সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মহেঞ্জোদারোর কঙ্কাল কথা

মহেঞ্জোদারোর কঙ্কাল কথা

তুষার মুখার্জী

অক্টোবর ১০, ২০২০ ১৮৭৯ 15

মহেঞ্জোদারো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কঙ্কালগুলো নানা জল্পনা কল্পনার জনক। জল্পনা-কল্পনার প্রেরণা হল এই কঙ্কালগুলো নিয়ে প্রকৃত তথ্যের প্রচারের অভাব। এই কঙ্কালগুলোর সম্বন্ধে সব তথ্য, একত্রে এক জায়গায় পাওয়া কঠিন। এই লেখায়, এই কঙ্কালগুলো নিয়ে যাঁরা সরাসরি কাজ করেছেন শুধু তাঁদের লেখা তথ্যকেই স্থান দেওয়া হল। চেষ্টা রইল সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান হোক।

প্রথমেই বলা যাক কঙ্কালের সংখ্যার কথা। কতগুলো কঙ্কাল মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া গিয়েছিল? সাধারণত বলা হয় ৩৭টি। এমনিতেই সংখ্যাটা ভুল, তা ছাড়া, একদম গোড়া থেকে খানিকটা অস্পষ্টতা থাকায় এই সংখ্যাও সবার লেখায় এক থাকেনি। প্রথম ধাপে পাওয়া গেছে ২৬টি কঙ্কাল। তবে এর মধ্যে একটি কলকাতায় আনার সময় মাঝপথে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল।

এরপরের ধাপে ম্যাককের আমলে বের হয় আরও ১৫টি কঙ্কাল। অতএব সহজ হিসাব ২৬+১৫=৪১(-১)কঙ্কাল। ৪১টি কঙ্কালর মধ্যে আছে সাতটি শিশু। তারপরে ডেলসের খনন থেকে পাওয়া গেল আরও ৫টি (১৯৬৪-৬৫)। সর্বমোট ২৬+১৫+৫ = ৪৬টি (১টি নিখোঁজ) এবং আলাদা করে না বলা থাকলেও, ZSI তালিকা অনুযায়ী আরও একটি নিখোঁজ।

আর্নেস্ট জন হেনরি ম্যাককে (১৮৮০-১৯৪৩)

এবার এর সাথে যোগ করতে হবে ছটি মাটির পাত্রে ভরা হাড়। যেহেতু এই পাত্রগুলোতে কতজন ব্যক্তির কঙ্কাল আছে তা বলা অসম্ভব (মাত্র একটি পাত্রে একটি খুলি ছিল) তবু ধরতে পারি ৬টি পাত্র মানে ৬টি মৃতদেহ। কিন্তু না, কঙ্কালের হিসাবে তা কেউ ধরেননি। কেন ধরা হয় নি?

এর মুল অসুবিধা হল, আরও বেশ কয়েকটি পাত্র পাওয়া গেছে যেগুলো ‘পাত্র-কবর’ ভাবা যেতে পারত, কিন্তু তার মধ্যে যে হাড় পাওয়া গেছে তা যে মানুষেরই হাড় তা নিয়েও নিঃসন্দেহ হওয়া কঠিন। কলকাতার ZSI অফিসে এক বাক্স হাড়গোড় এসেছিল। তার মধ্যে তথ্য বলতে শুধু বাক্সের উপরে লেখা ছিল ‘M’ অক্ষরটি। সেগুলো নিয়ে ZSI কোন কাজ করেনি। অনুমান করা যেতে পারে ঐ ‘M’ লেখা বাক্সে ভরা ছিল মাটির পাত্রে পাওয়া প্রায় ২ কিলো ওজনের হাড়গোড়, একটি খুলি আর একটি আঙুলের হাড়ের টুকরো। যাই হোক, অফিসিয়ালি লেখা তালিকায় নিখোঁজ সহ ৪৭টির মধ্যে ১টিকে বলা হচ্ছে প্রায় আধুনিক কালের। সম্ভবত মাত্র কয়েক’শ বৎসরের পুরানো।

তাহলে সব মিলিয়ে আমরা ধরতে পারি ৪৭, নিখোঁজ ১ বাদ দিয়ে হল ৪৬, তার থেকে বাদ যাবে আরও একটি, তুলনামূলকভাবে আধুনিক কালের বলে। অতএব শেষ সংখ্যা হল ৪৫টি। কিন্তু একটি একটি করে কঙ্কালের হিসাবে এর সবক’টির খবর পাওয়া দুর্ঘট। এমনকি লিখে রাখা নম্বর ধরেও মেলানো কঠিন। যে ভাবে উল্লেখ পেয়েছি একাধিক বই ঘেঁটে সেটাই নীচে দিলাম। প্রত্নক্ষেত্রেই কঙ্কালগুলোকে ধারাবাহিক সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল, প্রথম পাওয়াটিকে প্রথম সংখ্যা ধরে।

মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন এলাকাগুলির নকশা

কঙ্কাল ১-৪

১ থেকে ৪ সংখ্যার কঙ্কালগুলো যথাযথ কবরে ছিল বলা হয়েছে।

কঙ্কাল-১ এর কবরটি HR এলাকার বাড়ি-I এর উঠানে ছিল।

কঙ্কাল-২ এর কবরটিও HR এলাকায়, শুধু করোটি ছিল কবরে।

কঙ্কাল-৩, HR এলাকার বাড়ি-V ঘর-13, মাটির দুই ফুট নিচে হাঁড়ির মধ্যে খুলি আর কিছু হাড়ের টুকরো পাওয়া গেল। একেই একমাত্র মঙ্গোলিয়ান বলে বলা হয়েছে।

কঙ্কাল-৪ ছিল কবরে, HR এলাকার ঘর-74, উত্তরদিকের দেওয়ালের কাছে ২ ফুট গভীরে। কঙ্কাল প্রায় পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। কবরে ছিল কিছু তামার গয়না ও পাথরের পুঁতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই ৪-নং কঙ্কালের বেলাতেই সিওয়েল-গুহ-এর তালিকায় লেখা আছে, কিছুই নেই, অর্থাৎ কোন অজ্ঞাত কারণে সেটি কলকাতা পাঠানো হয় নি।

কঙ্কাল ৫–১৬

এই কঙ্কালগুলো ছিল একটা ছোট ঘরের (এলাকা–HR, বাড়ি-V, ঘর-74) মধ্যে। এখানে কঙ্কালগুলো যে ভাবে ছিল তাতে বলা যায় এদের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। হারগ্রীভসের ভাষায় যেভাবে একটির সাথে আরেকটি লেগে আছে তাতে মনে করা যেতে পারে কোন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে একত্রে এদের মৃত্যু হয়েছিল।

কঙ্কাল ১৭ ও ১৮

ডেডম্যান লেনের রাস্তার উপরে (এলাকা–HR সেকশন-A) কোনাকুনি ভাবে পড়েছিল চিৎ অবস্থায়, একটি খুলি আর গলার কয়েকটি হাড়। এর থেকে পনের ইঞ্চি দুরে একটি শিশুর খুলি পড়ে ছিল।

কঙ্কাল ১৯

একটি ঘরের (এলাকা–HR, ব্লক-2, ঘর-39) মেঝের ছয় ফুট নীচে পাওয়া গেছে একটি মহিলার খুলি।

কঙ্কাল ২০-২৫

এগুলো ছিল (এলাকা-VS ঘর-18 ও ঘর-33 এর মাঝখানের রাস্তায়, অন্তঃস্তর-২) চারজন পূর্ণবয়স্ক ও একটি শিশু নিয়ে ছটি কঙ্কাল। ঝুরো মাটি দিয়ে ঢাকা।

কঙ্কাল ২৬ (নিখোঁজ?)

দুটি বাড়ির যাতায়াতের পথের (এলাকা-VS, ব্লক-4, ঘর-21) নীচের কুঠুরিতে ডিম্বাকৃতি মাটির পাত্রে খুলির অংশ ও আঙুলের টুকরোকেই কঙ্কাল ২৬ বলা হয়েছে।

কঙ্কাল ২৭-৩৫

কঙ্কালগুলি পাওয়া যায় এলাকা DK, ব্লক-9, ঘর-2 এর গা ঘেঁষে গলির মধ্যে। নয়টি কঙ্কালের মধ্যে চারজন পূর্ণ বয়স্ক আর পাঁচ জন শিশু। এদের মধ্যে ৩০ আর ৩৪ নং কঙ্কালে পোড়ার চিহ্ন আছে। আর একটি শিশুর মাথা কেটে নেওয়া হয়েছিল। ২৭ নং কঙ্কাল (পূর্ণবয়স্ক পুরুষ)-এর খুলিতে খুব জোরে আঘাতের ফলে ভাঙ্গা, (খুলির ক্ষত ১২৭ মিমি লম্বা, ৩০ মিমি চওড়া)। ৩১ নং কঙ্কালটি একটি শিশুকন্যার।

কঙ্কাল ৩৬

এই কঙ্কালটির (এলাকা DK, ব্লক-7 বাড়ি-I, ঘর-19) শুধু একটি করোটি পাওয়া গেছে মেঝের আট ফুট নীচে।

কঙ্কাল ৩৭, ৩৮, ৩৯

এই কঙ্কালগুলির কোন উল্লেখ নেই।

কঙ্কাল ৪০

কঙ্কালটি পূর্ণ বয়স্ক, সম্ভবত নারীর (এলাকা DK, ব্লক-1)। ওয়েস্টার্ন কোর্টের উত্তর পশ্চিম কোনে কঙ্কালটির করোটি পাওয়া গেছে।

কঙ্কাল ৪১-৪৪

এই চার জনের মধ্যে দু’জন শিশু আর দু’জন পূর্ণ বয়স্ক। তবে একমাত্র কঙ্কাল-৪৪ কে পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ বলে সঠিক বোঝা গেছে। দুটো কঙ্কাল পাওয়া গেছে উঁচু রাস্তা থেকে কুয়োতলায় নেমে আসার সিঁড়িতে (এলাকা DK, ব্লক-4A ঘর-42 বা কুয়া ঘর)। বাকিদের পাওয়া গেছে কুয়োতলা ঘরে যাবার পথের উপর।

কঙ্কাল ডি১, ডি-২, ডি-৩, ডি৪ ও ডি-৫

১৯৬৪ সালে ডেলসের খনন কাজের দ্বিতীয় দিনেই (এলাকা HR) মাত্র দুই ফুট নীচে পাওয়া গেল তিনটি কঙ্কাল। একটি মাঝ বয়সী পুরুষ একটি তরুণী আর একটি শিশু। তারপরেই কয়েক ফুট দুরেই, একই সময়স্তরে, পাওয়া গেল আরও দুটি পূর্ণ বয়স্ক পুরুষের কঙ্কাল। মোট সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচটি। বর্তমানে কঙ্কালগুলো সম্ভবত পাকিস্তানেই আছে। কারণ ডেলসের প্রজেক্ট ছিল পাকিস্তানের আর্কিওলজি বিভাগের সাথে যুগ্ম ভাবে। এই কটি কঙ্কালকে আমি আলাদা করে বোঝার সুবিধার জন্য ‘ডি-১’, ‘ডি-২’, ‘ডি-৩’, ‘ডি-৪’, ‘ডি-৫’ – এইভাবে নামকরণ করলাম।

জর্জ ফ্রাংকলিন ডেলস্‌ জুনিয়ার (১৯২৭ – ১৯৯২)

কঙ্কালগুলির নৃতাত্ত্বিক বিবরণ

আমাদের মনে সবার আগে যে প্রশ্ন আসে, কঙ্কালগুলো এখন কোথায় আছে? যতটা জানতে পেরেছি, উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি তবে সবগুলোর খবর যোগাড় করতে পারিনি। প্রথমবারে পাওয়া ২৬টি (আদতে ২৪টি ও এক বাক্স খুচরো হাড়) আসে Zoological Survey of India-র কলকাতা অফিসে, তবে ঠিক কোথায়, তা জানা সম্ভব হয়নি। এমনিতে ZSI-এর প্রায় সব কিছু থাকে কলকাতার Indian Museum এ। ZSI-এর অধুনা ডিজিটাইজড লাইব্রেরীতে এ নিয়ে কোন লেখা আমার চোখে পড়েনি। হরপ্পার কঙ্কালগুলো কিন্তু আছে Anthropological Survey of India-র কলকাতা অফিসের Anthropological Museum-এ।

কিন্তু মানুষের কঙ্কাল Zoological Survey of India-র কাছে কেন? ঘটনা হল, ভারতে ১৯১৬ সাল থেকে ছিল শুধু ZSI, পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ZSI ভাগ হয়ে আলাদা করে Anthropological Survey India তৈরি হয়। ZSI-তে ২৪টি কঙ্কালের উপরে পরীক্ষার কাজে ছিলেন সিওয়েল (R. B. Seymour Sewel, Director of ZSI) ও গুহ (Dr. B. S. Guha, নৃতত্ত্ববিদ যার নেতৃত্বে পরবর্তীকালে আলাদা করে Anthropological Survey India তৈরি হয় এবং তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা-অধিকর্তা)। আর এই কাজে সহকারী ছিলেন প্রভাস চন্দ্র বাসু, বজ্র চট্টোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি চক্রবর্তী প্রভৃতিরা।

জন মার্শাল (১৮৭৬ – ১৯৫৮)

১৯৩১ সালে জন মার্শালের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘Mohenjo-Daro and Indus Civilization’- গ্রন্থে সিওয়েল ও গুহ এই কঙ্কালগুলোর পরীক্ষার কথা সবিস্তারে লিখেছিলেন। সেখান থেকেই জানতে পারি তাঁদের কাছে ২৬টি কঙ্কাল পাঠানোর কথা লেখা থাকলেও এসে পৌঁছেছিল ২৪টি অর্থাৎ দুটি কম।

কেমন অবস্থা ছিল সেই কঙ্কালগুলোর? প্রথমত প্রায় কোন কঙ্কালেরই পুরোটা পাওয়া যায় নি। আর যে মাটিতে এগুলো এতদিন ছিল তার নিজস্ব চরিত্রে হাড়গুলোতে খুব বেশি নোনা ধরে গিয়েছিল। নোনা এতটাই বেশি যে খোলা হাওয়ায় সেগুলো খুব দ্রুত ঝুরঝুরে হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। হাড় এমনই ভঙ্গুর ছিল যে মাপজোক নেওয়াও কঠিন ছিল। তাই প্রথমেই অ্যালকোহল আর গালার মিশ্রণের প্রলেপ বারে বারে দিতে হয়েছে। অনেক সময় করোটিতে লেগে থাকা মাটি পর্যন্ত ছাড়ানো সম্ভব হয়নি। মাটিসহ করোটিতেই গালার প্রলেপ দিয়ে সেগুলোকে ফসিলের অবস্থায় আনতে হয়েছিল।

এই কঙ্কালগুলো দেখে ওনাদের প্রথমেই যে ধারনা হয় তা হল, মহেঞ্জোদারোর কঙ্কালের সাথে নাল, বেলুচিস্তান, মাকরান প্রত্নএলাকা থেকে পাওয়া কঙ্কালের মিল আছে। এখানে বলা দরকার যে, ঐ সব অঞ্চলের কঙ্কালও ওনাদের কাছেই এসেছিল পরীক্ষার জন্য।

তখনও কার্বন ডেটিং, C.T. Scanning এসব ছিল না, প্যালিও-ফরেন্সিক আসতেও অনেক দেরী। তাই যা করা হত তা হল, মূলত দৈহিক উচ্চতা বের করা, কোন দৈহিক বিকৃতি বা গভীর অস্ত্রাঘাত আছে না নেই তা দেখা। আর খুলি, দাঁত ও নাকের মাপ দেখে কঙ্কালটি কোন জাতি বা জনগোষ্ঠীভুক্ত তা অনুমান করা। মহেঞ্জোদারোর বেলায় সেই খুলির মাপজোকগুলোও খুব একটা সুষ্ঠু ভাবে করা যায় নি। প্রসঙ্গত বলি, খুলির মাপ নিয়ে জাতি নির্ধারণ পদ্ধতি কিন্তু এখন খুব একটা জনপ্রিয় নয়।

বিরাজাশঙ্কর গুহ (১৮৯৪ – ১৯৬১)

কলকাতায় আসা ২৬টি কঙ্কালের মধ্যে তথ্য অনুযায়ী ২১টি পুরো কঙ্কাল, তিনটি শুধু করোটি, আর একটি আসেইনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের আগের বক্তব্যের সাথে পাঠক হয়তো এই কথার মিল পাচ্ছেন না, তাই এবার আর একটু গভীরে তত্ত্বতালাশ করবো। ২৬টির মধ্যে ১৭টি আবিষ্কার করেছিলেন হারগ্রীভস (১৯২৫-২৬), সেগুলোর সাথে হারগ্রীভসের ফিল্ড নোটও ছিল। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষার বিশদ বিবরণে দেখা গেল তিনটি নয়, বেশ কয়েকটিই ছিল শুধু করোটি, খুব বেশি হলে মেরুদণ্ডের সামান্য অংশ সাথে লেগে ছিল। এম এস ভাটের উদ্ধার করা ছটি কঙ্কাল, একটি খুলি সহ খুচরো হাড়ের বিশদ ফিল্ড নোট ছিল না। তবে সিওয়েল ও গুহ নিজেরা সেগুলো দেখে এসেছিলেন বলে অসুবিধা তেমন হয় নি। কঙ্কালের উচ্চতার মাপ বের করা হয়েছে মূলত হাত-পায়ের হাড়ের মাপ থেকে, তখনকার প্রচলিত ফর্মুলা অনুযায়ী। ZSI-তে প্রতিটি করোটির স্কেচ তৈরি করা হয়েছে বিশেষ ধরনের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে। সে সব স্কেচই Mohenjodaro and Indus Civilization গ্রন্থটিতে আছে।

এবার আসি নৃতত্ত্বের কথায়। সিওয়েল-গুহ মোট ২৪টি দেহাবশেষ পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের মতে মহেঞ্জোদারোর শেষ পর্যায়ের বাসিন্দাদের মোট চারটি ভিন্ন জাতিতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রোটো-অষ্ট্রোলয়েড, ভূমধ্যসাগরীয়, অ্যালপাইনও অ্যালপাইন-মঙ্গোলিয়ান। মহেঞ্জোদারোর খুলি গুলোর মধ্যে লম্বাটে খুলির (dolichocephalic cranial) আধিক্য লক্ষ্য করা গেছে। এখানে পাওয়া লম্বাটে খুলির গড়নে খুলির মেরুদণ্ডের কাছের অংশ (occipital bone) বেশ বড়, যা মেলে শ্রীলঙ্কার ভেদ্দা জনগোষ্ঠীর সাথে।

প্রোটো-অষ্ট্রোলয়েড ধরনের খুলিকে বলছেন Dolichocephalic, এই লম্বাটে খুলির লোক দেখা গেছে মেসোপটেমিয়ার কিশ, আল-উবেইড, ঊর-এ, প্রাচীন কবরখানা আদিত্যানালুর (তামিলনাড়ু), আর শ্রীলঙ্কার ভেদ্দা জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ভূমধ্যসাগরীয় ধরনের খুলিকেও Dolichocephalic বলা হয়েছে, শুধু এক্ষেত্রে খুলির আয়তন প্রোটো-অষ্ট্রোলয়েডদের থেকে ছোট। এধরনের খুলি আরও পাওয়া গেছে নাল প্রত্ন ক্ষেত্রে, মেসোপটেমিয়ার কিশ-এ, তুর্কমেনিস্তানের অ্যানাউতে ও বর্তমানের শিয়ালকোট-এ। অ্যালপাইন-মঙ্গোলিয়ান Mesaticephalic cranial খুলি একটিই মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া গেছে, যা তাঁরা নাগা খুলির সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। আর অ্যালপাইন গড়নের খুলি কেবল একটিই ছিল, একটি শিশুর।

কঙ্কালগুলো কিভাবে ছিল?

প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে কার্বন ডেটিং না থাকায় মহেঞ্জোদারোর সময়-স্তর ভেদ বেশ গোলমেলে। মহেঞ্জোদারোর সময়-স্তরকে উপর থেকে অন্ত, মধ্য, আদি, তিন স্তরে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি স্তরকে আবার তিন উপস্তরে ভাগ করা হয়েছে, উপর থেকে ১,২,৩ ধরে। সেই হিসাবে উপর থেকে ৫ম স্তর হবে মধ্য-২। তবে এই ভাগ সব জায়গায় এক থাকেনি। ফলে একটি বাড়ি অন্ত-২ হলেও তার পাশের বাড়ি মধ্য-১ হতেই পারে। যেহেতু শহরটি বারেবারে নতুন করে তৈরি হয়েছে, সব এলাকা সব সময় একলপ্তে নতুন করে বানানো হয়নি, তাই এই সমস্যা। তারপরেও আমাদের মনে রাখতে হবে এই স্তরভেদকেও অনেক সময় গুরুত্ব দেওয়া হত না।

যে কঙ্কালগুলো পাওয়া গেছে তার সবকটিই শহরের নিচু এলাকায় অর্থাৎ সাধারণ জনবসতি এলাকায়। উঁচু কেল্লা এলাকা, যেখানে স্নানাগার ইত্যাদি ছিল, সেই প্রশাসনিক এলাকায় কোন কঙ্কালই পাওয়া যায় নি। বিশদ আলোচনার সময় একটি কথা খেয়াল রাখবো তা হল, এই Mohenjodaro and Indus Civilization বইটিতে যাঁরা লিখেছেন তাঁরা তাদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে। সম্পাদক জন মার্শাল যেখানে একমত নন, সেখানে আলাদা করে ফুটনোটে নিজের বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন বা নিজের লেখায় সেটা বলেছেন। তাই অনেক কথাতেই বৈপরীত্য আছে, থাকবে।

কঙ্কাল ১ (এলাকা-HR, বাড়ি-I)

বাড়ির উঠানে কবরটি ছিল। কঙ্কালের গলায় ছিল তেরটি লালচে-হলুদ রঙের কাঁচের পুঁতির একটি নেকলেস। গলায় চোকারের মত করে ধাতুর রিং, (যা সীসার বলে পরে পরীক্ষায় জানা যায়)। বাম হাতের কনুইয়ের উপরে ছিল তিনটি হাতির দাঁতের বালা। কবরটি সিওয়েল ও গুহ দেখে অনুমান করেন এটি সামান্য কয়েক শতাব্দীর বেশি পুরানো নয়। মার্শালের মতে এটি প্রথম বা দ্বিতীয় সাধারণ শতাব্দীর। বামদিকে কাত হয়ে শোওয়া ২০ থেকে ২৫ বৎসরের নারীর পূর্ণ কঙ্কালটি অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় ছিল। এই কঙ্কালের ঘাড় আর মাথার সংযোগস্থলে রাখা ছিল একটুকরো চৌকো পাথর। পরীক্ষকরা অনুমান করেন এটি মৃত্যুর ঠিক আগে বা খুব সামান্য পরে রাখা হয়েছিল। এমন পাথরের টুকরো রাখার ধরন লক্ষ্য করা গেছে নাল ও বেলুচিস্তানের কঙ্কালের বেলাতেও। অনুমান এটি মৃত্যুর সাথে জড়িত কোন ধর্মীয় আচারের অঙ্গ ছিল।

কঙ্কাল ৩, (এলাকা-HR, ঘর-13)

এই কঙ্কালটির শুধু করোটি পাওয়া গেছে। মাটির দুই ফুট নিচে হাঁড়ির মধ্যে খুলি আর কিছু হাড়ের টুকরো ছিল। ভিন্ন ও বলিষ্ঠ গড়নের এই করোটি আরেকটি নাগা করোটির সাথে মিলিয়ে, প্রাচীন মানুষটিকে মঙ্গোলিয়ান বলে ধরা হয়েছে।

কঙ্কাল ৫-১৬, (এলাকা–HR, বাড়ি-V, ঘর-74)

এই ক’টি কঙ্কালই সর্বাধিক আলোচিত, মহেঞ্জোদারোর কঙ্কাল নিয়ে আলোচনা-জল্পনা-কল্পনা-গবেষণা সবই মূলত এই কটি কঙ্কালকে নিয়ে। ৩৫ ফুট চওড়া ফার্স্ট স্ট্রিটের গা ঘেঁষে, এই ঘর পার হলেই HR- 74-এর বাড়ির মুল অংশে প্রবেশ করা যায়। মার্শাল একে ‘ভেস্টিবিউল’ বলে উল্লেখ করেছেন। মার্শালের মন্তব্য, যদিও বাড়িটি মধ্য-১ ও মধ্য-২ স্তরের, তবু গোটা এলাকাটাই নতুন করে তৈরি হয়েছিল অন্ত-১, অন্ত-২, অন্ত-৩ কালে। এর উপরে মাটির স্তর তেমন উঁচু ছিল না। হতে পারে বন্যায় মাটি ধুয়ে গিয়েছিল। কাজেই এলাকার বাড়ি মধ্য-১ বা মধ্য-২ স্তরের হলেও কঙ্কালগুলোর সময় মধ্য-১ থেকে অন্ত-৩ এর মাঝের হবে। এমনকি, অন্ত-১ এর পরের সময়ের কথাও ভাবা যেতে পারে।

এটিই সেই HR এলাকার 74 নং ঘরের কঙ্কালের ছবি

ছোট ঘরের মধ্যে ৫ থেকে ১৬ কঙ্কালগুলো দেখলে প্রাথমিক ভাবে মনে হবে স্তূপীকৃত মৃতদেহ। ঘরের ছোট পরিসরে অতগুলো কঙ্কাল অনেক সময় একটির হাত অন্যটির পায়ের নীচে; এই রকম অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। অনেক কঙ্কালই উপুড় হয়ে আছে। এদের মধ্যে মহিলা এবং শিশুও ছিল। বেশির ভাগের খুলি ভাঙ্গা, মুখ থ্যাঁতলানো। এমনটা হতে পারে ভারী পাথর জাতীয় কিছুর উপর্যুপরি আঘাতে এমনটা ঘটেছে। দুই-একটি কঙ্কালের হাত কনুই থেকে কাটা, পায়ের পাতা কাটা। এগুলো মৃত্যুর আগে যেমন ঘটতে পারে, পরেও ঘটতে পারে। যদিও হাড়টি মাটির সাথে একেবারেই মিশে গিয়ে থাকতে পারে, তবে মাটির সাথে শুধু হাতের বা পায়ের জোড় থেকে খানিকটা চিহ্নহীন ভাবে মিশে যাবার সম্ভাবনা কম। কাজেই ধরে নিতে পারি যে মৃত্যু কালে এদের হাত পা কেটে নেওয়া হয়েছিল কোন ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে। এখানে পূর্ণবয়স্ক পুরুষদের উচ্চতা গড়ে সাড়ে পাঁচ ফুট। তবে ছয় ফুট উচ্চতার কঙ্কালও পাওয়া গেছে।

হারগ্রীভসের মতে কঙ্কালগুলোর হাতের তামার ও শঙ্খের গয়নাগুলি যদিও প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সময়ের, তবু এরা ছিল বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যাবার পরেরকার। তার আরও ধারনা, যদিও কঙ্কাল-২ ঘরের দক্ষিণের দেওয়ালের উপরে ও অন্যগুলোর থেকে ছয় ইঞ্চি উপরে ছিল, তবু তা বাকি মৃতদের সমসাময়িকই ছিল। এদের এই ঘরের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছিল।

মার্শাল কিন্তু তাঁর সহকর্মী হারগ্রীভসের সাথে একমত হননি। তাঁর ধারনা এগুলো মৃত্যুর পরেই, মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এনে জমা করা হয়েছিল এখানে। মার্শাল আরও বলেন একটি কঙ্কাল ছিল দেওয়ালের উপরে। সেই দেওয়াল পরে তৈরি। অন্যদের থেকে ছয় ইঞ্চি উপরে ছিল। এক্ষেত্রে এমনও ভাবা যেতে পারে যে সবার মৃত্যু একত্রে হয়নি। অন্তত ছয় ইঞ্চি উপরের জনের মৃত্যু পরে হতেই পারে। আর ভাঙ্গা দেওয়ালের উপরে থাকা থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে, ঘরটি অব্যবহারে নষ্ট হয়ে যাবার পরেই সেখানে মৃতদেহগুলো এসেছে। আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলেন মার্শাল, তা হল মৃতদেহ স্তূপীকৃত করার জন্যই ঘরটি ব্যবহার হয়েছিল। বাইরে অন্য কোথাও থেকে মৃতদেহ এনে ঘরের মধ্যে স্তূপ করা হয়, যাতে দেহগুলো পশুর খাদ্য না হয়।

কঙ্কাল ১৭ ও ১৮, (এলাকা–HR, সেকশন-A)

উপরের ৫–১৬ কঙ্কাল থাকা ঘর ছিল ৩৫ ফুট চওড়া ফার্স্ট স্ট্রীটের একদম কাছে। এই ফার্স্ট স্ট্রীট থেকে HR এলাকায় তিনটি গলি বের হয়েছে। হাই লেন, সাউথ লেন আর ডেডম্যান লেন। ডেডম্যান লেনের রাস্তার উপরে কোনাকুনি ভাবে পড়েছিল চিৎ অবস্থায় একটি দেহাবশেষ। দেহাবশেষ বলতে একটি খুলি আর গলার কয়েকটি হাড়। এর থেকে পনের ইঞ্চি দুরে একটি শিশুর খুলি পড়ে ছিল। এই কঙ্কালের ছবি বেশি প্রচারিত, রাস্তার উপরে আছে বলেই। কিন্তু এই কঙ্কালটি ঠিক রাস্তার উপরে নয়। রাস্তার ধার ঘেঁষে আবর্জনার উপরে ছিল,  সম্ভবত গলিটির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবার পরের জমে যাওয়া আবর্জনা আর মাটির উপরে। গলিটি কিন্তু মধ্য-স্তরের। হারগ্রীভস অনুমান করেন এটি উপরের অন্ত-স্তরের বাড়ির মেঝেতে কবর দেওয়া হয়েছিল, যা এই খননের ফলে আমরা নীচের স্তরে দেখতে পাচ্ছি।

কঙ্কাল ১৭-২২, (এলাকা VS, ঘর-18 ও ঘর-33)

দুটি বাড়ির মাঝখানের রাস্তায় ছটি কঙ্কাল (অন্তঃস্তর-২)। মহেঞ্জোদারোর উৎখননের সময় এই কঙ্কালগুলি দেখে মনে করা হয় প্রতিটিরই অস্বাভাবিক মৃত্যু। তাই কঙ্কালগুলোকে যেখানে যে ভাবে পাওয়া গেছে সেভাবেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্যই গালার প্রলেপও দেয়া হয়। খবর পেয়ে বি.এস.গুহ তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে যান মহেঞ্জোদারোর উদ্দেশ্যে (১৯২৫-২৬)। কিন্তু ততক্ষণে গালার প্রলেপ সত্ত্বেও সেগুলো গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেছে। গুহ কয়েকটি মাত্র টুকরোর মাপ নিতে পেরেছিলেন।

এখানে ২৪ X ৮ ফুট এলাকার মধ্যে থাকা ছটি কঙ্কালের একটি মাত্র শিশুর (কঙ্কাল-২৫) হাড় পাওয়া যায়। কঙ্কাল-২৪ ও ২৫ চিৎ হয়ে ছিল। কঙ্কাল-২০ ও ২৩ নং উপুড় হয়ে ছিল, চিৎ হয়ে থাকা কঙ্কাল-২১ ও ২২ একদম টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কঙ্কাল-২৩ এর উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। সবগুলো কঙ্কাল ঝুরো মাটি দিয়ে ঢাকা ছিল, তবে কবরে যেমন জিনিষ পত্র দেওয়ার প্রথা ছিল সে আমলে, সেরকম কিছু ছিল না।

এম এস ভাট অনুমান করেন এদের মৃত্যু ছিল অস্বাভাবিক। তবে যেহেতু এগুলো সরাসরি রাস্তার উপরে না থেকে ধারে ছিল এবং ইট বা অন্য আবর্জনা মুক্ত ঝুরো মাটি দিয়ে ঢাকা ছিল, তাই অনুমান করা যেতে পারে যে অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও কোন চরম হিংসাত্মক ঘটনার ফল এটা ছিল না। যথাযথ কবর দেওয়া না হলেও কবরের একটা প্রচেষ্টা ছিল। আরেকটি সম্ভাবনাও ভাবা হয়, তা হল কঙ্কালগুলো হয়ত উপরের স্তরেই ছিল, কোন কারণে নীচের মাটি সরে যাওয়ায় এগুলো দুটো বাড়ির মাঝখানের গলিতে এসে পড়ে। গলিটি ছিল মধ্য-১ স্তরের। সেক্ষেত্রে কঙ্কালগুলো অন্ত-৩ স্তরের হবার সম্ভাবনা থাকছে।

VS এলাকার 18 নং ও 33 নং ঘরের মাঝের কঙ্কালের ছবি

কঙ্কাল ২৭–৩৫, (এলাকা DK, ব্লক-9,(9A), বাড়ি-II)

এগুলো ম্যাককের আমলে পাওয়া। খানিকটা নিচু জাগায় থাকায় প্রথমে ম্যাককে অনুমান করেছিলেন এগুলো কবরেই আছে। পরে নিজেই নিজের ভুল বুঝতে পারেন। কারণ কবরের কোন দেওয়াল নেই কোন দিকেই। আদতে ওটা ছিল একটা সাধারণ ভাবে নিচু জায়গা। এখানে দুটো বিশেষ জিনিস পাওয়া যায়, একটি হাতির দাঁতের চিরুনি, আর একটি তামার বালা। হাতির দাঁতের চিরুনি সিন্ধু সভ্যতার উৎপাদন নয় সেটা তিনি নিশ্চিত ছিলেন, তেমনি নিশ্চিত ছিলেন তামার বালাটি এই সভ্যতারই মধ্য কালের উৎপাদন বলে।

ম্যাককে অনুমান করেন এরা সম্ভবত একই পরিবার ভুক্ত ছিল। হামলার সময় নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল। তবে মধ্য-সময় কালে কোন ধরনের হানাদারি সম্ভব সেটা নিয়ে তিনি কিছু বলেন নি। যাঁরা কঙ্কালগুলো পরীক্ষা করেছেন তাঁদের বক্তব্য ছিল অনেকগুলো মৃত শিশুর উপস্থিতি ধারণা দেয় এটা কোনও হত্যার উদ্দেশ্য লুঠপাট ছিল না, এদের সবাইকে মেরে ফেলাই মুল উদ্দেশ্য ছিল। ম্যাককে অন্য একটি লেখায় মন্তব্য করেন, হত্যাকারীদের মৃতদের প্রতি কোন প্রবল জিঘাংসা ছিল। ঠিক সাধারণ হত্যা নয়, কোন প্রবল আক্রোশ-ঘৃণা কাজ করেছিল হত্যাকালে। তাছাড়া অতগুলো শিশু হত্যার কোন সঙ্গত যুক্তি নেই।

কঙ্কাল ৪১-৪৪, (এলাকা-DK, ব্লক-4A ঘর-42 বা কুয়োতলা)

আগেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে, দুটো কঙ্কাল পাওয়া গেছে উঁচু রাস্তা থেকে কুয়োতলায় নেমে আসার সিঁড়িতে। আলাদা করে পাওয়া গেছে কুয়োতলায় যাবার পথের উপর। এদের মধ্যে দুইজন শিশু আর দুইজন পূর্ণ বয়স্ক। তবে একমাত্র কঙ্কাল-৪৪ কে পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ বলে সঠিক বোঝা গেছে।

আরেকটি বহুল প্রচারিত মহেঞ্জোদারোর কঙ্কালের ছবি এই কুয়োতলা থেকে আসা যাওয়ার সিঁড়িতে পড়ে থাকা কঙ্কালটি। পাশের রাস্তার থেকে নিচুতে থাকা কুয়াতে আসার জন্য আট দশ ধাপের সিঁড়ি আছে। এই সিঁড়ি বেয়ে নামার পথেই পড়েছিল কঙ্কালটি। বোঝাই যায়, তাকে প্রাণঘাতী আঘাত করা হয়, তারপরে সর্বশক্তি খরচ করেও সিঁড়ি শেষ করতে পারেনি। তাই এটি অতি অবশ্যই হত্যার একটি ঘটনা।

কুয়োতলার ঘরের প্রাপ্ত কঙ্কালের ছবি

মাটির হাঁড়িতে খুলি ও হাড় (এলাকা-VS, বাড়ি-IV, ঘর-9)

তিনটি ছোট কুঠুরির মধ্যে তৃতীয় কুঠুরি ছিল সযত্নে ইট গাঁথা 6 ফুট 10 ইঞ্চি X 2 ফুট 4 ইঞ্চি মাপের। ভর্তি ছিল ছাই, কাঠকয়লা, মাটির বাসনের টুকরো আর প্রায় দুই কিলো মানুষের হাড়ে। এর নীচে ছিল ঢাকা দেওয়া দুটো মাটির পাত্র আর চারটি ডিম্বাকৃতি মাটির পাত্র, যার থেকে হাড় বের হয়ে আছে। হাড়গুলোর মধ্য থেকে এম এস ভাট একটি আঙুলের হাড় ও একটি মাথার খুলি ছিল বলে পরিস্কার বুঝতে পেরেছেন। এইখানে ছাই, কাঠকয়লা, মাটির বাসন, হাড় বাদেও ছিল ছোটছোট কিছু মাটির বাসন, বাচ্চাদের খেলনা, চাকা, তিনকোনা টেরাকোটার টুকরো, ভাঙ্গা শাঁখা, নদীর ঝিনুক, কিছু দানা শস্য। ভাটের মতে এটি মানুষের দগ্ধাবশেষের কবর হতে পারে, কিন্তু এখানেই ছিল কেন, সেটা বোঝা যায়নি। কারণ এই কুঠুরিগুলো সাধারণত মালপত্র রাখার কাজে ব্যবহার হত। তবে একটি অনুমান যে, এই করোটিটি এখানে কবর হিসাবে নয়, অন্য কোথাও থেকে এনে কোন কারণে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

মাটির হাঁড়িতে হাড়ের টুকরো (এলাকা VS, ঘর-26)

এখানে বাড়ির দুটো ঘরের যাতায়াতের পথের নিচে পাওয়া গেল দুটো ডিম্বাকৃতি মাটির পাত্র, যার ভেতরে ছিল ছোট পান পাত্র, টেরাকোটার চুড়ি, পশুর মূর্তি (খুব ছোট আকারের) আর কিছু হাড়ের টুকরো, যা দেখে মানুষের বলেই ধারনা হয়। এছাড়া আরও বেশ কয়েক জায়গায় মাটির বাসনে ছোট পানপাত্র, পশুর মূর্তি, চুড়ি রাখা ছিল, কোথাও সাথে ছিল পশুর হাড়ও। মার্শাল অনুমান করেন এগুলো সবই মরদেহ পুড়িয়ে দেবার পরে মৃতের স্মরণে দেওয়া কবর। মার্শাল লেখেন তাঁর এই ধারনা আসে হিন্দু প্রথায় প্রচলিত অগ্নিসৎকারের পরে দেহাস্থি সংগ্রহ করে তা নদীতে ভাসানোর প্রথা থেকে।

মার্শাল লেখেন সব দেহাবশেষই পাওয়া গিয়েছে মহেঞ্জোদারোর অন্তঃস্তর ২ ও ৩ থেকে। কাজেই অনুমান করা যেতে পারে এই দেহাবশেষের কোনটিই আদতে মহেঞ্জোদারো বাসীদের নয়। কারণ অন্তঃস্তরের কালের মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা ছিল হতদরিদ্র সাময়িক বাসিন্দা মাত্র। কাজেই এমন হতে পারে যে এগুলো সবই নানা ভিন্ন ভিন্ন জাতির দেহাবশেষ মাত্র, যারা ঘটনাক্রমে সেখানে ঐ সময় বাস করত।

১৯৬৪ সালে ডেলসের পাওয়া কঙ্কাল

পেন মিউজিয়ামের হয়ে পাকিস্তানের সাথে যৌথ উদ্যোগে ১৯৬৪ সালে ডেলস মহেঞ্জোদারোতে উৎখননের কাজ চালান। খননের এই কাজ হয় আগে হারগ্রীভসের খনন করা HR এলাকারই একটি অখোদিত উঁচু অংশে, এবং একেবারে দ্বিতীয় দিনেই তাঁরা পান তিনটি কঙ্কাল, মাত্র দুই ফুট নীচে। তারপরে সেখানে আরও খননে বের হয়ে আসে কয়েক ফুট দুরে থাকা আরও তিনটি কঙ্কাল। কোনটিই যথাযথ কবর দেওয়া ছিল না।

কঙ্কালগুলোর মধ্যে ছিল পূর্ণবয়স্ক পুরুষ, তরুণী এবং শিশু। কঙ্কালগুলো রাস্তার উপরে ছিল না, তবে কবরেও ছিল না, ছিল রাস্তার ধারে ভাঙ্গা ইট, ভাঙ্গা মাটির বাসন আর আবর্জনার স্তূপে। এরা কি ভাবে মারা গেছে তা অনুমান করা অসম্ভব ছিল। তবে এরা যে মহেঞ্জোদারোর অন্তঃস্তরের ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এরা ছিল মহেঞ্জোদারোর সেই বাসিন্দারা, যারা শহরের পতনের পরে প্রায় ভবঘুরের আস্তানায় দিন কাটানোর মত করে নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিল। এই আমলে ঘর নতুন করে বিশেষ বানানো হতই না। যা কিছু হত তা খানিক পরিষ্কার করে পুরোনো ভাঙ্গা ইট জুড়ে মাথাগোঁজার ঠাই বানানো।

শেষের কথা

মহেঞ্জোদারোতে কোন যথাযথ কবরখানা পাওয়া যায়নি। তার মানে এমন নয় যে কোন কবরখানাই ছিল না। না পাওয়ার কারণ হতে পারে, সেই জায়গাটা খোঁড়া হয়নি এখনো, অথবা বারবার বন্যায় সব ভেসে চলে গেছে। ৪০ হাজার বাসিন্দার শহরে চল্লিশটি কঙ্কাল থেকে শহরের সামাজিক চরিত্র বা পরিস্থিতি বোঝা অসম্ভব।

মহেঞ্জোদারোর সবকটি কঙ্কালের যথাযথ হিসাব বের করা কঠিন কাজ। দুই চারটে এদিক ওদিক হয়েই যায়। এর পেছনের কারণ সম্ভবত তখন মৃতদের দেহাবশেষ নিয়ে প্রত্নবিদদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের মন্তব্য পড়েছিলাম কোথাও, যেখানে তিনি বলেছিলেন শুরুর দিকের উৎখননকারীরা মাটির বাসনের টুকরোর উপর যত গুরুত্ব দিতেন, তার ভগ্নাংশও কঙ্কালের প্রতি দেননি। তার উপরে তখন ভারতে যথাযথ ও পৃথক নৃতাত্ত্বিক বিভাগও ছিল না। মানুষের কঙ্কাল আর পশুর কঙ্কাল একই বিভাগে একই লোকের দায়িত্বে থাকলে কোন একদিকে কিছুটা অবহেলা দেখা দিতেই পারে। আর তখন এখনকার মত এতটা উন্নত বিজ্ঞানের সাহায্যও পাওয়া সম্ভব ছিল না। যে কয়টি কবর পাওয়া গেছে তাতে কোন একটি ধর্মাচরণের বিশেষ প্রভাব ছিল এমনটা বলা কঠিন। তবু তারই মধ্যে কয়েকটি শুধু খুলি মাটির হাঁড়িতে রাখার প্রথা নজর এড়াবে না।

এর পরবর্তী কালে ম্যাককে পেন মিউজিয়ামের হয়ে চানহুদারোতে যে উৎখনন কাজ করান সেখানেও এমন মাটির হাঁড়িতে খুলি (শুধু খুলি আর উপরের চোয়াল) পাওয়া গিয়েছে। সেটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় আমেরিকায়। সেখানে তিনজন বিজ্ঞানী আলাদা করে পরীক্ষা করে তাদের মতামত আলাদা করে প্রকাশ করেন। সেই মতামতের থেকে প্রধান কথা যেটি বের হয়ে আসে তা হল, মৃত্যুর পরে দেহ থেকে করোটি বিচ্ছিন্ন করা হয় সযত্নে এবং করোটিটি মেডেটেরেনিয়ান ও নেগ্রিটো জাতির মিশ্রণে উদ্ভূত কোন ব্যক্তির। তার মুখমণ্ডল আবার মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। এই হিসাব মেলাতে না পেরে সিদ্ধান্ত হল, এটি একটি ব্যক্তি বিশেষের বৈশিষ্ট্য মাত্র ছিল। যদিও মেডেটেরেনিয়ান মানে কোন ভূমধ্যসাগরীয় জাতি নয় অবশ্যই। সেটি হল মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া লম্বাটে খুলির লোকেদের মতই।

মহেঞ্জোদারোর কিছু কঙ্কাল কবরে ছিল, তা সে যত বাজে ভাবেই হোক, কবর তো বটেই। তবে বেশিরভাগটাই ছিল কবর না দেওয়া এবং এদের মৃত্যুও হয়েছিল কোন না কোন হিংসাত্মক ঘটনায়। কারা ঘটিয়েছিল এই হিংসাত্মক ঘটনা? মার্শালের মতে এরা পাহাড়ি জাতি বা বেলুচিস্তান, কির্থার পার্বত্য এলাকা থেকে আসা উপজাতিগুলো।

তথ্যসূত্রঃ

1. Sir John Marshall, (Ed.) Mohenjo-Daro and Indus Civilization. Being an official account of archaeological excavation at Mohenjo Daro carried out by Govt of India between the years 1922 and 1927, Vol- I, II & III, Aurthur Probsthain, London, 1931.

2. George F Dales, The Mythical Massacre of Mohenjo-Daro, 1961.

3. George F Dales, The decline of Harappans, 1966.

4. Bina Musharif, Human Skeletal studies in India: a review, Archaeological Human Remains, December 2014.

5. W. Norman Brown, ChhanuDaro Excavation 1935-36, Vol-20, American Oriental Series, 1943.

6. S. S. Sarkar, Ancient Races of Baluchistan, Punjab and Sindh, 1964.

মন্তব্য তালিকা - “মহেঞ্জোদারোর কঙ্কাল কথা”

  1. ইতিহাসের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে আমি শ্রদ্ধাবনত। লেখাটি অকৃত্রিম গবেষণালব্ধ। সমৃদ্ধ হলাম।

  2. মাটির পাত্র,যে গুলির মধ্যে মাথারখুলি ছিলো,সেই পাত্র গুলির সম্পর্কে আর একটু বিশদ বিবরণ তুলে ধরতে পারলে ভাল হয় ।

  3. মহেঞ্জোদাড়োর কঙ্কাল নিয়ে এত তথ্যবহুল, সুন্দর আলোচনা আমি এর আগে পড়ি নি। বাংলাভাষায় এরকম আর কোনও লেখাও বোধহয় নেই, যা এত বিশদে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এই বিবরণ তুলে ধরেছে।
    অসাধারণ লেখাটির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। সেই সঙ্গে রেখে যাই একটি আর্জি।
    বহু আলোচিত রাখিগড়ির কঙ্কাল নিয়ে, তার ডি এন এ অ্যানালিসিস একটি লেখা চাই আপনার থেকে।

    1. ধন্যবাদ। এই কঙ্কালগুলো নিয়ে যত আলোচনা তর্ক বিতর্ক হয়েছে গোটা হরপ্পা সভ্যতানিয়েও বোধহয় অতটা হয় নি। অথচ সব সম।ই দেখতাম তথ্যের কিছু ফাঁক থেকে যাচ্ছে কোথাও, খানিকটা অস্পষ্টতা। মুল তথ্যে অস্পষ্টতা ভ্রান্তি থাকলে সে বিষয়ে সব তর্কের মধ্যে সেই অস্পষ্টতা , ভ্রান্তি থাকতে বাধ্য। তাই যতটা সম্ভব সব তথ্য একত্র করা চেষ্টা ।
      রাখিগড়ীর জিন গবেষণার ফল প্রকাশ পেয়েছে অনেক দিনই হলো।
      চেষ্টা করবো আপনার কথা মত কিছু লিখতে।

  4. অকপটে স্বীকার করছি যে আপনার এই গবেষণাধর্মী লেখাটা হৃদয়ঙ্গম করার মতো পড়াশোনা আমার নেই। আমার এক অগ্রজ বন্ধু শ্রী শংকর হাজরা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর শিলালিপি এবং কঙ্কাল সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী। উনি দীর্ঘদিন ধরে এবিষয়ে গবেষণা করে চলেছেন। উনি ফেসবুকে নেই। তাই আপনার লেখাটা আমি ওনাকে মেলে পাঠিয়েছিলাম। লেখাটি পড়ে উনি রীতিমত মুগ্ধ। আপনি যদি আপনার মেল থেকে শংকরবাবুর সঙ্গে সময় করে যোগাযোগ করেন তবে উনি আপনাকে পাঠ- প্রতিক্রিয়া জানাবেন ও আপনার সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হতে পারেন বলে আমাকে ফোনে জানিয়েছেন। ওনার মেল আইডি হলোঃ-
    [email protected]

    1. ধন্যবাদ শেখর সেনগুপ্ত। আমি খানিক চেষ্টা করেছি ছড়িয়ে থাকা থথ্যগুলো একত্র করার জন্য।
      আমি শর্রী শঙ্কর হাজরার সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করব। হয়ত আমিও কিছু জানতে পারব ওনার থেকে ।

  5. অসাধারণ অনুসন্ধান। জানা ছিল না । ভারতের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে আরো অনুসন্ধান চালানো।

  6. অসাধারণ অনুসন্ধান। জানা ছিল না । ভারতের উচিত পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে আরো অনুসন্ধান চালানো। পুরাতন ও নতুন লেখার সূচনা পেলে ভালো লাগবে।

    1. ধন্যবাদ পুরানো লেখা এই খানে পাবেন লেখক সূচীতে মুষার মুখার্জী তে ক্লিক করে। নতুন লেখার সূচনা পাবেন ফেসবুকের ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক গ্রুপে। ইতিপাস তথ্য ও তর্ক গ্রুপে আরো উপর আমার আরো অনেক লেখাই পাবেন, হরপ্প সভ্যতার উপর, ও অন্যান্য বিষয়ে। সাধারনত অ্যান্সিয়েন্ট হিষ্টোরী বিভাগে। আর ।আমার নাম ধরে সার্চ করলে সব লেখাই পাবেন

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।