সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

হরপ্পীয় খাদ্যাখাদ্য

হরপ্পীয় খাদ্যাখাদ্য

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২১ ১৪৪৮ 10

আমাদের পূর্বজদের খাদ্য কী ছিল? আজ থেকে চার হাজার বছর আগে উত্তর-পশ্চিম ভারতবর্ষে মানুষ কী খেতে পছন্দ করত? হরপ্পীয়রা কী শাকাহারি ছিল, নাকি সঙ্গে মাছ মাংস চলত?

কীভাবে সে কথা জানা যেতে পারা যায়?

নয়-দশ হাজার বছর আগে, নব্যপ্রস্তর যুগে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ স্থানে মানুষ শিকার ও খাদ্যসংগ্রহ করে দিনাতিপাত করত। তবে তার মধ্যেই শুরু হয়েছে বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে খাদ্য উৎপাদনের হাতেখড়ি। দক্ষিণ এশিয়ায় বেলুচিস্তানের মেহেরগড় ছিল খাদ্য উৎপাদনের সূচনাপর্বের প্রতিনিধি। মেহেরগড়ের অবস্থান ইরানের মালভূমি ও সিন্ধু নদের মধ্যবর্তী অঞ্চলে। এই অঞ্চলে নয় থেকে সাড়ে সাত হাজার বছর আগে গম ও বার্লি চাষ শুরু হয়েছে; ছাগল, ভেড়া ও গবাদি পশু গৃহপালিত করা হয়েছে।

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু উপত্যকা ছিল সুজলা ও সুফলা। উর্বর জমি। ওখানে চাষ হত বার্লি, গম। পালন করা হত ভেড়া, ছাগল, গবাদি পশু। তারা খাদ্য শস্য হিসেবে গম, বার্লি ইত্যাদি ব্যবহার করেছে। সঙ্গে খেয়েছে ফল, মসুর এবং মটর, ছোলা, সবুজ ছোলা এবং কালো ছোলা ডাল। আর খেত মাছ। মাছের কাঁটা নদীর তীর থেকে বহু দূরেও পাওয়া গেছে।

তৃতীয় সহস্রপূর্বাব্দে ওই অঞ্চলে মানুষের মূল পেশা ছিল কৃষি, পশুপালন ও মৎসশিকার। ধাপে ধাপে প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদনের পরে শুরু হয় নিজস্ব প্রয়োজনে ছোট শিল্পদ্রব্য নির্মাণ। হরপ্পীয় সভ্যতা উপমহাদেশের প্রথম নগরকেন্দ্রিক ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা। শেষে যখন উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয় তখন তৈরি হয় নগর ও সড়ক, শুরু হয় সমুদ্রবাণিজ্য। তখনকার সভ্য পৃথিবীর মুখ্য অংশের সাথে যোগাযোগের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম, উত্তর, এমনকি দক্ষিণের পশ্চাদভূমি থেকে পণ্য সংগ্রহ করে হরপ্পীয়রা ভারতের প্রথম নৌবাণিজ্য দক্ষতার সাথেই চালিয়েছে।

আজ থেকে অন্তত ৫,২০০ বছর আগে থেকে ওই অঞ্চলে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠে। এই সময়ে বহু কারুশিল্পের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় ৩,৯০০ – ৪,৬০০ বছর আগের সময়কালে বিরাট ভৌগোলিক এলাকায় নানা জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংশ্লেষ ও সমন্বয়ের কাজ আরম্ভ হয়, কিছুটা সাংস্কৃতিক অভিন্নতাও আসে। ওই সময়টাকে বলে হরপ্পীয় সভ্যতার ঐতিহ্যের যুগ। শেষে আসে আবার সমসত্ত্ব সংস্কৃতির স্থানীয়করণের যুগ। এই সময়ে শুরু হয় উল্টো পথে হাঁটা। বড় সংযুক্ত অংশগুলি যেন ছোট ছোট অঞ্চলে ভেঙে যায়।

ওদের সাথে যোগাযোগ ছিল তখনকার ব্রোঞ্জ যুগের বিভিন্ন সভ্যতাগুলির। মেসোপটেমিয়া, দিলমুন বা আজকের বাহরিন। প্রাচীন নগর ‘শহর-ই-শোকতা’ অথবা অক্ষু নদীর তীরে তুরান ও আফগানিস্তান অঞ্চলে সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো ব্রোঞ্জ যুগের ‘ব্যাকট্রিয়া মার্জিয়ানা আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্স’-এর সাথে।

হরপ্পীয় সভ্যতার দুই বৃহত্তম ও মহত্তম প্রত্নস্থল, মহেঞ্জোদাড়ো (সিন্ধ অঞ্চল) ও হরপ্পা (পশ্চিম পাঞ্জাব অঞ্চল) বর্তমানে পাকিস্তানে অবস্থিত। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে আরও কতগুলি বৃহৎ প্রত্নস্থল আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে কালিবঙ্গান (রাজস্থান), রাখিগড়ি (হরিয়ানা), ধোলাভিরা ও লোথাল (গুজরাট) বহুচর্চিত হরপ্পীয় প্রত্নস্থল। উত্তরে জম্মুর মান্ডা থেকে পশ্চিমে বালুচিস্তান, দক্ষিণে গুজরাট সীমান্ত থেকে পুবে দিল্লি ছুঁয়ে এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিল। বর্তমানে ১৫০০ প্রত্নস্থলের মধ্যে ৯২৫টি প্রত্নস্থল খুঁজে পাওয়া গেছে ভারতবর্ষে।

বিগত ১০০ বছর ধরে হরপ্পীয় সভ্যতার বিভিন্ন সাইটগুলিতে পাওয়া গেছিল প্রভূত পরিমাণে গবাদি পশু, ভারতীয় মহিষ, ভেড়া, ছাগল, পাখি, শূকর ইত্যাদির কঙ্কাল। তার মধ্যে গবাদি পশু ও মহিষের কঙ্কালের পরিমাণ প্রচুর। কঙ্কালের অবশেষ এবং নৃতাত্ত্বিক তথ্যের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, বেশ কয়েকটি গবেষণা মনে করেছে যে, গবাদি পশু এবং মহিষের মাংস, দুধ ওরা খেত। তাছাড়া চামড়া দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বস্তু তৈরি করত। আর অন্যান্য শ্রম-ভিত্তিক কাজের জন্যও পশুদের ব্যবহার করা হত।

“গড়ে বিভিন্ন হরপ্পীয় প্রত্নস্থল থেকে প্রায় ৮০% প্রাণীর অবশেষ গৃহপালিত প্রাণী প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। গৃহপালিত প্রাণীগুলির মধ্যে আবার গবাদি পশু/মহিষ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, গড়ে ৫০ থেকে ৬০%। মেষ/ছাগল রয়েছে প্রায় ১০%।” গবেষণায় বলা হয়েছে, “গবাদি পশুর হাড়ের উচ্চ পরিমাণ সিন্ধু জনগোষ্ঠীর গো-মাংস খাওয়ার সাংস্কৃতিক অগ্রাধিকারের ইঙ্গিত দেয়, যা মাটন/মেষশাবকের মাংস দ্বারা পরিপূরণ করা হত।”

বিভিন্ন গবেষণা থেকে ওপরের সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়েছিল। অনেকে অবশ্য এগুলিকে চূড়ান্ত প্রমাণ বলে মানতে রাজি হন না।

তবে এই নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। এই কাজে অংশ নিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের গবেষক অক্ষয়েতা সূর্যনারায়ণ। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামেরন পেট্রি গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। অংশ নিয়েছেন ভারতের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ বসন্ত সিন্ধে। ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিকে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি প্রত্নস্থল হল রাখিগড়ি, ফরমানা, লোহারি রাগো, মাসুদপুরা, খানক ও আলমগীরপুর। আলমগীরপুর বাদে অন্য সব প্রত্নস্থলগুলি হরিয়ানাতে অবস্থিত। আলমগীরপুরের অবস্থান উত্তর প্রদেশে।

এর মধ্যে রাখিগড়ি ছিল বড় শহর, অনেকটা মহেঞ্জোদাড়োর মত। ফরমানা ছোট শহর, বাকিগুলি ছিল বড় বা ছোট গ্রাম।

এই সব প্রত্নস্থল থেকে ১৭০টি সিরামিক পাত্র ওরা সংগ্রহ করেছেন। এই পাত্রগুলি ব্যবহৃত হয়েছে হরপ্পীয় সভ্যতার ঐতিহ্যের যুগে (২৬০০ থেকে ১৯০০ সাধারণ পূর্বাব্দ)। ওরা ওই পাত্র সংগ্রহ করে তাতে শস্যদানা খোঁজেন নি। প্রাচীনকালের মাটির বাসনে অনেক সময়ে লেগে থাকে লিপিড নাম এক রাসায়নিক পদার্থ। লিপিডের অবশিষ্টাংশ তুলনামূলকভাবে কম নষ্ট হয়। তাই বিশ্বজুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি থেকে এই লিপিড নিয়ে বিশ্লেষণ করে তার উৎস নির্ণয় করা হয়। লিপিড বিশ্লেষণ করে প্রাচীন খাদ্যের অনুসন্ধান করা প্রত্নতত্ত্বের গবেষণায় এক আদর্শ পদ্ধতি। তবে ভারতবর্ষে এখনও এর প্রচলন কম।

ওরা এই পদ্ধতিতে মাটির বাসনে অনেক সময়ে লেগে থাকে লিপিড বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে:

“সিন্ধু মৃৎশিল্পে লিপিডের অবশিষ্টাংশের সমীক্ষায় পশুর লিপিডের প্রাধান্য দেখা যায়, যেমন শূকরের মত রোমন্থন না করা প্রাণীর মাংস বা গরু, মহিষের মত রোমন্থনকারী পশুর মাংস অথবা ভেড়া বা ছাগলের মাংস। এছাড়াও পাওয়া গেছে দুগ্ধজাতীয় খাদ্য,” Indian Express পত্রিকায় সূর্যনারায়ণ বলেছেন।

“Our study of lipid residues in Indus pottery shows a dominance of animal products in vessels, such as the meat of non-ruminant animals like pigs, ruminant animals like cattle or buffalo and sheep or goat, as well as dairy products.”

যদিও প্রত্নস্থলগুলি থেকে শূকরের অবশেষ পাওয়া গেছে মোট প্রাণী অবশেষের মাত্র ২-৩% তবে লিপিডের জন্য বিশ্লেষণ করা প্রায় ৬০% পাত্রে শূকর জাতীয় প্রাণীর ফ্যাট পাওয়া গেছে। এটা বেশ চমকপ্রদ তথ্য। অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলি থেকে শূকর বা পাখির ছোট অস্থির পুনরুদ্ধার করার কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। তুলনায় গবাদি পশুর কঙ্কাল পাওয়া সহজ। তাই সিরামিকের হাঁড়িগুলিতে প্রাপ্ত উচ্চ-শতাংশযুক্ত শূকর মেদ এবং বিভিন্ন সাইট থেকে সংগৃহীত শূকর কঙ্কালের টুকরোর সংখ্যার ব্যবধানের কারণ হতে পারে কঙ্কাল সংগ্রহের অক্ষমতা।

এক হিসেবে এই সব তথ্য খুব একটা চমকপ্রদ হয়ত নয়। কারণ ব্রোঞ্জ যুগে দক্ষিণ, মধ্য ও সেন্ট্রাল এশিয়ার বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে যা প্রাণী অবশেষে পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় মূলতঃ সবাই ছিল মাংসাশী। মেসোপটেমিয়ানরাও।

তবে কিছুদিন আগে এই সব নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। হরপ্পীয় সভ্যতার খাদ্য নিয়ে দিল্লিতে এই বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির জাতীয় জাদুঘর, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক এবং একটি বেসরকারী সংস্থা যৌথভাবে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। তাতে যারা যোগ দিয়েছিলেন, তারা ওই সময়ের কিছু খাবার চাখতে পারবেন এমন আয়োজন করা হয়েছিল। বেশ সারা জাগানো ব্যাপার।

সেই খাদ্য তালিকা যথেষ্ট গবেষণা করে তৈরি করা হয়েছিল। তাতে ছিল নানাবিধ নিরামিষ ও আমিষ খাদ্যসম্ভার। অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে রাতারাতি সমস্ত আমিষ খাদ্য অবশ্য তুলে নেওয়া হয়।

অর্থাৎ হরপ্পীয়রা মাংস খেত না, এমন প্রমাণ করার একটা তাগিদ যেন ওদের ছিল।

যাহোক, সেই তাগিদ জলাঞ্জলি গেল। এখন প্রমাণিত হরপ্পীয়রা শুধু যে মাংসাশী ছিল তাই নয়, ওরা সবচাইতে ভালোবাসত গরু ও শূকরের মাংস খেতে।

ও হ্যাঁ। আজকে প্রমাণিত প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে যদি কোন তিনটি জিন সর্বব্যাপী হয় সে তিনটি হল আন্দামানের ওঙ্গে জনজাতির জিন (মাতৃক্রমে) আর হরপ্পীয় এবং স্তেপভূমির অর্ধ-যাযাবর পশুপালকদের জিন (পিতৃক্রমে )।

পালাবার পথ নেই। ঐতিহ্যকে মুছে দেওয়া যায় না।

তথ্যসূত্র:

1. Akshyeta Suryanarayana, “Lipid residues in pottery from the Indus Civilisation in northwest India,” Journal of Archaeological Science, Volume 125, 105291, January (2021)

2. P.P.Joglekar, C.V. Sharada, G.S. Abhayan “Faunal diversity during the Harappan period in Haryana,” Heritage: Journal of Multidisciplinary Studies in Archaeology, 1, 262-287, (2013)

3. L.J. MillerSecondary products and urbanism in South Asia: the evidence for traction at Harappa

S. Weber, W.R. Belcher (Eds.), Indus Ethnobiology, Lexington Books, Oxford, 251-326, (2003)

4) Sheeren Ratnagar, “Understanding Harappa: Civilization in the Greater Indus Valley,” Tulika Book, Chapter 3, October (2002)

5) Jane R McIntosh, “The Ancient Indus valley – New Perspective,” ABC-CLIO, Chapter III, (2008)

6) David G. Mahal et al., “The Geographic Origins of Ethnic Groups in the Indian Subcontinent: Exploring Ancient Footprints with Y-DNA ,” Front Genet, 9(4.), (2018)

৭) indianexpress//indus-valley-civilisation-diet

৮) Newsclick/harappan food habits

লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “হরপ্পীয় খাদ্যাখাদ্য”

  1. ইতিহাসই মানুষকে সেই চেতনা যোগায় যে উন্নততর মানব সভ্যতা ক্রম বিকাশের পথে আবর্তিত; কোন পূর্ব-চর্চিত ধারা তার অগ্রগতির প্রতি বন্ধক।কত অজানারে জানাইলে তুমি,তোমায় করিগো নমস্কার”।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।