সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

আমাদের ইতিহাস জিজ্ঞাসা : রণবীর চক্রবর্তী ও কণাদ সিনহার উত্তর

আমাদের ইতিহাস জিজ্ঞাসা : রণবীর চক্রবর্তী ও কণাদ সিনহার উত্তর

ডিসেম্বর ১২, ২০২১ ৬০৯ 1

(অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক-গবেষকদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রাচীন যুগে ভারতের আর্থিক ও সামাজিক ইতিহাস এবং ভারত মহাসাগরে সমুদ্র বাণিজ্যের ইতিহাস। পরবর্তীকালে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ-এ দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই লিখেছেন অথবা সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কতগুলো গ্রন্থ হল- A Sourcebook of Indian Civilization, Trade in Early India, Trade and Traders in Early Indian Society, Warfare for Wealth: Early Indian Perspective, Exploring Early India up to c. AD 1300, The Pull Towards the Coast and Other Essays, ভারতের ইতিহাস-আদি পর্ব, প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে)

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক লাইভ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী দর্শকদের থেকে কিছু প্রশ্ন গ্রহণ করে লিখিতভাবে এখানে আলোচনা করেছেন। ওঁর ছাত্র অধ্যাপক কণাদ সিনহাও কিছু বিষয় নিয়ে নিজস্ব মতামত জানিয়েছেন।

১) ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব কোন সময়ে? উদ্ভবের কারণ কী ছিল?

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – সাম্প্রদায়িকতা শব্দটিকে ধৰ্ম-সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে ব্যবহার করা বা বোঝা অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও শ্রেয়। এই শব্দটি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা মাধুরী দেবীকে লিখিত একটি চিঠিতে ব্যবহার করেছিলেন – নানারকম দল তথা দলবাজির অনুষঙ্গে ‘ধর্মসাম্প্রদায়িক দল’ এই শব্দবন্ধ ওই চিঠিতে লিখেছিলেন (আমি দুঃখিত যে এই চিঠির তারিখ এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না; রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র রবীন্দ্রারচনাবলীর যে খন্ডে আছে, সেখানে দেখা যেতে পারে) নানাবিধ ধৰ্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে টানা-পোড়েনের, রেষারেষির সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। পতঞ্জলি পাণিনির ব্যাকরণের উপর যে বৃহৎ টীকা খ্রি: পূ: দ্বিতীয় শতকে লেখেন, তাতে ব্রাহ্মণ-শ্রমণ অহি-নকুল সম্পর্ক বলে চিহ্নিত। পুরাণগুলিতেও শিব ও বিষ্ণু কে বড় তা নিয়ে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভূরি পরিমান নজির আছে। কিন্তু যাকে আমরা সাম্প্রদায়িক/ধর্মসাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও বিদ্বেষ পূর্ণ আচরণ বলি, তার সূচনা উনিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব থেকে – যখন হিন্দু ও মুসলমান দুটি (সম্প্রদায়কে) একশৈলিক বিবাদমান ও যুযুধান গোষ্ঠী হিসেবে দেখা শুরু হল। এর সঙ্গে একাকার করে দেওয়া জাতি-রাষ্ট্র গড়ার মানসিকতা ও তাগিদ জুড়ে আছে।

অধ্যাপক কণাদ সিনহা – ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিবাদ বিসংবাদ, সংঘাত, এসব বহু প্রাচীন কাল থেকেই ছিল। কম বা বেশী। বৈদিক যুগ থেকেই এর নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্মীয় পরিচয়কে জাতিগত পরিচয় হিসাবে দেখিয়ে যে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতি তার পিছনে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা যেমন একটা কারণ, আর একটা বড় কারণ অবশ্যই ঔপনিবেশিক শাসকদের বিভাজনের রাজনীতি – Divide and Rule Policy. সংস্কৃত ভাষাভাষী ভারতীয় হিন্দুদের পূর্বপুরুষেরা এবং গ্রীক ও লাটিন ভাষাভাষী ইউরোপীয় সভ্যতার পূর্বপুরুষেরা আর্য নামক একই জনগোষ্ঠীর থেকে উদ্ভুত, যাদের থেকে তুর্কী ও আরবী ভাষাভাষী ভারতের মুসলিম শাসকরা জাতিগতভাবে পৃথক – ঔপনিবেশিক ইতিহাসের এই দাবী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অন্যতম বীজ। যদুনাথ সরকারের মত বেশ কিছু জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদের রচনাও এই ধারণার দ্বারা প্রভাবিত। বলা বাহুল্য, এই তত্ত্বটির সারবত্তা বিশেষ নেই। ভাষাগত পরিচয় নিশ্চিতভাবে জাতিগত পরিচয়ের দ্যোতক নয়। উপরন্তু ভারতীয় মুসলিম শাসকদের প্রধান প্রশাসনিক ভাষা ফার্সি সংস্কৃত, গ্রীক, লাটিনের মতই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত, সংস্কৃত ও প্রাচীন পারসিকের সম্পর্ক সংস্কৃত ও গ্রীক/লাটিনের সম্পর্কের চেয়ে ঘনিষ্ঠ। আরবী বা তুর্কীর ব্যবহার মধ্যযুগের ভারতে বিরল। আবার ইংরেজ বা আধুনিক ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীগুলি সরাসরি প্রাচীন গ্রীক বা রোমানদের উত্তরসূরী নয়। রোমানরা যাদের বর্বর জনগোষ্ঠী মনে করত (ভাষা যাই হোক না কেন) সেই স্যাক্সন, নর্মান, গল, ফ্রাঙ্ক, গথ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরী আধুনিক ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয়রা।

২) প্রাকৃৎ, পালি ভাষার সম্পর্কেও কিছু বলুন।

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – পালি ও প্রাকৃত দুই ভাষাই মধ্য ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। পালির ব্যবহার প্রাচীনতম বৌদ্ধ শাস্ত্র রচনায় দেখা যায়, যার সময় সম্ভবত খ্রি: পূ: তৃতীয়/চতুর্থ শতাব্দীতে। বুদ্ধ-র উপদেশ ও কথোপকথন পালি-তে রচিত। প্রাকৃত-র ব্যবহার ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী। প্রাকৃত-এর নানা শাখাও আছে: মাগধী, শৌরসেনী, মহারাষ্ট্রী, গন্ধারী প্রভৃতি। অশোকের অনুশাসনগুলি প্রধানত প্রাকৃত-এ লিখিত। শাসকীয় বয়ান ও নির্দেশাবলী খ্রি: পূ: তৃতীয় শতক থেকে খ্রি: তৃতীয় শতক অবধি প্রধানত প্রাকৃত-এ লিখিত। এর সেরা প্রমাণ প্রচুর সংখ্যক শিলালেখ যা সুদূর দক্ষিণ-ভারত বাদ দিলে উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র উপস্থিত। সুদূর দক্ষিণ ভারতে একই সময়ে তামিল-এর লিখিত ও কাব্যময় রূপ সুপরিচিত। উপরিউক্ত ৫০০ বছরে সংস্কৃত রচনার চেয়ে প্রাকৃত-র ব্যবহার কিছুমাত্র কমছিল না। পরবর্তীকালে প্রাকৃতের ব্যবহার মূলতঃ করছেন জৈন ধর্ম্বালম্বীরা। ভাষা হিসেবে পালি ও প্রাকৃত-র গুরুত্ব অপরিসীম।

৩) মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার আবিষ্কারক কারা?

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯২২); হরপ্পা-তে প্রথম উৎখনন ও আবিষ্কার করেন দয়ারাম সাহানি (১৯২১)

৪) কীভাবে চরম দ্রাবিড়িয়ানদের কেরালা আদিশঙ্করাচার্যের অধীনে সংস্কৃত ও হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যাকার হয়ে ওঠেন?

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী– ভারতীয় দর্শনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরোধা শঙ্করাচার্য কোথাও হিন্দু ধৰ্ম শব্দটি ব্যবহার করেছেন? প্রস্থানত্রয়-র প্রণেতা হিসেবে তিনি অবশ্যমান্য। বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যবাহী ধ্যান-ধারণা তো সংস্কৃত-র মাধ্যমেই হয়ে আসছে। খ্রি: চতুর্থ শতক থেকে বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধ্যানধারণার ব্যাপক প্রসার সমগ্র উপমহাদেশে সংস্কৃত-কে বিশেষ মান্যতা দেয়। এর-ই সুবাদে সুদূর দক্ষিণ ভারতেও সংস্কৃত-র বিস্তার ঘটে। তবে সংস্কৃত কখনো-ই সর্বসাধারণের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষা না; রাজ দরবার, অতি প্রতাপশালী রাজ-পুরোহিত, রাজ-গুরু, ব্রাহ্মণ্য আচার অনুষ্ঠান সম্পাদন, ধর্মকর্মের আয়োজন এই ভাষার দ্বার সম্পাদিত। সমাজের অল্প সংখ্যক উচ্চকোটির মানুষ এই ভাষায় স্বচ্ছন্দ– সুদূর অতীতেও যেমন, আধুনিক সময়েও তাই। সংস্কৃত নাটকে রাজা, ব্রাহ্মণ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবার্গ ছাড়া আর কেউ সংস্কৃত বলেন না। ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও রাষ্ট্রিক মতাদর্শ যেখানে দেখা যায়, সেখানে সংস্কৃত ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নজরে আসে I

অধ্যাপক কণাদ সিনহা – শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যাকর্তা নন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছটি প্রধান দর্শনের একটি হল বেদান্ত। এই বেদান্তের বিভিন্ন ব্যাখ্যার একটি হল অদ্বৈতবাদ। শঙ্কর এই মতের প্রবক্তা। ততদিনে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ, জৈনধর্মের মধ্যে পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। শঙ্কর সন্ন্যাসপন্থী শ্রমণীয় ধর্মগুলির, বিশেষত: বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে গার্হস্থ্যকেন্দ্রিক ব্রাহ্মণ্যধর্মকেও সন্ন্যাসকেন্দ্রিক সংগঠিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন বৌদ্ধ সংঘের আদলে সন্ন্যাসী সংঘ স্থাপন করে।

) প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চা প্রসঙ্গে আপনি ইতিহাস বনাম ইন্ডোলজি সহ ওরিয়োন্টোলজির (ইজিপ্টোলজি সুমেরোলজি ইত্যাদি) প্রসঙ্গ এনেছেন। এডওয়ার্ড সঈদের ওরিয়েন্টালিজম প্রকাশের পর এর ঔপনিবেশিক রাজনীতি উন্মোচিত হয়ে গেছে। সঈদের বইটি মূলত পশ্চিম এশিয়া, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল কেন্দ্রিক।ভারতকে কেন্দ্র করে এই ধরনের বই লেখার কাজ, উন্মোচনের কাজ কতটা হয়েছে? না হয়ে থাকলে তার কারণ কী? এই ধরনের কাজ কি আপনার কাছ থেকে আমরা পাবার দাবি রাখতে পারি না?

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – এই বিষয়ে সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। রোমিলা থাপার যে চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তার অন্যতম প্রধান প্রতিপাদ্য ভারতত্বের জগৎ থেকে সরে এসে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে প্রকট করা। এই জাতীয় প্রয়াসে অতীতের স্থানিক ও কালগত মাত্রাকে মাথায় রেখে পরম্পরা-পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে অতীতের বহুমুখী রূপকে দর্শানো ও তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। রোমিলা থাপারের Early India from the Origins to c. AD 1300 (2002) আর হেরমান কুলকে ও ভৈরবী প্রসাদ সাহু-র History of Pre-colonial India: Debates and Issues (2019) বইগুলি দেখলে এই অবস্থান স্পষ্টতর হবে।

অধ্যাপক কণাদ সিনহা – স্যারের বলা বইগুলি তো বটেই, তার পাশাপাশি রোমিলা থাপারের Past Before Us, রণজিৎ গুহর History at the Limit of World History, বিনয় লালের The History of History দেখতে পারেন।

) স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্য পঞ্চাশের দশকের প্রথমে ভারত সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। কিন্তু নানা টানাপোড়েনে সেটি সম্পূর্ণ হয়নি। রমেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের একটি বইয়ে পড়েছিলাম। আজকের বক্তারা যদি এটি সম্বন্ধে যদি কিছু আলোকপাত করেন!

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – রমেশচন্দ্র মজুমদার তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের অনুরোধে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে রাজি হননি। কারণ তাঁর অভিমত ছিল সরকারি আনুকূল্যে রচিত ইতিহাসে নানাবিধ সমস্যা ও বাধ্যবাধকতা থাকে। এই আদর্শ ও অবস্থান নিয়ে সমস্যা নেই। সমস্যা এই যে উনি কে. এম মুন্সীর আহ্ববানে সাড়া দিয়ে ভারতীয় বিদ্যা ভবনের উদ্যোগে যে এগারো খন্ডে বিশাল ভারত-ইতিহাসের সম্পাদনা করেন (স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস সমেত), তা একান্ত ভাবেই হিন্দু মানসিকতা ও আবেগের ভিত্তিভূমির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। রমেশ বাবুর নিজস্ব বক্তব্যের জন্যে ওনার স্মৃতিকথা, ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ দেখতে পারেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা আধুনিক ইতিহাসের উপর বহু উল্লেখযোগ্য কাজ আছে। অমলেশ ত্রিপাঠির The Extremist Challenge এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেস, সুমিত সরকারের Modern India, বিপন চন্দ্রের History of Modern India , শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের From Plassey to Partition এবং সুগত বসু ও আয়েষা জালাল-এর History of Modern South Asia এই বইগুলি পড়ে দেখতে পারেনI

অধ্যাপক কণাদ সিনহা – রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রত্যাখান করলেও এই গ্রন্থ লিখিত হয়। তারা চাঁদ লেখেন History of the Freedom Movement in India. মজুমদার সরকারী বয়ানে ইতিহাস লিখতে অস্বীকার করে যথার্থ পেশাদার ইতিহাসবিদের অবস্থান নিলেও তাঁর সম্পাদিত ভারতীয় বিদ্যাভবন সিরিজ বহুলাংশেই হিন্দুত্ববাদী নেতা কে. এম. মুন্সীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়। তবে এই সিরিজে তৎকালীন বহু অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদের প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়। হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের অপব্যাখ্যায় বিরক্ত হয়ে রমেশচন্দ্র এক সময় তাদের মুখপাত্রে লেখা দেওয়া বন্ধও করেন।

) একদিকে রাজা-রাজরাদের মসনদে দ্রুতলয়ে পটপরিবর্তন, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম গতিশীল self sufficient গ্রাম সমাজ, যেখানে গ্রামগুলোর একটা closed economy ছিল। বর্ণ বিভাজনের কারণে পরিবারগত ভাবে আলাদা পরিবারগুলো আলাদা আলাদা কাজ করে এসেছে। এই দুটো সমান্তরাল সমাজের ইতিহাসকে কি ভাবে একরৈখিক ইতিহাসের আওতায় আনা যাবে?

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজশক্তির পালাবদল যে গতিতে ঘটে এবং তা নিয়ে দলিল দস্তাবেজে যত তথ্য পাওয়া যায়, সেই তুলনায় সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের রদবদল একটু মন্থর। কারণ, প্রাক-আধুনিক পর্বের দলিল দস্তাবেজগুলি মূলতঃ দরবারের দ্বারা এবং শাসকীয় স্বার্থে প্রস্তুত। তাতে সমাজ-অর্থনীতির প্রসঙ্গ গৌণ, বিশেষত সাধারণ মানুষের আটপৌরে জীবন এই সব দলিলে বড়জোর পাদটীকার মতো থাকে। কিন্তু সেইসব তথ্যমুষ্টি থেকেও সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও আর্থিক ক্রিয়াকলাপের আভাস পাওয়া সম্ভব। আরও একটি কথা, প্রাক-আধুনিক ভারতের গ্রামজীবন স্বয়ংসম্পূর্ণ, স্বয়ম্ভর এবং তাই আবদ্ধ ও জড়বৎ, এই বহুপ্রচলিত ধারণাটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। প্রথমত, গ্রামীণ জীবনের দুই অপরিহার্য্য উপাদান, লোহা ও নুন, ভারতের প্রতিটি গ্রামে পাওয়া যায় না। শুধু এই দুই অত্যাবশ্যক উপাদান গ্রামে আনতে গেলে লেন-দেন করতেই হবে। হেনরি মেইন- র এই ধারণা এখন বাতিল। গ্রামগুলি সুপ্রাচীন কালেও একরকম না, আবদ্ধ না, স্বয়সম্পূর্ণ না। তাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন, মন্থর হলেও, লক্ষ্য করা যায়। আকর তথ্যসুত্রের অনুপুঙ্খসহ বিচার বিশ্লেষণ দিয়ে এই বিষয়টি অনুধাবনের জন্যে (প্রাচীন বাংলার অবস্থা সহ ) দুটি বই দেখতে পারেন : ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, রণবীর চক্রবর্তী, প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে।

অধ্যাপক কণাদ সিনহা – প্রাচীন ভারতে self sufficient গ্রামগুলির closed economy র ধারণা ঐতিহাসিক তথ্য দ্বারা সমর্থিত নয়। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের Making of Early Medieval India, রণবীর বাবুর নিজের লেখা গ্রামীণ অর্থনীতির সচলতার পরিচয় দেয়।

৮) Charles Allen-রা যেভাবে ঔপনিবেশিক আমলে নতুন তথ্য আবিষ্কারের কথা বলেন, বিশেষত অশোকের ক্ষেত্রে তাতে ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকতার ভুমিকা যেভাবে দেখা হয় তাতে কিছুপরিবর্তন হল?

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – চার্লস অ্যালেন-র বইটির নাম শুনেছি, পড়িনি। অশোক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অশোকের নিজের জারি করা শিলালেখগুলি (মূল ভাষায় ও অনুবাদের সঙ্গে) পরীক্ষা করে দেখা আবশ্যিক। অশোক নিয়ে বই লিখতে গেলে প্রাকৃত, গ্রিক, আরামীয় ভাষায় ব্যুৎপত্তি থাকা একান্ত জরুরি। অশোকের প্রাকৃত ভাষা ছাড়াও গ্রিক ও আরামীয় ভাষায় ৭টি শিলালেখ আছে, এগুলি প্রধানত আফগনিস্তানের থেকে পাওয়া। এই শিলালেখগুলি অশোকের সমকালীন। এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে পরবর্তী বৌদ্ধ সাহিত্যে (দিব্যবদান, অশোকাবদান, সিংহলি সাহিত্য-এ বিধৃত অশোক সংক্রান্ত স্মৃতি)। এর তুল্যমূল্য বিচারের দ্বারাই অশোক নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই লেখা যায়। চার্লস অ্যালেন-র বই এইভাবে লেখা কিনা বলতে পারব না, তবে তা হলে একটু অবাক-ই হব। অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে ১৯১৫ সালে মাস্কি (কর্ণাটক) থেকে অশোকের নাম সম্বলিত একটি শিলালেখ আবিষ্কারের আগে এই মৌর্য শাসক সম্বন্ধে স্পষ্ট কোন ধারণাই ছিল না। যে ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই, সেখানে এই বিস্মৃতির পিছনে কী কারণ থাকতে পারে তা ভাবনার কথা। অশোক সম্বন্ধে রোমিলা থাপারের বই সুবিদিত। তার সঙ্গে উপিন্দার সিং-র বই দ্রষ্টব্য।

অধ্যাপক কণাদ সিনহা – ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদেরা ইতিহাসের বহু উপাদান আবিষ্কার, উদ্ধার, সম্পাদনা, পাঠোদ্ধার, অনুবাদ, ও প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তার মানে এই নয় যে তাঁদের ইতিহাস-ব্যাখ্যা ঔপনিবেশিক রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল না। অশোকের লিপির পাঠোদ্ধার করেন জেমস প্রিন্সেপ। কিন্তু ঔপনিবেশিক লেখকেরা অশোককে মূলত: বৌদ্ধ অহিংসার নীতিতে প্রভাবিত এক আধ্যাত্মিকতাবাদী সম্রাট হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। রোমিলা থাপার, ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, নয়নজ্যোৎ লাহিড়ীরা অনেক পরে অশোককে এক বিশাল সাম্রাজ্যের দক্ষ প্রশাসক এবং প্রজাহীতৈষী বিচক্ষণ কুটনীতিবিদ হিসেবে দেখিয়েছেন যাঁর ধম্মনীতি আধ্যাত্মিক নীতি নয়, এক নৈতিক অনুশাসন যা বিশাল উপমহাদেশীয় সাম্রাজ্যকে একসূত্রে বাঁধার একটি উপায় ছিল। এ বিষয়ে রোমিলা থাপারের Asoka and the Decline of the Mauryas অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।

৯) ইতিহাস বলে যে সব অনৈতিহাসিক ধারণা আছে, সেগুলিকে সিস্টেমেটিক deconstruction প্রয়োজন।

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী – ইতিহাসচর্চার নানাবিধ ধারা ও পদ্ধতি আছে। সেই গুলিকে পুরোদস্তুর আয়ত্ত করে তবেই ইতিহাসের গবেষণালব্ধ বই বা প্রবন্ধ লেখা যায়। পাঁচ বা দশটি ইতিহাসের বই পড়ে আর একটি ইতিহাসের বই লিখতে গেলে হয় নিছক পুনরাবৃত্তি হয় না হলে নানা অভিমতের গোলমেলে মিশেলে জগাখিচুড়ি তৈরি হয়। ইতিহাসের গ্রন্থ-প্রবন্ধ ইতিহাস চর্চার রীতির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে লেখা ও তা যাচাই করার একটা পদ্ধতি আছে, লেখকের ব্যবহৃত আকর তথ্যসূত্রের তালিকা, ঐতিহাসিকদের মধ্যে যে বিতর্ক আছে তার সম্বন্ধে লেখকের সম্যক ধারণা ও তার উল্লেখ আছে কি না, লেখকের নিজস্ব অবস্থান কী, এবং কোন পদ্ধতিতে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন তা যাচাই করা। এইগুলি যে রচনায় থাকবে তা ইতিহাসের বই বা প্রবন্ধ বলে মান্য। না হলে তা ধোপে টিকবে না। এর জন্যে প্রথম দিন থেকে পেশাদার ঐতিহাসিক হতে হবে না, কিন্তু ইতিহাস রচনার নানারকম পদ্ধতি সম্বন্ধে , অর্থাৎ হিস্টোরিওগ্রাফি নিয়ে সম্যক দখল থাকতেই হবে। দামোদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী গণিতের বিশেষজ্ঞ, কিন্তু তিনি সংস্কৃত-র বাঘা পন্ডিত, অসামান্য বিশ্লেষণী প্রতিভার অধিকারী এবং অতীত চর্চার পদ্ধতিগুলি নিয়ে পুরোদস্তুর ওয়াকিবহাল। চিন্তা ও আশঙ্কার বিষয়, ইতিহাস চর্চার জটিলতা ও বৌদ্ধিকচর্চার সঙ্গে কিছুমাত্র তৈয়ার ছাড়াই বহু ব্যক্তি স্ব-ঘোষিত ইতিহাসবিদের তকমা লাগাচ্ছেন। এনাদের মূল কথা : এমনটা আমার বিশ্বাস বা এমনটা মনে হয়। বিশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণকে হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু ইতিহাসকে নৈব নৈব চ। যে কোন সার্থক ইতিহাসবিদ তাঁর রচনার প্রথমে জানান দেন – কেন ও কী পদ্ধতিতে, কী কী রসদের উপর নির্ভর করে তিনি তাঁর বয়ান তৈরি করেছেন। সেটি অনুধাবন করলে ইতিহাস রচনার প্রণালী সম্বন্ধে ধারণা জন্মায়। ইতিহাস জানার সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসবিদ-র মনোজগৎ ও তাঁর অনুসৃত গবেষণা-পদ্ধতিকেও বোঝা দরকার।

১০) আমার বিনম্র আবেদন, মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চায়, বিশেষতঃ সামাজিক ইতিহাসচর্চায় প্রত্নতাত্বিক গবেষণার ভূমিকা নিয়ে যদি কিছু বলেন। অষ্টাদশ শতকের agrarian history তে (যেমন রত্নলেখা রায়) জাতপাত সমস্যা ও উৎপাদন সম্পর্কের নিবিড় সম্পর্ক নিয়ে যে ইঙ্গিত করেছেন সেই সম্পর্কে কি প্রত্নতত্ব কিছু আলোকপাত করতে পারে বলে মনে হয়? প্রাক আধুনিক বাংলার জাতপাতের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা অনেকক্ষেত্রেই অসম্পূর্ণ ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল বলে মনে হয়।

অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী প্রত্ন সম্পদের মধ্যে থেকে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার কিছু পরিচয় অবশ্যই পাওয়া সম্ভব, কিন্তু থাকে থাকে সাজানো, অসাম্যের উপর আশ্রিত বর্ণ-জাতি ব্যবস্থার রেশ প্রত্ন বস্তুতে পাওয়া একান্ত দুর্লভ ও দুরূহ। মধ্যযুগের ইতিহাসচর্চায় পুরাতত্ত্বের ব্যবহার আছে বৈ কী। সেচ ব্যবস্থার জন্যে পার্সিয়ান হুইল-র প্রয়োগের পুরাতাত্ত্বিক প্রমান এবং স্লুইস গেট দিয়ে জল সরবরাহ-এর নজির মুঘল আমলে বিরাজমান। বিশেষ উল্লেখযোগ্য ফতেহপুর সিক্রি-তে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের করা উৎখনন। একই ভাবে গৌড়/লখনৌতির সুলতানি আমলের বসতি বিন্যাস উৎখনন থেকে বোঝা যাবে। এই বিষয়ে অনিরুদ্ধ রায়ের মধ্যযুগের নগরায়ণ নিয়ে বইটি উপযোগী।

মন্তব্য তালিকা - “আমাদের ইতিহাস জিজ্ঞাসা : রণবীর চক্রবর্তী ও কণাদ সিনহার উত্তর”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।