সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

প্রসঙ্গ শান্তিনিকেতন: কিছু কথা

প্রসঙ্গ শান্তিনিকেতন: কিছু কথা

শিবাশীষ বসু

মে ১৫, ২০২১ ১৮১৭ 1

আরম্ভ করা যাক শান্তিনিকেতনের আদি যুগের একটি কাহিনী দিয়ে। ব্রহ্মাচর্যাশ্রমের প্রথম দিকের ছাত্ররা সকলেই দেখেছেন লিকলিকে রোগা, দন্তহীন, গালে-টোপ-খাওয়া এক বৃদ্ধকে। আশ্রমের রূপ ও বিকাশ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজে যাঁর সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “আশ্রমের রক্ষী ছিল বৃদ্ধ দ্বারী সর্দার, ঋজু দীর্ঘ প্রাণসার দেহ। হাতে তার লম্বা পাকাবাঁশের লাঠি, প্রথম বয়সের দস্যুবৃত্তির শেষ নিদর্শন।” কেবলমাত্র রক্ষীর কাজই নয়, খাটো ধুতির উপর চামড়ার কোমরবন্ধ পরে খালি গায়ে লাঠি হাতে তিনি শান্তিনিকেতন আর বোলপুর যাতায়াত করতেন দিনে দু’বার করে। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর ডাকহরকরাও। সবাই তাঁকে সর্দার বলে ডাকতেন। তাঁর জীবনের গল্প শুনিয়েছেন সুধীরঞ্জন দাস। সে গল্পের কতোটা ইতিহাস আর কতোটাই বা কিংবদন্তি, তা বোধহয় আজ আর কেউ বলতে পারবেন না।

আজকে যেখানে জমজমাট বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, আজ থেকে একশো ষাট বছর আগে সে অঞ্চলটি ছিল বাস্তবিক অর্থেই তেপান্তরের মাঠ। চারিদিক ধু ধু করছে মাঠ, মাঝখানে দুটি ছাতিম গাছ। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, “সেই প্রান্তরে দুটি মাত্র ছাতিম বা সপ্তপর্ণী গাছ ও বন্য খর্জুর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়িত না।” স্থানটি ভয়েরও ছিল। ডাকাতের ভয়। দেবেন্দ্রনাথের জীবনীকার অজিতকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন, “শান্তিনিকেতনের সামনে ভুবনডাঙা গ্রাম, সে গ্রামে থাকিত এক ডাকাতের দল। বোলপুর হইতে নানা গ্রামে গ্রামে পথ গিয়াছে, পথের মধ্যে এই বিশাল প্রান্তর, চারি দিক জনশুন্য। ডাকাতির পক্ষে এমন উপযুক্ত জায়গা আর হইতে পারে না। কত লোককে যে তাহারা খুন করিয়া ঐ ছাতিম গাছের তলায় তাহাদিগের মৃতদেহ পুঁতিয়া রাখিয়াছিল, তাহার ঠিকানা নাই।” প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের নাম থেকেই এই ভুবনডাঙা গ্রাম।

আমাদের গল্পের এই ডাকহরকরাই নাকি ছিল সেই ডাকাতদলের সর্দার। ওই ছাতিমতলাতেই তারা সন্ধ্যাবেলা এসে ঘাপটি মেরে বসতো। বোলপুর থেকে গোয়ালপাড়া পেরিয়ে যে সব যাত্রীরা সিউড়ির দিকে যেত, তারা হত এই ডাকাতদলের শিকার। লুঠের টাকা ও মালপত্র সর্দার দলের সকলকে সমানভাবে ভাগ করে দিত। আবার দলের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে তার চরম শাস্তিরও ব্যবস্থা ছিল, শোনা যায় সর্দার এই ব্যাপারে তার জামাইকেও রেয়াত করে নি। এমন করেই দিন যায়, মাস যায়। এর পরের অংশ সরাসরি সুধীরঞ্জনের মুখ থেকে শুনুন। “একদিন সন্ধ্যার সময় সর্দার বের হল তার সাঙ্গপাঙ্গ সমভিব্যাহারে শিকার করতে। ছাতিমতলায় এসে দেখে এক প্রৌঢ় বয়সের লোক হাত জোড় করে বসে রয়েছেন গাছের তলায় জোড়সন কেটে পশ্চিমদিক-পানে চেয়ে। ধবধবে ফরসা তাঁর গায়ের রঙ। মুখ ভরা তাঁর দাড়ি, পরনে লম্বা জোব্বা। সর্দার ও তার চেলাচামুণ্ডারা ভাবলে যে আজকে একটা ভারী শিকার তাদের বরাতে জুটেছে এবং দিনকতক স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। লম্ফ দিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল সবাই – ‘হারে রে রে রে রে।’ লোকটি একবার চোখ খুলে বললেন, ‘তোমরা ক্ষণকাল অপেক্ষা করো, আমার প্রার্থনা শেষ হয়নি – শেষ হলে যা ইচ্ছে কোরো।’ শুনে সাঙ্গপাঙ্গরা হেসে উঠল। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সর্দারের দিকে চেয়ে। সর্দারের মুখচোখের ভাবই যেন বদলে গিয়েছে। স্তিমিতনেত্র সাধকের সৌম্য মুখচ্ছবি সর্দারের চোখে নাকি অনির্বচনীয় মহিমায় উদভাসিত হয়ে উঠল – সর্দার চেয়েই আছে। দেখে দেখে সে বিহ্বল হয়ে পড়ল। নিজের জামাইকে গুম করেও যার চক্ষের পলক পড়েনি, সেই সর্দারের চোখ নাকি জলে ভরে এল। অবশ্যমৃত্যুর সম্মুখে মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মানুষ যে সমাহিত চিত্তে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে পারে এ দৃশ্য সর্দার তো কখনো দেখেনি – এ ধারণা তার মনের ত্রিসীমানায় কখনো আসেনি। সমস্ত মনপ্রাণ তার লুটিয়ে পড়লো সেই ধ্যানরত সাধু পুরুষটির পায়ে। সর্দারের ইশারায় তার দলের লোকেরা চলে গেল খানিকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও। সর্দার বসে রইল হাত জোড় করে সেই মহাপুরুষের মুখের দিকে চেয়ে। উপাসনান্তে সাধক চাইলেন সর্দারের পানে। কি করুণাই ভরে উঠেছিল সেই ক্ষমাসুন্দর চক্ষের চাহনিতে যা সর্দারের উত্তপ্ত মনকে শীতল করে দিয়েছিল তার অজানিতে। মস্তক তার অবনত হয়ে পড়ল সেই সিদ্ধপুরুষের চরণে। লুন্ঠিত হয়ে প্রণাম করে সর্দার তার কাছে আশ্রয় ভিক্ষা চাইল। সাধক তার মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ করলেন। ধ্যাননিমগ্ন সাধু পুরুষটি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ।” অজিতকুমার লিখেছেন, “দেবেন্দ্রনাথের কাছে সেই ডাকাতের সর্দার ধরা দিল ; ডাকাতি ব্যবসায় ছাড়িয়া তাঁহার সেবায় আপনাকে নিযুক্ত করিল। যে জায়গা ছিল বিষম ভয়ের জায়গা, তাহাই হইল পরম আশ্রয়ের জায়গা – আশ্রম।”

শান্তিনিকেতনের প্রথমদিকের আশ্রমবাসী অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এই কিংবদন্তি বা কাহিনীকে গল্পকথা বলে প্রায় উড়িয়েই দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “মহর্ষির অবস্থিতিকালে শান্তিনিকেতনে একবার ডাকাতি হয়। এজন্য তিনি দস্যুদলের অবস্থাভিজ্ঞ একজন উপযুক্ত দারোয়ান অনুসন্ধান করিতে থাকেন। শুনিয়াছি মানকরের জমিদার বাবু হিতলাল মিশ্র একজন দীর্ঘদেহ বলিষ্ঠ লাঠিয়ালকে মহর্ষির নিকট পাঠাইয়া দেন। ইহার নাম দ্বারিক সর্দ্দার। দ্বারিক সর্দ্দার এই কর্ম্মসূত্রে মানকর হইতে আসিয়া ভুবনডাঙায় বাসস্থাপন করিয়াছিল। বার্দ্ধক্য অবস্থাতেও এই ব্যক্তি বহুদিন পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের কার্য্যে নিযুক্ত ছিল। … তেতাল্লিশ বছর পূর্ব্বে আমি বোলপুরে বাস করিতাম, (অঘোরবাবুর পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ফুটনোটে লিখেছেন, পিতৃদেব ১২৯০ বঙ্গাব্দে বোলপুরে আসেন) ভুবনডাঙার ন্যায় ক্ষুদ্র পল্লিতে ডাকাইতদলের বাস ছিল শুনি নাই। … আর দ্বারিক সর্দ্দার ‘ডাকাতের দলের সর্দ্দার’ রূপে ধরা দেয় নাই, চাকরী করিতে আসিয়া ভুবনডাঙায় বাদ করিয়াছিল। সুতরাং অজিতবাবুর উক্তি ভ্রমাত্মক। জ্ঞানেন্দ্রনাথ ফুটনোটে আরও লিখেছেন, “অনুসন্ধানে জানা যায় যে দ্বারিক সর্দ্দার পূর্ব্বে বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত সোনামুখি নামক প্রসিদ্ধ গ্রামের লোক ছিল। মানকরের জমিদার বাড়িতে সর্দ্দার কাজ করিত। … এ পরিবারের কেউ ডাকাত ছিল এরূপ শোনা যায় না।” সব মিলিয়ে যা দাঁড়ালো তা হল, অতীতের বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে কিছু তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতার গল্পককাহিনী প্রবেশ করিয়ে যতক্ষণ  আমরা তাঁদের মহামানব না বানিয়ে উঠতে পারছি, ততক্ষণ আমরা ক্ষান্ত হই না!

১৮ই ফাল্গুন, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ, রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন মাত্র দুই বছরও হয়নি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার প্রতাপনারায়ণ সিংহের থেকে বোলপুরের নিকটবর্তী ভুবনডাঙা গ্রামের বাঁধ সংলগ্ন কুড়ি বিঘে জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসী-স্বত্ব গ্রহণ করে ফেললেন। এইখানে প্রশ্ন জাগে, কলকাতা হতে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বীরভূম জেলার এই গ্রামটির সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের যোগাযোগ হল কি করে? উত্তর হল, দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের নানা স্থানে ভ্রমণ করতেন এবং বহু ধনী-মানী ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম রায়পুরের সিংহরা ছিলেন ওই অঞ্চলের একটি গণ্যমান্য পরিবার। তখনই রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের পরিচয় হয়। প্রতাপনারায়ণ ছিলে এই ভুবনবাবুরই জ্যেষ্ঠ পু্ত্র। রবি-জীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, “শোনা যায়, প্রতাপনারায়ণ দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করতেন এবং তখনই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন।” এখন ওই বিশেষ স্থানটির প্রতি দেবেন্দ্রনাথের আকর্ষণ কিভাবে জন্মালো তা আমাদের জানিয়েছেন অজিতকুমার চক্রবর্তী, তাঁর সুবৃহৎ ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে। “রায়পুরের সিংহ-পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুতা ছিল। একদিন সেখানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে যাইবার সময় বোলপুর স্টেশন হইতে রায়পুরের পথে শান্তিনিকেতনের দিগন্তপ্রসারিত প্রান্তরে যুগল সপ্তপর্ণচ্ছায়ায় তিনি ক্ষণকালের মতো দাঁড়াইলেন। সমস্ত প্রান্তরের মধ্যে তখন ঐ দুটি মাত্র গাছ ছিল ; চারি দিকে অবারিত তরঙ্গায়িত ধুসর মাঠ, তাহার কোনো জায়গায় সবুজ রঙের আভাস মাত্র নাই। শুধু দূর দিকচক্রবালে একশ্রেণী ঋজু তালগাছ ধ্যানমগ্ন মহাদেবের তপোবনপ্রান্তে স্তব্ধ পাহারার মতো দাঁড়াইয়া আছে। যতদূর দৃষ্টি যায় কোনো বাধা নাই। কিছুই দেখিবার নাই। উপরে অনন্ত আকাশ, নীচে এই স্থলসমুদ্র। এই জায়গাটি হঠাৎ তাঁহার মনকে টানিল। তার পর হইতে ঐ ছাতিম গাছের তলায় মাঝে মাঝে তাঁহার তাঁবু পড়িতে লাগিল।” মোটামুটিভাবে একই বক্তব্য প্রথম দিকের আশ্রমিক অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়েরও, “রায়পুর যাতায়াত করিবার সময় এই দিগন্তপ্রসারিত প্রান্তরের অপূর্ব্ব গাম্ভীর্য্যে মহর্ষির চিত্ত আকৃষ্ট হয়। এই বিশাল প্রান্তরে দৃষ্টি অবারিত, অনন্ত আকাশ ব্যতীত দিগ্বলয়ে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। অনন্তস্বরূপের এই উদাত্ত সৌন্দর্য্যে তাঁহার হৃদয়মন প্লাবিত হইল, উন্মুক্ত আকাশতলে এই নির্জন প্রান্তর তপস্যার একান্ত অনুকুল বলিয়া তাঁহার ধারণা হইল।”১০ 

এখানেও আমরা দেখতে পাবো যে, কিংবদন্তি-কাহিনী-বাস্তব সব মিলেমিশে একাকার। আরেক রবি জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে দেবেন্দ্রনাথ ঠিক কোনখান থেকে কোনখানে যাওয়ার সময় এই সুবিশাল প্রান্তরের দর্শন পেয়ে অভিভুত হয়েছিলেন, তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত আছে। প্রভাতকুমার লিখেছেন, “হিমালয় হইতে নামিয়া আসিবার পর দেবেন্দ্রনাথ রায়পুর আসেন; আমাদের মনে হয় নৌকাযোগে ভাগীরথী দিয়া কাটোয়া হইতে গুনুটিয়ার ঘাটে নামেন ও সেখান হইতে পালকী-পথে রায়পুর আসেন। চীপ সাহেব নির্মিত সুরুল-গুনুটিয়া রাস্তার পাশেই বর্তমান শান্তিনিকেতন ও ছাতিম গাছদুটি পড়ে। বোলপুর স্টেশন হইতে রায়পুর যাইতে শান্তিনিকেতন পথে পড়ে না।”১১ আর এক আশ্রমিক প্রমথনাথ বিশীও এই বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন, “বোলপুর স্টেশন হইতে রায়পুর যাইবার পাকা সড়ক আছে – এই সড়ক ধরিয়া রায়পুর গেলে পথে শান্তিনিকেতনের মাঠ পড়িবার কথা নয়। তবে মহর্ষির পথে এই মাঠ পড়িল কেমন করিয়া? আমার বিশ্বাস, কোনো একবার পশ্চিম হইতে ফিরিবার সময়ে মহর্ষি আমদপুর স্টেশনে নামিয়া রায়পুর যাইতেছিলেন। সিউড়ি হইতে বোলপুর যাইবার যে সড়ক আছে আমদপুর স্টেশনে নামিয়া তাহা ধরিয়া বোলপুর হইয়া রায়পুর যাওয়া যায়। এই পথ ধরিয়া চলিলে পথে শান্তিনিকেতনের মাঠ অতিক্রম করিতে হয়।”১২

সমস্যার সমাধানের জন্য এক্ষেত্রেও আমি স্মরণ নিতে চাই অঘোরনাথ-পুত্র জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের। পিতৃদেবের বই সম্পাদনা করবার সময়, ফুটনোটে তিনি লিখেছেন, “মহর্ষিদেব কোন সুযোগে এবং কখন এ-স্থানটি আবিস্কার করলেন সে-সম্বন্ধে অনেক প্রকারের কথা প্রচারিত হয়েছে। তিনি আহম্মদপুর রেল স্টেশন হইতে পালকিতে বোলপুরে আসছিলেন এবং তখন এই স্থান দেখে পছন্দ করেন, এরূপ কথা বলা হয়েছে। তিনি কখন কি কারণে এপথে পালকিতে আসছিলেন সে-কথা কেউ বলেন না। এ-কথার ভিত্তি কি তাও জানা যায় না। রেলপথ হওয়ার পর তিনি কেন আহম্মদপুর হতে বোলপুর পালকিতে আসবেন? তখনকার দিনে এ-সকল অঞ্চলে গরুর গাড়ী এবং পালকি ভিন্ন আর কোনো বাহন ছিল না। মহর্ষিদেব এ-স্থান লওয়ার আগে অবশ্যই পালকিতে ঘুরে দেখেছেন ও পরে পছন্দ করেছেন বলে মনে হয়। এই হতে পালকির কথা ওটা বিচিত্র নয়। মহর্ষিদেবের জীবনচরিতকার অজিতবাবু লিখেছেন, তিনি বোলপুর হতে রায়পুরের পথে এ-স্থান দেখেন। জায়গাটি সে-দিকেই নয়, ঠিক উল্টো দিকে। (একই কথা প্রভাতকুমার ও প্রমথনাথও বলেছেন) গুরুদেবের জীবনচরিত-লেখক শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, মহর্ষিদেব রায়পুরে যাচ্ছিলেন সুরুলের পথে। কেন ঘুর পথে যাচ্ছিলেন তা বলেন নাই। আর তা হলেও বাঁধগোড়ার রাস্তা থেকে এ-স্থান কতটুকু দেখা যায় তাও বিবেচনার বিষয়। ভুবনবাবুর নিমন্ত্রণে মহর্ষিদেব ১২৬৮ সালে মাসখানেকের ব্যবধানে দুবার রায়পুরে আসেন এবং পরের বছর শান্তিনিকেতনের জমির পাট্টা নেন। পাট্টার তারিখ ১৮ই ফাল্গুন, ১২৬৯ সাল। এই তথ্যগুলির উপর নির্ভর করে বলা যেতে পারে যে ভুবনবাবু এ-স্থানটি তাঁকে দেখান। পূর্ব্বেই বলেছি সে-সময়ে মহর্ষিদেবের পালকিতে ঘোরাফেরা করাই সম্ভব। পাট্টা লওয়া হয়েছিল মহর্ষিদেবের রায়পুরে আসার এক বছর পরে ভুবনবাবুর পুত্রদের কাছ থেকে। সুতরাং তাঁর আগমন ও পাট্টা লওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে ভুবনবাবু পরলোকগমন করেছিলেন এরূপ অনুমান করতে হয়।১৩ 

এই ক্ষেত্রেও সব দিক বিচার করে জ্ঞানেন্দ্রনাথের অনুমানই সঠিক বলে মনে করা যায়। প্রশান্তকুমার পালও তাই মনে করেন। যাইহোক, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এই আকর্ষণের পরিণতিতে ৩১শে মার্চ, ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে জমি হস্তান্তরের দলিল রেজিস্ট্রি হল। ভুবনডাঙা গ্রামের পার্শ্ববর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মালিক হয়ে বসলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রথমদিকে দেবেন্দ্রনাথ বছরে একআধবার ভুবনডাঙার পার্শ্ববর্তী এই নির্জন প্রান্তরে এসে ছাতিমগাছের নিচে তাঁবু খাটিয়ে উপাসনা করতেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই এখানে স্থ‍ায়ী একটি বাসস্থান নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ক্রমে ক্রমে বহু অর্থ ব্যয়ে প্রথমে একতলা, পরে দোতলা বাড়ি তৈরি করা হল। বাড়ির সঙ্গে একটি বাগান ও পুকুরেরও প্রয়োজন, কিন্তু এই অনুর্বর প্রান্তরে বাগান তৈরি করা বড়োই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। জমির কাঁকরযুক্ত মাটি তুলে ফেলে, সেই জায়গায় উর্বর মাটি এনে ফেলতে হয়েছিল। একটি সুবিশাল পুকুর খনন করতেও প্রচুর টাকা খরচ হয়। পুকুর থেকে তুলে আনা কাঁকরময় মাটি স্তুপীকৃত হতে হতে একটি ছোটখাটো পাহাড়ের আকার নিল, কিন্তু সে পুকুরে জল এল না। ছাতিমগাছের তলায় একটি বেদী তৈরি হল, উপাসনার জন্য। অবশেষে “আম জাম নারিকেল কাঁঠাল আমলকী শাল দেবদারু বকুল কদম্ব প্রভৃতি বিবিধ ফলবান ও ছায়াতরুসকল রোপিত হইল, নানাজাতীয় পুষ্পসম্ভারে প্রস্ফুটিত মালতী ও মাধবীর লতাবিতানে কঙ্করময় উষরভূমি পরমশোভাময় হইয়া উঠিল। মহর্ষি এই পরম রমণীয় উদ্যানবাটিকার নাম দিলেন ‘শান্তিনিকেতন’।”১৪ উষর মরুভূমির মধ্যে ফুটলো ফুল, নামলো ছায়া, পাখির কলকাকলিতেতে ভরে উঠলো এই মরুদ্যান। 

১৮৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। একাদশবর্ষীয় রবীন্দ্রনাথের সদ্য উপনয়ন হয়েছে। পিতা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে হিমালয়ের পথে পাড়ি দিলেন বালক। পথে কদিনের জন্য অবস্থান করলেন শান্তিনিকেতনে। কবির প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শন। ‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “গাড়ি ছুটিয়া চলিল ; তরুশ্রেণীর সবুজ নীল পাড়-দেওয়া বিস্তীর্ণ মাঠ এবং ছায়াচ্ছন্ন গ্রামগুলি রেলগাড়ির দুই ধারে দুই ছবির ঝরনার মতো বেগে ছুটিতে লাগিল, যেন মরীচিকার বন্যা বহিয়া চলিয়াছে। সন্ধ্যার সময় বোলপুরে পৌঁছিলাম। পালকিতে চড়িয়া চোখ বুজিলাম। একেবারে কাল সকালবেলায় বোলপুরের সমস্ত বিস্ময় আমার জাগ্রত চোখের সম্মুখে খুলিয়া যাইবে, এই আমার ইচ্ছা – সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্যে কিছু কিছু আভাস যদি পাই তবে কালকের অখণ্ড আনন্দের রসভঙ্গ হইবে। ভোরে উঠিয়া বুক দুরুদুরু করিতে করিতে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। … ব্যাকুল হইয়া চারি দিকে চাহিলাম। হায় রে, মরুপ্রান্তরের মধ্যে কোথায় ধানের খেত। রাখালবালক হয়তো-বা মাঠের কোথাও ছিল, কিন্তু তাহাদিগকে বিশেষ করিয়া রাখালবালক বলিয়া চিনিবার কোনো উপায় ছিল না। যাহা দেখিলাম না তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না – যাহা দেখিলাম তাহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্‌চক্রবালে একটিমাত্র নীল রেখার গণ্ডি আঁকিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না।”১৫

শান্তিনিকেতনে সকালবেলা পিতার কাছে কিছুক্ষণ ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়বার পর বালক রবির মিলত নিরবিচ্ছিন্ন অবাধ ছুটি। অনুমান করা যায়, প্রকৃতির সঙ্গে এই ধারাবাহিক মিলনই তাঁর কবিত্বশক্তির বিকাশে সহায়ক হয়ে উঠেছিল। ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধে তিনি নিজেই বলেছেন,  “শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি। উপনয়ন-অনুষ্ঠানে ভূভুর্বঃস্বলোর্কের মধ্যে চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করবার যে দীক্ষা পেয়েছিলেম পিতৃদেবের কাছ থেকে, এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেয়েছিলেম সেই দীক্ষাই। আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত। পিতৃদেব কোনো নিষেধ বা শাসন দিয়ে আমাকে বেষ্টন করেন নি।”১৬ বয়সে নিতান্ত ছোটো হলেও পিতা দেবেন্দ্রনাথ বালক রবিকে প্রকৃতির মধ্যে যথেচ্ছ ভ্রমণের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।  বোলপুরের দিগন্তবিস্তৃত মাঠের মধ্যে জায়গায় জায়গায় বর্ষার জলধারায় কাঁকুরে বালিমাটি ক্ষয়ে গিয়ে লাল কাঁকর ও রকমারি পাথরে খচিত ছোটো ছোটো জলভরা গহ্বর তৈরি হত। ওখানকার ভাষায় এগুলিকে খোয়াই বলে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “কাঁকুরে জমির মধ্যে দিয়ে বর্ষার জলধারার আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু খোদাই পথ, সে ছিল নানা জাতের নানা আকৃতির পাথরে পরিকীর্ণ; কোনোটাতে শির-কাটা পাতার ছাপ, কোনোটা লম্বা আঁশওয়ালা কাঠের টুকরোর মতো, কোনোটা স্ফটিকের দানা সাজানো, কোনোটা অগ্নিগলিত মসৃণ।”১৭ ওই খোয়াই থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রতিদিনই নানা প্রকারের পাথর সংগ্রহ করিয়া পিতার কাছে উপস্থিত করতেন।  দেবেন্দ্রনাথ কখনও রবির অধ্যবসায়কে তুচ্ছ করেননি বরং উৎসাহ দিয়ে বলতেন, “ঐ পাথর দিয়া আমার এই পাহাড়টা তুমি সাজাইয়া দাও।”১৮ একটা পুকুর খোঁড়বার ব্যর্থ চেষ্টায় পাহাড়ের অনুকরণে একটি মাটির ঢিবি তৈরি হওয়ার কথা আগেই জানিয়েছি। সেখানে প্রতিদিন সকাল দেবেন্দ্রনাথ চৌকি নিয়ে উপাসনায় বসতেন। স্তুপটি শান্তিনিকেতনের পূর্ব দিকে। সেই স্তুপ বা পাহাড়টাই পাথর দিয়ে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি পুত্রকে উৎসাহ দিলেন।

শান্তিনিকেতনের কথা লিখতে গিয়ে একটি অতি প্রাসঙ্গিক কথা মনে এল। অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, শান্তিনিকেতনের এই উদ্যানবাটিকার “চারিদিকের সীমানায় শাল সেগুন মহুয়া কেন্দ্ (আবলুস) প্রভৃতি তরুশ্রেণী রোপণ করা হয়, কিন্তু বেড়া দিয়ে গণ্ডীবদ্ধ করা হয় নাই। ‘সত্যংজ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম’ যেমন সকলের অধিগম্য, এই শান্তিনিকেতনও সেইরূপ সকল মানবের অধিগম্য …”১৯ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের এই ছিল ইচ্ছা। রবীন্দ্রনাথেরও কি সেইরকম ইচ্ছাই ছিল না?

কাল এবং বয়সের প্রভাবে দেবেন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে যাতায়াত ক্রমেই অনিয়মিত হয়ে উঠলো। ১২৯০ বঙ্গাব্দের পরে তিনি শান্তিনিকেতনে আর কখনওই যাননি বলেই জানা যায়। স্বভাবতই পরিচর্যা ও মেরামতির অভাবে শান্তিনিকেতন ক্রমেই শ্রীহীন হয়ে উঠছিল। ১২৯০ বঙ্গাব্দের জ্যেষ্ঠ মাসে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় শান্তিনিকেতন গিয়ে আক্ষেপ করে বলছেন, “দেখিলাম প্রকাণ্ড প্রাসাদ মেরামতের অভাবে শ্রীভ্রষ্ট, আসবাব-পত্রও যৎসামান্য, উদ্যানের বৃক্ষলতাদি যত্নের অভাবে অধিকাংশই শুষ্ক ও শ্রীহীন এবং আশ্রম প্রাঙ্গণ শুষ্ক বৃক্ষপত্র ও আবর্জ্জনাতে পরিপূর্ণ। …আশ্রমের বর্ত্তমান দুরবস্থা দেখিয়া প্রাণে বড়ই ক্লেশ হইত।”২০

অঘোরনাথের গ্রন্থ থেকে জানতে পারি, ইতিমধ্যে বোলপুরের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম মিলে শশীভুষণ মুখোপাধ্যায়ের গৃহে সাধারণভাবে ধর্ম আলোচনার জন্য ‘বোলপুর প্রার্থনা সমাজ’ স্থাপন করলেন। এখানে প্রতি শুক্রবার নিয়মিতভাবে উপাসনা করা হত। অঘোরনাথ উদ্যোগ নিয়ে এই প্রার্থনা সমাজের প্রথম বার্ষিক অধিবেশনের আয়োজন করলেন শান্তিনিকেতনে ১২৯১ বঙ্গাব্দের ১৭-১৯ কার্তিক। দেবেন্দ্রনাথ অথবা ঠাকুরবাড়ির কারুর সঙ্গে তাঁদের পরিচিতি ছিল না, কিন্তু শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মোৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এই সংবাদ পেলে মহর্ষিদেব খুশি হবেন এই আশায় কারুর অনুমতি না নিয়েই তাঁরা উৎসবের আয়োজন করেন। ‘তত্ত্বকৌমুদী’ পত্রিকার ১ অগ্রহায়ণ, ১৮০৬ শকাব্দ সংখ্যায় এই উৎসবের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশিত হয়। ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ১৮-২১ বৈশাখ সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনের আয়োজনও শান্তিনিকেতনেই করেন তাঁরা। এবারে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন কলকাতার বিশিষ্ট ব্রাহ্ম শিবনাথ শাস্ত্রী।

১২৯৪ বঙ্গাব্দে বোলপুরের আরেকজন বিশিষ্ট ব্রাহ্ম রামনাথ সামন্ত মহাশয় বোলপুর প্রার্থনা সমাজের কথা, শান্তিনিকেতনে তাঁদের উৎসব-উপাসনার কথা এবং সর্বোপরি শান্তিনিকেতনের তৎকালীন দুরবস্থায় অঘোরনাথের মানসিক ক্লেশের কথা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নিকট নিবেদন করেন। দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে অঘোরনাথকে সাক্ষাতের জন্য আহ্বান করলে ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ৩২শে শ্রাবণ অঘোরনাথ মহর্ষির সঙ্গে দেখা করলেন। মনে হয়, এই ঘটনাই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনে একটি সাধন আশ্রম প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্বুদ্ধ করলো। এই উদ্দেশ্যে তিনি ২৭ ফাল্গুন, ১২৯৪ বঙ্গাব্দে (৮ই মার্চ, ১৮৮৮) দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায় এবং প্রিয়নাথ শাস্ত্রীকে ট্রাস্টি নিযুক্ত করে একটি ট্রাস্ট-ডিড সম্পাদন করে শান্তিনিকেতনের অট্টালিকা সংলগ্ন জমি উৎসর্গ করেন এবং নিজ জমিদারির কিছু অংশ শান্তিনিকেতনের ব্যয় নির্বাহের জন্য দেবত্ব করে দেন। তিনি আনুমানিক ১৮৪৫২ টাকা মুল্যের সম্পত্তি দান করেন, যার মধ্যে শিলাইদহের নীলকুঠি এবং মিনসেৎপুর, ভরতিপাড়া ও গালিমপুরের রেশমকুঠি ছিল।

ওই ডিডে কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দেওয়া হয়েছিল যার কয়েকটি আমি সংক্ষেপ বিবৃত করছি, পাঠকপাঠিকাগণ একটু মন দিয়ে পড়বেন – “উক্ত সম্পত্তি চিরকাল কেবল নিরাকার একব্রহ্মের উপাসনার জন্য ব্যবহৃত হইবে। … নিরাকার একব্রহ্মের উপাসনা ব্যতীত কোনো সম্প্রদায়বিশেষের অভীষ্ট দেবতা বা পশু পক্ষী মনুষ্যের মূর্তির বা চিত্রের বা কোনো চিহ্নের পূজা বা হোমযজ্ঞাদি ঐ শান্তিনিকেতনে হইবে না। ধর্মানুষ্ঠান বা খাদ্যের জন্য জীবহিংসা বা মাংস-আনয়ন বা আমিষভোজন বা মদ্যপান ঐ স্থানে হইতে পারিবে না। কোনো ধর্ম বা মনুষ্যের উপাস্য দেবতার কোনো প্রকার নিন্দা বা অবমাননা ঐ স্থ‍নে হইবে না। … কোনোপ্রকার অপবিত্র আমোদপ্রমোদ হইবে না। ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাস্টীগণ বর্ষে বর্ষে একটি মেলা বসাইবার চেষ্টা ও উদ্যোগ করিবেন। এই মেলাতে সকল ধর্মসম্প্রদায়ের সাধুপুরুষরা আসিয়া ধর্মবিচার ও ধর্মালাপ করিতে পারিবেন। এই মেলার উৎসবে কোনোপ্রকার পৌত্তলিক আরাধনা হইবে না ও কুৎসিত আমোদ-উল্লাস হইতে পারিবে না ; মদ্য মাংস ব্যতীত এই মেলায় সর্বপ্রকার দ্রব্যাদি খরিদ-বিক্রয় হইতে পারিবে। … এই ট্রাস্টের উদ্দিষ্ট আশ্রমধর্মের উন্নতির জন্য ট্রাস্টীগণ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় ও পুস্তকালয় সংস্থাপন, অতিথিসৎকার ও তজ্জন্য আবশ্যক হইলে উপযুক্ত গৃহ নির্মাণ ও স্থাবর অস্থাবর বস্তু ক্রয় করিয়া দিবেন এবং ঐ আশ্রমধর্মের উন্নতির বিধায়ক সকলপ্রকার কর্ম করিতে পারিবেন। … শান্তিনিকেতনের কার্য নির্বাহের নিমিত্ত তথায় একজন উপযুক্ত সচ্চরিত্র জ্ঞানী ও ধার্মিক ব্যক্তিকে আশ্রমধারী নিযুক্ত করিবেন এবং প্রয়োজন হইলে তাঁহাকে পরিবর্তন করিতে পারিবেন।”২১ ট্রাস্ট-ডিডের নির্দেশানুসারে দেবপ্রতিপালক বাবাজি প্রথম আশ্রমধারী নিযুক্ত হন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আশ্রম ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। এরপর ১২৯৫ বঙ্গাব্দ থেকে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ আট বছরের জন্য আশ্রমধারী ছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তিনজন অছি বা ট্রাস্টির মধ্যে রমণীমোহন বাবু ১৬ শ্রাবণ ১২৯৬ (৩১ জুলাই ১৮৮৯) তাঁর দ্বায়িত্বভার ত্যাগ করলে শুন্যপদে রবীন্দ্রনাথকে নিয়োগ করা হল।

দেবেন্দ্রনাথের আশা ছিল শান্তিনিকেতন নির্জন সাধনকামীদের আশ্রম হবে। এই উপলক্ষে পরের বছর কার্তিকমাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতা থেকে একটি বিরাট দল শান্তিনিকেতনে যান। এই দলে ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, নীরদনাথ মুখোপাধ্যায়, ডাঃ বিপিনচন্দ্র কোঙার, অক্ষয়কুমার মজুমদার, মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদিরা। ৪ কার্তিক শুক্রবার (১৯ অক্টোবর ১৮৮৮) অপরাহ্ন চারটের সময়ে একটি সভার আয়োজন করা হল। রবীন্দ্রনাথ ও মোহিনীমোহন সভায় আচার্যের কাজ করেছিলেন। বোলপুর, রায়পুর ও সুরুল হতে প্রায় শ-দুয়েক লোক এই সভায় যোগদান করেন। সভায় শান্তিনিকেতনের আশ্রম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

এতদিন এই আশ্রমে কোনো মন্দির না থাকায় উপাসনা করবার যথেষ্ট সমস্যা হত, অবশেষে ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ২২ অগ্রহায়ণ (৭ই ডিসেম্বর, ১৮৯০) শান্তিনিকেতন আশ্রমে ব্রহ্মমন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করা হল দ্বিজেন্দ্রনাথের হাতে এবং এক বছর পর ৭ পৌষ ১২৯৮ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৯১) ব্রহ্মমন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

১৩০১ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৯৪) শান্তিনিকেতনে চতুর্থ বার্ষিক ব্রহ্মোৎসব অনুষ্ঠিত হল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ট্রাস্ট-ডিডে ‘ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য’ প্রতি বছর একটি মেলার আয়োজন করবার নির্দেশ ছিল, তা আমরা আগেই পড়েছি। সেই নির্দেশ অনুযায়ী এই বছরই প্রথম মেলা বসলো। সূচনা হল শান্তিনিকেতনের সুবিখ্যাত ‘পৌষমেলা’র। প্রশান্তকুমার সম্ভবত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করে এই মেলার বর্ণনা দিয়েছেন, “যাত্রাভিনয়ের আয়োজনও ছিল: ‘দিবা দ্বিতীয় প্রহর। চতুর্দ্দিকে দোকান পসার বসিয়াছে এবং স্থানীয়লোকে উৎসবক্ষেত্র পরিপূর্ণ হইয়াছে। ঐ সময়ে সাধারণের হৃদয়ের সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে রাজা হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান গীত হইয়াছিল।’ … সান্ধ্য উপাসনার পর বাজি পোড়ানো হয়: ‘পরে সমস্ত নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া চটাচট শব্দে বহ্ন্যুৎসব পর্ব্ব আরম্ভ হইল। লোকতরঙ্গ মহা কোলাহলে ক্ষুভিত হইয়া উঠিল। তৎকালে খোধূপোদ্গত গোলকের (তুবড়ি?) বিচিত্র নির্ম্মল আলোকে সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কেবলই মস্তকরাজি দৃষ্ট হইতে লাগিল। কো ভীষণ জনতা !’ … শান্তিনিকেতনের ১৩০১ সালের ৭ই পৌষ চতুর্থ সাম্বৎসরিক উৎসবের ব্যয় ১৭৩২ টাকা দশ আনা।”২২

এর পরের কয়েক বছর দেখা যাচ্ছে উৎসবে, বেড়াতে বা বিভিন্ন উপলক্ষে ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা সবান্ধবে দল বেধে শান্তিনিকেতনে যেতেন। ১৮৯৬ সালে কুচবিহারের মহারাণী শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়েছে আশ্রমের উন্নয়ন। ১৮৯৭ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম ব্রহ্মোৎসব চলাকালীন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রতিবেদনে আশ্রমের তৎকালীন একটি বর্ণনা পাওয়া যায় – “ঐ সপ্তপর্ণ বেদির নিকটে একটি তোরণাকার প্রস্তরফলকে ‘শান্তং শিবমদ্বৈতং’ খোদিত। … এক একটি স্তম্ভোপরি কোথাও বেদমন্ত্রের একাংশ, কোথাও ব্রহ্মসঙ্গীতের অল্পাংশ লিখিত। উদ্যানের অনেক স্থানে বৃক্ষমূলে সাধনবেদি এবং স্তম্ভোপরি লিখিত সাধন-সঙ্গীত। কাচময় মন্দিরের সম্মুখে একটি পুস্করিণী আছে। তাহার মধ্যস্থলে একটি ধারাযন্ত্র মুক্তধারায় অনবরত জল উদ্গার করিতেছে। উহার চতুস্পার্শে বসিবার নানারূপ সুশোভন মঞ্চ নানা-জাতীয় বিকশিত পুষ্পবৃক্ষ এবং স্তম্ভে স্তম্ভে হৃদয়াকর্ষক বৈরাগ্যসূচক নানারূপ সঙ্গীত। উহারই অদূরে সুদৃশ্য এক সাধনশৈল আছে। তাহার শিখরদেশে এক সুরচিত সমবৃত্ত পর্ণকুটির, একটা ঘনচ্ছায়া বংশীবট প্রকাণ্ড দুই শাখাবাহু দ্বারা আবৃত করিয়া যেন বাত বর্ষা প্রভৃতি নানারূপ উত্তাপ হইতে উহাকে নিরন্তর রক্ষা করিতেছে।”২৩ 

ইতিমধ্যে মহর্ষি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের উপনয়ন উপলক্ষে উত্তরভারতের আর্যসমাজের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের একত্রিকরণ করবার পরিকল্পনা করেছিলেন। মহর্ষির নিমন্ত্রণপত্র নিয়ে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর লাহোর, বোম্বাই, বেনারস প্রভৃতি শহরে গিয়ে আর্যসমাজের নেতৃস্থানীয়দের আমন্ত্রণ করে আসেন। ১৩০৫ বঙ্গাব্দের ১০ বৈশাখ (২২ এপ্রিল, ১৮৯৮) শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠিত হল।

আমরা দেখেছি, সেই সময়ে মহর্ষির পৌত্র তথা রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ পঞ্জাবের একেশ্বরবাদী আর্যসমাজের সঙ্গে বঙ্গের ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে মিলন স্থাপন এবং ধর্ম বিষয়ে একত্রে কাজ করার অভিপ্রায়ে পঞ্জাব গিয়েছিলেন। কিন্তু  সম্ভবত এই মিলনপ্রয়াস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি অচিরেই আবিস্কার করলেন ধর্মের থেকে প্রচলিত সংস্কার মানুষের মধ্যে প্রবল। আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রবন্ধে দেখছি, বলেন্দ্রনাথ “সেখানে গিয়ে তাঁদের বেদসর্বস্ব মনোভাব ও মতবাদের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যুক্তি ও ভক্তিমিশ্রিত ব্রহ্মবাদের মিলন সম্ভব নয় বুঝতে পেরে, পঞ্জাব থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন।”২৪ এরপর বলেন্দ্রনাথ স্থির করলেন, ব্রহ্মসমাজের আদর্শকে সর্বভারতীয় স্তরে ছড়িয়ে দিতে গেলে একটি শিক্ষাকেন্দ্রের সবিশেষ প্রয়োজন। শান্তিনিকেতনে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করবার ভাবনার কথা মহর্ষিকে তিনি জানালেন এবং মহর্ষি সেই ভাবনাকে যথোপযুক্ত মনে করে সম্মতি দিলেন। কেবল তাই নয়, ব্রহ্মবিদ্যালয়ের গৃহ নির্মাণ ও অন্যান্য খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দান করা হল। নব উদ্যমে বলেন্দ্রনাথ তাঁর ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন। মহর্ষির অনুমতি পেয়ে তিনি এই পরিকল্পনার বিস্তারিত খসড়া তৈরি করেন এবং শান্তিনিকেতনে তিনটি ঘর সমেত একতলা গৃহও নির্মাণ করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ব্রহ্মবিদ্যালয়ের  নিয়মাবলির সেই খসড়াটি রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চোদ্দোটি বিধান সহ সেই নিয়মাবলিতে ছিল, (১) শান্তিনিকেতন ব্রহ্মবিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার উপযোগী করিয়া অধ্যাপনা করা হইবে। (২) বিদ্যালয় ছয় শ্রেণীতে বিভক্ত হইবে। (৩) আপাততঃ দশজন ছাত্র বিনাব্যয়ে বিদ্যালয়ে থাকিয়া আহার ও শিক্ষালাভ করিতে পারিবেন। (৪) আহার্যের ব্যয়স্বরূপ মাসিক ১০৲ দিলে আরও ২০ জন ছাত্রকে বিদ্যালয়ে লওয়া যাইতে পারিবে। (৫) শান্তিনিকেতন আশ্রমের ট্রাস্টীগণ ব্যতীত আরও চারজন সভ্যকে লইয়া বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সমিতি গঠিত হইবে। প্রথম অধ্যক্ষ নির্বাচনে আশ্রমের ট্রাস্টীগণের কতৃত্ব থাকিবে। তৎপরে কোনো অধ্যক্ষ অবসর গ্রহণ করিলে অবশিষ্ট অধ্যক্ষেরা মিলিয়া অধ্যক্ষ নিবার্চন করিয়া লইবেন। (৬) অধ্যক্ষ সমিতি ব্রাহ্ম ধর্মানুমোদিত শিক্ষাপ্রনালী এবং শান্তিনিকেতন আশ্রমের নিয়মাবলী সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করিয়া বিদ্যালয়ের কার্য পরিচালনা করিবেন। (৭) শান্তিনিকেতন আশ্রমের ট্রাস্টীগণের মধ্যে একজন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক হইবেন। সম্পাদক অধ্যক্ষ-সভার অনুমতি লইয়া বিদ্যালয়ের কার্য পরিদর্শন, হিসাবপরীক্ষা, শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ ও পরিবর্তন, ছাত্র-নির্বাচন, পুস্তক, শিক্ষাপদ্ধতি নির্ধারণ করিবেন। (৮) বিদ্যালয়ের অন্যান্য পাঠগ্রন্থের সঙ্গে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে পদ্যে ব্রাহ্মধর্ম এবং চতুর্থ বার্ষিক হইতে প্রবেশিকা পর্যন্ত ব্রাহ্মধর্ম ও ব্যাখ্যান অধ্যাপন হইবে। (৯) ৩য় বার্ষিক শ্রেণী হইতে এন্ট্রান্স পর্যন্ত সমুদয় ছাত্র অধ্যাপকগণ-সহ আশ্রমের প্রতি সায়ং-উপাসনায় যোগ দিবে। এবং নিম্নশ্রেণীর বালকগণকে লইয়া অধ্যাপকগণ স্বতন্ত্র নির্দিষ্ট উপাসনা করিবেন। … (১০ এবং ১১ নম্বর নিয়মদুটি নেই) (১২) সকল ছাত্রকেই বিদ্যালয়-ভবনে বাস করিতে হইবে। এবং শিক্ষকগণ তাহাদিগকে লইয়া নিরূপিত সময়ে একত্র আহারাদি করিবেন। এবং যথাসম্ভব ছাত্রগণের সহিত ক্রীড়া-কৌতুকেও যোগ দিবেন। (১৩) ছুটির সময় ব্যতীত মাসে ৩ দিন ছাত্রগণ অভিভাবকের সম্মতি থাকিলে অধ্যাপকের অনুমতি লইয়া বাটী যাইতে পারিবে। (১৪) অভিভাবকগণ প্রতি রবিবারে গিয়া বালকদিগকে দেখিয়া আসিতে পারিবেন।২৫ স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে কোনও রাখঢাক না রেখে বলেন্দ্রনাথ একটি ধর্মীয় স্কুল তৈরি করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন যার নিয়মকানুন অনুযায়ী স্রেফ ব্রাহ্মপরিবারের পুত্রগণই এতে শিক্ষালাভের যোগ্য হবে।

১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের পৌষ উৎসবে শান্তিনিকেতন-সাধনাশ্রমের উদ্বোধনের লক্ষ্যে ব্রহ্মবিদ্যালয় নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছিল। সেই গৃহের কিছু অংশ এখন আদিকুটির নামে পরিচিত। কিন্তু এই সময়েই ২০ আগস্ট বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হল। তবে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে বাধাগ্রস্ত হলেও গৃহনির্মাণ বন্ধ হল না অথবা ব্রহ্মবিদ্যালয়ের প্রকল্পও পরিত্যক্ত হল না। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৯৯) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মবিদ্যালয়ের দ্বারোদ্ঘাটন করলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রতিবেদক জানিয়েছেন, উদ্বোধনী বক্তৃতায় সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এদেশে ব্যায়াম শিক্ষার স্থান আছে, জ্ঞান শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়াদি আছে, কিন্তু যেখানে আধ্যাত্মবিদ্যা অধীত হইতে পারে, এরূপ কোন স্থান নাই। … সেই জন্যই এই অনুকুল স্থানে এই ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপিত হইতেছে, এবং যাহাতে ব্রহ্মবিদ্যা প্রদত্ত হয়, তজ্জন্য সুনিয়ম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হইতেছে। … যিনি ব্রাহ্মধর্ম শিক্ষা ও প্রচারের জন্য এই ব্রহ্মবিদ্যালয় নির্মাণ করিয়া দিলেন, তিনি আমাদের সকলেরই ধন্যবাদের পাত্র ; তাঁহার নিকট সকলেরই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।”২৬ শোভন সোমের মন্তব্য, “তিনি (সত্যেন্দ্রনাথ) উদ্বোধনী ভাষণে পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন, কিন্তু প্রতিবেদনের কোথাও ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ের রূপকার বলেন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত হল না; তাঁর ভূমিকা প্রচ্ছন্ন রইল।”২৭ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রবি জীবনীকার প্রশান্তকুমারও বলেছেন, “লক্ষণীয়, নাম না করেও এখানে মহর্ষির কাছেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে – বলেন্দ্রনাথের কাছে নয়।”২৮ এই বিতর্কিত প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আসছি।

জোড়াসাঁকোর বাড়ির বিপুল জনসমাগম হইচইয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যেমন পারিবারিক স্বাতন্ত্র্য ছিল না, তেমনি তাঁর কবিসত্ত্বার মনোনিবেশেরও ব্যাঘাত ঘটত। তাই তিনি কলকাতা থেকে সপরিবারে শিলাইদহে গিয়ে নিভৃত সাহিত্যচর্চার সঙ্গে গ্রামোন্নয়ন ও গৃহবিদ্যালয় পরিচালনা নিয়ে থাকবেন ভেবেছিলেন। একদিকে শান্তিনিকেতনের এই ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের দ্বার উদ্ঘাটন বাস্তবিক অর্থেই প্রতীকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ দেখা যাচ্ছে উদ্বোধিত হয়েও পরবর্তী দুই বছর এই বিদ্যালয় বন্ধই রয়ে গেল। এর একটাই কারণ, ট্রাস্টীদের কেউই এই বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনও ব্যবস্থাই নিলেন না। এমনকি আমরা দেখছি, অছি হিসেবে এই যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পূর্ণ যোগাযোগ থাকলেও বলেন্দ্রনাথের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে তিনিও দীর্ঘদিন উদ্যোগী হলেন না। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ যদিও শিলাইদহে গৃহবিদ্যালয় চালু করেছিলেন কিন্তু সে সময়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ তিনি দিতে পারেননি। আবার কবিপত্নী মৃণালিনীও শিলাইদহের এই নির্বাসন দণ্ড বিশেষ পছন্দ করেননি বলেই চিঠিপত্রে জানা যায়। সব মিলিয়ে কবি তখন গৃহবিদ্যালয়ের বিকল্প স্থানের কথা ভাবছিলেন। ইতিমধ্যে ১৩০৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে শান্তিনিকেতনে গিয়ে বন্ধ থাকা ব্রহ্মবিদ্যালয়ের বাড়িটি দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদলে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার সংকল্প জেগে উঠলো।

‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ” প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “তার পরে সেদিনকার বালক যখন যৌবনের প্রৌঢ়বিভাগে তখন বালকদের শিক্ষার তপোবন তাকে দূরে খুঁজতে হবে কেন। আমি পিতাকে গিয়ে জানালেম, শান্তিনিকেতন এখন প্রায় শূন্য অবস্থায়, সেখানে যদি একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করতে পারি তা হলে তাকে সার্থকতা দেওয়া হয়। তিনি তখনই উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিলেন। বাধা ছিল আমার আত্মীয়দের দিক থেকে। পাছে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে যায় এই ছিল তাঁদের আশঙ্কা।”২৯ 

সঞ্চয়’ প্রবন্ধগুচ্ছের অন্তর্গত ‘ধর্মশিক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আর একটু বিস্তারিতভাবে বিষয়টি লিখেছেন – “আমার পূজনীয় পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বোলপুরের উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে যুগল সপ্তপর্ণচ্ছায়াতলে যেখানে তাঁহার নিভৃত সাধনার বেদী নির্মাণ করিয়াছিলেন সেইখানে তিনি একটি আশ্রম স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। এই আশ্রমের প্রতি কেবল যে তাঁহার একটি গভীর প্রীতি ছিল তাহা নহে, ইহার প্রতি তাঁহার একটি সুদৃঢ় শ্রদ্ধা ছিল। যদিও সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত এই স্থান প্রায় শূন্যই পড়িয়া ছিল তথাপি তাঁহার মনে লেশমাত্র সংশয় ছিল না যে ইহার মধ্যে একটি গভীর সার্থকতা আছে। সেই সার্থকতা তিনি চক্ষে না দেখিলেও তাহার প্রতি তাঁহার পূর্ণ নির্ভর ছিল। তিনি জানিতেন, ঈশ্বরের ইচ্ছার মধ্যে ব্যস্ততা নাই কিন্তু অমোঘতা আছে। একদিন এই আশ্রমে বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব যখন তাঁহার নিকট উপস্থিত হইল তখন পরমোৎসাহে তিনি সম্মতি দিলেন। এতদিন আশ্রম এই বিদ্যালয়ের জন্যই যে অপেক্ষা করিতেছিল তাহা তিনি অনুভব করিলেন।”৩০

এইখানে কয়েকটা বিষয় বলবার আছে। প্রথমত, দেবেন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথের কোন আত্মীয়ের দিক থেকে কিসের বাধা এসেছিল, সে-কথা রবীন্দ্রনাথ বলেননি। দ্বিতীয়ত, ইতিপূর্বে যে বলেন্দ্রনাথের উদ্যোগে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের পরিকল্পনা গৃহীত হয়ে তার দ্বারোদ্ঘাটন পর্যন্ত হয়ে গেছে, এ-কথাও রবীন্দ্রনাথ বললেন না। শোভন সোম স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, “দুটি উক্তিতেই রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্ম-বিদ্যালয়-প্রকল্পের কথা উহ্য রেখে গেছেন এবং বলেন্দ্রনাথের প্রয়াসও অনুক্ত রয়ে গেছে।”৩১ এইজন্যেই রবি জীবনীকার প্রশান্তকুমারের মতে, “দুবছর পরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার সময়ে বা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথও বলেন্দ্রনাথের প্রয়াসকে স্বীকৃতি জানাননি।”৩২ 

বলেন্দ্রনাথের জীবনী পড়লে আমরা জানতে পারি, এর আগে বলেন্দ্রনাথের বিভিন্ন উদ্যোগে, সে সাহিত্যই হোক বা ব্যবসা ; সকল কাজেই রবীন্দ্রনাথের সরাসরি সহায়তা ছিল। ব্যতিক্রম এই ব্রহ্মবিদ্যালয়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রভাতকুমার বলেছেন, “বলেন্দ্রনাথের সকল কার্যেই রবীন্দ্রনাথের যোগ ছিল ; কিন্তু এই ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’-পরিকল্পনায় রবীন্দ্রনাথের কোনো যোগ ছিল বলিয়া কোনো প্রমাণ পাই না। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় হইতে শিলাইদহে নিজ সন্তানদের জন্য গৃহবিদ্যালয় স্থাপনে পরিকল্পনারত। বলেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুতে (ভাদ্র ১৩০৬) তাঁহার আকাঙ্খা কার্যকরী হয় নাই।”৩৩ 

আদৌ ব্যাপারটা কি তাই? ‘বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থের লেখক শোভন সোমের মতে, “দেবেন্দ্রনাথের জীবিতকালে তাঁর পুত্রেরাও সম্পত্তিবিষয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। বলেন্দ্রনাথ পিতামহের অনুমতি নিয়েই এই পরিকল্পনা রূপায়নে এগিয়েছিলেন। পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সংখ্যক বিধানে অছি হিসেবে রবীন্দ্রনাথেরও দায়িত্ব ছিল। শান্তিনিকেতন-সাধনাশ্রমের অন্যতম অছি রবীন্দ্রনাথের অজ্ঞাতসারে এই নিয়মাবলী প্রণীত হয়েছিল বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ যদিও তখন গৃহবিদ্যালয় প্রকল্প নিয়ে শিলাইদহে ব্যস্ত ছিলেন, তবু অছি হিসেবে তাঁকে ব্রহ্মবিদ্যালয়ের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত বলা যাবে না।”৩৪

শোভনবাবুর বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া  যায় প্রশান্তকুমারের গ্রন্থেও। তিনি খুঁজে বার করেছেন, ১৩০৫ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ বলেন্দ্র-প্রস্তাবিত ব্রহ্মবিদ্যালয়ের কাজ উপলক্ষে ৬ মাঘ মির্জাপুর এবং ১৯ মাঘ রাজাবাগান গিয়েছিলেন। বলেন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যালয় সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে আগ্রহী ছিলেন, মির্জাপুর ও রাজাবাগানে যাতায়াতই তার প্রমাণ। প্রশান্তকুমার বলেছেন, “শান্তিনিকেতন আশ্রমের তিনি (রবীন্দ্রনাথ) একজন ট্রাস্টী ছিলেন ও শিক্ষা-বিষয়ে তাঁর বিশিষ্ট ভাবনারও যথেষ্ট প্রমাণ আছে – সুতরাং খুবই স্বাভাবিক যে, প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথের সংকল্প তাঁর সোৎসাহ সমর্থন লাভ করবে। কিন্তু বলেন্দ্রনাথের অকালমৃত্যু বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনাটিকে বিলম্বিত করে। তিন বৎসর পরে রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করেন তখন তাঁর ব্যবহারিক ও আত্মিক প্রয়োজন ছিল ভিন্নতর, কিন্তু তা অবলম্বন করেছিল বলেন্দ্রনাথের দ্বারা প্রস্তুত ভিত্তিটিতে – দুঃখের বিষয়, এই ‘সলতে পাকানো’ ইতিহাসটিকে তিনি কোথাও স্বীকৃতি দিয়ে যান নি।”৩৫ 

রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করলেন, তখন তিনি আর্থিকভাবে স্থিতিশীল নন। তখনও তিনি জমিদারির মালিক নন, এস্টেট থেকে দুশো টাকা মাসোহারা পেয়ে থাকেন। উপরন্তু  ঘাড়ে চেপেছিল কিছু দেনার দায়। ১৯০১ সালে জুলাই মাসের মাঝামাঝি মুজঃফরপুর হতে ফেরবার পথে শান্তিনিকেতনে তিনি কদিন কাটালেন। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে ৯ শ্রাবণ ১৩০৮ (২৫ জুলাই, ১৯০১) রবীন্দ্রনাথ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে লিখলেন, “পথের মধ্যে কিছুদিন শান্তিনিকেতনে বাস করিয়া আরাম লাভ করিয়াছি। সেখানে একটা নির্জন অধ্যাপনের ব্যবস্থা করিবার চেষ্টায় আছি। দুই একজন ত্যাগ-স্বীকারী ব্রহ্মচারী অধ্যাপকের সন্ধানে ফিরিতেছি।”৩৬

এই উপযুক্ত ‘ত্যাগ-স্বীকারী ব্রহ্মচারী’ অধ্যাপকের সন্ধান রবীন্দ্রনাথ অবশেষে পেলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং রেবাচাঁদ জ্ঞানচাঁদ মখিজানির (পরবর্তীকালে ব্রহ্মচারী অণিমানন্দ) মধ্যে। এলেন শিবধন বিদ্যার্ণব এবং জগদানন্দ রায়। ব্রহ্মবান্ধব পাঁচ-ছয়জন ছাত্রকে নিয়ে শান্তিনিকেতনের এসে প্রতিষ্ঠানটিকে আপন আদর্শে গড়তে প্রবৃত্ত হলেন। তাঁর ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত বিদ্যালয় ব্রহ্মচর্যাশ্রম রূপ ধারণ করল। রবীন্দ্রনাথ হলেন গুরুদেব, প্রভাতকুমার বলেছেন এই আখ্যা সর্বপ্রথম ব্রহ্মবান্ধবই রবীন্দ্রনাথকে দেন। “উপাধ্যায়ের কঠোর ব্যবস্থায় ছাত্রদের জুতা-ছাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ, নিরামিষ ভোজন সার্বজনিক ; তবে আহার-স্থানে বর্ণভেদ মানাই আবশ্যিক।”৩৭ এমনকি শান্তিনিকেতন আশ্রমের “ছাত্রদের মধ্যে ব্রাহ্মণদের জন্য সাদা, বৈদ্য ও কায়স্থদের জন্য লাল ও বৈশ্যদের জন্য হলুদ আলখাল্লা জাতীয় পোষাক নির্ধারিত ছিল। অনতিপরে বর্ণভেদ ঘুচিয়ে সকলের জন্যই গৈরিক আলখাল্লা নির্ধারিত হয় …।”৩৮ 

আশ্রম-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন ছাত্রদের অভিভাবকদের সঙ্গে তিনি কোনও আর্থিক সম্বন্ধ রাখবেন না। শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট-ডিডে বিদ্যালয়ের জন্য মাসিক দুশো টাকা বরাদ্দ ছিল। সম্ভবত তিনি দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন যে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের কথা শুনে দেশের ধনী হিন্দুরা বোধহয় প্রাচীন ভারতের আদর্শমত আশ্রমকে সাহায্য দান করবেন। কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই কবির ঘোর কেটে গেল। তিনি বুঝলেন তথাকথিত প্রাচীন ভারতের আদর্শের প্রতি সমকালীন দেশবাসীর সে শ্রদ্ধা আর নেই। দুশো টাকা অপ্রতুল হওয়ায় অতিরিক্ত সকল ব্যয় একা রবীন্দ্রনাথকেই বহন করতে হচ্ছিল। “রথীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের সম্বন্ধে লিখেছেন: যখনই বিশেষ প্রয়োজন হয়েছে, নিজের অলঙ্কার একে একে বিক্রি করে বাবাকে টাকা দিয়েছেন। শেষপর্যন্ত হাতে সামান্য কয়েকগাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন ছাড়া তাঁর কোনো গয়না অবশিষ্ট ছিল না। … বাবার নিজের যা-কিছু মুল্যবান সম্পত্তি ছিল তা আগেই তিনি বেচে দিয়েছিলেন।”৩৯ আদর্শের জন্য কবিদম্পতির এই কৃচ্ছ্রসাধনের ইতিহাসটি আজ সময়ের গর্ভে তলিয়ে গেছে।

গ্রীষ্মাবকাশের পর ছাত্রদের থেকে মাসিক তেরো টাকা করে বেতন নেওয়া স্থির হল। গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর ব্রহ্মবান্ধব, রেবাচাঁদ ও বিদ্যার্ণব আর ফিরে এলেন না। খ্রিস্টান ব্রহ্মবান্ধব ও রেবাচাঁদের সঙ্গে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের সম্পর্ক অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন না, তাঁদের কঠোর নিয়মানুবর্তিতাও আবার রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের অনুসারী ছিল না। সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে এবং তাঁরা আশ্রম ত্যাগ করতে মনস্থ করেন। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শান্তিনিকেতনে যোগ দিলেন মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র মজুমদার,  কুঞ্জলাল ঘোষ, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ভুপেন্দ্রনাথ সান্যাল প্রমুখ। এই সময় কবিপত্নী মৃণালিনীও পুত্রকন্যাদের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে এসে উঠলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় রথীন্দ্রনাথকে রেখে বাকি সকলকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ফিরে যেতে বাধ্য হলেন।

মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯০২ সালের নভেম্বর মাসের (তারিখ নেই) একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানালেন, “কুঞ্জবাবু শীঘ্রই বোলপুর যাইবেন। আশা করিতেছি তাঁহার নিকট হইতে নানাবিষয়ে সাহায্য পাইবেন। অধ্যাপনকার্য্যেও তিনি আপনার সহায় হইতে পারিবেন। আন্তরিক শ্রদ্ধার সহিত তিনি এই কার্য্যে ব্রতী হইতে উদ্যত হইয়াছেন। ইঁহার সম্বন্ধে যত লোকের নিকট হইতে সন্ধান লইয়াছি সকলেই একবাক্যে ইঁহার প্রশংসা করিয়াছেন।”৪০ ১৩ নভেম্বর এই কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা দীর্ঘ একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্রহ্ম-বিদ্যালয় বা আশ্রম-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবার মুল উদ্দেশ্যগুলি বিবৃত করেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রগণকে স্বদেশের প্রতি বিশেষরূপে ভক্তিশ্রদ্ধাবান করিতে চাই। … ব্রহ্মচর্য্য-ব্রতে ছাত্রদিগকে কঠিন অভ্যাস করিতে হইবে। বিলাস ও ধনাভিমান পরিত্যাগ করিতে হইবে। … উঠা বসা পড়া লেখা স্নান আহার ও সর্ব্বপ্রকার পরিচ্ছন্নতা ও শুচিতা সম্বন্ধে সমস্ত নিয়ম একান্ত দৃঢ়তার সহিত পালনীয়। … অধ্যাপকদের প্রতি ছাত্রদের নির্বিচারে ভক্তি থাকা চাই। তাঁহারা অন্যায় করিলেও তাহা বিনা বিদ্রোহে নম্রভাবে সহ্য করিতে হইবে। … রন্ধনশালায় বা আহারস্থানে হিন্দু আচারবিরুদ্ধ কোন অনিয়মের দ্বারা কাহাকেও ক্লেশ দেওয়া যাইবে না। … ছাত্রগণ পাঠ আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে সকলে সমস্বরে ‘ওঁ পিতানোহসি’ উচ্চারণপূর্ব্বক প্রণাম করে। …” ইত্যাদি।৪১

উক্ত চিঠিতে কুঞ্জবাবুকে রবীন্দ্রনাথ আরও একটি কথা লেখেন – “শান্তিনিকেতনের আশ্রমের সহিত বিদ্যালয়ের সংশ্রব প্রার্থনীয় নহে।”৪২ ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ গ্রন্থে পুলিনবিহারী সেন এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, “বাংলা ১২৬৯ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের জমির পাট্টা লইয়াছিলেন; ১২৯৪ সালে ‘নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার জন্য একটি আশ্রম সংস্থাপনের অভিপ্রায়ে’ ও তাহার অনুকুলকার্যসম্পাদনার্থে মহর্ষি এই সম্পত্তি ট্রস্টীদিগের হাতে অর্পণ করেন ও এই আশ্রমের ব্যয়নির্বাহার্থে আর্থিক ব্যবস্থা করিয়া দেন। ‘এই ট্রাস্টের উদ্দিষ্ট আশ্রমধর্মের উন্নতির জন্য ট্রাস্টীগণ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় ও পুস্তকালয় সংস্থাপন, … করিতে পারিবেন।’ পরে ১৩০৮ সালে মহর্ষির অনুমতিক্রমে তাঁহার ধর্মদীক্ষাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন; এ ক্ষেত্রে ‘আশ্রম’ বলিতে উক্ত ট্রস্ট অনুযায়ী পূর্বাগত ব্যবস্থা, ও ‘বিদ্যালয়’ বলিতে নবপ্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মচর্যাশ্রম বুঝিতে হইবে। পরে আশ্রম ও বিদ্যালয় সাধারণত সমার্থক হইয়াছে।”৪৩

মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ১৯০২ সালের নভেম্বর মাসের লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ দিলেন, “বিদ্যালয়ের কর্তৃত্বভার আমি আপনাদের তিনজনের উপরে দিলাম – আপনি জগদানন্দ ও সুবোধ। এই অধ্যক্ষসমিতির সভাপতি আপনি ও কার্য্য-সম্পাদক কুঞ্জবাবু।”৪৪

আশ্রমের বিস্তৃত নিয়মাবলি কুঞ্জলাল ঘোষকে সম্বোধন করে লেখা হলেও এই চিঠিই ছিল শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রথম সংবিধান।

বিশ্বজিৎ রায় আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, প্রথম দিকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমে খাওয়াদাওয়া নিয়ে বেশ বাছবিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে প্রচলিত সংস্কারে তিনি হাত দিতে চাননি। চিঠিপত্রে তার প্রমাণ ইতিউতি ছড়িয়ে আছে। রন্ধনশালায় বা আহারস্থানে হিন্দু-আচারবিরুদ্ধ কোন অনিয়মের তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, কুঞ্জলাল ঘোষকে লেখা ১৩ নভেম্বর ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের চিঠি যাতে তিনি বলেন, “ছাত্ররা যখন খাইতে বসিবে তখন পালা করিয়া একজন ছাত্র পরিবেশন করিলে ভাল হয়। ব্রাহ্মণ পরিবেশক না হইলে আপত্তিজনক হইতে পারে। অতএব সে বিষয়ে বিহিত ব্যবস্থাই কর্ত্তব্য হইবে।”৪৫ এমন আশঙ্কা সহজে যায়নি।  ভূপেন্দ্রনাথ সান্যালকে পাঁচ বছর পরে ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাঙালী ব্রাহ্মণ হিন্দুস্থানীর রান্না খাবে না।”৪৬

ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে আশ্রমে এক বার খুবই বিশ্রী কাণ্ড ঘটেছিল, সে কথা জানা যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে। তিনি ১৯০২ সালে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। হরিচরণবাবু লিখেছেন, “আশ্রম প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরে ভুপেন-দার ম্যানেজারীর সময় সকালে বিকালে রাত্রিতে বালকদিগের খাওয়ার সময়ে উপস্থিত হইয়া পর্য্যবেক্ষণের ভার কিছুকাল আমার উপরে ছিল। কোন কারণে মধ্যাহ্নে বালকদিগের আসার পূর্বে আমার আসা সম্ভব হইত না, সেই সময়ে আমার এক অধ্যাপকবন্ধু আমার পরিবর্ত্তে আসিয়া খাওয়ার প্রথম ব্যবস্থা করিতেন, আমি কিছু পরেই যোগ দিতে আসিতাম। এই সময়ে ছাত্রসংখ্যা প্রায় দুই শত। শিক্ষক ও ছাত্রদিগের খাওয়ার পরে আমরা খাইতাম। একদিন সকলের খাওয়ার পরে শুনিলাম, একটি অস্পৃশ্য জাতির বালকের কোনপ্রকার সংস্পর্শে অবশিষ্ট অন্নব্যঞ্জন দুষিত হইয়াছে। ঠাকুর চাকরেরা আপত্তি করিয়া বলিল, আমাদের কি ব্যবস্থা হইবে? আমি বলিলাম, কর্ত্তৃপক্ষকে জানাও, তাঁহারা ব্যবস্থা করিবেন। আমরা দুগ্ধাদি খাইয়া মধ্যাহ্নভোজন শেষ করিয়া স্বস্থানে আসিলাম। কর্ত্তৃপক্ষ কি ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, স্মরণ হয় না।”৪৭ স্পষ্টতই, তথাকথিত অস্পৃশ্য বালকের সেই ছোঁয়াচ-লাগা ভাত উচ্চবর্ণের অভুক্ত উচ্চশিক্ষিত আশ্রমিকেরা খেলেন না, ভাত ফেলে দিতে হল। অবশ্য শোনা যায়, বিষয়টি রবীন্দ্রনাথকে খুবই বিচলিত করেছিল।

আমরা দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের এই আশ্রমে একেবারে শুরুর দিকে বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিশেবে যোগ দেন কুঞ্জলাল ঘোষ। জাতিতে তিনি অব্রাহ্মণ। গোল বাধে তখনই। প্রশ্ন ওঠে ব্রাহ্মণ ছাত্র অব্রাহ্মণ গুরুকে প্রণাম করতে পারে কিনা। সম্ভবত তথাকথিত উচ্চবর্ণের কয়েকজন ছাত্র এ ব্যাপারে আপত্তি জানায়। অগত্যা প্রধান অধ্যক্ষ মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের মতামত চেয়ে তাঁকে চিঠি লিখলেন। শুনলে হয়তো হতবাক হবেন, ৫ই ডিসেম্বর, ১৯০২ তারিখের চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মনোরঞ্জনবাবুকে সাফ জানিয়ে দিলেন, “প্রণাম সম্বন্ধে আপনার মনে যে দ্বিধা উপস্থিত হয়েছে তাহা উড়াইয়া দিবার নয়। যাহা হিন্দুসমাজবিরোধী তাহাকে এ বিদ্যালয়ে স্থান দেওয়া চলিবে না। সংহিতায় যেরূপ উপদেশ আছে ছাত্ররা তদনুসারে ব্রাহ্মণ অধ্যাপকদিগকে পাদস্পর্শপূর্ব্বক প্রণাম ও অন্যান্য অধ্যাপকদিগকে নমস্কার করিবে এই নিয়ম প্রচলিত করাই বিধেয়। সর্ব্বাপেক্ষা ভালো হয় যদি কুঞ্জবাবুকে নিয়মিত অধ্যাপনার কার্য্য হইতে নিস্কৃতি দেওয়া যায়। তিনি যদি আহারাদির তত্ত্বাবধানেই বিশেষরূপে নিযুক্ত থাকেন তবে ছাত্রদের সহিত তাঁহার গুরুশিষ্যসম্বন্ধ থাকে না।”৪৮ কি বলবো? এক্ষেত্রে  কি অন্ধবিশ্বাসের সাপটি না মেরে রবীন্দ্রনাথ বরং সংস্কারের লাঠিটিই ভেঙে ফেললেন?

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তাঁর গ্রন্থে, “মহাত্মা গান্ধী যখন পাকশালায় ঠাকুর চাকরের প্রচলন রহিত করিয়া সর্ববর্ণসমন্বয়ের চেষ্টা করিতেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ আশ্রমে অনুপস্থিত। এইরূপ আকস্মিক আচারবিপ্লবে বিশৃঙ্খলার বিষম আঘাতে আশ্রমের চিরপ্রচলিত নিয়ম ভগ্নপ্রায় হইয়াছিল, উদ্বেগ-অশান্তিতে সকলের মনও অপ্রকৃতিস্থ হইয়া উঠিয়াছিল।”৪৯ সৈয়দ মুজতবা আলির মতে, “মহাত্মা গান্ধী কিছুদিনের জন্য আশ্রম পরিচালনার ভার স্বহস্তে নিয়ে দেখিয়ে দিলেন, এতদিন আশ্রমবাসীরা যে জীবন কৃচ্ছসাধনাময় ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলেন সেটা বাস্তবিক বিলাশ পরিপূর্ণ। আশ্রমের মেথর চাকর বিদায় দিয়ে তিনি এখানে যে বিপ্লবের সূত্রপাত করলেন সেটা তখনকার অনেক গুরুর পক্ষে অসহনীয় হয়ে দাঁড়ালো।”৫০ গান্ধীজি সবরমতি চলে গেলেন, এই নিয়ম কিছুদিন চলবার পর, কবি আশ্রমে ফিরে এলে পুনরায় পূর্ব নিয়ম প্রবর্তিত করলেন। এইখানে প্রশ্ন জাগে, তবে কি রবীন্দ্রনাথ চাননি, শান্তিনিকেতনে বর্ণভেদ উঠে যাক, নাকি তিনি স্রেফ অহেতুক প্রশাসনিক অচলাবস্থা এড়াতে চেয়েই এই আপোষটুকু করেছিলেন?

প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে শান্তিনিকেতনে যে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, সেটিও মর্মগতভাবে আসলে বর্ণাশ্রম। মোটামুটিভাবে দেখা যাচ্ছে বলেন্দ্রনাথের প্রণীত নিয়মাবলীটিই প্রাথমিকভাবে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের নিয়ম হিসেবে অনুসৃত হয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ যতদিন জীবিত ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরেও কয়েক বছর “এই বিদ্যালয়ে ব্র‍াহ্মণ-অব্রাহ্মণের স্বতন্ত্র আহার, অব্রাহ্মণকে প্রণাম না করা, কাষায় পরিধান, দণ্ডধারণ ও ‘প্রকৃত হিন্দু’ হয়ে ওঠার নিয়মগুলি পালিত হয়েছে।”৫১ সৈয়দ মুজতবা আলিও ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে প্রথম বিদ্যালয় স্থাপনা করেন তখন এটাকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা ব্রহ্মবিদ্যালয় বলা হত। ছেলেরা জুতো পরতো না, নিরামিষ খেত, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণেতরের জন্য পৃথক পৃথক পঙক্তি ছিল; এমন কি প্রশ্ন উঠেছিল, ব্রাহ্মণ ছাত্র কায়স্থ গুরুর পদধুলি নেবে কি না।”৫২ আরও উল্লেখ করি, ১৯০১ সালের আগস্ট মাসে জগদীশচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্র, “শান্তিনিকেতনে আমি একটি বিদ্যালয় খুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেছি। সেখানে ঠিক প্রাচীন কালের গুরুগৃহ-বাসের মত সমস্ত নিয়ম। বিলাসিতার নাম-গন্ধ থাকিবে না – ধনী দরিদ্র সকলকেই কঠিন ব্রহ্মচর্যে দীক্ষিত হইতে হইবে। উপযুক্ত শিক্ষক কোন মতেই খুঁজিয়া পাইতেছি না। … ছেলেবেলা হইতে ব্রহ্মচর্য না শিখিলে আমরা প্রকৃত হিন্দু হইতে পারিব না।”৫৩ ১৯০২ সালে এপ্রিল মাসে (২৪ চৈত্র, ১৩০৮ বঙ্গাব্দ) ত্রিপুরার মহারাজকুমার ব্রজেন্দ্রকিশোর দেবমাণিক্যকে লেখা চিঠিতে তারই সাক্ষ্য – “আমি ভারতবর্ষীয় ব্রহ্মচর্য্যের প্রাচীন আদর্শে আমার ছাত্রদিগকে নির্জ্জনে নিরুদ্বেগে পবিত্র নির্ম্মলভাবে মানুষ করিয়া তুলিতে চাই – তাহাদিগকে সর্ব্বপ্রকার বিলাতী বিলাস ও বিলাতের অন্ধমোহ হইতে দূরে রাখিয়া ভারতবর্ষের গ্লানিহীন পবিত্র দারিদ্র্যে দীক্ষিত করিতে চাই। … বিদেশী ম্লেচ্ছতাকে বরণ করা অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয় …।”৫৪ শান্তিনিকেতন থেকে আর একটি চিঠিতেও তিনি দেবমাণিক্যকে লিখেছিলেন, “ভারতবর্ষে যথার্থ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সমাজের অভাব হইয়াছে – দুর্গতিতে আক্রান্ত হইয়া আমরা সকলে মিলিয়াই শূদ্র হইয়া পড়িয়াছি। … আমি ব্রাহ্মণ আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিবার সংকল্প হৃদয়ে লইয়া যথাসাধ্য চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছি।”৫৫ সত্যি কথা বলতে কি রবীন্দ্রনাথের এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রাচীনপন্থী মনোভাব কেবলমাত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নয়,  ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সঙ্গে মেলামেশার প্রভাবের ফসল বলেও মনে করা হয়। আশ্চর্যজনকভাবে এই রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারা আমরা পালটে যেতে দেখি দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু এবং ব্রহ্মবান্ধবের শান্তিনিকেতন পরিত্যাগের পর।

১৩১৮ বঙ্গাব্দে (১৯১১) একজন মুসলমান ভদ্রলোক তাঁর পুত্রকে শান্তিনিকেতনে ভর্তি করবার প্রস্তাব দেন। রবীন্দ্রনাথ কায়মনোবাক্যে চেয়েছিলেন এই ভর্তি হোক। কিন্তু আশ্রমের অন্যতম ট্রাস্টি দ্বিপেন্দ্রনাথের কাছ থেকে বাধা আসবার আশঙ্কায় তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ৯ কার্তিক (২৬ অক্টোবর) তিনি প্রধান শিক্ষক নেপালচন্দ্র রায়কে এই বিষয়ে লেখেন। কিন্তু নেপালচন্দ্রও তত উৎসাহ দেখাননি। ১৬ কার্তিক (২ নভেম্বর) রবীন্দ্রনাথ পুনরায় নেপালচন্দ্রের কাছে তাঁর আগ্রহ ব্যক্ত করে দ্বিতীয় যে চিঠিটি লেখেন – “মুসলমান ছাত্রটির সঙ্গে একটি চাকর দিতে তাহার পিতা রাজি অতএব এমন কি অসুবিধা, ছাত্রদের মধ্যে এবং অধ্যাপকদের মধ্যেও যাহাদের আপত্তি নাই তাঁহারা তাহার সঙ্গে একত্র খাইবেন। শুধু তাই নয় – সেই সকল ছাত্রের সঙ্গেই ওই বালকটিকে এক ঘরে রাখিলে সে নিজেকে নিতান্ত যূথভ্রষ্ট বলিয়া অনুভব করিবে না। একটি ছেলে লইয়া পরীক্ষা শুরু করা ভাল অনেকগুলি ছাত্র লইয়া তখন যদি পরিবর্ত্তন আবশ্যক হয়, সহজ হইবে না। আপাতত শালবাগানের দুই ঘরে নগেন আইচের তত্ত্বাবধানে আরও গুটি কয়েক ছাত্রের সঙ্গে একত্র রাখিলে কেন অসুবিধা হইবে বুঝিতে পারিতেছি না। আপনারা মুসলমান রুটিওয়ালা পর্যন্ত চালাইয়া দিতে চান, ছাত্র কি অপরাধ করিল? এক সঙ্গে হিন্দু–মুসলমান কি এক শ্রেণীতে পড়িতে বা একই সঙ্গে খেলা করিতে পারে না? … প্রাচীন তপোবনে বাঘে–গরুতে এক ঘাটে জল খাইত, আধুনিক তপোবনে যদি হিন্দু–মুসলমান একত্রে জল না খায় তবে আমাদের সমস্ত তপস্যাই মিথ্যা। আবার একবার বিবেচনা করিবেন ও চেষ্টা করিবেন যে আপনাদের আশ্রমদ্বারে আসিয়াছে তাহাকে ফিরাইয়া দিবেন না – যিনি সর্ব্বজনের একমাত্র ভগবান তাঁহার নাম করিয়া প্রসন্নমনে নিশ্চিন্ত চিত্তে এই বালককে গ্রহণ করুন; আপাতত যদিবা কিছু অসুবিধা ঘটে সমস্ত কাটিয়া গিয়া মঙ্গল হইবে।”৫৬ দুঃখের বিষয়, মানবতার কাছে রবীন্দ্রনাথের এতবড় আবেদনটি ব্যর্থ হল, স্রেফ কিছু রক্ষণশীল পণ্ডিতমন্য শিক্ষক ও আশ্রমিকের আপত্তিতে।

আরও দশ বছর পর ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ সফল হলেন সৈয়দ মুজতবা আলিকে শান্তিনিকেতনের সদস্য করতে। বোধহয় এই কারণেই বড় বেদনার সঙ্গে ১৯৩১ সালে মুজতবা আলির সঙ্গে কথোপকথনে রবীন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছিলেন, “বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসবেন কাঁচি হাতে করে? … সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু–মুসলমান আর কতদিন আলাদা হয়ে থাকবে?”৫৭

মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আমরা এখনও কি দিতে পেরেছি?

তথ্যসূত্র :

১) রবীন্দ্র রচনাবলী সপ্তবিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৩২২

২) রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক প্রথম খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩৯,

৩) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী, জিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ৪৪২

৪) আমাদের শান্তিনিকেতন, সুধীরঞ্জন দাস, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩৪

৫) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী, জিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ৪৪২

৬) শান্তিনিকেতন আশ্রম, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়-জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, থ্যাকার স্পিঙ্ক, পৃষ্ঠা ১৫-১৭

৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭

৮) রবিজীবনী প্রথম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স,পৃষ্ঠা ৪২

৯) মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজিতকুমার চক্রবর্তী, জিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ৪৪২

১০) শান্তিনিকেতন আশ্রম, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়-জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, থ্যাকার স্পিঙ্ক, পৃষ্ঠা ১১

১১) রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক প্রথম খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩৯

১২) রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন, প্রমথনাথ বিশী, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃষ্ঠা ১৭

১৩) শান্তিনিকেতন আশ্রম, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়-জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, থ্যাকার স্পিঙ্ক, পৃষ্ঠা ১১-১২

১৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩

১৫) জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৪৫

১৬) রবীন্দ্র রচনাবলী সপ্তবিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৩৩৩

১৭) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩৪

১৮) জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৪৬

১৯) শান্তিনিকেতন আশ্রম, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়-জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, থ্যাকার স্পিঙ্ক, পৃষ্ঠা ১৪

২০) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪

২১) রবিজীবনী তৃতীয় খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৮৪

২২) রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৫৫

২৩) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৭

২৪) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় গড়তে চাইলেন বলেন্দ্রনাথ, রাহুল হালদার, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

২৫) রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক চতুর্থ খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩১৩

২৬) রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৭২

২৭) বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, শোভন সোম, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৭৯

২৮) রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৭২

২৯) রবীন্দ্র রচনাবলী সপ্তবিংশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৩৩৬

৩০) রবীন্দ্র রচনাবলী অষ্টাদশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী প্রকাশন, পৃষ্ঠা ৩৮৫-৩৮৬

৩১) বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, শোভন সোম, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৮১

৩২) রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৭২

৩৩) রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক দ্বিতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩২

৩৪) বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, শোভন সোম, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৭৯

৩৫) রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২১৮

৩৬) চিঠিপত্র ষষ্ঠ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩৩

৩৭) রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক দ্বিতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৪২

৩৮) রবিজীবনী পঞ্চম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৪৪

৩৯) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪

৪০) চিঠিপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃষ্ঠা ৯

৪১) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৪-১৬৯

৪২) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭২

৪৩) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪৬

৪৪) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০

৪৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৯

৪৬) শওকতকে সঙ্গে নিয়ে খেতে যেতেন বিধুশেখর শাস্ত্রী,বিশ্বজিৎ রায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ জুলাই, ২০১৯

৪৭) রবীন্দ্রনাথের কথা, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সান্যাল  কোম্পানী, পৃষ্ঠা ৪১

৪৮) চিঠিপত্র ত্রয়োদশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, পৃষ্ঠা ১১

৪৯) রবীন্দ্রনাথের কথা, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সান্যাল  কোম্পানী, পৃষ্ঠা ৪৩

৫০) গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন, সৈয়দ মুজতবা আলি, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৮০

৫১) বলেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, শোভন সোম, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৮১

৫২) গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন, সৈয়দ মুজতবা আলি, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ৬৩

৫৩) চিঠিপত্র ষষ্ঠ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬

৫৪) রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য প্রবেশক দ্বিতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, পৃষ্ঠা ৩৪

৫৫) প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৫

৫৬) রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ২৪৭

৫৭) গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন, সৈয়দ মুজতবা আলি, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা ১৫

মন্তব্য তালিকা - “প্রসঙ্গ শান্তিনিকেতন: কিছু কথা”

  1. আপনার আলোচনা অত্যন্ত সুন্দর ও তথ্য সমৃদ্ধ। লেখাটির জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য জানতে চাই, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক কত টাকার বিনিময়ে ভুবনডাঙার জমি কেনেন? তা পাট্টা করার সময় দেন না জমি হস্তান্তরের রেজিস্ট্রির সময় দেন?

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।