সোয়ান্টে পেবো আবিষ্কার করেছেন আমাদের সবার পরিবারের কাহিনি
বছর কয়েক আগে যখন অধ্যাপক সোয়ান্টে পেবোর অবশ্যপাঠ্য ‘আত্মজীবনী’ পড়ার সুযোগ আসে তখন দু’টি জিনিস মনে দাগ কেটেছিল। এক, গবেষণার ফলাফলকে নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে তাঁর নির্মোহ, প্রায়-ম্যানিয়াগ্রস্ত খুঁতখুঁতুনি। দুই, ল্যাবরেটরির প্রতিটি সাফল্যে নিজের ছাত্রছাত্রীদের মেধা ও পরিশ্রমের বিস্তারিত বর্ণনা। সেই জন্যে কয়েকদিন আগে নোবেল কমিটির “সোয়ান্টে পেবো অসাধ্যসাধন করেছেন….জন্ম দিয়েছেন একটি বিজ্ঞানের একটি নতুন বিষয় – প্যালিওজিনোমিক্স… ওঁর অনন্য আবিষ্কারগুলি থেকেই আজ আমরা জানতে পারছি কেমন করে বিবর্তনের পথে হেঁটে কীভাবে আমরা সবাই ‘মানুষ’ হয়ে উঠলাম” ঘোষণা শুনে যখন আরেকজন বিজ্ঞানী বললেন, “পেবোকে তো চিনি। উনি প্রথমেই বলবেন, না না আমি এসব করিনি। আমার টিম, আমার ছাত্ররা সবাই মিলে করেছি,” তখন সহমত না হয়ে পারলাম না। আপন যশের জন্যে অতি উৎসাহী এ দুনিয়ায় পেবোর মত অধিনায়কও বিরল; এবং সেটাই হয়ত এই ‘অসাধ্যসাধনে’র বড় চাবিকাঠি।
অবশ্য, পেবোর আবিষ্কারের কথায় আসার আগে কিছুটা ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ দেওয়া প্রয়োজন। স্কুলের পাঠ্যবই থেকে আমরা সবাই ‘জাভা ম্যান’, ‘হোমো ইরেক্টাস’, ‘পিকিং ম্যান’, ‘অস্ট্রেলোপিথেকাস’, ‘নিয়ান্ডারথাল’ (বৈজ্ঞানিক নাম ‘হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস’) নামগুলির সঙ্গে পরিচিত। এরা সবই ‘আদিম মানুষ প্রজাতি’; আমার আপনার মত আধুনিক মানুষের (বৈজ্ঞানিক নাম ‘হোমো সেপিয়েন্স’) বহু আগে এদের জন্ম, কয়েক লক্ষ বছর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করার পরে এরা সবাই এখন বিলুপ্ত। ৮-১০ লক্ষ বছর আগে ‘হোমো’ বংশের অন্তত ৫-৬টি প্রজাতি বিচরণ করত এই ধরাধামে, এখন আছে কেবল একটি প্রজাতি – আমরা, হোমো সেপিয়েন্স। তাই, সেই ডারউইন-ওয়ালেসের আমল থেকে নৃতত্ববিদরা জানতে চেয়েছেন – কেমন করে আমরা সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়লাম আর ‘আদিম’রা হারিয়ে গেল? সত্যিই কি চিরতরে হারিয়ে গেল? নাকি…?
এ বিষয়ে বেশ কয়েক দশক ধরে মনে করা হত যে ‘হোমো ইরেক্টাস’ হল প্রথম আদিম প্রজাতি যারা ~১৮ লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে গোটা ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে (পিকিং ম্যান, জাভা ম্যান ইত্যাদি সবই এদের ফসিল)। ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিবর্তিত হতে থাকা এই ‘হোমো ইরেক্টাস’দের থেকেই নাকি কালক্রমে আমাদের সবার জন্ম।
কিন্তু, ৮০র দশকের গোড়ায় প্রচলিত নৃতত্ত্ববিদ্যার সঙ্গে মলিকিউলার বায়োলজির মেলবন্ধন করিয়ে এই ধারণা আমূল বদলে দেন পেবোর ‘বস’ অ্যালান উইলসন। আমাদের প্রত্যেকের দেহকোষে মাইটোকন্ড্রিয়া নামের অঙ্গাণু আছে যাদের মুল কাজ খাদ্য থেকে শক্তি তৈরি করা। তবে বেশিরভাগ ডিএনএ কোষের প্রাণকেন্দ্র নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকলেও সব মাইটোকন্ড্রিয়ার মধ্যেও আছে একটি ছোট্ট ডিএনএ অনু। মানুষ সহ প্রত্যেক প্রাণীর ক্ষেত্রে এইসব ডিএনএ (এবং তার মধ্যে অবস্থিত জিনসমষ্টি) পূর্বপুরুষ থেকে বংশধর তস্য বংশধরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
উইলসন প্রমাণ করলেন যে বিভিন্ন মহাদেশের বাসিন্দা হলেও সব মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ-র মধ্যে রয়েছে আশ্চর্য সাদৃশ্য। এত মিল হবার একটাই কারণ – ‘হোমো ইরেক্টাস’ নয়, আমাদের সবার আদি পূর্বপুরুষ ছিলেন আনুমানিক ১ লক্ষ ৬০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার বাসিন্দা এক ‘হোমো সেপিয়েন্স’ নারী। কালের স্রোতে তাঁর বংশধররা, আমরা ছড়িয়ে পড়েছি এ গ্রহের সকল প্রান্তে। অধ্যাপক পেবোর কথায় – “আমরা অনেকে এখনও আফ্রিকা নিবাসী, বাকিরা কয়েক পুরুষ আগে অন্য মহাদেশে ঘর বেঁধেছি।” কিন্তু, আফ্রিকা আমাদের সবার উৎপত্তিস্থল; এই অর্থে আমরা সবাই আফ্রিকান। সত্যি, আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
আশির দশকের মাঝামাঝি পেবো যখন উইলসনের টিম থেকে বেরিয়ে নিজে অধ্যাপক হয়েছেন ততদিনে তিনি মিশরীয় মমি এবং তাসমানিয়ান বাঘের আর কোয়াগ্গা জেব্রার মত একাধিক বিলুপ্ত প্রাণীর কোষ থেকে ডিএনএ বের করতে ওস্তাদ। তবে তাঁর বিশেষ উৎসাহ আধুনিক মানুষের নিকট আত্মীয় ‘নিয়ান্ডারথাল’দের নিয়ে ডিএনএ-ভিত্তিক গবেষণায়। ৪ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু করে গোটা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং সুদূর সাইবেরিয়া অবধি ছিল এই ‘হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস’দের বসবাস। গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, মস্তিষ্কের আয়তন আমাদের থেকেও বড়(!), শিকারে দক্ষ ‘নিয়ান্ডারথাল’দের সমাজে আচার বিচার, প্রাগৈতিহাসিক ভাষা, অসুস্থ আত্মীয়দের সেবাযত্ন এবং সংগীতেরও স্থান ছিল! ৬৫-৭০ হাজার বছর আগে ‘হোমো সেপিয়েন্স’-এর একাধিক দল আফ্রিকার বাস্তুভিটে ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে একদিকে ছড়িয়ে পড়ে ভারতীয় উপমহাদেশ, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায়, অন্যরা চলে ইউরোপের পথে। স্বাভাবিক ভাবেই এদের সঙ্গে দেখা হয় ‘নিয়ান্ডারথাল’দের। তারপর রহস্য! আজ থেকে ৩০-৩৫ হাজার বছর আগে চিরকালের মত হারিয়ে যায় ‘নিয়ান্ডারথাল’রা। প্রশ্ন উঠবেই – কেন হারিয়ে গেল? সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হল? না লোকচক্ষুর আড়ালে তাদের কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেল?
চিত্র ১ : ‘নিয়ান্ডারথাল’ খুলি আর অধ্যাপক সোয়ান্টে পেবো কি একে অপরকে দেখে হাসছেন? ২০১০ সালে তোলা ছবিটি ‘হ্যামলেট’ নাটকের বিখ্যাত গ্রেভডিগার দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়।
‘নিয়ান্ডারথাল’দের ফসিল থেকে ডিএনএ বের করতে লেগে পড়লেন পেবো। তবে এক লক্ষ বছর আগেকার ফসিল-এর ডিএনএ পরিশোধিত করা প্রায় অসাধ্য। কারণ, সময়ের গ্রাসে ডিএনএ-র বিশালাকার অণুগুলি ভেঙে গিয়ে গবেষণার অযোগ্য হয়ে ওঠে। কল্পনা করুন, একটি আধুনিক এনসাইক্লোপিডিয়ার সব পাতাগুলি খুলে গেলে সেগুলিকে আবার একসঙ্গে বাঁধানো কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। ভাষাটি জানতে হবে, একই বই-এর অন্য কপির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাবে; সময় লাগবে, কিন্তু সম্ভব। কিন্তু, যদি বহু শতাব্দীর প্রাচীন ক্ষয়ে-যাওয়া বই হয়, যার প্রত্যেকটি পাতা ৫-১০টি টুকরোয় বিভক্ত? তাকে জোড়া লাগিয়ে পাঠযোগ্য করে তোলা প্রায় অসম্ভব, তাই না? সবচেয়ে বড় সমস্যা হল যে কোন ফসিলের হাড়ে যত না প্রাগৈতিহাসিক ডিএনএ পাওয়া যায় তার বহু গুণ বেশি পাওয়া যায় আধুনিক ডিএনএ। এই আধুনিক ডিএনএ-র সোর্স দুই প্রকার – ১) বহু সহস্র বছর মাটি চাপা পড়া অবস্থায় সেই ফসিলে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাক গজিয়েছে, ২) ফসিল আবিষ্কৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে ১০০ বছরের বেশি মিউজিয়ামে রাখার সময় বহুবার প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং মিউজিয়াম কর্মীরা সেগুলি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। এই আধুনিক ডিএনএ-র ‘ঘন কুয়াশা’ হয়ে দাঁড়াল পেবোর কাজে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তবু, বারবার ব্যর্থতা সত্ত্বেও একাধিক নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে টিম-পেবো এই অসাধ্যসাধন করেছেন, এবং একাধিকবার। এখানেই তাঁদের কৃতিত্ব, এই নতুন পথের দিশারীকে স্বীকৃতি জানিয়েছে নোবেল পুরস্কার।
চিত্র ২: ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোলিউশনারি অ্যানথ্রোপোলজিতে পেবোর গবেষণাগারে প্রাগৈতিহাসিক ডিএনএ বের করার জন্যে হাড়ে ড্রিল করা হচ্ছে।
প্রথমত, তাঁরা ৪০ হাজার বছরের প্রাচীন ‘নিয়ান্ডারথাল’দের হাড় থেকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বের করে সবাইকে চমকে দিলেন। উল্লেখ্য, এই হাড় হল ১৮৫৬ সালে জার্মানির নিয়ান্ডার উপত্যকার খনিতে আবিষ্কৃত প্রথম ‘নিয়ান্ডারথাল’ ফসিল থেকে নেওয়া। সুপ্রতিষ্ঠিত হল যে ‘হোমো’ বংশকুলে ‘নিয়ান্ডারথাল’রা সত্যিই ‘হোমো সেপিয়েন্সে’র নিকটতম আত্মীয়। আর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নয়। ক্রোয়েশিয়া, জার্মানি, স্পেন এবং রাশিয়া থেকে ‘নিয়ান্ডারথাল’ হাড়গোড় জোগাড় করে পেবো শুরু করলেন কোষের প্রাণকেন্দ্র নিউক্লিয়াস থেকে ডিএনএ উদ্ধার। ততদিনে বিখ্যাত ‘হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট’ আধুনিক মানবকোষের ২৩ জোড়া ক্রোমোসোমে অবস্থিত ডিএনএ-র পাঠোদ্ধার করে ফেলেছে। পেবোর আশা ‘নিয়ান্ডারথাল’দের ডিএনএ-র সঙ্গে আমাদের ডিএনএ পাশাপাশি ফেলে বিশ্লেষণ করবেন কোন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তফাতের ফলে ‘হোমো সেপিয়েন্স’ সারা পৃথিবীতে রাজত্ব শুরু করল আর হারিয়ে গেল ‘আপনজন’ ‘নিয়ান্ডারথাল’। এ বিষয়ে কাজ এখনও চলছে। যেমন গত মাসেই জানা গেছে ‘নিয়ান্ডারথাল’ এবং আমাদের উভয়ের ডিএনএ-তেই অবস্থিত টিকেটিএল১ (TKTL1) নামক জিনে ছোট্ট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ একটি তফাৎ (মিউটেশন) আছে, যার ফলে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সংখ্যার তারতম্য হয়ে যায়।
চিত্র ৩: মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পরিশোধিত করার জন্যে ‘নিয়ান্ডারথাল’ ফসিলের ডান হিউমারাস হাড় থেকে ছোট্ট অংশ নেওয়া হয়েছিল।
তবে ২০১০ সালে পেবোর বড় গবেষণাপত্র সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিল। কারণ প্রমাণ পাওয়া গেছে আজকের সব এশীয় এবং ইউরোপীয় মানুষের ডিএনএ-র ১-৪% ‘নিয়ান্ডারথাল’দের থেকে এসেছে! অর্থাৎ, আফ্রিকা থেকে বেরোবার পরে শুধু লড়াই নয়, ৫০ হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স আর ‘নিয়ান্ডারথাল’রা মাঝেমধ্যেই ‘আপন আমার আপন’ হয়ে উঠেছিল। তারপর ‘নিয়ান্ডারথাল’রা হারিয়ে যায় (বা মারা পড়ে?), কিন্তু আজও আমাদের প্রত্যেকের দেহে রয়ে গেছে সেই বিলুপ্ত পূর্বপুরুষের ছাপ এবং তার গুরুত্ব শুধু নৃতত্বে সীমাবদ্ধ নয়। যেমন অতিমারীকালে জানা গেছে অন্তত ৫০% ভারতীয়ের শরীরে আছে ‘নিয়ান্ডারথাল’দের থেকে প্রাপ্ত কিছু জিন যা করোনা সংক্রমণের দাপট কিছুটা কমিয়ে রেখেছিল। ভাগ্যিস!
চিত্র ৪: নিউক্লিয়ার ডিএনএ বিশ্লেষণের করার জন্যে ব্যবহৃত ‘নিয়ান্ডারথাল’ হাড়। যেসব গুহায় হাড়গুলি পাওয়া গিয়েছিল ডানদিকের মানচিত্রে তা চিহ্নিত করা আছে।
এতেই শেষ হলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু, ততদিনে দক্ষিণ সাইবেরিয়া থেকে প্রাপ্ত একটি বাচ্চা মেয়ের হাড় থেকে ডিএনএ বের করেছেন টিম-পেবো। বয়স ৪০ হাজার বছর। সবাইকে চমকে দিয়ে জানা গেল এ ‘হোমো সেপিয়েন্স’ নয়, ‘নিয়ান্ডারথাল’ও নয়, ‘হোমো ইরেক্টাস’ও নয়! এ ছিল এক সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির মানুষ, যারাও চিরতরে হারিয়ে গেছে। নামকরণ হল ‘ডেনিসোভান্স’। আর সবচেয়ে আশ্চর্য, পাপুয়া নিউ গিনি, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং পলিনেশীয় লোকজনের শরীরে রয়েছে অন্তত ৫% ‘ডেনিসোভান্স’ ডিএনএ! নিয়ানডার্থাল ১-৪% আর ডেনিসোভান্স ৫%! অর্থাৎ, আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসার পরে যতবার অন্য প্রজাতির সঙ্গে দেখা হয়েছে ততবার মিলিত হয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। জমি আর শিকার নিয়ে মারমার কাটকাট যেমন হয়েছে তেমন মাঝেমধ্যে সংসার পাতাও হয়েছে। আর আজ, ৫০-৬০ হাজার বছর পরেও, আমরা প্রত্যেকে সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের ধারকবাহক। বিজ্ঞানের নতুন বিষয় প্যালিওজিনোমিক্স-এর প্রবর্তক সোয়ান্টে পেবোর আবিষ্কার নিজেদের সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় করাচ্ছে।
চিত্র ৫: ‘হোমো সেপিয়েন্স’, ‘নিয়ান্ডারথাল’ এবং ‘ডেনিসোভান্স’দের মধ্যে জেনেটিক সম্পর্ক বোঝাচ্ছে এই ফাইলোজেনেটিক ট্রি (Phylogenetic tree)। পেবোর আবিষ্কৃত জিন ফ্লো (gene flow) দেখানো হয়েছে। অবলুপ্ত দুই প্রজাতি এক সময় ‘হোমো সেপিয়েন্স’দের সঙ্গে সন্তানের জন্ম দেয়, এবং তার ফলে আজও ‘হোমো সেপিয়েন্স’দের মধ্যে রয়ে গেছে অল্প কিছু ‘নিয়ান্ডারথাল’ এবং ‘ডেনিসোভান্স’ পূর্বপুরুষ থেকে প্রাপ্ত জিন সমষ্টি।
শুধু নৃতত্ত্ব এবং জীবনবিজ্ঞান নয়, পেবোর প্রদর্শিত পথ খুলে দিয়েছে ইতিহাস গবেষণার নতুন দিগন্ত। পোল্যান্ডে আবিষ্কৃত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস-এর কঙ্কাল; পেরুর বিজ্ঞানীরা ইনকা সম্রাটদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেছেন, পাঞ্জাবে উদ্ধার হয়েছে ১৮৫৭-র বিদ্রোহী সিপাহীদের দেহাবশেষ। গত ১৫-২০ হাজার বছরে মানব গোষ্ঠীরা কোথায় কখন ছড়িয়ে পড়েছিল তা আজ অনেকাংশে বোঝা সম্ভব হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া ম্যামথ হাতি এবং ঘোড়ার বিবর্তন নিয়ে দুর্দান্ত গবেষণা সম্ভব হয়েছে। তবে ভারতবাসীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেবোর জুনিয়র সহকর্মী হার্ভার্ডের ডেভিড রেইখের আবিষ্কার।
২০১৯-এ দুটি বিশ্ববন্দিত গবেষণাপত্রে রেইখের নেতৃত্বে ১১৭ জন বিজ্ঞানী-দল ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ভারতীয় উপমহাদেশ এমনকি সিন্ধু সভ্যতার শহর থেকে ৫২৪টি প্রাচীন কঙ্কালের ডিএনএ বের করে আধুনিক ভারতবাসীর ডিএনএ-র সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। তাঁদের (এবং অনান্যদের) গবেষণা সুস্পষ্ট দেখাচ্ছে: – –
১) ৬৫ হাজার বছর আগে বেশ কিছু শিকারি-সংগ্রহকারী আফ্রিকা ছেড়ে পূর্ব দিকে যাত্রা করেন। এক দল পৌঁছান ভারতে, আরেক গোষ্ঠী নিকটবর্তী ইরানে বসবাস শুরু করেন।
২) কালক্রমে এই দুই প্রাচীনতম গোষ্ঠীর মিলন হল আমার, আপনার, এই উপমহাদেশের সবার প্রাথমিক এবং মূল উৎস। কয়েক হাজার বছর পরে এঁরাই গড়ে তোলেন সিন্ধু নদের তীরে মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সভ্যতার।
৩) ২০০০-১৫০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ আসে আরেক ‘নতুন’ ডিএনএ। কারণ, সিন্ধু সভ্যতা যখন নিভুনিভু, তখন দক্ষিণ রাশিয়ার স্টেপস সমতল ভূমি থেকে বেরিয়ে আরেক ‘বহিরাগত’ অশ্বারূঢ় পশুপালক জনগোষ্ঠী একদিকে ইউরোপে অন্যদিকে এই উপমহাদেশে প্রবেশ করে।
৪) ম্রিয়মাণ সিন্ধু সভ্যতার একদল বাসিন্দাদের সঙ্গে স্টেপসবাসীদের সম্পর্ক স্থাপনের ফলে জন্ম হয় যে গোষ্ঠীর, তাঁরা আজকের উত্তর ভারতীয়দের পূর্বপুরুষ।
৫) আরেকদল হরপ্পাবাসী পৌঁছে যান দক্ষিণ ভারতে। সেখানকার নিবাসী প্রাচীনতম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁদের মিশ্রণে জন্ম হয় দক্ষিণ ভারতের আদি জনজাতির।
৬) তারপর, গত ৩৫০০ বছরে হরপ্পাবাসীর ডিএনএ, স্টেপসবাসীর ডিএনএ, প্রাচীনতম আদিবাসীর ডিএনএ (এবং বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার মানুষের ডিএনএ) নানা স্রোতে এসে মিলেছে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে এবং থাকবে। কিন্তু, এই হল ভারতে মানব প্রজাতির আগমন এবং বিস্তারের মূল কাহিনি।
চিত্র ৬: ব্রোঞ্জ যুগে স্টেপস পশুপালকদের ইউরেশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার কালক্রম
উল্লেখ্য, ২৪০ বছর আগে সেই উইলিয়ম জোন্স-এর আমল থেকে ভাষাবিদরা সংস্কৃত-বাংলা-গুজরাটি-মারাঠি-ফার্সির সঙ্গে ইংরেজি-ল্যাটিন-রুশ-লিথুনিয়ান-স্লোভাক বহু ভাষার সাদৃশ্য পেয়েছেন। এতদিনে তার জৈবিক কারণ বোঝা গেল। বংশবিস্তারের সাথেসাথে ছড়িয়ে পড়েছিল সংস্কৃতির মূল আধার – ভাষা। আর প্রত্নতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং আধুনিক জিনবিদ্যার এমন যুগান্তকারী সমন্বয় দেখে আরেক সত্যদ্রষ্টা নোবেলবিজয়ী হয়ত মুচকি হেসে বলতেন ‘আমি তো বাপু তাইই লিখেছিলাম – হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন….’
তথ্যসূত্র
- Press release: The Nobel Prize in Physiology or Medicine, 2022 [https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/2022/press-release/]
- Pääbo, S. ‘Neanderthal Man, In Search of Lost Genomes’; Basic Books, NY, 2014
- DNA clues to our inner Neanderthal – TED talk, 2011 [https://www.ted.com/talks/svante_paabo_dna_clues_to_our_inner_neanderthal]
- Reich, D. ‘Who We Are and How We Got Here’; Oxford Univ. Press, 2018.
- “From Neanderthal genome to Nobel prize: meet geneticist Svante Pääbo” [https://www.nature.com/articles/d41586-022-03191-9]
- “Ancient DNA pioneer Svante Pääbo wins Nobel in Physiology or Medicine.” [https://www.science.org/content/article/nobel-prize-physiology-or-medicine-2022]
- https://www.wsj.com/articles/nobel-prize-in-medicine-awarded-to-scientist-for- discoveries-in-human-evolution-11664790281
- Joseph, T. ‘Early Indians: The Story of Our Ancestors and Where We Came From’; Juggernaut Books, 2018.
- Krings, M. et al “Neanderthal DNA sequences and the origin of modern humans” in ‘Cell’, 90; 19-30, 1997 [https://www.cell.com/fulltext/S0092-8674(00)80310-4].
- Green, RE et al “A draft sequence of the Neandertal genome” in ‘Science’ 328; 2010, 710-722 [https://www.science.org/doi/10.1126/science.1188021].
- Prufer, K. et al “The complete genome sequence of a Neandertal from the Altai Mountains” in ‘Nature’ 505; 2014, 43-49 [https://www.nature.com/articles/nature12886].
- Krause, J. “The complete mitochondrial DNA genome of an unknown hominin from southern Siberia” in ‘Nature’ 464; 2010, 894-897 [https://www.nature.com/articles/nature08976].
- Meyer, M. et al “A High Coverage Genome Sequence from an Archaic Denisovan Individual” in ‘Science’ 338; 2012, 222-226 [https://www.science.org/doi/10.1126/science.1224344].
- Zeberg, H. and Paabo, S “A genomic region associated with protection against severe COVID-19 is inherited from Neandertals” in ‘Proc. Natl. Acad. Sci.’ 118; e2026309118, 2021 [https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7936282/pdf/pnas.202026309.pdf]
- “Did this gene give modern human brains their edge?” [https://www.nature.com/articles/d41586-022-02895-2].
- Narasimhan, V et al (2019) ‘The Formation of Human Populations in South and Central Asia’ in ‘Science’ 365; eaat7487 [https://www.science.org/doi/10.1126/science.aat7487].
- Shinde, V et al (2019) ‘An Ancient Harappan Genome Lacks Ancestry from Steppe Pastoralists or Iranian Farmers’ in ‘Cell’ 179; 729-735 [https://www.cell.com/cell/pdf/S0092-86741930967-5.pdf].
বেশ তথ্যপূর্ণ লেখা। ফিরে ফিরে পড়তে হয় আর বেশ কিছু মনে রাখার মত। লেখক এ এদিকে পারদর্শী।
অনেক অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ হলাম।
এই লেখকের আগের অনেক লেখার মতো এটিও সাবলীল ভাষায় লেখা অথবা অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ। অনেক কিছু জানলাম।
এই লেখকের আগের অনেক লেখার মতো এটিও সাবলীল ভাষায় লেখা অথচ অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ। অনেক কিছু জানলাম।
দুরূহ বিষয়কে সুখপাঠ্য করে তোলার বিরল ক্ষমতা
অসাধারণ তথ্যে সমৃদ্ধ হলাম।
bishoybostu r lekhoni melbondhone apurbo shristi. valo laglo anirban
When Physical Science gets united with Social Science to track some hitherto unknown trail, it meets with such a success and the same is applicable for Anirban Mitra as well.
আমি লেখকের অনেক লেখা পড়েছি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। লেখা অত্যন্ত তথ্যবহুল ও সুস্বাদু। লেখা চলুক। পাঠক ক্রমবর্ধমান হোক, তৃপ্ত হোক।
ভাল লাগল। কিন্তু মন ভরলনা।
আরেকটু বিস্তারিত আলোচনা হলে ভাল হত।
আর স্ট্যাটিসকাল analysis দরকার। জানি এই স্বল্প পরিসরে তা করা সম্ভব নয়। তাই অনেক ধন্যবাদ। নমস্কার।
লেখা’র সময় আমারই তো মনে হচ্ছিল – এটা আরেকটু বলা উচিত, এই বিষয়ে এটা বাদ দিলাম কেন। কিন্তু, এ ধরনের প্রবন্ধে তো একটা ‘লিমিট’ এবং ‘কতটা ডিটেল দেব, দেব না’ নিয়ে ভাবতেই হয়। তাই… তবে আপনার এই কথাটা ভবিষ্যতে লেখার সময় মনে রাখব।
এ ধরনের প্রবন্ধে তো একটা ‘লিমিট’ এবং ‘কতটা ডিটেল দেব, দেব না’ নিয়ে ভাবতেই হয়। তাই… তবে আপনার এই কথাটা ভবিষ্যতে লেখার সময় মনে রাখব।
লেখক হিসেবে একটা কথা বলতে পারি, আমার বন্ধু শৌভিক ভট্টাচার্য’র সঙ্গে এই বিষয়ে বেশ কিছুটা আলোচনা না হলে লেখা সম্ভব হত না)
অসাধারণ লেখা। ছোট্ট পরিসরে অত্যন্ত সুন্দর করে বোঝানো হয়েছে মূল বিষয়গুলো। শেষ করার পরেও মনে অতৃপ্তি রয়ে গেল। মনে হয় যেন আরেকটু হলে ভালো হতো।
দারুণ লেখা। অন্য লেখা গুলো কিভাবে পাওয়া যায়? whatsapp e shareকরা যায় – ৯৮৩০০৮২৫৬১.
উত্তর দিতে বিচ্ছিরি দেরি করে ফেললাম। মাফ করবেন। আপনার এই কথা থেকেই আমি একটা আইডিয়া পেয়েছি। নিজের সব প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি এক জায়গায় জড়ো করা যাক। শুরু করেছি। করলেই শেয়ার করব। কিন্তু, এই সুযোগে কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত এই লেখাটি শেয়ার করি। ভাল থাকবেন। থাঙ্কস। https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=26128