সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

খান বাহাদুর আজিজুল হক: সার্ধশতবর্ষে বিস্মৃত এক গণিতবিদ

খান বাহাদুর আজিজুল হক: সার্ধশতবর্ষে বিস্মৃত এক গণিতবিদ

সৈকত ভট্টাচার্য

এপ্রিল ২০, ২০২২ ৬৯০ 1

—”উইলিয়াম জেমস হার্শেল কে ছিলেন?”

—”ইংলিশম্যান। আই. সি. এস.। একসময় বাংলাদেশে পোস্টেড ছিলেন। আঠারোশো আশি সালে ইংল্যান্ডের নেচার পত্রিকায় তাঁর একটা চিঠি বেরোয়। আঙুলের ছাপ থেকে যে অপরাধী ধরার একটা উপায় হতে পারে, এই চিঠিতেই সেটা প্রথম জানা যায়।”

উপরের এই সংলাপটা ‘সোনার কেল্লা’ ছবিতে যে সিধু জ্যাঠার প্রশ্ন এবং ফেলুদার উত্তর, সেটা বলতে পারার জন্য কোনো ক্যুইজ প্রতিযোগিতাতেই অতিরিক্ত নম্বর যে থাকবে না সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু যে প্রশ্নটার জন্য কিছুটা নম্বর বরাদ্দ করা যেতে পারে, তা হল, খান বাহাদুর কাজি আজিজুল হক কে ছিলেন? ফেলু মিত্তির এই প্রশ্নের উত্তর অমন সাবলীলভাবে দিতে পারতেন কিনা জানা নেই, কিন্তু আমরা বাঙালিরা যে এই বঙ্গসন্তানের সার্ধশতবর্ষে দাঁড়িয়ে তাঁকে ভুলে গেছি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

অবশ্য এই বিস্মরণের দায় কেনই বা পুরোপুরি আমাদের নিজেদের কাঁধে চাপাই? আমাদের ভুলতে সাহায্য করেছে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বা, সঠিক ভাবে বললে আজিজুল হকের ঊর্ধ্বতন স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি।

ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলি তবে।

উইলিয়াম জেমস হার্শেল, ফেলুদার মতে, আঙুলের ছাপ থেকে অপরাধী সনাক্তকরণের বিষয়টি নিয়ে সর্বপ্রথম চিঠি ছাপেন—এই বিষয় নিয়ে একটু দ্বিমত আছে। হেনরি ফল্ডস নামে এক স্কটিশ চিকিৎসক প্রথম এই বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। কিন্তু পরবর্তীকালে হার্শেল এবং ফ্র্যান্সিস গ্যালটন দু’জনে মিলে ফল্ডসকে পাশ কাটিয়ে আঙুলের ছাপ থেকে অপরাধীকে চিহ্নিত করার বিষয়ে নিজেদের আবিষ্কারকেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে সে যাই হোক, হার্শেলের একার চেষ্টায় বাংলাতে যে বিভিন্ন মানুষের আঙুলের ছাপের একটা বড়সড় সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছিল, সে বিষয়টাকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় উইলিয়াম হার্শেল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পাশ করে ভারতবর্ষে আসেন। বাংলার সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব বর্তায় তাঁর কাঁধে। সেই সময় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য ঠিকাদারদের মধ্যে দুর্নীতির অন্ত ছিল না। প্রায়ই চুক্তি সই করে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যেতে দেখা যেত তাদের। পুলিশ লাগিয়ে ধরে আনলে তারা দিব্যি অস্বীকার করে বসত যে ওই চুক্তিপত্রে যে স্বাক্ষর আছে তা নিয়ে। পুলিশের হাতেও কোনো উপায় নেই এই দাবী নস্যাৎ করার। ফলে এই ঠিকাদারদের অত্যাচারে সড়ক উন্নয়ন বিভাগ একেবারে পথে বসতে চলেছিল। এই সময় হার্শেল সাহেব এসে হাল ধরলেন। অধুনা মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে একটা রাস্তা নির্মাণের কাজে ঠিকাদার রাজ্যধর কোনাই চুক্তি পত্র হাতে হার্শেল সাহেবের কাছে এলেন। চুক্তিতে সই করানোর আগে হার্শেল সাহেব মত পাল্টে বললেন, রোসো বাপু, কলম রাখো। তার চেয়ে এই নাও কালি। আঙুলে লাগিয়ে ছাপ দাও।

হার্শেল ভেবেছিলেন এমন একটা ‘স্বাক্ষর’-এর কথা, যা কোনোভাবেই এই দুর্নীতিপরায়ণ ঠিকাদারের দল অস্বীকার করতে না পারে। এরপর দীর্ঘ তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে বিভিন্ন মানুষের আঙুলের ছাপ বিভিন্ন সময়ে তিনি গ্রহণ করেন এবং প্রমাণ করেন যে সময়ের সাথে আঙুলের ছাপের কোনো পরিবর্তন হয় না। হার্শেলের এই কর্মকান্ড আইনি চুক্তি, দলিল, দস্তাবেজ নিছক সইয়ের বদলে আঙুলের ছাপ দিয়ে স্বাক্ষরিত করার ব্যবস্থা পাকাপাকি ভাবে সূচনা করে দিলো। আর তার সাথে সরকারের কাছে বিভিন্ন মানুষের আঙুলের ছাপের একটা সংগ্রহও তৈরি হয়ে গেলো।

এর মধ্যে এডওয়ার্ড হেনরি নামে আর একজন আই. সি. এস., লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে আইনে স্নাতক, সাগর পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছেছেন বাংলা মুলুকে। বেশ কিছুদিন যুগ্ম-ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি কালেক্টর ইত্যাদি পদে থেকে আঠারোশো একানব্বই সালে বেঙ্গল পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনেরাল পদে এসে আসীন হলেন। পুলিশের কাছে তখন এক বড় মাথাব্যথা ছিল অপরাধীকে চিহ্নিতকরণ। অর্থাৎ, ‘ক’ একটা চুরির দায়ে অভিযুক্ত, কিন্তু পুলিশ তার টিকি পায়নি। কিছুদিন পর অন্য কোথাও থেকে ‘খ’-কে গ্রেফতার করে পুলিশ দাবী করলো ‘ক’ এবং ‘খ’ আসলে এক এবং অভিন্ন মানুষ। কিন্তু ‘খ’ সে কথা অস্বীকার করলো। এদিকে সনাক্তকারীরা একেকজন একেকরকম বলে। ফলে আদালত পড়লো ফাঁপরে। এমনই একজন বিহারের দ্বারভাঙ্গাতে ধুতরোর বিষ দিয়ে লোককে অজ্ঞান করে তাদের সর্বস্ব লুটপাট করে ফেরার হয়ে শেষে ধরা পড়লো ঢাকাতে। সেখানে রেলগাড়ির কামরাতে একইভাবে ধুতরোর বিষের প্রভাবে মানুষকে অজ্ঞান করে চুরি করে পালানোর তালে ছিল। কিন্তু ঢাকার এই ‘খ’ বাবুই যে দ্বারভাঙ্গার ‘ক’ বাবু, তা আদালতে প্রমাণ করতে পুলিশকে নাজেহালের একশেষ হতে হয়েছিল। ঠিক এরকম সময় ইংল্যান্ডেও অ্যালবার্ট ব্ল্যাক নামের এক চোরকে পাকড়াও করে আদালতে প্রমাণ গিয়ে বেশ নাকানিচোবানি খেতে হয়েছিলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে। ফলে অপরাধীকে চিহ্নিত করার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপায় নিয়ে নাড়াঘাঁটা করছিলেন ব্রিটিশ পুলিশ তথা ইন্টেলিজেন্সের কর্তাব্যক্তিরা।

এই সময়, আঠারোশো বিরানব্বই সালে, উইলিয়াম হার্শেলের পরম সুহৃদ বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু ফ্রান্সিস গ্যালটন আঙুলের ছাপ নিয়ে তার এবং হার্শেলের গবেষণার উপর ভিত্তি করে ‘Finger Prints’ নামে একটা বই লিখলেন। উইলিয়াম হার্শেল এর মধ্যে ফিরে গেছেন দেশে। বন্ধুর বইয়ের এক কপি উপহার স্বরূপ পাঠালেন আর এক বন্ধু, বাংলার সরকারের তৎকালীন মুখ্যসচিব হেনরি কটনকে। সাথে আঙুলের ছাপকে সরকারি কাজে ব্যবহার করার জন্য উপদেশ দিয়ে এক দীর্ঘ চিঠি। কটন তড়িঘড়ি সেই চিঠি পাঠিয়ে দিলেন হেনরির দফতরে।

আঙুলের ছাপ তো সংগ্রহ হবে, কিন্তু তা সংরক্ষিত হবে কীভাবে? মানে, সে নাহয় কাগজে ছেপে ফাইল বানিয়ে রাখা হোল। কিন্তু এই বাংলাদেশের কথাই যদি ধরা হয়—এত মানুষ, তাদের মধ্যে একটা খুবই ছোট্ট শতাংশ মানুষের আঙ্গুলের ছাপও যদি পুলিশের কাছে রাখতে হয়, তা হয়ে দাঁড়াবে কয়েক হাজার। এবার এই হাজার হাজার ছাপ থেকে সনাক্তকরণের জন্য পাওয়া ছাপকে মেলাতে মেলাতে তো মাস ঘুরে যাবে! তাহলে উপায়? উপায় বাতলাতে ব্যর্থ হল খোদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও। হেনরি ভেবে দেখলেন, পুলিশ বিভাগে চাই এমন এক গণিতবিদকে যিনি এই সহস্রাধিক ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’কে সঠিক ভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত করতে পারবেন। আর সেই বিন্যাস অনুযায়ী পুলিশের হেফাজতে রাখা থাকবে যাবতীয় আঙ্গুল-ছাপ। ফলে প্রাপ্ত সন্দেহভাজনের আঙুলের ছাপ কোন শ্রেণীর—সেটা বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু এ কাজ করার মত লোক এই কোলকাতা শহরে কে আছেন? এডওয়ার্ড হেনরি তাঁর ঊর্ধ্বতনের কাছ থেকে চিঠি পাওয়া মাত্রই সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ প্রোফেসর গ্রিফিথকে। পত্রপাঠ গ্রিফিথ সাহেব তাঁর কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটির নাম সুপারিশ করে দিলেন আই. জি. সাহেবের কাছে। আজিজুল হক।  

অধুনা বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইগ্রাম-কসবাতে আঠারোশো বাহাত্তর সালে জন্ম হয় আজিজুল হকের। ছেলেবেলায় নৌকাডুবিতে মা-বাবাকে হারিয়ে অনাথ আজিজুল বড় হন দাদার কাছে। অনটনের সংসারে পেটুক আজিজুলকে বেশী খাওয়ার দোষে দাদার বিস্তর বকুনি শুনে থাকতে হত। একদিন আর থাকতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে সটান চলে এলেন কোলকাতা। এক ভদ্রলোক দয়াপরবশ হয়ে আশ্রয় দিলেন তাকে। বাড়ির ফাইফরমাশ খাটার কাজেই বহাল হয়েছিলেন আজিজুল। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ দেখে সেই ভদ্রলোক তাকে ভর্তি করে দিলেন ইশকুলে। সেখানে অভাবনীয় ফল করে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। বিষয় অঙ্ক। মুখে মুখে জটিল হিসাব নিকাশ করে দেওয়া তাঁর কাছে জলভাত। ফলে গণিতকে পাঠ্যবিষয় হিসাবে নিয়ে তাতে যে তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটবেই তাতে কারোর কোনো সন্দেহ ছিল না। কলেজের শিক্ষকদের থেকে প্রিন্সিপাল খোদ গ্রিফিথ সাহেব অবধি—সকলের প্রিয় ছাত্র তথা প্রিয়পাত্র ছিলেন আজিজুল। এমন ছেলের নাম তাই হেনরি সাহেবের কাছে সুপারিশ করতে দুবার ভাবতে হয়নি প্রোফেসর গ্রিফিথকে।

আজিজুল হক যোগ দিলেন কোলকাতা পুলিশের নতুন বিভাগে, যেখানে চর্চা হবে শুধু অপরাধীর আঙুলের ছাপ নিয়ে। তাঁর সাথে ওই বিভাগে সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগ দিলেন আর এক বাঙালী—হেমচন্দ্র বসু। পুলিশের সংগ্রহে তখন প্রায় এগারো হাজার আঙুলের ছাপ। হেমচন্দ্রের সাহায্যে আজিজুল উঠে পড়ে লাগলেন এই আঙুলের ছাপগুলোকে সঠিক শ্রেণীতে ভাগ করার কাজে। ইতিমধ্যে পুলিশ বিভাগে শুরু হয়েছিলো ফরাসী অপরাধ-বিজ্ঞানী আলফোন্সে বার্তিলোঁর প্রস্তাবিত ব্যবস্থা অনুযায়ী অপরাধীদের হাতের মাপ, উচ্চতা, পায়ের মাপ, বসা অবস্থায় উচ্চতা ইত্যাদি সংগ্রহ করার কাজ। কিন্তু এই সব মাপজোকের কাজে বঙ্গ-পুলিশ অফিসারদের দক্ষতার নমুনা দেখে, এর পিছনে সময় নষ্ট না করার সিদ্ধান্ত নেন আজিজুল। এডওয়ার্ড হেনরির কাছে গিয়ে সরাসরি প্রস্তাব দেন যে আঙুলের ছাপই একমাত্র উপায়, আর তার শ্রেণীবিভাগের জন্য তিনি স্বয়ং ফ্র্যান্সিস গ্যালটনের সাহায্যপ্রার্থী।

আঠারোশো চুরানব্বই সালে, ইংল্যান্ডে ছুটি কাটানোর সময় এডওয়ার্ড হেনরি নিজেই গিয়ে দেখা করলেন গ্যালটনের সাথে। দুজনে একবাক্যে মেনে নিলেন যে আঙুলের ছাপকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য শ্রেণীবিন্যাস খুব জরুরী। আর তার জন্য গ্যালটন হেনরিকে যথাসম্ভব সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। বদলে, হেনরি তাঁকে সাহায্য করবেন কোলকাতা পুলিশের সংগৃহীত সমস্ত আঙুলের ছাপ দিয়ে। বলা বাহুল্য, এ আলোচনা যাঁর উৎসাহে হয়েছিলো, সেই সাব-ইন্সপেক্টর আজিজুল হকের নাম ভুলেও একবারও উচ্চারিত হয়নি গ্যালটনের সামনে।

কিন্তু আজিজুল এই চুক্তির কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হলেন। তিনি তখন এই ধাঁধাঁর সমাধানে পৌঁছনোর নেশায় মেতেছেন। খ্যাতির মোহ তাঁর মধ্যে নেই। তাই হেনরির কাছে শোনামাত্রই সংগ্রহে যত ছাপ ছিল সবকটির নকল ফ্রান্সিস গ্যালটনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন। পরের বছর গ্যালটনের বই ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট ডিরেকটরিজ’ প্রকাশিত হল। আজিজুল আগ্রহ নিয়ে বইটা পড়লেন। কিন্তু হতাশ হলেন। এ বইতে তাঁর সমস্যার সমাধান নেই। বরং তাঁর পাঠানো আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে গ্যালটন এক অন্য শ্রেণীবিভাগ করেছেন। আঙুলের চামড়ার উপর সূক্ষ্ম দাগগুলোকে কেবলমাত্র বিভক্ত করেছেন নানা শ্রেণী এবং উপশ্রেণীতে। তাত্ত্বিকভাবে এর গুরুত্ব থাকলেও ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে খুব একটা সাহায্য কিছু যে হবে না সেটা আজিজুল হক বুঝলেন, এবং একটু আশাহত হলেন। কারণ, এই বঙ্গ-পুলিশের দল অপরাধীর হাতের মাপ, পায়ের মাপ মাপতেই যা কীর্তি করেছে, তাদের দিয়ে আঙুলের ছাপ অত সূক্ষ্মতা মেনে সংগ্রহ করে সূক্ষ্ম দাগ কটা কীরকম আছে, তা গুনে গেঁথে শ্রেণীবিভক্ত করার আশা করা দুরাশা। অতএব, ‘একলা চলো রে’। হেমচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে আজিজুল নিজেই বসলেন খাতা কলম নিয়ে।

বছরখানেক নানাবিধ উপায় অনুসন্ধানের পর অবশেষে হালে পানি পেলেন আজিজুল। সেই ‘পানি’ আমাদের ‘হালে’ও পাওয়ার জন্য আমাদেরই আঙুলের এই দাগগুলোকে একটু চিনে নেওয়া যাক। আপনি যদি নিজের আঙুলের দাগগুলোকে লক্ষ্য করেন, দেখবেন মোটামুটি তিন রকমের দাগ দেখা যায়। এক, যেগুলো একধার থেকে শুরু হয়ে মাঝে একটা ঢেউয়ের মত উপরে উঠে আবার নেমে গিয়ে অন্যধারে মিলিয়ে গেছে। এদের বলা হয়, আর্চ (Arch)। দ্বিতীয় প্রকার হলো, একধার থেকে শুরু হয়ে আঙুলের মাঝে এসে একটা ইউ-টার্ন নিয়ে আবার ফিরে গেছে যেদিক থেকে শুরু হয়েছিল সেদিকেই। এদের নাম, লুপ (Loop)। শেষ আর এক রকম যেটা হয়, সেটাকে বলা হয় হোর্ল (Whorl)। এরা আঙুলের মাঝ থেকে শুরু হয়ে সর্পিলাকারে ছড়িয়ে যায়। এবার পরিসংখ্যান নিয়ে আজিজুল দেখলেন যত ছাপ তাঁর সংগ্রহে আছে, তার মধ্যে আর্চের সংখ্যা খুবই কম। তাই আর্চ আর লুপকে মিলিয়ে রাখলেন একটা শ্রেণীতেই। অতএব, তৈরি হলো দুটো শ্রেণী—এক, লুপ (সাথে আর্চ) এবং দুই, হোর্ল।

বেশ, শ্রেণীবিভাগ তো হলো হাতের আঙ্গুলের দাগের। এবার এক একটা আঙুলে এক একরকম দাগ থাকতে পারে। তাদের কীভাবে রাখা হবে? গণিতজ্ঞ তথা পরিসংখ্যানবিদ আজিজুল তারও উপায় বের করলেন। ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেকে শুরু করে যদি দুটো করে আঙুল একসাথে ধরি—অর্থাৎ, বুড়ো আঙুল + তর্জনী এবং মধ্যমা + অনামিকা, তাহলে একলা পড়ে থাকলো কনিষ্ঠা বা কড়ে আঙুল। এই একলা কড়ে আঙুলের সাথে জুড়ে দিন বাঁ হাতের বুড়োকে। তারপর আবার দুই দুই। অর্থাৎ যে পাঁচটা দল পাওয়া গেলো তারা এরকম—

(ডান বুড়ো, ডান তর্জনী), (ডান মধ্যমা, ডান অনামিকা), (ডান কড়ে, বাম বুড়ো), (বাম তর্জনী, বাম মধ্যমা), (বাম অনামিকা, বাম কড়ে)

এবার দেখা যাক আঙুলের দাগের দিকটা। প্রথম আঙুল জোড়াই ধরা যাক। চার প্রকার রকমফের হতে পারে। এক, ডান বুড়ো – লুপ, ডান তর্জনী – হোর্ল। দুই, উল্টোটা, মানে, বুড়োতে আছে হোর্ল আর তর্জনীতে আছে লুপ। আর দুই ক্ষেত্র হল, যেখানে দুজনেই লুপ এবং দুজনেই হোর্ল। প্রতি জোড়া আঙুলের জন্য চারটে রকমফের পাওয়া গেলে সবমিলিয়ে পাঁচ জোড়ার জন্য ৪ x ৪ x ৪ x ৪ x ৪ = ১০২৪ রকমের কম্বিনেশন পাওয়া যাবে। আজিজুল দেখলেন, এই ১০২৪ কে আবার বত্রিশের বর্গ হিসাবেও প্রকাশ করা যায়। তিনি এবার গণিতের একটা ম্যাজিক করলেন। প্রতি জোড়া আঙুল যেভাবে আমি উপরে লিখেছিলাম, তাদের এক থেকে পাঁচ অবধি ক্রমিক সংখ্যা হিসাবে মনে করুন। রোল নম্বর ওয়ানের যদি যে কোনো একটি আঙুলে হোর্ল থেকে থাকে, তবে তাকে দেওয়া হবে ১৬ নম্বর। এইভাবে দু’নম্বর জোড়ার একটা আঙুল হোর্ল হলে দেওয়া হবে ১৬/২ = ৮ এবং তারপরের সব জোড়ার জন্য দুই দিয়ে আগের জোড়ার নম্বরকে ভাগ করে যথাক্রমে ৪, ২ এবং ১ দেওয়া হবে। এবার যদি লুপ থাকে, তাহলে সকল জোড়াকেই দেওয়া হবে গোল্লা অর্থাৎ শূন্য। নজর করলে বোঝা যাবে, এক থেকে একত্রিশ অবধি যে কোনো পূর্ণ সংখ্যাকে ১, ২, ৪, ৮ এবং ১৬—এই সংখ্যা পাঁচটার যোগফল হিসাবে প্রকাশ করা যায়। এবার, আজিজুল হক ব্যবস্থা করলেন বত্রিশটা আলমারির। প্রতিটা আলমারিতে বত্রিশটা দেরাজ। অর্থাৎ সবমিলিয়ে এক হাজার চব্বিশটা দেরাজ। কিন্তু কোন দেরাজে কোন কম্বিনেশন রাখা হবে?

হক সাহেব সেটারও একটা নিয়ম বের করলেন। ধরা যাক, প্রথম জোড়া আঙুল। ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী। ধরা যাক, ‘ক’ বাবুর বুড়ো আঙুলে দেখা গেছে লুপ এবং তর্জনীতে হোর্ল। অর্থাৎ বুড়ো আঙুল পেয়েছে ষোলো আর তর্জনীর কপালে গোল্লা। এবার বাকি আট আঙুলের প্রাপ্ত মানও বের করা গেলো। এখন প্রতি জোড়ার প্রথম সদস্যদের একসাথে আর দ্বিতীয় সদস্যদের একসাথে নিয়ে তাদের যোগফল আলাদা আলাদা করে বের করা হল। ‘ক’ বাবুর ডান হাতের বুড়ো লুপ আর তর্জনী হোর্ল আগেই বলেছি। এবার মনে করা যাক, বাঁ হাতের কড়ে হোর্ল অর্থাৎ এক নম্বর পেয়েছে। বাকি সব আঙুল লুপ মানে শূন্য। তাহলে এই দুই দলে ভাগ করে তাদের যোগফল নিয়ে প্রথম সদস্যদের দলের যোগফল দাঁড়াবে ষোলো আর দ্বিতীয় সদস্যদের দলের মোট মান হবে এক। এবার এদের দুজনকেই গ্রেস মার্ক হিসাবে এক নম্বর দেওয়া হলো। কারণ, সব যদি লুপ হয় তাহলে সবাই গোল্লা হয়ে যাবে। মানে, প্রথম দল পেলো সতেরো আর দ্বিতীয় দুই। আজিজুল বললেন, এই ‘ক’ বাবুর হাতের ছাপ রাখা হবে সতেরো নম্বর আলমারির দুই নম্বর দেরাজে।

আজিজুল হকের এই সহজ শ্রেণীবিন্যাস চমকে দিলো হেনরি সাহেবকে। করেছে কি এই নেটিভ ছোঁড়া! এত তাবড় ইংরেজ বুদ্ধিমান প্রায়-বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞ মানুষজন এতদিন ধরে যেটা করে উঠতে পারেনি সেটা এ বের করে ফেলল? মাত্র এক বছরের মধ্যে? কোলকাতার বুকে, রাইটার্স বিল্ডিঙে তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো’। পোশাকি নাম ‘বেঙ্গল ব্যুরো’। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সহ পশ্চিমদেশের সব পুলিশ এবং ইনটেলিজেন্ট বিভাগ গ্রহণ করলো আজিজুল হকের প্রস্তাবিত আঙুলের ছাপ শ্রেণীবিভাগের এই পদ্ধতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই অভাগা বঙ্গসন্তানের নাম শুনলো না কেউ। কারণ এডওয়ার্ড হেনরি। আইডেন্টিফিকেশন অফ ক্রিমিনাল কমিটির চেয়ারম্যান লর্ড বীপারের কাছে এই শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির প্রস্তাব নিয়ে যখন তিনি গেলেন, বীপারের প্রশ্নের উত্তরে সটান বলে বসলেন যে, আজ্ঞে হুজুর, এ তো আমারই মস্তিষ্ক প্রসূত। ডিপার্টমেন্টের লোকজনকে দিয়ে কাজটা করিয়েছি আর কি! শুধু তাই নয় এডওয়ার্ড হেনরি ‘ক্ল্যাসিফিকেসন অ্যান্ড ইউজেস অফ ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ শীর্ষক একটা গবেষণাপত্রও প্রকাশ করলেন ভারত সরকারের সহযোগিতায়। ইংল্যান্ডে গিয়ে নানা জায়গায় বক্তৃতা দিলেন এই নিয়ে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কোথাও একবারও উচ্চারিত হল না আজিজুল হক বা হেমচন্দ্র বসুর নাম।

ব্যাস, আজিজুল হকের আবিষ্কৃত এই পরিসংখ্যান পদ্ধতির নাম গোটা পৃথিবীর কাছে পৌঁছল ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’ নামে। বাঙালি সাব-ইন্সপেক্টর পড়ে রইলেন নিষ্ফল হতাশের দলে। চাকরি যাওয়ার ভয়ে প্রতিবাদের পথেও হাঁটলেন না। চুপচাপ মেনে নিলেন এই অন্যায়। বা হয়ত এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার আনন্দ তাঁকে এতটাই মোহিত করে রেখেছিলো যে এই খ্যাতির মোহ তার কাছে নিতান্ত ক্ষুদ্র, উপেক্ষণীয় বলে মনে হয়েছিলো।

এর পর প্রায় পঁচিশ বছর কেটে গেছে। হক সাহেবের ব্যক্তিগত পরিসরের মানুষজন ছাড়া এই ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’ যে আদতে ‘হক ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’ সেটা খুব একটা কেউ জানে না। ইতিমধ্যে এডওয়ার্ড হেনরি লিখেছেন একটা বইও। ঊনিশশো সালে প্রকাশিত এই বইতেও হেনরি এই ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম যে তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত সেটা ফলাও করে লিখতে কসুর করেননি। তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একজন হর্তা-কর্তা হয়েও বসেছেন কিছুকাল। এদিকে আজিজুল হক এসে উপস্থিত হয়েছেন তাঁর চাকরি জীবনের উপান্তে। ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অফ পুলিশ হক সাহেব নেটিভের ভাগ্য মেনেই অল্প কটা টাকা মাইনে নিয়ে সংসার চালান। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য ‘খান বাহাদুর’ উপাধি পেয়েছেন। এডওয়ার্ড হেনরি বিলেত থেকে আবার শুভেচ্ছাও পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে উনিশশো পঁচিশ সালের আঠাশে ফেব্রুয়ারি ‘দ্য স্টেটসম্যান’ কাগজে জনৈক সাংবাদিক ‘ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স ইন লন্ডন’ শিরোনামে একটা রিপোর্ট প্রকাশ করলেন। সেখানে সেই সাংবাদিক উল্লেখ করলেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ক্ল্যাসিফিকেশনে আজিজুল হকের অবদানের কথা। এদিকে আজিজুল হকের প্রয়োজন অবসর জীবনে পরিবার নিয়ে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। একটা ‘জমির’ জন্য আবেদন পাঠালেন সরকার বাহাদুরের কাছে। সাথে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এই ‘দ্য স্টেটসম্যান’এ প্রকাশিত সংবাদটার একটা কাটিং।  

এই সংবাদ নজর কাড়লো সরকারী আধিকারিকদের। সত্যি ঘটনা জানার জন্য বেশ কিছু চিঠি চালাচালি হলো সরকারের বিভিন্ন দফতরের মধ্যে। অবশেষে উনিশশো ছাব্বিশ সালে বাংলার মুখ্য সচিবের এক চিঠির উত্তরে স্বয়ং এডওয়ার্ড হেনরি স্বীকার করলেন তাঁর ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেমে’ তৎকালীন অধস্তন আজিজুল হকের অবদানের কথা। যদিও হেমচন্দ্র বসুর অবদানের কথা স্বীকার করলেন না। তাঁর সময় লেগেছিল আরো তিন বছর।

প্রায় তিরিশ বছর পর আজিজুল হক পেলেন তাঁর হকের পাওনা। স্ত্রী পরিবার নিয়ে অবসরত্তোর জীবন চালানোর জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। বদলে পেলেন স্বীকৃতি। কিন্তু ততদিনে সেসবের মোহ কি আর সত্যিই ছিল তাঁর? দিনের শেষে পরিবারের অন্নসংস্থান যেখানে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে হাজির হয়, সেখানে আর এই পুরনো না-পাওয়া স্বীকৃতি কীইবা সান্ত্বনা নিয়ে আসতে পারে? বিহারের মতিহারিতে স্ত্রী আর আট সন্তানকে রেখে উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই পরিসংখ্যানবিদ তথা ব্রিটিশ পুলিশের বাঙালী অফিসার। আজ তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে দাঁড়িয়ে তিনি হয়ত বিস্মৃতির অতলে কোনো এক অখ্যাত কবরের আঁধারে শান্তিতে নিদ্রাভূত। কিন্তু তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় একশো বছর ধরে। আধুনিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট রেকগনিশন সিস্টেমের পিছনেও গুরুত্বপূর্ণ  অবদান আছে ‘হেনরি ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’এর—নাকি বলা উচিৎ ‘হক-বসু ক্ল্যাসিফিকেশন সিস্টেম’? অবশ্য, মহান কবি তো বলেই গেছেন, নামে কীই বা আসে যায়?

তথ্যসূত্র:

১. E. R Henry, Classification and Uses of Fingerprints, 1900.

২. Gurvinder Sodhi, The Forgotten Indian Pioneers of Fingerprint Science: Fallout of Colonialism, Indian Journal of History of Science · November 2018.

৩. Colin Beavan, Fingerprints: The Origins of Crime Detection and Murder Case that Launched Forensic Science, Hyperion, NY, USA, 2001.

৪. Tewari RK, Ravikumar KV. History and development of forensic science in India. J. Postgrad Med 2000.

৫. https://en.wikipedia.org/wiki/Henry_Classification_System

লেখক সৈকত ভট্টাচার্য প্রযুক্তিগত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত। নেশা ফোটোগ্রাফি, বেড়ানো এবং লেখালিখি, মূলত নন-ফিকশন। প্রকাশিত দুটি বই – ‘উত্তরে আছে মৌন’ (২০২১) এবং ‘খামখেয়ালির পথপাঁচালি’ (২০১৯)।

মন্তব্য তালিকা - “খান বাহাদুর আজিজুল হক: সার্ধশতবর্ষে বিস্মৃত এক গণিতবিদ”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।