সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ভিন্ন অঙ্গনে সত্যেন্দ্রনাথ

ভিন্ন অঙ্গনে সত্যেন্দ্রনাথ

শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

জানুয়ারি ১, ২০২৪ ৩৯৫ 3

সত্যেন্দ্রনাথ বসু এ’যুগের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর প্রতিভার বহুমুখী স্ফুলিঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ শুধু বিজ্ঞানের উপাসক ছিলেন না, তিনি ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, সমালোচক, ভাষাবিদ, সঙ্গীতশাস্ত্রজ্ঞ। জ্ঞানের প্রায় সমস্ত রাজপথেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। সত্যেন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু দিলীপকুমার রায় তাঁর স্মৃতিচারণে শুনিয়েছেন সে কথা। “সংস্কৃতজ্ঞদের সঙ্গে সংস্কৃত, ঐতিহাসিকদের সঙ্গে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ববিদের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ব, গীতজ্ঞদের সঙ্গে সঙ্গীত, কবিদের সঙ্গে কাব্য-কোনো আলোচনাতেই ও পেছপা হত না। এমন সব মন্তব্য করত যে বিশেষজ্ঞরা খুশি না হয়ে পারতেন না। অন্তত সঙ্গীত ও সাহিত্য নিয়ে আমি এবং ওর আরও নানা বন্ধু ওর সঙ্গে বহুবারই আলোচনা করে বিশেষ লাভবান হয়েছি একথা হলপ করে বলতে পারি।”

সাহিত্যরসিক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। ছাত্রাবস্থা থেকেই সাহিত্যপাঠের অভ্যাস তাঁর তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৮ সালে তার এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার কথা। পরীক্ষার দু’দিন আগে আক্রান্ত হলেন জলবসন্ত রোগে। সে’বছর আর পরীক্ষা দেওয়া হল না, আরও এক বছর পড়তে হল হিন্দু স্কুলের ছাত্র হিসেবে। কিন্তু ততদিনে তো পরীক্ষার পড়া তৈরি হয়ে গেছে। সত্যেন্দ্রনাথ আগামী বছরের পরীক্ষার অপেক্ষায় পুরোনো পড়ায় নিজেকে আবদ্ধ রাখলেন না। কলেজে গিয়ে গণিতের যে সব বিষয় পড়তে হবে তা আয়ত্ত করতে লাগলেন নিজের উদ্যোগে। সংস্কৃত কাব্যপাঠের মধ্য পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছায় পড়ে ফেললেন কালিদাস, ভবভূতি প্রভৃতি সংস্কৃত কবিদের কাব্যসমগ্র। মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের কবিতা জীবনের শেষ পর্যন্ত আবৃত্তি করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে “মেঘদূত” কাব্যের আবৃত্তি তাঁর বন্ধুবান্ধবরা অনেকে শুনেছেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির খ্যাতনামা অধ্যাপক ছিলেন পার্সিভাল সাহেব। মিল্টনের কাব্যগ্রন্থের একটি অংশ সত্যেন্দ্রনাথদের ক্লাসে পড়িয়েছিলেন পার্সিভাল। পরীক্ষায় দেখা গেল দু’জন ছাত্র তাঁর কাছে ১০০-র ভিতর ৬০ পেয়েছে। একজন কলা বিভাগের, আর একজন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে— সত্যেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথের খাতার উপর পার্সিভাল সাহেব লিখে দিয়েছিলেন ৬০ + ১০, মন্তব্যে লেখা ছিল—এই ছাত্রটি অসাধারণ, এর নিজস্ব কিছু বলার আছে।

কলকাতার বাগবাজারের খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক, পশুপতি ভট্টাচার্যের নাম আমরা অনেকেই জানি। তার ছোটো ভাই গিরিজাপতি ভট্টাচার্য ছিলেন হিন্দু স্কুলে সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী। পশুপতি জানিয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথের কিশোর বয়সের সাহিত্যচর্চার কথা। “আমাদের বাড়িতে প্রায় প্রত্যহই সন্ধ্যার সময় ছাতের উপর একটি আড্ডা বসত, সত্যেন সেখানে এসে জুটতেন… আমাদের সেই ছাতের আড্ডাতে গান ও সাহিত্যচর্চা খুবই জমে উঠেছিল। তখন সকলে মিলে ঠিক করা হল যে, নিজেদের মধ্যে একটা হাতে-লেখা মাসিক পত্রিকা বের করতে হবে। সত্যেন বসু হবেন তার সম্পাদক। সেই পত্রিকার নাম দেওয়া হলো ‘মনীষা’। এ নাম সত্যেনেরই দেওয়া। আমরাই তাতে লিখতাম, কেউ প্রবন্ধ, কেউ গল্প, কেউ কবিতা। কিন্তু স্বয়ং সম্পাদকেরও তো কিছু লেখা চাই। সত্যেন বললেন, আমি একটা গল্প লিখছি। সেই গল্পের নাম হলো ‘সে’। … পড়লে মনে হতো, পাকা একজন সাহিত্যিকের লেখা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে গল্প সমাপ্ত হয়নি। কারণ মাত্র তিন মাস বেরিয়েই পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল।”

জীবনীপাঠের প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল প্রবল। সত্যেন্দ্রনাথ ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠাতা) জীবনী খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করেছেন, পড়েছেন। পশুপতি ভট্টাচার্য একবার ফরাসি ভাষায় লেখা শ্রী অরবিন্দের একটি জীবনী পেয়েছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ সেটি তাঁকে অনুবাদ করে শোনাতেন। মহৎ ব্যক্তিদের জীবনীর মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ খুঁজতেন তাদের মনীষাকে। সেই মনীষার জোরে কে কতখানি সত্যের সন্ধানে অগ্রসর হয়েছে, এটা জানাই ছিল সত্যেন্দ্রনাথের আগ্রহের বিষয়।

সত্যেন্দ্রনাথের সংস্কৃত সাহিত্যচর্চা নিয়ে লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। “…একদিন দেখি সংস্কৃত বই পড়ায় নিবিষ্ট। ভাসের ‘চারুদত্ত’, সবটা মনে নেই। যতদূর বুঝলুম পরবর্তী নাট্যকারের “’মৃচ্ছকটিক’ এরই উপর ভিত্তি করে রচিত। কোনটা আগে কোনটা পরে তার প্রমাণ এই শব্দের বিবর্তন। এর থেকে এল শব্দতত্ত্ব। সংস্কৃত খুব ভালো জানা ছিল তার। … আর একদিন দেখি পিশেল প্রণীত প্রাকৃত ব্যাকরণের মূল জার্মান গ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ তাঁর হাতে। মূল তো তিনি পড়েছেন।”

১৯২৪-এ প্যারিসে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা বন্ধু গিরিজাপতির। দেখা গেল সত্যেন্দ্রনাথ প্রবল আগ্রহে দান্তের দ্য ডিভাইন কমেডি (Divina Commedia) পাঠে বিভোর।

প্রমথ চৌধুরী প্রকাশ করলেন বাংলায় নতুন ধারার পত্রিকা ‘সবুজপত্র’। সবুজপত্রের আসরে সত্যেন্দ্রনাথের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের আর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সুধীন্দ্রনাথ, গিরিজাপতি, নীরেন্দ্রনাথ (রায়), ধূর্জটিপ্রসাদ (মুখোপাধ্যায়), সত্যেন্দ্রনাথ প্রমুখরা সুধীন্দ্রনাথের বাড়িতে সাহিত্যচর্চার আসর বসাতেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হল একখানি পত্রিকা

প্রকাশিত হবে। পত্রিকার নামকরণ হল “পরিচয়”। সত্যেন্দ্রনাথের লেখা “বিজ্ঞানের সঙ্কট”, সুধীন্দ্রনাথের পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সুশোভন সরকার, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অন্নদাশংকর রায়, প্রমথ চৌধুরী প্রভৃতির রচনা, প্রবন্ধ, কবিতা সম্বলিত হয়ে ‘পরিচয়’ আত্মপ্রকাশ করে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে। পরিচয়-এ ১৩৪২ বঙ্গাব্দে সত্যেন্দ্রনাথ “আইনস্টাইন” নামে আরও একটি প্রবন্ধ লেখেন।

বিভিন্ন ভাষাচর্চায় সত্যেন্দ্রনাথ আগ্রহী হয়েছিলেন ছাত্রাবস্থা থেকেই। সংস্কৃত, ইংরেজি দুটি ভাষাতেই তার পাণ্ডিত্য ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের ফরাসি শেখার অনুপ্রেরণা ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। সবুজপত্রের আসর তাঁকে ফরাসি চর্চা এবং ফরাসি আদবকায়দা সম্পর্কে আরও বেশি ওয়াকিবহাল করে তুলেছিল। বিশিষ্ট ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ। ১৯১৩ সালে এম এ পাশ করার পর সুনীতিকুমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ক্লাসে ভর্তি হন। সেই ক্লাসে তাঁর সহপাঠি ছিলেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁরা জার্মান এতটাই ভাল শিখেছিলেন যে বিজ্ঞান কলেজে শিক্ষকতা করতে এসে প্রথমেই মেঘনাদ সাহা এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু একটি যুগান্তকারী কাজ করেছিলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের যে আপেক্ষিতার তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিজ্ঞানে যুগান্তর এনেছিল, সেই বিষয়ে আইনস্টাইন ও মিনকাওস্কির লেখা কয়েকটি বিখ্যাত প্রবন্ধ তাঁরা মূল জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এগুলিই ইংরেজিতে প্রথম আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বিষয়ক প্রবন্ধের অনুবাদ, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভূমিকা লিখেছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের তখনকার অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।

ভাষাতত্ত্ব সন্বন্ধেও সত্যেন্দ্রনাথের গভীর ব্যুৎপত্তি ছিল। সুনীতিকুমার লিখেছেন ইউরোপ থেকে ফিরে আমার বই “দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ” ছাপার কাজে হাত দিই। সেই সময়ে ছাপা বইয়ের প্রুফের কিছু অংশ তাঁকে দেখাই। তিনি কিছু মৌলিক পরামর্শ দিয়েছিলেন যা আমার বইতে অন্তর্ভুক্ত করেছি।” বিভিন্ন ভাষার প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের জানবার কৌতূহলের কথা লিখেছেন বন্ধু দিলীপকুমার (রায়)। “একদিন ওর (সত্যেন্দ্রনাথ) ওখানে গিয়ে দেখি চীনা হরফ নিয়ে পড়েছে, আঁকছে আর মুছছে। তিব্বতি ভাষাও বোধহয় ও শিখতে চেয়েছিল।” বিজ্ঞান ছাড়াও এসব ভাষায় সমকালীন সাহিত্য পুস্তক তাঁর বন্ধুবান্ধবরা বিদেশ থেকে পাঠাতেন। বিজ্ঞান সাধনার ফাঁকে ফাঁকে প্রায়ই তিনি সেগুলো পড়তেন। তাঁর অনুদিত কিছু কিছু বিদেশী সাহিত্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

ইতিহাস চর্চায় সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন একনিষ্ঠ। অন্নদাশঙ্কর (রায়) লিখেছেন সে কথা। “দেখলুম একদিন আন্দ্রে জিদ সম্বন্ধে ফরাসি বই পড়ছেন। জিদের কথা তিনি যত জানতেন আমি তত জানতুম না, প্যারিসে শুনেছিলুম। বললেন দরদের সঙ্গে, সমালোচকের মত নয়। … একদিন দেখি মিশলে রচিত মূল ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস পড়ছেন। বললেন ইংরেজি তরজমা পড়ে আশ মেটেনি। বহু চেষ্টায় মূল সংগ্রহ করতে পেরেছেন। তাই তন্ময় হয়ে অধ্যয়ন করছেন। ফরাসি বিপ্লব আমার নিজের প্রিয় বিষয়। অথচ আমি তার জন্য আয়াস স্বীকার করিনি। আলোচনাও করলেন কৌতুহলীর মতো। সে রকম কৌতুহল যদি ঐতিহাসিকদের মধ্যে দেখতুম! আসলে কী হয়েছিল সেই ভিতরের খবরটাই তিনি জানতে চান। ইতিহাস লেখকেরা সেটা হয়তো জানেন না কিংবা জানলেও ভেঙে বলেন না। পাছে স্বজাতির বা নায়কদের প্রতিমা ভঙ্গ হয়। সেক্ষেত্রেও সত্যেন্দ্রনাথ দরদী বিবেচক। সমালোচক নন। এর পরে একদিন লক্ষ্য করি তিনি ফরাসিদের আরও পুরনো ইতিহাসে মগ্ন। বললেন, ফরাসি বিপ্লবকে বুঝতে হলে আরও কয়েক শতক পিছিয়ে যেতে হয়। তাই তিনি পড়ছেন ষোড়শ শতাব্দীর ইতিবৃত্ত।”

এন্টান্স পরীক্ষার আগেই সত্যেন্দ্রনাথ পড়ে ফেলেছিলেন ঐতিহাসিক গ্রীন-এর সুবিখ্যাত গ্রন্থ,“এ সর্ট হিস্ট্রি অব দ্য ইংলিশ পিপল”। পড়েছেন, হিস্টোরিয়ান্স্‌ হিস্টি অব্‌ দ্য ওয়ার্ড সিরিজের ফরাসি দেশের ইতিহাসের বিপুল গ্রন্থ। ইতিহাসচর্চায় সত্যেন্দ্রনাথ যে কতটা স্বচ্ছন্দ ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যাবে ধূর্জটিপ্রসাদের (মুখোপাধ্যায়) স্মৃতিচারণে, “আমি সেবার ইতিহাসে এম এ পরীক্ষা দিচ্ছি। বললাম, ইজিপ্ট পড়েছি, কিন্তু এসিরিয়া, হিটাইট প্রভৃতি কিছুই মনে আসছে না। সত্যেন চুপ করে থেকে বললে ‘দে আমাকে’, সন্ধে ছটার মধ্যে জিনিসটা ঠিক করে দিলে। পরীক্ষায় ভালোই লিখলাম। পরীক্ষক একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ধূর্জটি! আমি একটু আশ্চর্য হয়ে গেছি তোমার খাতা পড়ে। উত্তর দিলাম, “সত্যেন পড়িয়ে দিয়েছিল।” “ও সত্যেন, তাই বল।” কলকাতার ইতিহাস বিষয়ক রাধারমণ মিত্রের “কলিকাতা দর্পণ” গ্রন্থের সুতিকাগৃহ বলা চলে আচার্য বসুর বাড়ির শনিবারের বৈঠক। সত্যেন্দ্রনাথের উৎসাহেই রাধারমণ মিত্র এই সুবিশাল ইতিহাসগ্রন্থ লিখেছিলেন।

সাহিত্য, ইতিহাস ছাড়াও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সত্যেন্দ্রনাথের বিশেষ প্রিয় ছিল। ছাত্রাবস্থায় অনেক রাত অবধি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান শোনার জন্য তাঁকে প্রায়ই পিতার কাছে তিরস্কৃত হতে হয়েছে। পাড়ার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়ি আলাউদ্দিন খাঁ মাঝে মধ্যে আসতেন ও বাজাতেন। সত্যেন্দ্রনাথ সে বাড়ির বাইরে বসে তাঁর বাজনা উপভোগ করেছেন বহুদিন। কারণ ছাত্রাবস্থায় সে আসরে যোগদান করার অধিকার তাঁর ছিল না। পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথের সাদর আহ্বানে তাঁর নিজের বাড়িতেই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসত। ঢাকায় থাকাকালীন সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে এসেছেন জ্ঞান গৌঁসাই, কলকাতার অমিয় সান্যাল, বাহাদুর খাঁ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকার সময় পণ্ডিত রবিশঙ্কর সত্যেন্দ্রনাথের আতিথ্য গ্রহণ করেছেন, সেতার বাজিয়ে শুনিয়েছেন। সত্যেন্দ্রনাথ নিজেও এসরাজ বাজাতে পারতেন এবং জীবনের শেষ কয়েকটা বছর বাদে এসরাজ ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়ের দাদামশাই প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে সারা ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব ওস্তাদদের নিয়ে প্রায়ই সঙ্গীতের জলসা বসত দিলীপকুমারের দৌলতে। সেখানে অবশ্যই হাজির থাকতেন সত্যেন্দ্রনাথ। ঘন্টার পর ঘন্টা চলছে জলসা, আর স্বনামধন্য বিজ্ঞানী সঙ্গীতে মশগুল হয়ে বসে আছেন। তখন তাঁকে দেখে কে না বলবে যে, সঙ্গীতসাধনা ছাড়া তাঁর আর অন্য কোনো পেশা আছে! দিলীপকুমার লিখেছেন, “গানের সে একজন খাঁটি সমজদার ছিল— ভালো গান শুনবামাত্র এক আঁচড়েই ভালো বলে চিনে নিতে পারত ।”

শুধু সঙ্গীত নয়, অঙ্কন ও ভাস্কর্যেও তিনি ছিলেন সমান আগ্রহী ও বোদ্ধা। নন্দলাল বসুর ভাষায়, “সত্যেন্দ্রনাথ বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তাই জানতুম, কিন্তু আর্ট সম্পর্কে জ্ঞান যে এত বিস্তৃত ও গভীর তা জানতুম না। আর্টের ক্ষেত্রে ওঁর দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, আলোচনার ধারাও আলাদা। মনে হয় উনি যেন এক নিখুঁত আর্টিস্ট ।” যামিনী রায়ের মতো শিল্পগুরুকেও ম্যুরাল নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাগ্রহ আলোচনা করতে দেখা গেছে। যামিনী রায় বলতেন, “সত্যেনের কাছে আর্টের জিওমেট্রি শেখার মতো”

বিভিন্ন ভাষায় পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সত্যেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, “দেশের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা যদি তাড়াতাড়ি প্রচার করতে হয় তাহলে মাতৃভাষাই সবদিক থেকে সোজা।” অধ্যাপনা জীবনের প্রথম পর্বে ঢাকাতে তিনি ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে শুরু করেছিলেন ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ বলে একটি পত্রিকা, যাতে বিজ্ঞানের কথা সহজবোধ্য ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর তাগিদ ছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ১৯৪৮ সালে কলকাতায় তৈরি করলেন ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’। সত্যেন্দ্রনাথের কথায়, “তখন সবে আমরা স্বাধীন হয়েছি। কাজে কাজেই আমরা ভেবেছিলাম দেশের মধ্যে বিজ্ঞানের কথা প্রচার করা, দেশকে বিজ্ঞানের যে সমস্ত অবদান আছে সে সব জানানো, যাতে প্রতিদিনের কাজে তারা বিজ্ঞানের যা কলকারখানার বিষয়েতে তাদের প্রয়োজনীয়তা বুঝে নিজেদের কাজে লাগাতে পারে— এইরকমভাবে তাদের শিক্ষাদীক্ষার আয়োজন করা।” ১৯৪৮ সালেই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে তার মুখপত্র মাসিক ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা, ছিয়াত্তর বছর ধরে তার চলা আজও অব্যাহত।

সত্যেন্দ্রনাথ নিজে জীবনের বহুক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন। বিজ্ঞান চর্চায়ও তার গতিবিধি ছিল বহুমুখী। সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, ইতিহাসচর্চায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মানুষের উন্নতি ও বিকাশই তার কাছে ছিল জীবনের চরম লক্ষ্য। সত্যেন্দ্রনাথ বলতেন, “কেবলমাত্র বিদ্যা অর্জন ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে সহায়তা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, মতবাদ, ধনী, দরিদ্র এবং সাময়িক বংশ মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ যে মূলত এক, এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রচার করতে হবে। শেষ পর্যন্ত মানুষই যে পরম সত্য আমাদের সেই জ্ঞান হোক।” আজ যখন ধর্মের নামে, ভাষার নামে, জাতপাতের নামে দেশের মানুষকে ভাগ করার নির্মম চক্রান্ত চলছে, তখন সত্যেন্দ্রনাথের এই চিন্তা আমাদের পথ দেখাবে।

তথ্যসূত্র:

১. নানাচোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সংকলন ও সম্পাদনা: শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৮

২. আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু জীবন ও কৃতি, সম্পাদনা: তপনমোহন চক্রবর্তী, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, কলকাতা, ২০১৯

৩. তিন বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ/ সত্যেন্দ্রনাথ/প্রশান্তচন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ, ২০২০

বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও বিজ্ঞান লেখক। উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত বই: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ, স্মৃতি - সত্তায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায় : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা, বিজ্ঞান বিস্ময়, নানা চোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রবাসীর প্রফুল্লচন্দ্র ইত্যাদি

মন্তব্য তালিকা - “ভিন্ন অঙ্গনে সত্যেন্দ্রনাথ”

  1. অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম। এত ছোট পরিসরে এমন গুছিয়ে বলা হয়েছে যে মানুষ টির সম্মন্ধে সম্যক ধারণা তৈরি হয়ে যায়। মনে হয় পূর্ণ প্রবন্ধ হলে আরো ভালো হতো।

  2. স্বল্প পরিসরে এ এক অসাধারণ উপস্থাপনা।
    যতদূর মনে পড়ছে, সত্যেন্দ্রনাথ বিচিত্ৰা নামের এক সাহিত্য আসরের‌ও নিয়মিত সদস্য ছিলেন। বিস্তারিত জানালে খুব উপকৃত হবো।

  3. স্বল্প পরিসরে এ এক অসাধারণ উপস্থাপনা।
    যতদূর মনে পড়ছে, সত্যেন্দ্রনাথ বিচিত্ৰা নামের এক সাহিত্য আসরের‌ও নিয়মিত সদস্য ছিলেন। বিস্তারিত জানালে খুব উপকৃত হবো।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।