সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইসলাম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইসলাম

অমিত দে

সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০ ২২৯২ 9

(জয়ন্ত ভট্টাচার্য দ্বারা অনূদিত)

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরের এক শীতল ও সিক্ত সন্ধ্যায় ইংল্যান্ডের সোয়াস-এ, বিশিষ্ট লেখক গুলাম মুরশিদ মন্তব্য করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ মুসলিম সমাজ সম্পর্কে তেমন কিছু লেখেননি। প্রয়াত অধ্যাপক ধ্রুব গুপ্ত অবশ্য এই মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে জানিয়েছিলেন, মুসলিম সমাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কেবলমাত্র পরিমাণগত দিক থেকে বিচার করা ঠিক নয়। বরং এই বিষয়ে বিশ্বকবির আলোচনাগুলির গুণগত মূল্যায়ন করতে পারলে তা আরও অর্থবহ হবে। রবীন্দ্রনাথের মুসলিম সমাজের উপর আলোচনায় যে অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা লক্ষ্য করা যায়, তা এমনকি ইসলাম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পর্যন্ত বিস্মিত করে। প্রকৃতপক্ষে এই কারণেই আমি উত্সাহিত হয়েছি এই রকম কম আলোচিত ভূখণ্ডে ঐতিহাসিক গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যেতে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবন্ধ, ভাষণ, গল্প, উপন্যাস এবং চিঠিতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বিষয়ে তাঁর মতামত, আশা এবং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমকালীন মুদ্রিত আলোচনায় এমনকি রবীন্দ্রোত্তর কালপর্বের লেখালেখিও ইসলাম ও মুসলিম সমাজকে একটি নির্দিষ্ট ছাঁচে ঢালা রূপ দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য, উভয়ের গণমাধ্যমই এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। লিঙ্গবৈষম্য সংক্রান্ত আলোচনায় সম্ভবত এই একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বাধিক লক্ষ্য করা যায়। দূরদর্শি রবীন্দ্রনাথ এই প্রবণতাটি অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং স্পষ্টত ইসলাম ও মুসলিম সমাজকে এই ধরণের ছাঁচে ঢালা প্রতিচ্ছবি থেকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেন। মুসলিম মহিলাদের সম্বন্ধে আলোচনার সময় রবীন্দ্রনাথ তুরস্কে বসবাসকারী এক ইংরেজ মহিলা সাংবাদিকের লেখা একটি নিবন্ধ বেছে নিয়েছিলেন। লেখিকা মধ্য প্রাচ্যের পুরুষতান্ত্রিক মুসলিম সমাজে নারীদের উপর নিপীড়নের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিলেন এবং একে মুসলমানদের জাতীয় চরিত্র হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন। মুসলিম সমাজের এই একপেশে প্রতিকৃতি চিত্রণের উপর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিচারপতি আমির আলী উল্লেখ করেছিলেন যে, পরবর্তী যুগে ইসলাম বিকৃত হয়েছে। নবী ও খলিফাদের যুগে আরব মহিলারা তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতেন। [১] একইভাবে হিন্দু সমাজ যখন পাশ্চাত্যের দ্বারা সমালোচিত হয়, তখন শিক্ষিত হিন্দু পুরুষরা দাবি করেন যে আজকের তুলনায় হিন্দু মহিলারা প্রাচীন যুগে অধিকতর সুযোগ লাভের অধিকারী ছিল। এশিয়াবাসীদের এমন মনোভাব দেখে রবীন্দ্রনাথ হতবাক হয়ে পড়েছিলেন, কারণ যারা একদিকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, তারাই পাশ্চাত্যের গতিশীল সমাজের অনুপ্রেরণায় নিজেদের সমাজকে অন্ধকার থেকে মুক্তি ও আমূল রূপান্তর করার পরিবর্তে নিজেদের অতীতকে গৌরবান্বিত করার এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখান। [২]

রবীন্দ্রনাথ আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে, পাশ্চাত্যে মানবকেন্দ্রিকতা বর্তমান, সেখানে একজন মানুষের সার্বিকতা বিচার করা হয়, তার অন্তরলীন চেতনা এবং কৃতিত্বকেই সম্মান জানানো হয়, কিন্তু, প্রাচ্যে যখন কোনও মানুষ মহানুভবতা দেখান, তখন তিনি নিজের কৃতিত্বের জন্য খুব কমই সম্মানিত হন, বরং তাঁর উপর দেবত্ব অর্পিত হয়। এখানেও রবীন্দ্রনাথের দূরদর্শিতার প্রশংসা করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এত বছর পর আপনারা দক্ষিণ এশিয়ার ক্রিকেটের মহানায়কদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কিভাবে তাদের উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। অথচ সাধারণ দর্শক একজন ক্রিকেটারের এই সাফল্যের পিছনের কারণগুলিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা খুব কমই করেন বা বলা যায় করেনই না। রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন যে, এক সময় পাশ্চাত্য মানসিকতার মধ্যে পূর্ব ইউরোপে ঘটে যাওয়া খ্রিস্ট ধর্মের ঘটনাগুলিকে  ধর্মান্ধতার মোড়কে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যে যুক্তিবাদের জয় হয়েছে। এই জয়ের মূল কারণ তাদের শাস্ত্রগ্রন্থ বা ধর্মের শীর্ষনেতাদের অভ্রান্ততাকে প্রশ্ন করতে পারা।[৩] রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, আমাদের প্রাচ্যের ক্ষেত্রে, সবচেয়ে দৃঢ়চেতা বুদ্ধিজীবীরাও ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বক্তব্য প্রকাশ্য স্থানে বলার পূর্বে বেশ কয়েকবার চিন্তা করেন।

অন্য একটি রচনায় রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়েছিলেন মহান কবি টেনিসনের কথা, মৃত্যুর পূর্বে এই রচনায় তিনি সংক্ষেপে ভারতের উল্লেখ করেছিলেন। বিষয়টি ছিল মহান মুঘল সম্রাট আকবরের স্বপ্ন নিয়ে। এক রাতের স্বপ্নের প্রসঙ্গে আকবর তার বন্ধু এবং সুপণ্ডিত আবুল ফজলের সামনে ধর্ম ও জীবনের মর্ম সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন। টেনিসনের কাব্যিক কল্পনায় আকবর স্বপ্নে দেখেছিলেন যে তাঁর উত্তরাধিকারীরা কীভাবে এই সাম্রাজ্যের ধর্মীয় ও জাতিগত ঐক্যের সম্পর্কটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে একদল মানুষ সূর্যাস্তের ওপার থেকে এসে আকবরের আদর্শে গড়া সেই ভারতীয়  দেবালয়ের সত্য, শান্তি, ভালবাসা এবং ন্যায়বিচারের শাসনকে পুনর্নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কবির স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার জন্য প্রার্থনা করেছেন, কিন্তু এও লক্ষ্য করেছেন যে, প্রচুর শ্রম ও দক্ষতা দিয়ে ঐ মন্দিরকে পুনর্নির্মাণ করলেও, সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা, প্রেমের দেবতাকে ঐ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছেন,  ব্রিটিশদের অধীনে নির্মিত সুদৃঢ় অথচ হৃদয়হীন ও প্রাণহীন কাঠামোর সঙ্গে আকবরের তৈরি মন্দিরের পার্থক্য রয়েছে, কারণ আকবর সে মন্দিরে  হৃদয় দান করেছিলেন।[৪] স্পষ্টতই মহান সুফি (অতীন্দ্রিয়বাদী) ঐতিহ্যের প্রভাব রবীন্দ্রনাথকে এই তুলনা  করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মানসিক ঔদার্যসম্পন্ন আকবর গভীর আগ্রহের সঙ্গে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান বা জরথ্রুষ্টীয় ধর্মের প্রতিনিধিত্বকারী ধর্মতত্ত্ববিদদের কথা শুনতেন। আকবর তাঁর উদার, মানবিক এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুঘল অন্তঃপুরের হিন্দু মহিলাদের প্রতি, মুঘল দরবারের হিন্দু অভিজাতদের প্রতি এবং লড়াইয়ের ময়দানে হিন্দু সেনাপতিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ভারতের সমন্বয়ী সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে একটি অঙ্গীভূত সাম্রাজ্যের কল্পনা করেছিলেন। সূর্যাস্তের দিক থেকে আসা বহিরাগত লোকেরা ভারতের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জীবনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ করেছিল। তাদের এই অনাসক্তি মমতার প্রতিফলন নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা প্রভাবিত, এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।[৫]

রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সংহতি এবং সাম্প্রদায়িক মৈত্রীর প্রতীক হিসাবে আকবরকে যথাযথভাবে চয়ন করেছেন। আকবর স্বাক্ষর ছিলেন না, তবে প্রকৃতার্থে তিনি শিক্ষিত ছিলেন। ফার্সি মধ্যযুগে হিন্দুস্তান এবং পারস্যের মধ্যবর্তী অঞ্চলে রাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্য এবং সংস্কৃতির ভাষাতে পরিণত হয়েছিল। রুমী এবং হাফিজের মতো কবিরা ছিলেন পারসিক রেনেশাঁসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্গাতা। তাঁদের কবিতা এবং দর্শন ভারতের সাংস্কৃতিক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে অনেক কবিই ভারত ভ্রমণ করেনি, তবে তাঁদের উদার, মানবিক ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের বহু বুদ্ধিজীবীকে প্রভাবিত করেছিল। হাফিজের আয়াতগুলির সাথে আকবরের পরিচিতি তাকে সম্ভবত হিন্দু প্রজা থেকে জিজিয়া তুলতে উৎসাহিত করেছিল। (এস. নুরুল হাসান, ‘রিলিজিয়ন, স্টেট অ্যান্ড সোসাইটি ইন মিডাইভ্যাল ইন্ডিয়া’ সতীশ চন্দ্রের ভূমিকা সমেত সম্পাদিত)  রুমীর (মসনবী রচনার জন্য বিখ্যাত) কবিতাও ছিল আকবরের প্রিয়। তিনি বিশেষভাবে চাইতেন যে রুমীর সেই অংশটি তাঁর সামনে পড়া হোক, যেখানে রুমী লিখেছেন, ‘ঈশ্বর চাইলে বিশ্বে একটিমাত্র ধর্মীয় সম্প্রদায় সৃষ্টি করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর এই ইচ্ছা ছিল না। সেই কারণেই বিশ্বে একাধিক ধর্ম এবং ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকেই একজন ধর্মীয় পথপ্রদর্শক পেয়েছে। নবী ইঙ্গিত করেছিলেন যে সিন্ধ ও হিন্দের অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবনে কোনও হস্তক্ষেপ যেন না করা হয়।’ (নুরুল হাসান কর্তৃক উদ্ধৃত)। সত্যই যদি সমসাময়িক ইউরোপের সাথে আকবরের ভারতকে তুলনা করে দেখি, দেখতে পাব যে রানী এলিজাবেথ যখন রোমান ক্যাথলিকদের পীড়ন করছিলেন এবং ফরাসী সম্রাট হুগেনোটদের তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য ফ্রান্স ত্যাগ করতে বাধ্য করছিলেন, তখন আকবরের ভারতে সুলহ-ই-কুল (শান্তির বানী)  বিরাজ করছিল। হুগেনোটরা দক্ষ শ্রমিক ছিলেন এবং ব্রিটেনের শিল্পায়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। মূলত তাদের আগমনের ফলে সুইজারল্যান্ড ঘড়ি তৈরির ক্ষেত্রে পারদর্শিতা অর্জন করে। যাই হোক, আকবরের উদার, মানবিক এবং যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের বিশ্বজনীনতা বজায় রাখতে পেরেছিল। ভারতে এই আধুনিকীকরণের প্রবণতা উপনিবেশবাদ বা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার অনেক পূর্বে দেখা গিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে এবং পরবর্তী সময়ে কয়েকজন ঐতিহাসিক উনিশ শতকের ভারতীয় নবজাগরণের (পাশ্চাত্যের সাথে ভারতের যোগাযোগের ফলাফল হিসাবে) পূর্ববর্তী এই রেনেসাঁসের ভারতীয়ত্বের প্রতি জোর দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ইঙ্গিত করেছেন, ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্য বর্ধনের প্রয়াসে আন্তরিক ছিল না। তাদের রাজনৈতিক অভিধানে মমতার কোনও স্থান নেই। বরং, তারা বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে সমৃদ্ধ হত। শুধু আইন এবং পরিশীলিত প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের ধারণা শক্তিশালী করা যায় না। সত্যিকারের সৌভ্রাতৃত্ব এবং অন্তরাত্মাকে অনুভব করা গুরুত্বপূর্ণ, যা করতে আকবরের ভারত সক্ষম ছিল। যখন প্রেম বা বিনম্রতা জাতিগত ঔদ্ধত্যকে পরাস্ত করে, তখনই, আমরা সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের বৃদ্ধি এবং পুষ্টিসাধন দেখতে পাই,  যার আজ সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন।

অ্যারিস্টটল এবং প্লেটো গ্রীকদের একচেটিয়া নয়। শিক্ষিত মুসলমানরা মানবজাতির জন্য তাঁদের অবদানের প্রশংসা করেন। একইভাবে নওশেরওয়ানে আদিল পারসিকদের একচেটিয়া নয়। তিনি মধ্যযুগের ভারতীয় মুসলমানদের দ্বারা বন্দিত হয়েছিলেন। হিন্দুদের ইংরেজ লেখকদের রচিত সাহিত্যের দ্বারা  মনোরঞ্জনের  অধিকার রয়েছে, আমাদের ইউরোপীয়দের প্রদত্ত চিকিত্সা লাভ করার অধিকার রয়েছে। একইরকম ভাবে আমরা রেলওয়ে ব্যবস্থা বা টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার সুবিধা গ্রহণ করতে পারি। সেগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি কিনা তা আমরা কখনও জিজ্ঞাসা করি না। একটি নির্দিষ্ট জাতির আবিষ্কার সমগ্র মানবজাতির সম্পদ হতে পারে। কিন্তু, এই ভাবনার বিপরীতে, আমি যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে জানতে পারি যে আমার মালয়েশিয় মুসলিম বন্ধু ইহুদী মালিক বলে টেসকো নামের সুপার মার্কেটে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (১৯৯৭)

রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেখেছেন যে একজন হিন্দু আন্দোলনকারী এক গ্লাস জল পান করার সময় তাঁর স্বদেশবাসী মুসলিম সহযোদ্ধাকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলছেন। এই জাতীয় সামাজিক দূরত্ব এমন একটি ক্ষত সৃষ্টি করে যা নিরাময় করা কঠিন। (আমাদের বর্ণবৈষম্যবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার পৃথকীকরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় -অধ্যাপক হরি বাসুদেবন)। রবীন্দ্রনাথ গোহত্যা বিরোধী মনোভাবকে গোঁড়ামি ও ভণ্ডামি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কারণ হিন্দুরা ধর্মীয় বলিদানের নামে পশুদের জবাই করে (দুর্গাপূজার সময় যেমন মহিষ বলি) কিন্তু মুসলমানরা যখন গোহত্যা করে তখন হিন্দুরা একে একটি বিবাদের বিষয় হিসাবে তুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে আসা কিছু যুবক বিতর্ক করে যে ভারত একটি কৃষিক্ষেত্র দেশ তাই…। কিন্তু এই মতকে নস্যাৎ করে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে মহিষরাও লাঙ্গল টানে এবং দুধ উত্পাদন করে, তাহলে হিন্দুদের এদের হত্যা না করা উচিত ছিল। আমরা সমাজে ফাটল সৃষ্টি করেছি বলে বিভাজন ও শাসন নীতি সফল হয়েছে। আমাদের কোন অধিকার নেই এই জাতীয় নীতি অনুসরণ করার জন্য বিদেশীদের অভিযুক্ত করার। প্রথমে আমাদের নিজেদের ঘরকে সুসংবদ্ধ রাখতে শেখা উচিত।

হিন্দুরা অ-হিন্দুদের সাথে অহিংস অসহযোগিতার পথ অনুসরণ করেছে। ইউরোপীয় বৌদ্ধ বা ইউরোপীয় মুসলমান পরস্পরবিরোধী শব্দ নয়। কিন্তু ভারতের মুসলমান এবং হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয়ই প্রধান। সুতরাং ‘মুসলিম বৌদ্ধ’ বা ‘মুসলিম খ্রিস্টান’ এর মতো পারিভাষিক শব্দ হওয়া অসম্ভব। হিন্দুদের ধর্ম আচারভিত্তিক এবং মুসলমানদের ধর্ম আচরণভিত্তিক। খিলাফত আন্দোলনের কালপর্বে মুসলমানরা প্রায়শই মসজিদ প্রাঙ্গণে হিন্দুদের স্বাগত জানিয়ে থাকতেন। হিন্দুরা এর প্রতিদান দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তার যৌবনের দিনগুলিতে যখন রবীন্দ্রনাথ জমিদারির সংস্পর্শে এসেছিলেন, তিনি খুব হতাশ হয়েছিলেন যে স্বদেশীতে যুক্ত নায়েবের কাছে যখনই কোনও সম্মানীয় মুসলমান প্রবেশ করতেন, তখনই তিনি কার্পেটের এক প্রান্ত গোটাতেন। এই জাজিম সংস্কৃতি প্রতীকীভাবে সামাজিক বর্জনের ধারণার প্রতিনিধিত্বকারী এবং স্বদেশী আন্দোলন বা ভারতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্ভাব্য দুর্বলতার প্রকাশ। এ ছিল জাতিসত্তা নির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রতিবন্ধকতা। এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রীক, পারসিক, শক ও অন্যান্যরা ভারতে প্রবেশ করেছিল এবং এই সমন্বয়ের সংস্কৃতির জোরদার হয়েছিল। কিন্তু তা ছিল হিন্দু যুগের পূর্ববর্তী ঘটনা। হিন্দু যুগ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল যুগ, যখন ব্রাহ্মণ্যবাদী গোঁড়ামিকে দৃঢ়ভাবে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছিল। বৌদ্ধধর্মের পরবর্তী সময়ে, সামাজিক বহিষ্করণকে শক্তিশালী করার জন্য অত্যন্ত নিপুণভাবে রাজপুতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। (সতীশচন্দ্র একে রাজপুত এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘মিথোজীবী সম্পর্ক’ বলেছেন, যা তুর্কিদের আগমনের সাথে ভেঙে পড়েছিল)। সমাধান কোথায়? ইউরোপরা যেমন মধ্যযুগীয় অতীতকে পিছনে ফেলে বস্তুনিষ্ঠভাবে সত্য এবং জ্ঞানের অন্বেষণ করে যুক্তি, আলোকপ্রাপ্তি এবং মানবতাকে জয়ের মধ্য দিয়ে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, সেই মতো চিন্তার রূপান্তর দরকার। হিন্দু ও মুসলমানদের ইউরোপীয়দের অনুকরণ করে ধর্ম ও আচারের পরিমণ্ডল দ্বারা প্রভাবিত সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসা উচিত, কারণ সত্য এবং অজানাকে অনুসন্ধানের জন্য জীবনের বন্ধুর ভূখণ্ড অতিক্রম করতে হয়। রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন যে, সুইৎজারল্যান্ডে তিনটি প্রধান ভাষাগত/ জাতিগত জনগোষ্ঠী রয়েছে, কিন্তু তারা একটি জাতি গঠন করেছে। কেন সম্ভব হল? তার কারণ, ভারতে হিন্দু গোঁড়ামির রক্ষকেরা বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহের বিরোধিতা করেন (দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের তো কোন প্রশ্নই আসে না)। অন্যদিকে, সুইজারল্যান্ডে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের সম্পর্কস্থাপনে কোনও নিষেধ নেই। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাঠানরা মাঝে মধ্যে হিন্দু মহিলাদের অপহরণ করত। রবীন্দ্রনাথের জনৈক বন্ধু আবিষ্কার করেছিলেন, একবার যখন এই ঘটনার  পুনরাবৃত্তি হয়, তখন হিন্দু প্রতিবেশীরা “ও তো বেনিয়াকি লড়কি” যুক্তি দেখিয়ে কোন প্রতিবাদ করেনি। এর নিহিতার্থ এই যে, যখন হিন্দুদের নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি নেই, তখন তারা তাদের থেকে বহুল পরিমাণে পৃথক অন্য একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কিভাবে বজায় রাখতে পারে?

ঐতিহাসিকরা ভারত বিভাজনের উপাদানগুলির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক করেছেন। কিছু সমাজবিজ্ঞানী যুক্তি দিয়েছেন যে ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিভাজন ও বিভেদ নীতি দেশভাগে ভূমিকা ছিল। আবার কেউ কেউ হয়ত মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতার প্রস্তাবিত ‘দ্বিজাতি তত্ত্বকে’ দোষ দেবেন। কিন্তু বিভাজন ও শাসন নীতি একটি বাহ্য উপাদান। সাম্প্রতিক ইতিহাসচর্চায়, মূলত হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সমাজের মধ্যের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলিকে দোষারোপণ করা হয়। এই ইতিহাসবিদদের মতো রবীন্দ্রনাথ দেশভাগের অভিজ্ঞতা অর্জন করার জন্য জীবিত না থাকলেও, তিনি দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের বৃদ্ধি এবং সংরক্ষণে ভূমিকা গ্রহণকারী আভ্যন্তরীণ কারণগুলিকে অনুধাবন করতে এবং বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি এই বিভাজনকে একটি জাহাজের নিম্নভাগের ছিদ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন যে, আমরা এই ছিদ্রের মেরামত করি নি, বরঞ্চ আমরা সর্বক্ষণ জাহাজের ধ্বংসের জন্য ঝড়কে দোষ দিয়েছি। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার (বা তাদের বিভাজন ও শাসন নীতি) নামক এই ঝড় একটি বাহ্য কারণ মাত্র। এই ঝড়ের দ্বারা জাহাজের নীচের অংশের ছিদ্রের সহায়তা গ্রহণ খুব স্বাভাবিক। এখানে, রবীন্দ্রনাথ যেন এক অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ঐতিহাসিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, যিনি ইউরোপের সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ বা ভারতের বিভাজনের মত মুখ্য ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলির পিছনে অভ্যন্তরীণ কারণের উপর বেশী জোর দেন। রবীন্দ্রনাথ আরও বৃহত্তর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে অস্পৃশ্যতা আমাদের বিচ্ছেদকামী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র, যা স্বদেশী বা খিলাফত অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে না। তিনি প্রাচীনপন্থী হিন্দু ও মুসলমানদের তুলনা করেছিলেন সেই কুখ্যাত বুশম্যানদের সঙ্গে, যারা অন্য মানুষদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে হত্যা করে। তাই তারা অন্যদের সঙ্গে সৃজনশীল এবং অর্থপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া করতে সক্ষম হয় না, যা মানবতার বিকাশ ও আধ্যাত্মিকতার জন্য অপরিহার্য শর্ত। সামনের দিকে তাকানো ইউরোপীয়রা সীমানা অতিক্রম করে, আর অন্যদিকে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যের বিভাজনকে উদযাপনের জন্য সীমানা তৈরি করে। তিনি একে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।

পূর্ব বাংলায় জমিদারি পরিচালনা করার সময় সুগ্রাহী রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন যে স্ফীয়মান উগ্র পদ্মার উপর ঝড়ের সময় শত্রুভাবাপন্ন পাখিরা তাদের শত্রুতা ভুলে গিয়ে একই জায়গায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু, ঝড় থামার সাথে সাথে সেই পাখিদের মধ্যে আবারও শত্রুতা শুরু হওয়া কবিকে বিচলিত করত। খিলাফত আন্দোলন, এই মহান কবির মত অনুসারে ঐ অস্থায়ী ঝড়ের মতো, কোন সমাধান নয়।

কবি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে উল্লেখ করেছেন খিলাফত আন্দোলন যখন তার শীর্ষে পৌঁছেছিল সেই সময়ের মালাবারে নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ ও মোপিল্লাদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণরা মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতেন এবং মোপিল্লা মুসলমানরা নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণদের উপেক্ষা করতেন। যে সব রাজনৈতিক আন্দোলন, রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রধানত তাদের স্বল্প মেয়াদী বা তাত্ক্ষণিক লক্ষ্যের কারণে, অগভীর বলে প্রতিভাত হয়েছিল, সেই ধরণের আন্দোলনের প্রতি তাঁর আস্থা খুব কম ছিল। বরঞ্চ তিনি মুঘল রাজকুমার দারা শিকোহ বা রামমোহন রায়কে অনুসরণ করে প্রতিবেশীদেরকে জানার উপর জোর দিয়েছিলেন। খুব কম হিন্দু রাজা রামমোহন রায়ের মতো ইসলামকে জানার চেষ্টা করেছেন। একইভাবে, খুব কম সংখ্যক মুসলিম দারা শিকোহের মতো হিন্দু ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। বিদ্বেষ কাটিয়ে উঠতে প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান দরকার। মোপিল্লা সমস্যা বা আকালি শিখ সমস্যার গভীরে না গিয়ে আমরা জাতীয় সংহতির বিষয়ে কথা বলি। এ ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির সামাজিক অদূরদর্শিতা।

আধুনিক ভারতে দারিদ্র্য ও বিদ্বেষ এক সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে। রবীন্দ্রনাথ, ইরান এবং আরব বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম দেশ পরিদর্শন করেছিলেন। এই দেশগুলি ভারতের মতো পুরোপুরি উপনিবেশ ছিল না। সেখানকার মুসলমানরা স্বাধীন ও সচ্ছল হওয়ার কারণে উদারমনস্ক। তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিকে বলেছিলেন যে তাঁরা শুধু তাঁর প্রশংসক নন, তাঁকে তাঁরা ভালও বাসেন। তবে কবি স্বীকার করেছেন যে ভারতেও বহুসংখ্যক শিক্ষিত এবং উদারমনস্ক মুসলমান রয়েছেন, যার একটি অংশের সঙ্গে কবির বন্ধুত্ব ছিল। রবীন্দ্রনাথ সারা বিশ্বে ধর্মের অধার্মিক প্রকৃতি দেখে খুব চিন্তিত ছিলেন। গভীর হতাশার সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, ধর্ম জনসংখ্যার একাংশের উপর আধিপত্যের উত্স হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিচলিত কবি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে নাস্তিকতা কখনও কখনও আস্তিকতার চেয়েও ভাল।

হিন্দুদের মধ্যে সংহতির অভাব এবং বহুস্তরীয় হিন্দু সমাজে শোষণের ব্যাপকতাকে অনাবৃত করতে কবি পূর্ববঙ্গের উদাহরণ তুলে ধরেছেন, যেখানে নমশূদ্ররা বিভিন্ন ঘটনায় মুসলমানদের সমর্থন করেছিলেন। ভারতে, যেখানে লোকেরা নিজেকে হিন্দু বা মুসলমান হিসাবে পরিচয় দেয় এবং খুব কমই ভারতীয় হিসাবে পরিচয় দেয়, সেখানে জাতি গঠনের প্রক্রিয়া ধাক্কা খায়। অন্যদিকে, ইংরেজরা গর্বের সাথে নিজেকে ইংরেজ বলে পরিচয় দেয় এবং তাদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় নগণ্য হয়ে গেছে।

এ আমাদের নিয়ে আসে ভাষা বিতর্কে। ভাষার একটি প্রাণবন্ততা রয়েছে, একে জোর করে বা অগভীরভাবে পরিবর্তন বা হেরফের করা যায় না। সমস্ত সভ্য ভাষার সৃজনশীল স্বতঃস্ফূর্ততায় কিছু বিদেশী শব্দ অন্তর্ভুক্ত হয়। এমনকি একজন সাম্প্রদায়িক বাঙালি হিন্দুও অনেক তৎসম এবং তদ্ভব শব্দের জায়গায় মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করেন। আপনি যদি বলেন, ‘মেজাজটা খারাপ হয়ে আছে’ তাহলে স্বাভাবিক শোনায়। কিন্তু যদি আপনি বলেন ‘মনের গতিকটা বিকল হয়ে আছে’ তাহলে সবাই ভ্রু কোঁচকাবেন। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ওয়েলসের লেখকরা তাঁদের পারিবারিক বৃত্তে ব্যবহৃত আঞ্চলিক পরিভাষা এবং শব্দগুলিকে নির্বিচারে অন্তর্ভুক্ত করে ইংরেজি ভাষাকে ভারাক্রান্ত করার চেষ্টা করেননি। তাঁরা লেখার মাধ্যম হিসাবে অবিমিশ্র ইংরেজি ব্যবহার করেছেন। এই বিষয়ে আগ্রহী রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন যে ভারতীয় শব্দ ‘জঙ্গল’ স্বাভাবিক নিয়মে ইংরেজি অভিধানে স্থান পেয়েছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা ‘অরণ্য’ শব্দের দ্বারা ‘ফরেস্ট’ শব্দেরও প্রতিস্থাপন করতে পারব। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধ এবং পাঞ্জাবে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তিক্ততা বিরাজমান। কিন্তু, সেখানে উর্দু ভাষায় তৎসম শব্দগুলিকে জোর করে যুক্ত করার কোনও আন্দোলন হয়নি। বাংলাকেও আমরা একই রকম ভাবতে পারি। বিশ্বকবি যুক্তি দিয়েছিলেন যদি কৃতি মুসলিম লেখকরা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সাহিত্যে বর্ণনা করেন, তাহলে মুসলিম দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দগুলিকে বাংলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে। তাঁর জীবদ্দশায় এই ধারার রচনার অভাব ছিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তিদের দ্বারা এই ধরণের শব্দের ভাষাগত অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন যখন এক সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি তাঁকে তাঁর ‘পূজারিণী’ রচনার মাধ্যমে অন্ধভক্তির প্রচারক হিসাবে অভিযুক্ত করেছিলেন। ‘গান্ধারীর আবেদন’ রচনা করার সময় আরেকজন ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে পাপের বৈধতাকরণের অভিযোগ এনেছিলেন। এই অভিযোগ ছিল দুর্বল ধৃতরাষ্ট্রের ঘটনার গতিক্রম নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছিলেন যে শেক্সপীয়রের ইহুদি চরিত্রের চিত্রণটি বেনজমিন ডিস্রেলি বা লর্ড রিডিংকে (ভারতের ভাইসরয়) পাঠক্রম থেকে ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’কে নিষিদ্ধ করার জন্য প্ররোচিত করেনি। বাংলায় সেই অর্থে এই ধরনের মানসিকতায় পরিপক্কতা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছেন যে সাংস্কৃতিক জগতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে উল্লেখনীয় যোগাযোগের অভাব যে ছিল তা আমরা বুঝি যখন দেখি কেবলমাত্র কবি ভারতচন্দ্র ফার্সি নাগরিক সাহিত্য রীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আমি এটি স্বীকার করি না কারণ উর্দু ভাষা নিজেই ভাষাগত অন্তর্মিলন বা মাজমা উল জাবানতের ফলাফল। আমির খুসরু খুব সচেতনভাবে বলেছিলেন ‘বেয়া বরাদার আও রে ভাই-বেনোশি মাদ্র বোথ রে মাই’।

আমরা কুয়োর ব্যাঙের মতো বহির্বিশ্বের পরিবর্তন ও গতিশীলতা সম্পর্কে অবহিত নই; কথকথা, রামায়ণ, পাঁচালী এবং কবিগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যতদিন হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই অতীত থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে, ততদিন চিন্তার মুক্তি সম্ভব নয়। আমরা আমাদের চিন্তাকে গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপ বা পঞ্জিকার মধ্যে অবরুদ্ধ করে রেখেছি, যার ফলে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক আবিষ্কারের জগতের প্রতি সন্দিহান।

উপসংহার বা সমতুল্য কিছু:

শিক্ষা, দারিদ্র্য মোচন এবং হিন্দু ও মুসলমানদের যুক্ত করে গ্রামের পুনর্গঠনই এর সমাধান। পার্সিদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা যায়নি তার কারণ তারা যুক্তিবাদী এবং শিক্ষিত। বাংলাকে তাদের অনুকরণ করা উচিত। হিন্দু ও মুসলমানরা যখন পল্লী সংগঠনে যুক্ত হবে তখন তাদের সৃজনশীলতার সংযুক্তি ঘটবে। ধ্বংস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে। পাশ্চাত্যের নাগরিকতার প্রদর্শন দেখা যায় শহরে। কিন্তু ভারতের আত্মার অবস্থান গ্রামে। সাম্প্রদায়িক হিংসা মূলত শহরগুলিতে হয়। গ্রামের মানুষদের মধ্যে একটি পারস্পরিক সুসম্পর্ক রয়েছে। তাই গ্রামীণ বঙ্গ সমগ্র সাম্প্রদায়িক উগ্রতার বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছিল। রবীন্দ্রনাথ দাবি করেছেন এই সাম্প্রদায়িক উগ্রতা শান্তিনিকেতনের পরিবেশকে বিকৃত করতে পারেনি।

পাদটীকা:

১ Swadesh Samakal Granthamala (Vol-3)Hindu-Musalman Samparka(A collection of Tagores writings in Bengali) compiled by Nityapriya Ghosh,published from Kolkata in 2003.pp.13-15.

২ তদেব. pp.15-16.

৩ তদেব.

৪ তদেব. পৃ.17

৫ তদেব.

তথ্যসূত্র:

I. Swadesh Samakal Granthamala (Vol-3)Hindu-Musalman Samparka(A collection of Tagores writings in Bengali) compiled by Nityapriya Ghosh,published from Kolkata in 2003.

II. S Nurul Hasan, Religion State and Society in Medieval India. Introduced andedited by Satish Chandra.

III. Satish Chandra, Historiography, Religion and State in Medieval India.

মন্তব্য তালিকা - “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইসলাম”

  1. প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে গুরুদেবের পদপ্রান্তে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর নিজ কলমে বর্ণিত হিন্দু-মুসলিম বিষয়ক কিছু লেখা আছে। পুনরপ্রকাশ করলে পড়তে পারতাম।

  2. লেখাটার সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও বলতে হচ্ছে- ‘গুলাম মুর্শিদ’ নামে কোন বিশিষ্ট বাঙালী লেখক আমার জানামতে নেই, তাঁর নাম ‘গোলাম মুরশিদ’। একজন লেখকের নামটা পর্যন্ত শুদ্ধভাবে লেখার কষ্টটুকুও যে কেন করতে পারেননা আপনারা, অথচ জগতের কত বড় বড় বিষয় নিয়ে আপনাদের বিচরণ! জন্মসূত্রে ‘মুসলিম’ লেখকদের নামের ক্ষেত্রেই কেন জানি আপনাদের এই শৈথিল্য!

  3. চমত্কার লেখাটি পড়লাম।প্রাচ্যের দেশ ভারতবর্ষও পাশ্চাত্যের দেশগুলির মধ্যে জীবনটাকে দেখারও যে এক আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে তাও বেশ প্রত্যক্ষ করা যায় পরোক্ষভাবেই!অধিকাংশ মানুষই প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলির মধ্যে এমনসব সুমহান আদর্শ খূঁজে পান যে তার জন্য কেবল অন্যের প্রাণ নিতে পারেন অবলীলায় তাই নয় নিজের প্রাণের মায়াও ত্যাগ করতে পারেন ঈশ্বরের নামে,সহজেই।নিজেদের মধ্যেকার এই বিষাক্ত বিভেদমূলক মনোভাবই কিন্তু দেশবিভাগে ইন্ধন জুগিয়েছে কেবল কিছুজন চেয়েছেন রাজনৈতিক স্বার্থে বা ক্ষমতার লোভে দেশবিভাগ,তা চটজলদি রাসায়নিক কোনোরকম বিক্রিয়ার বিষয়ই নয়।ইউরোপের দেশগুলো আমাদের দেখিয়েছে যে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে অতিক্রম করে,কিভাবে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলোকে বস্তুনিষ্ঠ সত্যের সন্ধানে নিয়ত যুক্ত থাকা যায় যা মানব সভ্যতাকে ও ইতিহাসকে প্রজ্জ্বলিত করে তুলবে আরও একএকটি মাইলসটন পেরোতে পেরোতে।লেখাটিতে,রবীন্দ্রনাথের এই প্রসঙ্গে নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে উঠে ভাবনাগুলো সত্যিই ভাবায় ও সমস্যাগুলি দূর করার যে নানান উপায় নিয়ে ভাবনা-চিন্তাও তাও সুন্দর।ওনার ওই উক্তিটি যেখানে যুযুধান বুশম্যানদের সাথে তুলনা যে দেখামাত্রই পরস্পরকে বিষাক্ত তীরে বিদ্ধ করা,প্রণিধানযোগ্য বড়ই।লেখকের নিজের বিশ্লেষণও অতি চমত্কার কোথাও কোথাও।নিত্যনতুন আবিষ্কারগুলো যে আদতে গোটা মানব জাতির কাজেই লাগে তাই কখনই কোনোভাবেই তা যে মানুষের নিজস্ব স্বার্থে তৈরী করা,কোনো একটি বিশেষ জাতির উন্নাসিক মানসিকতার নিদর্শণ ও কুক্ষিগত হতে পারে না হয় না হওয়ার কথা নয়,পড়তে পড়তে সমগ্রটিতে মুগ্ধ হই।তাই ধর্মের এখন কি আর কোনো প্রয়োজন আছে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে,এ প্রশ্নটি মাথায় উঠে আসে শেষে।মানুষের ধর্ম কেবল মনুষ্যত্ব হলে ক্ষতি টা কি লাভ ছাড়া যখন এই শতাব্দীতেও দাঁড়িয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করছি কেবলই মানুষ নিধনের খেলা,কেবলই নিষঠাবান ধর্মীয় হয়ে ওঠার সঙ্কলপ!!

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।