সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

টমেটো ৫০০ নট আউট

টমেটো ৫০০ নট আউট

সহস্রলোচন শর্মা

নভেম্বর ২৮, ২০২০ ১৪৫০ 10

সবজি বনাম ফল

‘না, না, না, ট্যাক্স না দিলে কোনও মতেই ছাড়া যাবে এগুলোকে’ ব’লে উঠেন হেডেন। হেডেন (পুরো নাম: Edward long Hedden ১৮২৮-১৮৯৩) তখন ন্যু ইয়র্ক জাহাজঘাটার ‘কন্ট্রোলার অব দ্য পোর্ট অব ন্যু ইয়র্ক’ পদে কর্মরত ছিলেন। বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যর উপর ট্যাক্স সংগ্রহ করাই ছিল তাঁর কাজ। 

‘আরে ট্যাক্স তো আনাজের উপর ধার্য করেছেন সরকার। ফলের উপর আবার কিসের ট্যাক্স?’ প্রশ্ন করেন আনাজ ও ফল ব্যবসায়ী জন নিক্স। ঝানু ব্যবসায়ী নিক্স যে কিছু খবর রাখেন না তা নয়। ন্যু ইয়র্ক শহরের জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান তখন। স্বাভাবিক ভাবেই জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে আনাজ ও ফলের চাহিদা। কিন্তু আনাজ বা ফলের সেই চাহিদার তুলনায় আনাজের জোগান কোথায়? শহরে আনাজ বা ফলের ঘাটতি দেখেই না ১৮৩৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন ‘জন নিক্স অ্যান্ড কো. ফ্রুট কমিশন’। বারমুডা, কিউবা, ফ্লোরিডা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে জাহাজে করে আনাজ আর ফল আমদানি করে বেশ দু’পয়সা কামিয়েও ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। ন্যু ইয়র্ক শহরে নিক্স অ্যান্ড কো.-এর ভালোই পসার তখন। শুধু নিক্সই নন, নিক্সের মতো আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী সস্তায় আনাজ আমদানি করে ভালোই পসার জমিয়েছেন শহরে। আর এটা যে কেবল ন্যু ইয়র্ক শহরের চিত্র তা নয়। দেশের বিভিন্ন শহরে আনাজ আমদানির ব্যবসা করে লক্ষ্মী লাভ করেছেন বেশ কিছু ব্যবসায়ী। এই ব্যবসাদারদের দাপটে আবার প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছেন না দেশি চাষিরা। লাভ তো পরের কথা, দেশের মাটিতে আনাজ উৎপাদন করতে যা ব্যয় করতে হচ্ছে তাঁদের, সেই টাকাটাই ফেরত পাচ্ছেন না তাঁরা। দেশের মাটিতে আনাজ চাষ আর লাভজনক নয় দেখে আনাজ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন কিছু চাষি। কেউ কেউ পড়েছেন বিরাট লোকসানের মুখে। দেশি আনাজ বনাম বিদেশি আনাজের দ্বন্দ্ব তখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হতে শুরু করেছে। বিষয়টা নিয়ে সরগরম হতে শুরু করেছে রাজনীতির আঙিনা। সরকারও পড়েছেন চিন্তায়। দেশি চাষিদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে তার প্রভাব পড়বে ভোট ব্যাঙ্কে। আর ঝুঁকি নেননি সরকার। দেশি চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় আনলেন নতুন আইন। ৩ মার্চ ১৮৮৩, ইউএস-এর প্রেসিডেন্ট (১৮৮১-১৮৮৫) চেস্টার আর্থার (পুরো নাম : Chester Alan Arthur ১৮২৯-১৮৮৬) সই করলেন নতুন আইন ‘ট্যারিফ অ্যাক্ট অব ১৮৮৩’তে। সেই আইন মোতাবেক, সমস্ত আমদানিকৃত আনাজের উপর বসল ১০% কর। তবে ছাড় দেওয়া হলো ফলের ক্ষেত্রে। ফল আমদানিতে নতুন কোনও ট্যাক্স চাপানো হলো না।  

১৮৮৬ সালের বসন্তকাল, ন্যু ইয়র্ক বন্দরে আটকে দেওয়া হয় নিক্সের আমদানিকৃত আনাজপাতি। আনাজের উপর যে ১০% ট্যাক্স বসেছে তা অজানা ছিল না নিক্সের। আর ফলের উপর যে ট্যাক্স বসেনি তাও বিলক্ষণ জানেন নিক্স। আনাজের উপর ধার্য করা ট্যাক্স দিতে গররাজি নন তিনি। কিন্তু তাই বলে ফলের উপর কেন ট্যাক্স দেবেন তিনি?

‘ফল? কোনটা ফল এখানে?’ বিস্মিত হয়ে জিগেস করেন হেডেন। 

কেন, টমেটো। টমেটোর উপর ১০% ট্যাক্স ধরা হবে কেন? টমেটো তো এক ধরণের ফল। যুক্তি সাজান নিক্স। 

টমেটো আবার ফল হলো কবে থেকে? টমেটো তো সবজি। বলে উঠেন হেডেন।

না, মোটেও নয়। টমেটো হলো ফল। 

না, না, ওসব আমি শুনতে চাই না। টমেটো হলো সবজি। আর সবজির উপর ১০% ট্যাক্স দিলে তবেই মাল খালাস হবে এখান থেকে, না হলে নয়।

ব্যস, শুরু হয় গেল দু’পক্ষের তর্কাতর্কি। টমেটো ফল না সবজি – এই হলো তর্কের মূল বিষয়। টমেটো হলো এক প্রকার ফল, এই যুক্তিতে টমেটোর উপর ধার্য করা ট্যাক্স দিতে নারাজ নিক্স। হেডেনের দাবি টমেটো হলো এক প্রকারের সবজি, তাই ট্যাক্স না নিয়ে ছাড়বেন না তিনিও। নিক্স দেখলেন জাহাজঘাটা থেকে মাল খালাস করতে না পারলে সমূহ বিপদ তাঁর। আনাজপাতি, ফলমূলে পচন ধরবে। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে, শেষে টমেটোর উপর ১০% ট্যাক্স দিয়েই বন্দর থেকে মাল খালাস করতে হলো তাঁকে। কিন্তু সাথে সাথে এই হুমকিও দিয়ে গেলেন, এই অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে কোর্টে কেস করবেন তিনি। হেডেন আর তাঁর আইনকে কোর্টে দেখে নেবেন তিনি।   

৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭, ট্যাক্স কালেক্টর হেডেনের বিরুদ্ধে ন্যু ইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেন নিক্স। তাঁর মূল দাবি, টমেটোকে সবজি গোত্রভুক্ত করে অন্যায় ভাবে তাঁর কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করেছেন হেডেন। সেই ট্যাক্সের টাকা এখন ফেরত দেওয়া হোক তাঁকে। ৬ বছর ধরে মামলা চলল কোর্টে। মামলার বিষয়টা ভারি অদ্ভুত। টমেটো সবজি না ফল – এটাই হলো মামলার কেন্দ্রবিন্দু। ওয়েবস্টার ডিকশনারি, ইম্পেরিয়াল ডিকশনারিতে প্রদত্ত ফলের সংজ্ঞা থেকে শুরু করে বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে নিক্সের উকিল দেখান টমেটো হলো এক প্রকারের ফল। যুক্তি তো খুবই সহজ। অন্যান্য ফলের মতোই ফুল থেকেই জন্ম হয় টমেটোর। টমেটোর ভিতরেও বীজ রয়েছে। সেই বীজ থেকে নতুন গাছের জন্ম হয়। টমেটোর এই সমস্ত ধর্ম থেকে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় – এটা হলো এক প্রকার ফল। অতএব, তাঁর মক্কেলের কাছ থেকে অন্যায় ভাবে আদায় করা হয়েছে ট্যাক্স। সেই ট্যাক্সের টাকা ফেরত দেওয়া হোক এখন।  

যুক্তি, পাল্টা যুক্তির দাপটে তখন সরগরম বিচারকক্ষ। ‘অর্ডার, অর্ডার’ কাঠের ব্লকের উপর গ্যাভেল (হাতুড়ি) ঠুকে বলে উঠলেন বিচারক। মুহূর্তের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে এলো সমস্ত গুঞ্জন। আজ ১০ মে ১৮৯৩, ইতিহাস বিখ্যাত টমেটো মামলার রায় দান করতে চলেছেন বিচারপতি হরেস গ্রে (Horace Gray, ১৮২৮-১৯০২)। বিচারপতি গ্রে বলে উঠলেন “উদ্ভিদবিজ্ঞান মোতাবেক, শসা, স্কোয়াশ, বিন, এবং কড়াইশুঁটির মতোই টমেটো হলো একপ্রকারের গাছের ফল। কিন্তু ক্রেতা বিক্রেতা নির্বিশেষে সাধারণের ভাষায় এগুলো হলো সবজি… যেগুলো আলু, গাজর, পার্সনিপ, শালগম, বিট, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শাক ও লেটুসের মতো কাঁচা অথবা রান্না করে খাওয়া হয়, যা সাধারণত ভোজনের সময়ে তরকারি, মাছ বা মাংসের প্রধান সহযোগী হিসেবে বা পৃথক পদ হিসেবে পরিবেশন করা হয়ে থাকে, ফলের মতো ভোজনের পর গ্রহণ করা হয় না।”

অতএব?! প্রশ্ন করেন নিক্সের উকিল।        

অতএব আবার কি? অতএব, টমেটো হলো এক প্রকারের সবজি। রায় দান করে বলে উঠলেন বিচারপতি গ্রে।

টমেটো সবজি! বিস্মিত নিক্সের উকিল।

হ্যাঁ, আলবৎ সবজি। টমেটো হলো এক ধরণের সবজি। টমেটোকে সবজির গোত্রভুক্ত করেই তাঁর রায় দান করেছিলেন বিচারপতি গ্রে। বিচারপতি গ্রে’র সেই রায়ে খুশি হননি অনেকেই। সেই রায় নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান আজও। কিন্তু বিতর্ক থাকলে কি হবে, হাকিম নড়ে তবু তাঁর হুকুম নড়ে না। বিচারপতির সেই রায় কিন্তু আজও অক্ষরে অক্ষরে বহাল আছে পৃথিবীর সর্বত্রই। আজও টমেটোকে সবজি হিসেবেই গণ্য করেন সবাই। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিজ্ঞান সম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে টমেটো হলো এক প্রকারের ফল।      

কলম্বিয় বিনিময়

৩ অগস্ট ১৪৯২, দক্ষিণ-পশ্চিম স্পেনের ছোট্ট বন্দর পালোস দে লা ফ্রন্তেরা থেকে ভাসল কলম্বাসের তিনটে জাহাজ। গন্তব্য – পশ্চিমের জল পথ দিয়ে চিন। আজকের কিশোর কিশোরীরাও জানেন যে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের কাছে তখনও অপরিচিতই ছিল গোটা আমেরিকা মহাদেশটাই। পশ্চিমে যাত্রা করে কলম্বাস শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছলেন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বাহামায়। সেখান থেকে দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য অংশে ঘুরে, ১৪৯৩ সালের মার্চ মাসে স্পেন প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। ফেরার সময় নিদর্শন হিসেবে উপজাতিদের ব্যবহার করা কিছু সোনার গহনা, মুক্তা, চট জাতীয় বস্তু থেকে প্রস্তুত দোলনা, কয়েক প্রজাতির ফুল এবং তাইনো (Taino) উপজাতির কিছু মানুষকে ধরে এনেছিলেন কলম্বাস। সেই শুরু, তারপর থেকে মূলত সম্পদের খোঁজে ও এলাকা দখলের উদ্দেশ্যে জন ক্যাবট, আমেরিগো ভেসপুচি সমেত ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা পাড়ি জমাতে থাকেন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। কলম্বাস নিজে চারবার অভিযান চালিয়েছেন আমেরিকায়। এই সমস্ত অভিযানের মধ্য দিয়েই ‘ন্যু ওয়ার্ল্ড’-এর সাথে পরিচয় ঘটে ‘ওল্ড ওয়ার্ল্ড’-এর। শুধু পরিচয়ই নয়, দুই ভিন্ন জগতের মধ্যে আদান-প্রদান হতে থাকে কৃষিজ পণ্য, গাছ-গাছালি, প্রাণীজ সম্পদ, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম, কারিগরি, রোগ, ওষুধ আরও কত কি। এই সমস্ত বিনিময়কে একত্রে ‘কলম্বিয় বিনিময়’ (Columbian exchange) বলা হয়ে থাকে। এই সমস্ত আদান-প্রদানের সবগুলোর সাথে যে কলম্বাস নিজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তা কিন্তু নয়। বরং এই সমস্ত বিনিময়ের সাথে সরাসরি কলম্বাসের যোগাযোগ খুবই কম ছিল। কলম্বাস নিজে যে কয়েকটা ‘কলম্বিয় বিনিময়’-এর সাথে যুক্ত ছিলেন তার মধ্যে আলু, ভুট্টা, তামাক, মরিচ, আনারস, কোকোয়া (যা থেকে চকোলেট তৈরি হয়) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। আমেরিকা থেকে এই সমস্ত উদ্ভিজ্জ পণ্য ইউরোপে নিয়ে আসেন কলম্বাস স্বয়ং। ও হ্যাঁ, আমাদের আলোচ্য টমেটোর সাথেও সরাসরি জড়িয়ে আছে কলম্বাসের নাম। অর্থাৎ কলম্বাসই প্রথম, যিনি ইউরোপীয়দের সাথে টমেটোর পরিচয় ঘটান।  

ক্রিস্টোফার কলম্বাসই টমেটোর কথা প্রথম শুনিয়েছিলেন ইউরোপীয়দের।

টমেটোর আদি বাড়ি হলো পেরু, বলিভিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে। সে প্রায় খ্রিস্ট জন্মেরও ৫০০ বছর আগের কথা। আন্দিজ পর্বতমালার উত্তর অংশে, মাঝামাঝি উচ্চতায় জন্মাত টমেটো গাছ। মূলত শীতকালে জন্মাত এই টমেটো। টমেটো বললে যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে, এই অঞ্চলের টমেটোগুলো কিন্তু ঠিক সেই জাতীয় টমেটো ছিল না। এই অঞ্চলের টমেটোগুলোর হতো লাল অথবা ঈষৎ হলদেটে রঙের। আর আকারেও বেশ ছোটো মাপের হতো এই টমেটোগুলো। টোপা কুলের আকার বা তার চেয়েও ছোটো আকারের এই টমেটোগুলো বর্তমানে ‘চেরি টমেটো’ নামে পরিচিত। অনেকেই এই টমেটোগুলোকে আবার ‘বুনো টমেটো’ বলে থাকেন। পেরুতেও এই টমেটোগুলোকে বুনো ফল হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। এই টমেটোগুলো তখন খেতেন না কেউই। পেরু, বলিভিয়াতে জন্মের পর, কেটে যায় প্রায় দু’হাজার বছর। এই দু’হাজার বছরে আকারে বা জাতে অনেক পরিবর্তন ঘটে টমেটোর। বড় এক ভৌগলিক অঞ্চল জুড়েও বিস্তার লাভ করতে থাকে টমেটো। পেরু থেকে যাত্রা শুরু করে উত্তরের পথ ধরে ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, মধ্য আমেরিকা হয়ে টমেটো এসে পৌঁছয় মেক্সিকোয়। মেক্সিকোয় তখন গড়ে উঠেছে মায়া সভ্যতা। টমেটোর সাথে পরিচয় ঘটে মায়াদের। তবে সেই টমেটো খেতেন না তাঁরাও। পেরু থেকে মেক্সিকো আসার এই দীর্ঘ যাত্রাপথের মধ্যে এবং মেক্সিকোয় আসার পর, পরিবর্তন ঘটে টমেটোর চরিত্রেরও। মেক্সিকোয় বেশ বড় আকারের টমেটোর দেখা মিলল। শুধু আকারই নয়, লাল ও হলুদ, দুটো রঙের টমেটোরই ভালো ফলন দেখা গেল মেক্সিকোয়। মায়াদের পর, মেক্সিকোয় গড়ে উঠে আজটেক সভ্যতা (১৩০০-১৫২১)। টমেটো সম্পর্কে সম্পূর্ণ রূপে ওয়াকিবহাল ছিলেন আজটেকরা। আজটেকরাই হলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ যাঁরা খাদ্য হিসেবে টমেটোর ব্যবহার শুরু করেন। বড় আকারের লাল ও হলুদ টমেটোকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন তাঁরা। আজটেকদের ব্যবহার করা এই বড় সাইজের টমেটোগুলোই এবার ফিরতি পথ ধরে মধ্য আমেরিকা হয়ে পৌঁছোয় পেরুতে। পেরুতে তখন ইনকাদের রাজত্ব (১৪৩৮-১৫৭২) চলছে। টমেটোর সাথে পরিচয় ঘটেছিল ইনকাদেরও। তবে ইনকারা খাদ্য হিসেবে টমেটোকে ব্যবহার করতেন কিনা তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। কারও মতে ইনকাদের সম-সময়ের পেরুতে টমেটোর দেখা মিলত ঠিকই, কিন্তু ইনকারা সেই টমেটো ব্যবহার করতে জানতেন না। বুনো গাছের মতোই সেখানে জন্মাত টমেটো গাছ। সেই গাছের ফল খেতেন না কেউই। ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের অধীনে আসার পরই পেরুতে টমেটো খাওয়া ও টমেটো চাষের সূত্রপাত হয় বলেই মনে করেন তাঁরা। তবে এই মতের বিপক্ষে ভিন্ন মত পোষণ করেন অনেকেই। তাঁরা বলেন, ইনকারা টমেটোর চাষ করতে জানতেন এবং টমেটো খেতেও জানতেন।     

ইনকাদের টমেটো ব্যবহার নিয়ে কিছু দ্বিমত থাকলেও, এই বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে পেরু থেকে মেক্সিকোর মধ্যবর্তী অঞ্চলই টমেটোর আদি বিচরণ ভূমি। লক্ষণীয়, উত্তরের ইউএসএ, কানাডা কিম্বা দক্ষিণের আর্জেন্টিনা বা পুবদিকের ব্রাজিলের মতো দেশগুলো কিন্তু টমেটোর আদি বিচরণ ভূমির অন্তর্ভুক্ত নয়। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জও এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নয়। স্থূল অর্থে তাই আমরা বলতেই পারি, মধ্য আমেরিকাই হলো টমেটোর জন্মস্থান। এখানেই কেটেছে টমেটোর শৈশব। আর এই মধ্য আমেরিকাতেই পাড়ি জমিয়ে টমেটোর হদিশ পান কলম্বাস। কোনও সন্দেহ নেই, কলম্বাসই হলেন প্রথম ইউরোপীয়, যিনি মেক্সিকো অঞ্চলে গিয়ে টমেটো গাছ দেখতে পান। টমেটোর সাথে সম্যক পরিচিত ছিলেন তিনি। এতৎসত্ত্বেও, টমেটোকে ইউরোপে নিয়ে আসার কৃতিত্ব কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয় না। আমেরিকা থেকে আলু, ভুট্টা, আনারস ইত্যাদি ফসল স্পেনে নিয়ে এলেও, কলম্বাস কিন্তু নিজ হাতে করে টমেটো আনেননি ইউরোপে। মেক্সিকো থেকে স্পেনে টমেটো নিয়ে আসেন স্প্যানিশ অভিযাত্রী হেরনান কোরতেস (পুরো নাম : Hernan Cortes de Monroy y Pizarro Altamirano, ১৪৮৫-১৫৪৭)। আমেরিকায় স্প্যানিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের পুরোভাগে ছিলেন কোরতেস। ১৩ অগস্ট ১৫২১ সালে কোরতেস ও তাঁর বাহিনীর হাতেই পতন ঘটে আজটেক সভ্যতার। আজটেকদের রাজধানী টেনোচটিটল্যান (Tenochtitlan, উচ্চারণ: টেনোচ-টিট-ল্যান, অধুনা মেক্সিকো সিটি) দখল করে মেক্সিকোকে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন তিনি। ১৫২৪ সাল পর্যন্ত, প্রায় বছর চারেক, একক উদ্যোগেই এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করতেন তিনি। মেক্সিকোয় থাকাকালীনই টমেটোর সাথে পরিচয় ঘটে কোরতেসের। উজ্জ্বল গোলাকার এই ফল দেখে মুগ্ধ হন কোরতেস। সুন্দর দেখতে এই ফলটাকে দেশে নিয়ে যেতে মনস্থির করে ফেলেন। কিন্তু তিনি তখন মেক্সিকো শাসনে ব্যস্ত। ১৫২১ সালেই, বিবিধ প্রয়োজনে মেক্সিকো থেকে একটা জাহাজ পাঠান তিনি স্পেনের উদ্দেশ্যে। সেই জাহাজে চড়েই টমেটো ও টমেটোর বীজ এসে পৌঁছোয় স্পেনে। সেই বীজ থেকেই স্পেনের মাটিতে শুরু হয় টমেটোর চাষ। সেই হিসেবে আজ থেকে ঠিক ৫০০ বছর আগে নবজন্ম ঘটেছিল টমেটোর। তবে প্রথম দিকে স্পেনের মুষ্টিমেয় কয়েক জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল টমেটোর পরিচয়। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কাছে তখনও অচেনাই ছিল টমেটো। তাছাড়া খাদ্য হিসেবে টমেটোর প্রচলন তখনও শুরু হয়নি স্পেনেও।      

সন্ত ফ্রান্সিসের অনুগামী বেরনাদিনো দে শাহ্গুন (Bernadino de Sahagun, ১৪৯৯?-১৫৯০) ধর্ম প্রচারের জন্য স্পেন থেকে মেক্সিকোতে আসেন ১৫২৯ সালে। মেক্সিকোতে গিয়ে যথারীতি আজটেকদের সাথে পরিচয় ঘটে তাঁর। পরিচয় ঘটে টমেটোর সাথেও। আজটেকদের টমেটো খেতেও দেখেন তিনি। স্বদেশে ফিরে তিনি জানান, টমেটোর সাথে লঙ্কা ও আরেকটা গাছের বীজ মিশিয়ে সালসা বা চাটনি খেতে দেখেছেন তিনি আজটেকদের। মাছ বা মাংসর সাথে এই সালসা খেতেন তাঁরা। বেরনাদিনো এও জানান আজটেকরা এই ফলটাকে ‘জিটমেটল’ (Xitomatl) নামে অভিহিত করে থাকেন। আজটেকরা কথা বলতেন নাওয়াটল্ (Nahuatl) ভাষায়। নাওয়াটল্ ভাষায় ফলটাকে ‘টমেটল’ (Tomatl) নামেও ডাকা হয় বলে জানান বেরনাদিনো। 

বেরনাদিনো উল্লিখিত ‘টমেটল’ আর ‘জিটমেটল’ ফল দু’টো কিন্তু হুবহু একই ফল নয়। এই দু’টো ফলের মধ্যে কিছুটা ফারাক বর্তমান। সবুজ বা হলুদ রঙের টমেটল, আকারে বেশ খানিকটা ছোটো হয়। খেতেও হয় কিছুটা টক। আজটেকদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মায়ারা দীর্ঘদিন ধরেই এই ফলের সাথে পরিচিত ছিলেন। সম্ভবত মায়ারাই এই ফলটাকে ‘টমেটল’ নামে ডাকতেন। মায়াদের থেকেই টমেটলের সাথে পরিচয় ঘটে আজটেকদের। সেই তুলনায় জিটমেটল আকারে বেশ বড় হয়। লাল বা হলুদ রঙের দেখতে হয় জিটমেটল। নাওয়াটল্ ভাষায় ‘জিটমেটল’ কথাটার অর্থ হলো ‘বড় ফল’ বা ‘ফোলা ফল’। এই শব্দার্থ থেকে এটা স্পষ্ট যে আমরা এখন যাকে টমেটো বলে জানি আজটেকরা তাকে ‘জিটমেটল’ বলতেন। ‘টমেটল’ হলো তুলনায় ছোটো আকারের তথাকথিত ‘বুনো টমেটো’। প্রকৃত অর্থ যাই হোক না কেন, স্প্যানিশরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘টমেটল’ নামেই ডাকতে শুরু করে নতুন এই ফলটাকে। স্প্যানিশদের মধ্যে কেউ কেউ আবার টমেটাস (Tomatas) নামেও ডেকে থাকতেন এই ফলটাকে। কেউ কেউ টুমেটলি (Tumatle) নামেও ডাকতে থাকেন। খুব কাছাকাছি উচ্চারণের এই সমস্ত শব্দগুলো থেকেই শেষ পর্যন্ত ‘টমেটো’র উৎপত্তি হয়।       

বিষাক্ত প্রেম

স্পেন থেকেই পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে টমেটোর চাষ। পৃথিবীর যে সমস্ত অঞ্চলে স্প্যানিশ সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, প্রথম পর্যায়ে সেই সমস্ত অঞ্চলেই টমেটো চাষের সূত্রপাত হয়। স্পেন থেকে ক্রমান্বয়ে ক্যারিবিয়ন দ্বীপপুঞ্জে, পেরু ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অঞ্চলে, উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে, ফিলিপিন্স ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলে শুরু হয় টমেটো চাষ। তবে টমেটো নিয়ে বিশেষ আগ্রহ গড়ে উঠে ইতালিতে। স্পেন থেকেই টমেটো এসে পৌঁছোয় ইতালিতে। ইতালিতে দ্রুতই চর্চায় চলে আসে টমেটো। ১৫৪৪ সালে গ্রিক ভাষায় লিখিত ‘ডি মেটিরিয়া মেডিকা’বইটিকে ইতালিয় ভাষায় অনুবাদ করে টীকা রচনা করেন ইতালিয় চিকিৎসক ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানী পিয়েত্রো মাত্তিওলি (পুরো নাম : Pietro Andrea Gregorio Mattioli, ১৫০১-১৫৭৭)। এই বইতে টমেটো প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন তিনি। মাত্তিওলি লেখেন, “মেলরোজ (আপেল) -এর মতো (উপর-নিচ) চাপা, প্রকোষ্ঠযুক্ত, কাঁচা অবস্থায় সবুজ আর পাকা অবস্থায় সোনালি রঙের হয় (টমেটো)”। টমেটো প্রসঙ্গে এটাই প্রথম লিপিবদ্ধ বিবরণ। লক্ষণীয়, পাকা অবস্থায় টমেটোর রঙ সোনালি হয় বলে উল্লেখ করেছেন মাত্তিওলি। যার অর্থ প্রথম দিকে হলুদ টমেটোর চাষ শুরু হয়েছিল ইতালিতে। এই সোনালি রঙের কারণেই এই ফলটাকে ‘পোমি দ’অরও’ (Pomi d’oro) বা ‘সোনার আপেল’ নামে অভিহিত করেন তিনি। এই বইয়ের পরের সংস্করণে অবশ্য লাল টমেটোরও উল্লেখ করেন তিনি।  

টমেটো গাছের বিজ্ঞানসম্মত শ্রেণী বিভাগও করেন মাত্তিওলি। টমেটো গাছকে ম্যানড্রেক জাতীয় উদ্ভিদের পরিবার ভুক্ত (Family) করেন তিনি। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে স্বাভাবিক ভাবেই জন্মাতে দেখা যায় ম্যানড্রেক গাছকে। সাধারণভাবে বিষাক্ত বলেই পরিচিত এই ম্যানড্রেক গাছ। তবে ম্যানড্রেক গাছের মূল ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বল্প মাত্রায় ম্যানড্রেক সেবনে হ্যালুসিনেশন হয় বলে নেশার বস্তু হিসেবে বহুল পরিচিত ম্যানড্রেক। বাইবেলেও ম্যানড্রেক গাছের উল্লেখ রয়েছে বলেই দেখিয়েছেন বিশারদরা। হিব্রু ভাষায় লিখিত বাইবেলে ‘ডুডাইম’ নামে একটা গাছের উল্লেখ আছে। এই ডুডাইমই হলো আখেরে ম্যানড্রেক। হিব্রু ভাষায় ডুডাইম শব্দের অর্থ হলো ‘প্রেমের আপেল’। ম্যানড্রেক বা ডুডাইম তথা প্রেমের আপেলের সাথে একই পঙ্ক্তিভুক্ত হওয়ার সূত্রেই ল্যাটিন ভাষায় পোমা আমোরিস (Poma amoris) নামেও পরিচিত হয়ে উঠে টমেটো। ল্যাটিন ভাষায় পোমা আমোরিস কথাটার অর্থ ‘প্রেমের আপেল’। এই ‘প্রেমের আপেল’ শব্দ যুগলের অনুকরণে গোটা ইউরোপেই ‘প্রেমের আপেল’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে টমেটো। ফরাসিরা টমেটোকে ‘পাম দ’মুর’ (Pommes D’amour) নামে ডাকতেন। ফরাসি ভাষায় ‘পাম দ’মুর’ কথাটার অর্থ ‘প্রেমের আপেল’। ইংরাজিতে ‘লাভ অ্যাপেল’ নামে পরিচিত হয় টমেটো। সোনার আপেল বা প্রেমের আপেল নাম দুটো ছাড়াও ‘পমি ডি পেরু’ (pomi de Peru) বা পেরুর আপেল নামেও কোথাও কোথাও পরিচিত ছিল টমেটো।  

টমেটো তখন কোথাও প্রেমের আপেল, কোথাও সোনার আপেল নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো, এতো প্রেম থাকা সত্ত্বেও রান্নার পদ হিসেবে সমগ্র ইউরোপেই কিন্তু তখনও ব্রাত্যই রয়ে গেছে টমেটো। ইউরোপ জুড়েই টমেটো তখন বিষাক্ত ফল হিসেবে পরিচিত। ‘টমেটো একটা বিষাক্ত ফল’- এই ধারণা গড়ে উঠার পিছনে দু’টো ঘটনা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল, যার প্রথমটা হলো, টমেটোকে ম্যানড্রেক গাছের পরিবার ভুক্ত করা। তামাম ইউরোপ জুড়েই তখন বিষাক্ত গাছ হিসেবে সুপরিচিত ছিল ম্যানড্রেক গাছ। ম্যানড্রেক পরিবার ভুক্ত ‘প্রেমের আপেল’ যে বিষাক্তই হবে সে বিষয়ে এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন ইউরোপীয়রা। ভুলেও ‘প্রেমের আপেল’ মুখে তুলতেন না তাঁরা। তবে সত্যি বলতে কি, প্রেমের আপেলের প্রেমে তখন পাগল হতে শুরু করেছে গোটা মহাদেশই। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই তখন চাষ করা হচ্ছে প্রেমের আপেল। ইউরোপের নামজাদা বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে শুরু করে নিজের বাড়ির পিছনের ছোট্ট এক ফালি বাগানে তখন শোভা পাচ্ছে টমেটো গাছ। বিষাক্ত জানা সত্ত্বেও, টমেটো চারা রোপণ করতে পিছপা নন কেউই। বাগানে টমেটো গাছ লাগানোর পিছনে মূল কারণই ছিল টমেটোর উজ্জ্বল রং। রং লালই হোক বা হলুদ, অমন সুন্দর দেখতে একটা ফল থেকে কি চোখ ফিরিয়ে রাখা যায়? ফলে ষোল শতাব্দীর মাঝামাঝি বা ১৫৫০ সালের পর থেকে, ‘শো পিস’ বা বাহারি গাছ হিসেবে বহু বাগানেই শোভা পেত লাগলো টমেটো গাছ। এমন কি ডাইনিং টেবিলের উপরও সাজানো থাকতো সোনার আপেল। তবে ডাইনিং টেবিলের অলঙ্কার থেকে রান্নার পদ হয়ে আর উঠতে পারেনি টমেটো তখনও। ডাইনিং টেবিলের দুয়ার থেকে কিচেনের আঙ্গিনা, বহুদূরের পথ ছিল তখনও। 

শিল্পীর হাতে আঁকা ম্যানড্রেক গাছ।

টমেটোর গায়ে ‘বিষাক্ত’ তকমা পড়ার পিছনে দ্বিতীয় কারণ ছিলো- মৃত্যু। একথা সত্যি, সেই সময়ে টমেটো খাওয়ার পর মৃত্যু ঘটেছিল বেশ কয়েকজন অভিজাতদের। ইউরোপে, বিশেষত ইতালিতে টমেটো খেয়ে কয়েক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মৃত্যুর খবরে স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে উঠেন ইউরোপীয়রা। এই খবর থেকে ইউরোপীয়দের মনে এই ধারণাই জন্মায় যে টমেটো হলো বিষাক্ত ফল। সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় সদ্য গড়ে উঠা টমেটো খাওয়ার অভ্যাস। তবে বেশ কিছু ইতালিবাসি লক্ষ্য করেন, বিষাক্ত হওয়া সত্ত্বেও কিছু গরিব লোক কিন্তু তখনও দিব্যি খেয়ে যাচ্ছেন টমেটো (প্রসঙ্গত, টমেটো কিন্তু ‘গরিবের আপেল’ নামেও পরিচিত)। তাঁদের শরীরে কিন্তু কোনও বিষক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ক্রমেই একটা বিষয় তাঁরা লক্ষ্য করে দেখেন, গরিব লোকগুলো ভোজন করছেন কাঠের পাত্রে। বিপরীতে, অভিজাতরা ভোজন করতেন ধাতব পাত্রে। ভোজনের জন্য তামা, অ্যান্টিমনি, সীসা ও টিনের মিশ্রণে বিশেষ এক ধরণের ধাতব পাত্র বা ‘ডিনার সেট’ ব্যবহার করতেন অভিজাত ইউরোপীয়রা। আধুনিক ধারণা থেকে এই বিষয়ে আমরা অবগত যে টমেটোর মধ্যে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড (ভিটামিন সি) ইত্যাদি অ্যাসিড বিদ্যমান। তাছাড়া কিছু জাতের টমেটো একটু বেশি পরিমাণেই টক হয়ে থাকে। আর টক মানেই অ্যাসিড। এই অ্যাসিডের সাথে অ্যান্টিমনি, সীসার মতো ধাতুর মিশ্রণে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। সমসময়ের ইউরোপীয়রা জানতেন, সম্ভাব্য বিষক্রিয়ার কারণেই ধাতব পাত্রে টক খাওয়া উচিৎ নয়। অবশেষে সঠিক ভাবেই তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ধাতব পাত্রে টক টমেটো খাওয়ার পরিণতিতেই মৃত্যু ঘটেছে কিছু অভিজাতের। বিপরীতে, কাঠের পাত্রে ভোজন করার জন্যই, সেই একই টমেটো খেয়ে দিব্যি সুস্থ রয়ে গেছেন কিছু গরিব মানুষ। বিষয়টা সামনে আসার পর অবশ্য ভুল ভাঙ্গতে খুব বেশি সময় লাগেনি ইউরোপীয়দের। দ্রুতই স্বমহিমায় প্রকাশিত হতে থাকে টমেটো।

টমেটো স্যুপ

ষোল শতাব্দীর শেষের দিকে অথবা সতের শতাব্দীর প্রথম দিকেই, খাদ্য বস্তু হিসেবে টমেটোর ব্যবহার শুরু হয় ইউরোপ জুড়ে। অন্য পদের সহযোগী হিসেবে নয়, স্বতন্ত্র পদ হিসেবেই প্রথম আবির্ভাব ঘটে টমেটোর। যেহেতু বেগুন গাছ ও টমেটো গাছ একই পরিবারভুক্ত (পাদটীকা ৩ দ্রষ্টব্য) উদ্ভিদ, তাই বেগুন ভাজার মতো করেই তেল নুন দিয়ে টমেটো ভাজা খাওয়ার প্রচলন শুরু হয় প্রথমে। ১৬০৮ সাল নাগাদ, জনপ্রিয়তম ডিশ ‘স্যালাড’-এর অন্যতম উপাদান হিসেবে আবির্ভাব ঘটে টমেটোর। ব্যস, এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি টমেটোকে। দৈনন্দিন জীবনের খাদ্যসূচীতে রকমারি আঙ্গিকে হাজির হতে থাকে টমেটো। তরকারিতে বা মাছের ঝোলে আলুর দোসর হিসেবে তো অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি টমেটোর। শুধু সহযোগী হিসেবেই নয়, একক পদ হিসেবেও তৈরি হতে লাগল টমেটোর হরেক প্রস্তুতি। টমেটো স্যুপ, টমেটো স্টু, টমেটো রেলিশ, টমেটো কারি, স্টাফড টমেটো সমেত একাধিক লোভনীয় পদের একমেবাদ্বিতীয়ম্ উপাদান সেই টমেটোই। রান্নার পদে গোটা টমেটো না দিতে চাইলে টমেটো পিউরে ব্যবহার করুন। এছাড়াও টমেটো সস্ আর কেচআপের কথা ভাবুন। স্যুপ, ফাস্ট ফুড, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ফিস ফ্রাই, পিৎজা, পাস্তা, মোমো, সিঙ্গারা থেকে শুরু করে আধুনিক খাদ্যের হরেক সম্ভারের আদর্শ যুগলবন্দী হলো টমেটো সস বা কেচআপ। টমেটো সস্ ছাড়া এই সমস্ত ডিশগুলো নিতান্তই বিস্বাদগ্রস্ত বলেই প্রতীয়মান হয়। আর শেষপাতে টমেটোর চাটনি না হলে তো বাঙালিদের খাওয়া যেন ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’ বলে মনে হয়।    

টমেটোস্ফিয়ার: খায় না মাখে?

ওজোনোস্ফিয়ার ইয়েস… আয়নোস্ফিয়ার ইয়েস… ট্রপোস্ফিয়ার ইয়েস… স্ট্রাটোস্ফিয়ার ইয়েস, বাট নো টমেটোস্ফিয়ার। সে কি! টমেটোস্ফিয়ারের নাম শোনেননি? আশ্চজ্জ মিল মশাই আমাদের, আমিও টমেটোস্ফিয়ারের নাম শুনিনি কোনদিনও। শুধু আপনি বা আমি নই, টমেটোস্ফিয়ারের নাম শোনেননি প্রায় কেউই। কারণ টমেটোস্ফিয়ার নামে তো বায়ুমণ্ডলের কোনও স্তরই নেই। শুনবেন কি করে? টমেটোস্ফিয়ার হলো নাসা ও কানাডিয়ন স্পেস এজেন্সির একটা প্রকল্পের নাম। কি সেই প্রকল্প? “Tomatospher, a free program where Kindergarten to Grade 12 students use “space” tomato to learn about plant in space, right here on Earth”.      

হেঁয়ালি ছেড়ে এবার সহজ ভাষায় বর্ণনা করা যাক বিষয়টাকে। মাটি, জল, অক্সিজেন ইত্যাদি ছাড়া তো গাছ বাঁচে না। ফলে মহাকাশে গাছপালা নিয়ে গিয়ে গবেষণা করা বেশ অসুবিধার ব্যাপার। সেই লক্ষ্যে নাসা ও অন্যান্য সংগঠন মিলে একটা যৌথ কর্মসূচী গ্রহণ করেন, যার নাম ‘টমেটোস্ফিয়ার’। ২০০১ সালে ‘ইন্টারনেশান্যাল স্পেস সেন্টার’-এ ১২ লক্ষ টমেটো বীজ পাঠানো হয়েছিল। কম চাপে, কম অভিকর্ষের প্রভাবে, উন্মুক্ত অতিবেগুনি ও এক্স রশ্মির মাঝে এই টমেটো বীজগুলো রেখে দিয়েছিলেন তাঁরা। ৩৭ দিন পর পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বীজগুলোকে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে পাঠানো হয় সেই টমেটো বীজগুলো। সেই বীজ থেকে উৎপন্ন টমেটোর ওজন, আকার, রং, স্বাদ, গন্ধ, রাসায়নিক গুণাবলি ইত্যাদি তথ্য নথিভুক্ত করতে থাকেন তাঁরা। ‘টমেটোস্ফিয়ার’ কর্মসূচীতে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদেরও সামিল করেন তাঁরা। ইউএসএ ও কানাডার কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলি করা হয় সেই টমেটো বীজ। স্কুলের তত্ত্বাবধানে সেই বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটিয়ে ফলানো হয় টমেটো। সেই টমেটো সম্পর্কে নানান তথ্য লিপিবদ্ধ করতে থাকেন ছাত্র-ছাত্রীরাও।      

এখন প্রশ্ন হলো, এতো গাছ থাকতে হঠাৎ টমেটো গাছ কেন নির্বাচন করলেন উদ্যোক্তারা? না, এই প্রশ্নের খুব সরাসরি কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি তাঁদের তরফ থেকে। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে ছোটোখাটো যা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে, তাতে তাঁরা বলছেন, টমেটো খুব উপকারী ফল। এর থেকে বেশি কিছু জানা যায়নি তাঁদের তরফ থেকে। হ্যাঁ, তা তো বটেই, স্বাস্থ্যের পক্ষে টমেটো যথেষ্ট উপকারী বটে। টমেটোর উপকারিতা কী কী? এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক টমেটোর উপকারিতাগুলো। টমেটোর উপাদানের ৯৫% হলো জল। কিছুটা হলেও শরীরে জলের চাহিদা মেটায় টমেটো। টমেটোয় ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকে। ১০০ গ্রাম ওজনের একটা টমেটোয় ফ্যাট মাত্র ০.২ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেটস্ ৩.৯ গ্রাম আর প্রোটিন ০.৯ গ্রাম। অর্থাৎ টমেটো হলো ‘লো ক্যালরি ডায়েট’। ১০০ গ্রাম টমেটোয় শক্তির (তাপের) পরিমাণ মাত্র ২০ ক্যালরি। এবার প্রাণ ভরে খান না যত খুশি টমেটো, শরীরে মেদ কিন্তু বাড়বে না এতটুকুও। তাছাড়া টমেটোয় রয়েছে ভিটামিন। ভিটামিন এ, বি (১, ৩, ৬, ৯), সি, কে১, ই, এফ রয়েছে টমেটোয়। কোভিড ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন সি’র ভূমিকা এখন আমজনতার চর্চার বিষয়। ভিটামিন সি’র এক সস্তা ও সহজলভ্য উৎস হলো টমেটো। খনিজ পদার্থেও ভরপুর টমেটো। টমেটোর মধ্যে রয়েছে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক, লোহার মতো খনিজ পদার্থ। টমেটোয় যেহেতু পটাসিয়াম ও সামান্য পরিমাণে সোডিয়াম রয়েছে, উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের তাই টমেটো এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন কিছু চিকিৎসক। বিপরীতে যাঁদের রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে বা প্রায়ই নীচের দিকে থাকে রোজ একটা করে টমেটো খাওয়ার অভ্যাসটা তাঁদের ‘গুড হ্যাবিট’-এর মধ্যে পড়ে।

টমেটোর অন্যতম উপাদান হলো ক্যারোটিনয়েডস্। ক্যারট বা গাজরের মধ্যে এই উপাদানটা প্রথম পাওয়া গিয়েছিল বলে এদের ক্যারোটিনয়েডস্ বলা হয়। একগুচ্ছ যৌগকে একত্রে ক্যারটিনয়েডস্ বলা হয়। টমেটোয় উপস্থিত ক্যারোটিনয়েডস্ গুলো হলো লাইকোপিন, বিটা-ক্যারোটিন, গামা-ক্যারোটিন, জিটা-ক্যারোটিন, টোকোফেরল, ফাইটোইন ইত্যাদি। এদের মধ্য বিটা-ক্যারোটিন ও গামা-ক্যারোটিন, এই দুই ক্যারোটিনয়েডসকে ‘প্রোভিটামিন এ’ বলা হয়। যে সমস্ত যৌগগুলো সরাসরি ভিটামিনে পরিণত হতে পারে তাদের প্রোভিটামিন বলা হয়। অর্থাৎ, বিটা-ক্যারোটিন ও গামা-ক্যারোটিনকে প্রকারান্তরে ভিটামিন এ বলা চলে। আর একথা প্রায় সবারই জানা, চোখের রড কোষকে সজীব রাখতে সাহায্য করে ভিটামিন এ। ফলে চোখের পক্ষেও টমেটো খুবই উপকারী। টোকোফেরল হলো ‘প্রোভিটামিন ই’। ভিটামিন ই রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করতে এবং পেশি সজীব রাখতে সাহায্য করে। অ্যালজাইমার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে ভিটামিন ই।

টমেটোয় উপস্থিত ক্যারোটিনয়েডস্ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো লাইকোপিন। টমেটোর লাল রঙ তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা নেয় লাইকোপিন। মানবদেহেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে লাইকোপিনের। একথা ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত, শরীরে লাইকোপিনের মাত্রা কম থাকলে হার্টের সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। LDL (bad) Cholesterol মাত্রা কমাতে ও HDL (good) Cholesterol মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে লাইকোপিন। অর্থাৎ হার্টকে সুস্থ রাখার পক্ষে যথেষ্ট উপকারী টমেটো। মহিলাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার ও পুরুষদের প্রস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে লাইকোপিন। সানবার্ন প্রতিরোধে লাইকোপিনের ভূমিকা রয়েছে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবেও সুপরিচিত লাইকোপিন। 

জীববিজ্ঞান বিষয়টার ব্যাপ্তি যত বড়, গভীরতাও তত বেশি। ফলে একটা পরিসরে একটা ফলের রাসায়নিক গুণাগুণ আলোচনা করা অসম্ভবই। কচি টমেটো থেকে পাকা টমেটো, হলুদ টমেটো থেকে লাল টমেটো, ছোটো টমেটো থেকে বড় টমেটো- প্রত্যেকের রাসায়নিক উপাদানে বেশ কিছুটা তারতম্য বিদ্যমান। তাছাড়াও চাষের পরিবেশ ও পদ্ধতির উপরও অনেকটা নির্ভর করে টমেটোর উপাদান। প্রখর সূর্যালোক, ছায়া ঘন অঞ্চল, বায়ুর আর্দ্রতা, মাটির উপাদান ইত্যাদি অজস্র কারণে টমেটোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রজাতি, উপ-প্রজাতি মিলিয়ে প্রায় ১০,০০০ ভিন্ন ভিন্ন রকমের টমেটো গাছ আছে। সেই সব গাছে লাল, হলুদ, সবুজ ছাড়াও সাদা, কালো ইত্যাদি নানা রঙের, নানা আকারের, নানা আকৃতির টমেটো হয়। আলাদা করে এই সমস্ত টমেটোর রাসায়নিক গুণাগুণ আলোচনা করা নিবন্ধকারের ক্ষমতার অন্তর্গত নয়।       

তবে একথা জানাতে পারি, টমেটোর নামে অহেতুক একটা অপবাদ প্রচলিত রয়েছে বাজারে। আরথ্রাইটিস রোগীদের নাকি টমেটো খাওয়া বারণ। কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, টমেটোর মধ্যে সোলেনিন (Solanine) নামক একটা রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা আরথ্রাইটিসের ফোলা ও ব্যথা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আধুনিক ধারণা কিন্তু এই মতামতকে স্বীকৃতি দেয় না। ইউএসএর আরথ্রাইটিস ফাউন্ডেশন তো বিষয়টাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, আরথ্রাইটিসের সাথে সোলেনিনের কোনও সম্পর্কই নেই। আরথ্রাইটিসের রোগীরা নিরাপদেই খেতে পারেন টমেটো। টমেটো না খেলেই বরং টমেটোর অন্যান্য গুণাবলী থেকে বঞ্চিত হবেন রোগী।

অপবাদের পাশাপাশি, বাজারিকরণের প্রশ্নেও টমেটো নিয়ে একটা অভিযোগ আছে বটে। টমেটো গবেষকরা দেখেছেন, টমেটো যখন পাকতে শুরু করে, টমেটো খেত থেকে ইথিলিন গ্যাস নির্গত হয় তখন। এই পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক উপায়ে টমেটো সংরক্ষণ করা হয়। পূর্ণ বয়স্ক টমেটো যখন সবুজ থেকে সবে মাত্র লাল হতে শুরু করে, ঠিক সেই সময়ে খেত থেকে সংগ্রহ করা হয় টমেটো। এরপর এদের সংরক্ষণ করা হয়। প্রয়োজন অনুসারে ইথিলিন স্প্রে করে এই সবুজ টমেটোগুলোকে পাকিয়ে নেওয়া হয়। এতে সম্বৎসর অবিচ্ছিন্ন টমেটো সরবরাহ বজায় রাখা সম্ভবপর হয়। ইথিলিন স্প্রে-এর এই পদ্ধতিকে ঘিরে একটা অভিযোগ অবশ্য রয়েছে। ইথিলিন স্প্রে করার জন্য নাকি টমেটোর স্বাদে কিছু পরিবর্তন ঘটছে বলে দাবি করছেন অনেকেই। তাঁরা মনে করেন, স্প্রে করা টমেটোর থেকে মাঠে পাকা লাল টমেটো অনেক বেশি সুস্বাদু। স্প্রে করা টমেটোর স্বাদে কিছু তফাৎ ঘটল কিনা সেই বিষয় অবশ্য নিশ্চিত নন সকলে। তবে ইথিলিন স্প্রে করা টমেটো যে অপকারী নয় এমন তত্ত্বেই ভরসা রেখেছেন বিশেষজ্ঞরা।    

শুধু ইথিলিন স্প্রে করা নিয়েই নয়, টমেটোর অপকারিতা নিয়ে এর আগেও চিন্তিত ছিল মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে এমনও একটা সময় ছিল যখন টমেটো খাবো, না ঘরে সাজাবো তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছিল মানুষ। আজ আর সেই দিন নেই। আজকের শিশুরাও জানেন যে ‘টমেটো খায়, না গায়ে মাখে?’ এহেঁহেঁ, ভুল উত্তর দিলেন তো! টমেটো যেমন খায়, তেমন গায়েও মাখে। স্পেনের বিখ্যাত ‘লা টোমাটিনা’র নাম শোনেননি? বাঙালিদের দোলের মতো, প্রতি বছর অগস্ট মাসের শেষ বুধবার সেখানে জাঁকিয়ে টমেটো মাখামাখি হয়। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে শুরু হয়েছিল সেই উৎসব। ২৯ অগস্ট ১৯৪৫, মাসের শেষ বুধবার, দক্ষিণ স্পেনের ছোট্ট শহর বুনিয়লের ‘পিপলস স্কোয়ারে’ গান বাজনা সহযোগে চলেছে ‘জায়েন্ট অ্যান্ড বিগ হেড প্যারেড’। বড় মাথা ও বিরাট আকৃতির নরম পোষাকে সজ্জিত মানুষরাই এই শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ। স্থানীয় কিছু যুবক এই শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন সেইদিন। কিন্তু সেই শোভাযাত্রায় তাঁদের সামিল হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। উল্টে এক ‘বিগ হেড’ সবাইকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিতে থাকেন। ধাক্কাধাক্কিতে ব্যালেন্স হারিয়ে এক আনাজের দোকানে রাখা টমেটোর ঝুড়ির উপর পড়ে যান ‘বিগ হেড’। পড়ে গিয়ে, স্থানীয় যুবকদের উদ্দেশ্যে টমেটো ছুড়ে মারতে থাকেন ক্ষিপ্ত ‘বিগ হেড’। যুবকরাও পাল্টা টমেটো ছুড়তে থাকেন ‘বিগ হেড’কে লক্ষ্য করে। কিছুক্ষণ ধরে চলল টমেটো ছোড়াছুড়ি। মারামারির খবর পেয়ে হাজির হলো পুলিশ। পুলিশের হস্তক্ষেপে সেই যাত্রায় বন্ধ হলো টমেটো ছোড়াছুড়ি। কিন্তু শুরু হয়ে গেলো ‘লা টোমাটিনা’ উৎসব। পরের বছর ওই একই দিনে স্থানীয় কিছু যুবক, গত বছরের টমেটো ছোড়াছুড়ির স্মৃতিতে এই বছরও টমেটো ছোড়াছুড়ি শুরু করেন। তাতে সামিল হন আরও কিছু পথচলতি মানুষ। পরস্পরের উদ্দেশ্যে টমেটো ছুড়ে মেরে ব্যাপক মজা পান তাঁরা। ব্যস, সূচনা হয়ে গেল নতুন উৎসব- লা টোমাটিনা। সেই থেকে প্রতি বছর অগস্ট মাসের শেষ বুধবার কাতারে কাতারে মানুষ জমা হন বুনিয়ল শহরে, টমেটো ছুড়ে মেরে মজা নিতে। প্রতি বছর নিয়ম করে, অনাবশ্যক এই টমেটো মারামারিতে বেকায়দায় পড়ে যায় প্রশাসন। টমেটো মারামারিতে বিরক্ত হয়ে লা টোমাটিনাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন স্থানীয় প্রশাসন। প্রশাসনের রক্তচক্ষুর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়েন বুনিয়ল শহরের মানুষজন। টমেটোকে কবর দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন তাঁরা। ১৯৫৭ সালে লা টোমাটিনার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। লা টোমাটিনাকে আন্তর্জাতিক উৎসবের স্বীকৃতি দেয় প্রশাসন। প্রবল উৎসাহ নিয়ে ফের শুরু হয়ে যায় লা টোমাটিনা। ১৯৮৩ সালে টিভি সম্প্রচারে দেখানো হয় লা টোমাটিনা। তাতে আরেক বিপত্তি শুরু হয়ে যায়। হুহু করে বাড়তে থাকে লা টোমাটিনার জনপ্রিয়তা। স্পেনের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও সাড়া ফেলে দেয় লা টোমাটিনা। বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ লা টোমাটিনায় যোগ দিতে হাজির হন ছোট্ট শহর বুনিয়লে। ফের চিন্তার ভাঁজ পড়ে প্রশাসনের কপালে। এতো মানুষকে সামলাবেন কি করে তাঁরা? অবশেষে ২০১২ সাল থেকে টিকিটের বন্দোবস্ত করা হয়। ঠিক ২২,০০০ টিকিট বণ্টন করা হয় প্রতি বছর। টিকিট প্রাপকরাই কেবল যোগ দিতে পারবেন লা টোমাটিনা উৎসবে। বাকিরা নন। এই নিয়মের জেরে এখন তো বহুদিন আগে থেকেই তৈরি হয়ে যায় লা টোমাটিনা টিকিটের চাহিদা।

লা টোমাটিনা, বুনিয়ল, স্পেন।

লা টোমাটিনার সাফল্য দেখে পৃথিবীর নানান দেশে শুরু হয় টমেটো ছোড়ার উৎসব। চিন, আমেরিকা, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা প্রভৃতি দেশেও চালু হয়েছে লা টোমাটিনা ধাঁচের টমেটো ছোড়ার উৎসব। তবে কিছু লোক এই টমেটোম্যানিয়াকে সমর্থন করেন না একেবারেই। শুধুমাত্র স্ফূর্তির কারণে এই বিপুল পরিমাণ টমেটো অপচয়কে ঘিরে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। কত টমেটো ব্যবহৃত হয় লা টোমাটিনায়? ২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই বছর ১৪৫ টন টমেটো ব্যবহার করা হয়েছিল বুনিয়লের লা টোমাটিনা উৎসবে। এরপরও আছে অন্যান্য দেশের টমেটো ছোড়ার উৎসব। সব মিলিয়ে বিরাট পরিমাণ টমেটোর জোগান লাগে এই টমেটো ছোড়ার উৎসবের জন্য। তা লাগে লাগুক, টমেটো তো আর ‘কম পড়িতেছে’ না পৃথিবীতে। বর্তমান পৃথিবীতে সর্বাধিক উৎপাদিত উদ্ভিদজাত পণ্যর মধ্যে অন্যতম হলো টমেটো। চাল, গম, ভুট্টা, আলু, সয়াবিনের পরই টমেটোর স্থান। টমেটোকে সবজি হিসেবে বিবেচনা করলে আলু আর সয়াবিনের পরই টমেটোর স্থান। আর টমেটোকে যদি ফল হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে তো কলা, আপেল, আম, আঙুর, কমলালেবু ইত্যাদি জনপ্রিয়তম ফলকে বহু পিছনে ফেলে উৎপাদনের নিরিখে কবে থেকেই শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে টমেটো। কিন্তু মহামান্য ইউএস সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে ‘ফল’-এর সেই তকমা যে খোয়া গেছে টমেটোর। টমেটো বুঝি তাই অন্যান্য ফলকে বক্র হেসে বলে চলেছে, ‘নেই তাই আছো, থাকলে কোথায় যেতে?’

পাদটীকা

[১] ১৪৯৮ সালে ভারতে আসেন ভাস্কো ডা গামা। সেই সূত্রেই, পনের শতাব্দীর শুরুর দিকেই, পর্তুগীজদের হাত ধরে ভারতেও টমেটোর আগমন ঘটে। তবে পশ্চিম ভারতে নয়, পর্তুগীজরা প্রথম টমেটো নিয়ে আসেন পূর্ব ভারতের চট্টগ্রামে। অর্থাৎ ইউরোপে টমেটো আগমনের প্রায় সমসময়ে ভারতেও আবির্ভাব ঘটেছিল টমেটোর। তবে এটা ঠিক, টমেটো চাষের ব্যাপারে সেই সময়ে কোনও আগ্রহই দেখাননি ভারতীয় কৃষক সম্প্রদায়। প্রকৃতপক্ষে, ইংরেজরা আসার পরই বাংলায় টমেটো চাষের পুনর্প্রবর্তন হয়। বাঙালিদের কাছে টমেটো তখন ‘বিলাতি বেগুন’ নামে পরিচিত ছিল।   

[২] ৫০-৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্য, প্রায় ২০ বছর ধরে ভেষজ বিজ্ঞানের উপর একটা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন গ্রিক চিকিৎসক ও ভেষজবিদ পিডানিয়স ডিসকরডিস (Pedanius Dioscorides আনুঃ ৪০-৯০ খ্রিস্টাব্দ)। ৫ খণ্ডে লেখা তাঁর ‘ডি মেটিরিয়া মেডিকা’ গ্রন্থে প্রায় ৬০০ গাছের নাম ও তাদের গুণাগুণ লিপিবদ্ধ করেন ডিসকরডিস। এই বইটা পরে আরবি ও ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়।     

[৩] ম্যানড্রেক ও টমেটো গাছ একই পরিবার (Family) ভুক্ত উদ্ভিদ। এই পরিবারের বিজ্ঞানসম্মত নাম সোলানেসিয়ে (Solanaceae)। চলতি ভাষায় এদের নাইটসেড ফ্যামিলিও (Nightshade family) বলা হয়। এই পরিবারের কয়েকটা প্রজাতির গাছ ছায়াঘন অঞ্চলে বেশি জন্মায় আর রাতে ফুল ফোটে বলে ‘নাইটসেড’ নামকরণ করা হয়েছে বলেই মনে করেন অনেকে। সোলানেসিয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হলো- আলু, বেগুন, ক্যাপসিকাম, বেলেডোনা, তামাক, ধুতুরা, পিটুনিয়া ইত্যাদি। এই পরিবারের কয়েকটা প্রজাতির গাছ বিষাক্ত বলেই পরিচিত। যেমন- ম্যানড্রেক, বেলেডোনা, ধুতুরা ইত্যাদি। তবে পরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করে এই সমস্ত বিষাক্ত গাছ থেকে ওষুধও প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।  

[৪] মহাকাশে প্রথম টমেটো বীজ নিয়ে যাওয়া হয় ১৯৮৪ সালে। তখনও ইন্টারনেশ্যানাল স্পেস স্টেশন পাঠানো হয়নি পৃথিবীর কক্ষপথে। একটা কৃত্রিম উপগ্রহের ভিতরে সাড়ে ১২ কোটি টমেটো বীজ রেখে দেওয়া হয়েছিল সেইবার। ৬ বছর পর সেই বীজ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেই বীজ থেকেই ফলানো হয়েছিল টমেটো। সেটাই ছিল টমেটোস্ফিয়ারের প্রথম উদ্যোগ। তবে প্রথম সেই মিশনের কোনও নাম দেওয়া হয়নি কখনই।  

[৫] এটা এক পক্ষের মতামত মাত্র, কোনও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নয়।

[৬] ১৫ জুলাই ২০১১, ভারতের সিনেমা হলে মুক্তি পায় হিন্দি ফিল্ম ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’। এই সিনেমার ‘পেইন্ট ইট রেড’ গানটা স্পেনের লা টোমাটিনার উৎসবের উপর দৃশ্যায়িত হয়েছিল। গানটা স্যুটিঙের সময়ে লা টোমাটিনা উৎসব না থাকায়, বুনিয়ল শহরে পুনরায় ছোটো আকারে লা টোমাটিনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই সিনেমার প্রভাবে, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে বেঙ্গালুরু শহরে লা টোমাটিনা অনুকরণে টমেটো ছোড়ার উৎসব পালনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ৬২,০০০ কেজি টমেটো নিয়ে প্রায় ৫০০০ মানুষ যোগদানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু কর্ণাটক সরকার সেই অনুষ্ঠানের অনুমতি না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয় সেই অনুষ্ঠান। ২০১১ সালেই মহিশূর ও দিল্লিতেও একই রকম ভাবে লা টোমাটিনার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠান দু’টোরও অনুমতি দেওয়া হয়নি। ২০১৩ সালে পাটনায় এবং ২০১৪ সালে ভদোদরায় ব্যক্তিগত চৌহদ্দির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় লা টোমাটিনা। ২০১৮ সালে হোলির দিন লা টোমাটিনা পালন করে বিশাখাপত্তনামের মানুষ।        

গ্রন্থপঞ্জী

1. The Tomato in America: Early History, Culture, and Cookery, by Andrew F. Smith, University of South Carolina Press, 1994.

2. Nix v. Hedden (1893), United States Supreme Court.

3. History of Tomato (Poor Man’s Apple), by Ravi Mehta, IOSR Journal of Humanities And Social Science, 2017.

4. Nutritional attributes of tomatoes, by L. J. Hedges and Carolyn Lister, New Zealand, Jan 2005.

5. Various online sites on Tomato, Tomatosphere, La Tomatino, Tomato dish etc. 

মন্তব্য তালিকা - “টমেটো ৫০০ নট আউট”

  1. তথ্যবহুল অথচ দারুণ ইন্টারেস্টিং লেখা। আলু আর চিনির ইতিহাস লেখার অনুরোধ রইল। প্রথমটা তো কলাম্বিয়ান এক্সচেঞ্জের ফসল, যা বাকি বিশ্বের খাদ‍্যাভ‍্যাস পাল্টে দিয়েছিল। আর আখ ওল্ড ওয়ার্ল্ড থেকে আমেরিকায় গিয়ে ইউরোপের জন্য চিনি তৈরি করতে ওখানকার জীবন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। “আখের স্বাদ নোনতা”।

  2. লেখা অসাধারণ হয়েছে। আমি কিছু তথ্য যোগ করছি…

    টমেটোর বুনো পূর্বপুরুষ পশ্চিম দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয়।[1] এই বন্য সংস্করণগুলি মটরশুঁটির আকারের ছিল।[1] স্প্যানিশরা প্রথমে ইউরোপে টমেটো প্রবর্তন করে, যেখানে এগুলো স্প্যানিশ এবং ইতালিয়ান খাবারে ব্যবহৃত হয়। ফ্রান্স এবং উত্তর ইউরোপে টমেটো প্রথমে শোভাময় উদ্ভিদ (অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট) হিসাবে জন্মানো হয়েছিল। এটি খাদ্য হিসাবে সন্দেহের সাথে বিবেচিত হয়েছিল কারণ উদ্ভিদবিদরা এটিকে নাইটশেড হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন, যা বিষাক্ত অ্যাট্রোপা বেলাডোনা (Atropa belladonna) এর আত্মীয়।[2] এর পাতা এবং অপরিপক্ক ফলের মধ্যে টমেটাইন থাকে, যা প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত হতে পারে। তবে পাকা ফলটিতে টমেটাইন নেই।[3]

    মেসোআমেরিকাতে অ্যাজটেক এবং অন্যান্য লোকেরা এই ফলটি প্রথম চাষযোগ্য করেছিল, এবং তাদের রান্নায় ব্যবহার করেছিল। চাষযোগ্যকরণের সঠিক তারিখ অজানা; ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এটি দক্ষিণ মেক্সিকো এবং সম্ভবত অন্যান্য অঞ্চলে ইতিমধ্যে চাষ করা হচ্ছিল।[4] ধারণা করা হয় পুয়েব্লো জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করত যে, যারা টমেটোর বীজ খেতো তারা ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা লাভ করত।[5] বড়, পিণ্ডময় জাতের টমেটো এর মিউটেশন হয় একটি তুলনামূলকভাবে মসৃণ, ক্ষুদ্রতর ফল থেকে যা মেসোআমেরিয়াকায় উদ্ভূত হয়েছিল, এবং এটি আধুনিক চাষকৃত টমেটোর প্রত্যক্ষ পূর্বপুরুষ হয়ে থাকতে পারে।[4]

    স্পেনীয় কনকুয়েস্তেদর হার্নান কর্টেজ সম্ভবত ১৫২১ সালে অ্যাজটেক নগর তোনোচতিৎলান (বর্তমান মেক্সিকো সিটি) দখল করার পর প্রথম ছোট হলুদ টমেটো ইউরোপে পাঠান, যদিও ক্রিস্টোফার কলম্বাস সম্ভবত ১৪৯৩ এর প্রথম দিকেই টমেটোকে ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইউরোপীয় সাহিত্যে টমেটোর সর্বপ্রথম আলোচনা দেখা যায় ১৫৪৪ সালে ইতালীয় চিকিত্সক এবং উদ্ভিদবিদ পিয়েত্রো আন্দ্রেয়া মাত্তিওলি এর লেখায়, যিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পরিপক্ক অবস্থায় রক্ত-লাল বা সোনালি বর্ণের একটি নতুন ধরণের বেগুন ইতালিতে আনা হয়েছে, এগুলোকে বেগুনের মত অংশে অংশে বিভক্ত করে খাওয়া যেতে পারে, অর্থাৎ নূন, কালো লঙ্কা (ব্ল্যাক পিপার) ও তেল দিয়ে রান্না করা যেতে পারে। দশ বছর পরে মাত্তিওলি ছাপা অক্ষরে টমেটোর নামকরণ করলেন পমি ডি’ওরো (pomi d’oro) বা “সোনালী আপেল”।[4]

    পরে আমেরিকায় স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনের পর, স্পেনীয়রা ক্যারিবীয় অঞ্চলে তাদের উপনিবেশগুলোতে টমেটো বিতরণ করে। তারা এটিকে ফিলিপাইনে নিয়ে যায়, সেখান থেকে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং তারপরে পুরো এশীয় মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনীয়রা ইউরোপেও টমেটো নিয়ে এসেছিল। এটি ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুতে সহজেই জন্মাতো এবং ১৫৪০ এর দশক থেকে এর চাষ শুরু হয়েছিল। উৎপাদিত হবার কিছু সময়ের মধ্যেই এটি খাওয়া শুরু হয়, এওং ১৭শ শতকের প্রথম দিক থেকে স্পেনে নিশ্চিতভাবেই এটি খাওয়া শুরু হয়ে যায়।

    পরে ইতালী ও চীনে টমেটোর ব্যাপক ফলন শুরু হয়, সেই ইতিহাসে যাচ্ছি না, সরাসরি ব্রিটেনে চলে যাই… ১৫৯০ এর দশক পর্যন্ত টমেটো ইংল্যান্ডে জন্মেনি।[4] ইংল্যান্ডে টমেটো চাষের সর্বপ্রথম কৃষকদের একজন ছিলেন নাপিত শল্যচিকিৎসক জন জেরার্ড (সে সময় ইংল্যান্ডে ডাক্তাররা খুব একটা শল্যচিকিৎসা করতেন না, এই কাজটা নাপিতদের দ্বারাই করা হত)।[4] জেরার্ডের হারবাল নামক গ্রন্থটি ১৫৯৭ সালে প্রকাশিত হয়, যেখানে ইউরোপের মহাদেশীয় অঞ্চলের উৎস্যগুলো থেকে ব্যাপকভাবে তথ্য চুরি করা হয়েছিল।[4] বইটি ছিল ইংল্যান্ডে টমেটোর আলোচনা হওয়া প্রথম গ্রন্থগুলোর একটি।[4] জেরার্ড জানতেন টমেটো স্পেন ও ইতালিতে খাওয়া হত। তবুও, তিনি মনে করতেন এটি বিষাক্ত (আসলে এই উদ্ভিদ এবং এর কাঁচা ফলে কম মাত্রায় টমেটাইন থাকে, কিন্তু তা বিপজ্জনক নয়। ব্রিটেনে জেরার্ডের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবশালী ছিল এবং ব্রিটেন ও এর উত্তর আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে অনেক বছর ধরে একে খাবারের অযোগ্য মনে করা হত (যদিও এটি আবশ্যিকভাবে বিষাক্ত নয়)।[4]

    যাইহোক, ১৮শ শতকের মধ্যভাগে ব্রিটেনে টমেটোকে সর্বতোভাবে খাওয়া হত, সেই শতক শেষের আগেই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে বিবৃত হয় যে, টমেটো স্যুপ, ব্রোথ ও গারনিশ হিসেবে দৈনন্দিন ব্যবহার্য খাদ্য। এগুলি গড়পড়তা ব্যক্তির খাদ্যাভাসের অংশ ছিল না এবং ১৮২০ সালের মধ্যে তাদেরকে “সমস্ত উদ্ভিজ্জ বাজারে প্রচুর পরিমাণে থাকা” এবং “সেরা রন্ধক দ্বারা ব্যবহৃত” হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল। রান্নায় টমেটোর ব্যাবহার সেসময় বহিরাগত ইতালীয় বা ইহুদি রন্ধনপ্রণালী হিসেবে পরিচিত ছিল। উত্তর আমেরিকায় টমেটোর বিস্তারেরও ইতিহাস আছে, সেখানে যাচ্ছি না।[6]

    ১৬শ শতকে পর্তুগীজ আবিষ্কারকগণ ভারতে টমেটো নিয়ে আসে।[7] ১৮শ শতকে ইংরেজদের জন্য এটির চাষ হয়। আজও বাংলায় এটি “বিলাইতি বেগুণ” নামে পরিচিত। এরপর ভারতবর্ষে বিস্তৃতভাবে এটি খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়, কারণ এটি ভারতবর্ষের জলবায়ুর সাথে সাথে খুব মানিয়ে নিয়েছিল,[7] উত্তরাখণ্ড ছিল এর প্রধান উৎপাদন অঞ্চলের মধ্যে একটি।

    (ভবিষ্যতে চীন, ইতালী ও উত্তর আমেরিকায় টমেটোর ইতিহাস সহ আলাদাভাবে পোস্ট করার ইচ্ছা রইল)

    তথ্যসূত্র:
    1. Estabrook, Barry (22 July 2015). “Why Is This Wild, Pea-Sized Tomato So Important?”. Smithsonian Journeys Quarterly. Retrieved 13 January 2020.
    2. “Tomato”. Encyclopaedia Britannica. 4 January 2018. Retrieved 15 January 2018.
    3. Mcgee, H. (29 July 2009). “Accused, Yes, but Probably Not a Killer”. The New York Times. Retrieved 26 March 2010.
    4. Smith, A. F. (1994). The Tomato in America: Early History, Culture, and Cookery. Columbia SC, US: University of South Carolina Press. ISBN 978-1-57003-000-0.
    5. Donnelly, L. (26 October 2008). “Killer Tomatoes”. The East Hampton Star. Archived from the original on 29 May 2009.
    6. ‘LOVE-APPLE, or TOMATO BERRY.-Love apples are now to be seen in great abundance at all our vegetable markets.’ The Times (London, England), 22 September 1820, p.3
    7. Mehta R. (2017), “History of Tomato (Poor Man’s Apple)”, IOSR Journal Of Humanities And Social Science (IOSR-JHSS), Volume 22, Issue 8, Ver. III (August. 2017) PP 31-34

  3. লেখাটা পড়া ও সেই প্রসঙ্গে মতামত ব‍্যক্ত করার জন‍্য পাঠককুলের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।
    আলু আর চিনি নিয়ে লেখার অনুরোধ রেখেছেন সুমিতা দাশ। আলু, চিনি ও অন‍্যান‍্য কলম্বিয় বিনিময় নিয়ে বেশ কিছু আকর্ষণীয় তথ‍্য বই কি। কিছু তথ‍্য আমার নজরেও পড়েছে। তবে তা সম্পূর্ণ নিবন্ধ রচনার উপযুক্ত নয়। সময় পেলে আরও তথ‍্য সংগ্ৰহে ব্রতী হবো। আপনার অনুরোধ রক্ষা করতে পারলে খুশি হবো।
    সুমিত রায়ের প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ার মতো। আপনার তথ‍্যর জন‍্য ধন‍্যবাদ। আপনার উল্লিখিত কিছু তথ‍্য নিবন্ধে যুক্ত করাই আছে। কিছু তথ‍্য নিবন্ধে স্থান পায় নি। এ প্রসঙ্গে জানাই, টমেটোর ইতিহাস থেকে কেবলমাত্র ‘প্রথম’ অংশটাই নির্বাচন করেছি আমি। অর্থাৎ, টমেটো কবে, কোথায় ‘প্রথম’ এসেছে, কিভাবে এসেছে- এই ছিল আমার নিবন্ধের মূল অক্ষ। সেই হিসেবে, স্পেনের পর ইংলন্ড, ইউএসএ, চিন এমনকি ভারতকেও রচনার অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয় নি। ভারতীয় হিসেবে আবার, ভারতের টমেটো সংক্রান্ত ‘প্রথম’ তথ‍্যকে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে, তাকে পাদটীকায় অন্তর্ভুক্ত করেছি। সেখানে ‘বিলাতি বেগুন’ রয়েছে। একই কারণে, ভারতের ‘লা টোমাটিনা’কেও পাদটীকায় স্থান দিয়েছি।
    আন্তরিক ধন‍্যবাদ।

  4. দারুন ইন্টারেস্টিং ও তথ্যবহুল লেখা।
    লেখকের লেখার হাত যে পাকা তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।