সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

প্রাগৈতিহাসিক মানুষের সভ্যতার উত্থান – পর্ব ১

প্রাগৈতিহাসিক মানুষের সভ্যতার উত্থান – পর্ব ১

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

এপ্রিল ৩০, ২০২২ ৫৭১ 2

মানব বিবর্তন চলাকালীন সময়ে মস্তিষ্কের আকার তিন গুণ বেড়ে যায়। আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক যে কোন জীবিত প্রাইমেটের মধ্যে বৃহত্তম এবং সবচেয়ে জটিল। বৃহৎ এবং জটিল মস্তিষ্ক প্রচুর তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সঞ্চয় করতে পারে।

এপের মস্তিষ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে হোমো ইরেক্টাসের শেষের দিক থেকে এই পরিবর্তন হয়েছে দ্রুত।

কেন হয়েছে এই দ্রুত পরিবর্তন?

একটা হাইপোথিসিস আছে যে, জলবায়ুর নাটকীয় পরিবর্তনের সাথে সাথে মস্তিষ্কের আকার দ্রুত বিকশিত হয়। জলবায়ুর পরিবর্তন, ফলে খাদ্য আহরণে বিপর্যয়, ফলে মস্তিষ্কের ক্ষমতা ও আকার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ঘটনাচক্রে সেই সময়ে কোন সুবিধাজনক পরিব্যক্তি এলে তা সিলেক্টেড হয়েছিল। আর তার ফলে সে প্রজনন সুবিধা পেয়ে গেল। খেয়াল রাখতে হবে যে, তখন সে পুড়িয়ে রান্না করে বিভিন্ন প্রোটিন খেতে পারছে। পরিবেশ যত অসুবিধাজনক হয়ে উঠেছে, ততই বড় মস্তিস্ক আমাদের পূর্বপুরুষদের বাঁচতে সহায়তা করেছিল।

বিপর্যয় হয়েছিল, ফলে মস্তিষ্কের ক্ষমতা কোনোভাবে বাড়ল ও সে প্রজনন সুবিধা পেল। একই সময়ে সে পুড়িয়ে রান্না করে বিভিন্ন প্রোটিন খেতে পারল।

নিচের লেখচিত্র (চিত্র ১) দেখাচ্ছে, পৃথিবীর জলবায়ু শেষ ৩০ লক্ষ বছরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। লক্ষ্য করতে হবে, শেষ ৮ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছরে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে অনেক বেশি। জলবায়ুর গ্রাফের নিচে আরেকটি গ্রাফে একই সময়ে মানব মস্তিষ্কের বৃদ্ধি দেখান হয়েছে। এখানেও শেষ ৮ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ বছরের মধ্যে মস্তিষ্কের আয়তন আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। এই গ্রাফ তৈরি করতে ১৬০টি আরকায়িক মানবের (আরকায়িক হোমো জেনাস) করোটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এন্ডকাস্ট হল মস্তিষ্কের অভ্যন্তরের প্রতিরূপ, খুলির ভেতর দিকের ছাঁচ। এন্ডকাস্ট থেকে মস্তিষ্কের ভেতরে যে মগজ ছিল তার প্রতিরূপ পাওয়া যায়।

আধুনিক মানুষের মস্তিষ্ক দশকের পর দশকের তথ্য সঞ্চয় করে রাখতে পারে, প্রয়োজন মত সেই তথ্য গোপন গহ্বর থেকে নিয়ে এসে মুহূর্তে প্রক্রিয়াকরণ করতে পারে, সেই প্রক্রিয়াজাত তথ্য বর্তমানে প্রাপ্ত কোন তথ্যের সাথে তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে প্রক্রিয়াকরণ করে সৃষ্টি করতে পারে মূর্ত বা বিমূর্ত ভাবনা, হাইপোথেসিস, চিত্র, উপন্যাস, বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ নিগূঢ় নিয়ম।

তবে এই বিশাল মস্তিষ্কের জন্য (যার ওজন দেহের ওজনের মাত্র ২%) আমাদের ২০% অক্সিজেন দিতে হয়। আর দেহের ২০% রক্ত সঞ্চালন হয় ওই মস্তিষ্কে। দ্বিপদী প্রাণী হবার ফলে (সেই সময়ে মানবের পেলভিস নেড়েঘেঁটে গেছে, হিপ্স ও জননপথ ছোট হয়ে গেছে), শরীর দীর্ঘ হবার ফলে এবং মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পাবার ফলে সবচাইতে যন্ত্রণা পায় মানুষ মা। কারণ সরু জননপথ দিয়ে বড় মাথাওয়ালা, লম্বা হাত পা নিয়ে হোমো স্যাপিয়েন্স শিশু জন্মায়। গণনা করে দেখা গেছে ৮৩০ জন মানুষ মা প্রতিদিন মারা যায় শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে। আর ১৯৯০ সালের থেকে (অর্থাৎ ৩০ বছর আগে) এই মৃত্যু আসলে ৪৪% কমেছে। ভাবতে পারেন প্রাচীন বা মধ্য যুগে মায়েদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান কী ছিল!!

এইভাবে বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে যেন এক দ্বন্দ্ব এল। দু পায়ে দাঁড়াতে হবে, তাই পেলভিস ছোট হয়ে গেল, জননপথ সরু হয়ে গেল আর বুদ্ধিমান হতে হবে তাই মস্তিষ্ক বড় হতে থাকে। এসবের ফলে মা ও অজাত শিশু বেচারি পড়ল ভীষণ অসুবিধায়। টিকে থাকার লড়াইতে বৃহৎ মস্তিষ্ক নিঃসন্দেহে এইসময় মানুষকে এসব অসুবিধা ছাপিয়ে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে পেরেছিল।

চিত্র ১- পৃথিবীর জলবায়ু শেষ ৩০ লক্ষ বছরে কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে

জ্ঞান ও আচরণের বিবর্তনীয় পরিবর্তনের সাথে এন্ডকাস্টের আকার এবং আকারের বিবর্তনীয় পরিবর্তনগুলির সম্পর্ক স্থাপন করা খুব সহজ নয়। তবে মস্তিষ্কের বিবর্তন এবং তার সাথে সম্পর্কিত জ্ঞানাত্মক বিকাশ (কগনিটিভ  ডেভেলপমেন্ট) এবং আচরণগত পরিবর্তনগুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যেতে পারে। এটি করার জন্য, একদিকে কাঠামোগত মস্তিষ্কের বিকাশ, জ্ঞানাত্মক বিকাশ, এন্ডকাস্টের আকার এবং অন্যান্য পরিবর্তনগুলি নিয়ে আগে সামান্য আলোচনা করি।

৭ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে সাড়ে ৫ লক্ষ বছর আগে ‘হোমো হাইডেলবার্গেনসিস’-এর একটি গোষ্ঠী আফ্রিকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তার দীর্ঘদিন পরে, ৪ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার বছরের মধ্যে কোন এক সময়ে ওরা আবার বিভক্ত হয়ে যায়।

  • একটি শাখা উত্তর-পশ্চিম দিকে ইউরোপে ঢুকে পড়ে। এদের বলা হয় ‘নিয়ান্ডারথাল’।
  • অন্য শাখাটি পূর্ব দিকে এশিয়াতে চলে যায়। এই শাখাটি থেকেই বিবর্তনের পথে ‘ডেনিসোভান’-এর সৃষ্টি। ‘নিয়ান্ডারথাল’ ও ‘ডেনিসোভান’-রা আফ্রিকার বাইরে উদ্ভূত হয়েছে।
  • আর আফ্রিকাতে বসবাসকারী শাখাটি থেকে আনুমানিক ৩ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ৩ লক্ষ বছর আগে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে।

অন্তত ৫-১০ লক্ষ বছর আগে থেকে ‘হোমো ইরেক্টাস’ আগুনের অনিয়মিত ব্যবহার করেছে। পরবর্তীকালে এই বিদ্যা ‘নিয়ান্ডারথাল’ ও আধুনিক মানুষের আয়ত্তাধীন হয়। ওরা আগুনে পুড়িয়ে মাংস ও বিভিন্ন কন্দ খেতে শেখে। অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরে আধুনিক মানুষ, তার পূর্বসূরী ও আত্মজন খাবার পুড়িয়ে খাচ্ছে। ‘হোমো ইরেক্টাস’ বা ‘নিয়ান্ডারথাল’-দের মস্তিষ্কের পরিমাণও কম ছিল না। সত্যি কথা বলতে, ‘নিয়ান্ডারথাল’-এর মস্তিষ্কের পরিমাণ আধুনিক মানুষের থেকে বেশি ছিল। তবু কেন আধুনিক মানুষ সকলকে পিছনে ফেলে এক সময়ে পূর্ণবেগে দৌড়াতে শুরু করল?

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ রিচার্ড ক্লাইন মনে করেন, আজ থেকে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের এক জিনগত পরিব্যক্তি ঘটেছিল। এই পরিব্যক্তি মানুষের চিন্তাধারা ও আচরণে এক আকস্মিক বিপ্লব ঘটায়। তার ‘দ্য ডন অফ হিউমান কালচার’ বইয়ে বলেছেন, এর আগে মানুষের শারীরবৃত্তীয় এবং আচরণগত পরিবর্তন খুব ধীরে ধীরে হয়েছে। পরবর্তীতে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন নাটকীয়ভাবে ত্বরান্বিত হয়। ৫০ হাজার বছর আগে আধুনিক মানুষের চিন্তায় ঘটে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’, এর ফলে সে এক মাঝারি গোছের স্তন্যপায়ী থেকে বিরাট শক্তিধর হয়ে ওঠে।

তিনি অনুমান করেন, ওই সময়ে কিছু আকস্মিক জিনগত পরিব্যক্তি মস্তিষ্কে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটায়; ফলে আধুনিক মানুষের পক্ষে গোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করা সহজ হয়।

অবশ্য এই ধারণাটি পরবর্তীকালে কিছুটা সরলীকৃত হিসেবে বিবেচিত হয়।

  • এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, অন্তত ৭৩ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লম্বস গুহায় পুরনো নকশা-করা দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া গেছে। ওইখানে ঝিনুকের পাত্রে লাল গিরিমাটি, ছিদ্রযুক্ত সমমাপের শেলের পুঁতি, জ্যামিতিক নকশা-করা পাথর ইত্যাদি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ সেই সময়েও ‘আধুনিক মানুষ’ কল্পনা করতে শিখেছে, আঁকতে পেরেছে। চোখের সামনে যা নেই, সেই বিমূর্ত ধারণার অল্পসল্প প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ব্লম্বস গুহার প্রত্নদ্রব্য প্রমাণ করে, রিচার্ড ক্লাইন দ্বারা নির্দিষ্ট ৫০ হাজার বছরের আগে থেকেই আধুনিক মানুষ তার চিন্তায় বিমূর্ত ধারণার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বিমূর্ত প্রতীকের মাধ্যমে চিন্তাভাবনা করা এবং অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা সমস্ত সৃজনশীলতার প্রাথমিক পদক্ষেপ। এর থেকেই জন্ম নেয় শিল্প, সঙ্গীত, ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান। ৭৩ হাজার বছর আগেকার ওই মানুষ প্রতিদিন যথেষ্ট পরিমাণে খাবার পায়নি। নিত্য তাদের লড়াই করতে হয়েছে সিংহের সঙ্গে, হায়েনার সঙ্গে। তবুও সে জোগাড় করেছে লালচে রঙের ফেরিক অক্সাইড। সেই ফেরিক অক্সাইড গুঁড়ো করেছে নিটোল পাথর দিয়ে। তারপরে একটা ঝিনুকে সেই গুঁড়ো ফেরিক অক্সাইড দিয়ে তৈরি করেছে রং। কেন রং তৈরি করা হত সেকথা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও এটা সুস্পষ্ট যে, ওরা ওখানে নিয়মিত রং তৈরি করত। নিয়মিতভাবে রং তৈরি করার অভ্যাস থেকে এটাও বোঝা যায় যে, ওদের চিন্তা করার প্রক্রিয়া ছিল উন্নত (চিত্র ২)।

চিত্র ২ -অন্তত ৭৩ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লম্বস গুহায় সমমাপের শেলের পুঁতি পাওয়া গেছে

  • প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কবর খুঁজে পাওয়া ও তার থেকে প্রাচীন দেহাবশেষ উদ্ধার করা খুব দুরূহ কাজ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা আফ্রিকার মানুষের আপাতত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম কবরস্থানের খোঁজ পেয়েছেন আফ্রিকার কেনিয়াতে। প্রায় ৮০,০০০ বছর আগের সমাধিতে একটি শিশুর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে (চিত্র ৩)। খেয়াল রাখতে হবে এই কবরস্থান ব্লম্বস গুহারও পূর্ববর্তী। হাড়গুলির বিন্যাস দেখে বোঝা যায় যে, শিশুটি ছিল তিন বছর বয়সের। মৃত শিশুটির পা ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখা ছিল। সম্ভবত বালিশে মাথা দিয়ে দেহটি শক্ত করে কাপড়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছিল। তারপরে সযত্নে মাটিতে রেখে ওপরে মাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেনিয়ায় সমুদ্রের তীর থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে উপকূলীয় সমভূমির পানগা ইয়া সাইদি গুহার মুখে মেঝে খুঁড়ে গবেষকরা হাড়গুলি আবিষ্কার করেছেন। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান হিস্ট্রির মানব বিবর্তন ও প্রাগিতিহাসের অধ্যাপক মাইকেল পেট্রাগ্লিয়া বলেছিলেন, “এটি আফ্রিকার প্রাচীনতম কবরস্থান। প্রাগৈতিহাসিক সময়ে মানুষের সমাজ, বুদ্ধিমত্তা ও আচরণ সম্পর্কে এই আবিষ্কার কিছু তথ্য দেয়। আর উপলব্ধি করা যায় ওদের সেই আচরণ আমাদের কাছে খুব পরিচিত”।

চিত্র ৩ -আফ্রিকার কেনিয়াতে প্রায় ৮০,০০০ বছর আগের সমাধিতে একটি শিশুর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গেছে

  • দক্ষিণ আফ্রিকার শিবুডু গুহায় অন্তত ৭৭ হাজার বছর আগের পাথরের সূক্ষ্ম সরঞ্জাম, দক্ষতার সাথে তৈরি হাড়ের জিনিসপত্র, মাটিতে খোঁড়া আখা, আগুনে পোড়া বড় এবং ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর হাড়, ঘাসের তৈরি বিছানা, লাল গিরিমাটি এবং সমুদ্রের শেল থেকে তৈরি ঝলমলে পুঁতি পাওয়া গেছে। এই সাইটটি আধুনিক মানুষের জ্ঞানাত্মক বিকাশ সম্পর্কে ধারণা দিতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
  • ওই একই গুহায় ৬৪ হাজার বছর আগের পাথরে তৈরি তীরের ফলা পাওয়া গেছে, তাতে রক্ত ও হাড় লাগানো ছিল। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত এটাই সব চাইতে পুরনো তীরের ফলা। তীর ধনুক সরঞ্জামের চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিশাল উল্লম্ফন (চিত্র ৪)। প্রাথমিক তীর-ধনুক তৈরির পাশাপাশি ছোট প্রাণীগুলি ধরার জন্য ফাঁদ এবং ফাঁদগুলির স্পষ্ট ব্যবহার করার প্রমাণ পরিকল্পনা করার ক্ষমতার দাবি রাখে। প্রাথমিক তীর-ধনুক তৈরির পাশাপাশি ছোট প্রাণী ধরার জন্য ফাঁদ এবং ফাঁদগুলির স্পষ্ট ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে, এর থেকে সেই মানুষের পরিকল্পনা করার ক্ষমতা বোঝা যায়।

চিত্র ৪ – শিবুডু গুহায় ৬৪ হাজার বছর আগের পাথরে তৈরি তীরের ফলা পাওয়া গেছে

অর্থাৎ রিচার্ড ক্লাইননের নির্ধারিত ৫০ হাজার বছরের অনেক আগেই আধুনিক মানুষ রং তৈরি করছে, জমকালো মালা পরছে, পাথরে ক্রসহ্যাচ আঁকছে, তীর তৈরি করে শিকার করছে।

আফ্রিকার বাইরে মানুষের সফল পরিযান হয়েছিল ৭০-৭২ হাজার বছর আগে, তাকে বলে ‘আউট অফ আফ্রিকা মাইগ্রেশন’ বা মহাপরিযান – তার আগেই সে ছিল চিন্তায় অন্যদের থেকে কিছুটা উন্নত।

তবে এও পুরো চিত্র নয়।

  • মানুষ বস্ত্র হিসাবে পশু চর্ম ব্যবহার করছে অন্তত ১ লক্ষ বছর আগে থেকে। পোশাকের উকুন উদ্ভূত হয়েছিল মাথার উকুনের থেকে, আর তার থেকে পোশাকের উকুনের উদ্ভবের সময়কাল সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। তার থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ১ লক্ষ ৭০ হাজার থেকে ৮৩ হাজার বছরের মধ্যে পোশাকের উকুন উদ্ভূত হয়ে গেছে। এখানেও কিন্তু বোঝা যায় যে, আফ্রিকার থেকে মহাপরিযানের আগেই সে পোশাক পড়তে শুরু করেছে। তবে যে আর্কাইক হোমিনিনরা তুষার যুগের শৈত্যে ইউরেশিয়ায় থাকত, তারাও পোশাক ব্যবহার করত কিনা জানা যায় না। কারণ, তারা লুপ্ত, সাথে সাথে সেই পোকাও লুপ্ত। অন্তত এটুকু বলা যায় যে, আধুনিক মানুষ আফ্রিকা থেকে মহাপরিযানের আগেই বস্ত্র পরতে শিখেছে।
  • দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়াজুলু-নাটাল অঞ্চলের বর্ডার গুহা পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষ সম্পর্কে আরেকটি  প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞানের সমৃদ্ধ উৎস। এই গুহায় স্ট্র্যাটিগ্রাফিক রেকর্ড সংরক্ষিত রয়েছে। সম্প্রতি বর্ডার গুহায় প্রায় ২ লক্ষ বছর আগের ঘাসের বিছানার আবিষ্কারের খবর সায়েন্স জার্নালে দেওয়া হয়েছে। বিছানাটি ছাইয়ের সাথে মেশানো ছিল। বিছানার মধ্যে পোড়া হাড় এবং গোলাকার গিরিমাটির দানা ছিল। লেখক অনুমান করেছেন যে, বিছানায় ইচ্ছাকৃতভাবে ছাই দেওয়া হয়েছিল পোকার কামড় থেকে বাঁচতে। ছাইয়ের ব্যবহার করা হয়েছিল বিভিন্ন ডানাবিহীন মাছির (টিক্স এবং অন্যান্য আর্থ্রোপড) বিছানায় চলাচলে বাধা দেওয়ার জন্য। ২ লক্ষ বছর আগে মানুষ শুধু পাতার তৈরি বিছানায় শুতো না, তারা ছাই ব্যবহার করে বিছানায় পোকা চলাচলের গতিরোধ করত, আবার গিরিমাটির টুকরোতে গা ঘষে দেহে লাল রঙের দাগ করত (চিত্র ৫)। তাহলে গায়ে ট্যাটু আঁকা কোনমতেই আধুনিক কোন বিলাস নয়, অন্তত দুই লক্ষ বছর ধরে মানুষ গায়ে রংচং করছে। বিছানার পশে আগুন জ্বালানোর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ যেন দার্জিনিঙের শীতে বিছানায় বসে আগুনের তাপ পোয়াতে পোয়াতে আড্ডা মারার জায়গা, অথবা ঘরের সবচাইতে কোজি কর্নারে দুএকটা কাজ করে নেওয়া যায় পায়ে আগুনের তাপে পোহাতে পোহাতে।

চিত্র ৫ -বর্ডার গুহায় প্রায় ২ লক্ষ বছর আগের ঘাসের বিছানা

  • মানুষ রান্না করা শ্বেতসার প্রধান খাবারের প্রারম্ভিক প্রমাণগুলি অপ্রতুল। তবে শ্বেতসার প্রধান (স্টার্চি ) শিকড়ের ব্যবহার ছিল মানুষের খাদ্যতালিকায় এক নতুন উদ্ভাবন। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ডার গুহায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার বছর আগে মানুষ রান্না করা শ্বেতসার প্রধান খাবারের প্রারম্ভিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। খাদ্যযোগ্য হাইপোক্সিস বংশের উদ্ভিদের পোড়া কন্দ সনাক্ত করা গেছে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ ভূগর্ভস্থ কন্দ রান্না করার প্রথম দিকের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ভোজ্য হাইপোক্সিস কন্দগুলি গুহায় রান্না করে খাওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। হাইপক্সিসের বিস্তৃত ভৌগলিক বিস্তার ইঙ্গিত করে, কন্দগুলি আফ্রিকার হোমো স্যাপিয়েন্সদের জন্য নির্ভরযোগ্য কার্বোহাইড্রেট উৎস হতে পারে। সম্ভবত জনগোষ্ঠীর পরিযানের সাথে সাথে এই কন্দ আফ্রিকাযা ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে মানুষ কন্দ প্রান্তর থেকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে সংগ্রহ করে গুহায় এনে পুড়িয়ে খেত।
  • ২ থেকে ১.৫ লক্ষ বছর আগে মানুষ পাতার বিছানায় শুয়েছে, দেহ রং করতে চেয়েছে।
  • ১.৭ লক্ষ বছর আগে প্রান্তর থেকে কন্দ কুড়িয়ে গুহায় ফিরে আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছে।
  • আর ১.৩ থেকে ১ লক্ষ বছর আগে সে চামড়া দিয়ে শরীর ঢেকেছে।

মানুষের মস্তিষ্কের বৃদ্ধির সাথে সাথে তার কর্মক্ষমতা ও জ্ঞানাত্মক বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) বৃদ্ধি পেয়েছে।

  • আবার ৮০ হাজার বছর আগে সে মৃত শিশুকে অতি যত্নে কবর দিয়েছে, পাথরে ক্রশ হ্যাচ এঁকেছে, অতি যত্নে শেলের মালা তৈরি করেছে, রং মিশিয়েছে ঝিনুকের প্যালেট–এ।
  • ৬৪ হাজার বছর আগের পাথরে তৈরি তীরের ফলা তৈরি করেছে।

এগুলো নিঃসন্দেহে সভ্যতার মাইলফলক।

তথ্যসূত্র-

  1. “What does it mean to be human”, Smithsonian National Museum of Natural History.
  • Melissa A. Toups et al., “Origin of Clothing Lice Indicates Early Clothing Use by Anatomically Modern Humans in Africa,” Molecular Biology and Evolution, 28(1), (2011), pp. 29–32.
  • Wadley, Lyn, et. al., “Fire and grass-bedding construction 200 thousand years ago at Border Cave, South Africa”, Science, Vol. 369, Issue 6505, 14 Aug 2020, pp. 863-866.
  • Wadley, Lyn, et. al, “Cooked starchy rhizomes in Africa 170 thousand years ago”, Science, Vol. 367, Issue 6473, 3 Jan 2020, pp. 87-91.
  • Balter, Michael, “South African Cave Slowly Shares Secrets of Human Culture”, Science, Vol. 332, Issue 6035, 10 Jun, 2011, pp. 1260-1261.
  • Martinn-Torres, M., d’Errico, F., Santos, E. et al., “Earliest known human burial in Africa”, Nature 593, 2021, pp. 95–100.
  • Will Dunhum, “Child’s burial 78,000 years ago in Kenya was a Homo sapiens milestone”, Science, 5 May, 2021.
লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “প্রাগৈতিহাসিক মানুষের সভ্যতার উত্থান – পর্ব ১”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।