যে রাজা মেরু বর্মণের আদেশে গুগ্গা নামে ভাস্কর মন্দিরটি কাঠের উপর খোদাই করে তৈরি করেছিলেন।

এই মন্দিরটি প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজাণ্ডার কানিংহাম পরিদর্শন করেন ১৮৮৩‌ সালে।

হিমাচল প্রদেশের মহিষাসুরমর্দিনী মন্দিরের ভাস্কর্য, চিত্রগ্রহণ – রীনা হাজরা

ঐতিহাসিক হাচিসনের মতে এটি সিডার বা দেবদারু গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। বর্তমান পুরোহিতের কথাতে এটি আখরোট গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। মন্দিরে ভিতরে আর বাইরে সূক্ষ্ম কারুকার্য খোদাই করা রয়েছে। দ্বাদশভুজ বিষ্ণু মূর্তি খোদাই করা আছে দরজার অনেকটা উপরে। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে আর ভিতরের  নাটমণ্ডপের অংশে অনেক মূর্তির সঙ্গে মিথুন মূর্তিও খোদাই করা হয়েছিল। এ ছাড়া রয়েছে শিব সহ অন্য দেবতাদের মূর্তি। বাইরে ব্যায়লা বা ইয়ালি অর্থাৎ সিংহাকৃতি প্রহরী মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। এই ব্যায়লা বা ইয়ালি মূর্তি দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত মূর্তি। গর্ভগৃহে অষ্টধাতুর তৈরি চতুর্ভুজা মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। মূর্তির পাদপীঠে গুপ্ত রীতির হরফে সংস্কৃতে নির্মাণ শিল্পী গুগ্গা আর রাজা মেরুবর্মণ ও তাঁর ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষের নামসহ প্রতিষ্ঠার বছর উল্লেখ করা হয়েছে।

অষ্টম শতকে হিমাচলে প্রতিষ্ঠিত হাটকোটি দেবীও শক্তি দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপের দুর্গা মূর্তি।

পৃথিবীর অনেক দেশেই মাতৃকার পূজার কথা আমরা জেনেছি। বৈদিক যুগের আগে থেকেই ভারতের সিন্ধু আর আরও অন্যান্য সভ্যতায় মাতৃকা পূজার প্রচলন ছিল। প্রস্তর যুগেও যে মাতৃকা মূর্তি ছিল তার প্রমাণ ইয়োরোপে পাওয়া পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগের ‘ভেনাস’ মূর্তি। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘হিন্দুদের দেবদেবী : উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ’ বইতেও এর সমর্থন রয়েছে।

কিন্তু শক্তিসাধনা যে ভাবে ভারতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, পৃথিবীর অন্য জায়গায় সেটা দেখা যায় না। শশিভূষণ দাশগুপ্ত তাঁর ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ বইতে এই সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আদিবাসী, বনবাসী সমাজের মধ্যে সব জায়গাতেই প্রচলিত ছিল দেবী পূজা। অধিকাংশ জায়গায় এখনও পর্যন্ত সেই দেবীদের পূজা প্রচলিত রয়েছে। সেই সব দেবীদের উদ্ভব কাহিনী স্থান বিশেষে বিভিন্ন হলেও সকলেই মূলত শক্তি দেবীর প্রকাশ। সেই দেবীরা দুর্গার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন সর্বত্র।

বিভিন্ন পুরাণে ভারতের অসংখ্য জায়গায় দেবীর আলাদা আলাদা অসংখ্য মূর্তি ও নামে পূজার কথা রয়েছে। কিছু এই রকম নাম হল, ‘পুষ্করে সাবিত্রী, বারাণসীতে বিশালাক্ষী, নৈমিষারণ্যে লিঙ্গধারিণী, প্রয়াগে ললিতা দেবী, গন্ধমাদনে কামুকা, মানসে কুমুদা, অম্বরে বিশ্বকায়া, গোমন্তে গোমতী, মন্দরে কামচারিণী, চৈত্ররথবনে মদোৎকটা, হস্তিনাপুরে জয়ন্তী, কান্যকুব্জে গৌরী, মলয়াচলে রম্ভা, একাম্রকাননে কীর্তিমতী, বিল্বেশ্বরে বিল্বা, কর্ণিকপুরে পুরুহস্তা …, এ ছাড়াও আরও অসংখ্য নাম রয়েছে।

পদ্মপুরাণে (১৭/১৮৪-২১১) বিভিন্ন নামে দেবীর এই অসংখ্য নামের তালিকা পাওয়া যায়।

শশিভূষণ দাশগুপ্ত এই তালিকাটি উল্লেখ করেছেন। সময়ের সঙ্গে এইসব শক্তির প্রতিমূর্তি দেবীরা এক হয়ে সনাতনী মহাদেবীরই অংশ বা রূপভেদ হয়ে উঠলেন ।

এর পর থেকে এই রকম প্রাচীন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি ভারতের সব জায়গাতেই পাওয়া গেছে।

প্রচ্ছদ চিত্র পরিচিতি: লক্ষণা দেবীর নিরাবরণ মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, চিত্র গ্রহণ – রীনা হাজরা

তথ্যসূত্র

  • শশিভূষণ দাশগুপ্ত: ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য
  • জিতেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়: পঞ্চোপাসনা
  • নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য: ধর্ম ও সংস্কৃতি, প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট
  • হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য: হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ
  • J. Hutchison, J. Ph. Vogel: History Of the Panjab Hill States in two volumes
লেখকের পড়াশোনা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে। পরবর্তী কালে পঠনপাঠন ও পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাস সম্পর্কে আকর্ষণের ফলে ইতিহাসের আগ্রহী পাঠক ও লেখক। লেখকের ‘সাম্বালা - তন্ত্রের আলোয়’ বই আদি কাল থেকে মানুষের সমাজে ঈশ্বর ও ধর্মভাবনার বিবর্তনের এক তথ্যনির্ভর রচনা। এখনও পর্যন্ত বইটির দুটো খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে আরও কয়েকটি খণ্ড প্রকাশিত হবে। ঐতিহাসিক কাহিনী সঙ্কলনও প্রকাশের অপেক্ষায়।

মন্তব্য তালিকা - “মাতৃকা দেবী থেকে দুর্গা”

  1. সিন্ধু সভ্যতায় কোন পাথরের মুর্তি পাওয়া যায় নি বলেই জানি। যে বৃক্ষ প্রসবীনী নারীর কথা লিখেছেন সেটিও একটি সিয়াটাইটের (সোপ স্টোন জাতীয়) এক দেড় ইঞ্চির সিল বলেই জানি।

    1. ঠিকই বলেছেন। ‘পাথরের দেবী মূর্তিগুলোকে তাঁরা মাতৃকা মূর্তি বলেছেন।’ এই বাক্যটা স্ট্যানজার শেষে দেবার কথা। এডিট করার সময় দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। বাক্যটা হবে পৃথিবীর অনেক জায়গায় পাওয়া পাথরের প্রাচীন দেবী মূর্তিগুলোকে…. হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।