সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

যশোধরা কথা

যশোধরা কথা

সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়

জুলাই ২৪, ২০২১ ৭৬১ 4

ভারতীয় চিন্তাধারায় মহাপুরুষ বা সাধকদের সংসার আশ্রমের সঙ্গিনী রা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাব্যে উপেক্ষিতা। এমনই এক নারী বুদ্ধপত্নী যশোধরা। মাতা মায়াদেবী(যিনি সিদ্ধার্থের জন্মের অনতিবিলম্বে মারা যান) ব্যতীত, একাধারে বুদ্ধের পারিবারিক ও ধর্মীয় জীবনের সাথে জড়িত দুই নারী হলেন তাঁর বিমাতা তথা পালিকামাতা গৌতমী ও পত্নী যশোধরা। এই দুজনের মধ্যে, অপেক্ষাকৃত কম উল্লেখিত আবার যশোধরা, অন্তত প্রাচীন পালি ধর্মীয় সাহিত্যে। কিন্তু সেই খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক থেকে, যত সময় এগিয়েছে, যশোধরা/গোপা/বিম্বা ততই জনপ্রিয় হয়েছেন, লৌকিক জীবনে। বিভিন্ন বৌদ্ধ সাহিত্যে তিনি যেমন চিত্রিত হয়েছেন পুণ্যবতী সাধিকা হিসাবে, তেমনি এক দুখিনী অথচ তেজস্বিনী নারী হিসাবেও। এই লেখার বিষয় ও উদ্দেশ্য, তাঁর সেই চিরন্তন মানবী সত্ত্বার অন্বেষণ।

সংক্ষিপ্ত জীবনী — যশোধরা ছিলেন কোলিয় প্রধান সুপ্পবুদ্ধ ও অমিতার কন্যা। তিনি ও সিদ্ধার্থ একই বছরে, এমনকি একই দিনে জন্ম নেন বলে কথিত। ষোলো বছর বয়সে উভয়ে বিবাহিত হন। উনত্রিশ বছর বয়সে, হয় পুত্রলাভ। পুত্র রাহুলের জন্মের সপ্তম রাতে, সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন। তাঁর বোধিলাভের ছয় বৎসর পর যশোধরা ভিক্ষুণী সংঘে যোগ দেন। ক্রমে অর্হত্ত্ব লাভ করেন। আটাত্তর বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

সময় তালিকা

১. সিদ্ধার্থ ও যশোধরার জন্ম — ৫৬৩ খ্রিঃ পূঃ

২. বিবাহ — ৫৪৭ খ্রিঃ পূঃ

৩. সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ — ৫৩৪ খ্রিঃ পূঃ

৪. সিদ্ধার্থের বোধিলাভ — ৫২৮ খ্রিঃ পূঃ

৫. বুদ্ধের কপিলাবস্তুতে আগমন — ৫২৭ খ্রিঃ পূঃ

৬. ভিক্ষুণীসংঘ প্রতিষ্ঠা — ৫২২ খ্রিঃ পূঃ

৭. যশোধরার মৃত্যু — ৪৮৫ খ্রিঃ পূঃ

৮. বুদ্ধদেবের নির্বাণ লাভ — ৪৮৩ খ্রিঃ পূঃ

প্রাচীন পালি ধর্মীয় সাহিত্যে যশোধরা একান্তই বুদ্ধজীবনীর এক পার্শ্বচরিত্র। বারংবার বর্ণিত মহাভিনিষ্ক্রমণের চিত্রে তিনি এক সুন্দরী নিদ্রিতা নারী। পরে, তাঁর সংঘে যাত্রা গোতমির অনুগামিনী হিসেবে, ভিক্ষুণী হবার অধিকার লাভও, গোতমির কৃতিত্বেই।

এই সাধারণ পটভূমি যেন প্রতিমা নির্মাণের কঠামো মাত্র। বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম ক্রমে এতে কিভাবে প্রাণসঞ্চার করে, তা কিছু উদাহরণ সহযোগে আলোচ্য —

১. পালি যশোধরাপদান — অপদান হল কয়েকজন আদি থের ও থেরির জীবনী। যশোধরাপদান এই পর্বের অন্তর্ভুক্ত। এখানে, বিশেষভাবে, যশোধরার জীবনের শেষ দিনটির বর্ণনা রয়েছে, যেদিন তিনি বুদ্ধের নির্দেশে জনসমক্ষে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন, আর তাঁর সাথে বুদ্ধের জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের কাহিনী (বোধিসত্ত্ব জীবন) শুনিয়েছিলেন। যশোধরাপদান তাই বুদ্ধের ছায়াচরিত্র থেকে যশোধরার স্বমহিমায় উত্তরণের একটি বিশিষ্ট ধাপ।

২. অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত — খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের সূচনায় লিখিত এই বুদ্ধজীবনীতে অঙ্কিত যশোধরা চরিত্র যেন কিঞ্চিৎ প্রতিবাদী। গ্ৰন্থের অষ্টম অধ্যায়ে মহাভিনিষ্ক্রমণ ও পরদিন সেই সংবাদ প্রাপ্তিতে পুর নারীদের বিলাপের বর্ণনা রয়েছে। সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেন সারথি ছন্দক ও অশ্ব কন্থক সমভিব্যাহারে। পরদিন ছন্দক ফিরে এলে, যশোধরা তাকে বলেন, ‘ছন্দক, যখন আমি দেখছি যে তুমি আর কন্থক ফিরে এসেছ, তখন, আমার হৃদয়ের আনন্দস্বরূপ আমাকে অসহায় নিদ্রিতা অবস্থায় রেখে কোথায় গেলেন?’

ছন্দক এমনকি কন্থককেও, দোষারোপের সাথেসাথেই তিনি আরো যা বলেন—

ক. আমি তাঁর সহধর্মিণী। তিনি অনাথা আমাকে পরিত্যাগ করে ধর্ম অর্জন করতে চান। কিন্তু যিনি সহধর্মিণী বিনা (ধর্মের জন্য) তপস্যা করতে চান, তাঁর ধর্ম কোথায়?

খ. আমাদের প্রাচীনকালের মহাসুদর্শ প্রভৃতি রাজপিতামহ গণপত্নীদের সাথে বনে গমন করতেন। নিশ্চয়ই তিনি তা শোনেননি, তাই আমা বিনা ধর্মাচরণ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন!

গ. ভর্তার আয়তলোচন শুচিস্মিত মুখমণ্ডল নিরীক্ষণ করা আমার ভাগ্যে না থাকতে পারে, কিন্তু মন্দভাগ্য রাহুলও কি কোনোদিন তার পিতার ক্রোড়ে বসতে পারবে না?!

অশ্বঘোষ যশোধরার অন্তরের এই বিলাপকে ভাষা দিলেন যা ক্রমে অনুরণিত হতে থাকলো পরবর্তী হাজার বছর ধরে..

যশোধরা কথা প্রসঙ্গে, পরের গ্ৰন্থটি—

৩. মহাভগ্গ— বৌদ্ধ ধর্ম সাহিত্য মহাভগ্গ, যশোধরার জীবনের পরবর্তী পর্বটির সন্ধান দেয়। Paul Carus তাঁর Buddha, the Gospel এ সংশ্লিষ্ট অংশটির যে অনুবাদ করেছেন, তা এইরকম,– বোধি লাভের একবছর ও গৃহত্যাগের সাতবছর পর, বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে আসেন, শুদ্ধোদনের আহ্বানে। রাজা সকল আত্মীয়, মন্ত্রী প্রমুখ সহ বুদ্ধসমীপে উপস্থিত হন। কিন্তু রাহুলমাতা যশোধরা অনুপস্থিত ছিলেন। শুদ্ধোদন যশোধরাকে ডাকতে পাঠালে সেই বার্তাবাহককে তিনি বলেন যে “যদি আমি সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত হই, তবে সিদ্ধার্থ নিজে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।” এই বক্তব্য বুদ্ধকে জানান হলে, তিনি যশোধরার কক্ষের দিকে অগ্ৰসর হন। সঙ্গী দুই শিষ্য সারিপুত্ত ও মোগ্গল্লানকে তিনি বলেন, “আমার বোধি লাভ হয়েছে, যা যশোধরার এখনো হয়নি। তাই এত বছর পর আমার সাক্ষাৎ পেয়ে তিনি অতীব বিহ্বল হয়ে পরতে পারেন। সেই হৃদয়বিদারক কষ্টের মুহূর্তে যদি যশোধরা পুণ্যাত্মা তথাগতকে স্পর্শও করে ফেলেন, তোমরা তাকে নিবারণ কোরো না।” বুদ্ধ যখন কক্ষে প্রবেশ করলেন, তখন মুণ্ডিতমস্তক, চিরপরিহিতা সেই নারীর হৃদয় বাস্তবিকই, এমন কাতর হয়ে পরলো যে তিনি ভুলে গেলেন তাঁর ভালোবাসার মানুষটি বর্তমানে জগৎত্রাতা সত্যপ্রচারক বুদ্ধদেব। তিনি বুদ্ধের পা জড়িয়ে ধরে প্রবল কান্নায় ভেঙে পরলেন। প্রাথমিক আবেগ প্রশমিত হলে ও শুদ্ধোদনের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে, তিনি নিজেকে সংযত করলেন।

শুদ্ধোদন যশোধরার এমন উচ্ছাসপূর্ণ আচরণের জন্য ক্ষমা চাইলেন, এবং যশোধরার গত সাত বছরের জীবনযাত্রা বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন, যশোধরা যখন শোনেন সিদ্ধার্থ মস্তক মুণ্ডন করেছেন, তিনিও তাই করেন। একইভাবে পতিকে অনুসরণ করে তিনি বহুমূল্য বস্ত্র অলংকার ত্যাগ করে চিরবসন ধারণ করেন, একাহারি হন ও ভূমিশয্যা আশ্রয় করেন। ইতিমধ্যে অনেক রাজপুত্র তাঁর পাণিপ্রার্থনা করলেও, নিজ স্বামী ভিন্ন কোনো পুরুষকে তিনি মনে স্থান দেননি।

বুদ্ধ তখন যশোধরাকে তাঁদের পূর্ব পূর্ব জনমের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন (বোধিসত্ত্ব জীবন) যেখানে জন্ম জন্মান্তর ধরে যশোধরাই ছিলেন তাঁর সঙ্গিনী। তিনি এও বললেন যে, যশোধরার দুঃখ অবর্ণনীয়, কিন্তু আধ্যাত্মিকতার যে গৌরব তিনি এখন লাভ করলেন, তা তাঁর সব দুঃখকে স্বর্গীয় আনন্দে পরিণত করবে। বাস্তবে যশোধরার বেদনা কতটা আনন্দে পরিণত হয়েছিল, তার খতিয়ান অবশ্য ইতিহাস রাখেনি।

৪. থাইল্যান্ডে প্রাপ্ত ‘বিম্বার বিলাপ’ পুঁথি — বিম্বাবিলাপের প্রাচীন পুঁথির একাধিক অনুলিপি পাওয়া যায়। সামান্য হেরফের বাদ দিলে, আলোচ্য অংশের মূল বক্তব্য প্রায় এক। এখানে যশোধরার অভিযোগ আরো তীক্ষ্ণ।

বুদ্ধর কপিলাবস্তুতে আগমনের পর শুদ্ধোদন, যশোধরার কাছে এক পরিচারিকাকে প্রেরণ করেন এই নির্দেশ দিয়ে যে, তিনি যেন বুদ্ধ সমীপে উপস্থিত হন। সেই বার্তা জানিয়ে, পরিচারিকা সসম্ভ্রমে যশোধরার কাছে জানতে চায় যে তিনি এত বিমর্ষ কেন। তখন যশোধরা যে দীর্ঘ বিলাপোক্তি করেন, তা সংক্ষেপে এইরকম, “আমি বিষণ্ণ এই কারণে যে ধর্মের সংস্থাপক বুদ্ধ, আমার পতি, আমাকে ভালোবাসেন না। যদিও আজ পর্যন্ত আমি কোনো অন্যায় তো করিইনি, বরং বিশ্বস্ততার সাথে স্ত্রীর কর্তব্য পালন করে চলছি। হতে পারে আমি সামান্যা নারী, যাকে এই পরিত্যক্ত হবার বেদনা সহ্য করে নিতে হবে, কিন্তু বুদ্ধের নিজ পুত্র রাহুলের প্রতি সমবেদনা থাকা উচিত ছিল, সেই রাহুল যে কিনা দিঘীর জলতলে ফুটে থাকা পদ্মের মতই সৌন্দর্য ও সারল্যের প্রতীক। আমরা দুজনেই অসীম যন্ত্রণা সহ্য করছি। রাজকীয় পরিচয় বহন করে তার পতাকা, শিখা নির্ভর করে আগুনের ওপর, নদীর অস্তিত্ব সমুদ্র আছে বলেই, আর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব শাসকনির্ভর। কিন্তু পরিত্যক্ত রাহুল আর আমার অস্তিত্ব??! আমার স্বামী এমনকি বিদায় সম্ভাষণ টুকুও না করে নিদ্রিতা আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। এখনো তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি, এসেছেন তাঁর পিতা ও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে। সুতরাং, প্রীতিপূর্ণ ও প্রিয়তম স্বামী আমি পেয়েছিলাম কোনো একদিন, এই সুখস্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আমি কিইবা করতে পারি! তাই, হে পরিচারিকা, তুমি আমার শ্বশুরকে জানিও যে আমি বুদ্ধকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে যেতে অক্ষম। তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করেন।”

এই গ্ৰন্থেও এরপর বিম্বার কাছে বুদ্ধের আগমন ও তাঁকে সান্ত্বনা প্রদানের উল্লেখ আছে।

বিম্বাবিলাপের আর একটি পুঁথিতে একটি বর্ণনা আমরা পাই, যা প্রাচীন পালি সাহিত্য দ্বারাও সমর্থিত হয়। যশোধরা কপিলাবস্তু প্রাসাদের অলিন্দ থেকে ভিক্ষারত বুদ্ধকে দেখেন, রাহুলকে চিনিয়ে দেন তার পিতাকে, এবং তাকে বুদ্ধর কাছে পাঠান। তিনি শিখিয়ে দেন, রাহুল যেন পুত্র হিসাবে তার পিতার কাছে উত্তরাধিকার প্রার্থনা করে। হয়তো তিনি এভাবে পিতৃকর্তব্য সম্পর্কে বুদ্ধকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। পরিণতি হয় মারাত্মক। বুদ্ধ পিতৃধন হিসাবে রাহুলকে প্রব্রজ্যা দান করেন। এখানে একটা প্রশ্ন মনে আসে। সন্ন্যাসীর পক্ষে তার পূর্বাশ্রমকে স্বীকার না করাই বিধি। সেক্ষেত্রে মহাসাধক বুদ্ধদেবের পক্ষে তাঁর সংসার জীবনের আত্মজকে নিজের সন্ন্যাস জীবনে প্রাপ্ত ধনের উত্তরাধিকার প্রদান কতটা যুক্তিযুক্ত? যাই হোক, এর ঠিক আগেই বুদ্ধ প্রব্রজ্যা দান করেছেন গৌতমীপুত্র নন্দকে। শেষ অবলম্বন পৌত্রও প্রব্রজ্যা প্রাপ্ত হয়েছে শুনে শুদ্ধোদন দারুণ আঘাত পান, এবং  বুদ্ধকে আদেশ দেন, যেন কোনো নাবালককে তার অভিভাবকের অনুমতি বিনা প্রব্রজ্যা দান না করা হয়। বুদ্ধ এই নির্দেশ মেনে নেন (বিনয় পিটক)। কিন্তু ততক্ষণে যশোধরা ও শুদ্ধোদন, দুজনেই খুইয়েছেন তাদের শেষ সম্বল!

পরিশেষে আলোচ্য গ্ৰন্থ দুটি যশোধরাবথা ও যশোধরাপনেয়। এই দুই সিংহলী সাহিত্যের প্রথমটি পদ্যে ও পরেরটি গদ্যে রচিত।

যশোধরাবথা— যশোধরা কাব্যের এই বিশেষ গাথার আদিরূপ যথারীতি নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এর প্রাচীনতম সংস্করণটি খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকের, যদিও এর ঐতিহ্য আরো পুরনো, এবং তা ছিল তালপাতার পুথি। বিবর্তনের পথ ধরে এই কাব্য কিভাবে সিংহলের লোকসংস্কৃতি ও লোকগানের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তা ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। যে সংস্করণটির ইংরেজি অনুবাদ আমার হাতে এসেছে, তার বৈশিষ্ট্য ও বক্তব্যই বর্তমানে আলোচ্য।

যশোধরাবথায় গাথার সংখ্যা ১৩০টি। এর প্রথম ৭০টিতে বোধিসত্ত্বের আবির্ভাব, মানুষের দুঃখ মোচনে তাঁর দীর্ঘ যাত্রা, শেষ জন্মে মায়াদেবীর স্বপ্ন, সিদ্ধার্থের জন্ম থেকে তাঁর মহাভিনিষ্ক্রমণ পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ৭১- ১০২ নং গাথায় সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগে যশোধরার প্রতিক্রিয়া বিধৃত, যখন সারথি ছন্দক (সিংহলী উচ্চারণে কন্ন) ফিরে এসে তাঁকে ঐ সংবাদ দিচ্ছেন। অর্থাৎ এই সিংহলী কাব্য, অশ্বঘোষ অনুসারী। এর অন্য বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে যশোধরা আগে থেকেই জানতেন তাঁদের জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের কাহিনী। প্রতি জন্মেই তিনি বোধিসত্ত্বকে এগিয়ে দিয়েছেন বুদ্ধত্ব লাভের পথে এবং এই জন্মে যে সেই মহান উদ্দেশ্য পরিপূরিত হতে চলেছে, তাও তাঁর অজানা নয়। তাই এখানে তাঁর মূল ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয়েছে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের জন্য ততটা নয় যতটা তাঁকে বিনা, এমনকি তাঁকে না জানিয়ে প্রস্থানের জন্য। কারণ তাঁদের পূর্ব পূর্ব জনম চালিত হয়েছিল এই লক্ষ্যেই, আর এজন্য তিনি বহু যাতনা সইতেও পরাঙ্মুখ হননি। সেই জন্যই এই সব গাথায় অজস্রবার উঠে এসেছে সেইসব একত্রযাপনের সুখদুঃখের স্মৃতি। তাই শুধু বিলাপ নয়, এ এক অন্তহীন যুগ্মজীবনের স্মৃতিমেদুর কাব্যকথা, বেস্সান্তর জাতক, ছদ্দন্ত জাতক, মহাউসদ জাতকের পথ ধরে যার ধারা এই জন্মেও বহমান। আবার বৌদ্ধ সাহিত্যের ঐতিহ্যমত, যশোধরা সিদ্ধার্থের অরণ্য জীবনের কষ্টের কথাও বারেবারে স্মরণ করে হাহুতাশ করেছেন এবং নিজেও কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে তার অনুগমন প্রতিজ্ঞ হয়েছেন। 

(ছন্দ মিলিয়ে বঙ্গানুবাদে নিতান্ত অক্ষম হয়েও, কয়েকটি গাথা এখানে লেখার স্পর্ধা করলাম।)

১. ছন্দক যবে ফিরিল একাকী সেই সে বিষাদ-দিনে

‘কোথায় আমার প্রিয়তম? সখা, নিয়ে এস পথ চিনে’

সিংহীগরজে আদেশিলা রাণী সারথিরে সম্ভাষি

দেখিবারে চাই সেই প্রিয় মুখ, সম্মুখে উদ্ভাসি।

২. একসাথে রব প্রতিজ্ঞা মোরা করেছিনু হাত ধরে

বিনা বারতায় ত্যাজিলে আমায়, বুদ্ধ হবার তরে!?

প্রতিজ্ঞা তুমি ভাঙিয়াছ প্রভু, ভাঙি নাই তাহা আমি

জনমে জনমে আমি ছিনু জায়া, তুমি ছিলে মম স্বামী।

৩.  তব আজ্ঞায়  করিয়াছি দান, এমনকি সন্তানে

কোনো অন্যায় করি নাই আমি জ্ঞানে কিবা অজ্ঞানে

তোমার কারণে অশ্রু ঝরেছে শত সহস্র ধারে

তবুও গোপনে ত্যাগিলে মোরে কেন এই শেষবারে?

৪. বনানীর যেথা যত ফল আছে মধুর হউক তোমার তরে

সূর্যের তেজ স্তিমিত হইয়া যেন গো তোমার গাত্রে ঝরে

মনুষ্য গণে বেষ্টিত থাকো, মধুপ যেমতি ফুলের পাশে

দেবতা গড়ুক পান্থশালা, পথশ্রান্ত তোমার আশে।

৫. সোনার বরণ প্রিয়তমে মোর হেরিব না আর স্বপনে

শুনিবে না প্রিয় আমার বিলাপ প্রতিটি দিবসযাপনে

ছাড়িব বিলাস, কঠোর সাধনে হব আমি ব্রতী

প্রভুর মতোই। যদিও ত্যেজেছে মোরে মম পতি।

বাকি গাথাগুলিতে বুদ্ধের কপিলাবস্তুতে আগমন থেকে শুরু করে যশোধরার মৃত্যু পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।

যশোধরাপনেয়— গদ্যে লেখা এই আখ্যান অনেকটাই মূল পালি যশোধরাপদান এর অনুগামী ও বর্ধিত রূপ। এর প্রধান উপজীব্য যশোধরার মৃত্যু সিদ্ধান্ত, ও দৃঢ়চিত্তে তাকে কার্যকর করা। যশোধরা এখানে আর বিলাপকারিনী বধূটি নন। দীর্ঘ সাধনা তাঁকে পরিণত করেছে প্রজ্ঞাশালিনী ব্যক্তিত্বময়ী নারীতে। ঘটনার বর্ণনা এইরকম— যশোধরা ও বুদ্ধ, দুজনেরই বয়স যখন ৭৮ এবং তাঁরা গৃহ্যকূটে অবস্থান করছেন, তখন একদিন যশোধরা তাঁর ভিক্ষুণী সংঘ থেকে বুদ্ধ সমীপে যান, উপদেশ শ্রবণ করেন, ও ফিরে আসেন। ঐ সন্ধ্যাতেই তিনি মগ্নাবস্থা প্রাপ্ত হন ও জানতে পারেন যে তাঁরা দুজনে একইদিনে নির্বাণ প্রাপ্ত হবেন। তিনি চিন্তা করেন যে পৃথিবীর মানুষ এক্ষেত্রে একসাথে দ্বিগুণ ক্ষতি ও শোকের সম্মুখীন হবে। এই পরিস্থিতিকে এড়ানোর একটাই উপায়, তা হলো তাঁর নিজের মৃত্যু কে এগিয়ে আনা।(ঐ বয়সে মৃত্যু সমীপবর্তী হয়, তা সহজেই অনুমেয়। বাস্তবে, এই নারী কি নিজ আরাধ্যের মৃত্যুশোক যাতে না পেতে হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? মনে রাখতে হবে, ততদিনে রাহুলও সম্ভবত মৃত)। যাইহোক, তিনি সিদ্ধান্ত নেন এবং তখনি বুদ্ধের কাছে যান, ক্ষমাপ্রার্থনা ও শেষ বিদায়ের প্রচলিত আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় বিধি পালনের জন্য। প্রাসঙ্গিক  মূল পালি উদ্ধৃতিটি হলো-

অথ্থসত্তাতি বস্সামহি পবজিমো বা তথ্থিভায়ো

পভারহি অনুপত্তা আরোসেমি মহামুনি

সমসারিভাচ সমসারে খালিতম চে মামম তায়িপ

আরোচেমি মহাবির অপরাধস খমেসু মে।

এই সমাপ্তিদৃশ্যে বুদ্ধ স্বয়ং সমবেত অগণিত মানুষের সামনে যশোধরার গুণগানে মুখর হয়েছেন। তিনি বলেছেন, যশোধরার ক্ষমাপ্রার্থনার কোনো প্রয়োজনই নেই। এই সমগ্ৰ বুদ্ধকল্পের মধ্যে যশোধরা অপেক্ষা পবিত্র, প্রজ্ঞাবতী, ত্রিজ্ঞানের অধিকারী নারী আর নেই। অর্হত্ব প্রাপ্তিজনিত যে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী যশোধরা হয়েছেন, তাও তিনি কখনো প্রদর্শন করেননি। সাধারণ ভিক্ষুণীর মতো জীবনযাপন করেছেন। অর্থাৎ যশের মোহও তিনি ত্যাগ করেছেন। কিন্তু এই শেষদিনে তা প্রদর্শিত হোক। পৃথিবী জানুক তাঁর সাধনপথের উচ্চ মার্গীয় অবস্থানকে।… রাহুলমাতার জীবনব্যাপী অগ্নিপরীক্ষার সফল উত্তরণের বাণী যেন ধ্বনিত হয়েছে, বুদ্ধের এই উচ্চারণে!

যশোধরা তখন বহু অলৌকিক ক্ষমতার প্রদর্শন করলেন। পরিশেষে, প্রথানুযায়ী তিন বার প্রদক্ষিণ করলেন বুদ্ধকে। তারপর বললেন, ‘যে জলধারা সমুদ্রে পৌঁছায় তা যেমন আর নদীতে ফেরে না, মকর যে জল পান করে নেয় তা যেমন আর সমুদ্রে মেলে না, তেমনি আমি, যশোধরা, যে কিনা তোমাকে বিগত অনন্তকাল মধ্যে কখনো পরিত্যাগ করেনি, এইবার শেষযাত্রায় চললাম। এই আমাদের শেষ দেখা। আর কখনো আমরা পরস্পরকে দেখবো না’।

এই কি নির্বাণের আনন্দোক্তি, নাকি জন্মজন্মান্তরের সঙ্গীর সাথে চিরবিচ্ছেদের আর্ত সঙ্গীত?!

তথ্যসূত্র-

১. Ranjini Beyesekere, Yasodhara, the wife of the Bodhisattva.

২. Radhika Abeysekera, Relatives and disciples of Buddha

৩. প্রসঙ্গ গৌতম বুদ্ধ।

৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনূদিত অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত।

৫. নারায়ণ সান্যাল, অপরূপা অজন্তা।

মন্তব্য তালিকা - “যশোধরা কথা”

  1. বিষয় বস্তু বা চরিত্র নির্বাচন এর জন্য ধন্যবাদ লেখককে। যশোধরা সম্পর্কে আমারও
    অনেক জিজ্ঞাসা ছিল। উত্তরগুলি পেলাম। সুখপাঠ্য আলোচনার।

  2. অনেক ধন্যবাদ এই লেখার জন্য। নতুন ভাবনা শুরু হল এই লেখা পড়ে।

    পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় বৌদ্ধ দর্শন এর প্রভাব বিষয়ে লেখা প্রকাশ হলে খুশী হব।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।