সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ইস্কো গুহা ও হাজারিবাগ চিত্রকলা

ইস্কো গুহা ও হাজারিবাগ চিত্রকলা

শর্মিষ্ঠা দাস

জানুয়ারি ৮, ২০২১ ১১০০ 14

গায়ের লোম থেকে টপ টপ করে জল ঝরছে। ঝুপ্পুস ভিজে সবাই। জল পড়েই চলেছে কদিন ধরে। ঠান্ডা লাগার ভয়, সর্দিকাশি হ্যাঁচ্চোর বোধ নেই কারো। বাজ পড়ল দূরে কোথাও।  দুদিন আগের শিকার বুনো শূকরটা কিছু আছে। আর এক কাঁদি কলা আরো কিছু ফলপাকড়। থম মারা আকাশ আর দমচাপা গরম দেখেই আন্দাজ হয়েছিল কদিন বেরোনো যাবে না। খাবার মজুত। বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে। জোয়ান ছেলে মেয়েদের সময় কাটছে না।  পাথরের মেঝেতে টুকরো পাথর ঘষে চলেছে কেউ কেউ – ক্রমশ ছুঁচলো হয়ে উঠছে তার অগ্রভাগ। রাশি রাশি বর্শার ফলার মতো প্রস্তর অস্ত্র নির্মিত হয়ে জমা থাকে গুহার কোণে। ক্ষুধা নিবৃত্তি–প্রস্তর। আত্মরক্ষা–প্রস্তর।

দুদিনে বৃষ্টি কমল না। হুপহাপ করে গুহার  সর্পিল অন্দরপথে ঘুরল ফিরল সবাই। কক্ষের  অমসৃণ দেয়ালে জলছাপ ফেলল কারো হাত। কেউ অন্য লিঙ্গের আকর্ষণে আলিঙ্গনবদ্ধ হল কিছুটা সময়।  সময় যে তবু আর কাটে না। সারাদিন  সবথেকে চুপচাপ বসে থাকে যে ছেলেটা সে একটা লাল মাটির ঢেলা হাতে তুলে নিল। নিঃশব্দে পৃথিবীতে এক বিপ্লব ঘটে গেল। সেদিন যূথবদ্ধ ভাবে বন্যবরাহ শিকারের সময় তার এক মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। শিকার না জুটলে পেটের মধ্যে কেমন কেমন করে–তার নাম যে “খিদে” তা জানে না ছেলেটা। শুধু মনে হল কী যেন একটা দরকার–বরাহটিকে মনে রাখা ধরে রাখা–নাকি নিছক কর্মহীন হাত দুটিকে ব্যস্ত রাখা। দেয়ালে লাল পাথর দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটতে লাগল। গুহার অন্যান্যরা বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে  রইল–ওই তো চৌকো পেট, চারটে পা! স্মৃতিশক্তি বড় কম, তবু তাদের মনে পড়ে গেল কী যেন একটা ঘটেছিল। এক অর্থহীন শব্দের উল্লাসে ভরে উঠল কক্ষ। একজন অতি উৎসাহী বরাহকে বিদ্ধ করার বর্শাটাও এঁকে ফেলল। সকালে যখন সূর্যের তেরছা আলো এসে পড়ে দেয়ালের  আঁকিবুঁকিতে। সবাই ঘুরে ফিরে দেখে নিজেদের সৃষ্টি।

মাটি শুঁকে ওরা বুঝতে পারে জলের গন্ধ, গাছের গন্ধ, মাটিতে কান পেতে বোঝে কাছাকাছি হিংস্র পশু অথবা খাদ্য পশুর গন্ধ। মাটিতে  খুরের দাগ অনুসরণ করে  পশু শিকার করা হয়। আবার কখনো খুরের দাগ ভীতির সঞ্চার করে। পশুর খুরের দাগ যেন শিশুদের বর্ণপরিচয়। সেদিন মেয়েরা ফিরেছে ফল কুড়িয়ে। তার কিছু খেল, কিছু জমিয়ে রাখল। গুহার কোণে চোখে পড়ল সেই লাল মাটির ঢেলা। একজন মেয়ে ঢেলাটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। পাথুরে মেঝেতে দাগ কাটল ক’টা। তার পর দেয়ালের নীচে লাল মাটির ঢেলাটা ছুঁইয়ে হাতটা একটু ঘুরিয়ে দিল। বিস্মিত নিজে। আদিম নারী জানল না সে একটা বৃত্ত এঁকে ফেলল। তারপর তাদের এই খেলা চলতেই থাকল। বৃত্তের ভেতর আর একটা বৃত্ত–তাকে ভাগ করে একটা রেখা। রেখা বরাবর আরো আরো বৃত্ত। এবার যেন অনেকগুলো অশ্বধ্বনি শোনা যেতে লাগল গুহার ভিতর।

অনেক বছর পর – সে প্রায় পাঁচ দশ হাজার বছর হবে। তখন আর তারা গুহায় থাকে না, শুধু পশু শিকারের উপর নির্ভর করে বাঁচে না। চাষবাস, ফসল ফলানো, ঘর বানানো শিখে গেছে। নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসব “সোহরাই”-এর আগে মাটির উঠোনে বাড়ির মেয়ে-বৌরা হুবহু সেই একইরকম সারি সারি বৃত্ত আঁকবে–পশুখুরের প্রতীক, তাদের গৃহপালিত পশুদের গৃহে আহ্বানের সংকেত।

ইস্কো গুহা ও দেয়ালচিত্র আবিষ্কার

১৯৯১ সাল। হাজারিবাগের জেস্যুইট  ফাদার টনি হারবার্ট এনজিওর কাজে পাহাড় জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামে ঘুরে বেড়ান। একা বেরিয়েছেন সেদিন। গ্রামের পাশে উঁচু পাহাড়ে গাড়ীবারান্দার মতো এগিয়ে থাকা পাথরটা ফাদারকে রোজ হাতছানি দেয়। নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, যাওয়া হয় না কোনোদিন। নীচে থেকে আবছা দেখা যায় একটা অন্ধকার গুহামুখ। সেদিন সঙ্গে কেউ নেই।  কোনো পিছুটান নেই। ফাদার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না। ছোট পাকদণ্ডি ভেঙে পাথুরে চট্টানে পৌঁছে গেলেন। বেশ খানিকটা পাথর পেরিয়ে সেই এগুনো ছাদের কানাতের মতো জায়গা–তার ওপাশে সত্যিই একটা লম্বা গুহা। বুক ধড়ফড় করছে এতটা হাঁটা আর উত্তেজনায়! সাপের ফণার আকারে গুহাটা এগিয়ে গিয়ে বাঁক নিয়েছে। সূর্য ঘুরতেই হঠাৎ চোখ  গিয়ে পড়ল গুহার দেয়ালে ছাদে–চোখ বিস্ফারিত হল, চোখ রগড়ালেন একবার ফাদার। শহরে ফিরে যোগ্য লোককে গিয়ে বললেন, ওখানে গিয়ে দেখো একবার। Something is there… আমি ঠিক মর্মোদ্ধার করতে পারিনি।

এরপর হাজারিবাগের ইস্কো গুহা আবিষ্কার হল, ভারতের বাইরে সব পত্র পত্রিকাতে ইস্কোর খবর ছাপা হল। এই কাজটি করলেন বুলু ইমাম, হাজারিবাগে INTACH (Indian National Trust For Art and Cultural Heritage) এর আহ্বায়ক ।

নিজের স্টাডিতে বুলু ইমাম

আন্তর্জাতিক গুহাচিত্র বিশেষজ্ঞ, ভিয়েনার Erwin Neumayer  ও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রাগৈতিহাসিক বিভাগের  প্রধান S. B. Otta ইস্কো গুহাচিত্র নিয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত  দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা চালান। গুহাচিত্রের সময়কাল নির্ধারিত হয়  ৯০০০ BCE থেকে ৫০০০ BCE  অর্থাৎ  মেসোলিথিক পিরিয়ড। এত বছর আগের সৃষ্টি এগুলি! গুহাচিত্রের বয়স নির্ধারণ নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হয় বিজ্ঞানীদের। ধন্দও যে পুরোপুরি মেটে তা নয়। গুহাচিত্রের বয়স দুভাবে  বোঝা যায়। এক, রেডিওকার্বন ডেটিং। দুই, পারিপার্শ্বিক বস্তু বা অন্য কোনো প্রমাণের সঙ্গে মিলিয়ে। রেডিওকার্বন ডেটিং পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত সঠিক উপায়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে জীবাশ্ম, দেহাবশেষ বা অন্যান্য জৈব পদার্থের বয়স নির্ধারণ যতটাই সহজ গুহাচিত্রের ক্ষেত্রে ততটাই কঠিন, কখনো বা অসম্ভব। ধরা যাক কোনো এক আদিম মানুষ এক টুকরো কয়লা দিয়ে ছবি এঁকেছিলেন। রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ছবির রঙ থেকে সেই কয়লার বয়স নির্ধারণ করতে পারবে, আঁকার সময়ের নয়। কাঠকয়লাটার জন্ম তো আরো কত কত বছর আগে। গুহাচিত্রের ক্ষতি না করে বয়স নির্ধারণের উপাদান সংগ্রহও বড় কঠিন। মাটি দিয়ে বা খোদাই করে আঁকা গুহাচিত্রের বেলাতেও এক সমস্যা। রেডিওকার্বন ডেটিং-এর মূল উপাদান C14 এর উপস্থিতিই নেই। ইস্কো গুহার অধিকাংশ চিত্র লাল পাথর হিমাটাইট আর সাদা মাটি দিয়ে আঁকা। এখুনি হাজারিবাগের পাহাড় ঘেঁষা আদিবাসী গ্রামে গেলে দেখা যাবে দেয়াল চিত্র আঁকা হচ্ছে। কী দিয়ে ? সেই দশ হাজার বছর আগের রঙের ব্যবহার–লাল মিট্টি, সাদা রঙের দুধি মিট্টি আর কালি মিট্টি। কারো ছবিতে থাকে আর একটা গেরুয়া হলুদ রঙের সংযোজন–নাগরি মিট্টি।

হাজারিবাগে পাওয়া মাইক্রোলিথ, বুলু ইমাম কর্তৃক সংস্কৃতি কেন্দ্র মিউজিয়ামে সংরক্ষিত

ইস্কো গুহা গহ্বরে প্রচুর Microlith বা ক্ষুদ্র প্রস্তর পাওয়া গেছে যা আসলে গুহামানবদের ব্যবহৃত অস্ত্র, যন্ত্রপাতি। ছোট পাথরের টুকরোকে ঘষে ঘষে বা চেঁছে একদিক তীক্ষ্ম ধারালো করে তোলা হত। মাংস ভাগ করতে, পশুচামড়া কাটতে–সব কাজেই লাগত। এত মাইক্রোলিথের উপস্থিতি প্রমাণ করে অর্ধ-যাযাবর গোষ্ঠীর আদি মানুষ ইস্কো গুহায় বাস করত। হাজারিবাগের উত্তর করণপুরা উপত্যকা অঞ্চলে প্রস্তরযুগের “Olduwan” ধরনের অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। বুলু ইমামের গবেষণা অনুযায়ী এই প্রাপ্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ! ঝাড়খন্ড অঞ্চলে নিশ্চয় অতি প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কোন প্রজাতির বসবাস ছিল। (Reference–The Antiquarian Remains Of Jharkhand. Page number 425)

ইস্কো গুহাচিত্র দেখতে গিয়েই প্রস্তরযুগের যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জানতে পারলাম।  আধুনিক AK 47, L96 Sniper Rifle, 870 Shot gun—লক্ষ লক্ষ বছর আগে এসবের পূর্বসূরি শুধু পাথরের  অস্ত্র।  পৃথিবীর যেখানে প্রথম পাওয়া গেছে সেই অঞ্চলের নাম অনুযায়ী  প্রস্তরযুগের অস্ত্রশস্ত্রের নামকরণ করা হয়েছে। ৩.৩ মিলিয়ন বছর আগে আদি প্রস্তরযুগে একদম ভোঁতা পাথর, শুধু এবড়োখেবড়ো ধারগুলো একটু ভেঙ্গে ফেলে ব্যবহার করা হত–এই পাথুরে অস্ত্রকে “Lomekwian” নাম দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এরপর এল “Olduwan” শ্রেণির পাথুরে অস্ত্র, আগের ভোঁতা পাথরকে একটু চেঁচে ছুলে ধারালো করতেই লেগে গেল এক মিলিয়ন বছর! আরো প্রায় এক মিলিয়ন বছরের অধ্যবসায়ের ফলে হোমো হ্যাবিলিসরা পাথরকে হাতের মুঠোয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরার মত একটা আকৃতি দিতে সক্ষম হল। তৈরি হল ঘোড়ার নালের মত হাতুড়ি, “Horse hoof hammer”।

ধান ভানতে শিবের গীত ছেড়ে ইস্কো গুহায় ফিরি। হাজারিবাগ শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে ইস্কো গ্রাম ঘেঁষে। গুহার সৌভাগ্য যে এখনো আমপর্যটক সন্ধান পাননি। গা ছমছম করে ওঠে স্বল্প পরিসর কুঠুরিতে ঢুকে। সারি সারি জ্যামিতিক চিত্র। সমকেন্দ্রিক বৃত্ত, চতুর্ভুজ। অনেকগুলো বর্গক্ষেত্রের মধ্যে ত্রিভুজ। এতো শুধু ছবি নয়—যেন কোনো লিপি। অনেক কথা। সারাদিনের খাটুনির পর নিশ্চয়ই কিছু  দিনলিপি লিখে রেখে গেছে আদিমানব। যা পাঠোদ্ধার কোনোদিন সম্ভব হবে না, শুধু নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকব। গবেষকরা বলেন এসব জ্যামিতিক চিত্র প্রাক-হরপ্পা লিপি। প্রোটো ব্রাহ্মীলিপিও বলেন কেউ কেউ। অন্ধকার দেয়ালে নজর করলে চোখে পড়বে হরিণের মতো কোনো চতুষ্পদ। ব্যাঙ। অনেক হাতের ছাপ। মানুষের কৌণিক রেখাচিত্র। এরকম একটা রেখাচিত্রের বিষয় ও সময় নির্ধারণ নিয়ে গবেষণা চলতে পারে।

আদি মানব শুধু  রেখায় মানুষ আঁকত। মানবদেহের নানা বিভঙ্গ, খাঁজ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আলাদা করে শেড দিয়ে  আঁকা হত না। ইস্কো গুহার এক মানবদেহের দুই জঙ্ঘার সংযোগস্থলে ছিল একটি ক্ষুদ্র বর্গক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্রের একদম নীচের বাহুর সঙ্গে সংযুক্ত  ততোধিক ক্ষুদ্র একটি বৃত্ত। আন্তর্জাতিক গুহাচিত্র বিশেষজ্ঞ  Erwin Neumayer এই চতুর্ভুজ আর বৃত্তকে পুরুষ লিঙ্গ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু ইস্কো গুহা বিশেষজ্ঞ বুলু ইমাম একে লিঙ্গ বলতে নারাজ।  তাঁর  মতে আদিমানব Diagramatic figure যেটুকু পারত নিখুঁত আঁকত, ভুল আঁকত না। চতুর্ভুজের নীচে বৃত্ত পুরুষ লিঙ্গের আকৃতি প্রতিফলিত করে না। এটা একটি শিশু প্রসবের ছবি। যদি তাই হয়, তাহলে জীবনের বিভিন্ন  অধ্যায় আদিমানবের মনকে নাড়া দিত। এ এক নতুন সংযোজন।

খোবর ও সোহরাই চিত্রকলা

আজ থেকে ১০,০০০ বছর আগে, এখনকার প্রথা অনুযায়ী লিখতে হবে ১০,০০০ বিপি, বিফোর প্রেজেন্ট। সেখান থেকে একেবারে ২০১৯ সাধারণাব্দ। বড়কাগাঁও গ্রামে ঢুকলাম। হাজারিবাগ শহরে ঢোকার আগেই বাঁ দিকে ২৬ কিলোমিটার লেখা তীরচিহ্ন। আদিবাসী গ্রাম। পুরো গ্রামটাই যেন এক আর্ট গ্যালারি। সারাবছর ধরে যেন প্রদর্শনী চলে। বছরে দুবার চিত্র বদল হয়। মানে দেয়ালচিত্র আর কি। হাজারিবাগ চিত্রকলা– খোবর আর সোহরাই বিভিন্ন পর্যায়ে  আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। GI tag ( Geographical Indication) পেয়েছে।

রাঁচি এয়ারপোর্টে চিত্রিত খোবর

খোবর চিত্র আঁকা হয় নবদম্পতির বিয়ের ঘরে। বাইরের ও অন্দরের দেয়ালে। Sgraffito পদ্ধতিতে আঁকা হয়। দুই রঙের স্তরের মধ্যে আঁচড় কেটে নীচের স্তরকে ফুটিয়ে তোলা–যেন বুক চিরে পরানটা দেখানো। বিয়ে হয় বসন্ত অথবা গরমকালে। শহুরে এলইডি লাইট নেই, মাইক নেই। তবু কেমন  সাজ সাজ রব। প্রথমে মাটির ঘরের দেয়ালে লেপে দেওয়া হয় কালো মাটি, এই ‘কালি মিট্টি’ ম্যাঙ্গানিজ সমৃদ্ধ। তার উপরে সাদা (কেয়োলিন) মাটি। দ্বিতীয় প্রলেপ পুরো শুকোনোর আগেই তার উপর আঁচড় কেটে আঁকা হয়–হাতি, ব্যাঙ, ময়ূর, পদ্মফুল, কচ্ছপ, মাছ, কাঠবেড়ালি, চড়ুইপাখি।  না-মানুষ পারিপার্শ্বিক সবাইকে নিয়েই তো পরিবার। নব-বিবাহিতদের সেই দীক্ষা দিতেই কি এসবের মোটিফ ফুটিয়ে তোলা! খোবর চিত্রে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে নরনারীর অনন্ত বন্ধন, উভয়ের মিলনে সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখার বার্তা দেওয়া হয়। ছবির বিষয়বস্তু ফুটিয়ে তোলার জন্য হালকার পাশে গাঢ় – দুটো কনট্রাস্ট রঙের প্রয়োগ হল  “Chiarascuro” পদ্ধতি। প্রাচীনকাল থেকেই  সারা পৃথিবীর চিত্রকলায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খোবর চিত্রশৈলীতে শিল্পীর অজান্তে সাদা কালো রঙের বৈপরীত্যে এই ‘কিয়ারাস্কুরো এফেক্ট’ প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়।

রাঁচি এয়ারপোর্টে চিত্রিত সোহরাই

নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে। ঝাড়খন্ড ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রমী ঝাড়খন্ডের হাজারিবাগ জেলার আদিবাসী গ্রামগুলো। এই সময়ে বরকাগাঁও-এর পঞ্চাশ কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে দশটা গ্রামে ঘুরলেই বোঝা যাবে আর পাঁচটা জায়গার সঙ্গে তফাতটা কোথায়! আক্ষরিক অর্থে অভাবী মাটির বাড়ি সবার। দেওয়ালীর পরেই সেসব ঘর মেরামত করা হয়, দেয়ালে নতুন মাটি লেপা হয়–সোহরাই আসছে যে! সোহরাই পরবের অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানের কথা অনেকেই জানেন। উত্তর দামোদর উপত্যকা, হাজারিবাগের আদিবাসী গ্রামে সোহরাই উপলক্ষে ঘরে ঘরে যে দেয়ালচিত্র আঁকা হয়–অমন জীবন্ত ইতিহাস বিরল। নতুন ফসল-নবান্নের, সুগন্ধ-সম্বৎসর, খাবারের আশ্বাস-জীবনে, এর চেয়ে বেশি কিইবা  চাওয়ার থাকতে পারে? সাজো সাজো রব। গানবাজনা নাচ খানাপিনা তো হবেই। কিন্তু ওরা তো সহজাত শিল্পী। তাই ঘরের ভিতর বাইরে সেজে উঠবে সোহরাই চিত্রে। এ ছবি রঙিন। চার রঙের যাদুখেলা। লাল মিট্টি, কালি মিট্টি, দুধি মিট্টি আর পিলা মিট্টি। গাঢ় কালো রঙের জন্য আছে ভেলার বীজ। বাড়ির গিন্নীমা বৌমা কন্যা – সবাই মিলে  ছবি আঁকবে; শুধু কুঁড়েঘরের দেয়াল জানে সেই আবেগ।  ঘরের দাওয়ায় লতিয়ে ওঠা উদ্ভিদ, শুঁড়ওয়ালা পোকা সরীসৃপ, জন্তু জানোয়ার, পাখি সব আঁকা হবে। তুলি হয়ে উঠবে হাতের চার আঙুল,  কখনো ছেঁড়া কাপড়, ভাঙা চিরুনি বা গাছের ভাঙা চিকন ডাল। বিভিন্ন অঞ্চলের সোহরাই চিত্রে বিষয়বস্তু পৃথক। এই ভিন্নধারা দেখে বোঝা সম্ভব যে কোন গ্রামের ছবি। জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামের দেয়াল চিত্রে বন্য প্রাণীর প্রাধান্য বেশী, অন্যত্র জনজীবন। সোহরাই চিত্রে বিষয়ের  আনুপাতিক পরিমাপের দিকে মোটেই খেয়াল রাখা হয় না। হয়তো দেখা গেল হাতি, প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা – সব এক সাইজের। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সোহরাই আধুনিকও বটে।

ছবিকে ইতিহাস বলছি কেন?

এক একটা গ্রামে আছেন ওঁরাও, কুর্মী, গুঞ্জু, মুন্ডা, প্রজাপতি, অসুর, বীরহোর ইত্যাদি আদিবাসী। যাদের পূর্ব পুরুষরা শুয়ে আছে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেগালিথ অথবা মাটির  নীচে। বনচারী সময়ের মানুষ যখন বছরের কিছুটা সময় গুহায় কাটাত তারা  ছবি আঁকত। এরপর  হোমো হ্যাবিলিস থেকে হোমো সেপিয়েন্স-এ উন্নীত হল মানুষ। বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে  মস্তিষ্কের উন্নতির  সঙ্গে  হাজার হাজার বছরে তাদের ব্যবহার, জীবন যাপন, জীবিকার কিছু পরিবর্তন ঘটল। তবু নৃতত্ত্ববিদরা আধুনিক মানুষের  পূর্বসূরিদের সঙ্গে যোগসূত্র ঠিক খুঁজে বের করতে পারেন।  বুলু ইমাম ও পৃথিবীর  গুহাচিত্র বিশেষজ্ঞরা – হাজারিবাগে খোবর ও সোহরাই চিত্রকলার সঙ্গে ওই অঞ্চলের গুহাচিত্রের মিল খুঁজে পেয়ে প্রমাণ করেছেন যে এইসব দেয়ালচিত্র ইস্কো ও তৎসংলগ্ন গুহাচিত্রেরই বিবর্তিত সংস্করণ। খোবর ও সোহরাই চিত্রকলা যে কোনো আঞ্চলিক  চিত্রকলার  চাইতে প্রাচীন এবং প্রাকবৈদিক তার প্রমাণ – এই চিত্রকলায় কখনোই কোনো দেব দেবীর উপস্থিতি থাকে না, থাকে শুধু প্রকৃতি আর মানুষের যাপন। এই প্রমাণের ফলে হাজারিবাগ চিত্রকলা বিশ্বে “Intellectual property rights”  আদায় করেছে। এই ধরনের  লড়াইয়ে প্রথম পথ দেখিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার হার্মান্সবার্গ জনজাতির চিত্রকলার সংরক্ষণ।

খোবর আর সোহরাই পুরোপুরি নারী শিল্পীদের আঁকা ও তাঁদেরই পরিকল্পনা। ছোটবেলা থেকেই মেয়ে শেখে মায়ের কাছে। এক গ্রামের মেয়ে যখন বিয়ের পরে পতিগৃহে আসে তাঁর বাড়ির তাঁর মায়ের আঁকার ঘরানা, আঁকার বিশেষত্বটুকু সঙ্গে নিয়ে আসে। এভাবে সোহরাই ও খোবর ঘরানা এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মের হাতে প্রবাহিত হয়ে চলে। পৃথিবীতে এরকম সম্পূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক শিল্পকলা আর দুটি আছে কিনা সন্দেহ!

খোবর ও সোহরাই চিত্রকলার  বিপন্নতা

সোহরাই ও খোবর কি বিপন্ন শিল্প থেকে বিলুপ্তির পথে চলে যাবে? যেদিন আর কোনো মাটির বাড়ি থাকবে না। আমরা পাকা বাড়ির ছাদের নীচে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় বসে যদি চোখের জল ফেলি, তাহলে জীবনের বাস্তব চাহিদা  থেকে দূরে সরে যাব। শিল্পকর্ম বাঁচিয়ে রাখার জন্য  ঝড় বৃষ্টি বন্যা শীতের কষ্ট সহ্য করে আদিবাসীরা অনন্তকাল ধরে আত্মত্যাগ করবেন সে দাবী অন্যায্য।

এসব প্রশ্নের মাঝেই অন্য এক খাঁড়া নেমে এল। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার কথা। কোল ইন্ডিয়ার নর্থ করণপুরা প্রজেক্ট কার্যকর করার লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে দেয়ালচিত্র সম্বলিত দু’শটি গ্রাম একেবারে  নিশ্চিহ্ন হবার উপক্রম হল।  মিটিং, প্রতিবাদ  মিছিল, পদযাত্রা – কোনো কিছুই খুব ফলপ্রসূ হল না। ওই গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন হলে নিশ্চিত যে চিত্রধারা থাকবে না।

TWAC র নারী শিল্পীদের কাজ (১)

কী করা যায়?

বুলু ইমাম সম্পূর্ণ নিজস্ব মস্তিস্কপ্রসূত ভাবনা থেকে ১৯৯৩ সাধারণাব্দে ভারতে অস্ট্রেলিয়া হাই কমিশনের আর্থিক সহযোগিতায়, পঞ্চাশজন আদিবাসী শিল্পীদের নিয়ে গঠন করলেন TWAC (Tribal Women Artists Co-operative)। তাঁদের বললেন, যে ছবি তোমরা এতদিন তাদের মাটির ঘরের দেয়ালে আঁকতে, এখন কাগজ বা কাপড়ে অ্যাক্রিলিক রঙে সেই ছবি আঁকো। হাজারিবাগ শিল্পের ধারা, চিত্রশেলী তো বাঁচুক।  TWAC গঠনের উদ্দেশ্য ছিল তিনটি। প্রথমতঃ করণপুরা কয়লাখনি প্রোজেক্টের জন্য পৃথিবী কী হারাতে চলেছে  তা দৃষ্টিগোচর করানো। দ্বিতীয়তঃ বিলুপ্ত হবার আগে এই আদিম শিল্পশৈলীকে সংরক্ষণ। তৃতীয় উদ্দেশ্যটি মহৎ, এখনই খালি চোখে দেখা যায় – সোহরাই ও কোওহর শিল্পী মহিলাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা।

১৯৯৫ সাধারণাব্দে অস্ট্রেলিয়াতে পর পর সতেরোটা প্রদর্শনী করল এই কোঅপারেটিভ এবং সব ছবি বিক্রি হয়ে গেল। কোঅপারেটিভের নিয়ম – উপার্জনের এক তৃতীয়াংশ সরাসরি শিল্পীরা পান। এক তৃতীয়াংশ আদিবাসী ওয়েলফেয়ারের কাজে লাগে।  তিন ভাগের বাকি এক ভাগ “সংস্কৃতি মিউজিয়াম” সংরক্ষণের জন্য রেখে দেওয়া হয়।

এরপর TWAC র জয়যাত্রায় আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতে প্রথম প্রদর্শনী মুম্বই এর কেমোল্ড গ্যালারিতে, ১৯৯৫ সালেই। যাঁরা হাজারিবাগে নিজের গ্রামের বাইরে কখনো পা রাখেনি, ২০০০ সালে এরকম পাঁচজন শিল্পী একমাস রইলেন সিডনিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মিউজিয়ামের দেয়ালে সোহরাই আর খোবর এর ম্যুরাল নির্মাণ করলেন। শিল্পকর্মের স্থায়ী স্বীকৃতি আর উপার্জন–অক্ষরপরিচয়হীন গুণী মহিলা, যাঁরা এতদিন শুধু অবজ্ঞা উপেক্ষা অনাহার অর্ধাহারে অভ্যস্ত ছিলেন–করপুট ভরে এল তাঁদের প্রাপ্য সম্মান! এখন সব আন্তর্জাতিক পর্যটক হাজারিবাগের অখ্যাত কুর্মি, গুঞ্জু, ওঁরাও, তিরকিদের নির্মাণ দেখেন জুরিখে, রিটবার্গ মিউজিয়ামের ম্যুরালে। ইংল্যান্ড, রোম, কানাডা—-বিশ্বজুড়ে এখনও পর্যন্ত পঞ্চাশটি বড় মাপের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হয়েছে–সব ক’টিতে বিপুল সাফল্য। জয়ের টুপিতে ক্রমশ নতুন পালক যোগ হয়েই চলেছে—

বর্তমানে TWAC-র অন্য শাখা এই শিল্পকে দুনিয়াতে আরো ছড়িয়ে দিয়েছে। সেরামিক নির্মাণে, ফেব্রিক প্রিন্টেও ব্যবহার হচ্ছে খোবর, সোহরাই চিত্র।

TWAC র নারী শিল্পীদের কাজ (২)

কিছু সংশয় তবু মনে ঘুরপাক খায়। এই যে মাধ্যমটা বদলে গেল–মাটির দেয়ালের বদলে অন্য জমি, ধূসর প্রাকৃতিক রঙের বদলে উজ্জ্বল  কেমিক্যাল রঙ। চিত্রকলার মেজাজ তো বদলে গেল। দুই চিত্রই পাশাপাশি দেখলে এ প্রশ্ন মনে আসবেই। উত্তর শিল্পীদের কাছ থেকেই যেমনটা পাওয়া যায়–প্রাকৃতিক রঙ আগের মতো সহজলভ্য নয়। আরো ভাবি , এ হয়তো বা প্রকৃতিকে খুবলে নেওয়া। মার্বেলে মেঝে মুড়তে গিয়ে আমরা যেমন কিছুদিনের মধ্যেই রাজস্থানের অনেক  প্রাকৃতিক সম্পদ শেষ করে ফেলতে চলেছি। সেইরকম মাধ্যম অপরিবর্তিত রেখে খোবর বা সোহরাইকে বিপুল জনপ্রিয় করতে গেলে  সতিপাহাড় (যেখানে মেলে দুধিমিট্টি) কি অনেকটা ছোট হয়ে যাবে না?

এসব প্রশ্নের মধ্যেই পুতলি গুঞ্জু নির্বিকার ভাবে এঁকে চলে প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ। রুধনি এসে বাঁ হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার কথা লিখবে না? রুধনি গাঁয়ের সোহরাই খোবর শিল্পী। করণপুরিয়া গ্রাম্য হিন্দী ছাড়া কোনো ভাষা বোঝে না। বছর দশেক আগে গ্যাংগ্রীন হয়ে তাঁর ডানহাত বাদ গেছে। এখন সে বাঁ হাতে একই রকম নিপুণতায় পৃথিবী জুড়ে দেয়ালচিত্র আঁকে।

তথ্যসূত্রঃ

১) লেখকের নিজের ক্ষেত্রসমীক্ষা 2018 November  –2020 February

২) বুলু ইমাম, গুস্তাভ ইমাম ও জাস্টিন ইমামের সঙ্গে লেখকের সাক্ষাৎকার

৩) উইকিপিডিয়া

৪) হাজারিবাগ চিত্রকলা শৈলী (হিন্দি)–জনসম্পর্ক বিভাগ। ঝাড়খন্ড সরকার। year of publication October 2018

৫) Bulu Imam. Antiquarian Remains of Jharkhand. 2014. Indian National Trust for Art and Cultural Heritage

মন্তব্য তালিকা - “ইস্কো গুহা ও হাজারিবাগ চিত্রকলা”

    1. অনেক ধন্যবাদ কণিকাদি ।
      নৃতত্ত্বের গবেষণা এখনো অনেকটাই অসম্পূর্ণ । এখানে লিপি নয় কিন্তু লিপির মত কিছু চিত্র চিন্তার দরজা খুলে দিয়েছে ।

  1. একবারে নতুন তথ্য পেলাম। সমৃদ্ধ হলাম।
    অনেকে ধন্যবাদ এমন গবেষণা জাত তথ্য সাবলীল ভাবে প্ৰকাশ করায়।

  2. আমি নিজে ইতিহাসের ছাত্র না হলেও ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ আছে । সেই আগ্রহেই বন্ধুবর শিবাশিশের পরামর্শে এখানে এসে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি । এই সমস্ত খবর অ তথ্য সম্বন্ধে আমার আগে কন ধারনা ছিল না । লেখিকাকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।