সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

চোল সাম্রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা

চোল সাম্রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা

শান্তনু ভৌমিক

ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪ ৫৪৩ 4

ভূমিকা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কয়েকটি রাজবংশকে প্রবল পরাক্রমশালী রাজবংশ বলে গণ্য করা হয়, সেই সব রাজবংশের একটি হল দক্ষিণ ভারতের চোল রাজবংশ। চোল শাসনের পত্তন হয়েছিল আনুমানিক ৮৫০ সাধারণ অব্দ নাগাদ, তামিলনাড়ুর কাবেরী বদ্বীপ অঞ্চলে। রাজধানী ছিল তাঞ্জাভুর (তাঞ্জোর)। চোল সাম্রাজ্য পরাক্রমের শীর্ষে পৌঁছেছিল সাধারণ অব্দের দশম শতকের শেষ দিকে যখন চোল সিংহাসনে আসীন হন প্রথম রাজরাজ চোল (৯৮৫-১০১৪ সাধারণ অব্দ)। পরবর্তী প্রায় ১৩০ বছর, প্রথম কুলতুঙ্গ-এর রাজত্বকাল (১০৭০-১১২০ সাধারণ অব্দ) পর্যন্ত অব্যাহত ছিল চোলদের বিজয়যাত্রা। সেই সময় দক্ষিণ ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল হয়ে গিয়েছিল চোল শাসনাধীন। চার’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজ্যপাট চালানোর পর চোল শাসনের অবসান ঘটে সাধারণ অব্দের তেরো শতকের শেষ চতুর্থাংশে। শেষ চোল শাসক ছিলেন তৃতীয় রাজেন্দ্র চোল (১২৪৬-১২৭৯ সাধারণ অব্দ) ।

চোলদের মত সুদীর্ঘ রাজত্বকালের উদাহরণ ভারতের ইতিহাসে বিরল। তাঁদের মত প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তির উদাহরণও ভারতের ইতিহাসে খুব বেশি নেই। চোলরা যখন ক্ষমতার মধ্যগগনে তখন তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণের পুরো অঞ্চলটাই তাঁদের অধীনে। আজকের তামিলনাড়ুর প্রায় পুরোটা, আজকের অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরালার একটা বড় অংশে এবং আজকের কর্ণাটকের দক্ষিণ-পূর্ব ভাগে অংশে তখন উড়ত চোল পতাকা। নিজ সাম্রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে চোলদের রাজনৈতিক প্রভাব পৌঁছে গিয়েছিল আজকের ওড়িশা এবং বাংলায়। সমুদ্র পেরিয়ে চোল পরাক্রমশীলতার ঢেউ ভাসিয়েছিল মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জকে।

এত দীর্ঘ সময় ধরে এতটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কি করে রাজত্ব করেছিলেন চোলরা? পক্ষে বিপক্ষে একাধিক কারণের উল্লেখ করেন ঐতিহাসিকরা। এইসব একাধিক কারণের একটি হচ্ছে ‘চোল প্রশাসনিক ব্যবস্থা’। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে চোল প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ যা চোলদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিকাশের সহায়ক ছিল।

চোল প্রশাসনিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল কেন্দ্রিকতা এবং বিকেন্দ্রীকরণের ভারসাম্যযুক্ত সমন্বয় যা আজকের দিনেও অনুধাবনযোগ্য। এই প্রশাসনের এক প্রান্তে যেমন ছিল সুদক্ষ কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র তেমনই অন্য প্রান্তে ছিল স্থানীয় স্বশাসন।

চোল শাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক বিভাগ

প্রশাসনিক সুবিধার জন্য চোলরা তাঁদের শাসনাধীন অঞ্চলকে অনেকগুলি মণ্ডলম-এ বিভক্ত করেছিলেন। মণ্ডলমগুলো বিভক্ত হত একাধিক ভালানাড়ুতে। এক একটি ভালানাড়ুর অধীনে থাকতো একাধিক নাড়ু (স্থানভেদে কোট্টাম বলে উল্লিখিত হয়)। নাড়ুর নিম্নবর্তী প্রশাসনিক বিভাগ ছিল গ্রাম এবং ছোট শহর। গ্রাম এবং ছোট শহর ছিল বহুস্তরীয় চোল প্রশাসনিক ব্যবস্থার বুনিয়াদি ভিত্তি। সাধারণত দশটি গ্রাম এবং একটি-দুটি ছোট শহর নিয়ে গঠিত হত নাড়ু। যদি কোন গ্রামের আয়তন খুব বড়ো এবং লোকবসতি খুব বেশি হত তখন সেই একটি গ্রামকে নিয়েই তৈরি হত একটি নাড়ু। সেইরকম বড়ো গ্রামকে বলা হত তানিয়ার।

প্রথম রাজরাজ চোলের শাসনকালের শেষদিকে, চোল সাম্রাজ্যের মণ্ডলমের সংখ্যা ছিল আট, যার মধ্যে একটি ছিল শ্রীলঙ্কার চোলশাসিত অঞ্চল। সেই সময় ভালানাড়ুর সংখ্যা ছিল দশ। পরবর্তী চোল শাসকদের সময় মণ্ডলমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। তবে ভালানাড়ুর সংখ্যা পরবর্তীকালে বৃদ্ধি পেয়ে দ্বাদশ শতকের গোড়ায় পনেরো হয়েছিল। প্রসঙ্গত প্রথমদিকের চোল রাজাদের রাজত্বকালে প্রশাসনিক বিভাগ হিসাবে ভালানাড়ুর অস্তিত্ব ছিল না। প্রথম রাজরাজ চোল মণ্ডলম এবং নাড়ুর অন্তর্বর্তী প্রশাসনিক বিভাগ হিসাবে ভালানাড়ুর প্রবর্তন করেছিলেন।  

চোল প্রশাসনিক ব্যবস্থার বুনিয়াদি ভিত্তি গ্রাম এবং ছোট শহরগুলি ছিল স্বশাসিত। গ্রামের প্রশাসনিক কাজের ভার ন্যস্ত থাকতো পঞ্চায়েতের ওপর। ছোট শহরের প্রশাসন চালাতো নগরম।  

গ্রাম পঞ্চায়েত

চোল রাজত্বে গ্রাম ছিল দু-ধরণের – উর এবং ব্রহ্মদেয়। ব্রহ্মদেয় গ্রামে শুধু ব্রাহ্মণরা বসবাস করতেন । উর গ্রামে বসবাস করতেন বাকি সব জাতের লোকেরা। চোল শাসনাধীন অঞ্চলে ৭৫% গ্রাম ছিল উর এবং ২০% গ্রাম ছিল ব্রহ্মদেয়। উর গ্রামের পঞ্চায়েতকে বলা হত উরার। ব্রহ্মদেয় গ্রামের পঞ্চায়েতকে বলা হত সভা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই গ্রামে উরার এবং সভা, দুটোই থাকতো। এইসব ক্ষেত্রে গ্রামটি প্রাথমিকভাবে ছিল ব্রাহ্মণ ব্যতিরেক অন্যান্য জাতের মানুষের বসতি। পরবর্তীকালে, রাজাদেশে সেইখানে ব্রাহ্মণদের বসতি স্থাপিত হয়। তখন একই গ্রামে গঠিত হয় দু’টো পৃথক পঞ্চায়েত। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে, যেমন ১২২৭ সাধারণ অব্দে, সত্যমঙ্গলম গ্রামে গঠিত হয়েছিল দু’টি উরার – একটি গ্রামের হিন্দু অধিবাসীদের জন্য এবং অন্যটি গ্রামের জৈন অধিবাসীদের জন্য।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়, ব্রহ্মদেয় গ্রামগুলি সম্ভবত উপরোল্লিখিত প্রশাসনিক বিভাগ নাড়ুর আওতায় আসতো না। এই গ্রামগুলির পঞ্চায়েত অর্থাৎ সভা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে সরাসরি কাজকর্ম চালাতো। নাড়ু গঠিত হোক উর এবং ছোট শহরের সমন্বয়ে।

সভা ও সমিতি

চোল আমলের বিভিন্ন লেখ থেকে সভা সম্পর্কে বহুল তথ্য পাওয়া গিয়েছে। এই সব তথ্যের ভিত্তিতে মনে করা হয় যে সভার গঠন ছিল বেশ বিস্তৃত এবং ক্ষেত্রবিশেষে জটিল।

গ্রামের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ছিলেন সংশ্লিষ্ট সভার সদস্য এবং তাঁরা সভার বৈঠকে যোগদান করে নিজস্ব মতামত দিতেন। তবে বয়োজ্যেষ্ঠদের মতামতই এইসব বৈঠকে প্রাধান্য পেত। সভার বৈঠক সম্ভবত ঢোল বাজিয়ে ডাকা হত। সভার বৈঠকে কোনরকম ভোটাভুটি হতো কিনা বা সভার বৈঠকের বৈধতার জন্য গ্রামবাসীদের ন্যূনতম উপস্থিতির দরকার ছিল কি না – এইসব বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। সময়বিশেষে সভার বৈঠক রাতেও হতো।

সভা নিজের দায়িত্ব পালন এবং কার্য সম্পাদনের  জন্য এক বা একাধিক সমিতি গঠন করতো। এই সমিতিগুলোকে বলা হত ভারিয়াম। প্রত্যেকটি সমিতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকতো। যেমন তামিলনাড়ুর উত্তরামেরুর গ্রাম থেকে পাওয়া এক লেখ থেকে জানা যায় যে সেচকার্যের জন্য ব্যবহৃত এক গুরুত্বপূর্ণ পুষ্করিণীর দেখভাল করার জন্য সেখানকার সভা এক সমিতি (এরি-ভারিয়াম) গঠন করেছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোন একটি বিশেষ কাজের জন্য স্থানীয় সভার অধীনে একটি সমিতি গঠন করে দিত। যেমন তামিলনাড়ুর মহেন্দ্রমঙ্গলমের এক মন্দিরের কর্তৃপক্ষ মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে অপারগ হলে, মন্দির দেখভালের জন্য স্থানীয় সভার অধীনে এক সমিতি গঠন করা হয়েছিল। প্রদেয় দায়িত্বের প্রকৃতি অনুসারে সমিতি কোন কোন ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে গঠন করা হতো আবার কখনও কখনও একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য গঠন করা হতো।

কোন সভা কতগুলো সমিতি গঠন করবে তা সেই নির্দিষ্ট সভাই ঠিক করতো। এই বিষয়ে সরকারি প্রশাসন পারতপক্ষে নাক গলাতো না। আমানী-নারায়ণ-চতুর্বেদী-মঙ্গলম গ্রামের সভা ৯’টি সমিতি গঠন করেছিল। তিরুপ্পারকাদালে প্রাপ্ত ৯১৯ সাধারণ অব্দের এক লেখ থেকে জানা যায় যে সেখানকার সভা চার’টি সমিতি গঠন করেছিল।

যে কেউ সমিতির সদস্য হতে পারতো না। সমিতির সদস্য হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু যোগ্যতা থাকা দরকার ছিল। সভাই নির্ধারণ করতো এই যোগ্যতাবলী। যেমন তামিলনাড়ুর তেন্নারি থেকে প্রাপ্ত ৯৯৬ সাধারণ অব্দের এক লেখ থেকে জানা যায় যে উত্তমচোল-চতুর্বেদী-মঙ্গলম গ্রামের সভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সেই সব ব্যক্তি যারা মন্ত্র-ব্রাহ্মণ অধ্যয়ন করেছিলেন শুধুমাত্র তারাই সমিতির সদস্য হওয়ার এবং সভার সমাধানের খসড়া প্রস্তুত করার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সাথে এইটাও বলা হয়েছিল যে সভার এই সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করা রাজাদেশ ভঙ্গ করার সামিল হবে। ওই একই লেখ থেকে জানা যায় যে উপরোক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দু’মাস পরে সভা নতুন সিদ্ধান্ত নেয় যে যদি কোন ব্যক্তি ব্রাহ্মণের সম্পত্তি চুরি করে থাকেন বা আরও গুরুতর কোন অপরাধ করে থাকেন তাহলে তিনি সমিতির সদস্য হতে পারবেন না।

সমিতির গঠন সম্পর্কিত সবচেয়ে বিস্তৃত বিবরণী পাওয়া গিয়েছে উত্তরামেরুর অঞ্চলে প্রাপ্ত এক লেখ থেকে। সেই লেখ অনুযায়ী ৯১৯ সাধারণ অব্দে প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালে স্থানীয় এক সভা রাজপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে সমিতি গঠন করেছিল। ওই গ্রামে ছিল ৪০টি পাড়া (কুড়ুম্বু) এবং ১২টি রাস্তা। সমিতির সদস্য নির্বাচনের প্রথম ধাপে প্রত্যেকটি পাড়া এবং রাস্তা সন্নিহিত অঞ্চল সমিতির সদস্য হওয়ার মাপকাঠি মেনে নিজেদের প্রতিনিধি মনোনীত করেছিলেন। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে থেকে সমিতির পাঁচ সদস্য বেছে নেওয়া হয়েছিল লটের মাধ্যমে। এইভাবে সমিতির সদস্য নির্বাচন করার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যাতে গ্রামের সব অংশের মানুষের সামনে সুযোগ থাকে সমিতিতে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠানোর। তা নিশ্চিত করার জন্যই রাজার নির্দেশে সমিতি গঠন প্রক্রিয়ার পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন রাজপ্রতিনিধি। ওই একই লেখ অনুযায়ী, উপরোক্ত সমিতি গঠনের দু’বছরের মধ্যে সেই সমিতি পুনর্গঠিত হয়েছিল। তবে সেই সময় প্রাথমিক মনোনয়নের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল শুধু পাড়াগুলিকে। তার সাথে কোন একটি নির্দিষ্ট পাড়া কাকে প্রাথমিক অনুমোদন দিতে পারে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং নির্দেশিকাও দেওয়া হয়েছিল সেই সময়। সমিতির এই পুনর্গঠনও সম্পন্ন হয়েছিল রাজপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে এবং রাখা হয়েছিল পুরো পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার লিখিত বিবরণী (ব্যবস্থা)। উত্তরামেরুর ওই লেখ থেকে আরও জানা যায় যে তার পরের বছর অর্থাৎ ৯২২ সাধারণ অব্দে, সভা তার অধীনস্থ স্বর্ণ-সমিতিকে (পণ-ভারিয়াম, ‘পণ’ শব্দের মানে হল সোনা)  সহায়তা করার জন্য গ্রামের একটি নির্দিষ্ট পাড়া থেকে সোনার গুণমান নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ এবং নিয়মিত কর প্রদান করে এই রকম আটজনকে নিয়ে একটি কর্মীদল গঠন করেছিল। স্বর্ণ-সমিতির কাজ ছিল সোনার গুণমান নির্ধারণে গ্রামের সবাইকে সহায়তা করা।

চোল রাজত্বের শেষের দিকে সমিতির সদস্য হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী সম্পর্কিত নির্দেশিকা জারি করতে শুরু করে চোল প্রশাসন। আয়্যামপেত্তাই-এ প্রাপ্ত ১১৯০ সাধারণ অব্দের এক লেখ থেকে জানা যায় যে রাজেন্দ্রচোল-চতুর্বেদী-মঙ্গলম গ্রামের সমিতি গঠনোপলক্ষে রাজনির্দেশ ছিল যে শুধুমাত্র সেই সব ব্যক্তি সমিতির সদস্য হতে পারবেন যারা আগে কখনও সমিতির সদস্য হননি এবং যাদের বয়স চল্লিশের বেশি। সিদ্ধামল্লিতে প্রাপ্ত চোল শাসক অথিরাজেন্দ্রর রাজত্বকালের (১০৬৮-১০৭০ সাধারণ অব্দ) এক লেখ অনুযায়ী সমিতির সদস্য তিনভাবে হওয়া যেত – (১) রাজাদেশ অনুযায়ী ডাকা সাধারণ সভায় নির্বাচিত হয়ে; (২) শাসনপাট্টা এবং শাসনপাট্টা-মাক্কাল হলে অর্থাৎ শাসন কর্তৃক প্রদত্ত বংশানুক্রমিক অধিকার বলে এবং (৩) রাজা কর্তৃক সরাসরি নিযুক্ত হলে।

অনেক ক্ষেত্রে, সমিতি ছাড়াও পাড়াভিত্তিক ছোটো ছোটো গোষ্ঠী বা দল তৈরি হয়েছিল সেই সময়। এই গোষ্ঠীগুলি তৈরি করতেন পাড়ার বাসিন্দারা। এই গোষ্ঠী তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য হতো সমিতিতে নিজের পাড়ার লোক যাতে থাকে তা সুনিশ্চিত করা। ক্ষেত্রবিশেষে এই পাড়াভিত্তিক গোষ্ঠীকে স্বীকারও করে নিত চোল প্রশাসন। উত্তম চোল কাঞ্চিপুরমের এইরকম দুই পাড়াভিত্তিক গোষ্ঠীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন উরাগম মন্দিরের দায়িত্ব সামলানোর জন্য। প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালে উত্তরামেরুর গ্রামের সভার সমিতি কিভাবে গঠিত হবে তা ঠিক করে দিয়েছিল এই পাড়াভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি।

সমিতির সদস্যরা হতেন অবৈতনিক। তাঁরা দিনের কিছুটা সময় দিতেন সভার কাজে। সভার দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানোর জন্য সর্বক্ষণের বেতনভুক কর্মচারী থাকতো। তাঁদের বলা হত মধ্যস্থ। মধ্যস্থদের দায়িত্ব এবং বেতন সভার বৈঠকের মাধ্যমে নির্ধারিত হত। মধ্যস্থরা সভার বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন এবং বৈঠকের পরিচালনা করতেন কিন্তু আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন না। বৈঠকের আলোচনার নির্যাস লিপিবদ্ধ করে রাখতে হত মধ্যস্থদের। সম্ভবত বৈঠকে উপস্থিত কোন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বৈঠকের মূল আলোচনার মৌখিক বিবরণী দিতেন এবং তা লিখে নিতেন মধ্যস্থরা। 

মধ্যস্থ ছাড়াও আর এক শ্রেণীর বেতনভুক কর্মচারী থাকতো সভাতে। এদের বলা হত করনাট্টার। এরা ছিলেন হিসেবরক্ষক। এদের কাজ ছিল জমির পরিমাণ, তার ওপর প্রদেয় কর এবং প্রাপ্ত ও বকেয়া কর হিসেবে রাখা। সেই হিসাবে ভুল হলে এদেরকে গুনাগার দিতে হত। ১২৩৫ সাধারণ অব্দের এক লেখ থেকে জানা যায় যে ভুল কাজের জন্য জনৈক করনাট্টারকে সংশ্লিষ্ট সভার সমিতি কাজ থেকে বরখাস্ত করেছিল। শুধু তাই নয়, সেই করনাট্টার-এর আত্মীয় এবং উত্তরসূরিরা যাতে কখনও ওই পদে যোগ না দিতে পারে তার নির্দেশও দিয়েছিল সমিতি।

সভার ওপর যে মূল দায়িত্বগুলি ছিল সেইগুলি হলো:    

(১) গ্রামের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা, গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা, গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বা দলের মধ্যে কোন বিষয়ে বিবাদ বেধে গেলে তা মেটানো ইত্যাদি। কোন ব্যক্তি কোন অন্যায় করলে বা অবৈধ কাজ করলে, সেই কাজের বিচার করার, শাস্তি দেওয়ার এবং আর্থিক জরিমানা করার অধিকার ছিল সভার। জরিমানা বাবদ আদায়ীকৃত অর্থ সভা ব্যবহার করতো গ্রামের সার্বিক উন্নয়ণে।

(২) স্থানীয় প্রশাসন চালানো এবং উন্নয়নের জন্য কর ধার্য করার, তা আদায় করার এবং আদায়কৃত কর কোন নির্দিষ্ট খাতে খরচ করার ক্ষমতা ছিল সভার হাতে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে সেই স্থানীয় কর মোকুব করারও অধিকার ছিল সভার। এই সবের জন্য সভাকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অনুমতির নিতে হত না। নালুর থেকে প্রাপ্ত এক লেখ থেকে জানা যায় যে সেখানকার সভা স্থানীয় এক মন্দির থেকে কিছু অর্থ ঋণ নিয়েছিল। সেই ঋণের সুদ স্বরূপ স্থানীয় দোকানের ওপর ধার্য করা কর (অঙ্গাদিক-কুলি) চিরস্থায়ীভাবে বরাদ্দ হয়েছিল মন্দিরের জন্য।

(৩) গ্রাম কোন বিশেষ দান পেলে, সেই দানের সঠিক ব্যবহার সুনিশ্চিত করা ছিল সভার আর একটা দায়িত্ব। এই ধরণের দান সম্বন্ধীয় একাধিক লেখ পাওয়া গিয়েছে যা থেকে মনে হয় যে গ্রামীণ অর্থনীতির একটা মূল ভিত্তি ছিল এই ধরণের দান এবং সম্ভবত স্থানীয় করের মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থের তুলনায় অধিক হতো এই দানপ্রাপ্ত ধন। কোন কোন ক্ষেত্রে এই দানের পরিমাণ এতটাই বেশি হত যে দানে পাওয়া ধনসম্পত্তির দেখভাল করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সমিতি (ধৰ্ম-ভারিয়াম) গঠন করতে হত। সভা দান সম্পর্কিত শর্তাবলীর সমস্ত তথ্য যত্নসহকারে সংরক্ষণ করতো যাতে এই নিয়ে পরবর্তীকালে কোন বিতৰ্ক না হয় এবং ভবিষ্যতের  প্রতিশ্রুত দান ঠিক ঠিক ভাবে পাওয়া যায়। এছাড়াও ধনবান ব্যক্তিরা যাতে জনকল্যাণে অর্থ প্রদান করেন তার জন্যও উদ্যোগ নিতো সভা। দানের সার্বজনীন স্বীকৃতি দিয়ে বা অন্যান্য কিছু সুবিধা দিয়ে সভা কর্তৃক ধনবানদের দানকার্যে উৎসাহিত করা হত। তিরুপুরে প্রাপ্ত ১১২৯ সাধারণ অব্দের এক লেখর বিষয়বস্তু হলো জনৈক ভট্টকে গ্রাম সভার পক্ষ থেকে ধন্যবাদজ্ঞাপন। ওই লেখ অনুযায়ী, গ্রামের কঠিন সময়ে যখন গ্রামবাসীরা গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তখন অর্থসাহায্য করেছিলেন ভট্ট – করেছিলেন গ্রামের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা। উত্তরামেত্তুর-এর সভা জনৈক নর্তকীকে বংশানুক্রমিক কিছু সুবিধে দিয়েছিল গ্রামের বিষ্ণু মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নতিসাধনের জন্য অর্থ প্রদান করার জন্য।

(৪) গ্রামের মন্দিরের কাজকর্ম ঠিক থাক চলছে কি না তাও দেখতে হত সভাকে। যে কোন কারণেই হোক, চোল আমলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ওপর মন্দিরের প্রভাব খুব বেড়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের জীবন আবর্তিত হত মন্দিরকে ঘিরে। তাই মন্দিরের কাজকর্ম সামলানোর জন্য যে স্বাধীন পরিচালন সমিতি থাকতো, তাদের কাজকর্মের ওপর নজর রাখতো সভা। কখনও কখনও মন্দিরের দেখভাল সরাসরি করতে হতো সভাকে। কিছু ক্ষেত্রে মন্দিরের কথকঠাকুরকে, যিনি মন্দিরে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ পাঠ করতেন, নিঃশুল্ক জমি দিয়েছিল সভা।

উপরোক্ত দায়িত্বগুলোর সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সভাকে:

(১) সংশ্লিষ্ট গ্রামের জমির নথি এবং রাজস্বের নথি সংরক্ষণ করতে হতো।

(২) গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য কর আদায় করতে হতো। এই কাজ সভার লোকজন সরকারি আমলাদের উপস্থিত করতো। ধার্য করের অধিক কর আদায় করা ছিল নিয়ম বহির্ভূত। এই কর জমা পড়তো কেন্দ্রীয় রাজকোষে। অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর অগ্রিম নেওয়া হত। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে। সিররানাইচ্চুর নামে এক ব্রহ্মদেয় গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের সভা স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু অর্থ ঋণ নিয়েছিল। পরে সেই ব্যক্তি দেউলিয়া হয়ে যায় এবং কেন্দ্রীয় কর দিতে অপারগ হয়। তখন সভাকে ঋণের সমতুল্য অর্থ দেউলিয়া ব্যক্তির তরফে কর বাবদ জমা করতে হয়েছিল রাজকোষে। সেই অর্থ সভা জোগাড় করেছিল স্থানীয় এক মন্দিরের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। এর বিনিময়ে ওই মন্দিরের কিছু জমির ভবিষ্যতের কেন্দ্রীয় কর প্রদান করার দায় পড়েছিল সভার ওপর।       

(৩) যখন কোন ব্যক্তি জমির চরিত্র বদলের জন্য চোল দরবারে আবেদন করতেন তখন সেই আবেদনের যৌক্তিকতা বিচারের দায়িত্ব পড়তো সভার ওপর। তবে এইক্ষেত্রেও কাজের পুরো দায় সভার একার ঘাড়ে পড়তো না। সভার সাথে থাকতো সংশ্লিষ্ট  সরকারি আমলা যাদের কে বলা হত ‘অধিকারী’। প্রসঙ্গত চোল রাজস্ব ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ কর ছিল কাদামাই, যা দিতে হত জমির মালিককে। কাদামাই-এর অঙ্ক কত হবে তার সাথে জমিতে কতটা ফসল উৎপাদিত হলো বা আদৌ উৎপাদিত হলো কি না, তার সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না। কাদামাই নির্ধারিত  হতো জমির উৎপাদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে। সুতরাং জমির চরিত্র বদলে গেলে, কাদামাই-এর অঙ্কও বদলে যেত।

সভার উপরোক্ত দায়িত্বগুলি থেকে বোঝা যায় যে একদিকে যেমন সভাকে স্থানীয় অঞ্চল ও মানুষের খেয়াল রাখতে হতো তেমনি অন্যদিকে কেন্দ্রীয় শাসনের প্রতি নির্দিষ্ট কিছু দায়বদ্ধতা ছিল সভার।

গ্রামভিত্তিক সভার পাশাপাশি আর এক ধরণের স্বশাসিত সংস্থা ছিল চোল সাম্রাজ্যে। তবে এই সংস্থাগুলো সভার ন্যায় এলাকাভিত্তিক ছিল না। এই সংস্থাগুলো গঠিত হত সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক স্বার্থের ভিত্তিতে। সভার তুলনায় এদের কাজের ব্যাপ্তি ছিল সীমিত। যেমন শুধুমাত্র মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একাধিক অঞ্চলে গঠিত হয়েছিল একাধিক সংস্থা যেমন মুলাপারুদাইয়ার, পেরিলামইয়ার, শঙ্করপ্পাদিয়ার। ব্যবসাবাণিজ্যে সম্পর্কিত আইনকানুনের বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল ভালানিজিয়ার, মনিগ্রামম নামক সংস্থাগুলি। ছুতোর, স্বর্ণকার, কামার, জেলে, মেষপালক – এদেরও নিজস্ব বৃত্তিভিত্তিক সংস্থা ছিল। একই ব্যক্তি একই সাথে এই সংস্থাগুলোর এবং সমিতির সদস্য হতে পারতেন।

যেহেতু অনেক বিষয় সভা এবং এই সংস্থাগুলির যৌথ আওতায় আসতো, স্বশাসিত হওয়া সত্ত্বেও সেই বিষয়গুলিতে এই সংস্থাগুলি সভার তত্ত্বাবধানে কাজ করতো। যেমন মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্বশাসিত সংস্থা মুলাপারুদাইয়ার-এর কাজের ওপর নজর রাখতো সভা যার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সংস্থাগুলি নিজেদের উপযোগিতা বা কর্মক্ষমতা হারালে সভার সাথে মিশে যেত। যেমন প্রথম পরান্তকের রাজত্বকালে সুচিন্দ্রমের মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত হয়েছিল এক মুলাপারুদাইয়ার। সেই মুলাপারুদাইয়ার কাজ চালিয়েছিল প্রথম রাজরাজ চোলের রাজত্বকাল পর্যন্ত। তারপর মিশে গিয়েছিল স্থানীয় সভার সংশ্লিষ্ট সমিতির সাথে। কোন বিষয়ে সভার সাথে এই সংস্থাগুলোর মতবিরোধ হলে প্রচলিত রীতিনীতির এবং আগেকার উদাহরণের ভিত্তিতে অথবা গ্রামবাসীদের অভিমতের ভিত্তিতে হতো  মীমাংসা। কোন ক্ষেত্রে সেই পদ্ধতিতেও সুরাহা না হলে, বিষয়টিকে পাঠানো হতো রাজদরবারে মীমাংসার জন্য।

তৎকালীন সমাজে এই সংস্থাগুলির প্রভাব ছিল ইতিবাচক। গ্রামের সবার পক্ষে সম্ভব ছিল না সমিতির সদস্য হওয়ার। এই সংস্থাগুলির মাধ্যমে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কোন না কোন সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত থাকতেন।

উরার

উর গ্রামে মোটামুটি চার শ্রেণির মানুষ বসবাস করত – (১) ভেল্লালা – এরা ছিলেন সম্পন্ন কৃষক। এদের চাষযোগ্য জমি ছিল; (২) কাম্মানা অর্থাৎ হস্তশিল্পী; (৩) পারাইয়া, পুলাইয়া, চাক্কিলয়া ইত্যাদি – এরা ছিলেন খেতমজুর। এদের নিজস্ব চাষযোগ্য জমি ছিল না; এবং (৪) ইলাভা – এরাও ছিলেন খেতমজুর। কিন্তু এরা শুধু নারকেল চাষের কাজ করতেন। ব্রহ্মদেয় গ্রামের ক্ষেত্রে গ্রামের সব বাসিন্দাই পঞ্চায়েতের সদস্য হতে পারলেও, উর গ্রামের পঞ্চায়েত অর্থাৎ উরার-এর সদস্য হওয়ার অধিকার ছিল শুধু জমির মালিকদের অর্থাৎ ভেল্লালাদের।

সভার গঠনতন্ত্র এবং কর্মপদ্ধতি নিয়ে বহু তথ্য পাওয়া গেলেও উরার-এর গঠনতন্ত্র এবং কর্মপদ্ধতি নিয়ে তথ্য অপ্রতুল। উরার সম্পর্কে জানা যায় যে সভার ন্যায় উরারও কাজকর্ম সামলানোর জন্য কার্যনির্বাহী সমিতি গঠন করতো। এই কার্যনির্বাহী সমিতিকে বলা হত আলুনগণম। আলুনগণমকে ক্ষেত্রবিশেষে শুধু গণম অথবা মি-য়ালুন-গণম অথবা উর-আলভার্গাল বলেও উল্লেখ করা হত।

সভার তুলনায় উরার-এর কর্মপদ্ধতি ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ সরল। যেখানে ব্রহ্মদেয় গ্রামে জমির মালিকানা ছিল ব্যক্তিভিত্তিক, সেইখানে চোল সাম্রাজ্যের প্রথমদিকে উর গ্রামে জমির মালিকানা ছিল গোষ্ঠীভিত্তিক। ফলে জমির মালিকানা এবং করসম্বন্ধীয় নথিপত্র ছিল অনেক কম। কর আদায়ের প্রক্রিয়া ছিল সরল এবং সংক্ষিপ্ত। মন্দির সামলাতে বা ধর্মীয় কোন বিষয় দেখতে হতো না উরারকে। সেই কারণে, যেখানে প্রায় প্রতিটি সভা একাধিক সমিতি গঠন করেছিল, সেখানে উরার পিছু একটি করে আলুনগণম গঠিত হয়েছিল। চোল সাম্রাজ্যের পরবর্তীকালে এই অবস্থার বদল হয়। তখন উর গ্রামের জমির ওপরও ব্যক্তি মালিকানা অনুমোদিত হয়। ফলে উরার-এর কাজ কর্ম বাড়ে। সেই কারণে চোল সাম্রাজ্যের পরের দিকের লেখতে উরার-এর কাজকর্মের অধিকতর উল্লেখ পাওয়া যায়।

কে বা কারা সমিতির অন্তর্ভুক্ত হতেন বা হওয়ার যোগ্য ছিলেন, তা নিয়ে বিশদ তথ্য পাওয়া গেলেও, আলুনগণম-এর ক্ষেত্রে বিশদ তথ্য পাওয়া যায়নি।  তবে উপরে উল্লিখিত সিদ্ধামল্লিতে প্রাপ্ত চোল শাসক অথিরাজেন্দ্রর রাজত্বকালের (১০৬৮-১০৭০ সাধারণ অব্দ) লেখতে সমিতির গঠন সম্পর্কিত যে সমস্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তা আলুনগণম-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। 

নগরম

নগরমের উল্লেখ অনেক কম পাওয়া গিয়েছে চোল আমলের লেখতে। সভা এবং উর-এর ন্যায় নগরমও ছিল স্বশাসিত। নগরমের প্রশাসনাধীন ছোট শহরগুলিতে মূলত ব্যবসায়ীরা বসবাস করতেন এবং এই শহরগুলির অর্থনীতি ছিল  ব্যবসাবাণিজ্য নির্ভর।

উপসংহার

চোলদের এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গোড়াপত্তন কিন্তু করেছিলেন পল্লবরা এবং পাণ্ড্যরা। সাধারণ অব্দের অষ্টম এবং নবম শতকের যে সমস্ত লেখ তামিলনাড়ুতে পাওয়া গিয়েছে, সেইগুলো থেকে জানা যায় যে সেই সময় পুরো তামিলনাড়ু জুড়েই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু ছিল। চোলরা যা করেছিলেন তা হলো সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে পরিশোধন ও পরিমার্জন করে উন্নততর করে তোলা।

চোল রাজত্বের দ্বিতীয়ার্ধে বা শেষের দিকে কে সমিতির সদস্য হতে পারবে আর কে হতে পারবে না, সেই বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশিকা জারি করেছিল চোল প্রশাসন যার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন যে সেই সময় সভাগুলো তাদের স্বশাসনের ক্ষমতা হারিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় চলে এসেছিল। তবে এর বিপক্ষীয় মত আছে। বিপক্ষীয় মত হল যে ওই সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সভার অধিকার খর্ব করে নির্দেশিকা জারি করেননি। কোন বিশেষ কারণে সংশ্লিষ্ট সভাগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নির্দেশিকা চেয়েছিল বলেই কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশিকা জারি করেছিল। তাঁদের এই ধারণার ভিত্তি হলো সমসাময়িক অন্য কয়েকটা লেখ যেগুলো সমকালীন অন্যান্য সভার স্বশাসনের সাক্ষ্য দেয়।

১২৩২ সাধারণ অব্দের এক লেখ অনুযায়ী কামাদাভাল্লি-চতুর্বেদীমঙ্গলম-এর মহাসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পূর্বতন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যারা এক বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে রাজি হবে শুধু তাদেরই সমিতির সদস্য হিসাবে নিযুক্ত করবে পঞ্চায়েত। এইখানে কোন সরকারী নির্দেশিকার নিদর্শন নেই। ঠিক একইভাবে সেম্বিয়ানমহাদেবীর মহাসভা স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে স্থানীয় শাসন এবং রাজস্ব সম্পর্কিত বৈঠক রাতের বেলায় করা হবে না কারণ রাতের বেলায় সদস্যদের কর্মদক্ষতা কমে যায় এবং প্রদীপ জ্বালানোর তেল বাবদ অতিরিক্ত খরচ হয়। ওই ক্ষেত্রেও কোন সরকারী নির্দেশের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়নি।

পক্ষান্তরে এই সময়ের আর একটি লেখ থেকে বোঝা যায় যে সেই সময় সভার ওপর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার জায়গায় হ্রাস পাচ্ছিল। এই লেখটি পাওয়া গিয়েছে তাঞ্জোরের সেঙ্গানুর গ্রামে। এই লেখটি লেখা হয়েছিল তৃতীয় রাজরাজ চোলের (১২১৬-১২৪৬ সাধারণ অব্দ) রাজত্বকালের তিরিশতম বছরে। এই লেখ অনুযায়ী সেঙ্গানুর গ্রামের সভা নিজেরা সমিতি গঠনে অপারগ হলে, সমিতির গঠন সম্পর্কিত নির্দেশিকা নিয়ে এসেছিল বিশ্বেশ্বরদেব-এর মন্দিরের মুলাপারুদাইয়ার-এর কাছ থেকে। আগে এইসব ক্ষেত্রে সভা রাজদরবারে যেত নির্দেশিকার জন্য। এইক্ষেত্রে সভা গিয়েছিল আর একটি স্বশাসিত সংস্থা মুলাপারুদাইয়ার-এর কাছে। অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু চোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রশাসন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছিল সভাগুলির কাছে।

 সেঙ্গানুর-এর এই লেখই হচ্ছে চোল সাম্রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রাপ্ত শেষ লেখ।

চোল সাম্রাজ্যের পঞ্চায়তে ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করে এইটাই মনে হয় যে চোলরা স্থানীয় স্তরে প্রশাসনের জন্য একটি প্রশাসনিক ম্যাট্রিক্স গঠন করেছিলেন যার একটি অক্ষে ছিল এলাকাভিত্তিক স্বশাসিত সংস্থা – উর, সভা এবং নগরম, এবং অন্য অক্ষ বরাবর ছিল ধর্ম, বৃত্তি এবং ব্যবসা বাণিজ্যভিত্তিক সংস্থাগুলি। এই দুইয়ের ঠাসবুননে চোল শাসিত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল এক বলিষ্ঠ স্থানীয় প্রশাসন যা একাধারে ছিল স্বশাসিত, স্ব-স্থায়ী এবং স্ব-সংশোধনকারী। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজ ছিল এই স্থানীয় প্রশাসন কেমন চলছে তা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা এবং কোন রকম বিচ্যুতির সম্ভাবনা দেখলে, নির্দেশিকা জারি করে তা রোধ করা।

চোল আমলের গ্রামাঞ্চলের এই স্বায়ত্ব শাসনের মডেল হয়তো আজকের ভারতেও অনুকরণযোগ্য।

শীর্ষক চিত্র পরিচিতি: ১০১৪ সাধারণ অব্দে চোল সাম্রাজ্য

পাদটীকাঃ

চোল শাসকদের তালিকা:

বিজয়ালয় চোল (৮৫০-৮৭১ সাধারণ অব্দ)

প্রথম আদিত্য (৮৭১-৯০৭ সাধারণ অব্দ)

প্রথম পরান্তক (৯০৭-৯৫৫ সাধারণ অব্দ)

গন্দরাদিত্য এবং অরিঞ্জয় (৯৪৯-৯৫৭ সাধারণ অব্দ)

দ্বিতীয় পরান্তক ওরফে সুন্দর চোল (৯৫৭- ৯৭৩ সাধারণ অব্দ)

উত্তম চোল (৯৭০-৯৮৫ সাধারণ অব্দ)

প্রথম রাজরাজ চোল (৯৮৫ -১০১৪ সাধারণ অব্দ)

প্রথম রাজেন্দ্র চোল (১০২-১০৪৪ সাধারণ অব্দ)

প্রথম রাজাধিরাজ চোল (১০১৮-১০৫৪ সাধারণ অব্দ)

দ্বিতীয় রাজেন্দ্র চোল (১০৫২-১০৬৩ সাধারণ অব্দ)

বীররাজেন্দ্র চোল (১০৬৩-১০৬৯ সাধারণ অব্দ)

অথিরাজেন্দ্র চোল (১০৬৮-১০৭০ সাধারণ অব্দ)

প্রথম কূলতুঙ্গ (১০৭০-১১২০ সাধারণ অব্দ)

বিক্রম চোল (১১১৮ – ১১৩৫ সাধারণ অব্দ)

দ্বিতীয় কূলতুঙ্গ (১১৩৩ – ১১৫০ সাধারণ অব্দ)

দ্বিতীয় রাজরাজ চোল (১১৪৬ – ১১৭৩ সাধারণ অব্দ)

দ্বিতীয় রাজাধিরাজ চোল (১১৬৩-১১৭৯ সাধারণ অব্দ)

তৃতীয় কূলতুঙ্গ (১১৭৮ -১২১৬ সাধারণ অব্দ)

তৃতীয় রাজরাজ চোল (১২১৬-১২৪৬ সাধারণ অব্দ)

তৃতীয় রাজেন্দ্র চোল (১২৪৬ -১২৭৯ সাধারণ অব্দ)

তথ্যসূত্রঃ

  1. The Colas, K.A.Nilkanta Sastri, Madras University Historical Series No. 9, University of Madras, Second Edition, 1955
  2. South India under the Cholas, Y.Subbarayalu, Oxford University Press, First Edition, 2012
  3. A Concise History of South India – Issues & Interpretation, edited by Noboru Karashima, Oxford University Press, First Edition, 2014
  4. The Illustrated History of South India – From Prehistoric times to the Fall of Vijaynagara, K.A.Nilkanta Sastri, Oxford University Press, First Edition, 2009
লেখক মুম্বাইতে স্বনিযুক্ত শান্তনু কারিগরিবিদ্যায় স্নাতক এবং ফিনান্স'এ এম.বি.এ। পেশার বাইরে শান্তনু'র শখ হলো নতুন জায়গা ঘুরে দেখা এবং ইতিহাসচর্চাকরা।

মন্তব্য তালিকা - “চোল সাম্রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা”

  1. সেই একই ব্যাপার।মুখ্যত রাজকোষ এ ধনবৃদ্ধি ও ব্রাম্ভণ সমাজের অনুগত থাকার পর যদি সন্তুষ্ট হয়
    সকলে তখন সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশের জন্য কিছু করার চেষ্টা।
    অনুশাসনের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নিশ্চয়ই।
    তবে বেশ ভালো লাগলো লেখাটি। দলিল অতীতের যা আমাদের দেশে বিশেষ দূর্লভ।

  2. চোল রাজত্বের সামাজিক কাঠামো ও প্রশাসনিক ব‍্যবস্থা সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না প্রায়। অনেক কিছু জানতে পারলাম এবং আরও জানার আগ্রহ তৈরী হলো।

    লেখককে ধন‍্যবাদ এমন সুলিখিত তথ‍্যপূর্ণ রচনার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।