সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বিবর্তন: আদি যুদ্ধ আদি প্রেম

বিবর্তন: আদি যুদ্ধ আদি প্রেম

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

নভেম্বর ১২, ২০২২ ৩৫৮ 4

(বইয়ের নাম: বিবর্তন: আদি যুদ্ধ আদি প্রেম; লেখক: ডা. জয়ন্ত দাস; প্রকাশক: গাঙচিল; প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০২১, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৬৬)

“বেঁচে থাকা প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীরা বিবর্তনের ফলে বেঁচে থাকে না, সবচেয়ে বুদ্ধিমানরাও বিবর্তনের ফলে বেঁচে থাকে না, যারা পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি অভিযোজিত হতে পারে তারাই টিকে থাকে।”

প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রকৃতিবিদ, ভূতত্ত্ববিদ চার্লস ডারউইন একথা বলেছেন।

তবু আজও বিবর্তনের উপলব্ধিতে একটি দোলাচলমানতা আমাদের অনেকের মধ্যে রয়েছে। একদিকে, এর পক্ষে এতই পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে যে বিবর্তনকে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিজ্ঞানীরা বিবর্তনকে জীববিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় নীতি হিসাবে মনে করেন। অন্যদিকে, এক অংশের মানুষের মধ্যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে, বিবর্তনের বিষয় ও প্রক্রিয়াটি যেন বিতর্কিত। অনেকে আবার বিবর্তনবাদকে ধর্মবিরোধীও মনে করেন।

বিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশে তবু কিছু বই লেখা হয়, এপার বাংলায় শেষ যে বাংলা বইটি বহুপঠিত হয়েছিল, সেটি ষাট বছরের বেশি পুরোনো। অথচ বিগত ছয় দশকে বিজ্ঞানের ব্যাপক আধুনিকীকরণ হয়েছে, বিভিন্ন কেতাবি বিষয়ে বিজ্ঞানের ব্যবহার বেড়েছে। আজকের বিবর্তনবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নতুন চর্চার বিষয় হল জিনবিদ্যা, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ইত্যাদি। আবার সাবেকি ভূতত্ত্ববিদ্যা, নৃতত্ববিদ্যা ও প্রত্নতত্ত্ববিদ্যাও নবরূপে জীবের বিবর্তন চর্চাতে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এইসবের ফলে বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে বিপুল তথ্য। জোরদার হয়েছে বিবর্তনবাদের পক্ষে যুক্তি।

আবার আজকের পাঠকের হাতেও আছে ইন্টারনেট, মোবাইল, হোয়াটস্যাপ। এর সমান্তরালে বাংলা ভাষায় বিবর্তনবাদ চর্চার প্রয়োজনে আধুনিক মননের উপযোগী বিবর্তন ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের শারীরিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমপরির্তন নিয়ে গ্রন্থের প্রয়োজন আছে। সেই গ্রন্থ এমনভাবে লিখিত ও পরিবেশিত হতে হবে, যা হবে বস্তুনিষ্ঠ, বিষয়মুখী তথ্যযুক্ত, সহজ, সরল ও সরসভাবে সমগ্র পাঠককুলকে আকৃষ্ট করার মতো।

সাধারণ পাঠকের কথা ভেবে বাংলায় জীবের তথা মানুষের উদ্ভব ও জন্মকুলজি নিয়ে ভাল বই অত্যন্ত জরুরি। সেই বইয়ের মূল থিম হবে বিবর্তনের মূলসূত্রগুলো নিয়ে আলোচনা। প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যৌন নির্বাচন কেমন করে জীবনের অজস্র জটিলতার সরল ব্যাখ্যা দিতে পারে, আর কীভাবে এক ধরনের বনমানুষ আস্তে আস্তে মানুষ হয়ে উঠল আজকের ছেলে মেয়েদের উপযোগী ভাষায় তা লেখা সহজ কাজ নয়। আবার বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে সেই বই যেন প্রচারমূলক ও প্ররোচনামূলক না হয়ে যায়।

এই অবস্থায় জয়ন্ত দাসের প্রকাশিত বই ‘বিবর্তন: আদি যুদ্ধ আদি প্রেম’ পড়তে গিয়ে মনে হল, এক চমৎকার সময়োপযোগী বই পড়লাম। নামের নতুনত্ব প্রথমেই আকর্ষণ করে। বিবর্তন কেন আদি যুদ্ধ, বিবর্তনের সঙ্গে আদি প্রেমের সম্পর্ক কোথায়! সেই কথা জানা যাবে বইটা পড়ে।

বইটিতে সরল ও সরস ভাষায় বিবর্তনবাদ বোঝানোর জন্য বিভিন্ন তথ্যসমূহ, ক্ষুরধার যুক্তি, মৌলিক উদাহরণ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। এই বই পড়তে গিয়ে বারবার ক্লান্ত হতে হয়নি, বিরক্তিকর মনে করে হাত থেকে ফেলে দিতে হয়নি। বাংলা ভাষার এক অতি সমৃদ্ধ ধারা হল রম্যরচনা। এই বইটি পড়তে গিয়ে আরেক প্রাপ্তি হল লঘুচালের সৃষ্টিমূলক গদ্য রচনার সেই পুরনো ধারা যেন কেতাবি বিজ্ঞান বইয়ে নতুন করে পাওয়া গেল।

মূল ধারা ও বিভিন্ন সংযোগকারী বিষয়ের পর্যালোচনার জন্য ছোট ছোট বারোটি বাহুল্যবর্জিত অধ্যায়ে বইটি লেখা হয়েছে।

কেন আমি বাবা মায়ের মত দেখতে, প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছে এই প্রশ্ন দিয়ে। লেখক বিভিন্ন ধর্মে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে যে চর্চা আছে তা আলোচনা করে ডারউইনীয় বিবর্তনের সপক্ষে তথ্যগুলি পেশ করেছেন। বিখ্যাত বিবর্তনবাদী লেখকদের মত বৈরীভাব উদ্রেক না করেও লেখক ধর্মীয় শাস্ত্রের তত্ত্বগুলিকে বিবর্তনের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন। সেই সময়ের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করে নির্মোহ দৃষ্টিতে যুক্তি দিয়ে লেখার এই পদ্ধতি বইয়ের পাঠযোগ্যতা বৃদ্ধি করবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডারউইনীয় বিবর্তনের মূল তিনটি সূত্র ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যোগ্যতমের জয়, স্বার্থপর জিন এই সব বাজার চলতি শব্দবন্ধ শেষ পর্যন্ত সমাজের স্থিতাবস্থা রাখার পক্ষেই ব্যবহৃত হয়। আসলে বিবর্তনবাদ যে সেই অর্থে যোগ্যতমের জয় শব্দ ব্যবহার করেনি তা অনেকেরই অজানা থেকে গেছে। অধ্যায়টি মূল্যবান।

বাঙালির জ্ঞানচর্চার বাইরে বেরিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রাণীর যৌন নির্বাচন নিয়ে। সেখানে বিস্তারিতভাবে এসেছে পোকা থেকে বিভিন্ন ধরনের এপ-এর যৌন নির্বাচন পদ্ধতির কথা, এমনকি মানুষ-মানুষীর আলোচনাও বাদ যায়নি। কেন স্ত্রী-পছন্দ প্রকৃতিতে এত গুরুত্বপূর্ণ? কোন প্রাণীতে পুরুষ-পছন্দ গুরুত্ব পায়? বহুগামিতা কি পুরুষের স্বাভাবিক ধর্ম? প্রাকৃতিক নির্বাচন ও যৌন নির্বাচন পরস্পর বিপরীতধর্মী হলে কোন বৈশিষ্ট্য প্রাণীর মধ্যে প্রাধান্য পায়? চির-নাবালক বাঙালি সরস ও উৎকৃষ্ট সাবালক আলোচনার পরিসর পাবেন এই অধ্যায়ে।

চতুর্থ অধ্যায়ে আছে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তনের কথা। কবে দু পায়ে মানব হাঁটল, কীভাবে বিভিন্ন মানব প্রজাতি এই পৃথিবীতে সহাবস্থান ও প্রতিযোগিতা করেছে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সহকারে তার আলোচনা করা হয়েছে।

এই অধ্যায়টি দীর্ঘ, আরেকটু নির্মেদ হলে ভাল হত।

পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক জেনেটিক সাক্ষ্য সহকারে বিবর্তনের ধারাবাহিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। বংশগতি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনে এই অধ্যায়ে লেখক জিন, জিনের পরিবর্তন, ডিএনএ, ইত্যাদি প্রসঙ্গ এনেছেন। বিজ্ঞানের জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও সকলের বোধগম্য করবার জন্য চমৎকার সব উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শুরু ও শেষ হয়েছে। তবে এই অধ্যায়টিও আরও সরল করা যেত।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন দেহ গঠনে পূর্ব পরিকল্পনা বিষয়ে যেসব ভাবনা আছে তা নিয়ে। যে কোন প্রত্যঙ্গের আদিরূপে গিয়ে বোঝা যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ধাপে ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে সেই জটিল প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়েছে।

স্বার্থপর জিন আজকের চলতি লব্জ। লম্বা অণুর এক টুকরো কীভাবে স্বার্থপর হয়? সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে লেখক স্বার্থপর জিন ও তার সামাজিক পরার্থপরতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মা ও সন্তানের মধ্যে যে সম্পর্ক সেখানেও কি লুকিয়ে আছে স্বার্থপর জিনের আচরণ?

নবম ও দশম দুটিই অণু অধ্যায়। এই দুই অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতি বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত হয়েছে। সীমান্ত ও সঙ্গমের দুরূহতা, সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা কীভাবে বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তনে সাহায্য করে চলেছে উদাহরণ সহযোগে তা আলোচনা করা হয়েছে।

বইয়ের বিশেষ মূল্যবান দুটি অধ্যায় হল, একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়। বিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন ভুল ধারণা থেকে গেছে, সেই ধারণাগুলি নিয়ে আমরা বিশেষ আলোচনা করি না। শেষ অধ্যায়ে লেখক ধৈর্য সহকারে প্রশ্ন উত্তরের ঢঙে বিবর্তন নিয়ে আমাদের বিভিন্ন ভুল ধারণা ও বিশ্বাস আধুনিক বিবর্তনের আলোকে আলোচনা করেছেন। এটা অনেকটা আজকের Frequently Asked Questions-এর মত। বিভিন্ন প্রশ্নের হাতে গরম উত্তর অনেককেই সন্তুষ্ট করবে।

বইটির দীর্ঘ বিশ্লেষণধর্মী মুখবন্ধ লিখেছেন জিনবিদ্যার বিশিষ্ট অধ্যাপক, ন্যাশনাল সায়েন্স চেয়ার পার্থ প্রতিম মজুমদার। জন বিজ্ঞানের বিখ্যাত সুলেখক আশীষ লাহিড়ী রিভিউ করে বইটির গুরুত্বের কথা জানিয়েছেন। অসংখ্য ছবি রয়েছে বইটি জুড়ে। ছবি না থাকলে বিবর্তন বিষয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। ছবিগুলো অতি চমৎকার। বইটির ছাপাই বাঁধাই কাগজ যথেষ্ট ভাল।

কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়েছে। কয়েকটি অধ্যায় একত্রিতভাবে লিখলে বইটা সামান্য সংক্ষিপ্ত হত। ভারতের জীব জন্তুর উদাহরণ আরও দেওয়া যেত। এসব সত্ত্বেও বলতে পারি, একই সঙ্গে জরুরি ও সুখপাঠ্য এই বই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার এক বড় ধাপ। বইটির আরেক শক্তি এর ভাষা। কাঁথা স্টিচের মত ভাষার ফোঁড় তুলে আধুনিকতম বিবর্তনবাদের যুক্তিসমৃদ্ধ আলোচনা বহু সৃষ্টিবাদী মানুষকেও নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করবে, এই আস্থা রাখি।

লেখক জয়ন্ত দাসকে ধন্যবাদ কঠিন কাজটি করবার জন্য।

লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “বিবর্তন: আদি যুদ্ধ আদি প্রেম”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।