সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ইউরোপীয় আইনের চোখে সমকামিতা

ইউরোপীয় আইনের চোখে সমকামিতা

সুদীপ্ত পাল

মে ৪, ২০২৪ ১২৮ 2

চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দী ছিল ইউরোপের ইতিহাসে একটা টালমাটাল সময়— রোম সাম্রাজ্যের বিভাজন, বিভিন্ন জার্মান জাতির বহিরাক্রমণ, সেনেটের শক্তিহীনতা, খ্রিষ্টান ধর্মের দ্রুত প্রসার ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি, ৪৭৬ সাধারণাব্দে রোমের পতন এবং ইউরোপ মধ্যযুগের সূচনা। মধ্যযুগের প্রথম ছয় শতাব্দী— পঞ্চম থেকে একাদশ শতকের শেষদিক অবধি সময়কাল অন্ধকার যুগ হিসেবে পরিচিত। এই সময়ে দ্রুত বি-নগরায়ন হয়, রোমান আইনব্যবস্থাও ভেঙে পড়ে। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রোমের রাজকীয় আদালত এবং সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে রোমান সেনেট বিলুপ্ত হয়। ওকালতি ও অন্যান্য আইনি পেশাও অবলুপ্ত হয়। ক্লাসিকাল অ্যান্টিকুইটির যুগ থেকে অন্ধকার মধ্যযুগের দিকে ইউরোপের অধঃপতনের এই সময়ে যে পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হয় তা শুধু রাজনৈতিক নয়, এইসময়ে সমাজব্যবস্থাও দ্রুত বদলায়— তার প্রতিফলন দেখা যায় সমাজের বহু ক্ষেত্রে। আজকের এই আলোচনার মূল বিষয় হলো সমকামিতার প্রতি আইনি দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ইতিহাস নিয়ে কিছু চর্চা।

ইউরোপে অষ্টম সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ৪৭৬ সাধারণাব্দ অবধি সময়কাল ক্লাসিক্যাল অ্যান্টিকুইটি হিসেবে পরিচিত। এই সময়কার গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতি, বিশেষ করে গ্ৰিক সংস্কৃতি, সমকামিতার প্রতি সহনশীল ছিল। কয়েকটা উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। গ্রিক পুরাণে দেখা যায় দেবতা হারকিউলিস নিজের মৃত প্রেমিকদের সম্মানে অলিম্পিকের মতো দুটি আঞ্চলিক ক্রীড়া-উৎসবের প্রচলন করেছিলেন— ইলাকেটিয়া (ইলাকেটাসকে সম্মান জানাতে) এবং অ্যাগোনেস (অ্যাবডারাসকে সম্মান জানাতে)। এ তো ছিল পুরাণগাথা, তবে প্রাচীন গ্রিক মৃৎশিল্প, কবিতা এবং মন্দিরের শিলালিপিতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় সমপ্রেমের উদযাপন। প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার, অ্যাকিলিস এবং প্যাট্রোক্লাস, এই দুই পৌরাণিক পুরুষের ভালবাসাকে হোমো-এরোটিক রূপ দিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিক মহিলা কবি স্যাফো দুই নারীর প্রেমকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন কবিতায়। তিনি বাস করতেন লেসবোস দ্বীপে, আর সেখান থেকেই লেসবিয়ান শব্দের জন্ম। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো হারমোডিয়াস এবং তার শিক্ষক অ্যারিস্টোজিটন— এই প্রেমিকযুগল বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন এথেন্স-এর স্বৈরাচারী শাসক হিপারকাস-এর নিধনে। এই ঘটনা এথেন্স-এ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে। তার প্রতিদানে এথেন্সবাসীরা এদের যৌথ স্মারকমূর্তি বানায়, এই মূর্তিযুগলের একাধিক প্রতিলিপি সেযুগের গ্রিস ও পরবর্তীকালের রোমে তৈরি হয়েছে।

রোম সম্রাটদের অনেকেই প্রকাশ্যে সমকামী বা উভকামী ছিলেন। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল সম্রাট হেদ্রিয়ানের সঙ্গে আন্তিনোসের ভালবাসা। আন্তিনোসের মৃত্যুর পর তাকে স্মরণীয় করতে সারা রোম সাম্রাজ্য জুড়ে সম্রাট তার স্মারক মূর্তি বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, গোটা একটা নগরের পত্তন করেছিলেন আন্তিনোসের নামে, অলিম্পিকের ধাঁচে স্মারক ক্রীড়া-উৎসবের প্রচলন করেছিলেন আন্তিনোসের স্মৃতিতে। সর্বোপরি তিনি আন্তিনোসের দেবত্বারোপণ করেছিলেন এবং তাকে ঘিরে সম্পূর্ণ নূতন এক ধর্মমতের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

বোঝা যায় রোম সাম্রাজ্যের আইনে সমকামিতা অপরাধ ছিল না। তবে বেশ কয়েকবার এমন কিছু আইন আনা হয়েছিল যেগুলো কিছুটা সমকামবিরোধী ছিল।‌ পুরুষ বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে একাধিকবার আইন আনা হয়। ২২২ সালে সম্রাট সেভেরাস আলেকজান্ডার পুরুষদের মন্দির-বেশ্যাবৃত্তির উপর ট্যাক্স বসিয়েছিলেন। “লেক্স স্ক্যান্টিনিয়া” (Lex Scantinia) নামে পরিচিত একটি আইনের কথা জানা যায়— তবে এটি মূলতঃ নাবালকদের যৌন শোষণকারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হতো। অবশ্য সামগ্রিক ভাবে সমকামবিরোধী আইন রোম সাম্রাজ্যে ছিল না।

রোম সাম্রাজ্যের আইন হামুরাবির কোডের মতো একটা প্রস্তরলিপির আকারে লিখিত আইন নয়। এই আইনের ব্যাপ্তি অনেক বেশি, সময়কালও অনেক দীর্ঘ যার ফলে বহু বিবর্তন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টান ধর্ম রোম সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে, এই ঘটনার ফলে আইনব্যবস্থায় লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে। আধুনিক ইতিহাসকারদের কাছে রোমান আইনের প্রধান উৎস হলো বিভিন্ন সময়ে রচিত আইন-সংহিতা (কোডেক্স), প্রাচীন রোমের লেখকদের রচনা (রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিকদের রচনাসমূহ) আর বিভিন্ন শিলালিপি যাদের মাধ্যমে নূতন আইন ঘোষণা করা হতো। কোডেক্সগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, তৃতীয় শতাব্দীর শেষে রচিত দুটি— গ্রেগরিয়ান কোডেক্স এবং হারমোজেনিয়ান কোডেক্স, পঞ্চম শতাব্দীর থিওডোসিয়ান কোডেক্স এবং ৫২৯-৫৩৪ অব্দে বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের উদ্যোগে রচিত “কর্পাস জুরিস সিভিলিস” (অর্থাৎ দেওয়ানি বিধি সংগ্রহ)। প্রথম তিনটি কোডেক্স তাদের পূর্ণাঙ্গরূপে পাওয়া যায় না। এই তিনটি কোডেক্সরই অনেকাংশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শেষটিতে— জাস্টিনিয়ানের কর্পাস জুরিস সিভিলিসে— অর্থাৎ কর্পাস জুরিস সিভিলিস থেকে তাদের আংশিক পুনর্নির্মাণ সম্ভব।

এই চারটি কোডেক্স-এর মধ্যে প্রথম দুটি রচিত হয়েছিল খ্রিস্টধর্ম রোমের রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠার আগে, শেষ দুটি তার পরে। থিওডোসিয়ান কোডেক্স-এ প্রথম দেখা যায় ৩৯০ সালের একটি আইন যা সমকামী পুরুষদের প্রকাশ্যে জ্যান্ত পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা বলে (থিওডোসিয়ান ৯.৭.৩)। থিওডোসিয়ান কোডেক্স রচিত হয়েছিল সম্রাট দ্বিতীয় থিওডোসিয়াসের তত্ত্বাবধানে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার পূর্ণ খ্রিস্টীয়করণের উপরে জোর দিয়েছিল।

রোমের পতন বলতে ৪৭৬ অব্দে পশ্চিম রোম সাম্রাজ্যের পতনকে বোঝায়, তবে পূর্ব রোম সাম্রাজ্য আরও এক হাজার বছর টিকে থাকে যা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। বাইজান্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের তত্ত্বাবধানে রচিত কর্পাস জুরিস সিভিলিসের একটা অংশ হলো পূর্ববর্তী কোডেক্সগুলির আলোচনা। এর আর একটা অংশের নাম হলো নভেলা – অর্থাৎ নূতন। ৫৩৮ এবং ৫৪৪ সালে সম্রাট জাস্টিনিয়ান সমকামিতাকে অপরাধ ঘোষণা করে দুটি নূতন আইন তৈরি করেছিলেন— এই আইনগুলি নভেলা ৭৭ ও নভেলা ১৭৮ নামে পরিচিত। প্রথমটা পুরুষ সমকামিতাকে, দ্বিতীয়টা নারী সমকামিতাকে নিষিদ্ধ করে। পুরুষদের শাস্তি ছিল জীবন্ত দগ্ধ হওয়া, নারীদের শাস্তি দ্বীপান্তরে নির্বাসন। এই আইনদুটির বক্তব্য ছিল, “এই ধরনের অপরাধের কারণে দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প এবং মহামারী হয়।” ৫৪১ সাধারণাব্দে  ব্যাপক প্লেগের প্রাদুর্ভাব মানুষের মনে এই ধারণাকে আরো বলবৎ করেছিল। মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সমকামিতাকে যুক্ত করার নজির পরবর্তীকালে বহুবার দেখা যায়। তার প্রথম নথিভুক্ত উদাহরণ এটি।

জাস্টিনিয়ানের আইনের প্রভাব ছিল মূলতঃ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে— অর্থাৎ গ্রিস, বলকান উপদ্বীপ, পশ্চিম এশিয়া, মিশর, আফ্ৰিকার মাগরেব অঞ্চল, সেইসঙ্গে ইতালির অনেকটা অংশে। বাদবাকি ইউরোপে তখন কোনো সুনির্দিষ্ট আইন ব্যবস্থা ছিল না— সবই স্থানীয় আইন ছিল— রোমান আইনের কিছু ভগ্নাংশ, জার্মানদের ট্রাইবাল আইন আর বৈবাহিক বিষয়ে ব্যবহার হতো খ্রিস্টান ক্যানোনিকাল আইন অর্থাৎ ধর্মীয় আইন। এই যুগে ভিসিগথ আর ফ্র্যাঙ্কিশরা যে আইন ব্যবহার করত সেটা থিওডোসিয়ান কোডেক্স-এর উপর ভিত্তি করে রচিত এবং থিওডোসিয়ান কোডেক্সকেই তারা রোমান আইন বলে অভিহিত করত।

সমকামিতার প্রতি খ্রিস্টান ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি পারম্পরিক গ্রিক-রোমান ধর্মের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। এপোস্টল সেন্ট পল খ্রিস্টধর্মকে রোমে এনেছিলেন এবং পুরো রোম সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রসারের একটা বড় কৃতিত্ব তাঁর। সর্বোপরি, বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট-এর একটা বড় অংশ হলো তাঁর লেখা এপিস্টলগুলি। এপিস্টল হলো চিঠি যা বিভিন্ন নগরবাসীর উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা। তাঁর একটি এপিস্টলে দেখা যায় সেইসব পুরুষদের প্রতি ধিক্কার যারা “একে অপরের প্রতি লালসায় পুড়ে যায় ও নারীর স্বাভাবিক সংসর্গ ত্যাগ করে” (রোমানস ১:২৬-১:৩২)। এখানে স্পষ্টভাবে তিনি বলেছেন ঈশ্বরের বিধান হলো এরকম অনাচারীদের মৃত্যু। করিন্থিয়ান ১:৬:৯ এপিস্টলে দেখা যায় সেন্ট পলের বক্তব্য, যারা ঈশ্বরের রাজ্যপাটের অধিকারী হতে পারবে না তাদের মধ্যে আছে মূর্তিপূজক ও সমকামীরা।

বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট-এ সদোম, গমোরা এবং লূতের কাহিনী ছিল, যা সমকামিতাকে ঈশ্বরের ক্রোধের কারণ হিসেবে দেখায়। এগুলো খ্রিস্টধর্মের শুরুর দিকের কাহিনী। পরবর্তীকালে যখন চতুর্থ শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছিল সেই সময়ের দিকে দেখা যাক। সেন্ট অগাস্টিন ছিলেন খ্রিস্টধর্মের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এবং সম্রাট থিওডোসিয়াসের সমসাময়িক, তাঁর ধর্মতত্ত্ব ভবিষ্যতের খ্রিস্টধর্মের এবং পাশ্চাত্যের যৌন চেতনার দিক নিরূপণ করেছিল। তাঁর মতে যৌনতা সহজাতভাবেই পাপ, তা নারীপুরুষের হোক আর সমলিঙ্গেই হোক— যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য সন্তান উৎপাদন। সেন্ট অগাস্টিন আদম ও ইভের ঈশ্বরবাক্য লঙ্ঘনের ‘আদি পাপ’ তত্ত্বকে জনপ্রিয় করে তোলেন— ফলে প্রতিটি মানুষই পাপী বলে চিহ্নিত হয়।

হেদ্রিয়ান তাঁর প্রেমিক আন্তিনোসকে ঘিরে যে ধর্মমত প্রবর্তন করেছিলেন তার প্রতি বিশেষ ঘৃণা চোখে পড়ে খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিকদের রচনায়। চতুর্থ শতাব্দীর একজন খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক অ্যাথানাসিয়াস (Athanasius) তাঁর বই “Apologia contra Arianos”-এ আন্তিনোসকে “নির্লজ্জ ও কলঙ্কিত যুবক” এবং “তার প্রভুর লালসা মেটানোর একটি জঘন্য এবং ঘৃণ্য যন্ত্র” হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও লেখার শেষ অংশে তিনি বলেছেন, “হেদ্রিয়ান মানবজাতিকে দিয়ে গিয়েছিলেন মূর্তিপূজার উৎসমুখরূপী একটি স্থায়ী ও কুখ্যাত নমুনা।” এটি আন্তিনোস, সমকামিতা এবং মূর্তিপূজা— তিনটির প্রতি অ্যাথানাসিয়াসের তীব্র ঘৃণাকে তুলে ধরে।

খ্রিস্টধর্ম যে সবসময় সমকামীদের মৃত্যুদণ্ডের কথা বলেছে তা নয়। চতুর্থ শতাব্দীতে সেইন্ট বাসিল তাঁর ক্যাননে বলেছেন. সমকামী পুরুষ পনেরো বছর প্রায়শ্চিত্ত (repent) করার পর ধর্মীয় সম্প্রদায়ে যোগদান করতে পারে। সামাজিক বর্জন, আর্থিক জরিমানা, প্রায়শ্চিত্ত— সমকামীদের জন্য এই শাস্তি বিভিন্ন খ্রিস্টান ধর্মীয় আইনে ছিল।

এবার আমরা মধ্যযুগের শেষদিকে আসব। দ্বাদশ শতকে একটা ছোটখাটো নবজাগরণ হয়েছিল যেটাকে মিডিয়েভাল রেনেসাঁ বলা হয় যা পঞ্চদশ শতাব্দীর মূল রেনেসাঁর চেয়ে পুরোনো। আগের যুগের থেকে এই যুগের আইনি পরিবেশের কয়েকটা পার্থক্য আছে। আগের যুগে আইনি দৃষ্টান্তের নথিবদ্ধকরণ কম হয়েছে অর্থাৎ কারা কী শাস্তি পেয়েছে, কতজন মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে, বাস্তবে সমকামিতার জন্য মৃত্যুদণ্ড বহুপ্রচলিত ছিল কিনা— এগুলোর খুব বিশদ নথি পাওয়া যায় না। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে দেখা যায় ইউরোপে সমকালীন ইতিহাসের সক্রিয় নথিবদ্ধকরণ; কারণ এই সময় সাক্ষরতা বৃদ্ধি পায়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় যেমন ইতালির বোলোনিয়া (Bologna), ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ আর অক্সফোর্ড। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আইন শিক্ষা ছিল গুরুত্বপূর্ণ পঠিত বিষয়গুলির একটি। বোলোনিয়া বিশেষভাবে বিখ্যাত ছিল রোমান আইন এবং ধর্মীয় আইনের শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে। এই সময়ে ইউরোপে রোমান আইন পুনরাবিষ্কৃত হয় এবং আইন শিক্ষার গুরুত্ব মানুষ বুঝতে শুরু করে। এসবের ফলে এই যুগে সমকালীন বিভিন্ন আইনি বিষয়, আইনি উদাহরণ বিশদে লিপিবদ্ধ হয়েছে। খ্রিস্টান চার্চও এই সময়ে নিজেদের কাজ নথিবদ্ধ করতে সক্রিয় হয়েছে। তবে, সমকামীদের অপরাধ নথিভুক্ত করতে গিয়ে চার্চ এবং আইনরক্ষকরা নিজেদের অন্যায়েরই নথি বানিয়েছিল। গণহত্যা, সমকামীদের পুড়িয়ে মারা— এগুলো তারা সগর্বে নথিভুক্ত করেছিল কারণ তারা সমকামীদের শাস্তি দেয়াটাকে অন্যায় মনে করেনি, বরং ধর্মরক্ষার কাজ, সমাজরক্ষার কাজ, গৌরবজনক বিষয় হিসেবে দেখেছিল।

সমকামিতার বিরুদ্ধে আইন এরকম নয় যে শুধু সমকামীরাই তাতে শাস্তি পাবে। চার্চ এবং আইনরক্ষকরা যাকে নিজের প্রতিপক্ষ ভাবত তারই শাস্তি হতো। এই ব্যাপারে ভালো উদাহরণ নাইট টেম্পলাররা। শুধু খ্রিস্টধর্মবিরোধীরাই যে শাস্তি ভোগ করত তা নয়। টেম্পলাররা খ্রিস্টধর্মরক্ষার্থে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে যুদ্ধ করেছিল। ১৩০৭ সালের ১৩ই অক্টোবর শুক্রবার, চার্চ তাদেরকেই খ্রিস্টবিরোধী ও সমকামী অভিযোগ দিয়ে পুড়িয়ে মারে। এই হত্যাকাণ্ডের সত্যিকারের কারণ হিসেবে অনুমান করা হয় যে, নাইট টেম্পলারদের ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি ও সম্পত্তি চার্চের আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠছিল।

পঞ্চদশ শতকে মধ্যযুগ শেষ— আধুনিক যুগ শুরু হয়। এই যুগসন্ধিক্ষণ পরিচিত রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে। মানুষের দার্শনিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে, তবু রেনেসাঁর সময়ও সমকামীদের উপর আইনি নির্যাতন অব্যাহত ছিল। রিচার্ড পুলার ভন হোহেনবার্গ ছিলেন জুরিখের একজন নাইট। ১৪৮২ সালে তার সঙ্গীর সঙ্গে তাকে জনসমক্ষে পুড়িয়ে মারা হয়। ১৩৪৮ সালে ভেনিসে ‘কাউন্সিল অফ টেন’ গঠিত হয় আইনরক্ষার জন্য। দু’জন পরিচারক পিয়েত্রো ডি ফেরারা আর গিয়াকর্নেলোকে তারা সমকামের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে এবং প্রথমজনকে পুড়িয়ে মারে। ১৪৭৪ সালে ভেনিসে পাডুয়ানো ডি’অলট্রান্টো এবং মারিনো অ্যালেগ্রেটিও একই শাস্তি পেয়েছিলেন। ভেনিসীয় নৌকার মালিক নিকোলো মারমাগনা এবং তার ভৃত্য জিওভানি ব্রাগানজাও সমকামিতার জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত হয়। শহরের প্রাশাসনিক রেকর্ডে এই নামগুলো লিপিবদ্ধ হয়েছিল। ইউরোপের শক্তিশালী আইনী ব্যবস্থা এবং রেকর্ড রাখার ব্যবস্থার ফলশ্রুতি হিসেবেই এতগুলি নথিভুক্ত নাম পাওয়া যায়। এই নথিবদ্ধ নামগুলো থেকে এটাও বোঝা যায় যে, আইনব্যবস্থা সুসংগঠিতভাবে এই শাস্তিদানের কাজ করছিল।

ভেনিসে সমকামীদের সামাজিক অবস্থান কতটা খারাপ ছিল তা একটা উদাহরণ থেকে বোঝা যায়। ১৪৯৭ সালের ক্রিসমাসের দিনে, সান মার্কো চার্চের বিশপ ভেনিসের ডিউক-এর কাছে আবেদন করেছিলেন: “আপনি প্লেগের ভয়ে গীর্জাগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু, যদি ঈশ্বর চান, তাহলে গীর্জা বন্ধ করার প্রয়োজন হবে না। প্লেগ এড়ানো যেতে পারে যদি আপনি প্লেগের কারণগুলিকে নির্মূল করেন আর সেগুলি হলো [এই শহরে] সংঘটিত ভয়ঙ্কর সব পাপ— ঈশ্বরনিন্দা এবং সাধুদের নিন্দা, সমাজে পুরুষদের সমকামিতা বা পায়ুকাম, রিয়াল্টোতে করা অগুনতি সুদখোর চুক্তি…”। এটি ছিল ভেনিসকে প্লেগ থেকে মুক্ত করার জন্য বিশপের দাওয়াই।

ডিউক মহামারী প্রশমিত করার জন্য গির্জা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, ভিড়-জমায়েত রোধ করার জন্য, যা বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। অন্যদিকে বিশপ চেষ্টা করেছিলেন ডিউক এবং জনসাধারণকে বিশ্বাস করানোর যে, চার্চের সমাবেশ প্লেগের কারণ নয় বরং নাস্তিকতা এবং সমকামিতা ছিল মহামারীর আসল কারণ। সমকামী, নাস্তিক, ইহুদি সহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে মহামারীর জন্য দোষারোপ ইউরোপে বহুযুগ ধরে প্রচলিত। জাস্টিনিয়ানের সময়ের উদাহরণ আমরা দেখেছি, আবার নবজাগরণ-পরবর্তী ইউরোপেও দেখছি‌।

১৫৩৩ সালে ইংল্যান্ডে রাজা অষ্টম হেনরি একটি আইন প্রণয়ন করেন যেখানে বিকল্প যৌন আচরণ (buggery)-এর শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়। প্রাচীন গ্রিক শিল্পকলা ও দর্শনকে ফিরিয়ে আনা সত্ত্বেও, রেনেসাঁ যুগ ব্যর্থ হয়েছিল গ্ৰিসের যৌন সহনশীল সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতে। অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি ইউরোপে সমকামিতার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের নজির আছে— ফ্রান্সেই ১৭৫০ সালে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় দুজন সাধারণ কৰ্মী মানুষকে,জন ডিয়ট এবং ব্রুনো লেনিয়র, সমকামিতার অপরাধে।

পুড়িয়ে মারার যে শাস্তিগুলো হতো সেগুলো শহরের মাঝখানে বিপুল জনসমাবেশের মাঝে হতো। সাধারণ মানুষ এগুলো দেখতে আসত, উপভোগ করত। প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার আরেকটা কারণ ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সবসময় মৃত্যুদণ্ড হতো না, জেল-জরিমানার মতো শাস্তিও হতো সমকামিতার অপরাধে। অনেক মৃত্যুদণ্ডের উদাহরণ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, অভিজাতদের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি অনেকসময়ই দেয়া হতো ব্যক্তিগত ঈর্ষা-বিদ্বেষ থেকে, অনেক সময় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য। পূর্বে উল্লিখিত জুরিখের নাইট হোহেনবার্গ-এর উদাহরণে দেখা যায়, তিনি সন্তানহীন ছিলেন, সম্পত্তির খুব নিকট দাবিদার কেউ ছিল না। অতএব শহরের প্রশাসনের কাছে এটা একটা সুযোগ ছিল তাঁর সম্পত্তি হস্তগত করার। তাঁর সঙ্গে তাঁর পরিচারক তথা প্রেমিক এন্টোন মাজলারকেও একসঙ্গে বেঁধে পোড়ানো হয় যাতে কোনো দাবীদার না থাকে। হোহেনবার্গকে পোড়ানোর আগে জনসমক্ষে স্বীকারোক্তি করতে বলা হয়, সেখানে স্বীকারোক্তির বদলে তিনি শহরের মেয়র এবং অন্যান্য প্রশাসকদের দুর্নীতি আর তাঁর সম্পত্তির উপর প্রশাসকদের লোভ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। সমাজের নিচের স্তরের লোকেদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো অন্য কারণে, দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য, তাছাড়া আইনি লড়াই করার মতো সঙ্গতিও তাদের থাকত না।

তবে সব জায়গার আইন সমান ছিল না। ইতালিতে ভেনিসে যেখানে সমকামিতার দায়ে একের পর এক মৃত্যুদণ্ডের নজির দেখা যায়, সমকালীন ফ্লোরেন্সে তুলনামূলকভাবে সহনশীল পরিবেশ দেখা যায়।

সবমিলিয়ে আমরা দেখতে পাই, আইনি পরিবেশের বিচারে ইউরোপের এই কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে অন্ততঃ তিনটি পর্যায় ছিল-

১) ৩৯০ সালের আগে: সমকামবিরোধী আইন তেমনভাবে নেই। সাহিত্য, রাজনীতি ও শিল্পের বিশ্লেষণ করলে সহনশীলতার পরিবেশই চোখে পড়ে।

২) ৩৯০-১১০০ সাধারণাব্দ: রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর খ্রিস্টান ধর্মের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, সমকামবিরোধী আইনব্যবস্থা, তবে বিচার এবং শাস্তির প্রচুর নথি নেই।

৩) ১১০০ সাধারণাব্দের পর: আইনশিক্ষা এবং নথিভুক্তকরণের প্রসার, আর তার ফলে সমকামীদের বিচার এবং শাস্তির বহুল পরিমাণ তথ্য পাওয়া যায়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে শিল্প বিপ্লব এবং ১৭৯০ সালের দিকে ফরাসি বিপ্লবের ফলে মানুষের ভাবনাচিন্তা উন্নত হতে শুরু করে। বেশিরভাগ ফরাসিভাষী দেশ এবং প্রদেশে (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা) সমকামিতা ১৭৯০-এর দশকে বৈধ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ফরাসি বিপ্লব ফ্রান্সকে ডি-ক্রিশ্চিয়ানাইজেশনের দিকে পরিচালিত করেছিল। ৩৯০ থেকে ১৭৯০ সাল অবধি ফ্রান্সে দীর্ঘ ১৪০০ বছর ব্যাপী প্রচলিত খ্রিস্টান শাসন ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৭৯১ সালের নতুন ফরাসী আইন সমকামিতা ও ধর্মদ্রোহিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেয়। প্রতিবেশী ফরাসিভাষী দেশ বেলজিয়ামে ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব পড়ে এবং ১৭৯৫ সালে সমকামিতাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাইরে আনা হয়।

১৮৫৮ সালে ওটোমান শাসিত তুরস্কে সমকামিতাকে বৈধতা দেয়া হয়। মুসলিম শাসিত তুরস্ক বেশিরভাগ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের আগে সমকামিতাকে বৈধ করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে সমকামিতা বৈধতা পায়— মেক্সিকো ১৮৭২ আর আর্জেন্টিনা ১৮৮৭। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে ১৯৬৭ অবধি সমকামিতা অবৈধ ছিল। পূর্ব ইউরোপ আরো পিছিয়ে। রাশিয়াতে বলশেভিক বিপ্লবের পর ১৯২২-এ সমকামিতাকে অপরাধের তালিকার বাইরে আনা হয়, কিন্তু ১৯৩৩ সালে স্তালিনের শাসনকালে আবার এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। রাশিয়াতে এখনও সমকামীদের উপর আইনি নিপীড়ন হয়। কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থা ভূমিকম্প আর বন্যার জন্য সমকামিতাকে দায়ী না করলেও, সমকামিতার প্রতি তাদের মনোভাবও ধর্মভীরু সমাজের মতোই ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে সমকামিতা বৈধতা পায়।

শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: দু’জন পুরুষ, রিচার্ড পুলার ভন হোহেনবার্গ এবং অ্যান্টন ম্যাজলার, সোডোমির দায়ে অভিযুক্ত, পুড়িয়ে মারা হচ্ছে— জুরিখ ১৪৮২।

তথ্যসূত্র:

  • James M. Saslow, “Pictures and Passions A History of Homosexuality in the Visual Arts”, Viking (1999)
  • Hajek, Nicolaus J. (2015) “Still a Rivalry: Contrasting Renaissance Sodomy Legislation in Florence and Venice,” Black & Gold: Vol. 1.
  • Thomas K. Hubbard, “Homosexuality in Greece and Rome A Sourcebook of Basic Documents”, University of California press (2003)
  • Patrick Demetrios Viscuso, “Sexuality, marriage, and celibacy in Byzantine law”, HOLY CROSS ORTHODOX PRESS (2008)
  • Clyde Pharr, “The Theodosian Code and Novels, and the Sirmondian Constitutions”, PRINCETON UNIVERSITY PRESS (1952)
  • Jill Harries, Ian Wood “The Theodosian Code Studies in the Imperial Law of Late Antiquity”, Duckworth (1993)
  • Athansius, “Apologia contra Arianos” 3.5.230 (collected from online source: Documenta Catholica Omnia)
  • Paul’s Epistles from the website: BibleGateWay

মন্তব্য তালিকা - “ইউরোপীয় আইনের চোখে সমকামিতা”

  1. লেখাটি ভালো লাগলো। খুব বেশি জানতাম না। বিশেষ করে রেনেসাঁ পিরিয়ড এর আগের সময় সম্পর্কে।এভাবে পর্যায় ভাগ করে দেওয়ায় বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা করা গেল।
    ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়ক একটি নিবন্ধ আশা করছি।

    1. অনেক ধন্যবাদ। ভারতীয় সাহিত্যে সমকামিতা নিয়ে এর আগে এই পোর্টালে লিখেছি, তবে প্রাচীন ভারতের আইনের প্রেক্ষিতে এই বিষয়ে লেখা একটু মুশকিল, কারণ ভারতীয় আইনের ইতিহাস পাশ্চাত্যের মতো অতোটা সুসংহতভাবে পাওয়া যায় না

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।