সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

হরপ্পীয় সভ্যতার ধাতু শিল্প

হরপ্পীয় সভ্যতার ধাতু শিল্প

তুষার মুখার্জী

ডিসেম্বর ৪, ২০২১ ১৪২৮ 2

প্রাথমিক কিছু কথা

হরপ্পীয় সভ্যতার সাধারণ পরিচিতি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। এই পরিচিতির সূত্র ধরে আমরা ভাবতে পারি হরপ্পা সভ্যতায় ব্রোঞ্জ শিল্পের উন্নতি যথেষ্ট উন্নত পর্যায়ে গিয়েছিল। এবং হরপ্পীয় কারিগরেরা ব্রোঞ্জ শিল্পে দক্ষ হস্ত ছিলেন। আর ভাবা যেতে পেরে হরপ্পীয় সভ্যতার যুগে লোকের হাতে ছিল ব্রোঞ্জের নানা উপকরণ ও হাতিয়ার। হরপ্পীয় সভ্যতা থেকে পাওয়া ব্রোঞ্জের মূর্তি বা নানা উপকরণ সেই ধারনাকেই জোরদার করবে। তামা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। সেই মেহেরগড় থেকেই তামার ব্যবহার চলছে। সোনা রূপারও ব্যবহারও হরপ্পীয় সভ্যতায় ছিল। সব মিলিয়ে যে ছবি ফুটে ওঠে তাতে বোঝা যায় হরপ্পীয় সভ্যতার আমলের প্রচলিত সব ধাতুরই ব্যবহার হরপ্পার কারিগরদের জানা ছিল এবং তারা ব্যবহারও হতো।

কিন্তু এটা একটা সামগ্রিক ছবি, যা আমাদের মনে গেঁথে গেছে, নানা বই পড়ে আর ছবি দেখে। আসলেই কি তাই? অথবা নানা তথ্যের ভিড়ে আমাদের ধাঁধা লেগে গেছে? যদি ধাঁধা লেগেই থাকে তবে সেই ধাঁধার গোলক থেকে বের হয়ে প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা কিছুটা হলেও করা হয়েছে কি? কতটা করা হয়েছে?

কঠোর সত্য জানার চেষ্টার পথে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হল প্রত্নবিজ্ঞানের নীরস তথ্যের অনেকটাই বিজ্ঞানীর নিজস্ব ব্যাখ্যা সহ পড়তে হয়। সেই ব্যাখ্যা আবার নির্ভর করে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর নিজস্ব অভিজ্ঞতা প্রসূত ধারনার উপর। তার উপরে পাঠকের নিজস্ব ভাবনার সমস্যাও থাকছে। প্রতিটি ব্যক্তি নিজের পছন্দের কথাই বার বার পড়তে ভালোবাসে। কোন কথা অপছন্দ হলে হয়ত পড়বেই না, বা খানিক পরেই তা ভুলে যাবে।

আরেকটি সমস্যা হল বহু বৎসর আগে যে যে পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রত্নদ্রব্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, তা বহুলাংশে তখনকার ভাবনা চিন্তার গতি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল ছিল। তখনকার প্রত্ন খনন কাজে বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক উৎসাহ, প্রবলপ্রচেষ্টা থাকলেও অনেক সময়ই উপযুক্ত পদ্ধতি অজানা থাকায়, তখনকার অনেক তথ্য ও তার ব্যাখ্যা আজ অকেজো মনে হতে পারে। ফলে প্রকৃত বা নিখাদ সত্য জানলাম কি না তা হয়ত কখনো জানা সম্ভব হয় না। তবু সেই দিকে এগোবার প্রচেষ্টাটুকু অব্যাহত থাকা একান্ত প্রয়োজন। সেই পথে প্রচেষ্টা শুরুও হয়েছে আধুনিকতম বিজ্ঞানের সহায়তায়। ফলে আগেকার অনেক ধারনা বাতিল হতে শুরু করেছে, আবার অনেক পাশে সরিয়ে রাখা ভাবনা এখন গ্রহণীয় মনে হচ্ছে।

একদম শুরুতে হরপ্পীয় সভ্যতাকে ভাবা হত পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ ভাবে মেসোপটেমিয় সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত। ফলে তখন হরপ্পীয় সভ্যতার ধাতু শিল্পের প্রতিটি পর্বকেই মেসোপটেমিয়ার সাথে সম্পর্কিত অথবা তুলনীয় করে ভাবার একটা প্রয়াস ছিল। কিন্তু এখন আমরা অনেকটাই নিশ্চিত ভাবে জানি যে, প্রতিটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নিজের নিজের ভৌগোলিক পরিবেশের ভিত্তিতে। ফলে মেসোপটেমিয়াকে হরপ্পা সভ্যতার মাপকাঠি হিসাবে ভাবাটা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।

তবে এই দুটি সমসাময়িক সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক, বিশেষ করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় নানা ধারনার আদান প্রদান হতেই পারে। যেমন ধাতুর বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের ধারনা বিনিময় সম্ভব। তবে দূরত্বের নিরিখে সরাসরি ধাতু ব্যবহারের প্রকৌশল বিনিময়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হবারই সম্ভাবনা। আজকাল কিছু বিজ্ঞানী ধারনা করছেন ধাতুর ব্যবহারিক প্রকৌশল যেহেতু বিশেষ ভাবে লব্ধ জ্ঞান ছিল, তাই সীমিত লোকেরই সেই জ্ঞান অর্জনের সুযোগ থাকত। এবং সেই সীমিত লোক, পরিবার বা গোষ্ঠী ছিল একটু ভিন্ন ধরনের যাযাবর। তারা সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী কর্মস্থান বদলাত। এবং প্রথমদিককার অনেক সভ্যতারই ভাগ্য এদের বাসস্থানের উপর নির্ভরশীল ছিল।

ধাতু শিল্পে দক্ষদের যাযাবরত্ব ধরে নিয়েও মেসোপটেমিয়ার ধাতুশিল্পে দক্ষ লোকেরা হরপ্পীয় সভ্যতায় এসে কাজ করত, এমনটা ভাবার অবকাশ খুব একটা নেই। কারণ নব্যপ্রস্তর যুগের মেহেরগড়ের ধাতুর ব্যবহার আমাদের বলে এই এলাকায় ধাতুশিল্পের জন্ম হয়েছিল তার নিজস্ব ঘরানায়।

৪০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মেহেরগড়ের আমলে যে শিল্পের জন্ম হয় তা কিভাবে হরপ্পীয় সভ্যতায় পরিণত শিল্পে বিবর্তিত হয় সেই ধারাটি জানার জন্য আমাদের নির্ভর করতে হবে প্রত্নসামগ্রীর যথাযথ বিশ্লেষণের উপর। তার জন্য দরকার কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রত্নদ্রব্যগুলো পরীক্ষা করা। এই কাজটা কিন্তু এখনো ভালো ভাবে হয় না। অনেক সময় গাছাড়া ভাব, আবার অনেক সময় পরীক্ষাগারে না পাঠিয়েই অনুমান স্থির করে ফেলা হয়। তার চেয়েও বড় সমস্যা হল প্রত্নবিজ্ঞানীদের নিয়মিত ফিল্ডরিপোর্টের ভিত্তিতে গবেষণাপত্র প্রকাশ না করা। বহুদিন বাদে গবেষণাপত্র লেখা হলে প্রকৃত তথ্যের সাথে কাল্পনিক তথ্য জুড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

হরপ্পীয় সভ্যতায় ধাতু নিয়ে আলোচনা করতে হলে রাখিগড়িকে নিয়েই প্রথমে করতে হয়। অথচ রাখিগড়ির ধাতব প্রত্নদ্রব্যের তথ্য তালিকার অবস্থা এখনো খুব করুণ। বলা হয়, এত নমুনা জমা পড়ে আছে যে প্রত্নবিভাগ স্রেফ হাবুডুবু খাচ্ছে। ফলে তথ্যসমৃদ্ধ কোন তালিকা প্রকাশ এখনো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে। মাঝে একটি অসম্পূর্ণ ছোট্ট তালিকা বের হলেও বিজ্ঞানীমহল সঙ্গত কারণেই তার উপর ভরসা রাখতে পারছেন না, বা করলেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ হচ্ছেন না।

এটা শুধু রাখিগড়ির কাহিনি নয়, প্রায় গোটা হরপ্পীয় সভ্যতার প্রত্ন খননের একই কাহিনী। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হল তথ্য-তালিকা সহ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলেও তাতে অনেক সময় একই লেখায় প্রত্ন দ্রব্যের বর্ণনা আর তালিকায় মিল থাকছে না। থাকছে ছাপার ভুল। সেই ভুল খতিয়ে না দেখে অন্য বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করে ফেলছেন। ফলে ভুলটাই এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া অনেক সময় দেখা গেছে যা বর্ণনা করা আছে তার বাস্তবতা নেই বা ছিলই না। মূলত দেরীতে রিপোর্ট লেখা, গবেষণাপত্র ফেলে রাখার কুফল এগুলো।

হরপ্পীয় সভ্যতার শহরগুলির তামা গলানোর চুল্লীকে আজকাল বিজ্ঞানীরা চুল্লি বলে মানছেন না। বলছেন ওগুলো আসলে ভাটি। তামা নিষ্কাশনে উচ্চতাপে চুল্লির ভেতরের মাটির প্রলেপ গলে কাঁচের মত দানার সৃষ্টি না করে থাকলে সেটা সেই উচ্চ তাপে ব্যবহার হয়নি বলেই ধরা হয়। একটি এলাকায় তামার নানা উপকরণ থাকলে, তামা গলানো ও ঢালাই করার সম্ভাবনা থাকলেও, সত্যিই ছিল কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। নিশ্চিত হতে হবে ভাটির তাপমান তামা গলানোর মত উচ্চতায় যেত কি না, বা ভাটির আশপাশে তামার গোল গোল দানা পড়ে আছে কি না, তামার গাদ আছে কি না, বা গলন্ত তামা রাখার পাত্রে সত্যিই তামা রাখা হত কি না, তা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করে তবেই নিশ্চিত হতে হবে। এই সব ব্যাপারেই আমাদের এখনো প্রচুর খামতি রয়ে গেছে।

হরপ্পীয় সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার কতটা বিস্তৃত ছিল ও সামগ্রিক জনজীবনে, শহরে ও শহরের বাইরে, তার প্রভাবই বা কতটা ছিল তা বোঝার জন্য খাপছাড়া একটি চুল্লী বা দুটি ধাতু-পাত্র বা দশটি উপকরণের উপস্থিতি জানার বা অনুমানের বদলে আরেকটু গভীরে দেখতে হবে। কারণ প্রতিটি ছোটখাট তথ্য একেবারে ভিন্ন অর্থের জন্ম দিতে পারে।

তামার ব্যবহার

তামার সাথে মানুষের পরিচিতির প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে ১২ হাজার বৎসর আগের জাগ্রোস এলাকার আলিকোশ প্রত্নক্ষেত্রে। তবে সেই তামা প্রাকৃতিক ভাবে খনি থেকে পাওয়া, যা গলিয়ে পিটিয়ে একটি পাতের মত আকার দিয়ে কয়েক ভাঁজ করে মোড়া হয়েছে। একে সঠিক অর্থে তামার ব্যবহারিক নমুনা হয়ত বলা যাবে না। তবে তামা নামক অতি প্রয়োজনীয় নমনীয় ধাতুটির অস্তিত্বের জানান বলা যেতেই পারে।

মেহেরগড়ে তামার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে সেখানে পুরোদমে কৃষিকাজ শুরু হবার আগেই। কিন্তু সেই প্রথম দিকের তামা সেখানে ভাটি বানিয়ে গালিয়ে ব্যবহার করা হত এমন কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্যই সেখানে ভাটি বানিয়েই তামার ব্যবহার হত। আশপাশের এলাকা যথা নৌশেরাও-তেও তামার ভাটি ছিল। এই থেকে অনুমান করা যায় মেহেরগড়ে প্রথমে তামার উপকরণ বাইরে থেকে আসলেও ক্রমে মেহেরগড়বাসীরা তামা গলিয়ে ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছিল। এখানেই আবার সেই প্রসঙ্গ আসে। ধাতু কারিগরি বিদ্যার সাথে পরিচিত জনগোষ্ঠী কিছুটা হলেও প্রায় যাযাবর ছিল। আর তাদের উপস্থিতি সভ্যতার চরিত্র বদলে দিত। হয়ত মেহেরগড়বাসী প্রথমে যেখান থেকে তামার উপকরণ আনত তাদেরই কয়েকজন মেহেরগড়ে বসবাস করতে চলে আসে। শুরু হয় মেহেরগড়ে তামার কাজ। অনুমান মাত্র। কোন প্রমাণ নেই। তবে তার সাথে এটাও আমাদের ভাবতে হবে যে ধাতু নিষ্কাশন বা পরে নিষ্কাশিত ধাতু গালিয়ে ব্যবহারের পেছনে আদত কৌশল ছিল তাপ নিয়ন্ত্রণ। মেহেরগড়বাসীরা পোড়া মাটির বাসন বানাতে বানাতে সেই কাজে পর্যাপ্ত দক্ষতা অর্জন করেছিল। ফলে ধাতু নিয়ে তাদের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য বহিরাগতদের কোন সাহায্যের দরকার আদৌ নাও থাকতে পারে। কেবল মাত্র ধাতুর ব্যবহারের সম্ভাবনার ধারনাটুকু জানা থাকেলেই যথেষ্ট ছিল তাম্র যুগের সূচনার জন্য।

খনির তামায় প্রাকৃতিক ভাবেই অন্য ধাতুও মিশে থাকে। কোন ধাতু কতটা পরিমাণে আছে তার উপর তামার উপযোগিতা বদলে যেত। এই সত্যটা একেবারে গোড়া থেকেই হয়ত জানা সম্ভব ছিল না, কিন্তু ক্রমে সেটা জানা হয়ে যায়। তখন কারিগরেরা কি কাজে দরকার সেই অনুযায়ী তামা বাছাই করত। সে আমলে তামার রাসায়নিক বিশ্লেষণ সম্ভব না হলেও ব্যবহার করতে করতে কারিগরেরা জেনে গিয়েছিল কোন এলাকার তামা কোন কাজের উপযোগী। আর প্রয়োজন অনুযায়ী সেই এলাকার তামাই তারা ব্যবহার করত।

খনিজ ধাতুর সম্ভাব্য খনি বা উৎস

হরপ্পীয় সভ্যতা মূলতঃ গড়ে উঠেছিল নদীর পলিমাটি সমৃদ্ধ এলাকায়। এমন এলাকায় খনিজ পদার্থ থাকার সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ প্রথম থেকেই হরপ্পা সভ্যতার ধাতব শিল্পের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে নির্ভর করতে হতো আমদানির উপর। কোথা থেকে আসত খনিজ তামা বা টিন রূপা সোনা ইত্যদি?

প্রথমেই দেখা যাক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ধাতু তামার সম্ভব্য উৎস।

খনিজ তামার উৎস খনি থেকে তামা (বা অন্য যে কোন ধাতু) নিষ্কাশন করে ধাতুর তাল বাণিজ্যিক পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে হরপ্পীয় সভ্যতার ব্যবহারকারীদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। ফলে খনি এলাকার সাথে শহরের বাণিজ্যিক সম্পর্কের অস্তিত্ব থাকতেই হবে। বিভিন্ন খনি থেকে পাওয়া তামারও গুনগত মানে অনেক পার্থক্য থাকে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক ভাবে আর্সেনিক মিশ্রিত তামা, আর আর্সেনিক হীন তামা। যা থেকে উৎস খনির পরিচয় বোঝা যেতে পারে। সেগুলো আলোচনায় পরে থাকছে।

হরপ্পীয় সভ্যতার এলাকার কাছাকাছি তামা পাওয়া যায় বালুচিস্তানে, আফগানিস্তানে, আরাবল্লি পর্বত এলাকায়, চোলিস্তানে, আর সিংভুমে। এর মধ্যে সিংভুমের থেকে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার দূরত্বের কথা ভেবে এবং সরাসরি বাণিজ্য সংযোগের প্রমাণাভাবে সিংভুমকে সরিয়ে রাখলে হাতে থাকল দুরের ওমান, কাছের বালুচিস্তান, আফগানিস্তান, চোলিস্তান আর আরাবল্লি।  অনুমান করা যেতে পারে সিন্ধু নদীর পশ্চিমপাড়ে ও পূর্বপাড়ে, অর্থাৎ পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশে ধাতুর উৎস ছিল বালুচিস্তান, আফগানিস্তান। রাজস্থান ঘেঁষা এলাকায়, যথা রাখিগড়ি, ফারমানা ইত্যাদি তামা পেত রাজস্থানের আরাবল্লি এলাকা থেকে। আর সমুদ্রতট এলাকায় তামা আসত ওমান থেকে। রাজস্থানের খেত্রী তামাখনি এখন থাকলেও ১০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের আগে সেখানে তামা তোলার কোন প্রমাণ এখনো নেই।

এই উৎস আর ব্যবহারের এলাকা কেবল ভৌগোলিক নৈকট্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হল। বাস্তবে অন্যরকম ঘটে থাকতেই পারে। যেমন দিল্লির কাছে ফারমানা আর গুজরাতের উপকুলের কুন্টাসী এই দুই এলাকার সম্ভব্য তামা উৎস একই ছিল বলে ধারনা। অথচ ভৌগোলিক দূরত্বের দিকে তাকালে মনে হবে ফারমানার তামা ছিল আরাবল্লির আর কুন্টাসির তামা ছিল ওমানের। তবু দুই জায়গার তামার বৈশিষ্ট্য এক কেন হল সেটা খোঁজা দরকার।

বালুচিস্তানে, ছয় সাত হাজার বৎসর আগে থেকেই তামা নিষ্কাশনের প্রমাণ রয়েছে।তাছাড়া বালুচিস্তানে ৩০০০ থেকে ১৭০০ সাধারণ পূর্বাব্দ সময়ে তামা খনিগুলোতে তামা তোলা হত অনেক বেশি পরিমাণে। সমস্যা হল বালুচিস্তানের সম্ভাব্য প্রত্নখনি এলাকা ইরান পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় এবং খুব একটা শান্তিপূর্ণ এলাকানা হওয়ায় সেখান থেকে নতুন তথ্য আসার পথ প্রায় বন্ধ। আফগানিস্তানের বেলাও একই কথা।

আরাবল্লিতে প্রাচীনকাল থেকে খনিজ থেকে ধাতু নিষ্কাশনের একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া মহোঞ্জো-দারো হরপ্পা চানহু-দারো কালিবঙ্গানে যে তামার নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষা হয়েছে তাতে বলা যায় সে তামা আরাবল্লির খনি থেকে আসার সম্ভাবনা ছিল।

কিন্তু মুশকিল হল আরাবল্লির তামার চুল্লিগুলোর মাত্র একটির কার্বন ডেটিং হয়েছে। উদয়পুরের কাছে ‘রাজপুর দারিবার’ খনি। কার্বন ডেটিং-এ সময় পাওয়া গেছে এখন থেকে ৩১২০±১৬০ বৎসর আগে। যদিও এই খনির তামা ৪-৮% আর্সেনিক সমৃদ্ধ, আর হরপ্পীয় সভ্যতায় আর্সেনিক সমৃদ্ধ তামার ব্যবহার প্রচুর হয়েছে, তবু সময়ের হিসাবে উদয়পুরের এই তামা হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তিম লগ্নের।তার আগেও কি আরাবল্লির তামা ব্যবহার হত? আরো গভীর ভাবে অনুসন্ধান দরকার। আরো বিভিন্ন খনির কার্বন ডেটিং দরকার। তা না হলে সেই তামা হরপ্পীয় সভ্যতার শহরে এলেও সভ্যতাটির কোন পর্যায়ে এসেছিল, তার আগে কি অবস্থা ছিল, বা পরে উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন ঘটেছিল কি না তা সঠিক জানার উপায় নেই।

চোলিস্তানে তামা নিষ্কাশন হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বলে, তা খুব একটা বড় আকারে হয় নি। সম্ভবত এই তামা হরপ্পানদের বদলে হাকরা সংস্কৃতি, ও আহর সংস্কৃতির লোকেরাই ব্যবহার করত। রাজস্থানে আহরদের তামা ব্যবহারের ভাটি পাওয়া গেছে বলে জানানো হলেও পরে দেখা যায় সেই ভাটিতে প্রচুর ছাই থাকলেও কাঠকয়লার কথা রিপোর্টে নেই। ভাটির ভেতরে তামা গলানোর মত উচ্চ তাপ সৃষ্টি হলে মাটির প্রলেপে যে কাঁচের মত দানার সৃষ্টি হবার কথা তাও ফিল্ড রিপোর্টে বলা নেই। গলন্ত তামা থেকে সৃষ্ট ছোট ছোট তামার দানা ভাটির পাশে পড়ে থাকার কথা, সেরকমও কিছু পাওয়া গেছে বলে বলা নেই। ফিল্ড রিপোর্টে লেখা না থাকলে পরে ছিল বললেও একে তামার ভাটি বললে অনেক বিজ্ঞানীই খুঁত ধরবেন।তবে আহর সংস্কৃতিতে তামার ব্যবহার ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু সঠিক তামার চুল্লি আর ভাটি খুঁজে পাওয়া গেছে কি না, তা বোঝা গেল না।

কোন এলাকায় তামার খনি থাকলেই তাকে তামার উৎস বলে ধরা হবে না। খনিজ তামা থেকে তামা নিষ্কাশনে লাগবে জ্বালানী কাঠ, সেটাও কাছেই থাকা দরকার। আর খনিজ থেকে তামা নিষ্কাশনের পরে পড়ে থাকবে বর্জ। ফিল্ড রিপোর্টে তা লেখা থাকতে হবে। তারপরেও ব্যবহৃত তামার রাসায়নিক বিশ্লেষণের থেকে বের হওয়া প্রাকৃতিক ভাবে মিশ্রিত অন্য ধাতব উপাদানও সেই খনির নিষ্কাশিত তামায় সমপরিমাণেই থাকা দরকার। এই এত সব শর্ত মিলে গেলে তবেই সেই এলাকাকে তামার খনিজ উৎস বলে ধরা যাবে।

টিন

ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতাটির জন্য খুব গুরুত্ব পূর্ণ ধাতু। কিন্তু এরও কোন সঠিক উৎস খুঁজে পাওয়া যায় নি। যেহেতু আফগানিস্তানে টিন পাওয়া যেত তাই অনুমান করা যায়, আফগানিস্তানই টিনের উৎস ছিল। আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকার সাথে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলই। তাই টিন আসার সম্ভাবনা থাকছে।

সোনা

হরপ্পীয় সভ্যতায় সোনার ব্যবহার ছিল। কোলার সোনা খনি থেকেই সোনা এসেছে, এমন সম্ভাবনা থাকতেই পারে। কিন্তু মুশকিল হল আজ পর্যন্ত কোলার এলাকার সাথে হরপ্পীয় সভ্যতার কোন বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাজেই অন্য উৎসের কথাও ভাবতে হয়। সোনা নিষ্কাশনের প্রমাণ পাওয়া গেছে হরপ্পীয় সভ্যতার বৈদেশিক বাণিজ্য কেন্দ্র শর্তুগাই শহরে। সেখান থেকে সোনা আসার সম্ভাবনা থাকছে। তবে মুশকিল হল শর্তুগাই বাণীজ্য কেন্দ্র তৈরি হবার আগেই হরপ্পীয় সভ্যতায় সোনার ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। তাই সোনার আরেকটি উৎস খোঁজা দরকার। ধারনা করা হয় আফগানিস্তানের নদীর থেকে সংগৃহীত সোনাই গোড়াতে ব্যবহার হত। পরে হয়ত শর্তুগাই থেকে আসত।

রূপা

হরপ্পীয় সভ্যতায় রূপার ব্যবহার ভালোই ছিল। কিন্তু এই ধাতুটির উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। বাণিজ্যিক পথে আমদানি করা হত বলেই অনুমান।

ইলেকট্রাম

সোনা-রূপার প্রাকৃতিক মিশ্রণের এই খুব ধাতু কম ব্যবহার হলেও ব্যবহার অজানা ছিলনা হরপ্পীয় সভ্যতায়। তবে এরও উৎস অজানা। বাণিজ্যিক পথে আমদানি করা হত বলেই ধারনা করা হয়।

লোহা

হরপ্পীয় সভ্যতায় লোহার ব্যবহারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সমসাময়িক আফগানিস্তানের মান্ডিগাকে অতি সামান্য আর একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের লোহার ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই লোহা সম্ভবত আচমকা কোন খনিজ থেকে পাওয়া, পরীক্ষামূলক অভিনব ধাতু হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ধারাবাহিক লোহার উৎপাদন তখনো বহুদূরে।

খনি থেকে ধাতুর নিষ্কাশন

খনিজ থেকে ধাতু নিষ্কাশনের কাজে লাগবে চুল্লি। মহেঞ্জো-দারো, হরপ্পা, চানহু-দারো, লোথাল, কালিবঙ্গান কোথাও নিষ্কাশনের উপযুক্ত চুল্লি পাওয়া যায়নি। একদম শুরুতে মহেঞ্জোদারোতে খনিজ ধাতুর ব্যবহার ছিল বলে অনুমান করা হয়েছিল কয়েকটি ওই রকম তাল দেখে। পরে ভালো ভাবে পরীক্ষার পরে বোঝা যায় ওগুলো অক্সিডাইজড তামার গাদ। যদিও মহেঞ্জোদারো আর হরপ্পাতে বিভিন্ন ধাতুর আকরিক পাওয়া গেছে, কিন্তু তা এতই কম আর এতটাই বিভিন্ন রকমের যে এগুলো আলাদা করে নিষ্কাশনের বদলে নিষ্কাশিত ধাতু ভাটিতে গলানোর সময় মেশানোর জন্য বা অন্য কোন প্রয়োজনেও আনার সম্ভাবনাই বেশি হয়ে থাকতে পারে। অন্য প্রয়োজন বলতে রূপচর্চা, রঙ, ওষুধ, বিষ, এমনি নানা দরকারে।

আরাবল্লির তামা খনিতে (হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তিম লগ্নে) তামা গলানোর যে পদ্ধতি নেওয়া হত তা ছিল প্রথমে খনিজ তামাকে হাল্কা তাপে গরম করা, বিজ্ঞানীদের ভাষায় সিদ্ধ করা। এরপরে ধাতু সমৃদ্ধ খনিজ নিষ্কাশনের চুল্লিতে দিলে তামা নিষ্কাশনে সুবিধা অনেক বেশি পাওয়া যেত।

হরপ্পীয় সভ্যতার শহরগুলোতে যে তামার ‘চুল্লি’ আছে বলা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে তামা গলানোর ভাটি। এম. এস. ভাটের রিপোর্টে লেখা একটি ‘চুল্লি’ পরে আবার পরীক্ষা করে দেখা হয়। (‘চুল্লি’টি মাঝখান থেকে দু’টুকরো হয়ে ছিল।) তার ভেতরের মাটির প্রলেপ উচ্চতাপে গলনাঙ্কে গিয়ে কাঁচের পেন্সিলাকৃতি দানাও সৃষ্টি করেছিল। মুশকিল হল তামার গলন্ত গোল দানা যা ওখানেই থাকার কথা তা পাওয়া গেল কুড়ি ফুটেরও বেশি দুরে।

হরপ্পা শহরেরই এফ এলাকার কাছে কয়েকটি ভাটি পাওয়া যায়, যার নিচের দিকে হাওয়া ঢোকার ও উপরের দিকে ধোঁয়া বের হবার ছিদ্র ছিল। স্বভাবতই প্রথমে সেগুলোকে তামার চুল্লি ভাবা হয়। পরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায় এগুলোর ভেতরে উচ্চ তাপে মাটির প্রলেপ গলে যে কাঁচের দানার মত দানা সৃষ্টি হবার কথা তা নেই। ফলে এগুলো অন্য কোন অজানা কাজে ব্যবহার হতো বলে ধরা হয়েছে। এই এলাকায় গলন্ত তামাধার পাওয়া গেছে। অগভীর, খাড়া মোটা দেওয়ালের পোড়া মাটির এই গলন্ত তামাধারগুলোকে পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মিশ্রধাতুর অবশেষ। ফলে এগুলোও তামা নিষ্কাশনের বদলে তামার মিশ্রধাতু গলানোর কাজেই ব্যবহার হতো বলে ধরে নেওয়া হল।

নিষ্কাশিত ধাতুর তাল থেকে ব্যবহার্য ধাতু

নিষ্কাশিত বড় ধাতুর তালকে ভাটিতে গলিয়ে তৈরি করা হত ছোট ছোট তাল। সম্ভবত বিভিন্ন উৎপাদন কেন্দ্রে বিতরণের জন্য। অনেক সময় এই নিষ্কাশিত ধাতুর তাল ভাটিতে গালিয়ে সরাসরি ঢালাই করা হত। ভাটিতে গলানোর সময়ই তামার সাথে অন্য ধাতুর মিশ্রণ করা হত বলেই ধারনা করা হয়।

নিষ্কাশিত ধাতু থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নানা উপকরণ তৈরি করা

এখানেই আসে ব্যবহারিক প্রকৌশল। যে কোন পণ্যের উৎপাদন তার উপভোক্তার প্রয়োজন আর চাহিদার দিকে লক্ষ রেখেই করা হয়। মানব সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই আজ অবধি তা সমান ভাবে সত্য। হরপ্পীয় সভ্যতার ধাতু শিল্পের উৎপাদনকে আমরা মোটা দুই ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি। এক হল নিত্য জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য, আর বিলাসিতা বা শখ শৌখিনতার চাহিদা পূরণের জন্য।

তামার ব্যবহার শুরু হয়েছে মেহেরগড় থেকে। এবং ধারাবাহিকতা বজায় রেখে হরপ্পীয় সভ্যতার শুরু থেকেই তামার ব্যবহার চলে এসেছে। ধাতু হিসাবে তামার ব্যবহারের বড় সুফল ছিল তার থেকে বিভিন্ন ধরণের ব্যবহার্য উপকরণ তৈরিতে। যা অনেক সময়ই পাথরের হাতিয়ারের বদলে বেশি উপযোগী বলেই দেখা হত। কিন্তু নিখাদ তামা ধাতু হিসাবে নরম বলে সব কাজে লাগতো না। সেই ফাঁক পূরণের জন্য এল খাদ মিশে থাকা বা পরে ইচ্ছাকৃত ভাবে খাদ মেশোনো তামা। সেই পথেই এল আর্সেনিক মেশানো তামা, সিসা মেশানো তামা আর টিন মেশানো তামা। এই শেষেরটিই ব্রোঞ্জ বলেই পরিচিত। এগুলো আসতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। ফলে গোড়া থেকেই তামা আর পাথরের হাতিয়ার পাশাপাশি ব্যবহার হয়ে চলেছে। পরে ব্রোঞ্জ এলেও টিনের অভাবে তার বাজার দাম এতটাই বেশি থাকত যে সেটাও পাথরের সব হাতিয়ার বাতিল করাতে পারেনি। তবে গয়নার কাজে দুটোরই প্রচলন ছিল।

ভাটির গলন্ত তামা থেকে বানানো পাত নানা কাজে ব্যবহার হতো প্রচুর পরিমাণে। তামার বড় পাত কেটে টুকরো করে ব্যবহার করা হত। সেই পাত সব সময় সমান পুরু বা চওড়া থাকত না। পাত প্রয়োজন মাফিক পুরু ও চওড়া করা হত। তারপরে তামার পাতকে কেটে বা পিটিয়ে প্রয়োজনীয় আকার দেওয়া হত।

সিল ও কবচ বানাবার সময় লম্বা পাত থেকে টুকরো কাটা হত ছেনি দিয়ে দুই পিঠে গভীর দাগ দিয়ে হাতের চাপ মুচড়ে ভেঙ্গে। এই পদ্ধতি এখনো চলে। তামা অ্যালমুনিয়াম এমনকি পাতলা লোহার পাতকেও এভাবেই ভাঙ্গা হয় ছোট ছোট কাজের জায়গায়। এই কাটার পদ্ধতি বোঝা যায় মাইক্রোস্কোপের সাহায্যেই।

পাত থেকে তৈরি হত তীর, ছুরি, সিল কবচ এমনি নানা জিনিষ। এর মধ্যে সিল আর কবচের প্রধান ফারাক ছিল সিলে লেখা হত উল্টো করে, যেমনটা আয়নায় দেখা যায়। আর কবচে লেখা বা চিত্র থাকত স্বাভাবিক ভাবেই। এ ছাড়া অক্ষর বা প্রাণীর ছবিতে উল্লেখ করার মত কোন ফারাক দেখা যায়নি। যদিও তামার সিল সংখ্যায় খুব কম পাওয়া গেছে, তাই এগুলোর ব্যবহারের নিয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা করা এখনো কঠিন। তবে বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে কাপড়ে ছাপায় বিশেষ করে সিল্কের (তসর সিল্কে পরীক্ষা করা হয়েছিল) উপর ছাপ সব চেয়ে ভালো আসে। তাই একটা অনুমান তামার সিলগুলো ব্যবহার হত ছাপার জন্য, এবং হয়ত সূক্ষ্ম সূতীর কাপড় বা সিল্কের উপর। এবার ছাপা কেন হত তা কিন্তু অজানাই আছে।

তামার নল (খুব ছোট আকারের) কেমন করে তৈরি হত সেটা নিয়ে খানিকটা গবেষণা হয়েছে। নল ঢালাই হত না। নল তৈরির জন্য তামার পাতকে পিটিয়ে গোল করে দুটো মুখ মিলিয়ে দেওয়া হত। কখনো একটার উপর আরেকটা মুখ চাপিয়ে পিটিয়ে মেশানো বা ঝালাই করা হতনা। কয়েক হাজার ধাতব প্রত্ন নমুনার মধ্যে এখন অবধি শুধু একটি নমুনা পাওয়া গেছে, যাকে ঝালাইয়ের প্রাথমিক পর্যায় হয়ত ভাবতে পারি। তা হল রুপার উপর গলন্ত তামার ফোঁটা ফেলে জোড়া। হরপ্পীয় সভ্যতায় তামার তারের ব্যবহার দেখা গেলেও সেটা তৈরির পদ্ধতি নিয়ে খুব গভীর ভাবে গবেষণা এখনো হয়নি। একটা অনুমান, পিটিয়ে পিটিয়ে লম্বা করা হত।

বাসন বানাবার সময় বড় পাতকে পিটিয়ে গভীর করা বা উঁচু করা হত। এই পিটানোর কাজে কেমন হাতুড়ি ব্যবহার হতো সেটাও বোঝা সম্ভব পরীক্ষাগারে সযত্নে পরীক্ষা করলে। সাধারণত পাথরের, আর কাঠের হাতুড়ি ব্যবহার হত। বাসনে ভাল ফিনিস আনার জন্য হাতুড়ির মসৃণতা খুব দরকারি। অনুমান করা হয় প্রয়োজনে হাতুড়ি চামড়ায় ঢেকে নেওয়া হত প্রকৃত মসৃণতা বজায় রাখার জন্য।বাসনের উপরের নীচের দুই অংশ জোড়ার জন্য পাতের দুটো টুকরো ওভারল্যাপ করে পিটিয়ে জোড়া হত। ঝালাই বা রিভেট ব্যবহার হত না।

ঢালাই তো হতই। ঢালাই কাজের নমুনা পাওয়া গেছে মেহেরগড়েও।আজ থেকে ৬হাজার বৎসর আগেই তামার ঢালাই হয়েছিল মেহেরগড়ে। সেখানে ব্যবহার হত লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি। একই পদ্ধতি পরবর্তীকালের হরপ্পীয় সভ্যতাতেও প্রচলিত ছিল। তবে লস্ট ওয়াক্স বাদেও লস্ট মডেল পদ্ধতিও ছিল। লস্ট মডেল পদ্ধতিতে মডেল বানানো হত অতি মিহি বালিকে চর্বি, আলকাতরা জাতীয় জিনিষের সাথে মিশিয়ে। তারপরে মডেলের উপর আবার বালি সহ মাটির প্রলেপ। এই পদ্ধতিতে বালি খুবই মিহিদানার হতে হত। সম্ভবত একই বালি একাধিক বার ব্যবহার করা হত। এছাড়া বালির ছাঁচ, পাথরের ছাঁচ, মাটির ছাঁচেও তরল ধাতু ঢেলে ঢালাই করা হত। ঢালাই হয়ে গেলে ঘষা মাজা আর পালিশের কাজ।

ঢালাইয়ের কাজে পাথরের ছাঁচও ব্যবহার হতো। যেমন হতো বালির বা মাটির ছাঁচ। লোথালে একটি পাথরে পিনের মত গর্ত দেখে রাও বলেছিলেন সেটি পাথরে পিন ঢালাইয়ের ছাঁচ। পরবর্তীকালে ভালো ভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেল পাথরের ছাঁচের গর্ত দুই দিকেই ঢালু, আবার যে পিন হরপ্পীয় সভ্যতায় ব্যবহার হত তার চেয়ে এই পাথরের খোদা গর্ত বেশ খানিকটাই বড়। কাজেই ওটাকে আর পিন ঢালাইর পাথরের ছাঁচ বলা গেল না।

সোনা পিটিয়ে পাত বানিয়ে ব্যবহার হত। তামার বলের উপর সোনার পাত মুড়ে দেওয়া পুঁতিও পাওয়া গেছে। সোনা দুর্লভ ছিল। কাজেই যত কম ব্যবহার করা যায়। হরপ্পায় সোনার জিনিষ বানানোর সময় দেখা গেছে ঝালাই না করলেও গরম অবস্থায় জোড়া হয়েছে।

হরপ্পীয় সভ্যতায় সোনা রূপা ছাড়াও তামা ব্রোঞ্জ গয়নার ছড়াছড়ি দেখে প্রশ্ন তোলাই যায় শখ শৌখিনতার বাইরে নিত্য ব্যবহার্য কাজে ধাতুর ব্যবহার আদতে কতটা ছিল? শহরে ব্যবহার ছিল, জানা গেছে। তার বাইরে? গ্রামে? কৃষিকাজে? হরপ্পীয় সভ্যতার আমলে তামার ছুরি তৈরি হয়েছিল। দাঁতওয়ালা তামার করাতও ছিল। কিন্তু ফসল কাটার জন্য থেকে গেছে পাথরের কাস্তে। মাছ ধরার বড়শি কিন্তু হাড়ের বা অন্য কোন কিছুর দেখা যায়নি। সব বড়শিই মূলত তামার। হয়ত তামা আসার পরেই বড়শিতে মাছ ধরার প্রচলন হয়েছে। শিকারের জন্য তীরের ফলা বা বর্শার ফলা তামা আর ব্রোঞ্জের ছিল। ক্ষুর জাতীয় ধারাল ছুরিতে আর্সেনিক তামার ব্যবহার দেখা গেছে। কুড়াল দুই তিন রকমের। তামা আর ব্রোঞ্জের পাওয়া গেছে। আর ছেনিও তামা আর ব্রোঞ্জের।

নিত্য প্রয়োজনীয় আরেকটি জিনিষ হল বাসন। থালা, বাটি, হাঁড়ি এইসব। এগুলো তৈরি হত প্রধানত তামার। খুব কম ক্ষেত্রেই ব্রোঞ্জের। কিন্তু অবাক করা জিনিষ হল এই ধাতব বাসনে বজায় থেকে গিয়েছিল মাটির বাসনের ডিজাইন। পাথরের কাস্তে আর মাটির বাসনের ডিজাইনের ধাতব বাসন হয়ত ভারতীয়দের চিরন্তন রক্ষণশীলতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

হরপ্পীয় সভ্যতায় বিশুদ্ধ বা প্রায় বিশুদ্ধ, কিছুটা খাদ তো থাকবেই, তামার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তামার তৈরি নানা জিনিষ গোটা সভ্যতা এলাকা জুড়েই ছড়িয়ে আছে। সে তুলনায় মিশ্র ধাতুর ব্যবহার কম। তবে সামগ্রিক ভাবে তামার মিশ্রধাতু বিশেষ করে আর্সেনিক সিসা এই সব ধাতুর মিশ্রণ মোটামুটি নেহাত কম নয়। এই ধরণের মিশ্র ধাতুর ব্যবহারে মিশ্রণের অনুপাত থাকত বিভিন্ন। সাধারণত উৎপাদিত জিনিষটির ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা খেয়াল রেখেই অনুপাত রক্ষা করা হত। বেশি টিনের অনুপাতে সমৃদ্ধ কঠিন মিশ্র ধাতুর ব্যবহার হয়েছে কম। বেশির ভাগ সময়েই টিন মেশানোর লক্ষ্য ছিল গয়নার উপযুক্ত ধাতুর সোনালী রঙ অর্জন করা। তুলনায় ধাতব কাঠিন্য অর্জনে বিশেষ প্রাধান্য ছিল না।

হরপ্পীয় সভ্যতার টিন ব্রোঞ্জের সাথে সমকালীন মেসোপটেমিয়া বা চিনের তুলনা করলে দেখা যাবে আকারে বা নক্সায় হরপ্পা পিছিয়ে ছিল। হরপ্পার উৎপাদনে শিল্প সৌকর্য বা বিশালত্বের বদলে ব্যবহারিক উপযোগিতার দিকেই লক্ষ্য ছিল। ফলে সব কিছুই সাদাসিধে প্রয়োজন মাফিক। এছাড়া ধাতু মিশ্রণে জ্ঞান-দক্ষতার অভাব চোখে পড়বে না।

কিন্তু সবার আগে দেখা যাক এ পর্যন্ত কি কি পাওয়া গেছে হরপ্পীয় সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্রগুলো থেকে। এখানে এসে হয়ত হরপ্পাবাসীদের বদলে আমাদের বর্তমানের প্রত্নবিশারদদের অক্ষমতাই প্রথমে চোখে পড়বে। তাঁরা প্রত্নক্ষেত্রগুলোর পূর্ণাঙ্গ বিশদ তালিকা প্রকাশ করে উঠতে পারেননি। পারেননি যথেষ্ট পরিমাণে ধাতব জিনিষগুলোর অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করতে। ফলে কী কী পাওয়া গেল সে তালিকা অসম্পূর্ণ। তবু দেখা যাক।

(১) যুদ্ধ বা শিকারের হাতিয়ার

মানব সভ্যতা থাকবে অথচ অস্ত্র থাকবে না এমন হয় না। হরপ্পীয় সভ্যতাতেও অস্ত্র ছিল। তবে কিনা সে অস্ত্র দিয়ে শিকার করা যায়, প্রতিবেশীর সাথে, চোর ডাকাতের সাথে, মারামারি করা যায়। এমনকি তেমন দরকারে পাশের গ্রামের সাথে দাঙ্গাও করা যায়। কিন্তু অন্য সভ্যতার এলাকায় দেখা ব্রোঞ্জযুগে রাজ্যজয়ের জন্য যুদ্ধ করা যায় না। আর যুদ্ধের অস্ত্র না থাকলে সেনা বাহিনীর দরকার নেই। সেনা বাহিনী না থাকলে রাজার কোন ভূমিকাই নেই। আর রাজা না থাকলে অস্ত্র নির্মাণে অর্থব্যয় করার কেউ নেই।

তামার তরোয়াল

দেড় ফুট লম্বা। কিন্তু তা পাতলা। আর কোন খাড়া খাঁজ না থাকায় সেগুলো বেঁকে যেতেই পারে। ফলে প্রকৃত যুদ্ধে এগুলো অকেজো বলা যায়। তবে বড় ছুরি হিসাবে ব্যবহার সম্ভব। বল্লম আর বর্শার ছোট বড় দুই রকমের ফলা আছে। তীরের ফলা আছে। খাঁজ কাটা-ছুরি, তীর ও বর্শার ফলা আছে। সাধারণ ধারালো ছুরি, কুড়াল দুই তিন রকম, ক্ষুর, বড়শি আছে।

হাতযন্ত্র

ছেনি, বাটালি, মোটা সূচ, রিমার (ছোট ফুঁটো বড় করার জন্য লাগে), ওলন। নানা রকম বাসন (আকৃতি প্রচলিত মাটির বাসনের অনুকরণে), ড্রিল বা অগার।

গয়না

পুঁতি, নেকলেস, চুড়ি, বালা, কানের দুল, আর আয়না।

অন্যান্য

পুতুল মাপের মানুষের আর জীব জন্তুর মূর্তি, একটি গরুর গাড়ির মত যান,সিল, কবচ।

সোনাঃ- পাদানি সহ বাটি, গয়না রূপাঃ- সিল, ঢাকা সহ জার, গয়না,

ধাতব প্রত্নসামগ্রী কোনটা শহরের কোথায় পাওয়া গেল তার থেকে আমরা অনুমান করতে পারি সেগুলো তাদের কাছে কতটা গুরুত্ব পূর্ণ ছিল। কোনটা ছিল নিত্য ব্যবহার্য সহজ লভ্য আর কোনটা ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্লভ। তেমন একটি তালিকা বানিয়েছেন ফ্রেনটেস (১৯৭৭), হরপ্পা আর মহেঞ্জোদারোর তখন অবধি পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।

ধাতুসযত্নে সংরক্ষিত ছিলখোলা জায়গায় ছিল
বাসন  
তামা-ব্রোঞ্জ৩৯২৮
রূপা
সিসা
গয়না  
তামা-ব্রোঞ্জ৩৮১৩০
সোনা২১৩৩
রূপা৪৭
ইলেকট্রাম
হাত যন্ত্র  
তামা-ব্রোঞ্জ৭২৩১৪

এই তালিকা থেকে খুব বেশি অবাক হবার মত কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও মনে হবে বাসনের বেলা গল্পটা হয়ত একটু আলাদা। অথবা হয়ত আসলে তা নয়। হরপ্পীয় সভ্যতায় এবং সম্ভবত সব সমসাময়িক সভ্যতাতেই ধাতুর জিনিষ ছিল মূল্যবান। তাই তামা কাঁসার বাসন সিন্দুকে (তখনকার ধারায় মাটির হাঁড়িতে) ভরে রাখা একদম স্বাভাবিক। আজকালও তামা কাঁসার বাসন আলাদা করে সংরক্ষিত থাকে। কারণ সেগুলোর বিক্রয়মুল্য আছে। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোতেও বিক্রয়মুল্য থাকারই কথা। কারণ সেখানেও ব্যবহৃত ধাতু গালিয়ে অন্য কিছু বানানোর প্রমাণ তো আছেই। খোলা জায়গায় যে সোনা রূপার গয়না তালিকায় দেখা যাচ্ছে, কেনয়ের জানাচ্ছেন সেগুলো ছিল খুবই ছোট ছোট, হয়ত অসাবধানে হারিয়ে গিয়েছিল। তবে হরপ্পীয় সভ্যতায় ধাতু যে অন্য সভ্যতার চেয়ে বেশি মূল্যবান ছিল তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় আরেক দিক থেকে। হরপ্পায় অনেক কবর পাওয়া গেছে, কিন্তু অন্য সভ্যতার কবরের তুলনায় হরপ্পাতে মৃতদেহের সাথে ধাতব গয়না বা অস্ত্র হাতিয়ার কবরে ছিলই না বলা চলে।

মিশ্র ধাতু

ব্রোঞ্জ যুগের হরপ্পীয় সভ্যতায় মিশ্রধাতু বলতে প্রধানত বোঝাবে ব্রোঞ্জ। তামা আর টিনের মিশ্রণ ব্রোঞ্জ। তামা আর অন্য ধাতু যেমন সিসা, আর্সেনিক মিশ্রণকেও অনেক সময় কোন কোন বিজ্ঞানী ব্রোঞ্জ বলতে পছন্দ করেছেন। কিন্তু বোঝার সুবিধার জন্য তামা টিন মিশ্রণকেই আমরা ব্রোঞ্জ বলব।

এমনিতে মিশ্র ধাতু বলতে মুল খনিজ ধাতুর সাথে অন্য ধাতুর মিশ্রণ। প্রকৃতিতে কোন নিখাদ ধাতু পাওয়া কঠিন। সব সময়ই তার সাথে ট্রেস এলেমেন্ট হিসাবে আরো নানা ধাতু মিশেই থাকে। কিন্তু সেগুলোকে এখানে আমরা মিশ্র ধাতু বলব না। মিশ্রধাতু তখনই বলব যখন কোন একটি ধাতুর সাথে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অন্য ধাতু মেলানো হয়েছে। 

তামার সাথে টিনের মিশ্রণ

তামার মিশ্র ধাতুর মধ্যে আমাদের আছে অতি পরিচিত কাঁসা আর পিতল। এর মধ্যে পিতলের (তামা ও দস্তার মিশ্রণ) ব্যবহার হরপ্পীয় সভ্যতায় নেই। এবার কাঁসা বলতে তামা আর টিনের যে মিশ্রধাতু চিনি সেটাই হরপ্পীয় সভ্যতায় ব্যবহার হত এমন নয়। এমনিতে কাঁসা হল তামা-টিনের বিশেষ অনুপাতের মিশ্রণ (তামা ৮০% + টিন ২০%) বা আদর্শ ব্রোঞ্জ।  কিন্তু এই অনুপাত সব সময় বজায় রাখা হয় না। তামা ৭৫-৯০% সাথে টিন ২৫-১০% অনুপাতকে ব্রোঞ্জ বলা যেতে পারে।

হরপ্পীয় সভ্যতার ব্রোঞ্জের অনুপাত সব সময় তামা ৭৫-৯০% সাথে টিন ২৫-১০% মেনে চলেনি। খুব স্বাভাবিক কারণেই। তখনকার ধাতু মিশ্রণ পদ্ধতিতে অত নিখুঁতভাবে মিশ্রণ অনুপাত বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। তেমনটা আশা করা খুব বেশি কল্পনা হয়ে যাবে। হরপ্পীয় সভ্যতার কারিগরেরা এই মিশ্রণ অনুপাত নিয়ন্ত্রণ করত খানিকটা অভিজ্ঞতা প্রসূত আন্দাজ, আর চোখে দেখে। তামার সাথে ৭-৮% টিন মেলালেই তার রঙ হয়ে যেত সোনালী। ব্রোঞ্জের গয়না তৈরির জন্য এই সোনালী রঙটুকুই দরকার। বেশি টিন মিশিয়ে কঠিন করার দরকার হত কেবল বিশেষ হাতিয়ার তৈরির জন্য। যেহেতু হরপ্পা সভ্যতায় বহুল ব্যবহৃত আর রঙ সোনালী, তাই এই ৭-৮% টিন মিশ্রণকেই উদ্দেশ্যমূলক মিশ্রণ, বা ব্রোঞ্জ বলতে পারি।

সাধারণভাবে তামার সাথে ২%-এর বেশি টিন থাকলে ধরে নেওয়া হয় সেটা ইচ্ছাকৃত ভাবে মেশানো হয়েছিল। ৮-১২% এর বেশি টিন মেশানো থাকলে তাকে প্রকৃত ব্রোঞ্জ বলে ধরা যেতে পারে। অনুপাতে টিনের মাত্রা ৪-৫% এর কম হলে তার মধ্যে ব্রোঞ্জের নিম্নতম গুণগত মান আর বজায় থাকে না। চক্রবর্তী-লাহিড়ির মতে হরপ্পান কারিগরেরা সব সময় ব্রোঞ্জের কাঠিন্যের কথা ভেবে ব্রোঞ্জ ব্যবহার করতো না। তাদের একটা বড় কাজ ছিল গয়না তৈরিতে ব্রোঞ্জের ব্যবহার। তামার অক্সিডাইজেশন হবে না আর রঙ সোনালী হবে এই দুটো শর্ত পূরণ করলেই তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হত। হরপ্পান কারিগরদের মুখ্য উদ্দেশ্য গয়না তৈরি হলে ৮% আশপাশের অনুপাতের মিশ্রণকেই তারা প্রাধান্য দেবে। এই অনুপাতকে ব্রোঞ্জ ধরলে সংখ্যাতত্ত্বের হিসাবে হরপ্পা সভ্যতার ব্রোঞ্জের ব্যবহার বেশ ভালো মনে হলেও বাস্তবে তাই হয়ত হল না। হরপ্পান কারিগরদের উৎপাদনের দুটো প্রধান ভাগ হাতিয়ার আর গয়না। ছেনি কুড়াল বানাতে লাগবে কাঠিন্য আর বালা, চুড়ি বানাতে লাগবে সোনালী রঙ। সম্ভবত সেই প্রয়োজন অনুযায়ী তারা তামার সাথে টিন মেলাত। ফলে ঠিক একটি নির্দিষ্ট অনুপাতকে ব্রোঞ্জ বললে হরপ্পা সভ্যতার ব্রোঞ্জ চেনা কঠিনই হবে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে অনুপাতই যদি ঠিক না থাকলো তবে তাকে ব্রোঞ্জ বলবো কেন? এই প্রসঙ্গে প্রত্নবিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মত পার্থক্য আছে যে ঠিক কতটা হলে তাকে মিশ্রধাতু ব্রোঞ্জ বলা হবে। যেমন হল-স্টিম্যান (১৯৯১)এর মতে ৫% টিন থাকলেই অনেকটা কাঠিন্য দেখা যায়, কাজেই তাকেই ব্রোঞ্জ বলা যেতে পারে। তবে মতপার্থক্য আছে কোন অনুপাতকে প্রাকৃতিক মিশ্রণ বলা হবে আর কোন অনুপাতকে ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ বলে ধরা হবে। আগরওয়ালের মতে ১% এর বেশি টিন থাকলেই ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ বলা যেতে পারে। মহেঞ্জোদারোতে তামা ব্রোঞ্জের রাসায়নিক পরীক্ষা করেছেন (প্রধানত) সানাউল্লা এবং (কিছুটা) ম্যাককে। কিন্তু তাঁরা প্রাকৃতিক মিশ্রণ আর উদ্দেশ্যমূলক মিশ্রণ বলে যে বিভেদ রেখা চিহ্নিত করেছিলেন সেই নিয়েও মতবিরোধ থেকে গেছে। ফলে সব সহ হরপ্পীয় সভ্যতায় ব্রোঞ্জের ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়েও দ্বিমত থেকে গেছে।

তামার সাথে আর্সেনিক

এই মিশ্রণ হরপ্পীয় সভ্যতায় বহুল ব্যবহৃত হলেও এখানে বড় সমস্যা হল তামার সাথে আর্সেনিক কি খনিজ খাদ হিসাবেই ছিল না পরে মেশানো হয়েছে, সেটা পরীক্ষাগারে বের করা দুষ্কর। সাধারণত আর্সেনিকের পরিমাণ ২% এর কম হলে তাতে সাধারণ তামার সাথে গুনগত মানে খুব কিছু আলাদা হয় না। তবে আগরওয়ালের মতে ২% নয় ১% আর্সেনিক থাকলেই তাকে উদ্দেশ্যমূলক মিশ্রণ বলতে হবে। হরপ্পীয় সভ্যতায় এই তামার সাথে মিশ্রণে সাধারণত ১%-৫% আর্সেনিক থাকে। কাজেই আগরওয়ালের মত ধরে এগোলে হরপ্পীয় সভ্যতার প্রায় সব আর্সেনিক সমৃদ্ধ তামাকেই বলতে হয় ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ। যেটা হয়ত খানিক বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। আর্সেনিক ইচ্ছাকৃত ভাবে মেশাতে হলে খনিজ তামার সাথে আর্সেনিক সমৃদ্ধ কোন খনিজ মেলাতে হয়। আর্সেনিক উদ্বায়ী। ফলে এক্ষেত্রে তামার সাথে আর্সেনিকের মিশ্রণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন। কিন্তু তেমন মিশ্রণ হরপ্পাতে পাওয়া গেছে। ফলে বোঝা যায় এই কঠিন কাজটি তারা আয়ত্ত করতে পেরেছিল। হরপ্পীয় সভ্যতার আর্সেনিক সমৃদ্ধ তামায় আর্সেনিকের অনুপাত বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন। সম্ভবত এটা নির্ভরশীল ছিল কোন এলাকার তামা ব্যবহার হচ্ছে তা উপরে। এই আর্সেনিকের মাত্রার সূত্র ধরে হয়ত তামার উৎসের বা সভ্যতার বসতিগুলোতে বিতরণের একটা ধরণ বোঝা যেতে পারে। যার থেকে বাণিজ্যিক যোগাযোগ পথ আন্দাজ করা সম্ভব হতেও পারে।

তামা সিসার মিশ্রণ

তামা টিন মিশ্রণ বাদে আরেকটি মিশ্রণ হরপ্পীয় সভ্যতায় বহুল ব্যবহৃত। তা হল তামা সিসার মিশ্রণ। মহেঞ্জোদারোর একটি নমুনায় তামার সাথে সিসার মিশ্রণে ৩২.১৭% সিসা পাওয় যায়। কতটা সিসা থাকলে তাকে ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ বলা হবে সেটাতেও দ্বিমত আছে। তবে সাধারণভাবে হরপ্পীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে ১% বা তার বেশি সিসা থাকলেই তাকে ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ বলে ধরা হয়। সিসা মেলানোর দুটো সম্ভাব্য পদ্ধতি ছিল। এক হল ভাটিতে গলানোর সময় মেশানো, অপরটি হল ঢালাই করার সময় মেলানো।

তামা দস্তার মিশ্রণ

এই সোনালী রঙের মিশ্র ধাতুটি আমাদের কাছে পরিচিত পিতল হিসাবে। তামার সাথে দস্তার মিশ্রণ ঘটানো কঠিন পদ্ধতি। তাই গোটা পৃথিবীতে এই মিশ্রণ চালু হয়েছে ব্রোঞ্জের অনেক পরে। আনুমানিক সাধারণ পূর্বাব্দের প্রথম সহস্রাব্দে।

প্রায় সব বিজ্ঞানীর ধারনা হরপ্পীয় সভ্যতায় দস্তা মিশ্রণ তথা পিতলের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু সিন্ডে-পা্র্ক (২০১৪) জুটি বলেন তাঁরা দস্তার মিশ্রণ পেয়েছেন ফারমানাতে ও কুন্টাসিতে। দুটো জায়গা মিলে মোট ৪টি প্রত্ন সামগ্রী পেয়েছেন, যাতে মিশ্রণের অনুপাত মিশ্র ধাতুটির স্বীকৃত অনুপাতেই আছে। এটা বেশ চমকপ্রদ খবর। এরপরে খবর আসে নভিনাল (২০১৪) প্রত্নক্ষেত্রেও দস্তা মিশ্রণ পাওয়া গেছে ৭টি প্রত্ন দ্রব্যে। এগুলোতে দস্তার পরিমাণ ০.৩২% থেকে ৩.৯%. কিন্তু তামা-দস্তা ইচ্ছাকৃত মিশ্রণের স্বীকৃত মানে অনুযায়ী মিশ্রধাতুটিতে দস্তার অনুপাত থাকার কথা কম করেও ৮% কাজেই নভিনালে এই দস্তা মিশ্রণকে প্রাকৃতিক খনিজ খাদ বলতে হয়। এছাড়া সম্ভাবনা থাকে অজান্তে দস্তা সমৃদ্ধ খনিজ মিশে যাওয়া একেবারে নিষ্কাশনের সময়। অজান্তে, কারণ ঐ ৮শতাংশের কমে তামার চরিত্রগত পরিবর্তন বোঝার উপায় নেই।

নভিনালকে বাদ দিলেও ফারমানা ও কুন্টাসিতে যে পিতলের ব্যবহার হত তার গুরুত্ব অনেক। ফারমানা-কুন্টাসিতে যে ৪টি পিতলের প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গেছে তার সবকটাই গয়না। মূলত চুড়ি, বালা এইসব। তাতে বোঝা যায় কারিগরদের পিতল উৎপাদনের লক্ষ ছিল সোনালী রঙ পাওয়া। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই থাকুক যদি ফারমানা-কুন্টাসি তথ্য একেবারেই সঠিক হয় তবে বলতেই হবে ধাতু মিশ্রণ কারিগরেরা সাধারণ পূর্বাব্দের তৃতীয় সহস্রাব্দেই একটি অসাধারণ ধাতু মিশ্রণ কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। কাজেই এই বিষয়ে আরো জোরদার গবেষণা হওয়া জরুরী। কারণ ফারমানা কুন্টাসি মোটেই পাশাপাশি প্রত্ন ক্ষেত্র নয়। তাদের ভৌগোলিক পরিবেশও একেবারেই ভিন্ন। এবং সিন্ডে-পার্ক (২০১৪) একই গবেষণাপত্রে জানাচ্ছেন এই দুই প্রত্নক্ষেত্রে সিসা খাদ মিশ্রিত তামার দেখা পাননি। কোন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বা ঘটনাক্রম এই দুটো প্রত্নক্ষেত্রকে ধাতু-মিশ্রণে বিশেষ জায়গায় মিলিয়ে দিল তা জানা খুব দরকার।

হরপ্পীয় সভ্যতায় তামার মিশ্র ধাতুর ব্যবহার

তামা নরম ধাতু। তাই অনেক কাজেই তামার ব্যবহার সম্ভব না। বিশেষ করে পাথরের হাতিয়ারের বদলে তামা অনেক সময়ই অকেজো। সেই অসুবিধা দুর করতে ব্যবহার শুরু হলো মিশ্রধাতু ব্রোঞ্জের। ফলে সাধারণভাবে ভাবা যেতে পারে যে কালক্রমে তামার পরিবর্তে ব্রোঞ্জের ব্যবহারই সর্বজনীন হয়ে উঠবে। কিন্তু হরপ্পীয় সভ্যতায় তেমনটা ঘটেনি। ব্রোঞ্জের ব্যবহার সীমিতই থেকে গেছে। তার কারণ হিসাবে প্রধানত ভাবা হয় যে হরপ্পীয় সভ্যতার কাছে তামা থাকলেও টিনের জোগানের অভাব ছিল।

সাধারণ তামার চেয়ে আর্সেনিক মিশ্রিত তামা খানিক কাঠিন্য দেয়। হরপ্পীয়সভ্যতার কারিগরেরা এর যথোপযুক্ত ব্যবহার করেছেন।

হরপ্পীয় সভ্যতার কোন এলাকা থেকে কত মিশ্রিত তামার প্রত্ন সামগ্রী পাওয়া গেছে তার একটা তালিকা থাকল। অবশ্যই এই তালিকা সম্পূর্ণ তালিকা নয়। অজান্তে আরো থেকেই যেতে পারে। তাছাড়া প্রকাশিত তথ্যের অভাবে রাখিগড়িও বাদই থেকে গেল। তালিকায় দেখানো আছে ইচ্ছাকৃত মিশ্রিত তামার নানা প্রত্নসামগ্রী, যা পরীক্ষার যোগ্য আর পরীক্ষিত। এতে দেখা যাবে পরীক্ষার যোগ্য সামগ্রীর অর্ধেক মাত্র বিশ্লেষণ হয়েছে। বেশির ভাগ ধাতব প্রত্নদ্রব্য কোন না কোন কারণে বিশ্লেষণের বাইরেই থেকে গেছে।

যেমন চানহু-দারোতে পাওয়া গিয়েছিল ৫২১টি নমুনা (বোষ্টন মিউজিয়ামে রাখা আছে)।

লোথাল রিপোর্টে বি.এস রাও বলছেন তিনি পেয়েছিলেন ১৫০০ ধাতব প্রত্নদ্রব্য। তবে তার মধ্যে কেবল ৫০০টি কী জিনিষ, তা অনুমান করা গেছে মাত্র। আর ১৩০টি সঠিক ভাবে চেনা গেছে।

সুরকোটাডাতে ১২৯টি ধাতব প্রত্নদ্রব্য পাওয়া গেছে।

কালিবঙ্গানে বি. বি. লালের প্রথম ফিল্ড রিপোর্টে ১৯টি লেখা থাকলেও ভিন্ন আরেকটি লেখায় তিনি আরো ৯টির উল্লেখ করেন।

রাখিগড়ির তালিকা এখনো তৈরি হচ্ছে এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণ চলছে এর বেশি কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই।

ধোলাভীরার রিপোর্টে বিস্ত বলছেন প্রচুর ধাতব প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গেছে। যা পরিমাণে ও ধরনে হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর মতই। কয়েকটা স্কেচ প্রকাশ করেছেন, তাতে ধরনটা বিস্তের কথাকেই সমর্থন করে। কিন্তু পরিমাণটা সংখ্যায়, বিশদে, বলা নেই।

রংপুর থেকে পাওয়া প্রত্ন সামগ্রী সংখ্যায় ২৫ হলেও আকৃতি চেনা যায় এমন ছিল ১৮টি।

ফারমানা আর কুন্টাসির ধাতব প্রত্নের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করেছেন বসন্ত সিন্ডে ও পার্ক (২০১৪) যুগ্মভাবে। ওনাদের করা ৫৬টি বিশ্লেষণ থেকে এক অদ্ভুত তথ্য বের হয়ে আসে। এই পরীক্ষিত নমুনাগুলোতে তামার সাথে প্রাকৃতিক বা ইচ্ছাকৃত কোন ভাবেই সিসা যোগ হয়নি। অথচ হরপ্পা কালিবঙ্গান ধোলাভীরা এসব এলাকায় তামার সাথে সিসার মিশ্রণ দেখা গেছে। তা হলে দিল্লির কাছে ফারমানা আর গুজরাতে উপকুলের কুন্টাসি দুটো এলাকার বিশাল দূরত্ব সত্যেও শুধু এই দুটো ক্ষেত্রের তামার নমুনা কেন সিসাহীন? খুব বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে হরপ্পীয় সভ্যতার তামার বিভিন্ন উৎসের কথা, নিষ্কাশিত তামার আদান প্রদান বাণিজ্যের কথা। আর সাথে তামার ব্যবহারের প্রক্রিয়া পদ্ধতির বিভিন্নতার কথাও।যা হয়ত নির্ভর করত স্থানীয় কারিগর গোষ্ঠীর উপর।

সিন্ডে-পার্ক (২০১৪) জানাচ্ছেন ফারমানা আর কুন্টাসিতে ইচ্ছাকৃত তামা-দস্তা মিশ্রধাতু (পিতল) পাওয়া গেছে। হরপ্পীয় সভ্যতার কালে পৃথিবীতে আর কোথাও তামা-দস্তা মিশ্রণ ব্যবহারের প্রমাণ নেই।

দাইমাবাদে পাওয়া গেছে অনেকগুলো ব্রোঞ্জের পুতুলাকৃতি মূর্তি। কিন্তু মুশকিল হল এগুলোর কাল নির্ণয় বিতর্কিত। তাই এগুলো এই আলোচনার বাইরেই থাকবে।

সব সহ অনেক তথ্যই নেই। ফলে এখনো কোন সঠিক কিছু ধারনা করা সম্ভব না। আপাতত ধারনার বদলে অনুমানেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছে।

প্রত্নক্ষেত্রনমুনার সংখ্যাতামা খাদ আর্সেনিকতামা খাদ সীসাতামা খাদ টিনমিশ্র ধাতুমোট পরীক্ষিত মিশ্র-ও খাদ
মহেঞ্জোদারো১৬২২৪১২৪৩
ধোলাভীরা
হরপ্পা৭১২৮১০১২৫২
লোথাল৭৩১২
চানহু-দারো৩১১৫
কালিবঙ্গান২৭১৪২২
রংপুর১২
সুরকোটাডা৪২১০৩১
নভিনাল১০
কুন্টাসি৩১২১
ফারমানা২৬১৬১৭
মোট৪৮৭৮০৩০৬৯৪৬২২৫
তামার সাথে মিশ্রণসংখ্যাবিশ্লেষিত সামগ্রীর
সিসা৩০৬.৪২%
আর্সেনিক৮০১৭.১৩%
টিন৬৯১৪.৭৮%
বিভিন্ন৪৬৯.৮৫%
অমিশ্রিত২৪২৫১.৮২%
প্রত্নক্ষেত্রবিশ্লেষণ করা হয়েছেতামার মিশ্র ধাতু
হরপ্পা৩৩৭৮.৭৯%
সুরকোটাডা৪২৭৩.৮১%
কালিবঙ্গান২৭৮১.৪৮%
কুন্টাসি২৫৮৪.০%
ফারমানা৩১৫৪.৮৪%

উপরের তালিকাগুলো বলবে যে ইচ্ছাকৃত মিশ্রধাতু হিসাবে তামার বিভিন্ন মিশ্রণের ব্যবহার মোটামুটি ভালোই বলা গেলেও টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জের ব্যবহার হরপ্পীয় সভ্যতায় তেমন একটা উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাছাড়া একদম শুরুতে, জন মার্শালদের আমলে, আর্সেনিক বা সিসা মিশ্রিত তামাকে সাধারণ তামারই সমতুল বলে ধরা হত। কারণ সেগুলো টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ নয়। মহেঞ্জোদারোতেই ম্যাককে লিখেছেন ৪৪০টি তামা ও ব্রোঞ্জের প্রত্নসামগ্রীর কথা। তার আগে জন মার্শালরাই বেশির ভাগ কাজ করেছেন, অথচ তার কোন তালিকা রাখেননি। শুধু সামগ্রিক ভাবে প্রতিটি প্রত্নদ্রব্যের তালিকা রাখেননি তাই নয়সামগ্রীগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ভাগও করেননি। পরে ম্যাককে মহেঞ্জোদারোতে তেমন একটা ব্যবহারিক ভাগ করা তালিকা বানিয়েছিলেন

১. হাতিয়ার ও হাতযন্ত্রঃ কুড়াল, বল্লমের ফলা, তীর, ছুরি, তরোয়াল, ক্ষুর, কাস্তের আকারে বাঁকা ব্লেড, করাত, ছেনি, ড্রিলবিট, বড়শি, হুক, সূচ, দাঁড়ি-পাল্লা, ওলন।

২. গয়নাঃ আয়না পুঁতি, বালা, দুল, আংটি, বোতাম, নানা গয়না।

৩. বাসনঃ মাটির বাসনের মত দেখতে নানা বাসন, চ্যাপ্টা চামচ, হাতল সহ কড়াই।

জন মার্শালরা মহেঞ্জোদারোর খনন কালে শহরটির পর্যায় ভেদ করলেও কালস্তর ভেদ করেননি। ফলে কোন জিনিষ কোন সময়ে তৈরি তাও জানার কোন উপায় নেই। আসলে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির অভাবে কাল নির্ণয় সব সময় একটা বেঞ্চ মার্ক ধরে করার প্রথা ছিল। সেই বেঞ্চ মার্ক তখন ছিল কিশ শহরে পাওয়া মহেঞ্জোদারোর সিলের কালস্তর। ফলে কিশের সাথে মহেঞ্জোদারোর কালও বদলাতো।

কেনয়ের আরেকটা সমস্যার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন মহেঞ্জোদারোতে বলা হয় সিটাডেল এলাকায় ধাতব জিনিষ প্রায় কিছুই ছিল না। সবই পাওয়া গেছে নিচু শহর এলাকায়। অবাক করা তথ্য। এর সম্ভাব্য সমাধানে তিনি বলেছেন, মহেঞ্জোদারো শহরটি একই সমতলে নেই। শহরের মধ্যেকার আবর্জনার স্তূপ দিয়ে নিচু জায়গা ভরাট করে বাড়ি তৈরি ও পূনর্নির্মাণ হত। একই ভাবে বাড়ির ভিতের জন্য মাটি ভরাটের কৌশল হরপ্পাতেও ছিল। ফলে কোন এক জায়গায় ধাতব জিনিষ পেলে আসলেই সেটা সেই জায়গারই, তা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব না। অন্য আবর্জনার সাথে বাতিল ধাতব আবর্জনাও স্থানান্তরিত হবেই। সেসব তথ্য ফিল্ড রিপোর্টে উল্লেখ থাকলে ভুল বোঝার সম্ভাবনা কমে যায়। পরবর্তীকালেও অন্যান্য জায়গার খনন কাজেও এই সব বিবরণ বিশদে রাখা ও যাচাই করা হয়নি।

ফলে সব নিয়ে, আমরা জানতে পারছি না, হরপ্পীয়সভ্যতায় ব্রোঞ্জের ব্যবহার সঠিক কবে শুরু হয়েছিল। আর তার ধারাবাহিক বিবর্তনের ইতিহাসও অজানাই থেকে গেল। ব্যবহার কাল, বিবর্তনের ধারা জানলে অন্য সংস্কৃতি, যথা বালুচিস্তান, আফগানিস্তান, চোলিস্তান, আহর, সোথি, এইসব এলাকার সংস্কৃতির সাথে হরপ্পীয় সভ্যতার ধাতু শিল্পের সম্পর্কের ইতিহাস বোঝা সম্ভব হত।

আয়না

হরপ্পীয় সভ্যতার ব্রোঞ্জের আয়নার উৎপাদন আলাদা করে উল্লেখ করার মত। কবরে দান সামগ্রীর মধ্যে ধাতব জিনিষ যতই কম থাকুক না কেন একটি ব্যতিক্রম ছিল এই আয়নার বেলা। নারীদের কবরে আয়না থাকাটা খুব সাধারণ ছিল। এটা কোন ধর্ম-সংস্কার না শুধুই নারীদের পরলোকেও রূপচর্চা দরকার বিশ্বাসে দেওয়া হত তা অবশ্য বলা কঠিন।

ঐতিহাসিক যুগের ব্রোঞ্জ

যদিও হরপ্পা যুগের কথা নয় আর যে বইটি থেকে তথ্য নিচ্ছি সেটি লেখা হয়েছে হরপ্পীয় সভ্যতার আবিষ্কারেরও আগে, তবু ঐতিহাসিক ভাবে ভারতে ব্রোঞ্জ বলতে আমাদের কি ধারনা ছিল তা খানিটা বোঝা যাবে। ১৯১৮ সালে প্রকাশিত কপার ইন অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়া বইটির লেখক পঞ্চানন নিয়োগী। বইটি উল্লেখ যোগ্য কারণ এটা প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সাইন্স থেকে।

পঞ্চানন নিয়োগী লিখছেনঃ (যেহেতু তখনও হরপ্পীয় সভ্যতার কথা জানা যায়নি তাই…) প্রাচীন ভারত বলতে তখন বৈদিক ভারত। সেই বৈদিক ভারতে চরক সুশ্রুত অর্থশাস্ত্র এগুলোতে কাঁসার উল্লেখ থাকলেও বেদে কাঁসার উল্লেখ নেই। আদি সংস্কৃত শব্দে পিতলকে বলা হত “রিতি”। পিত্তল থেকে পিতল শব্দটি পরে এসেছে। ষষ্ঠ শতাব্দীর অমরকোষে উল্লেখ আছে কাঁস্য-তলা যা ব্যবহার হতো বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে মিশ্র ধাতু “ত্রিপুটকা” যার মধ্যে থাকত দুইভাগ তামা আর একভাগ রূপা। ত্রয়োদশ শতাব্দীর “রসরত্ন-সমুচ্ছায়া” অনুযায়ী কাঁসাতে থাকবে আটভাগ তামা দুইভাগ টিন।

পঞ্চানন নিয়োগীর বই থেকেঃ- মোঘল আমলের বিখ্যাত কামান (১৪ফুট ৩ইঞ্চি লম্বা) “মালিক-ই-ময়দান” কামান ছিল ব্রোঞ্জের। এই ব্রোঞ্জে তামা ৮০.৪২৭% আর টিন ১৯.৫৩৭% বাংলার ইশা খাঁয়ের কামানঃ- তামা ৮৭.৭২%, টিন ১.৮৩, দস্তা আর লোহা ১৩.৮২%

পঞ্চানন নিয়োগীর কাছে প্রত্ন ব্রোঞ্জ সামগ্রী হিসাবে পরীক্ষার জন্য জমা পড়া চারটি নমুনার বিশ্লেষণের ফলঃ-

নমুনা ক্রমিকতামা%টিন%
১. ছুরি৮৬.৭১৩.৩
২ তরোয়াল ২৮.৩/৪ ইঞ্চি লম্বা৯৫.৬৮৩.৮৩
৩. হারপুন৯১.১২৭.৯৭
৪. হারপুন৯৩.১৮৬.৭৪

এই তালিকা দেখে বোঝাই যায় ঐতিহাসিক আমলেও সব কাঁসা আসলেই ব্রোঞ্জ ছিল না। টিনের অভাব ছিল এবং ঐ প্রয়োজন অনুসারে অনুপাত নিয়ন্ত্রণ হত।

পঞ্চানন নিয়োগীর মতে বাংলায় ব্রোঞ্জ ঢালাই উৎকর্ষতা লাভ করে অষ্টম নবম শতাব্দীতে। এই ঢালাই জ্ঞান এসেছিল নেপাল হয়ে তিব্বত থেকে।

পঞ্চানন নিয়োগীর মতে ভারতে পিতলের ব্যবহার প্রথম শতাব্দীতেও প্রচলিত ছিল। ভারতে দস্তা পেত ক্যালামাইন খনিজ থেকে, যার সংস্কৃত নাম ছিল “রসকা” ও “খারপারা”।

আলোচনা

পশ্চিম এশিয়া থেকে দক্ষিণ এশিয়া এই বিশাল এলাকায় ধাতুর ব্যবহার সমসাময়িক কালে বর্তমান থাকলেও এর উৎপত্তি পশ্চিম এশিয়া। তারপরে এসেছে দক্ষিণ এশিয়াতে এমনটা ভাবার পেছনে যথেষ্ট প্রত্ন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায় নি। বরং এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রমাণ বলে দক্ষিণ এশিয়াতে ধাতুর ব্যবহার স্বাধীন ভাবে শুরু হয়েছিল। ফলে কে আগে কে পরে সেই হিসেব অর্থহীন।

এটা ঠিক গোটা এলাকায় হয়ত একটা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল, যা নিয়মিত না হলেও ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর আসা যাওয়ার মাধ্যমে। গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সম্ভাবনা ছিলই। গোটা এলাকাতেই প্রথমে হাতে মাটির বাসন বানানো শুরু করে মাটির বাসন পোড়ানো তার পরে রঙকরা হতে থাকে। এই মাটির বাসন পোড়ানো থেকেই আগুনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের শুরু। যে নিয়ন্ত্রণজ্ঞান পরে কাজে লেগেছে ধাতু গলানো ও মেশানোর কাজে।

পোড়া মাটির বাসন বানানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের মাটি নিয়ে তারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে। পরবর্তী পর্যায়ে বাসন রঙ করার উৎসাহেও বিভিন্ন এলাকার মাটি এনেছে। এর মধ্যে দিয়েই নানা এলাকা থেকে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে মাটি আনার প্রথা চালু হয় সেই নব্যপ্রস্তর যুগের গোড়াতেই। আর এই প্রয়োজনটিও বিশেষ মাটির নির্বাচিত ব্যবহার। এর থেকেই তাদের নজরে আসে, কোন কোন মাটি পোড়ালে তার থেকে শক্ত জিনিষ বের হয়ে আসে। আর সেই শক্ত জিনিষটি জলে গলে না, তাকে পেটালে দুমড়ে যায় বটে, কিন্তু ভাঙে না।

ধাতু বিশেষ করে তামার আবিষ্কার যে এই পথেই হয়েছিল তা আলিকোশের পেটানো দোমড়ানো তামার টুকরো থেকেই বোঝা সহজ। এটাও বোঝা সহজ যে ধাতু আচমকা আবিষ্কার হয়নি। বাসন বানাবার মাটি নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। আর এই পরীক্ষা নিরীক্ষার অভ্যস-জ্ঞানই তাদের ধাতুর ব্যবহার আরম্ভকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে এগুতে শিখিয়েছে। কেউ কদিন আগে তো কেউ কদিন পরে শিখেছে। একই পথে প্রায় প্রতিটি সভ্যতাই স্বাধীন ভাবে ধাতুর ব্যবহার শুরু করতে পারে, যদি তাদের কাছে ধাতু সমৃদ্ধ খনিজ থাকে।

মেহেরগড় সংস্কৃতির এলাকা অবশ্যই ছোট্ট মেহেরগড়েই সীমাবদ্ধ এমন ভাবা উচিত হবে না। আশপাশের অনেকটা এলাকাতেই সমসাময়িক জনবসতি থাকার সম্ভাবনা আছেই। তাদেরই কোন একটিতে তামা বের হলে তারপরে সেটার আদান প্রদান চালু হতে আর কতক্ষণ। মাটির বাসন বা তার রঙের জন্য যেমন করে মাটি দেওয়া নেওয়া হত, তেমনি করে ঐ শক্ত জিনিষ মেশা মাটিরও দেওয়া নেওয়া স্বাভাবিক ভাবেই না চলার কোন কারণ নেই।

অবশ্যই মাটিতে ধাতুর উপস্থিতি জানা আর ধাতু হিসাবে তার বিশেষ ব্যবহার শুরু করার মধ্যে থাকবে সময়ের ব্যবধান। একটি জনগোষ্ঠীর সামগ্রিকভাবে নিত্য নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য সামাজিক স্তরে উন্নতির একটি পর্যায়ও দরকার। মেহেরগড়ে তামার ব্যবহার শুরুর কালেই দেখা গেছে তারা মাটির পুঁতি বানানো, বিশেষ ধরনের মাটি পুড়িয়ে ছাঁচ বানানো শুরু করে দিয়েছিল। ফলে বোঝা সহজ তারা তখন নানা অভিনব জিনিষ বানাতে, ব্যবহার করতে প্রস্তুত হয়েই ছিল। ফলে ধাতুর ব্যবহার শুরু করতে তাদের বিরাট কোন মানসিক বাধা আসেনি।

মেহেরগড়ে তামার ব্যবহারের প্রায় সমসাময়িক কালেই তামার ব্যবহার শুরু হয়ে যায় বালুচিস্তানের নানা এলাকায়, এবং সম্ভবত রাজস্থানের আরাবল্লি এলাকায়, কালিবঙ্গানে, আর এখনো না জানা নানা এলাকায়। এর সবকটি এলাকাতে স্বাধীনভাবেই তামার ব্যবহার শুরু হবার সম্ভাবনা থাকছে। পরবর্তী কালে কোন কোন এলাকা উন্নতি করেছে বা অবনতি হয়েছে নানা ভৌগোলিক কারণে। মাঝখানে সিন্ধু নদ অববাহিকা থাকায় রাজস্থান ঘগ্গর-হাকরা এলাকার আর মেহেরগড় বালুচিস্তানের সাথে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, সেই শুরু আমলে অতি ক্ষীণ থাকারই কথা। ফলে শুরুতে, সিন্ধু নদীর পাড়ের আর ঘগ্গর-হাকরা পাড়ের জনগোষ্ঠীগুলো স্বাধীন ভাবে গড়ে ওঠা ধাতু শিল্পে ভিন্ন প্রকৌশল অবলম্বন করতে পারে। তারপরে আসবে হরপ্পীয় সভ্যতা। এই সভ্যতার আমলে যোগাযোগ হবে ঘনিষ্ঠতর। ফলে ভিন্ন প্রায়োগিক প্রকৌশল বিনিময় শুরু করবে। আর এই বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হবে বহু বিভিন্ন নতুন প্রকৌশল। তৈরি হতে থাকবে বিভিন্ন উপকরণ।

হরপ্পীয় সভ্যতার যে দিকগুলো গবেষণার দিক থেকে অবহেলিত হয়েছে তার মধ্যে পড়বে ধাতু শিল্প। যৎসামান্য যা জানা গেছে তা কেবল প্রত্ন সামগ্রীর পরিচিতি আর ধাতু পরিচিতি নিয়ে। অতি সামান্য গবেষণা হয়েছে যে দিক নিয়ে তা হল, ধাতব জিনিষগুলো উৎপাদনের পেছনে কি কোন কেন্দ্রীয় বা গোষ্ঠীগত ভাবনা ছিল, অথবা প্রতিটি এলাকা এই নিয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করত? সাধারণ ভাবে এখন অবধি পাওয়া তথ্যে মনে হবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কিছু হয়ত ছিল না। পুরো ব্যপারটাই চলত আঞ্চলিক চাহিদাভিত্তিক। যদি তাও হয়, তবে প্রকৌশল বিনিময় কতটা হত বা কি ভাবে হত? এখানেও কি সেই ধাতু বিশারদ কারিগরদের প্রায় যাযাবর প্রথা প্রচলিত ছিল? উৎপাদিত সামগ্রীর ধরন ও পরিমাণ কি ভাবে নিয়ন্ত্রিত হত? খনি থেকে ধাতু আমদানির পেছনে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাজ করত? খনিগুলোর উপর হরপ্পাবাসীর কতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল? ধাতব উৎপাদন কি কেবল শহরে সীমাবদ্ধ ছিল না গ্রামাঞ্চলেও হত? অনেক প্রশ্ন। উত্তর খুব খুব কম।

হরপ্পীয় সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্র থেকে যতটা প্রত্নসামগ্রী বের হয়েছে তার এক ভগ্নাংশই কেবল পরীক্ষাগারে পৌঁছেছে। ফলে সভ্যতাটির ব্যবহারিক ধাতু শিল্পের বৈচিত্র্য আমাদের অজ্ঞাতই থেকে গেছে বলা যেতে পারে। বিশেষ করে প্রথমেই বলতে হয় ধাতব সামগ্রী আর তার খনি উৎসের সম্পর্ক প্রকৃতপক্ষে এখনো অজানা। কারণ যেটুকু পরীক্ষাগারে গেছে তা কেবল তৈরি করা সামগ্রী। প্রাচীন খনির খনিজ পরীক্ষার কাজে বহুদূর পিছিয়ে আছে। পিছিয়ে থাকার বড় কারণ অবশ্যই যে সম্ভাব্য প্রাচীন খনি এলাকাগুলো বিশেষ করে বালুচিস্তান, আফগানিস্তানের খনি এলাকার পরিবেশ এখন এতটাই অশান্ত যে সেখানে গবেষণামূলক কাজের কথা ভাবাই কঠিন।

খনির উৎস না জানলে, কোন খনিতে কি ধরনের ধাতু পাওয়া যেত তা না জানলে, হরপ্পীয় সভ্যতার শহরে কতটা ধাতু আসলে মিশ্রিত(ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ) সেটা বোঝা কঠিন। উদাহরণ স্বরূপ আগরওয়ালের মতে হরপ্পীয়সভ্যতার বেলা ১% বা তার বেশি আর্সেনিক থাকলেই তাকে ইচ্ছাকৃত মিশ্রণ ধরতে হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? অন্য বিজ্ঞানীরা একমত নন। এই মতপার্থক্যের সমাধান হতে পারে খনির খনিজ পরীক্ষা করে। যদি দেখা যায় হরপ্পীয়রা সব তামাই পেত ১% এর কম আর্সেনিক সমৃদ্ধ তবে সবাই মেনে নিতেন আগরওয়ালের মত। কিন্তু বর্তমানে সেই তথ্য অধরা। তাই মতপার্থক্য বজায় থাকবেই।

হরপ্পীয় সভ্যতায় কতটা ধাতু প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃত মিশ্রধাতু তা নির্ণয়ের পথে বহু বাধা। একটা বড় বাধা ব্যবহৃত ধাতু গালিয়ে আবার ব্যবহার করা। যেহেতু এখন অবধি অতি সামান্য প্রত্ন সামগ্রী পরীক্ষাগারের মুখ দেখেছে তাই কোন ব্যবহারিক ধারাও নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। তার উপরে থাকছে আরেক সমস্যা, প্রত্নক্ষেত্রগুলোর যথার্থ কালস্তর নির্ণয় না করা। প্রকৃতপক্ষে মহেঞ্জোদারোর পর্যায়স্তর নির্ণয় হলেও কালস্তর নির্ণয় হয়নি। একে তো তখন কার্বন ডেটিং চালু হয়নি, তার উপরে খননের সময়েও কালস্তর আলাদা করার কোন প্রচেষ্টাই ছিল না। একই কথা হরপ্পা শহরের বেলাও প্রযোজ্য। তবে হরপ্পার কার্বন ডেটিং এখন বেশ কিছুটা হয়েছে, কেনয়েরের উদ্যোগে।

তার সাথে বলতে হয় যে হরপ্পা মহেঞ্জোদারো খননের আমলের পরীক্ষাগারের মান এখনকার মত উন্নত ছিল না। ফলে অনেক ধাতব প্রত্ন নমুনার হয়ত সঠিক বিশ্লেষণ হয় নি তখন। পৃথিবীতে অনেক জায়গাতেই আজকাল আগে পরীক্ষা করা প্রত্নদ্রব্যের নতুন করে পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক ভিন্ন তথ্য বের হয়ে আসছে। হরপ্পীয় সভ্যতার বেলা দ্বিতীয় বার পরীক্ষা না হলেও অন্তত প্রথম বারের পরীক্ষাটুকু করে ফেলা হবে তেমন আশা করা অন্যায় হবে না।

হরপ্পীয় সভ্যতায় ধাতুর, বিশেষ করে টিনের, জোগান বেশ কমই ছিল। ফলে তাদের তামা তো বটেই পাথরের উপরও ভরসা বজায় রাখতে হয়েছিল। ধাতুর জোগান কেন কম ছিল তার সঠিক কারণ বলার মত তথ্য এখনো আমাদের হাতে নেই। তবে ইদানীং বোঝা যাচ্ছে হরপ্পীয় সভ্যতার বন্দরগুলো ধাতুর জোগানে বড় ভূমিকা পালন করত। ওমানে পাওয়া গেছে একাধিক খনি। আর ওমানের সাথে হরপ্পীয় সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক যে যথেষ্ট ঘন ছিল তার অনেক প্রমাণই পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে সমুদ্রতট পিছিয়ে যাওয়ায় এই বন্দরগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে ওমান থেকে ধাতু আনায় ভাঁটা পড়ে।

কিন্তু বিদেশের বদলে দেশের মধ্যেকার ধাতু জোগান সব সময়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু দেশের মধ্যে এই খনিগুলো ছিল পাহাড়ি এলাকায়, তাই অনুমান করা যায় মূলত শিকারি সংগ্রাহক জনগোষ্ঠীর হাতে ছিল ধাতু জোগানের চাবিকাঠি। তারাই ধাতু নিষ্কাশন করত ও জোগান দিত। অবশ্যই বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলেই সেটা সম্ভব ছিল।

কিন্তু গোটা পৃথিবীতেই কখনো শিকারি-সংগ্রাহক (পরে সরবরাহক) আর কৃষি ভিত্তিক সমাজের সম্পর্ক সুমধুর ছিল না। হরপ্পীয় সভ্যতাতেও তার ব্যতিক্রম হবার কথা নয়। হরপ্পা শহরের পতনের একাধিক কারণের মধ্যে দুর্বল শহরগুলোতে পাহাড়িদের বার বার হানা দেবার কথা বলেছেন ডেলস সহ একাধিক প্রত্ন বিজ্ঞানী। তবে কি শেষের দিকে পাহাড়ি এলাকা থেকে ধাতুর জোগান কমে গিয়েছিল? বা বার বার বাধা পাচ্ছিল? অথবা হরপ্পা শহরগুলোর চাহিদাই কমে গিয়েছিল? এবং তার ফলে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভাঁটার টানে বিরোধ বাড়ছিল?আরো গভীরে অনুসন্ধান করতে হবে। খনিগুলোর স্তরভেদে কার্বন ডেটিং করলে অনেক বেশি তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

লেখায় দেওয়া তালিকাগুলো বলছে হরপ্পীয় সভ্যতা, কারণ যাই হোক না কেন, তাম্রযুগ থেকে ব্রোঞ্জযুগে যথাযথ উত্তরণে ব্যর্থ হয়েছিল। যদি তাই হয়ে থাকে তবে সেটা গোটা সভ্যতাটিরই ব্যর্থতা। বলতে হয় সভ্যতাটি অগ্রগতির পথে চলতে চলতে মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু সে কথা বলার আগে জানতে হবে কতটা তথ্য আমরা পেয়েছি।

ধাতুশিল্পে হরপ্পীয় সভ্যতা ব্যর্থ আপাতভাবে এমনটা মনে হলেও তা বলার আগে দেখতে হবে আমাদের কর্তব্যরত বিজ্ঞানীরা কতটা সঠিক তথ্য দিতে পেরেছেন। একেতো খননের বিশদ বিবরণের অভাব, তার উপরে দেখা যাবে প্রাপ্ত নমুনার অর্ধেক মাত্র বিশ্লেষণ হয়েছে। আড়াই হাজারের মত খনন করা শহর-বসতির মধ্যে কটির প্রত্ন ধাতু সামগ্রীর তালিকা বিশদে প্রকাশ করা হয়েছে? যদি কোন প্রত্ন এলাকায় ধাতব প্রত্নদ্রব্য বলে কিছু না থাকে, তবু শূন্য লেখা তালিকাও প্রয়োজনীয়। জানতে হবে কেন শূন্য? কেন নেই? এটা সবাই জানি অনেক জায়গাতেই প্রত্নবিজ্ঞানীরা সংখ্যার বদলে ‘কিছু’, ‘বেশ কিছু’, ‘অনেক’, ‘প্রচুর’, লিখে দেন। অথচ সভ্যতাটির আদ্যোপান্ত বুঝতে সংখ্যা দরকার। প্রত্নদ্রব্যের সংখ্যা, বিবরণ, বিশ্লেষণ, এবং বিজ্ঞানীর অভিমত সবই দরকার। সম্ভবত এই খামতির কথা অনুমান করেই বা জেনে বুঝেই মর্টিমার হুইলার তাঁর আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার মুখপত্রে শেষ লেখায় লিখেছিলেন, প্রত্ন বিজ্ঞানীরা যেন নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেন। দরকার হলে খনন কাজ বন্ধ রাখতে হবে, কিন্তু রিপোর্ট যেন বন্ধ না হয়।

তথ্যসূচীঃ-


1. Biva Tripathy, “Metals and Metallurgy in the Harappan Civilization.” Published in Indian Journal of History of Science. 2018.

2. Walter A. Fairservis, A Book review of “the Copper and Bronze Age in India” By D.P Agarwal. Published in American Anthropologist. Vol 75 1973.

3. Vasant Sinde, Rick J. Willies, “A New Type of Inscribed Copper Plate from Indus Valley (Harappan) Civilization.” Published in Ancient Asia in 2014.

4. Brett C. Hoffman: “Indus Copper Bronze: Traditional Perspectives and New Interpretations” Published in: Walking with the Unicorn. Social Organization and Material Culture in Ancient South Asia. Jonathan Mark Kenoyer Felicitation Volume. Edited by Dennis Frenez, Gregg M. Jamison, Randal W. Law, Massimo Vidale, Richard H Meadow. Published by Archaeo press Publishing Ltd. Oxford.

5. Jonathan M. Kenoyer. Heather M.L. Miller.: “Metal Technologies of the Indus Valley Tradition in Pakistan and Western India.”

6. Panchanan Neogi: “Copper in Ancient India” Published by The Association for Cultivation of Science. Calcutta. In 1918.

মন্তব্য তালিকা - “হরপ্পীয় সভ্যতার ধাতু শিল্প”

  1. একটি অসাধারণ সুন্দর এবং সাম্প্রতিক গবেষণায় পাওয়া তথ‍্যে পূর্ণ রচনা। বাংলায় এতো বিস্তারিত এবং তথ‍্যসমৃদ্ধ অথচ সুখপাঠ‍্য রচনা আমি অন্তত পড়িনি।
    বিভিন্ন সভ‍্যতার মানুষ প্রায় একই সময় ধাতুর ব‍্যবহার শিখেছে এটা একটা আশ্চর্য বিষয়। আমার মনে হয়, কোনো ভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল বা আমরা যাকে প্রায় একই সময় ভাবছি তা আসলে এক সময় না। দু-তিনশো বছরের তফাৎ আমরা তেমন গ্রাহ‍্য করিনা কয়েক হাজার বছরের কথা বলার সময় কিন্তু মানবজীবনের গড় আয়ুর নিরিখে (যেটা সে সময় বেশ কম ছিল ) ঐ দুশো বছর মানে প্রায় আট কি দশ প্রজন্ম। একটা নতুন প্রযুক্তি এক এলাকায় উদ্ভবের পর তার খবরটা অন্তত আশেপাশের অন‍্যান‍্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়া এবং তারপর সেই এলাকার মানুষের পক্ষে স্বাধীনভাবে সেই প্রযুক্তি পুনউদ্ভাবন করার পক্ষে যথেষ্ট সময়।

    1. ধন্যবাদ কৃশানু, ঠিক কথা এটা একটু অবাক লাগে প্রায় সমসাময়িক কালে সভ্যতাগুলো ধাতুর ব্যবহার শিখে ফেলেছিল। আর অবশ্যই দুই তিনশ বৎসরের এদিক ওদিকে কে কিছুই যায় আসে না। ধাতুর ব্যবহারিক জ্ঞান বিনিময় কাচাকাছি থাকা লোকেদের মধ্যে খুব স্বাভাবিক ভাবেই হতে পারে। যার একটা সম্ভবনা থাকছে ধাতু ব্যবহারে অভিক্ষদের প্রায় যাযাবর জীবন যাপনে। হয়ত এখনকার মতই দক্ষ লোকেরা পরিচিত মানুষের মধ্যে থাকার সুবিধা ত্যাগ করত নিজেদের নতুন পাওয়া জ্ঞান চর্চার সুবিধার আশায়।
      ধাতুর ব্যবহার জ্ঞান আচমকা হয়ে গেছে কোন এক জায়গায় তারপর সবাই শিখেছে, এমন একটা মডেল ঠিক কাপ খায়না সেই আমলের জনবসতিগুলোর দুরত্বের নিরিখে। কাজেই সব সময় সরাসরি দক্ষ লোক বিনিময় ছাড়াও অন্য কোন ঘটনা এই বিদ্যাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে ছিল।
      সেটা হতে পারে পোড়া মাটির বাসন তৈরীর সময় বিভিন্ন মাটি নিয়ে তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার কালে, পোড়ানোর সময় ভাটির তাপ নিয়ন্ত্রনে দক্ষতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে।
      দেখা যাবে পোড়া মাটির বাসন তৈরীতে দক্ষ জনবসতিগুলোই ধাতুর ব্যবহার শুরু করেছিল।
      সেটা শুধু আমাদের এই এলাকাতেই না, নাইজেরীয়ার নক সংস্কৃতির লোকেরাও তাই করতে পেরেছিল। তারা আরো একধাপ এগিয়ে একেবারে লোহার ব্যবহার শুরু করেছিল।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।