সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

আলাস্কার সাতরঙা ইতিহাস – পর্ব ৪

আলাস্কার সাতরঙা ইতিহাস – পর্ব ৪

ভাস্কর দাস

সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩ ৩২৭ 0

কাব্যে উপেক্ষিত – নাম শেলিকভ  

শেলিকভের সরকারি প্রতিকৃতি

ইতিহাসের যদি কোনো ঈশ্বর থাকেন তবে তাঁর রাজত্বে তাঁর কিছু নিজস্ব নিয়মকানুন, রীতিনীতিও আছে। সে নিয়মানুসারে এক সম্রাট যদি আর এক সম্রাটের সাম্রাজ্য দখল করতে মনস্থ করেন তবে তিনি প্রথম পাঠান তাঁর সেনাবাহিনীকে। সামরিক শক্তিতে প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করে বিজয়ী সম্রাটের জন্য লাল কার্পেট পেতে দেবার দায়িত্ব তাদেরই। তারপর আসেন রাজপুরুষের দল। প্রশাসনিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে তারা তৎপর হন। সব শেষে আসে সাধারণ মানুষ, অর্থাৎ জনগণ। প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতার বিনিময়ে সম্পর্ক স্থাপন হয় বিজিত জনগণের সঙ্গে। যদিও এ দখলদারি সাময়িক — অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে দেশের মাটি দেশের মানুষের একদিন প্রতিদিনের সীমানাতেই বাধা পড়ে। তবে অল্প কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ঈশ্বর তাঁর নিয়মের ব্যতয় ঘটান — যেমন কিনা আলাস্কার বেলায়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে দেবার নিয়মে রাশিয়ার আলাস্কা অধিকারের প্রক্রিয়ায় সেখানে প্রথম যায় তার সাধারণ মানুষ, তারপর রাজপুরুষ বা তার প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষ, বহু পড়ে নিয়মরক্ষার্থে এক ছোট্ট সেনাদল আর সম্রাট বা জার কখনই না।  

১৭৪১-এ ভিটাস বেরিং-এর আলাস্কায় পদার্পণের পর সেখানে রাশিয়ার যে কার্যক্রম, তাতে প্রথম যারা এসেছিল তারা রাশিয়ার ‘জনগণ’ শ্রেণীর মানুষ, আরও নির্দিষ্টভাবে পূর্ব রাশিয়ার সাইবেরিয়া আর কামচাটকা অঞ্চলের মানুষ। ভৌগলিক সীমানার বিচারে রাশিয়ার নাগরিক হলেও এরা মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা থাকা কামচাদাল, কোডিয়াক, ইন্টেলমান ও চুকচি – এই ৪ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রায় মেরু অঞ্চলের আবহাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের সংস্থান নিজেরাই করে নিয়ে এরা দেশের মধ্যে আর এক স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে জীবন কাটিয়েছে। এদের প্রতিপালনের কোনো দায়িত্ব নেয়নি পিটার্সবার্গ বা মস্কো। শুধু প্রধিনিধি পাঠিয়েছে তাদের শাসন করতে। এদের আহৃত সম্পদে আরামের জীবন কাটিয়েছে সরকারি প্রতিনিধিরা। আর প্রতিদিনের সংগ্রামের ফসল থেকে এক দশমাংশ সম্পদ কেড়ে নিয়েছে রাজস্ব হিসেবে। এই বৈরিতার আবহে আলাস্কা তাদের কাছে নিয়ে এল এক মহান     দেশরূপকথা যার সমুদ্রে আর জমিতে রয়েছে অনন্ত সম্পদের হাতছানি। অজানা সমুদ্রে অভিযানের বিপদ, সেখানকার মানুষদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্ভাবনা, কিছুই দমাতে পারল না তাদের। তাদের সঙ্গে যোগ দিল মূল রাশিয়া থেকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত অপরাধীর দল। স্বভাবহিংস্র এই মানুষেরা ছোট বড় দলে ছোট ছোট জাহাজে সমুদ্র তোলপাড় করে শিকার করে আনতে লাগল সীলমাছ, সমুদ্রঘোটক আর ভোঁদড়ের চামড়া। মাংসের লোভে শান্ত বিশালদেহি সমুদ্রগাভীর শিকার এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে আবিষ্কারের ২৮ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেল এদের অস্তিত্ব। ডাঙায় অভিযান চালিয়ে ফারের জন্য মারতে লাগল অগুন্তি কাঠবিড়ালি, বিভার আর লাল ও কালো শিয়াল। নরম সোনা (Soft Gold ) শিকারি এই মানুষেরা আলাস্কার যে মানুষদের প্রথম মুখোমুখি হল তারা অ্যালুসিয়ান দ্বীপপুঞ্জের পাশ্চিমপ্রান্তের অ্যালিউট সম্প্রদায়ের মানুষ। চূড়ান্ত বল প্রয়োগ, হত্যা আর ধর্ষণ — এই তিন অস্ত্রে এক ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করে রাশিয়ানরা তাদের পরিণত করল আজ্ঞাবাহী ক্রীতদাসে। সে গল্প আগেই বলেছি। পরিণতিতে আলাস্কার অধিবাসীদের কাছে রাশিয়া তকমা পেল ‘শয়তানের দেশ’। যদিও এর দায়ভার পুরোপুরি বর্তায় না রাশিয়ার রাজশক্তির ওপর। আসলে ‘প্রমিসলেনিকি’ (Promyshlenniki) নামে পরিচিত যে মানুষেরা এই তৎপরতায় অংশ নিয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফল — রাশিয়ার রাজশক্তির কাছে না ছিল এদের কোনো নথি, না ছিল কোনো নিয়ন্ত্রণ।  

আলাস্কা অভিযানের ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রথম প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ১৭৪৩-এ। এ্যামিলিয়ন ব্যাসভের নেতৃত্বে সেন্ট অ্যাপস্টেল পিটার নামের এক জাহাজ যখন বাণিজ্য অভিযানে যায়, তখন জার সম্রাটের তরফ থেকে তাকে দেওয়া হয় দুটি নোঙর। আপাত হাস্যকর এই দানের গুরুত্ব কিন্তু অসীম। কারণ কামচাটকা উপদ্বীপ, যেখান থেকে শুরু হবে অভিযান, সেখানে লোহার কোনো অস্তিত্ব নেই। সবচেয়ে কাছের যে অঞ্চলে লোহার সন্ধান পাওয়া যায় বা তাকে ছাঁচে ঢেলে কিছু তৈরি করা যায় তা কয়েকশো মাইল দূরে কোলিমা বা লেনা নদীর উৎসের কাছে। পূর্ণপ্রস্তুত নোঙর ওজনের কারণে সেখান থেকে বয়ে আনা অসম্ভব। তাই এতদিন টুকরো অবস্থায় নদীপথে কামচাটকায় নিয়ে এসে কারখানায় জুড়ে তৈরি হত নোঙর। ফলে একটা নোঙরের পেছনে ছিল চূড়ান্ত পরিশ্রম, প্রচুর সময় আর অপরিমিত অর্থব্যয়ের গল্প। এ অবস্থায় দুটো নোঙর — যা কিনা ছিল ১৭২৯-এ ডুবে যাওয়া এক জাপানি জাহাজ থেকে সংগৃহীত সরকারি সম্পত্তি — তা দান করে রাশিয়া অভিযানের গায়ে প্রথমবারের জন্য লাগাল সরকারি সীলমোহর। প্রতিষ্ঠিত হল যে রাজশক্তি চায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগঠিত হোক অভিযান, তাতে রাজশক্তি থাকবে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায়। 

কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়ন্ত্রকের অধিকার মেলে না, পাওয়া যায় না শাসকের মর্যাদা। ফলে এই দলগুলির কাজের চরিত্র নির্ধারিত হত তাদের অন্তর্গত চরিত্রের অঙ্গুলিহেলনে। স্বভাবত হিংস্র এই দলগুলির কার্যকলাপের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়েছিল হত্যা ও ধ্বংসের গল্প যা পরবর্তী ২০ বছরে বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত উচ্চতায় পৌঁছয় ১৭৬১-৬২ তে বেচেভিন-এর দলের হাতে। উনিমাক দ্বীপে তাদের অত্যাচারের প্রতিবাদ দানা বাঁধল। চরিত্রগতভাবে শান্তিপ্রিয় অ্যালিউটরা একজোট হয়ে আঘাত করল তাদের। ১৭৬৩-র ডিসেম্বরে প্রতি-আক্রমণে ডুবিয়ে দিল ৪টি বাণিজ্যপোত, ২০০ জন নাবিকের মাত্র ১২ জন প্রাণ নিয়ে পালাতে পারল। ইতিহাস যদিও বলছে যে পরবর্তী দু’দশকে আক্রমণ প্রতি-আক্রমণের অনেক ঘটনা ঘটেছে চক্রাকারে যাতে আদিবাসী মানুষরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি, এই ঘটনা ‘ফার ট্রেড’এ অন্তত দুটো পরিবর্তন আনল

এক – রাশিয়ার রাজশক্তি এটা বুঝল যে শুধুমাত্র বলপ্রয়োগ করে আলাস্কার অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না, পাওয়া যাবে না তাদের কুশলতাকে কাজে লাগিয়ে বানিজ্য বাড়ানোর উপায়।

দুই – ছোট ছোট দলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অভিযান চালান যাবেনা, তাতে বিপদ বেশি, সাফল্য কম।

অতএব বাণিজ্যের স্বাভাবিক নিয়মেই তৈরি হল বড় প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কোম্পানি। মূলত ১৭৮০-র পরে তৈরি হওয়া ৪টি কোম্পানি রাজ করতে লাগল আলাস্কার ফার শিকারের সাম্রাজ্যে। তবে বড় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান মানেই ‘কর্পোরেট কালচার’ — অর্থাৎ উচ্চপদের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ, উৎকোচ আর প্রতিযোগীকে কোমরবন্ধের নীচে ছুরি মারার দক্ষতা — এই তিন কৌশলকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেল গোলিকভ-শেলিকভ কোম্পানি। রাশিয়ার ইরখুস্ক অঞ্চলের স্বাধীন ব্যবসায়ী গ্রেগরি শেলিকভ আর ইভান ল্যারিয়াভিচ গোলিকভ, এই দুজনের কোম্পানির মূল চালিকাশক্তি ছিলেন শেলিকভ — সৌজন্যে তাঁর ক্ষুরধার ব্যবসাবুদ্ধি, ওপরতলার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ আর বাস্তববোধ। ১৭৮৪তে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোডিয়াকের থ্রি সেন্টস বে-তে তাঁরা তৈরি করলেন কোম্পানির প্রথম স্থায়ী আস্তানা। এই আস্তানা তৈরি করতে কোডিয়াকে আসার পথে উনালাসকা দ্বীপ থেকে ১২ জন অ্যালিউটকে জোর করেই সঙ্গী করলেন শেলিকভ — উদ্দেশ্য তাদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা। এদেরই একজন মিরজাফরের ভূমিকা পালন করে। কোডিয়াকে আদিবাসীদের যে দুর্গ আছে, সেই আপাত দুর্ভেদ্য কুঠিতে ঢোকার গোপন রাস্তা বলে দেয় সে। ছিদ্রপথে প্রবেশ করে কালনাগিনী; অপ্রত্যাশিত আক্রমণে ছারখার হয়ে যায় কোডিয়াকের অ্যালিউটিকরা (কোডিয়াকের আদি বাসিন্দারা এই নামে পরিচিত)। নিহত হয় প্রচুর মানুষ। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় কোম্পানি তথা রাশিয়ার।

প্রেমে, যুদ্ধে আর বাণিজ্যে নীতি-নিষ্ঠতা নিষ্প্রয়োজন, অন্তত শেলিকভের অভিধান তাই বলছে।

তবে শেলিকভ সম্পর্কে এইটুকু বলে কথা শেষ করলে তাঁর ওপর চূড়ান্ত অবিচার করা হবে। কারণ ইনিই সেই মানুষ যিনি বুঝেছিলেন যে সম্পর্ক তৈরি হয় সহযোগিতার মন্ত্রে। তাই আলাস্কায় রাশিয়ার মুঠি দৃঢ়বদ্ধ করতে হলে দরকার আলাস্কার অধিবাসীদের সঙ্গে সহজ সম্পর্ক। কোডিয়াক দখলের পরবর্তী দুবছরে যেমন বলপ্রয়োগে তাদের অধীনস্ত করে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন, তেমনি তাঁর মত করে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তাদের অধিকারকে। কাজের বিনিময়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়াকে কর্তব্য বলে মনে করতেন। তাদের নারীদের সম্মানরক্ষায় রাশিয়ান নাগরিকদেরও কোনো বেহিসেবি আচরণকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে কসুর করেননি। রাজশক্তির কেউ না হয়েও আলাস্কার বুকে রাশিয়ার উপস্থিতিকে উত্তরোত্তর স্পষ্ট করাকে নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছেন। সেই উদ্যোগে ব্যক্তিগত ঝুঁকিতে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ক্যাথারিনের কাছ থেকে ২ লক্ষ রুবল ধার নিয়ে অভিযান চালিয়েছেন আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ধরে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত। তাতে সেখানে প্রতিহত হয়েছে ইংল্যান্ড আর স্পেনের আগ্রাসন। স্বল্প সময়ের জন্যে হলেও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জকে রাশিয়ার বাণিজ্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজশক্তি এই উদ্যোগকে স্বাগত তো জানায়নি, বিরুদ্ধাচরণও করেছে কখনও কখনও। সম্রাজ্ঞী ক্যাথারিন মন্তব্য করেছেন ‘It is one thing to trade, quite a different thing to take possession.’ এমন কি ২ লক্ষ রুবলের খরচের হিসেব নিয়ে প্রশ্ন তুলে জবাবদিহি চাওয়া হয়েছে শেলিকভের কাছে।  

শেলিকভ নিজে ছিলেন নিষ্ঠাবান খ্রিষ্টান। অ্যালিউটদের শতাব্দীপ্রাচীন ওঝা (Shaman) ও তন্ত্রমন্ত্রনির্ভর ধর্মাচরণ তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও তাদের ধর্মান্তরের কাজকে পৃষ্ঠপোষকতা করা তাঁরই দায়িত্ব, এই বিশ্বাসে রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের যাজকদের আনিয়েছেন নিজের উদ্যোগে। কোম্পানির খরচে তৈরি করেছেন গির্জা। আজকের যে হোলি রেজারেকসন চার্চ দাঁড়িয়ে আছে কোডিয়াকের বুকে, তাই সেদিনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রথম অর্থোডক্স চার্চ। আবার চার্চের সঙ্গে সংঘাতেও জড়িয়েছেন যখন যাজকরা আদিবাসীদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে সরাসরি বিরোধিতা করেছেন কোম্পানির কাজকর্মের। তাতে নির্দিষ্ট কোনো পাদ্রীর কাজে বাধা সৃষ্টি করলেও সামগ্রিকভাবে চার্চের পৃষ্ঠপোষকতা থেকে সরে আসেননি। সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার আগে পর্যন্ত চার্চের দৈনন্দিন কাজকর্মের ব্যয়ভার বহন করেছে কোম্পানিই।

বলপ্রয়োগে কসুর করেননি শেলিকভ। তাতে নিহত হয়েছে অনেক অ্যালিউট আর অ্যালিউটিক পুরুষ। তাদের অনাথ সন্তানদের জন্য অনাথাশ্রম তৈরি করেছেন — কোম্পানির কোষাগার তার ব্যয়ভার বহন করেছে। হত্যার পাপ তাতে স্খালন হয় না নিশ্চয়ই, কিন্তু হত্যায় যে অপরাধ জড়িয়ে আছে তাকে স্বীকারের রাস্তা থেকে সরে আসেননি তিনি। প্রথাগত শিক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছেন আদিবাসীদের জীবনে। নিজের উদ্যোগে তাই স্কুল তৈরি করেছেন আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য যেখানে চেয়েছেন যে পড়ান হোক ‘literacy, arithmetic and singing so that in time they would become navigators and fine sailors;  it is also necessary to teach them various crafts, but especially carpentry.’ ( Shelikov to Delarov. P. A. Tikhmenev ).

কোডিয়াক ও সংলগ্ন অঞ্চলে জনগণনার প্রথম প্রয়াস তাঁর। ত্রুটিপূর্ণ হলেও এটাই জনসংখ্যার প্রথম পরিসংখ্যান। মানুষের সংখ্যা গণনার পাশাপাশি চেষ্টা চালিয়েছেন তাদের অসুস্থতা আর রোগের চেহারাটা অনুধাবন করার। নিশ্চিতভাবে আলাস্কার প্রথম ‘মেডিক্যাল ডাটাবেস’। লক্ষ্য করেছেন যৌনরোগের প্রাদুর্ভাবের। তার সংক্রমণ ঠেকাতে অবিবাহিত রাশিয়ান পুরুষদের সঙ্গে স্থানীয় অ্যালিউট মেয়েদের বিবাহকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর ধর্মবিশ্বাস কখনও তাকে বাধা দিয়েছে, রাশিয়ান সমাজ একে অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু বাস্তববোধ তাকে যুক্তির পথে থাকতে সাহায্য করেছে। তিনি লিখেছেন ‘permit those who are not married, and want to do so, to marry; God be the judge of married men, not us;’ (letter to Delarov.  P. A. Tikhmenev).

একথা অনস্বীকার্য যে শেলিকভের কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে স্বাধীন অ্যালিউট আর কোডিয়াকের অ্যালিউটিকরা তাদের স্বাধীন সত্তার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিল। আকাশের পাখি থেকে তারা পালটে গিয়েছিল খাঁচার পাখিতে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ান হয়ে রাশিয়ার বিস্তার আর আদিবাসীদের স্বার্থরক্ষাকে একটা সহযোগী বিন্দুতে নিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা আজীবন চালিয়ে গেছেন শেলিকভ।

১৮৮৬-র ২২ এপ্রিল যেদিন কোডিয়াক বন্দর থেকে শেষবারের মত চলে গেলেন শেলিকভ রাশিয়ার উদ্দেশে, সেদিন তাঁর সঙ্গী ছিল ৪০ জন স্থানীয় আদিবাসী শিশু-কিশোর যাদের তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন রাশিয়ার বড় শহর ওখস্ক আর ইরখুস্ক-এ রেখে পড়াশোনা করাবার।

শেলিকভের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য-সঙ্গী ছিলেন অ্যালেক্সি পোলেভয়। সেই সুবাদে তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন অ্যালেক্সি কন্যা আভিভা। খুব অল্প কথায় মানুষটির মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি লিখছেন ‘ His fiery soul coveted not so much riches but glory ; for him, obstacles did not exist, he conquered all with his inflexible iron will ; those around him called him ‘the scorching flame’ for good reasons.’

১৭৯০-এ যখন তাঁর বাণিজ্য মধ্য গগনে, তখন তিনি খুঁজে পান এমন একজনকে যার চোখের ছায়ায় খেলা করছে তাঁর নিজের স্বপ্নের প্রতিবিম্ব। সমাজের নিতান্ত সাধারণ স্তরের বাসিন্দা এই মানুষটি পরবর্তী ২৮ বছর ধরে রাশিয়ান আমেরিকান কোম্পানির প্রধান পরিচালকের পদে থেকে এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার কাজে প্রাণপাত করে গেছেন। পরিণতিতে আলাস্কার ওপর রাশিয়ার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। আর সাড়ে ৫ ফুটেরও কম দৈর্ঘ্যের মানুষটি ইতিহাসের দেবতার আশ্রয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম মানুষদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর নাম আলেকজান্ডার আঁদ্রেয়াভিচ ব্যারানভ।

আলাস্কা বিষয়ে বিশ্বখ্যাত গবেষক প্রবন্ধকার Lidia. T. Black তাঁদের সম্বন্ধে লিখছেন – ‘ If there were Russian empire builders in Alaska, ones to whom posterity should grant the title, they would be these two men : Grigorii Shelikhov an Aleksandr Baranov.’ তাই আলাস্কার গল্প বলতে গেলে এঁদের আপনি ঘৃণা করতে পারেন, ভালবাসতেও পারেন কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেন না কিছুতেই।  

রাশিয়ান আমেরিকান কোম্পানির পতাকা

টীকা ও চিত্র-পরিচিতিঃ-

১. ‘প্রমিসলেনিকি’ হল সাইবেরিয়া অঞ্চলের সেই মানুষেরা যারা স্বাধীনভাবে রাশিয়ানদের সঙ্গে ফারের বানিজ্য করত। রাশিয়ানদের সরকারি আইনকানুন এদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলনা যদিও পরে জারের নির্দেশানুসারে তাদের সংগ্রহের ওপর ১০ শতাংশ কর চাপায় রাশিয়া। আলাস্কায় ফারের বানিজ্যের প্রথম ২৫ বছর এরাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। সরকারি বিধিনিষেধ আরোপিত না হওয়ায় এরা যথেচ্ছ অত্যাচার চালায় অ্যালিউটদের

ওপর। পরে কোম্পানির পত্তন হলে এদের অনেকেই তার কর্মচারীতে রুপান্তরিত হয়।

২. ইভান বেচেভিন – বেরিং পরবর্তী আলাস্কা অভিযানে যারা অংশ নিয়েছিল শুধুমাত্র ফারের বানিজ্যের প্রয়োজনে, তাদের হাতে অ্যালিউটরা সবসময় পরাস্ত হয়েছিল। বেচেভিনও এক প্রমিসলেনিকি, যার নেতৃত্বে ১৭৬১-৬২তে উনিম্যাক দ্বীপে চূড়ান্ত অত্যাচারের ঘটনা ঘটে। এতে কোণঠাসা অ্যালিউটরা প্রথম নিজেদের বিভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধ হয় ও রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৭৬৩র এই যুদ্ধে ৪টি রাশিয়ান জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তারা। মোট ২০০ নাবিকের ১২ জন মাত্র জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচে।

৩. Black, Lydia.T. Russians in Alaska 1732 – 1767. p – 113

৪.  Shelikov to Delarov in P. A. Tikhmenev. Reprinted in A. I. Andreev, ed., Russkie otkrytiia 1948, p – 289

৫.  A letter to Evstrat Delarov dated 30 August,1789 in A. I. Andreev, ed., Russkie otkrytiia 1948, p – 288

৬.  Avdeeva-Polevaia, Zapiski, 56.

চিত্র-১   গ্রেগরি শেলিকভের সরকারি প্রতিকৃতি।

চিত্র-২   গোলিকভ-শেলিকভের রাশিয়ান আমেরিকান কোম্পানির এই নিশান প্রথম তৈরি হয় ১৮০৬ সালে। আড়াআড়ি ওপরের অর্ধাংশ সাদা যার বাঁ কোণে আঁকা আছে জারের প্রতীক দু-মাথাওয়ালা ঈগল। নীচের অর্ধাংশে আধাআধি নীল আর লাল রঙ। পরবর্তী ৭৫ বছরে নিশানের নকশায় অনেক পরিবর্তন আসে। এই নকশার একমাত্র নিশানটি সংরক্ষিত আছে সেন্ট পিটার্সবার্গের হারমিটেজ মিউজিয়ামে।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জিঃ

পর্ব ১ এর অনুরূপ।

পর্ব ৫
https://www.itihasadda.in/alaska-5/

জন্ম ১৯৫৯। কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা। পেশায় অস্থিশল্য চিকিৎসক। লেখার জগতে বিলম্বিত প্রবেশ। লেখা প্রকাশিত 'দেশ', হরপ্পা, ভ্রমি ভ্রমণআড্ডা সহ নানা পত্রিকায় ও সংকলনে। প্রকাশিত বই 'টাইমলাইন আলাস্কা', 'এক চামচ বিদেশ', 'কোভিড-১৯, এক বিভ্রান্তির সন্ত্রাস'। ভ্রমণআড্ডা প্রদত্ত 'কলম' সম্মান লাভ ২০২২এ। ভ্রমণ, ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে বিশেষভাবে অনুরাগী। ছবি তোলার নেশায় দেশে বিদেশে পাড়ি, তাতে কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানপ্রাপ্তি। দেশে ও বিদেশে একক ও দলগত প্রদর্শনী।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।