সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

একটি বিষণ্ণ বইয়ের রিভিউ

একটি বিষণ্ণ বইয়ের রিভিউ

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ডিসেম্বর ৭, ২০২২ ২৯১ 5

(গ্রন্থ নাম: দ্য সিক্সথ এক্সটিঙ্কশন: আন অনন্যাচারাল হিস্ট্রি; লেখক: এলিজাবেথ কোলবার্ট; প্রকাশক: হেনরি হল্ট অ্যান্ড কোম্পানি, ২০১৪)

ইতিহাস কি শুধু মানুষের? আর প্রকৃতির? প্রকৃতির ইতিহাস আমরা জানি তো? প্রকৃতিকে কি আমরা পাল্টে দিচ্ছি? প্রকৃতি পাল্টে গেলে অসীম ক্ষমতাধর মনুষ্য প্রজাতি বেঁচেবর্তে থাকবে তো?

বইটা পড়তে পড়তে বারবার মনে হয়েছে, যেন কোন এক ভুতুড়ে, অন্ধকারময় গ্রহে একজন মানুষ ঘুরে চলেছেন প্রাণের হদিস পেতে। দুর্গমতম স্থানে যাচ্ছেন নিজের চোখে দেখতে পাখিরা, পশুরা ভাল আছে তো?

তারা ভাল নেই। তারা মরে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

পৃথিবীতে পাখি বা স্তন্যপায়ীর আগে এসেছে উভচরেরা। এমন এক উভচর হল ব্যাঙ। এক দশক আগেও পানামার সোনালী ব্যাঙ ওই অঞ্চলে ছিল অগুনতি। এখন তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেক পরীক্ষার পরে বোঝা গেল তারা মরে যাচ্ছে, কারণ তাদের গায়ে হচ্ছে এক ধরণের ফাঙ্গাস। সেই ফাঙ্গাস কিন্তু ওই অঞ্চলে হয় না। মানুষ বাহিত ফাঙ্গাসে মরে যাচ্ছে পানামার সোনালী ব্যাঙেরা।

পানামার সোনালী ব্যাঙ

মানুষ যখন প্রথম আইসল্যান্ডে বসতি করে, কিছুদিনের মধ্যে সে শেষ করে ফেলে লক্ষ লক্ষ অক পাখিদের। এরা এক জাতীয় পেঙ্গুইন; বেচারারা উড়তে পারত না। এতদিন দিব্বি সেখানে বাল বাচ্চা নিয়ে থেকেছে। মানুষ আসার কিছুদিনের মধ্যে নধর তৈল যুক্ত অক পাখিরা শেষ হয়ে গেল।

অক পাখি

এভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে অগুনতি পশু ও পাখি। সেই ১০ হাজার বছর আগে থেকে আমরা কৃষিকাজ শুরু করি, আর তারপরে অরণ্য পুড়িয়ে, গাছ কেটে পৃথিবীকে নিষ্পাদপ করবার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। প্রাণীদের শেষ আশ্রয় থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছি।

অনেকে বলবেন এত নতুন নয়। এর আগেও বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি হয়েছে। পৃথিবীর যৌবনকাল থেকে বেশ কয়েকবার প্রাণীকূলের গণবিলুপ্তি ঘটেছে। প্রাণী জগতের ব্যাপক বিলোপসাধনকে বলে মাস এক্সটিঙ্কশন। পৃথিবী থেকে অন্তত পাঁচবার প্রাণীকুল বিপন্ন হয়েছে বা বিলুপ্তির কাছাকাছি চলে গেছে। তবে সেইসব বিলুপ্তি ঘটেছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। এখন যা চলছে তাতে প্রকৃতি নেই, আছে একমাত্র মানুষ। মানুষ ছাড়া আর সব প্রাণী আছে শুধু মানুষের ব্যবহারের জন্য। ২০১৪ সালে বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে শুধুমাত্র শেষ ৪০ বছরে পৃথিবীর বন্য জন্তু ৫০% কমে গেছে।

একদিকে গণনিধন করে চলেছে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীকে, অন্যদিকে নিজেরা বংশবৃদ্ধি করে চলেছে অতি দ্রুত গতিতে।

১০ হাজার বছর আগে থেকে, মানুষ পরিকল্পনা করে খাদ্য উৎপাদন করতে শিখল। শেখে কৃষিকাজ, শেখে বনের পশুকে পোষ মানিয়ে পালন করতে। কৃষকরা জমির সমগ্র জৈববস্তুপুঞ্জকে পরিবর্তন করে দিল। একদিকে কৃষিজমি প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে বন্যপ্রাণীকুল বাস্তুচ্যুত হয়ে গেল। বৃক্ষ মরে গেল। প্রাণীকুলের সংখ্যা কমে গেল। আবার তারাই কিছু বন্য প্রজাতির প্রাণীকে পোষ্য বানিয়ে রাখল। বন্য প্রজাতিগুলি হ্রাস পেতে শুরু করল। যেমন বুনো ঘোড়া, গাধা, গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল এগুলো মূলতঃ হয়ে গেল পালিত পশু।

আগে মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যেত; জীবনের একটা দীর্ঘ সময়কাল সে থাকত কম খেয়ে। শিকার করাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ম্যামথ, ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে অনেকে নিহত হত। জনসংখ্যা ছিল অতি স্বল্প। কৃষিকাজ শুরু হবার পরে দৈনন্দিন খাদ্যে আসে সামান্য নিশ্চয়তা। সে বাস করতে থাকে সমতল ভূমিতে। বনে জঙ্গলে থাকার ঝুঁকি তাকে আর নিতে হয় না। সেই সময়ে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করে। ৭ হাজার বছর আগে থেকে কয়েকটা নদীকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠল। এর মধ্যে মানুষ ধাতুকে কাজে লাগিয়ে যন্ত্র ও অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। ফলে প্রথমে ব্রোঞ্জ ও পরে লোহার অস্ত্র দিয়ে ক্রমাগত সে শিকার করেছে।

সভ্যতার পরবর্তী ধাপগুলি দ্রুততর হল। আগে যে সামান্য পরিবর্তন কয়েক লক্ষ বছরে হয়েছে, পরবর্তীকালে আরও ব্যাপ্ত পরিবর্তন হতে সময় লেগেছে মাত্র কয়েক হাজার বছর।

১০ হাজার বছর আগে কৃষি শুরুর সাথে সাথে জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল; আজ তার গতি বেমালুম সোজা সরল রেখায় উপরের দিকে চলেছে। আজ মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটি। বিশ্বব্যাপী মানুষের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ৫৯ জন প্রতি বর্গ কিমিতে। অর্থাৎ গড়ে ১কিমি লম্বা ও ১ কিমি চওড়া স্থানে পৃথিবীতে ৫৯ জন মানুষ থাকে। এই স্থলপুঞ্জের মধ্যে আছে সাহারা মরুভূমি, গ্রিনল্যান্ডের তুষারাবৃত ভূমি, আমাজনের জঙ্গল। সুতরাং প্রকৃত জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি।

অনেক বিজ্ঞানী এখন মনে করেন যে পৃথিবী এক ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির (সিক্সথ মাস এক্সটিঙ্কশন) দিকে এগোচ্ছে। আফ্রিকা থেকে মহাপরিজনের পর থেকেই কমপক্ষে ৭৫% সমস্ত প্রজাতি গ্রহ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আমরা যখন আর থাকব না, তখন কে জানে, আমাদের বংশধরেরা এক মনুষ্যবাসের অনুপযুক্ত ধূসর কোন গ্রহে তাদের জীবন কাটাবে কিনা!

জীবনের বেঁচে থাকার অধিকার সকলের আছে। আমরা নিজেদের জন্য এন্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন, স্বাস্থ্য বিধি তৈরী করে গড় আয়ু বাড়িয়েছি। আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে, দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীকে ভোগ করার গোপন ইচ্ছা আছে। সেই মহাভারতের কালে শান্তনুর ছিল, আর কলি যুগে আমাদের হতে দোষ কি?

আমার যেমন বেঁচে থাকার অধিকার আছে, পাখি, পশু, স্যাপ, ব্যাঙ- তাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। তাদের অধিকার যদি স্বীকার নাও করি, বুঝতে হবে তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। তাই প্রকৃতি ৪৫৪ কোটি বছর ধরে পৃথিবীকে সাজিয়েছে। আর আমরা ‘ভগবানের নির্বাচিত’ মানুষ আছি মাত্র ৩.৩ লক্ষ বছর ধরে।

আমাদের টিঁকে থাকার জন্যও তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন আছে। প্রকৃতি শুধু উপভোগ করবার জন্য নয়। প্রকৃতি ছাড়া আমরা বাঁচব না।

বইটা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে ছন্দপতন হয়েছে, মনে হয়েছে পাঠ্য বই পড়ছি। এলিজাবেথ কোলবার্ট একটি ব্যক্তিগত আবেদন দিয়ে বইটা শেষ করেছেন। আমাদের মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কে কম চিন্তা করা উচিত এবং অন্যান্য প্রজাতির বিবর্তনীয় সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া উচিত। কোন অ্যাকশন দেননি, বরং মানুষের  চেতনা জাগানোর চেষ্টা করেছেন। এলিজাবেথ কোলবার্টের প্রাণবন্ত বিবরণ ও চিন্তা আমার আগ্রহ জাগিয়েছে এই বিষয়ে আরও পড়তে।

লেখিকা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা। প্রাবন্ধিক।

মন্তব্য তালিকা - “একটি বিষণ্ণ বইয়ের রিভিউ”

  1. মধুশ্রীদেবীর লেখার সঙ্গে অনেক দিন ধরেই পরিচিত । তথ্যবহুল অথচ স্বাদু লেখার যাদুভরা ওনার কলম ।
    নতুন একটি শব্দবন্ধ শিখলাম । “মহাপরিজন” । এই শব্দবন্ধের মাধ্যমে উনি নিশ্চয়ই আফ্রিকার আঁতুড়ঘর থেকে হোমো-সেপিয়েন্সদের পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার যে প্রচলিত ধারণা, তারই উল্লেখ করেছেন । তবে ওনার প্রতি একটা অভিযোগ জানিয়ে শেষ করি । পাঠপরিক্রমা আর একটু দীর্ঘায়িত হলে ভাল লাগত ।
    তবে এতে করে উনি হবু পাঠকের বইটি পড়ার আকাঙ্খাকে বাড়িয়ে তুললেন ।

  2. পালনের ফলে বিশেষ বিশেষ প্রাণী বা উদ্ভিদএর সংখ্যা যে অবিরাম বেড়ে চলেছে তারও অপপ্রভাব থাকবে পরিবেশে।

  3. যার চিন্তা ভাবনার গভীরতা আছে, তিনি তো এ নিয়ে নিরন্তর ভাববেন। বড় হয়ে অনবরত পড়ে এবং শুনে সেই স্কুল পর্বেই
    গাছ লাগান ও না কাটা এই বলে আসা হয়েছে। আজ এত দিন পর বুঝতে পারছি কিছু করার নেই। কেউ শুনতে চাইছে না।
    স্টেট হাইওয়ে রাস্তার ধারে একের পর এক সারি দিয়ে মেরে ফেলে কেটে দিচ্ছে।
    খেলা করার মত জান্তব আনন্দে প্রাণীকুল ধ্বংস করছে। কি করবো, গুমড়ে মরা ছাড়া?

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।