সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

মিহিজাম থেকে চিত্তরঞ্জন: বাঙালির প্রযুক্তির ইতিহাসের এক মাইলফলক

মিহিজাম থেকে চিত্তরঞ্জন: বাঙালির প্রযুক্তির ইতিহাসের এক মাইলফলক

শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়

মে ১১, ২০২৪ ১৮০ 2

কাশফুলের জঙ্গল পেরিয়ে অপু – দুর্গার প্রথম রেলগাড়ি দেখা শিল্প – সাহিত্য আমাদের মনের মণিকোঠায় কোথায় যেন অত্যন্ত যত্ন করে ফ্রেমে বাঁধানো আছে, কোনোদিন ভোলবার নয়। শুধু বাঙালি নয়, অনেকদিন থেকেই সারা ভারতবাসীর জীবনের সঙ্গে রেলগাড়ি ব্যাপারটার একটা ওতপ্রোত যোগাযোগ রয়েছে।

ভারতবর্ষ ট্রেন চলাচলের প্রথম স্বাদ পেয়েছিল বোম্বে, আজকের মুম্বাই। ১৮৩৬ সালে বাংলায় ট্রেন চালানোর জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। তাঁদের পত্রিকা ‘ফ্রেন্ডস অফ্ ইন্ডিয়া’তে এবিষয়ে প্রথম সম্পাদকীয় লেখা হয়। এরপর এ বিষয়ে আবেদন ছিল প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবে রূপ পায় বহুদিন পর। ১৮৫৪ সালে বাংলায় প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন চলতে শুরু করে। উল্লেখ করার মতো বিষয়, এই যাত্রীবাহী ট্রেনের কামরাগুলো তৈরি করেছিল বাংলার কারিগররাই, ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির প্রথম ইঞ্জিনিয়ার জন হজসন ইংল্যান্ড থেকে ট্রেনের কামরার নক্সা অনিয়ে এখানকার রেল লাইনের মাপ অনুযায়ী ঘোড়ার গাড়ির কোচ নির্মাণে অভিজ্ঞ কলকাতার স্টুয়ার্ট কোম্পানি ও শেটন কোম্পানির কারিগরদের দিয়ে রেল কামরা তৈরি করিয়েছিলেন। অবশ্য প্রথম রেল ইঞ্জিনটি তৈরি হয়েছিল ইংল্যান্ডে— সিম্পল এক্সপ্যানশন নীতি মেনে কাজ করবে। এই রেল ইঞ্জিন ‘ফেয়ারী কুইন’ জাহাজে চড়ে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে বাংলার মাটিতে এসে নেমেছিল। সেই সময় কলকাতার কারিগরদের স্টীম ইঞ্জিন তৈরির কারিগরি কৌশল জানা থাকলেও এই স্টীম ইঞ্জিন দিয়ে রেল ইঞ্জিন বা লোকোমোটিভ বানানোর কারিগরি বিদ্যা জানা ছিল না। ফলে সেই সময় রেল ইঞ্জিন থেকে শুরু করে জ্বালানি কয়লা অবধি সবকিছুই ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হতো। এর মূল কারণ, ওই ইঞ্জিন এমন পদ্ধতিতে তৈরি ছিল যাতে ইংল্যান্ডের উন্নতমানের কয়লা ছাড়া এখানকার কয়লায় ব্যবহার করা যেত না। কয়লা আমদানির বিষয়টা চলেছিল ১৯০০ সাল পর্যন্ত।

ট্রেন চালু হওয়ার প্রথম কয়েক বছর ইঞ্জিনের মেরামতি, নতুন কামরা তৈরি ইত্যাদি ইংল্যান্ডের ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে হাওড়া স্টেশন চত্বরে করা হতো।

১৮৬২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির প্রথম রেল ওয়ার্কশপ গড়ে ওঠে বিহারের জামালপুরে। ১৮৮৫ সালে জামালপুর ওয়ার্কশপে এবং ১৮৯৬ সালে আজমের রেল কারখানায় স্থানীয় কারিগররা রেল ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ এবং পুরো রেল ইঞ্জিন তৈরির দক্ষতা দেখালেও ইংরেজ সরকার এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখেনি। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকার আইন করে নির্দেশ দেয়, ইংল্যান্ডে তৈরি BESA (British Engineering Standards Association) স্ট্যান্ডার্ড ইঞ্জিন ছাড়া অন্য কোনো রেল ইঞ্জিন ভারতে ব্যবহার করা যাবে না। বলা বাহুল্য, এই ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য উন্নতমানের কয়লাও আমদানি করতে হতো ইংল্যান্ড থেকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে পণ্য আমদানি কমতে থাকে। ১৯৪০ এর দশকের প্রথম দিকে আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালে পূর্ব ভারত রেলওয়ে বাংলায় একটি রেল ইঞ্জিন গড়ে তোলার প্রস্তাব নেয়। প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল কাঁচরাপাড়ার কাছে চাঁদমারি গ্রামে এই কারখানা গড়ে তোলা হবে। সেদিনের চাঁদমারি গ্রামই এখন কল্যাণী শিল্পাঞ্চল। ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীন হয়। চাঁদমারির অবস্থান ছিল প্রতিবেশী দেশ পূর্ব পাকিস্তান-এর খুব কাছে। নিরাপত্তার স্বার্থে ঠিক হয় কারখানাটি তৈরি হবে বাংলা ও বিহারের সীমানায় মিহিজাম রেল স্টেশনের কাছে।

প্রাথমিকভাবে কারখানাটির নাম ছিল লোকোমোটিভ ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়ার্কস। ১৯৪৮ সালে শুরু হয় কারখানা গড়ে তোলার কাজ, শেষ হয় ১৯৫০ সালে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্মৃতিতে মিহিযামের নামকরণ হয় চিত্তরঞ্জন এবং ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তী দেবী কারখানাটির উদ্বোধন করেন, নাম হয় ‘চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস’ সংক্ষেপে CLW। ইংল্যান্ডের নর্থ ব্রিটিশ লোকোমোটিভ কোম্পানির সহায়তায় এখানে শুরু হয় স্টীম লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরির কাজ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ১ নভেম্বর ১৯৫০ তৈরি হয় স্টীম লোকোমোটিভ WG loco 8401, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দেশবন্ধু’। ভারতীয় রেলওয়ের WG ক্লাস হল এক ধরনের ব্রডগেজ পণ্য লোকোমোটিভ যা ১৯৫০-এর দশকে চালু হয়েছিল।

চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস হয়ে দাঁড়ায় স্টীম লোকোমোটিভ তৈরির প্রধান কারিগর। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল ২৫৩১ টি স্টীম লোকোমোটিভ ইঞ্জিন। ভারতবর্ষের শেষ ব্রড গেজ স্টীম লোকো ইঞ্জিন WG 10560 ‘অন্তিম সিতারা’ (The last star) তৈরি হয় ৩০ জুন ১৯৭০, শেষ স্টীম লোকো মিটার গেজ ইঞ্জিন MG YG class loco 3573 তৈরি হয়েছিল ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।

স্টিম ইঞ্জিন 

১৯৬৭-‘৬৮ সাল থেকে CLW (Chittaranjan Locomotive Works) শুরু করে ডিজেল ইঞ্জিন তৈরির কাজ। এর মধ্যে ডিজেল-হাইড্রালিক শান্টারই ছিল সংখ্যায় বেশি, যার বাণিজ্যিক নাম ছিল WDS- 4 class; ১৯৭০ এবং ১৯৮০ র দশকে তৈরি হল ZDM গোত্রের এবং YDM গোত্রের 2-unit (ডিজেল-ইলেকট্রিক) ইঞ্জিন।

১৯৯৪-এর পর CLW আর ডিজেল লোকোমোটিভ ইঞ্জিন তৈরি করে না। উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় হল, বহুদিন ধরে এই কারখানায় একই সঙ্গে তৈরি হয়েছে স্টীম, ডিজেল এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিন।

  • ১৪ অক্টোবর ১৯৬১-তে তৈরি হয়েছিল WCM-5 গোত্রের প্রথম ইলেকট্রিক ইঞ্জিনটি, নামকরণ হয় ‘লোকমান্য’।
  • এর কয়েক বছর পর ১৯৬৩ সালে তৈরি হয় WAG -1 গোত্রের ইলেকট্রিক ইঞ্জিন ‘বিধান’, ভারতবর্ষের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি প্রথম ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ।
  • এরপর তৈরি হয়েছে WAP -5 এবং WAP -7 এর মতো AC লোকোমোটিভ, যেগুলি রাজধানী বা শতাব্দী এক্সপ্রেসের মতো দ্রুতগামী ট্রেনে ব্যবহার করা হয়।
  • সম্প্রতি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেনগুলির জন্যও উন্নত মানের ইঞ্জিন তৈরি করছে CLW।

চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস শুধুমাত্র দেশের চাহিদা মিটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বাহির্ভারতের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেছে স্টীম, ডিজেল এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিন। রেল ইঞ্জিন ছাড়া অন্যান্য লোকোমোটিভ ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরিতেও কাজ করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান।

ডিজেল ইঞ্জিন

১৯৫০-এ যাত্রা শুরু করে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস ৭৫ তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। সঙ্গে রয়েছে তার এক গৌরবময় ইতিহাস। নব্য উদারবাদী ব্যবস্থায় অনেকের মনেই একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি লোকসানে চলে এবং সরকারি সংস্থায় কর্মসংস্কৃতি নেই। এই ধারণা যে কতটা ভ্রান্ত তা প্রমাণ করেছে CLW।

ইলেকট্রিক ইঞ্জিন

২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে ৫৪০টি লোকোমোটিভ তৈরির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসে। আর্থিক বছর শেষে দেখা গেল, এই সংস্থা তৈরি করেছে ৫৮০টি লোকোমোটিভ। সংস্থার ইতিহাসে কোনো আর্থিক বছরে সর্বোচ্চ লোকোমোটিভ তৈরির রেকর্ড গঠিত হল। (সংবাদ সূত্র: এই সময়, ৯ এপ্রিল ২০২৪)

২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার এক মাস আগেই ৫৪৯টি লোকোমোটিভ তৈরি করে লক্ষ্যমাত্রা থেকে এগিয়ে ছিল CLW। এভাবেই এগিয়ে চলেছে বাংলায় অবস্থিত একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস।

সাহায্যকারী সূত্র:

১. রেল: উনিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সাহিত্যে, রমেনকুমার সর, কমলিনী, কলকাতা, জুলাই ২০১২

২. সমাজচিত্রে ভারতীয় রেল, প্রদোষ চৌধুরী, গাংচিল, কলকাতা, আগস্ট ২০১২

৩. https://clw.indian railways.gov.in

বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী ও বিজ্ঞান লেখক। উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত বই: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রবন্ধ সংগ্রহ, স্মৃতি - সত্তায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র রায় : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা, বিজ্ঞান বিস্ময়, নানা চোখে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, প্রবাসীর প্রফুল্লচন্দ্র ইত্যাদি

মন্তব্য তালিকা - “মিহিজাম থেকে চিত্তরঞ্জন: বাঙালির প্রযুক্তির ইতিহাসের এক মাইলফলক”

  1. ভালো লাগলো, কিছু দিন ধরে ই প্রায় ই এই বিষয়টি ভাবনার মনোজগতে ঘোরাফেরা করছিল।কদিন আগে এও চিন্তা করছিলাম পুরোনো ফোন নং নিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করি সিএল ডবলু’র খবর কি । আসলে কর্মসুত্রে বেশ ভালো ভাবেই এই কারখানা টি তে যাতায়াত ছিল। এবং দায়িত্ব প্রাপ্ত আধিকারিক বেশ কয়েকজন আমার পছন্দের বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন ও গুরুত্ব দিতেন।
    অনেক টা জায়গা জুড়ে ও মনোরম পরিবেশে এটি
    অবস্থিত।কর্মিবৃন্দের সকলকে যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার পরিচয় দিতে দেখেছি।
    কখনো অজথা সময় নষ্ট হয়নি।
    এসেম্বলি লাইন ও মেটালার্জী সেকসন খুব আউটপুট
    দিতে মনে আছে বেশ।
    কারখানার বাইরে লাঞ্চ করতে খুব ভালো লাগত।
    ওঁরা আপগ্ৰেড করা শুরু করে দিয়েছিলেন তখন ই।
    জেনে আনন্দিত হলাম ভালো চলছে।
    ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে।

  2. এক দিনে প্রায় দেড় খানা engine কি করে তৈরী করা সম্ভব সেটা মাথায় ঢুকছে না I এখানে কি শুধুই assembly হয়? খবর কাগজেও এই খবর বেরিয়েছিল I তখনই আশ্চর্য হয়েছিলাম I এমন বিপুল কর্মকান্ড এক দিনে কি করে করা যায়?

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।