![মহাবীরের সিদ্ধিক্ষেত্র রূপে বঙ্গদেশের দাবি ও একটি অনুসন্ধান](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2021/12/Cover-Photo-4.jpg)
মহাবীরের সিদ্ধিক্ষেত্র রূপে বঙ্গদেশের দাবি ও একটি অনুসন্ধান
বৈশালী নগরীর উপকণ্ঠে ক্ষত্রিয়কুণ্ডপুর গ্রাম। সমৃদ্ধি ও ব্যাপ্তির দিক থেকে এক ছোটখাটো উপনগরী বলা চলে। কাল আনুমানিক ৫৬৯ সাধারণ পূর্বাব্দ। সিদ্ধার্থ গৌতমের মহাভিনিষ্ক্রমণ হতে আরো ৩৫ বছর বাকি। সেই দিনটি ছিল মার্গশীর্ষ মাসের কৃষ্ণা দশমী তিথির উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রের দিনমান। সময় চতুর্থ প্রহর। সূর্য অস্তাচলে যাবার সময় হয়েছে। সমগ্র নগরী সেদিন সুদৃশ্য পত্র পল্লব পুষ্পমালায় সুসজ্জিত। নগরের পুরবাসীগণ সেই প্রাক সন্ধ্যা কালে উৎসব মুখর, কিন্তু তাদের মন বিষাদগ্রস্ত। ত্রিশ বছর বয়সী রাজকুমার বর্ধমান যে শ্রমণ দীক্ষা গ্রহণ করতে চলেছেন। এই উপলক্ষেই ক্ষত্রিয়কুণ্ডপুরের বাইরের দিকে ঈশান কোণে ‘জ্ঞাতষণ্ডবন’ উদ্যানের জনসমাগম। মঙ্গলবাদ্য বেজে চলেছে। আপামর পুরবাসীতে জনাকীর্ণ নগর উদ্যান। কিন্তু কোনো কোলাহল নেই। সেই বিপুল জনমণ্ডলী যেন কোন এক মন্ত্রবলে সেদিন অস্বাভাবিক মৌন কিন্তু সুশৃঙ্খল। জ্ঞাতষণ্ডবনের উদ্যানে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে সকলের প্রিয় রাজকুমার শেষবারের মত রাজবেশ ত্যাগ করে এক শ্বেত বস্ত্রখণ্ড মাত্র সম্বল করে প্রবেশ করবেন সুকঠিন সন্ন্যাসজীবনে। তাই প্রিয়তম রাজকুমারকে অন্তিম বিদায় জানাতে এসেছে পুরনাগরিকগণ।
‘জ্ঞাতৃক’, ‘নায়পুত্ত’ সমস্ত রাজকীয় সুখ-বিলাস, স্ত্রী-কন্যা-পরিবার এমনকি সর্বপ্রকার বস্ত্রাভরণ ত্যাগ করে যাত্রা করতে চলেছেন মহাজ্ঞানের সন্ধানে, তাই এত সব আয়োজন।
জ্ঞাতষণ্ডবনে এক অশোক বৃক্ষের নীচে কুমার দেহের সমস্ত বস্ত্র অলঙ্কার ত্যাগ করে নিজের হাতে পাঁচবার কেশ উৎপাটন করে মুণ্ডিতমস্তক হয়েছিলেন। রাজকীয় বস্ত্র ত্যাগ করে ধারণ করেছিলেন একমাত্র বস্ত্র ‘দেবদূষ্য’। এরপর তিনি স্বহস্তে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। পার্শ্বনাথ পর্যন্ত নির্গ্রন্থি ধর্মের কোন তীর্থঙ্করই নিজ ব্যতীত অন্য কোন গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেননি। রাজকুমার বর্ধমান নিশ্চিতভাবেই তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
অবশেষে ক্ষত্রিয়কুণ্ডপুরের উদ্যান থেকে বর্ধমান সংসারকে বিদায় জানালেন, ঋষভদেব থেকে পার্শ্বনাথ সমস্ত মহান নির্গ্রন্থি তীর্থঙ্করদের পরম্পরা ও পদচিহ্ন ধরে তিনি এগিয়ে চললেন ‘জিন’ হতে। বিভিন্ন জৈন পুস্তকের বিবরণ থেকে জানা যায়, পথে এক ব্রাহ্মণ যাচক এসে কিছু দানপ্রার্থনা করলে তিনি তাঁর একমাত্র সম্বল বস্ত্রটির অর্ধেক ছিঁড়ে ব্রাহ্মণকে দান করেছিলেন। পরবর্তী ১৩ মাস বাকি অর্ধেক বস্ত্রখণ্ড তাঁর শরীরে ছিল, তারপর তিনি সম্পূর্ণরূপেই নির্বস্ত্র হয়েছিলেন। জৈন শাস্ত্র বলে ‘আমি উলঙ্গ’ এই জ্ঞান ও চিন্তা একেবারে লোপ না পেলে কেউ মোক্ষলাভের অধিকারী হন না।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2021/12/Photo-1-4.jpg)
মহাবীর বৈশালী থেকে বের হয়ে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন তার বিবরণ জৈন কল্পসূত্রতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই বিস্তৃত বিবরণে না গিয়ে শুধুমাত্র মহাবীরের সিদ্ধিলাভের স্থান সম্পর্কে আপাতত জিজ্ঞাসু হওয়া যাক। এ ব্যাপারে আমরা ভদ্রবাহুর মতকে গুরুত্ব দেব, তার কারণ, ভদ্রবাহু কোন সাধারণ সন্ন্যাসী ছিলেন না, তিনি ছিলেন দিগম্বর জৈন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা।চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনামলে একবার উত্তর ভারত জুড়ে ১২ বছর ব্যাপী এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়। সেসময় বহু জৈন অনুসারী ভদ্রবাহু নামে এক জৈন সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে চলে যান। এঁরা মহাবীরকে অনুসরণ করে দিগম্বর থাকতেন। অন্যদিকে উত্তর ভারতে যেসকল জৈনরা থেকে যান তাঁরা স্থুলভদ্রের নেতৃত্বে শ্বেতবস্ত্র ধারণ করে শ্বেতাম্বর নামে পরিচিতি পান। অর্থাৎ স্থুলভদ্র এবং ভদ্রবাহু এঁরা দুজনেই জৈন ধর্মের দুই অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন বলা চলে।
কল্পসূত্র মতে বর্ধমান তাঁর সাধক-পরিব্রাজক জীবনের তেরোতম বছরে ঋজুপালিকা নদীর তীরে জম্ভীয় গ্রামের উপকণ্ঠে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে এক শালগাছের নীচে উপবাসী অবস্থায় ধ্যান করতে করতে কেবল-জ্ঞান প্রাপ্ত হলেন। হয়ে উঠলেন ২৪ তম তীর্থঙ্কর ভগবান বর্ধমান মহাবীর। কল্পসূত্র রচয়িতা জৈন সন্ন্যাসী ভদ্রবাহু তাঁর সিদ্ধিলাভের স্থানটি খুব সুন্দর ভাবে চিহ্নিত করে গেছেন। তাঁর ভাষায়, “জংভিয় গামস্স নগরস্স বহিয়া উজুবালিয়াএ নঈতীরে বিয়াবওস্স চেইয়স্স অদূর সামংতে সামাগস্স গাহাবইস্স কট্ঠ করণং সি সাল পায়বস্স…” অর্থাৎ, জংভীয় গ্রাম নগরের বাইরে উজুবালিয়া (ঋজুপালিকা) নদী তীরে বিয়াবও চৈত্যের অদূরে সামাগ নামে গৃহস্থের কাষ্ঠকরণে (কৃষিক্ষেত্রে)শাল বৃক্ষের নীচে…
মহাপণ্ডিত ভদ্রবাহু খুব বিস্তারিত ভাবে মহাবীরের সিদ্ধিলাভের স্থানের বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু তা একান্ত ভাবেই সেযুগের মাপকাঠিতে। আজ থেকে মোটামুটি ২৫৮৮ বছর আগে সামাগ নামে এক ভদ্রলোকের কৃষিজমির শাল গাছের নীচে বসে মহাবীর যে কৈবল্য জ্ঞান লাভ করেছিলেন তা তো বোঝা গেল, কিন্তু আজ যদি সেই জায়গাটা কেউ খোঁজাখুঁজির চেষ্টা করে তবে তা একটু বাড়াবাড়ি মনে হবে কি? যাই মনে হোক, হরিপ্রসাদ ও নৃসিংহপ্রসাদ তেওয়ারী নামে সম্পর্কে পিতা পুত্র দুজন মানুষ সেই আপাত অসম্ভব কাজটিই করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের পথ ধরে আমরাও বরং একবার উদ্যোগ নিয়ে দেখি কোথায় পৌঁছনো যায়।
সামাগের শালগাছ না হয় পরে খোঁজা যাবে, আগে উজুবালিয়া বা ঋজুপালিকা নদীটা খুঁজে বের করা যাক। সেটা পাওয়া গেলে তারপর জম্ভীয় গ্রামে গিয়ে সামাগের চাষের জমির হদিস নেব।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2021/12/Photo-2-2.jpg)
মহাবীর লাঢ় দেশের বজ্জভূমি, সুহ্মভূমি, পণিয়ভূমি অঞ্চলে অন্তত ছয় বছরকাল পরিভ্রমণ করেছিলেন এবং এই পরিক্রমাকালে একসময় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন একথা যদি নিশ্চিত হয় তবে ঋজুপালিকা নদীও এই অঞ্চলে হওয়াই স্বাভাবিক। লাঢ়দেশ অর্থাৎ রাঢ়ের দুই ভাগ। উত্তর রাঢ় বজ্রভূমি ও দক্ষিণ রাঢ় সুহ্মভূমি নামে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলের প্রধান নদী অজয়। আড়াই হাজার বছরে ঋজুপালিকা> উজুবালিয়া> উজু> অজয় এটুকু অপভ্রংশ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আবার একটু ব্যাক ক্যাল্কুলেশন করলে দেখা যাচ্ছে, মহাবীর বজ্জভূমিতে যে যে জায়গায় পরিক্রমণ করেছিলেন বলে জৈন শাস্ত্রকারেরা জানিয়েছেন তার প্রায় সবগুলিই অজয়ের তীরবর্তী অঞ্চল। অতএব আপাতত দুইয়ে দুইয়ে চার থুড়ি উজুবালিয়া ইক্যুয়েল টু অজয় ধরে এগোনো যাক।
এবারে সন্ধান করতে হবে জংভীয় বা জম্ভীয় গ্রাম নগরের। জংভীয় নামে জায়গাটি অবশ্যই উজুবালিয়া নদীর তীরে কোথাও হতেই হবে। ভদ্রবাহু তেমনই ইশারা করেছেন। আবার জংভীয় গ্রাম নগরের উল্লেখ যখন করা হয়েছে তখন বুঝতে হবে সেটি সেযুগে কোন ক্ষুদ্র পল্লী ছিল না, দিকনির্দেশক রূপে এমন কোন অখ্যাত পল্লীর উল্লেখ ভদ্রবাহুর মত পণ্ডিত করবেন না, যা কিছুদিনের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে পারে। এছাড়া গ্রাম নগর অভিধাটিও লক্ষণীয়। খুব বড় নগর হলে সেখানে মহাবীর নির্জনবাস করতে আসতেন না, আবার শুধুমাত্র সাধারণ এক গ্রাম হলে সঙ্গে নগর উপাধি জুড়ত না। এত সব হিসেব করে অঞ্চলটিকে সেকালের এক নামকরা অঞ্চল বলে মনে হচ্ছে যখন, তখন হাজার আড়াই বছরের ব্যবধান তো কি হয়েছে, একবার খোঁজ করাই যায়।
অজয় উপত্যকায় পণিয়াতি বা পণিয়ভূমিতে জামগ্রাম নামে একটা জায়গার খবর পাওয়া যাচ্ছে যা জম্ভীয়-র বিবর্তিত নাম হওয়া অবাস্তব কিছু নয়। না, পণিয়ভূমি নামে আজ আর কোন জায়গা নেই, তবে পণিয়াতি নামে এক পুরনো কয়লাখনির নাম রেকর্ডে পাওয়া গেছে, যাকে বেস ধরে এগোলে জামগ্রামে পৌঁছনো যাচ্ছে। তাহলে ধরা যাক জম্ভীয়> জাম। কোথায় এই জাম গ্রাম? জায়গাটা চিচুর বিল নামে এক গ্রামের কয়েক কিলোমিটার পশ্চিম দিকে গড় দিগম্বর (গড় দেমো) পাহাড়ের পায়ের কাছে। অজয়ও খুব দূরে নয়। চিচুর বিল নামটা খুব ইন্টারেস্টিং। এই গ্রামে বড় বড় বিল আছে, বর্ষাকালে যা অজয়ের জলে পূর্ণ হয়ে থাকে। ঋজুপালিকার সংক্ষেপ ঋজু থেকে চিচু অপভ্রংশ হওয়া কি একেবারে অস্বাভাবিক? মনে তো হয় না। এককালে ঋজুপালিকার মূল খাত সরে গিয়ে আজ কয়েকটা বিল হিসেবে কিছু চিহ্ন মাত্র পড়ে আছে। যেহেতু এ অঞ্চলের ভূমিরূপ পৃথিবীর প্রাচীনতম শিলা থেকে সৃষ্ট, আড়াই হাজার বছরেও মারাত্মক কিছু অদল বদল হয়ে যায়নি। আবার পাহাড়ও গড় দিগম্বর। যা জৈন চিহ্ন বহন করছে। জাম গ্রামে কিছু পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। বিয়াবও চৈত্য কি? ভগবান মহাবীরই জানেন।
জম্ভীয় গ্রাম নগর পর্যন্ত যখন পৌঁছতে পেরেছি, আরেকটু চেষ্টা করি না কেন? সামাগের কৃষিক্ষেত্র যদি পাওয়া যায়! জম্ভীয় গ্রামের উত্তর দিকে ঋজুপালিকা নদীর পলিসমৃদ্ধ খাত। নদী আরো খানিকটা উত্তরে সরে গেলেও এখানে পাঠকের জন্য একটা চমক অপেক্ষা করে আছে। মন্দির জাতীয় কিছু স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ও অজয় নদীর মাঝের যে এলাকা তার নাম সামাপুর! কোন গ্রাম নয়, কয়েকঘর সাঁওতাল জাতীয় দরিদ্র মানুষের বাস আর চাষের জমি নিয়ে সামাপুর। চাষের জমি– ‘কৃষিক্ষেত্র’। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেকার এক সম্ভ্রান্ত মানুষ ‘সামাগ’—যিনি কল্পসূত্রকারের কলমে অমর হয়ে আছেন, তাঁর নিজের ‘কাষ্ঠকরণ’ তাঁর নাম বুকে ধারণ করে নিজেও অমরত্বের দাবিদার হয়ে বসে আছে যে! সামাগের কৃষিক্ষেত্র সামাপুর। ভাবা যায়! চমকের আরো বাকি আছে। সামাগের চাষের জমি বা সামাপুর থেকে নদীর উত্তর দিকে তাকান। চোখে পড়বে একটি পল্লীগ্রাম। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষের বাস সেখানে। নাম কাষ্ঠা! কাষ্ঠকরণের কাষ্ঠা। ‘জংভীয় গ্রাম নগরের বাইরে উজুবালিয়া (ঋজুপালিকা) নদী তীরে বিয়াবও চৈত্যের অদূরে সামাগ নামে গৃহস্থের কাষ্ঠকরণে (কৃষিক্ষেত্রে)’ মানব ইতিহাসের এক দিকপাল মহামানব যে তপস্যা করে কৈবল্য জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন, তার প্রতিটি পদধ্বনির হিসেব রাঢ় বাংলার ঊষর প্রান্তর কালের গ্রাস উপেক্ষা করে নিজের আঁচল প্রান্তে সংরক্ষিত রেখেছে।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2021/12/Photo-3-1.jpg)
মহাবীর বর্ধমান কৈবল্য জ্ঞান লাভ করে ‘সমবসরণ’ করেছিলেন বলে জৈন ধর্মে বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন, যেখানে নাকি দেবতারা তাঁর উপদেশ শুনতে এসেছিলেন। সমবসরণ সম্ভবত সম্মেলন। জৈন শাস্ত্রে ঘটনাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিন বা কেবলীর বাণী বলে এ ব্যাপারটাকে ‘অছেরা’ বলা হয়। দেবতারা মাথায় থাকুন, বাংলায় মহাবীরের স্পর্শ পাওয়া স্থানগুলির খোঁজ যখন চলছে,তখন অছেরার স্থান খুঁজতে আপত্তি কি?সিদ্ধিলাভের পরপরই মহাবীর যখন সমবসরণ করেছিলেন তখন এ জায়গাটাও নিশ্চয় জাম গ্রামের আশেপাশেই হবে। ঠিক তাই। জম্ভীয় বা জাম গ্রাম থেকে পশ্চিম দিকে কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই আছেরা বা আছেনা নামে একটা জায়গা কালের অনুশাসন উপেক্ষা করে অপেক্ষা করছে ইতিহাস স্বীকৃতির।
বাংলার মাটি পুণ্যভূমি। ‘বজ্জভূমির কৌমজন’ মহাবীরের প্রতি কুকুর লেলিয়ে দিয়ে যে পাপ করেছিল, রাঢ় বাংলা সেই মহাবীরের সিদ্ধিলাভ ক্ষেত্রের গৌরব ধারণ করে অচিরেই সে পাপ স্খালন করে নিতে পেরেছে। কিন্তু হায়রে ইতিহাস, আমাদের এই গর্বিত অতীত আমরা সংরক্ষণ করতে শিখিনি, তাই সহজেই হারিয়ে ফেলেছি এসব ঐতিহাসিকস্থানকে। যা অতীত গৌরব হতে পারত, প্রত্নস্থল, তীর্থভূমি বা পর্যটন ক্ষেত্রও হয়ে উঠতে পারত, কালের গর্ভে তা আজ নিমজ্জিত। যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরি।
কৈবল্য জ্ঞান লাভ করে বাংলার মাটি থেকে বেরিয়ে মহাবীর পরিব্রাজন রত অবস্থায় সাধারণের বোধগম্য ভাষা অর্ধমাগধীতে মত প্রচার করতে লাগলেন। দ্রুত তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। জৈন ধর্মের বিস্তারও তার সাথে তাল মিলিয়ে হয়ে চলল।
মহাবীর পার্শ্বনাথ প্রবর্তিত চতুর্যাম অর্থাৎ অহিংসা, সত্য, অচৌর্য ও অপরিগ্রহ নীতির সাথে ব্রহ্মচর্যকে জুড়ে দিয়ে পঞ্চমহাব্রত প্রবর্তন করলেন। কিন্তু গৃহীর পক্ষে পঞ্চমহাব্রত সম্পূর্ণরূপে পালন সম্ভব নয় বলে তা আংশিকরূপে পালনের নিয়ম প্রচার করা হল। সেইসাথে মহাবীর চার ধরণের সংঘের ধারণা জনসমক্ষে আনলেন—সাধক, সাধিকা, শ্রাবক (গৃহস্থ, যারা উপদেশ শ্রবণ করেন), শ্রাবিকা।
অহিংসা ও কৃচ্ছসাধনের মন্ত্রে ভারতভূমিকে মন্দ্রিত করে ৭২ বছর বয়সে মহাবীর পাবাতে এক কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে উপদেশরত অবস্থায় নির্বাণ প্রাপ্ত হন।
মহাবীর অহিংসার উপরে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বৈদিক ধর্মের যজ্ঞানুষ্ঠানে পশুবলি প্রথার সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে তিনি জাগ্রত বিবেকের ন্যায় জীব হিংসার বিরোধিতা করে গেছেন। জৈন ধর্ম কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নিয়ে নীরব। জাগতিক সমস্ত কিছুই এক সর্বজনীন নিয়ম অনুসারে পরিচালিত হয় বলে এঁরা বিশ্বাস করেন। সেই নিয়ম হল, উত্থানের পরে আসবে পতন। উন্নতির পর্যায় শেষে আসবে অবনতি। আর প্রতিটি পর্যায়ে তীর্থঙ্করেরা এসে মানবজাতিকে পথ দেখাবেন। এর পাশাপাশি সর্বপ্রাণবাদ জৈন ধর্মের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জৈনরা কর্মফলেও বিশ্বাসী। কর্মফলের হাত থেকে মুক্তির জন্য ‘ত্রিরত্ন’ অর্থাৎ সৎ বিশ্বাস, সৎ জ্ঞান ও সৎ আচরণ পালন করলে মানুষ হবে ‘সিদ্ধশীল’। তখনই কর্মফল ও জন্মান্তরের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সততা, মিতব্যায়িতা ও অনাড়ম্বর জীবন জৈনদের কাম্য।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2021/12/Photo-4.jpg)
মহাবীরের দর্শন মূলত গাঙ্গেয় উপত্যকা তথা পূর্ব ভারতে প্রচারিত হয়েছিল। বাংলা ছিল জৈন ধর্ম তথা জৈন দর্শনের এক অন্যতম চারণক্ষেত্র। রাঢ় বাংলার সরাক সম্প্রদায় তার আদি অবশেষ রূপে আজও জৈন ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
সময়ের চাকা এগিয়ে চলে। আধ্যাত্মবাদের ধাত্রীভূমি ভারতবর্ষের বুকে বহু মহামনীষীর আবির্ভাব হয়, কালে কালে বহু মতবাদ প্রবল হয়ে উঠে অন্যান্য মতবাদ গুলিকে পেছনে ফেলে দেয়। এমনি ভাবেই বৌদ্ধধর্মের প্রাবল্য-উচ্ছ্বাস, সনাতন ধর্মের পুনরুত্থান, বহিরাগত ইসলামের আবির্ভাব—ভারত দর্শন এগিয়ে চলে আপন ছন্দে। আর জৈন ধর্ম? মহাবীরের পঞ্চমহাব্রত শত উত্থান পতনের মাঝেও ফল্গুধারার মত বহমান। আজকের এই একুশ শতকে অন্তঃসলিলা হলেও যথেষ্ট বেগবতী সে। নইলে আড়াই হাজার বছর আগের বৈশালীর রাজকীয় দম্পতি সিদ্ধার্থ-ত্রিশলার পুত্র বর্ধমান বাংলার মাটিতে কেবলী হয়ে যে চিন্তাধারার প্রচলন করে গেলেন এযুগের মানুষের কাছে আজও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থাকে কিভাবে?
আসলে মহাবীরের প্রাসঙ্গিকতা, অহিংসার আবেদন হিংসায় মত্ত মানুষের কাছে জেগে আছে যুগ থেকে যুগান্তরে,আর সেই প্রাসঙ্গিকতায় ভর করে বাংলায় মহাবীরের পদলাঞ্ছিত স্থান গুলো হারিয়ে গিয়েও আবার বেঁচে ওঠে ফিনিক্সপাখির মত, বিস্মৃতির অতল থেকে। এভাবে শত প্ররোচনার মাঝেও হাজার হাজার বছর ধরে জেগে থাকে বাংলার তথা ভারতের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
তথ্যসূত্রঃ
১. ভগবান মহাবীরের সিদ্ধভূমি ও জৈন কালচক্র; হরিপ্রসাদ তেওয়ারী, নৃসিংহপ্রসাদ তেওয়ারী, বাংলার মুখ প্রকাশন, কলকাতা, ২০১৯
২. A Comprehensive history of Jainism, 1; by Asim Kumar Chatterjee, Munshiram Manoharlal Publishers, New Delhi 2000
খুব ভাল লাগল পড়ে। তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। সবার কাছে, বিশেষত জৈন সম্প্রদায়ের মানুষজনের মধ্যে এ তথ্য পৌঁছে দিতে পারলে জায়গাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকৃতি পেত, জৈনদের কাছে একটি তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠত।
অনেক ধন্যবাদ। বাংলায় জৈনধর্ম নিয়ে ইদানিং বেশ কিছু কাজ হচ্ছে, নিশ্চয় একদিন তা সবার নজরে আসবে।
আমাদের রাঢ় বাংলা এত ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান জানতে পেরে ভালো লাগল।
ঠিকই। রাঢ় বাংলা ইতিহাসের খনি। এখানকার মাটিতে কত যে ইতিহাস লুকিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।
অনেক ধন্যবাদ।।
মনোগ্রাহী মহাবীর কথা। খুব ভালো লাগল।
অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
অসাধারণ সুন্দর ও মনোগ্রাহী লেখা। এ বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে যত গবেষণা ও অনুসন্ধান এগোবে তত বাঙলার জৈন ধর্মের বিস্তার সম্বন্ধে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালবাসা।