সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বিজ্ঞানীর লেখা বিজ্ঞানের কাহিনী

বিজ্ঞানীর লেখা বিজ্ঞানের কাহিনী

শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

জানুয়ারি ১৩, ২০২৪ ২৮৪ 4

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। এদেশে আধুনিক রসায়নচর্চার পথিকৃৎ। রসায়নবিদ হিসাবে যতটা তার চেয়েও বেশি ছিলেন সমাজসংস্কারক, শিল্পোদ্যোক্তা, ছাত্রবৎসল, শিক্ষাবিদ। সারা জীবনে প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন একটা অগোছালো, উদ্দেশ্যহীন, আত্মবিস্মৃত জাতিকে বলিষ্ঠ, স্বনির্ভর, আত্মসচেতন সত্তায় সংগঠিত করতে। জাতিটার নাম—বাঙালি। বিজ্ঞান বিষয়ক নানা প্রবন্ধ লিখেছেন পরম মমতায়। শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত ছোটদের পত্রিকা ‘মুকুল’-এ লিখেছেন ‘পশুর কৌতুকপ্রিয়তা’, ‘প্রকৃতি’ পত্রিকায় লিখেছেন ‘প্রাণীদিগের দংশন কাহাকে বলে?’। বালক- বালিকাদের উপযোগী করে বাংলায় সচিত্র বই লিখলেন ‘সরল প্রাণীবিজ্ঞান’। অন্যান্য বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ছড়িয়ে আছে সেকালের নানা সাময়িক পত্রে। সেই সংগ্রহ থেকে শোনাব দুটি গল্প।

প্রথম গল্প

কালাজ্বর-এর ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন ডা. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, ইউরিয়া স্টিবামিন। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় ‘কালাজ্বরে চিকিৎসা বিভ্রাট’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। এতেই আছে অ্যান্টিমনির স্টিবিয়াম থেকে অ্যান্টিমনি হয়ে ওঠার গল্প। পর্যায় সারণীতে যে একশ তিনটি মৌলিক পদার্থের নাম আছে, তার একটি অ্যান্টিমনি। রসায়নের ছাত্র-ছাত্রী মাত্রেই জানেন এই মৌলটির মধ্যে ধাতু ও অধাতু দুইয়েরই গুণ আছে, ফলে একে বলা হয় ধাতুকল্প। জল দূষণে যে আর্সেনিকের কথা আমরা শুনি—অ্যান্টিমনি তারই জাতভাই অর্থাৎ একই রকম একটি মৌলিক পদার্থ।

ডা. উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী

রোগ সারাতে পারদের যৌগ (মকরধ্বজ) বা অন্যান্য ধাতব যৌগের ব্যবহার ভারতবর্ষ বা মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামীয় দেশে প্রাচীনকাল থেকেই চালু ছিল। ইউরোপ-এ ধাতব ওষুধের প্রচলন হয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে। সম্ভবত প্রাচ্যের দেশ থেকেই এই বিদ্যা তারা অর্জন করেছিল। রোগ সারাতে অ্যান্টিমনির ব্যবহার ইউরোপ-এ প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। পাশ্চাত্য দেশে তখন অ্যান্টিমনির তৈরি সুরাপাত্র ব্যবহার হত। ঐসব পাত্রে সুরা ঢাললে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় টারটার এমেটিক (বা পটাশিয়াম অ্যান্টিমনি টার্টরেট) নামে একরকম যৌগিক পদার্থ তৈরি হত। ওই পদার্থটি ওষুধ হিসাবে নানা রোগে বেশ সুফল দিয়েছিল। ক্রমে ওষুধের জন্য এই পাত্রের এমন আদর হয় যে, গির্জার সন্ন্যাসীরা (মঙ্ক) নিজেদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য অ্যান্টিমনি ধাতুর তৈরি পাত্রে যথেচ্ছ ভাবে সুরাপান করতে লাগল। সুরাপাত্রের এই অপব্যবহারের ফলে সন্ন্যাসীদের মধ্যে নানা রোগ দেখা দিতে লাগল এবং অনেক সন্ন্যাসী মারা গেলেন। এই সুরাপাত্রের গায়ে জার্মান ভাষায় লেখা থাকত, তুমি এক আশ্চর্য পাত্র এবং তোমার সর্ব রোগহারী ক্ষমতা আছে। অ্যান্টিমনির ল্যাটিন নাম স্টিবিয়াম। সেই অনুসারে অ্যান্টিমনির রাসায়নিক সংকেত Sb, কিন্ত সাধুঘাতী বলে এর নতুন নাম হল অ্যান্টিমঙ্ক (antimonk), তারই অপ্রভংশ অ্যান্টিমনি (antimony) ঐ মৌলের নতুন সর্বজনবিদিত নাম। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই সুরাপাত্রের প্রচলন ছিল। কিন্তু ক্রমশ এর অপব্যবহারজনিত কুফল দেখে প্যারিস (ফ্রান্স) এবং হাইডেলবার্গ-এর (জার্মানি) চিকিৎসকরা আইন করে এর ব্যবহার বন্ধ করে দেন। আশ্চর্য এই যে, অ্যান্টিমনি মৌলঘটিত ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামিন বিংশ শতাব্দীতে আবার কালাজ্বরের চিকিৎসার অমোঘ ওষুধ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

দ্বিতীয় গল্প

দ্বিতীয় গল্পটি টিকাদানের। প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছিলেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দ-এ, শিরোনাম ‘লুই পাস্তুর ও এডওয়ার্ড জেনার’। এই প্রবন্ধে টিকাদানের এক অজানা তথ্য জানিয়েছেন প্রফুল্লচন্দ্র, যা সচরাচর আমাদের অজানা।

তখনকার দিনে একদল ব্রাহ্মণ ছিলেন, যাদের কাজই ছিল টিকা দেওয়া। তারা একসাথে তিন-চারজন এই কাজে বের হত এবং এমন সময়ে তারা এই কাজ শুরু করত যাতে বসন্ত রোগের সংক্রমণ আরম্ভ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই উদ্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছাতে পারে। বাংলাদেশে (অবিভক্ত বঙ্গদেশ) তারা সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই টিকা দেওয়া আরম্ভ করত। বাংলার অধিবাসীরা আগে থেকেই জানত কোন সময়ে এই টিকাদার এবং সেইজন্য এই সময়ের একমাস আগে থেকেই তারা মাছ, ঘি, দুধ ইত্যাদি খাবার খেত না। এই সমস্ত নিয়মকানুন না মানলে টিকা নেওয়া যেত না। যখন টিকাদার ব্রাহ্মণের দল বাড়ি বাড়ি টিকা দিতে আরম্ভ করত তার আগেই তারা জেনে নিত অধিবাসীরা এইসব নিয়মকানুন ঠিকমত মেনেছে কিনা। শিশুদের টিকা দেওয়ার আগে কয়টি গুটি ব্যবহার করে তাদের টিকা দেওয়া হবে এ বিষয়ে তার পিতামাতার সম্মতি নেওয়া হত। টিকা শরীরের যে কোনো অংশেই নেওয়া যেত কিন্তু টিকাদাররা পুরুষের হাতের কব্জি থেকে কনুই পর্যন্ত যে কোনো জায়গায় এবং মহিলাদের ঘাড়ের উপরিভাগে যে কোনো জায়গায় টিকা দিত। যে জায়গায় টিকা দেওয়া হবে সেখানে টিকাদার এক টুকরো শুকনো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে একটা রৌপ্যমুদ্রার মতো জায়গা জুড়ে সুচ দিয়ে সামান্য আঘাত করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর সে তার কোমরে জড়ানো একটা কাপড়ের থলি থেকে তুলোর গুটি বের করত। তুলোর গুটিতে থাকত গো-বসন্তের বীজ। এই তুলোর গুটি দু তিন ফোঁটা গঙ্গাজলে ভিজিয়ে টিকাদার অতি যত্নে বসিয়ে দিত ক্ষতস্থানে। সেই জায়গাটা তখন একটা ছোট কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হত। ব্যান্ডেজ খোলা হত ছয় ঘণ্টা পর। তুলোর গুটির মধ্যে থাকত এক বছর আগে টিকা নিয়ে বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়েছে এমন লোকের বসন্তের গুটি।

যে দিন টিকা দেওয়া হত তার পরদিন থেকে তিন চারদিন রোগীকে সকাল সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা জলে স্নান করানো হত, যতক্ষণ না তার শরীরে বসন্ত রোগের লক্ষণগুলো পরিস্ফুট হয় এবং রোগী বেশিরকম জ্বরে আক্রান্ত হয়। এই ব্যবস্থায় চালু থাকত যতদিন না বসন্ত রোগের গুটিগুলো শুকিয়ে ওঠে। টিকাদাররা নির্দেশ দিতেন ভালো করে শুকিয়ে ওঠার আগেই গুটিগুলো খোঁচা দিয়ে তুলে ফেলার। রোগীর মুক্ত বাতাসে চলাফেরা করার কোনো বাধা ছিল না, ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকা নিষেধ ছিল। ব্যাধিমুক্ত হওয়ার পর দেবদেবীকে পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করার প্রণালী প্রচলিত ছিল। টিকাদার তাঁর পারিশ্রমিক হিসাবে এক পন কড়ি পেতেন।

যে বাড়িতে টিকা দেওয়া হয়েছে, সে বাড়ির লোকেরা যাতে টিকা নেওয়ার একুশ দিনের মধ্যে অন্য বাড়িতে না যায় এবং অন্য বাড়িরও কোনো লোক সেই বাড়িতে না আসে—এমন নিয়ম বলবৎ ছিল। একুশ দিন কোনো নাপিত টিকা দেওয়া হয়েছে এমন বাড়িতে চুল দাড়ি কাটার কাজ করত না। এইসব সতর্কতার পাশাপাশি টিকাদারদের নিয়ম ছিল কোনো গ্রামে অধিকাংশ লোক টিকা না দিলে সেই গ্রামে কোনো লোককেই টিকা দেওয়া হবে না। আসন্নপ্রসবা মহিলা বা অন্য কোনো লোক যারা বিশেষ কারণে টিকা নিতে পারত না তাদের একুশ দিনের জন্য গ্রাম থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হত। যাদের টিকা দেওয়া হত তারা রোগমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সাধারণের ব্যবহার্য কোনো পুকুরে স্নান করতে পারত না।

তখনকার ভারত সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী এস. পি. জেমস তাঁর Small Pox and Vaccination in British India গ্রন্থে লিখেছেন, সন্দেহ নেই যে, সেই তুলনামূলক প্রাচীন যুগে সাফল্যের সঙ্গে (টিকা দেবার) প্রয়োজনীয় পদ্ধতির বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান অর্জিত হয়েছে। তখন আমরা দেখতে পাই যে, পুরোনো সময়ে যখন শুধুমাত্র সমস্ত নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হত এবং যখন শুধুমাত্র পেশাদার ব্রাহ্মণ টিকাদার দ্বারা অপারেশন করা হত, তখন এই পদ্ধতি ভারতের নির্দিষ্ট অংশের বাসিন্দাদের জন্য সত্যিকারের আশীর্বাদস্বরূপ ছিল। [অনুবাদ সম্পাদকের]

“There can be no doubt that in those comparatively olden times a high degree of knowledge in regard to the procedure necessary for success have been attained. We see then that in olden times when all the rules just enumerated were strictly enforced and when the operation was performed by the professional Brahmin inoculators only, the measure proved a real blessing to the inhabitants of a certain part of India.”

যতদিন শিক্ষিত টিকাদার সম্প্রদায়ের হাতে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা ন্যস্ত ছিল, ততদিন ভারতীয় টিকাদান প্রণালী পৃথিবীর মধ্যে অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় উন্নত ছিল। ক্রমে অর্থপিপাসু লোকেদের হাতে এটা একটা অর্থকরী ব্যবসায় পরিণত হয়। টিকার পারিশ্রমিক এক পন কড়ি থেকে বেড়ে দাঁড়ায় এক, দুই থেকে দশ রৌপ্যমুদ্রা পর্যন্ত। ফলে অনভিজ্ঞ লোকেরাও এই ব্যবসা আরম্ভ করে। এতে রোগের প্রসার আবার বেড়ে যায়। কারণ, এইসব অনভিজ্ঞ লোকেদের বসন্তের রোগ বিস্তারের বিরুদ্ধে আবশ্যক নিয়ম পালনের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ভারত সরকার বিশেষ আইন করে এই দেশীয় টিকাদান পদ্ধতি নিষিদ্ধ করে দেয়।

প্রসঙ্গত উল্লখ্য, শিকদার, গোলদার, তরফদার ইত্যাদির মতো ‘টিকাদার’ পদবীটিও এখনও প্রচলিত। এঁদের পূর্বপুরুষেরা নিশ্চয়ই যুক্ত ছিলেন টিকাদানের কাজে।

সাহায্যকারী সুত্র:

১. আত্মচারিত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শৈব্যা, কলকাতা, ১৯৯৮ 

২. প্রবন্ধ সংগ্রহ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সম্পাদনা: পিনাকপানি দত্ত, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১২

বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও বিজ্ঞান লেখক। উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত বই: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ, স্মৃতি - সত্তায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায় : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা, বিজ্ঞান বিস্ময়, নানা চোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রবাসীর প্রফুল্লচন্দ্র ইত্যাদি

মন্তব্য তালিকা - “বিজ্ঞানীর লেখা বিজ্ঞানের কাহিনী”

  1. জানতাম ই না। খুব কার্যকরী ব্যবস্থা তখনকার সময়ের জন্য। কিন্তু কত দিন আগে এটা শুরু এবং কোন কারণ এ।
    তাহলে দেখা যাচ্ছে পুরো কারণ না জেনে সব পুরোনো ব্যবস্থা খারাপ বলে দেওয়া টা
    একে বারেই ঠিক নয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।