সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

পোলো এবং পাস্তা

পোলো এবং পাস্তা

সহস্রলোচন শর্মা

অক্টোবর ২২, ২০২০ ৯৮৫ 3

লক্ষ গল্প

সহসাই হাসির কলরোলে ভরে উঠল কারাগারের ছোট্ট ঘরটা। উপস্থিত শ্রোতার হোহো করে হেসে উঠেছেন তখন। দমফাটা হাসির দমকে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। হাসির লহরি যেন থামতেই চায় না আর। ঠোঁটে হাল্কা হাসি ঝুলিয়ে বন্দি কিন্তু তখনও রসিয়ে রসিয়ে বলে চলেছেন তাঁর কাহিনী। শ্রোতার শশব্যস্ত হয়ে হাসি চেপে চুপ করে গেলেন, পাছে গল্পের পরের অংশটা যদি শুনতে না পান তাঁরা। বন্দি বলে চলেছেন তাঁর কাহিনীর পরের অংশ। বিচিত্র সেই কাহিনী শুনে কখনও শ্রোতাদের চোখ একেবারে ছানাবড়া, তো কখনও টানটান উত্তেজনায় নিষ্পলক দু’চোখ, ঘরে পিন পড়ার নিস্তব্ধতা তখন।      

রোজ সন্ধ্যায় নিয়ম করে এই বন্দির ঘরে বসতো গল্পের আসর। জেলের অন্যান্য বন্দিদের ঘরের চাবি খুলে দেওয়া হতো তখন। সমস্ত বন্দিরা এসে জুটতেন এই বন্দির ঘরে, গল্প শুনতে। বন্দির গল্পের এমনই জাদু যে শুধু আশেপাশের বন্দিরাই নয়, কারারক্ষী থেকে শুরু করে জেলের পদস্থ কর্মচারী, এমনকি স্বয়ং জেলার সাহেবও এসে হাজির হতেন বন্দির কক্ষে। জমিয়ে বসতো গল্পের আসর। স্বয়ং জেলার ছিলেন তাঁর গল্পের একনিষ্ঠ শ্রোতা। বন্দির কোনও আখ্যান বাদ দিতেন না তিনি কখনও। কোনও কারণে জেলার সাহেব যদি অনুপস্থিত থাকতেন কোনও দিন, জেলারের অনুরোধে পরের দিন সেই কাহিনী পুনরায় বর্ণনা করতে হতো বন্দিকে। এমনই আকর্ষণ ছিল বন্দির গল্পের। বন্দির গল্পের জাদু যে শুধুমাত্র কারাগারের সুউচ্চ প্রাচীরের ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু নয়। কারাগারের পাঁচিল ভেদ করে রাজপথে, অলিতে গলিতে, বসতিতেও ছড়িয়ে পড়েছিল বন্দির গল্পের যাদু। তাঁর গল্প শুনতে জেলের বাইরে থেকেও নাগরিকরা এসে হাজির হতেন সেই কারাকক্ষে। শুধু হাজিরই হতেন না, বন্দির জন্য শুভেচ্ছা মূলক উপহারও আনতেন তাঁরা সাথে করে। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু উপহার আসতো বন্দির জন্য। এমনিতে তো কারাগারের ভিতরে উপহার আনা নিষিদ্ধই। তবে বিশেষ এই বন্দির জন্য বিশেষ ছাড় ছিল সেই নিয়মে। সেই নিয়মের জেরেই বন্দির ঘরের ফাটকও খোলা রাখা হতো অধিকাংশ সময়ে। বন্দির আচারে, ব্যবহারে, গল্প বলার দক্ষতায়, স্বর ক্ষেপণে মোহিত সবাই। প্রত্যেকেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন বন্দির আখ্যান। সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা হলো, রোজ নতুন নতুন কাহিনী বলতেন তিনি। তাঁর গল্পের ভাঁড়ার শেষই হতে চায় না যেন। কয়েক লক্ষ গল্প যেন মজুদ আছে তাঁর ভাঁড়ারে। অন্যান্য বন্দিরা তাই ‘ইল মিলিওনে’ (Il milione- The million) নামে ডাকতে শুরু করলেন এই বন্দিকে।   

বন্দি ইল মিলিওনের গল্প তো শেষ হবার মতোও নয়। কারণ, গত ২৪ বছর ধরে তিনি যে ভ্রমণ করে এসেছেন মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। ১৭ বছর তিনি কাটিয়ে এসেছেন ‘ক্যাথে’ দেশে। পাশ্চাত্যে তখন ক্যাথে নামেই পরিচিত ছিল চিন। তারপর সেখান থেকে একে একে এখনকার বার্মা, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইরান আরও কত দেশ ঘুরে হালেই ফিরেছেন দেশে। যাত্রা পথের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার সাক্ষী তিনি। ভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা কি বলে শেষ করা যায় কখনও? তাহলে লিখেই ফেলুন না- আবদার জানাতে থাকেন শ্রোতারা। অনুরোধ করেন স্বয়ং জেলারও। হুম্, লিখে ফেলার প্রস্তাবটা মন্দ নয়, মনে মনে ভাবলেন বন্দি। তাঁর বিরল অভিজ্ঞতাগুলোকে একটা লিখিত রূপ দেওয়ার কথা তাঁর মাথাতেও ঘুরছিল কিছুদিন ধরে।

ইল মিলিওনে হাতে মার্কো পোলো

বন্দি ইল মিলিওনে একদিন কারাগারের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। সহসাই আরেক বন্দির উপর নজর পড়ে তাঁর। নিবিষ্ট মনে কিছু একটা লখে চলেছেন তিনি। দুই বন্দির মধ্যে আলাপ পরিচয় হয়। পেশায় লেখক সেই বন্দির নাম রুস্তিকেল্লো। বাড়ি পিসা শহরে। প্রায় ১৪ বছর ধরে এই কারাগারে বন্দি আছেন তিনি। দীর্ঘ এই কারা জীবনের মধ্যে বসেও গল্প লিখে চলেছেন তিনি। সাধারণত রোমান্স মিশ্রিত কাল্পনিক বীরত্বের কাহিনী লিখতেন রুস্তিকেল্লো। তবে তাঁর কাহিনীর পাত্রমিত্রদের সাথে ইতিহাসের জীবন্ত চরিত্রের কিছু ছোঁয়াও থাকত কখনও সখনও। এহেন রুস্তিকেল্লোর সাথে অচিরেই গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল ইল মিলিওনের। রুস্তিকেল্লোও শুনলেন বন্ধুর বিচিত্র সেই ভ্রমণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা। সেই অভিজ্ঞতাকে বই আকারে লেখার আর্জি জানান রুস্তিকেল্লোও। প্রয়োজনে বন্ধুর হয়ে কলম ধরতে রাজি আছেন বলেও জানালেন তিনি। রুস্তিকেল্লোর অনুরোধে বই লিখতে সম্মত হলেন ইল মিলিওনে। জেলারের নির্দেশে, রুস্তিকেল্লোকে স্থানান্তরিত করা হলো ইল মিলিওনের কক্ষে। ব্যবস্থা হলো মোমবাতি, কাগজ কলমের। দুই বন্ধুর তালমিলে শুরু হলো বই লেখার কাজ। ইল মিলিওনে বলে চললেন তাঁর জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার কথা। জেলের কক্ষে বসে বন্ধুর সেই বক্তব্য নিপুণ হাতে লিপিবদ্ধ করে চললেন রুস্তিকেল্লো। প্রায় বছর খানেক ধরে চলল সেই বই লেখার কাজ। ১২৯৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে মুক্ত হন ইল মিলিওনে। ততক্ষণে অবশ্য শেষ হয়ে গেছে তাঁর বই লেখার কাজও। অন্য বন্দিদের দেওয়া ‘ইল মিলিওনে’ নামটা ভারি পছন্দ তাঁর। তাই তাঁর বইয়ের নামও তিনি দিলেন ‘ইল মিলিওনে’। জেলের সদর দরজা পেড়িয়ে, মুক্ত পৃথিবীর বুকে যেদিন পুনরায় পা রাখলেন তিনি, সেদিন তাঁর হাতে ধরা ছিল তাঁরই লেখা বই ‘ইল মিলিওনে’। যদিও পরবর্তী কালে তিনি বইটার নাম রাখেন ‘লিবঁ ডেস মেরলেই ডু মন্ড’ (Book of the Marvels of the World) । দ্রুতই ফরাসি, ল্যাটিন ও ইতালিয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় বইটার। কোথাও কোথাও আবার ‘দিভিমন ডু মন্ড’ (Description of the World) নামেও পরিচিত হয় সেই বইটা। বইটা লেখার প্রায় ৩০০ বছর পর, ১৫৭৯ সালে Most Noble and Famous Travels of Marco Polo শিরোনামে বইটার ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় লন্ডন থেকে। ততদিনে অবশ্য পৃথিবীর সব দেশেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন মার্কো পোলো। তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণ বৃত্তান্ত সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছে বিশ্ববাসীর।

অর্ধ মিথ্যা

ইতালির ভেনিস শহরে জন্ম গ্রহণ করেন মার্কো পোলো (১২৫৪-১৩২৪)। তাঁর বাবা নিকোলো পোলো এবং কাকা মাফিও পোলো যখন চিনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন, মার্কো পোলো তখনও মাতৃগর্ভে। ছোটবেলায় কখনও বাপ কাকার মুখ দেখেন নি মার্কো। অল্প বয়সেই মারা যান মা নিকোল আনা পোলো। জ্যাঠা মার্কো পোলোর (একই নাম) কাছে বড় হতে থাকেন ভাইপো মার্কো পোলো। এপ্রিল ১২৬৯, মার্কোর বয়স তখন ১৫ বছর, চিনের সম্রাট কুবলাই খানের দরবার ঘুরে, ভেনিসে প্রত্যাবর্তন করেন নিকোলো পোলো এবং মাফিও পোলো। এই প্রথম ছেলে মার্কো পোলোর মুখ দর্শন করলেন বাবা নিকোলো পোলো। মিলন হলো পিতা পুত্রের। আড়াই বছর পর, নভেম্বর ১২৭১ সালে, ফের চিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন নিকোলো পোলো এবং মাফিও পোলো। এবার তাঁদের সঙ্গী হলেন ১৭ বছরের তরুণ মার্কো পোলো। দুর্গম ও দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে, ১২৭৫ সালের মে মাসে কুবলাই খানের দরবারে ফের হাজির হলেন তাঁরা। সপ্রতিভ তরুণ মার্কো পোলোর বুদ্ধিমত্তা মুগ্ধ করে রাজাকে। মার্কোকে তাঁর রাজ্যের দূত নিযুক্ত করেন কুবলাই খান। ইতিহাসবিদরা বলেন, জাতে মোঙ্গল কুবলাই খান চিনা কর্মচারীদের উপর বিশেষ ভরসা করতেন না। চিনাদের থেকে পাশ্চাত্যের বিদেশিরা অধিক ভরসার পাত্র ছিলেন তাঁর কাছে। সম্রাট কুবলাই খানের দূত হিসেবে, চিনের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয় মার্কোকে। চিন ছাড়াও এই সময়ে তিব্বত, বার্মা, (উত্তর-পূর্ব) ভারতেও যান মার্কো পোলো। প্রায় ১৭ বছর চিন দেশের রাজদরবারে অতিবাহিত করার পর, ১২৯২ সালের প্রথম দিকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ ধরেন পোলো পরিবার। স্বদেশ ত্যাগের ২৪ বছর পর, ১২৯৫ সালের শীতকালে ভেনিসে প্রত্যাবর্তন করেন পোলো পরিবার।    

১২৯৫ সালে যখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন পোলো পরিবার, ভেনিসের আকাশে তখন দুর্ভোগের ঘনঘটা। কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ভেনিস-জেনোয়া (১২৯৪-১২৯৯) যুদ্ধ। ব্যবসা, কর, জলপথের দখল, নগর রাষ্ট্রের প্রতাপ, হারের বদলা ইত্যাদি বিবিধ কারণে এমনিতেই ইতালির নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিবাদ ও যুদ্ধ লেগেই থাকত এই সময়ে। তেমন ভাবেই শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় ভেনিস-জেনোয়া যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন, ১২৯৮ সালে প্রায় ৭০টা রণতরী নিয়ে (অধুনা ক্রোয়েশিয়ার) কোরচুলা দ্বীপ আক্রমণ করে জেনোয়া বাহিনী। কোরজুলা তখন ভেনিসের অধীনস্থ অঙ্গরাজ্য ছিল। এখানে আবার পোলো পরিবারের বড় ব্যবসাও ছিল। সেই সূত্রে, বেশ কিছু ইতিহাসবিদ দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, ভেনিসে নয়, করচুলাতেই জন্মে গ্রহণ করেছিলেন মার্কো পোলো। এহেন কোরচুলায় জেনোয়ার আক্রমণ ঠেকাতে উদ্যোগী হয় ভেনিস। জেনোয়ার আক্রমণের জবাবে, প্রায় ৯৫টা (মতান্তরে ৯৮টা) রণতরীর এক বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে কোরচুলার অভিমুখে রওনা দেন তাঁরা। ভেনিস-জেনোয়ার এই কোরচুলা যুদ্ধে স্বদেশের হয়ে যুদ্ধে নামেন মার্কো পোলো। ভেনিসের একটা রণতরীর ‘সোপ্রাকোমিতো’ (কম্যান্ডার বা ক্যাপ্টেন) পদের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ৬ই সেপ্টেম্বর ১২৯৮, পড়ন্ত বেলায় কোরচুলার জলভাগে মুখোমুখি হয় ভেনিস ও জেনোয়ার নৌবহর। সন্ধ্যা নেমে আসায় সেই দিন আর শুরু হয় নি যুদ্ধ। পরদিন, ৭ই সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন দু’পক্ষ। শুরুর দিকে ভেনিসের আক্রমণের ধার বেশি হলেও, পাল্টা আক্রমণে যায় জেনোয়াও। ঘটনাক্রমে, ভেনিসের বেশ কয়েকটা জাহাজ অগভীর জলে আটকে যায়। সেই সময়ে ভেনিসের বেশ কয়েকটা রণতরী দখল করে নেয় জেনোয়া বাহিনী। দখল করা সেই রণতরীর মুখ ঘুড়িয়ে ভেনিসের বিরুদ্ধেই তাঁদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করে জেনোয়া বাহিনী। আর এতেই বাজি জিতে নেয় তাঁরা। বিকেলের মধ্যেই ভেনিসের প্রায় সবকটা রণতরী কব্জা বা ধ্বংস করে ফেলে জেনোয়া। মাত্র এক বেলার যুদ্ধে জেনোয়ার হাতে বিধ্বস্ত হয় ভেনিসের বিশাল বাহিনী। ৭০০০ ভেনিস যোদ্ধাকে বন্দি (মতান্তরে হত্যা) করা হয়। ধরা পড়েন মার্কো পোলো। বন্দি করা হয় তাঁকে। সমস্ত বন্দিদের সাথে জেনোয়া শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। জেনোয়া শহরের জেলে বসেই তাঁর চিন ভ্রমণের বিখ্যাত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন পোলো।     

কোরচুলা যুদ্ধের ১৪ বছর আগের কথা। একই কারণে পিসা নগরীর সাথেও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল জেনোয়া বাহিনী। ৬ই অগস্ট ১২৮৪ সালে পিসা-জেনোয়ার ‘মেলোরিয়া যুদ্ধ’-এ যুদ্ধে পরাজিত হয় পিসা। এই যুদ্ধেই বন্দি হন পিসার বাসিন্দা রুস্তিকেল্লো। অন্যান্য বন্দিদের সাথে তাঁকেও স্থানান্তরিত করা হয় জেনোয়ার কারাগারে। ১২৮৮ সালে পিসা-জেনোয়ার সন্ধি ও বন্দি মুক্তির উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ফলে দীর্ঘদিন কারাবাস করতে হয় রুস্তিকেল্লোকে। সেই তুলনায় অবশ্য বেশিদিন কারা জীবন ভোগ করতে হয় নি মার্কো পোলোকে। মার্কো বন্দি হবার ৯ মাসের মধ্যেই, ২৫শে মে ১২৯৯ সালে ভেনিস-জেনোয়া সন্ধি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এবার আসে বন্দি মুক্তির পালা। ১৮ই জুলাই ১২৯৯, বন্দি মুক্তির লিখিত নির্দেশ আসে জেনোয়ার কারাগারে। ১২৯৯ সালের ৩১শে জুলাই(?) জেল থেকে মুক্ত হন মার্কো। যদিও, সঠিক কবে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তবে ১২৯৯ সালের অগস্ট মাসে তিনি যে ভেনিসে ছিলেন এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই কারও।    

জেল থেকে বেরনোর সময়, রুস্তিকেল্লোর হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপিটা সাথে করে নিয়েই বেড়িয়ে ছিলেন মার্কো। দীর্ঘদিন ধরে এই পাণ্ডুলিপিটা নিজের সংগ্রহেই রেখে দিয়েছিলেন তিনি। ১৩০৭ সালে মূল পাণ্ডুলিপিটার বেশ কয়েকটা প্রতিলিপি তৈরি করা হয়। সম্ভ্রান্ত কিছু ইতালিবাসীর হাতে পৌঁছয় সেই প্রতিলিপি গুলো। সেই সূত্রেই, সামনে আসে মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত। পাণ্ডুলিপি প্রকাশের পর, লোক মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা। চাহিদা বাড়তে থাকে তাঁর বইয়ের। তাঁর বইয়ের আরও কয়েকটা প্রতিলিপি প্রস্তুত হতে থাকে। ক্রমেই সারা ইউরোপে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পোলোর ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা। প্রায় রাতারাতি খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যান পোলো। হুহু করে বাড়তে তাঁর বইয়ের চাহিদা। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় বইয়ের প্রতিলিপি প্রস্তুত করা নিয়ে। মূল পাণ্ডুলিপিটা ফ্রাঙ্কো-ইতালিয় ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন রুস্তিকেল্লো। ফ্রাঙ্কো-ইতালিয় একটা আঞ্চলিক ভাষা। ১৩-১৪ শতকে উত্তর ইতালির ভেনিস ও আরও দু’একটা অঞ্চলে এই ভাষা প্রচলিত ছিল। মূলত লেখ্য ভাষা হিসেবে ব্যবহার হতো এই ভাষা। সাধারণত এই ভাষায় কথা বলতেন না ভেনিসবাসীরা। ফলে পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি প্রস্তুত করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় বহু ভেনিসবাসীকেও। কারণ সব শব্দের মানে বুঝতে পারছেন তাঁরাও। কথা বলার সময়ে এমন শব্দ তো ব্যবহার করেন না তাঁরা। ভাষা বুঝতে না পারায় বেশ কিছু অংশে আন্দাজ মতো মন গড়া প্রতিশব্দ ব্যবহার করা শুরু হয়। এতেই শুরু হয় বিভ্রান্তি, গরমিল। কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে লেখা হতে থাকে প্রায় সব প্রতিলিপিগুলোই। প্রায় প্রত্যেকটা প্রতিলিপির বয়ান অন্যটার থেকে বেশ কিছুটা আলাদা হতে শুরু করে। মার্কো পোলোর লেখা বইটার, আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫০টা এমন প্রতিলিপির হদিশ পাওয়া গেছে, যাদের প্রত্যেকের বয়ানে কিছু না কিছু পার্থক্য রয়েছে, রয়েছে মতভেদ। আর এদের মধ্যে কোনটা যে মূল লেখা আজ আর তা জানার কোনও উপায়ও নেই। কারণ এটা স্পষ্ট, রুস্তিকেল্লোর হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপিটা খোয়া গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে। ছাপাখানা আবিষ্কারের পর, মার্কোর বইটা ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় সেই পাণ্ডুলিপি নিয়েই। কোন পাণ্ডুলিপিটাকে অনুসরণ করে ছাপা হবে বই? বিভিন্ন প্রকাশকরা যে পাণ্ডুলিপিকে প্রামাণ্য বলে বিবেচনা করেছেন, তাঁরা সেই পাণ্ডুলিপিকে অনুসরণ করে মার্কোর বই প্রকাশ করেছেন। ফলে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত মার্কোর বইগুলোর মধ্যেও অনেকটাই ফারাক রয়ে গেছে আজও।

মার্কো পোলো ভেড়া: ওভিস এমন পোলিয়াই

সমস্যা শুধু পাণ্ডুলিপিকে ঘিরেই তৈরি হয় নি, সমস্যা তৈরি হয়েছে মার্কোর বয়ানকে ঘিরেও। তাঁর বইতে এমন সব ঘটনার উল্লেখ করেছেন মার্কো যার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। মার্কো নাকি দৈত্যর দেখা পেয়ে ছিলেন বলে দাবি করেছেন। সবাই জানেন দৈত্য একটা কাল্পনিক চরিত্র মাত্র, অথচ মার্কো বেমালুম বলে দিলেন, তিনি দৈত্যর দেখা পেয়েছিলেন! এছাড়াও অদ্ভুত প্রকৃতির হাতি, বাঁদর, কুমিরের বর্ণনাও করেছেন মার্কো। মার্কো বর্ণিত এই সমস্ত প্রাণীগুলো কাল্পনিক বলেই কথিত। এই প্রাণীগুলোকে কি ভাবে দেখলেন তিনি? এই নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। বিতর্ক আছে অন্যান্য বিষয় নিয়েও। মার্কোর বইটা পড়ার পর অনেকেই দেখেন, চিনের বিখ্যাত প্রাচীরের কোনও উল্লেখই নেই বইটাতে! মার্কোর চিন ভ্রমণের ১৫০০ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল চিনের প্রাচীর। জগৎজোড়া খ্যাতি তখন সেই প্রাচীরের। ১৭ বছর চিনে  অতিবাহিত করেছেন মার্কো। অথচ তাঁর বর্ণনা থেকে বাদ পড়ল চিনের প্রাচীর? কুবলাই খানের দূত হিসেবে বহু জায়গা ঘুরেছেন তিনি। অথচ প্রাচীন ও বিখ্যাত সেই প্রাচীর নজরে পড়ে নি মার্কোর? এটা কি কোনও বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা? শুধু চিনের প্রাচীর কেন, চিনের চা খাওয়ার রীতি, চপস্টিক দিয়ে খাওয়ার রীতি, চিনা লিপির জটিলতা নিয়েও কিছু উল্লেখ করেন নি মার্কো। আরও তো আরও, জানা যায়, মোট চারটে বিদেশি ভাষা জানতেন মার্কো- ফার্সি, আরবি, তুর্কি ও মোঙ্গোলিয়। চিনা ভাষা জানতেন না তিনি। ১৭ বছর ধরে চিনের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন মার্কো, অথচ চিনা ভাষা জানেন না তিনি! আশ্চর্য নয় এটা? তাহলে কি ভাষায় কথা বলতেন তিনি চিনাদের সাথে? সন্দেহ তো আরও গভীর হলো যখন দেখা গেল, সমসময়ের চিনের দস্তাবেজে, ইতিহাসে, সাহিত্যে কোথাও মার্কো পোলোর আগমনের কোনও উল্লেখই নেই। রাজার দূত হিসেবে যে লোকটা ১৭টা বছর অতিবাহিত করল চিনে, তাঁর উপস্থিতি নিয়ে নীরব কেন সমসময়ের চিন? একদল ইতিহাসবিদ তাই মনে করেন কস্মিনকালেও চিনে যাননি মার্কো পোলো। তাঁরা বলেন, কোনও দিনও কৃষ্ণ সাগরের ওপাড়েই যাননি পোলো। কৃষ্ণ সাগরের এপাড়েই ছিলেন তিনি। সেই সময়ে মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত লোককথার উপর নির্ভর করে তাঁর গল্প ফেঁদেছেন মার্কো। দ্বিতীয় বা তৃতীয় লোকের মুখ থেকে শোনা অভিজ্ঞতাকে নিজের অভিজ্ঞতা বলে চালিয়েছেন তিনি। আদতে মার্কো পোলো হলেন একটা মস্ত গল্পবাজ লোক।

অনেক ইতিহাসবিদই আবার মার্কোকে গল্পবাজ বলতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন মার্কো অবশ্যই চিনে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলেন, মার্কো যে কৃষ্ণসাগরের ওপাড়ে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ ‘মার্কো পোলো ভেড়া’। মধ্য এশিয়ার একটা ভেড়ার বর্ণনা দিয়েছেন মার্কো, যা ইতিপূর্বে অপরিচিত ছিল পাশ্চাত্যে। সেই ভেড়া আজও ‘মার্কো পোলো ভেড়া’ নামেই পরিচিত। ১৮৪১ সাল নাগাদ কলকাতায় কর্মরত ছিলেন ব্রিটিশ প্রাণীবিদ এডওয়ার্ড ব্লাইথ (১৮১০-১৮৭৩)। তিনিই ‘মার্কো পোলো ভেড়া’ বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন। পোলোর স্মৃতিতে তিনি সেই ভেড়ার নাম দেন ‘ওভিস এমন পোলিয়াই’। কিছু গবেষক তাই বলেন, মার্কো বর্ণিত যাত্রাপথ অনুসরণ করে শুধু মধ্য এশিয়া কেন, দিব্যি পৌঁছনো যাচ্ছে চিনে। নিজে না গিয়ে, দ্বিতীয় কারও কাছ থেকে শুনে, এমন নিখুঁত ভাবে এতো দীর্ঘ ও দুর্গম এক যাত্রাপথের বর্ণনা করা সম্ভবপর নয়। তাঁরা আরও বলেন মার্কোর চিন ভ্রমণের অকাট্য প্রমাণ হলো ‘কাগজের নোট’। কুবলাই খানের রাজত্বে কাগজের নোট ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন পোলো। ইউরোপে তখনও তামা, সোনা প্রভৃতি ধাতব মুদ্রার প্রচলন ছিল। একথা সর্বজন বিদিত যে মার্কো পোলোই ইউরোপয়ীদের কাগজের নোট ব্যবহারের কথা জানিয়ে ছিলেন। জানিয়ে ছিলেন চিন দেশের বারুদ ও বাজির ব্যবহারের কথা। একথা সবাই মানেন যে চিন থেকেই বারুদের ব্যবহার শিখেছে ইউরোপীয়রা। যদিও মার্কোর দেশে ফেরার আগেই চিন থেকে বারুদের ব্যবহার শিখে নিয়েছিলেন ইউরোপীয়রা। কিন্তু বারুদের সেই আদি যুগে মার্কোও জানিয়ে ছিলেন যে তিনি চিন দেশে বারুদ ও বাজির ব্যবহার দেখেছেন। এসব সাক্ষ্য প্রমাণ তো আর মিথ্যা নয়। 

এতৎসত্ত্বেও এখনও অনেকেই মনে করেন, অন্যর মুখ থেকে শোনা গল্পই রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করতেন মার্কো পোলো। কথিত, মার্কো বর্ণিত বেশ কয়েকটা ঘটনা নিয়ে নাকি সন্দেহ পোষণ করতেন রুস্তিকেল্লো স্বয়ং। মার্কোর সমকালীন যুগের অনেকেই মনে করতেন পাতি ঢপ মারছেন মার্কো পোলো। জেনোয়ার জেল থেকে ফিরে, ভেনিসের ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের তাঁর ভ্রমণের গল্প শোনাতেন মার্কো। কথিত, পোলোর সেই সমস্ত গল্প শুনে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরাও নাকি বলে উঠতো, “পোলো মশাই আরেকটা মিথ্যা বললেন”। অধিকাংশ ভেনিসবাসী যে তাঁর অভিজ্ঞতাকে ‘মিথ্যা’ বলে উপহাস করেন তা অজানা ছিল না স্বয়ং মার্কোরও। মার্কো পোলো তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। শেষের সেইদিন পরিজনরা এসে তাঁকে বলেন, ‘এবার তো স্বীকার করুন, বইটা একটা গল্প ছাড়া কিছুই নয়’। অন্তিমক্ষণে মার্কো পোলো বলে ওঠেন, ‘আমি যা দেখেছি তার অর্ধেকও বলিনি আমি’।

স্পাগেত্তি ও লাসানিয়ে

সমুদ্র পথে ক্যাথের (চিনের) পাশ দিয়ে চলেছে মার্কো পোলোর জাহাজ। এমন সময় এক নাবিক এসে জানায়, জাহাজে পানীয় জলের পরিমাণ অস্বাভাবিক ভাবে কমে গেছে। এখুনি একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অগত্যাই ডাঙার কাছাকাছি একটা জায়গায় নোঙর ফেলা হলো। একটা ছোটো নৌকা করে ৩-৪ জনকে স্থলের উদ্দেশ্যে পাঠানো হলো, জলের খোঁজে। সেই দলে স্পাগেত্তি নামের এক নাবিকও ছিলেন। স্থলে পৌঁছে ৩-৪ জন সদস্য ৩-৪ দিকে গেলেন জলের খোঁজ করতে। কিছুদূর এগোতেই একটা গ্রামের সন্ধান পান স্পাগেত্তি। সেখানে একটা বাড়ির উঠোনে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার দেখা পান তিনি। একটা পাত্রে ময়দা জাতীয় কিছু জিনিস মাখছিলেন তাঁরা। সেই মণ্ডকে  সরু সুতোর আকৃতি দিয়ে, টানটান করে রোদে শুকোতে দিচ্ছিলেন তাঁরা। গরম আবহাওয়ার কারণে সেই সুতোগুলো দ্রুত শুকিয়েও যাচ্ছিল। শুকনো বস্তু গুলো বেশ মচমচে বা ভঙ্গুর বলেই মনে হলো স্পাগেত্তির। সুতোর মতো সেই শুকনো খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী দেখে বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন স্পাগেত্তি। ওই খাদ্য প্রস্তুত প্রণালীতে এতোটাই মগ্ন হয়ে গেলেন তিনি যে জল সংগ্রহের কথা ভুলেই গেলেন। উল্টে, কি ভাবে ওই মণ্ড তৈরি করা হয়েছে, আর কি কি বস্তু যোগ করা হয়েছে মণ্ডর সাথে- খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার বিবরণ সংগ্রহ করতে থাকেন স্পাগেত্তি। নতুন খাদ্য প্রস্তুতির নেশায় মশগুল স্পাগেত্তি, আনন্দের সাথে জাহাজে ফিরে সবাইকে তাঁর নতুন অভিজ্ঞতার কথা বলেন। সেই দিনই ময়দা মেখে খাদ্য প্রস্তুতির পরীক্ষায় নেমে পড়েন তিনি। প্রথমে, মণ্ডটাকে লম্বা সুতোর মতো আকৃতি দিয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিলেন তিনি। অতঃপর সমুদ্রের জলে দিয়েই শুকনো সুতোগুলো সিদ্ধ করে পরিবেশন করেন সবাইকে। সমুদ্রের জলে নুনের উপস্থিতির কারণে, ভিন্ন স্বাদের সেই খাবার খেয়ে চমৎকৃত হলেন সবাই। স্পাগেত্তির নাম অনুসারে নতুন সেই খাবারের নাম রাখা হলো স্পাগেত্তি। আর সেই সূত্রেই জন্ম হলো বিখ্যাত ইতালিয় প্রস্তুতি- স্পাগেত্তি। দেশে ফিরে অনেকেই স্পাগেত্তি প্রস্তুতির কথা জানান তিনি। অচিরেই ইতালিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো নতুন খাবার- স্পাগেত্তি।   

কাহিনী শুনে কি মনে হচ্ছে, মার্কো পোলোর আরেকটা গুল্প (গুল+গল্প) এটা? না, মার্কো পোলোর কোনও গুল্প নয় এটা। তাঁর বইতে কিন্তু এমন কোনও গল্প লিখে যাননি মার্কো। তাহলে কোথা থেকে সংগৃহীত হলো মার্কো পোলোর জীবনের এমন বিচিত্র কাহিনী? মার্কো পোলো মারা যাওয়ার ৬০০ বছর পর, ১৫ই অক্টোবর ১৯২৯ সালে, ইউএসএর ‘National Pasta Association’এর মুখপত্র ‘The Macaroni Journal’এ প্রথম ছাপা হয় এই কাহিনীটা। কাহিনীটা জনপ্রিয় ও প্রচলিত ছিল। A Saga of Cathay শীর্ষক এই নিবন্ধটায় তাই কোনও লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ইতিপূর্বে মুদ্রিত আকারেও কোথাও প্রকাশিত হয় নি এই কাহিনীটা। তাই ছাপা অক্ষরে প্রকাশ হওয়ার পর পাস্তা প্রেমীদের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে এই কাহিনী। কাহিনীর সত্যতা নিয়ে উঠতে থাকে প্রশ্ন। কোথা থেকে পাওয়া গেল এই কাহিনী? উৎসাহী পাস্তা প্রেমীরা খোঁজ খবর নিতে শুরু করলেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও, এই কাহিনীর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া গেল না। জানা গেল না কাহিনীর ‘উৎস কোথায়?’ কাহিনীটাকে তাই ফালতু বকম বকম ছাড়া অন্য কোনও গোত্রেই ফেলতে রাজি হলেন না তাঁরা। ইউএসএর ‘National Pasta Association’এর মুখপত্রে কি করে এই রকম ভিত্তিহীন একটা কল্প কাহিনী ছাপা হয়েছিল তা নিয়ে আজও প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।  

যতই ভিত্তিহীন হোক এই গল্পটা, এমন কাহিনী প্রচলনের পিছনে একটা সূত্র কিন্তু রয়ে গেছে। সেই সূত্র অনুসারে, ইতালির অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় খাদ্যবস্তু পাস্তার প্রচলন করেছিলেন মার্কো পোলো। চিন থেকে মার্কো পোলো এই খাদ্য প্রস্তুত প্রণালী শিখে এসেছিলেন বলেই কথিত। তাঁর গ্রন্থে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের উৎসব, সংস্কৃতি, আচার, খাদ্য, পানীয় প্রভৃতির বিবরণ পেশ করেছেন মার্কো। চিনের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে চাল, গম, বাজরা, বার্লির উল্লেখ করেছেন পোলো। বাজরা থেকে প্রস্তুত এক বিশেষ খাদ্যর উল্লেখ করে পোলো লিখেছেন, এই খাবারটা একাধিকবার খেয়েছেন তিনি। কি সেই বিশেষ খাবার, যা একাধিকবার খেয়েছিলেন মার্কো? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মার্কোর এই খাবার আদতে- পাস্তা।

বিবিধ প্রকারের পাস্তা: তৃতীয় সারিতে লাসানিয়ে, চতুর্থ সারিতে স্পাগেত্তি

পাস্তা নিয়ে আলোচনা গড়াবার আগে, সাধারণ ভাবে পাস্তা নিয়ে দু’চার কথা বলা প্রয়োজন। ‘পাস্তা’ নামটা কিন্তু একান্তই ইতালিয়। ইতালিয় ভাষায় পাস্তা মানে Paste বা মণ্ড (এই মণ্ডর কথাই উল্লেখ করা আছে উপরের কাহিনীতেও)। পাস্তা প্রস্তুতিতে ময়দার মণ্ড প্রস্তুত করতে হয় বলে খাদ্যবস্তুটা ‘পাস্তা’ নামে পরিচিত হয়েছে। ময়দা প্রসঙ্গে বলতে হয়, সাধারণের ধারণা, শুধুমাত্র গম থেকেই প্রস্তুত করা হয় ময়দা। প্রকৃতপক্ষে, ছাল ছাড়ানো যে কোনও শস্যকে মিহি পাউডারে পরিণত করে বানানো হয় ময়দা। গম ছাড়াও ভুট্টা, বাজরা, জোয়ার, চাল, আমন্ড, চিনাবাদাম, বিন এমনকি আপেল, কলা, আলু থেকেও ময়দা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। তাঁর বইতে, বাজরা থেকে প্রস্তুত ময়দার কথা উল্লেখ করেছেন মার্কো।  

পাস্তা প্রস্তুতি যে কোনও প্রকার ময়দাকে তেল, নুন ও ডিম সহযোগে অথবা শুধু জল দিয়ে মেখে প্রস্তুত করা হয় ময়দার মণ্ড। প্রস্তুত করা মণ্ডকে নানা আকৃতিতে বেলা হয় ও কাটা হয়। ভিন্ন ভিন্ন আকৃতিতে কাটা ময়দার টুকরো গুলোকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। প্রায় দেড় শতাধিক বিভিন্ন নামের পাস্তার প্রচলন রয়েছে বর্তমানে। স্পাগেত্তি, লাসানিয়ে, ম্যাকারনি, ভেরমিচেলি, লিনগুইনি, নচি, ফারফাল্লে ইত্যাদি ইত্যাদি হলো বিভিন্ন আকৃতির পাস্তার নাম। অর্থাৎ, পাস্তা মানে নির্দিষ্ট কোনও একটা খাদ্যবস্তু বোঝায় না। হরেক নামের ও হরেক আকারের টুকরোকে একত্রে পাস্তা বলা হয়। পাস্তার আকার বা নাম যাই হোক না কেন, সমস্ত রকমের পাস্তাকে প্রথমে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এই শুকনো পাস্তাকে রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রথমে গরম জলে সেদ্ধ করে নেওয়া হয় সমস্ত রকমের পাস্তাকে। জলের বদলে দুধও ব্যবহার করা যেতে পারে। জলেই হোক বা দুধে, সেদ্ধ পাস্তাকে উপযুক্ত ভাবে গার্নিস করে খাওয়া যেতে পারে। জলে সেদ্ধ করা পাস্তার জল ঝরিয়ে, সেদ্ধ পাস্তাকে ফের তেলে দিয়ে ভাজা যেতে পারে। ভাজার সময় কড়ায় প্রয়োজন মতো নুন, লঙ্কা, হলুদ, মরিচ, জিরে, ধনে, আদা, টমেটো, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, পার্সলে পাতা, সেদ্ধ ব্রোকোলি, বিট, গাজর, চিকেন, মটন, সস, চকোলেট, দুধ ইত্যাদি দিয়ে হরেক স্বাদের পাস্তা প্রস্তুত করা হয়। উপকরণ ও রন্ধন প্রণালী ভেদে অন্তত ৩৫০ রকমের পাস্তা ডিশ চালু আছে বিভিন্ন দেশে। স্থূল অর্থে এরা সবাই কিন্তু পাস্তা নামেই পরিচিত।    

এখন প্রশ্ন হলো, বিভিন্ন জাতের এই পাস্তার সমস্ত মধ্য ঠিক কোন জাতের পাস্তার প্রবর্তন করেছিলেন মার্কো পোলো? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে সরাসরি ইতিহাসের পাতায় ডুব দেওয়া যাক। চিনে গিয়েই যে পাস্তা প্রস্তুতি শিখেছিলেন মার্কো, তা প্রথম দাবি করেন ভেনিসবাসী ভূগোলবিদ লেখক জোভান্নি বাতিস্তা রামুসিয়ো (১৪৮৫-১৫৫৭)। রামুসিয়োর মৃত্যুর দু’বছর পর, ১৫৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা বই ’Navigations and Travels’-এর দ্বিতীয় খণ্ড। এই বইতে ইউরোপের বিশিষ্ট পরিব্রাজক ও ভূগোলবিদদের জীবনী ও রচনাংশ প্রকাশ করেন রামুসিয়ো। ইতালিয় ভাষায় লেখা সেই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে মার্কো পোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্তও লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। সেই বইতে মার্কোর বয়ানে তিনি লিখেছেন- ‘ক্যাথে ও মাঞ্জিতে ধান ও বাজরা যে পরিমাণে উৎপন্ন হয় সেই হারে গম উৎপন্ন হয় না। গম যা সংগ্রহ করতেন, লাসানিয়ে ও অন্যান্য প্রকার পাস্তা তৈরিতে তা ব্যবহার করতেন তাঁরা’। এই বয়ানে স্পষ্ট ভাষায় ‘লাসানিয়ে’র উল্লেখ করেছেন রামুসিয়ো। এই বয়ানে এটা স্পষ্ট যে চিন থেকেই পাস্তা প্রস্তুতি শিখে এসেছিলেন মার্কো। পাশাপাশি চিন থেকেই ‘অন্যান্য প্রকার পাস্তা’ প্রস্তুতিও শিখেছিলেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও ‘অন্যান্য প্রকার পাস্তা’ বলতে, ঠিক কোন প্রকারের পাস্তার কথা বোঝাতে চাইছেন রামুসিয়ো তার অবশ্য আর কিছুই উল্লেখ করেন নি তিনি। ফলে রামুসিয়ো উল্লিখিত ‘অন্যান্য প্রকার পাস্তা’ নিয়ে একটা রহস্য রয়েই গেছে। এই ‘অন্যান্য প্রকার পাস্তা’র প্রশ্নটাই কিন্তু ঘুরতে থাকে পাস্তা প্রেমীদের মাথায়। রামুসিয়ো বর্ণিত সেই ‘অন্যান্য প্রকার পাস্তা’র রহস্য সমাধানে উদ্যোগী হলেন অনেকেই। অনেকেই নানা রকমের আন্দাজ করতে শুরু করলেন। সেই আন্দাজের ফসলই হলো উপরের ‘স্পাগেত্তি’ কাহিনী। স্পাগেত্তি দেখতে হয় সুতো বা কাঠির মতো, যার সাথে চিনের নুডুলসের ভীষণ মিল রয়েছে। চিনের ঐতিহ্যময় ও জনপ্রিয় খাদ্য হলো নুডুলস। বহু প্রাচীন কাল থেকেই নুডুলস খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় চিনের ইতিহাসে। উপরের কাহিনীতে চিনের কোনও গ্রামে সুতোর মতো নুডুলস প্রস্তুতির কথাই যে উল্লেখ করা হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারও। সুতো আকৃতির শুকনো খাদ্যবস্তুকে জলে ফুটিয়ে খাওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে কাহিনীতে। কি হতে পারে, ময়দার মণ্ড থেকে প্রস্তুত সেই সুতোর মতো শুকনো খাদ্য, যা জলে ফুটিয়ে খেতে হয়? নুডুলস! নুডুলস!! নুডুলস ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না। বলা হয়ে থাকে, স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে সাথে করে প্রচুর পরিমাণে নুডুলসও নিয়ে এসেছিলেন মার্কো পোলো। দেশে ফেরার পর এলাকার মানুষ জনকে এই নুডুলস প্রস্তুতি কথা জানিয়ে ছিলেন তিনি। কালক্রমে সেই নডুলস থেকেই জন্ম নেয় ইতালির নিজস্ব প্রস্তুতি- স্পাগেত্তি। লক্ষ্য করে দেখবেন, বিবিধ রকমের পাস্তার মধ্যে, উপরের কাহিনীতে কিন্তু শুধুমাত্র স্পাগেত্তি প্রস্তুতির কথাই বলা হয়েছে। স্পাগেত্তির সাথে নুডুলসের সাদৃশ্য দেখেই রচিত হয়েছে উপরের কাহিনী। তবে সেই কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্য কোনও সূত্রর হদিশ অবশ্য পাওয়া যায় নি আজও।

বিজয় দিবস

চিন থেকে লাসানিয়ে ও অন্যান্য প্রকার পাস্তা প্রস্তুতি শিখে এসেছিলেন মার্কো পোলো- তাঁর নিজের লেখা বইতে এমন কথাই জানিয়ে গেছেন রামুসিয়ো। রামুসিয়োর এই দাবি কিন্তু মানতে নারাজ অনেকেই। তাঁরা বলেন মার্কোর বইয়ের ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেছেন রামুসিয়ো। মার্কোর লেখা বইয়ে অনেক বাক্যর অর্থই স্পষ্ট নয়। সেই অস্পষ্ট অংশকেই ব্যবহার করেছেন রামুসিয়ো। রামুসিয়োর বইয়ের জবাবে, পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাঁরা বলেন, মার্কো পোলোর জন্মের বহু আগে থেকেই ইতালিতে পাস্তা খাওয়ার প্রচলন ছিল। রোমান কবি হরাসের (৬৫-৮ খৃঃপূঃ) রচনাংশ উদ্ধৃত করে তাঁরা দেখান, খৃস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকেই লাসানিয়ে খাওয়ার প্রচলন রয়েছে ইতালিতে। এই প্রসঙ্গে হরাসের ‘স্যাটায়ারস্’ (Satires) গ্রন্থ থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধৃত করেন তাঁরা। ‘স্যাটায়ারস্’ একটা ব্যঙ্গাত্মক গ্রন্থ। এই গ্রন্থে রাজনৈতিক ও সামাজিক উচ্চাশাকে বিদ্রূপ করে নিজের মতো করে বাঁচার কথা লিখেছেন হরাস। স্যাটায়ারসে লাসানিয়ে সংক্রান্ত সেই বিখ্যাত লাইনগুলোর ভাবানুবাদ এই রকম : ‘আমি আমার খচ্চরের পিঠে চেপে বহুদূর যেতে পারি। … ও মহান সেনেটর, তোমার ও তোমাদের মতো সহস্রজনের থেকে অনেক ভালো আছি আমি। আমি নিজের মর্জি মতো ঘুরি, ভেষজ ও রুটির দর করি, সার্কাসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই, সন্ধ্যাবেলায় রাস্তার ধারে বসা জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎ বাণী শুনি, অতঃপর বাড়ি ফিরে এক প্লেট লিক, ছোলা ও লাগানিক খাই’। এই ছত্রটাতেই লাসানিয়ে প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে বলে দাবি করেন অনেকে। ওই যে, বাড়ি ফিরে ‘লাগানিক’ (laganique) খাওয়ার কথা বলেছেন হরাস। লাগানিকই হলো ইতালির জনপ্রিয় খাদ্য লাসানিয়ে, এমনটাই দাবি করেন কেউ কেউ। ‘লাগানিক’ মানে যে ‘লাসানিয়ে’ এমন দাবির সাথে মোটেও সহমত নন ভাষা বিজ্ঞানীরা। কারণ, প্রাচীন ইতালীয় অভিধানে ‘লাগানিক’ শব্দটার কোনও হদিশ পাননি তাঁরা। ফলে ‘লাগানিক’ কথাটার অর্থ মোটেও স্পষ্ট নয় এখানে। ঠিক এই কারণেই, স্যাটায়ারস্ অনুবাদের সময়, এক এক জন অনুবাদক এক এক অর্থে ব্যবহার করেছেন ‘লাগানিক’ শব্দটাকে। কারও মতে ‘লাগানিক’ মানে শামুক, কারও মতে ‘লাগানিক’ মানে প্যানকেক, আবার কারো মতে ‘লাগানিক’ মানে লাসানিয়ে। ‘শামুক’ বা ‘প্যানকেক’-এর মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর উপস্থিতির ফলে খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না যে ‘লাগানিক’ মানে লাসানিয়ে। সুতরাং, প্রাচীন ইতালিতে লাসানিয়ের প্রচলন ছিল- এমন সিদ্ধান্তে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে পৌঁছানো যাচ্ছে না।

প্রাচীন ইতালিতে পাস্তার প্রচলন ছিল- এই তত্ত্ব প্রমাণের জন্য, হরাসের তথ্যই তো শেষ তথ্য নয়, হরাস হলেন শুরু। হরাসের পর, ইতিহাসের অন্যান্য পাতায়ও লাসানিয়ে বা পাস্তার উল্লেখ রয়েছে বলেই দাবি করেন অনেকে। এই প্রসঙ্গে যে সমস্ত প্রমাণ হাজির করেন তাঁরা, সেই প্রমাণগুলো খুবই বিচ্ছিন্ন এবং অস্পষ্ট। সেই তথ্যসূত্র গুলোর অধিকাংশই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সেই সমস্ত সূত্রগুলোর মধ্যে মধ্যে বহুল উদ্ধৃত হলো ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিস (১১০০-১১৬৫) এর রচনাংশ। উত্তর আফ্রিকার স্প্যানিশ শহর (জিব্রাল্টারের অপর পাড়ে) কেউটায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইদ্রিস। প্রায় ১৮ বছর ধরে সিসিলির রাজা দ্বিতীয় রজারের ড্রাফটসম্যানের পদে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। আরবি ভাষায় রচিত ‘তাবুলা রজারিয়ানা’ (Map of Roger) গ্রন্থে আল-ইদ্রিস পাস্তা প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন বলে দাবি করা হয়। আল-ইদ্রিস লিখেছেন, আরব দেশ থেকে পাস্তার ব্যবহার এসেছে সিসিলিতে। দীর্ঘ মরুপথে ও জলপথে যাত্রার সময় শুকনো খাদ্য হিসেবে ‘ইট্রিয়া’ (Itriyya) বহন করতেন আরববাসীরা। এই ইট্রিয়াই হলো আদতে পাস্তা। ইদ্রিস লিখেছেন, সিসিলি দ্বীপের উত্তরাংশে অবস্থিত ত্রাবিয়া শহরে ইট্রিয়া তথা পাস্তা তৈরির কারখানা ছিল। ত্রাবিয়া শহরের পার্শ্ববর্তী পালেরমো বন্দর থেকে ইতালি ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা হতো সিসিলির পাস্তা। সিসিলি দ্বীপের উত্তরে অবস্থিত সার্দিনিয়া দ্বীপেও তৈরি হতো ইট্রিয়া তথা পাস্তা। সার্দিনিয়া দ্বীপ থেকেও পাস্তা রপ্তানি করা হতো বলে জানিয়েছেন ইদ্রিস।  

আল-ইদ্রিস উল্লিখিত ‘ইট্রিয়া’ মানে যে পাস্তা, এমন দাবি মানতে নারাজ অনেকেই। আরবি ভাষায় ‘ইট্রিয়া’র অর্থ মোটেও স্পষ্ট নয়। ইতিহাস বলে, অতি প্রাচীন কাল থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকায় গমের ভালো ফলন হতো। গমই এখানকার প্রধান ফসল। আর সেই গম থেকে আটা বা ময়দা প্রস্তুত করা ছিল এই সমস্ত অঞ্চলের অতি প্রাচীন এক রীতি। আটা বা ময়দার রুটি বা পরোটাই ছিল এই সমস্ত দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্য। সেই রকমই কোনও শুকনো খাদ্যকে ইট্রিয়া বলে থাকতে পারেন আল-ইদ্রিস। আর মার্কোর সমসময়ে তো পৃথিবীর সব দেশেই রুটি, পাউরুটি বা পরোটা প্রস্তুত করার প্রথা প্রচলিত ছিলই। এই রুটি, পাউরুটি বা শুকনো কোনো খাদ্যকে পাস্তার আদি রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন কেউ, কিন্তু এই সমস্ত খাদ্য গুলোকে কি পাস্তার স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে? পাস্তা আর রুটি, পাউরুটি বা পরোটার আকার এবং প্রস্তুত প্রণালী মোটেও এক নয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, পোলোর জন্মের পূর্বেই পাস্তার কাছাকাছি কোনও খাদ্যর প্রচলন ছিল ইতালিতে, তাহলেও একথা জোরের সাথে বলা যায় যে, সেই সময়ে সেই খাদ্য নিতান্তই আঞ্চলিক এক অভ্যাস হিসেবেই প্রচলিত ছিল মাত্র। সেই খাদ্যবস্তুর দেশজোড়া জনপ্রিয়তা আদৌ ছিল না। একথা প্রমাণিত, মার্কো পোলোর চিন থেকে প্রত্যাবর্তনের পরই ইতালি জুড়ে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে পাস্তা। ইতালিতে পাস্তার কারখানা ও দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় মার্কোর মৃত্যুর পর থেকেই। লিপিবদ্ধ সরকারী নথি অন্তত সেই তথ্যই জানান দিচ্ছে। 

মার্কোর মৃত্যুর পরই, দিনকে দিন ইতালি জুড়ে বাড়তে থাকে পাস্তার জনপ্রিয়তা। অঞ্চল ভেদে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন আকারের পাস্তা। বিভিন্ন আঞ্চলিক রীতিতে রান্না হতে থাকে বিভিন্ন পদের পাস্তা। উৎকৃষ্ট পাস্তা প্রস্তুতির প্রশ্নে, একে অপরকে টেক্কা দিতে শুরু করে ইতালির শহর গুলো। সুস্বাদু পাস্তা প্রস্তুতির প্রশ্নে শুরু হয় জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কয়েক বছরের মধ্যেই, সুস্বাদু পাস্তা বানিয়ে সংবাদ শিরোনামে উঠে নেপলস, পারমা প্রভৃতি শহর। তবে লম্বা রেসের ঘোড়া হিসেবে শেষ বাজিটা মারে দক্ষিণ ইতালির ছোটো শহর গ্র্যানিয়েনো (Gragnano)। ইতালির বিখ্যাত পম্পেই শহরের পাশে অবস্থিত গ্র্যানিয়েনো শহরের পাস্তার স্বাদ ইতালির অন্যান্য শহরের পাস্তার স্বাদের থেকে অনেকটাই আলাদা বলে স্বীকৃত। ক্রমেই চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে গ্রানিয়েনো শহরের পাস্তার। দ্রুতই খ্যাতির শিখরে পৌঁছে যায় গ্র্যানিয়েনো শহরের পাস্তা। গ্র্যানিয়েনো শহরের ভৌগলিক অবস্থান, জলের গুণ ও আবহাওয়াই তার পাস্তার স্বাদকে অনন্য করে তুলেছে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আধুনিক যুগে প্রবেশ করে, তাদের পাস্তার জন্য ‘ঐতিহ্যময়’ তকমা দাবি করে গ্র্যানিয়েনো। তাঁদের সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে, ২০১৩ সালে PGI (Protected Geographical Indication) তকমা লাভ করে গ্র্যানিয়েনোর পাস্তা। সারা বিশ্ব আজ গ্র্যানিয়েনোর পাস্তার স্বাদ পেতে উদগ্রীব। আজও তাঁদের ঐতিহ্য বজায় রেখে, প্রায় ২০০ ভিন্ন ভিন্ন জাতের পাস্তা প্রস্তুত করে চলেছে গ্র্যানিয়েনো।

লোগো: ওয়ার্ল্ড পাস্তা ডে, ২৫ অক্টোবর

নির্দিষ্ট ভাবে পাস্তার জন্মস্থান ও জন্মদিন নিয়ে কিছু ভিন্ন মত থাকলেও, পাস্তার রাজ্যাভিষেক নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকতে পারে না। মার্কো পোলোর হাত ধরেই যে যৌবনে পদার্পণ করেছে পাস্তা, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ইতালিতে স্বাদের মোহ জাল বিস্তারের পর আসে পাস্তার বিশ্ব বিজয়ের পালা। তার স্বকীয় স্বাদে সারা পৃথিবীর ভোজন রসিকদের উদর জয়ে সক্ষম হয় পাস্তা। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই জনপ্রিয় খাদ্য অথবা প্রধান খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত পাস্তা। পাস্তাকে কেন্দ্র করে জমায়েত হতে থাকেন পাস্তা উৎপাদক ও পাস্তা প্রেমীরা। খাদ্যর গুণাগুণ সংক্রান্ত আধুনিক সংজ্ঞাকে মান্যতা দিয়ে, পাস্তার গুণমান বজায় রাখা, ফ্যাটের পরিমাণ কমানো, সস্তায় পাস্তা উৎপাদন প্রভৃতি লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠতে থেকে পাস্তা প্রেমীদের নিজস্ব সংগঠন। বিশ্বায়নের মুখে দাঁড়িয়ে এক আন্তর্জাতিক পাস্তা সংগঠন গড়ার চিন্তা ভাবনাও শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের ২৫ অক্টোবর, রোম শহরে প্রথম ‘ওয়ার্ল্ড পাস্তা কংগ্রেস’-এর অধিবেশন বসে। ১৯৯৮ সালে নেপলস শহরে বসে পাস্তা কংগ্রেসের দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশন। এই অধিবেশনেই (প্রথম অধিবেশনের) ২৫ অক্টোবর দিনটাকে ‘ওয়ার্ল্ড পাস্তা ডে’ হিসেবে পালনের ডাক দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ২৫ অক্টোবর দিনটা ‘ওয়ার্ল্ড পাস্তা ডে’ পালিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর একটা শহরকে বেছে নেওয়া হয় আয়োজনের মূল কেন্দ্র হিসেবে। ২০১৮ সালে দুবাই শহরে সমারোহের সাথে পালিত হয়েছে ২০তম ‘ওয়ার্ল্ড পাস্তা ডে’। তবে করোনার আবহে বাতিল করা হয়েছে এই বছরের সমস্ত আয়োজন। কিন্তু নিজেদের ঘরে বসে ‘ওয়ার্ল্ড পাস্তা ডে’ পালনে অসুবিধা কোথায়? আগামী ২৫শে অক্টোবর- দুর্গা নবমী, ভোজন রসিক বাঙ্গালিদের বড় প্রিয় দিন এইটা। ২২তম ‘ওয়ার্ল্ড পাস্তা ডে’ উপলক্ষে আমাদের খাদ্য সূচীতে কি তবে শুধুই পাস্তা থাকছে ওইদিন?      

পাদটীকা –

[১] সাধারণ ভাবে, চিনের উত্তর অংশ ‘ক্যাথে’ এবং দক্ষিণ অংশ ‘মাঞ্জি’ নামে পরিচিত ছিল।

[২] ১৫৫০ সালে প্রথম খণ্ড ও ১৫৫৬ সালে তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় বইটার। দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি পুড়ে যাওয়া সময় মতো প্রকাশ করা যায় নি দ্বিতীয় খণ্ড। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ পায় বইটার দ্বিতীয় খণ্ড।

[৩] Book I, Satire VI, line 110-115. প্রসঙ্গত, লিক হলো পেঁয়াজ জাতীয় খাদ্য।

তথ্যসূত্র –

1) The Travels of Marco Polo, Amended and enlarged by Huge Murray. Edinburgh 1845. 

2) The Travels of Marco Polo, Translated by Henry Yule 1870. Revised by Henry Cordier, Paris 1902. 

3) The Macaroni Journal, October 15 1929. Minneapolis.

4) The Works of Horace. Edited by C. Smart and T.A. Buckley. 

5) Various online sites on Pasta. 

মন্তব্য তালিকা - “পোলো এবং পাস্তা”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।