সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সাম্প্রতিক লেখা

বটতলার বই মানেই মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এক ধরনের আদিরসাত্মক রচনার ছাপা, যেগুলো ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে পড়তেন এক সময়ে। হতে পারে ‘বটতলা’ নামটি এসেছে কলকাতার মুদ্রণ যুগের প্রথম পর্বের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে, কিন্তু এই নামের সঙ্গের যে ধারণা, তার মধ্যে মিশে আছে উচ্চধারার সাহিত্যের তাচ্ছিল্যের ধারাবাহিকতা, প্রোপাগান্ডা, এমনকি প্রকাশক বা বিক্রেতার পাঠককে প্রলুব্ধ করার হাতছানিও। বটতলার বই মানেই যে কেবল আদিরসাত্মক নয়, তা বারবার উল্লেখ হয়ে আসছে সেই সুকুমার সেনের সময় থেকে। এমনকি প্যাট্রিক জে. কারনি তাঁর রচিত A History Of Erotic Literature–এ চার শতকের প্রধানত ইংরেজি ও ফরাসি আদিরসের যে সাহিত্যিক নিদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে দেখা যায় বটতলার ছাপার তুলনায় এলিট সাহিত্যের সংখ্যা এক্ষেত্রে অনেক বেশি। তবুও মধ্যবিত্ত বাঙালি পাঠকের কাছে বটতলার বিষয়গত চরিত্র সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
'একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয় একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।' ছেলেবেলায় দুলে দুলে যখন এই দুই ছত্র মুখস্ত করতাম, তখন তার ইতিহাস-ভূগোল নিয়ে প্রশ্ন করার বয়স হয়নি। মনেই আসেনি কে বিজয়, আর অর্ণবপোতই বা কী। পরিণত বয়সে তত্ত্ব তল্লাশ করে জানলাম খ্রিস্ট জন্মের প্রায় পাঁচশো বছর আগের বাংলার (নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকবে— ভৌগোলিক সীমারেখার আন্দাজ দিতে নামটি ‘বাংলা’ লিখলাম) রাঢ় অঞ্চলের অধিপতি সিংহবাহু আর তার আপন বোন সিংহসিবলির দাম্পত্যজাত বত্রিশ পুত্রের সবচেয়ে বড়োটির নাম ছিল বিজয় সিংহ। তার জন্মের পর বাকি একত্রিশটি সন্তানের উৎপাদনে ব্যস্ত বাবা মা বিজয়ের কোনো দেখভাল করতে না পারায় এক নিখুঁত লম্পট হয়ে ওঠে সে। তার সপারিষদ উৎপাতে অতিষ্ঠ প্রজাদের উপর্যুপরি অভিযোগে বিরক্ত হয়ে একসময় সিংহবাহু তাকে দেশান্তরী হবার আদেশ দেন।
প্রতিবেশী দেশগুলোর অতীত সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা থাকে না। যেটুকু সামান্য জানার উৎসাহ জাগে তা কেবল আমাদের দেশের সাথে, আমাদের গৌরবজনক সংযোগ সূত্রগুলো ঘিরেই। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর ইউরোপীয় অধীনতার কবল থেকে স্বাধীন হবার পরেই কেবল তাদের নিজেদের অতীত জানার আগ্রহ দেখা দিতে শুরু করে। এই আগ্রহের পেছনে তাগাদা ছিল ইউরোপীয় ধাঁচে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য আপন আপন জাত্যাভিমানের সৃষ্টি করা। ইউরোপীয় ভাবধারায় জাতি-রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রয়োজন প্রতিটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের নিজস্ব জাতি পরিচয় সৃষ্টি করা ও তাকে সুদৃঢ় জাতিসত্তায় পরিবর্তিত করা। এই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার থেকেই নবীন রাষ্ট্রগুলো তাদের ইতিহাস চর্চার প্রয়োজন অনুভব করে।