সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

হাসপাতাল থেকে “হসপিটাল ও ল্যাবরেটরি মেডিসিন” – মেডিসিনের নতুন যুগ

হাসপাতাল থেকে “হসপিটাল ও ল্যাবরেটরি মেডিসিন” – মেডিসিনের নতুন যুগ

ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য

ডিসেম্বর ২২, ২০২১ ৬১৮ 11

হাসপাতাল মানবেতিহাসের অতি প্রাচীন মানবিক সংগঠনগুলোর একটি। এবং এর ইতিহাসও অতি প্রাচীন। আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে এলিয়াস অ্যারিস্টিডিস বলছেন – “Neither belonging to a chorus nor sailing together nor having the same teacher is as great a thing as the boon and profit of being a fellow pilgrim to the temple of Asclepius and being initiated into the first of the holy rites by the fairest and most perfect torch-bearer and leader of the mysteries.” (Guenter B. Risse, Mending Bodies, Saving Souls: A History of Hospital, 1999, পৃঃ ১৫)

এসকেলেপিয়াস, আমরা বোধ করি সবাই জানি, প্রাচীন গ্রিসের মেডিসিনের পৌরাণিক দেবতা। তাঁর মন্দিরে যাবার জন্য, অবশ্যই রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে, এই আকুলতা। মন্দির, মঠ, চার্চগুলোতে আর্ত মানুষের নিরাময় করার জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকত সে আদিম কাল থেকে।

ইউরোপের উদাহরণে আবার ফিরে আসব। তার আগে ভারতের প্রথম আয়ুর্বেদ গ্রন্থ তথা শাস্ত্র বলে স্বীকৃত চরকসংহিতারও সংকলনকালের সময়কালের কিছু আগে পরে (আয়ুর্বেদের সবচেয়ে মান্য গবেষক মিউলেনবেল্ডের মতে এ সময়কাল খুব বেশি হলে ১৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে হতে পারে না, বা খুব বেশি হলে ১০০ খ্রিস্টাব্দ – মিউলেবেল্ড, A History of Indian Medical Literature, IA, পৃঃ ১১৪) বৌদ্ধযুগে কিছু হাসপাতালের হদিশ পাওয়া যায়।

কেনেথ জিস্ক তাঁর প্রামাণ্য গবেষণাগ্রন্থ Asceticism and Healing in Ancient India: Medicine in the Buddhist Monastery-তে জানাচ্ছেন – “Evidence of Buddhist hospitals or monastic structures devoted to the care and treatment of the sick is meager. Monks and nuns were usually treated in their own cells. However, a reference in the Pali canon to a “hall of the sick” (gildnasald), located at the Hall of the Peaked Gable (kutdgarasala)in the Great Forest (mahavana) near Vesali, points to a structure in the monastery compound set aside for the care of sick brethren … An inscription from Nagaijunikonda, dating from the third century c.e., suggests that a health house for the care of those suffering and recovering from fever was part of this famous Buddhist monastery.” (পৃঃ ৪৪)

চরকসংহিতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে (উপকল্পনীয়মধ্যায়) রাজতুল্য কোন ধনবান ব্যক্তি বা রাজা রাজপুরুষদের উপযুক্ত পঞ্চকর্মের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল তৈরির বেশ বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে নম্বর থেকে ১২ নম্বর শ্লোক পর্যন্ত এবার বর্ণনা দেখা যাক – “বাস্তুবিদ্যায় কুশল ব্যক্তিকে দিয়ে যাদের চিকিৎসার জন্য আগে থেকেই একটি গৃহ নির্মাণ করতে হবে গৃহটি দৃঢ় হবে এবং বায়ুরহিত (অর্থাৎ বায়ু চলাচল করবেনা) হবে কেবল একটি জায়গা খোলা থাকবে যেখান দিয়ে বাতাস ঢুকতে বা বেরোতে পারবে গৃহটি আয়তনে এরকম হবে যে ঘরের মধ্যে বিচরণে যেন কোন কষ্ট না হয় গৃহটিঅনুপত্যকহবে অর্থাৎ পাশে কোন উঁচু বাড়ি বা উঁচু পর্বতাদি থাকবেনা গৃহের মধ্যে যেন ধোঁয়া, রোদ ধুলো প্রবেশ করতে না পারে গৃহে যেন কোনভাবে অনিষ্টকর শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস গন্ধসমূহের অগম্য হয় সেখানে যেন সোপান, উদুখল, মুষল, মলত্যাগের স্থান, স্নানের জায়গা এবং রান্নাঘর থাকে

এরকম গৃহ নির্মাণ করানোর পরে সেখানে রোগীর শুশ্রূষার জন্য সুশীল, শুচি, প্রভুভক্ত, দক্ষ, দয়ালু, সর্বকর্মে পটু, অন্নব্যঞ্জন রন্ধনে নিপুণ, পাচক, স্নানকারক, হাত-পা শরীর মর্দনকারক, উত্থাপক ও সম্বেশক অর্থাৎ যে শোয়াতে ও বসাতে পটু, এবং কোন কাজেই বিরক্তি প্রকাশ করে না, এরকম পরিচারকেরা নিযুক্ত থাকবে।

চিকিৎসার স্থানে তথা হাসপাতালের এই আদিরূপে যে ধনাঢ্য ব্যক্তি বা রাজপুরুষ কিংবা রাজন্যবর্গ অবস্থিতি করছেন তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গীত, বাদ্য, স্তুতিপাঠ (এই শব্দটিকে খেয়াল করব – স্তুতিপাঠ, স্তোত্রপাঠ নয়), শ্লোক, গাথা, আখ্যায়িকা, ইতিহাস ও পুরাণে কুশলী ব্যক্তিরা এবং প্রভুর অভিপ্রায়জ্ঞ (অর্থাৎ ইঙ্গিত মাত্রি যে প্রভুর অভিপ্রায় বুঝতে পারে এরকম ভৃত্য) ব্যক্তিসকল প্রভুর অভিমত ও দেশকালজ্ঞ ব্যক্তিদের পারিষদ হিসেবে নিযুক্ত থাকবে।

এই চিকিৎসার গৃহে তথা বাসস্থানে ল্যাব (বক পাখি), কপিঞ্জল (চাতক পাখি), কৃষ্ণসার মৃগ, কালপুচ্ছ হরিণমাতৃকা হরিণ (আকারে এবং উদরের আকৃতিতে বৃহৎ হরিণ বিশেষ) ও উরভ্র অর্থাৎ ভেড়া প্রভৃতি প্রাণী থাকবে। শুধু তাই নয়, শান্ত, নীরোগ, জীববৎসা (মৃত বাছুর প্রসব করে না), দুগ্ধবতী গাভিদের রাখা হবে, এবং তাদের খাবার জন্য তৃণ, শোয়ার জন্য গৃহ ও পানের জন্য জন্য জলের আয়োজন থাকবে।

সে স্থানে আচমনপাত্র (অর্থাৎ পুজোর কাজ শুরু করার আগে জল দিয়ে বিধিমতো দেহশুদ্ধি, জলকোষ্ঠ (জলের টব), হাঁড়ী, কলসী, ঘট, কুম্ভ, শরাব, হাতা, জলপাত্র, রান্নার পাত্র, মন্থদণ্ড, বস্ত্র, সূত্র, কার্পাস, লোমের সূত্র, নিদ্রার সুখের জন্য উত্তম আস্তরণ, এবং তার ওপরে চাদর, বালিশ প্রভৃতি উপজরণ সমেত “ছাগদি লোমজ শয্যা ও আসন” থাকবে। এবং ভৃঙ্গার (গাড়ু) ও প্রতিগ্রহও (থুতু ফেলবার পাত্র) সেখানে থাকবে। সেখানে শয়ন, উপবেশন, স্নেহ, স্বেদ, অভ্যঙ্গ, প্রলেপন, পরিষেক, অনুলেপন, বমন, বিরেচন, শিরোবিরেচন, আস্থাপন, অনুবাসন এবং মলমূত্র ত্যাগ এসব কাজ সম্পাদনের জন্য যে যে সামগ্রী আরামদায়ক সেসমস্তকিছুর আয়োজন করা থাকবে।

এসব ছাড়াও ভালোভাবে ধোয়া এবং পরিষ্কার করা (সুপ্রক্ষালিত) বালিশ; মসৃণ, কর্কশ এবং মধ্যম প্রকারের শিলাসমূহ; এবং কোদাল, কুঠার ও কাটারি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রসমূহ উপকরণ হিসেবে সে জায়গায় থাকবে। থাকবে ধূমপানের নল, বস্তির (তলপেট বা মূত্রাশয়) নল ও উত্তর বস্তির আয়োজন। সেখানে কুশহস্ত (আর্দ্রদ্রব্য যাতে পচে না যায়), তুলাদণ্ড, মাপের পাত্র এবং ঘি, তেল, বসা (চর্বি), মজ্জা, মধু, মাত (ঝোলা গুড়), গুড়, লবণ, কাঠ, জল, মধুজাত মদ্য, কাঁচা ছোলা, বার্লি, তিল, মৈরেয় মেদক, দই, মণ্ড, ঘোল, ধান্যাম্ল (আউশধানের কাঁজী) এবং গোমূত্রাদির আয়োজন করে রাখা আবশ্যক।

এখানে শালিধান, ষষ্টিকধান, মুগডাল, মাষকলাই ডাল, যব, তিল, কুলত্থ (কলাই), মৃদ্বীকা (কিসমিস), ফলসা ফল, হরিতকী, আমলকী, বহেড়া (হরিতকীর মতো ফল), নানাবিধ স্নেহ (চর্বি বা ঘি) এবং স্বেদের উপযুক্ত দ্রব্যসমূহ রাখতে হবে। এছাড়া ঊর্ধ শোধন, অনুলোমন, ঊর্ধাধঃ শোধন, সংগ্রহণীয়, দীপনীয়, পাচনীয়, উপশমনীয় এবং বাতনাশক ঔষধ সমূহ সংগ্রহ করে রাখতে হবে। এসব ছাড়া যেসব দ্রব্যে ওষুধ সেবনের পরে বিপত্তি হতে পারে তার প্রতিকারের জন্য যাতে ওষুধ সেবনের পরে সুখ স্বচ্ছন্দ হয় – এসব সামগ্রীরও আয়জন করে রাখতে হবে।

রোগীর শয্যার পাশে থুথু ফেলবার পাত্র থাকবে। আর রোগীর কপাল, পার্শ্ব কিংবা নাভি বা পিঠে বেদনা হলে সেসব জায়গা মালিশ করে দেবে এরকম প্রিয় সুহৃদেরা পরিচর্যার জন্য থাকবে।

এত দীর্ঘ বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হল ইংরেজিতে চরক-সংহিতায় সেসময়ের উপযোগী proto-hospital নিয়ে আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিয়ায় অনেক আলোচনা হলেও বাংলায় আমার জানার মধ্যে কোন আলোচনা চোখে পড়েনি। অথচ হাসপাতালের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এ অংশটুকু জরুরী – আশা করা যায় সবাই বুঝবেন।

হাসপাতালের এরকম পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার পরে ১৮ থেকে ২১ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে – “রাজা কিংবা রাজতুল্য ব্যক্তি অথবা অতুল ধনসম্পদ আছে তিনিই এরকম চিকিৎসা পেতে পারেন। দরিদ্র ব্যক্তির পক্ষে পূর্বোক্ত দ্রব্য সম্ভার সংগ্রহ করা কঠিন। এজন্য সে অসুস্থ হলে তৎকালোচিত বিরেচন ওষুধ সেবন করানো হবে। সকাল মানুষেরই সমস্ত উপকরণ থাকা সম্ভব নয় এবং দরিদ্রেরও দারুণ রোগ হওয়া অসম্ভব নয়। ফলে যেরকম সম্ভব সেভাবে চিকিৎসা হবে।”

আমরা এ বিবরণ থেকে বুঝতে পারি যে হাসপাতাল বলে বিশেষ ধরনের চিকিৎসার যে স্থানটির বর্ণনা আমরা এতক্ষণ পড়লাম তার সাথে আধুনিকে হাসপাতালের কোন সাযুজ্য নেই। ধনীদের বাড়ির একটি প্রসারিত রূপ হচ্ছে এই হাসপাতাল।

বর্তমানের হাসপাতালের চেহারা কেমন তা বোঝা যাবে মেডিসিনের জগতে সবচেয়ে মান্য টেক্সটবুক “হ্যারিসিন’স টেক্সটবুক অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন” থেকে – “The hospital is an intimidating environment for most individual. Hospitalized patients find themselves surrounded by air jets, button, and glaring lights; invaded by tubes and wires; and beset by the numerous members of the health care team – nurses, nurses’ aides, physicians’ assistants, social workers, technologists, physical therapists, medical students, house officers, attending and consulting physicians, and many others. … It is little wonder that patients may lose their sense of reality.” (Harrison’s Principles of Internal Medicine, 18th edn., eds., Dan L. Longo et al, vol. I (New York, Chicago: McGraw Hill, 2012), 6)

কার্যত, কী ইউরোপে কী ভারতে বা চিনের বৌদ্ধ মঠগুলোতে দরিদ্র, অসুস্থ এবং আর্ত মানুষদের আশ্রয় দিয়ে থাকা, খাওয়া আর চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল তাকে ইংরেজিতে “alms house” বলা হত। নীচের ছবিটি থেকে আর ধরন বোঝা যাবে।

(ছবি আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত)

এরকমই কোন গৃহের বর্ণনা চরকসংহিতায় রয়েছে। এবং রয়েছে সাধারণভাবে অসুস্থ সবার চিকিৎসার জন্য নয়। রাজা, রাজপুরুষ বা ধনাঢ্য ব্যক্তির বিশেষ ধরনের চিকিৎসার জন্য। এখানে দরিদ্রদের কোন প্রবেশাধিকার ছিল না। ফলে alms house-এর দরজা যেমন সবার জন্য অবারিত ছিল, এখানে সেরকম কোন পরিস্থিতি ছিল না। এ কারণে এই হাসপাতালের সাথে প্রাচীন alms house-এর সাযুজ্য পাওয়া যাবে না।

রিসে তাঁর পূর্বোক্ত পুস্তকে বলছেন – “For almost a 1,000 years, almshouses and hospitals had been organized and run in accordance with highly successful monastic models of prayer and work.” (Risse, Mending Bodies, Saving Souls, পৃঃ ১০৭)

আমরা ভারতের আরও একটি হাসপাতালের বর্ণনা পাই একাদশ শতাব্দীর এক মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ তামিল লিপি থেকে (A.D. 1069)। তামিলনাড়ুর চিঙ্গালপেট (বর্তমান চেঙ্গালাপাট্টু) জেলার মধুরত্নকম তালুকের তিরুমুক্কুদলে ভেঙ্কটেশ পেরুমলের বিষ্ণু মন্দিরের প্রাচীরে খোদাই করা ছিল দুটি সেকশনে বিভক্ত এই বর্ণনা। মোট ৫৫ লাইনের এই লেখার প্রথম সেকশন লম্বায় ৫৫ ফিট। খোদাই করা এই লিপি মোট ৫৪০ স্কোয়ার ফিট জায়গা জুড়ে রয়েছে। (কে ভি সুব্রমনিয়া আয়ার, “The Tirumukkudal Insription of Virarajendra”, Epigraphia Indica and Record of the Archaeological Survey of India, vol. XXI, 1931-32, পৃঃ ২২০)

এই সুদীর্ঘ লিপিতে এই মন্দির কিভাবে চালানো, কার কাছ থেকে কতটা সাহায্য পাওয়া যায়, কোন কোন খাতে অর্থ ব্যয় হয় এসব সংক্রান্ত বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। এরপরে বলা আছে এই মন্দিরে বেদশিক্ষার জন্য একটি কলেজ আছে। ঋগ্বেদের শিক্ষকের জন্য বছরে ৬০ কলম (১১৫,২০০ তিলের সমান) ধান এবং ৪ কাশু মুদ্রা (প্রাচীন তামিলে ব্যবহৃত তাম্রমুদ্রা, ওজনে ১/২ গ্রাম) বরাদ্দ ছিল। কলেজের সাথে যুক্ত হোস্টেলে দৈনিক ৬০ জনকে ভোজন করানো হত। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২২)

এরপরে একটি হাসপাতাল চালানোর খরচের বর্ণনা রয়েছে। বৈদিক কলেজের হোস্টেলে যেসমস্ত ছাত্ররা থাকত তাদের চিকিৎসার জন্য তৈরি হয়েছিল এই হাসপাতাল। হাসপাতালে ১৫টি বেড ছিল। হাসপাতালের দায়িত্বে যে ফিজিশিয়ান ছিলেন তাঁর জন্য বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৯০ কলম ধান এবং ৮ কাশু মুদ্রা। একজন সার্জন ছিলেন যাঁর জন্য বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৩০ কলম ধান। সুপ্রাচীন কাল থেকে ইউরোপের মতো এখানেও ফিজিশিয়ান এবং সার্জনের মধ্যে সামাজিক মর্যাদায় পার্থক্য ছিল সেটা এই বরাদ্দ থেকে স্পষ্ট হয়। ফিজিশিয়ানদের অবস্থান সার্জন বা শল্য চিকিৎসকদের ওপরে ছিল। যে দুজন ভেষজ সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত ছিল তাদের জন্য বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৬০ কলম ধান এবং ২ কাশু মুদ্রা। এরা জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করত এবং ওষুধ তৈরির কাজও করত। ২ জন নার্স ছিল যাদের বার্ষিক বরাদ্দ ছিল ৩০ কলম ধান এবং ১ কাশু মুদ্রা। (পৃঃ ২২৩)

একজন নাপিতও ছিল যার জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫ কলম ধান। প্রামাণিকের কাজ করা ছাড়াও সম্ভবত এরা ছোটখাট অপারেশনও করত। অসুস্থদের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক বরাদ্দ ছিল ১ নালি (এর হিসেব খুঁজে বের করতে পারিনি) চাল। হাসপাতালের সারা রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার জন্য বরাদ্দ ছিল সোয়া ২ কাশু। যারা জল-বাহক ছিল তাদের বরাদ্দ ছিল ১৫ কলম ধান এবং ওষুধ সংরক্ষণ করে রাখার জন্য ৪০ কাশু বরাদ্দ ছিল। (পৃঃ ২২৪)

যেসব ওষুধ সংগ্রহে রাখা হত সেগুলো হল – (১) ব্রাহ্মায়ম-কাদুম্বুরি, (২) বাসা-হরিতকি, (৩) গোমূত্র-হরিতকি, (৪) দশমূল-হরতকি, (৫) ভল্লাতক-হরিতকি, (৬) গণ্ডীরা, (৭) বলাকেরণ্ড তৈল, (৮) পঞ্চাক তৈল, (৯) লশুনাদী-এরণ্ড-তৈল, (১০) উত্তম-করণাদি-তৈল, (১১) ষুক্লস-ঘৃত, (১২) বিলবাদি-ঘৃত, (১৩) মণ্ডূকর-বটীকা, (১৪) দ্রবত্তি, (১৫) বিমল, (১৬) সুনেত্রী, (১৭) তামাদ্রি, (১৮) বজ্রকল্প, (১৯) কল্যাণক-লবণ, এবং (২০) পুরাণ-ঘৃত। ব্রাহ্মরসায়নের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ৪৪টি উপাদান দিয়ে এই ওষুধটি তৈরি হয়। যেহেতু এই ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া ও উপাদান এবং ওষুধ হিসেবে গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি এজন্য ছাত্রদের সম্যকভাবে জানা একান্ত জরুরী। এ ওষুধে বুদ্ধিবৃত্তি শানিত হয়, অবসন্নতা দূর করে, স্মৃতিবর্ধক এবং শক্তি ও আয়ু বৃদ্ধি করে। (পৃঃ ২২৪)

উল্লেখযোগ্য হল যেসব ওষুধের কথা বলা হয়েছে সে ওষুধগুলোর একটি বৃহদংশের ব্যবহার চরকসংহিতা অথবা বাগভট রচিত অষ্টাঙ্গহৃদয়-এ পাওয়া যায়। ওষুধের লিস্টে ৮ নম্বরে যে পঞ্চাক তৈল-র কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি চরকসংহিতা-য় গুল্ম পরিচয়ের যে অধ্যায় আছে সেখানে উল্লেখিত তৈল-পঞ্চক – এই দুটি সম্ভবত একই বস্তু।

এই হাসপাতালের খরচের বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে Epigraphia Indica and Record of the Archaeological Survey of India, vol. XXI, 1931-32-র ২৪৯ থেকে ২৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে। প্রথম লাইনের ৪৩-৪৫ অংশ জুড়ে হাসপাতালের এ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে সেখানে ১৫ জন রোগী ভর্তি আছে। তাদের এবং চিকিৎসক ও অন্যান্য সাহায্যকারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট খাতে বর্ণনার বিস্তৃত বিবরণ আছে। বলা আছে, ৪০ কাশু ভেষজ উদ্ভিদ ক্রয়ের জন্য ব্যয় করা হবে।

১৩শ শতাব্দীতে রাজা বীরেশ্বর হাসপাতালের জন্য তাঁর আয়ের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় করতেন – “The third share was granted in favour of three different institutions which were a Prasūti-śālā, an Ārogya-śālā and a Vipra-satra. The reference to a Prasūti-śālā, i.e., maternity or lying-in hospital, in a record of the thirteenth century is very interesting. Ārogya-śālā is a hospital” (D. C. Sircar, Studies in the Religious Life of Ancient and Medieval India, ১৯৭১, মতিলাল বানারসি দাস, পৃঃ ১৫৯) এরপরে একই পুস্তকে বলা আছে – “The Srirangam inscription, dated Śaka 1415 (1493 A.D.), registers the gift of two veli land (old South Indian unit) made by Śrīnivāsa alias Śrīraṅgam Garuḍavāhana-bhaṭṭa who repaired and renovated the Ārogya-śālā or hospital. The hospital was constructed by one of Śrīnivāsa’s ancestors”। (পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৬২)

মুসলিম শাসনকালেও বিভিন্ন সময়ে অনেক হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। এ ধরনের হাসপাতালগুলোতে সার্জারির গুরুত্ব ছিল। (দ্রষ্টব্যঃ Fabrizio Speziale, “Introduction,” in Hospitals in Iran and India, 1500-1950s ed. Fabrizio Speziale, Leiden, Brill, 2012)

ভারতে বিভিন্ন শাসনকালে কয়েক শতাব্দী জুড়ে হাসপাতালের বিবর্তনের সম্যক চিত্র, বিবরণ ও ধারণার জন্য দেখুন – জয়ন্ত ভট্টাচার্য, “From Hospitals to Hospital Medicine: Epistemological Medical Knowledge in India”, Historia Hospitalium, Band 28, Lit Verlag, 2013, পৃঃ ৪৫-৭৪।

আমরা এতক্ষণ যে হাসপাতালগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলোর ক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়।

প্রথম, বর্তমানে আমরা হাসপাতালের যে চেহারা দেখি তার সাথে প্রাক-আধুনিক হাসপাতালের কোনরকম সাযুজ্য নেই একমাত্র রোগীর চিকিৎসা হয় রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে এটুকু ছাড়া।

দ্বিতীয়, এ হাসপাতালগুলোর সাথে ধর্মীয় অনুষঙ্গ যুক্ত হয়ে আছে – কি এখানে চরক-সংহিতায় বর্ণিত হাসপাতাল কিংবা তিরুমুক্কুদলে ভেঙ্কটেশ পেরুমলের বিষ্ণু মন্দিরের হাসপাতাল হোক না কেন। এমনকি ইউরোপের প্রাক-আধুনিক চার্চ কিংবা বৌদ্ধ মঠগুলোতে হাসপাতালের যে ঐতিহাসিক বিবরণ আমরা পাই সেক্ষেত্রেও একথা সত্যি। একজন গবেষক অল্পকথায় বলেছেন – “monasteries had a church, for example, and a hospital might be attached to a monastery, or served by clerics or communities of religious.” (Sethina Watson, On Hospitals: Welfare, Law, and Christianity in Western Europe, 400–1320, Oxford, 2020) তিনি আরও জানাচ্ছেন – “The term ‘hospital’ refers to a dizzying array of charitable facilities. They arose in the Eastern Empire in the mid-fourth century, in the early decades of Roman Christianity (and after Constantine had moved the capital of the empire east, to Constantinople/Byzantium). In fact, these facilities were a response to the challenge posed by the conversion of a state to Christianity … They had a clear typology, serving different categories of the needy: foundlings (brephotrophia), orphans (orphanotrophia), the poor (ptochotrophia), the sick (nosocomia), the traveller (xenodochia), and the elderly (gerontocomia).”

আমরা চরকসংহিতার হাসপাতালে দেখেছি কেবল রাজপুরুষ বা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা হত, এবং দক্ষিণ ভারতের বিষ্ণু মন্দিরের হাসপাতালের উপযোগিতা ছিল কেবল নিজস্ব বৈদিক কলজের ছাত্রদের জন্য। ইউরোপেও সেরকম শিশু, বৃদ্ধ, সাধারণভাবে অসুস্থ, অনাথ, দরিদ্র এবং পরিব্রাজক বা যাত্রীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতাল ছিল। আরেকটি বিষয় হল, এই ধর্ম-কেন্দ্রিক হাসপাতালগুলোতে লক্ষ্য থাকত রোগীদের শুধুমাত্র দেহের নয়, soul-এর চিকিৎসা করা।

তৃতীয়, এই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা হত রোগীর উপসর্গের কথা শুনে। অর্থাৎ এক অর্থে রোগী চিকিৎসকের চিকিৎসার দিশা নির্ধারণ করত। যেহেতু শবব্যবচ্ছেদ-নির্ভর রোগের অঙ্গস্থানিকতা তখনও বহুদূরে সেজন্য দেহের যে ধারণা ছিল তা একেবারেই দ্বিমাত্রিক ধারণা। বিভিন্ন সময়ের কয়েকটি পেইন্টিং রাখি – দেহের ধারণার রূপান্তর বুঝতে সাহায্য করবে।

মধ্যযুগের দেহের মাংসপেশি বোঝানোর চিত্র

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রক্তপরিবহণ বোঝানোর চিত্র

 মধ্যযুগে বিভিন্ন অঙ্গের ওপরে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবের চিত্র – পূর্ণত দ্বিমাত্রিক দেহের ধারণা

১৫শ শতাব্দীতে ভেসালিয়াসের শবব্যবচ্ছেদের মধ্য দিয়ে অর্জিত দেহের ত্রি-মাত্রিক ধারণা

লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ত্রি-মাত্রিক এবং সিমেট্রিকাল দেহের চিত্র

চতুর্থ, রোগীর ওপরে চিকিৎসকের কর্তৃত্ব তখনও শুরু হয়নি। এ বিষয়টিকে ঐতিহাসিক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকদের একাংশ এভাবে দেখেছেন – “from the later eighteenth century, doctors on the whole supplanted governors in the determination of hospital admissions, staff appointments, and overall policy. For the first time in history, hospital medicine was different in kind from non-hospital medicine”। (Pregrine Horden, Cultures of Healing: Medieval and After, Collected Studies, 2019, পৃঃ ৮)

পঞ্চম, হাসপাতালের চিকিৎসার সাথে মেডিক্যাল শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া কোনভাবেই যুক্ত ছিলনা। ভারতের অভিজ্ঞতায় আমরা শিক্ষাদানের এরকম ধরনকে বলব পুঁথি-নির্ভর শিক্ষা বা স্কল্যাস্টিক মেডিসিন। চিকিৎসকেরা তথা আয়ুর্বেদজ্ঞরা রোগীর দেহ স্পর্শ না করে জ্ঞানের জগতে কর্ত্রৃত্বকারী টেক্সট থেকে শ্লোক বলতেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ছাত্ররা শিখত।

এরপরের ধাপে মেডিসিনের শিক্ষার জগতে যে উত্তরণ হল তাকে গবেষকেরা বলেছেন “বেড সাইড মেডিসিন” বা রোগীর শয্যাপার্শ্বে শিক্ষাফ্রহণ। ইউরোপের ক্ষেত্রে ১৩শ শতাব্দির আগে এই নতুন ধারার চিকিৎসা ও শিক্ষাদানের সাথে মেডিসিনের জগতের পরিচয় হয়নি – “In the early Middle Ages, however, before about 1200 or so, no such system of education existed. There were no formal medical schools; aside from those monks and priests who might offer medical care, most healers were probably illiterate and had learned their trade by apprenticeship or on their own. Patients certainly could not assume that some- one calling himself a physician had the expertise of learning”। (Michael R. McVaugh, “Bedside Manners in Middle Ages”, Bulletin of the History of Medicine, Vol. 71, No. 2, pp. 201-223)

কিন্তু আরেকজন মান্য গবেষক দেখিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে আল রাজির সময় থেকে (৮৬৫-৯২৫) “Bedside events were recorded, and such progress reports were consulted as clinical management of the patient unfolded before the eyes of medical staff members and perhaps some students. Given the availability of good paper and skilled copyists and binders, some institutions possessed a separate library of medical books and manuscripts.” (Risse, Mending Bodies, Saving Souls, পৃঃ ১২৭)

রয় পোর্টার বলছেন – “it is a moot point whether bedside medicine was growing wiser or safer. The sixteenth and seventeenth centuries brought no revolution in medical services or treatments. There remained a mosaic of practitioners – learned physicians, herbalists, wise-women, astrologers, uroscopists, empirics, apothecaries, barber-surgeons and specialists like tooth-drawers and lithotomists.” (রয় পোর্টার, The Greatest Benefit to the Mankind, 1999, পৃঃ ২৩১)

প্রকৃত অর্থে ভিয়েনায় কিংবদন্তি শিক্ষক-চিকিৎসক Hermann Boerhaave (১৬৬৮-১৭৩৮)-এর হাতে বেডসাইড মেডিসিনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে – “Boerhaave emphasized the importance of the history. “Everything pertaining to the case must be listed; nor that least thing neglected which a critical Reader might rightly seek to understand the malady.” (Lester S. King and Marjorie C. Meehan, “A History of the Autopsy”, American Journal of Pathology, November 1993, পৃঃ ৫২৮)

চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষক ডগলাস গাথরি Boerhaave-এর শিক্ষাদানের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আমাদের নজরে এনেছেন – “Like Hippocrates, he placed the patient in the centre of the picture, and favoured observation rather than argument. Although only twelve beds were allotted to him, he made excellent use of this scanty material.” (Douglas Guthrie, A History of Medicine, 1945, পৃঃ ২২১)

এরপরের ধাপটি হল “হসপিটাল মেডিসিন”। আন্তর্জাতিকভাবে গবেষকেরা Erwin Ackernecht-এর উদ্ভাবিত মেডিসিনের এই পর্বান্তরকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এ নিয়ে অসংখ্য পুস্তক এবং গবেষণাপত্র রয়েছে। অল্প কথায় বললে – “Hospital medicine in Paris fostered a revolution in medical practice, which, with the concomitant creation of the clinic and the furtherance of bedside clinical teaching, had encouraged practitioners to formulate and then to test explanations of disease processes.” (E. M. Tansey, “The Physiological Tradition”, in Companion Encyclopedia of the History of Medicine, ed. W. F Bynum and Roy Porter, Vol. 1, 1993, পৃঃ ১২৭)

“হসপিটাল মেডিসিন”-এর বৈশিষ্ট্য, উদ্ভব এবং বিস্তার নিয়ে দুটি অবশ্য দ্রষ্টব্য গ্রন্থ হল – Erwin Ackernecht, Medicine at the Paris Hospital 1794-1848 এবং Caroline Hanawya ও Ann La Berge সম্পাদিত Constructing Paris Medicine। দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকে জানতে পারি “By the 1830s Paris was the from which ideas and practices were disseminated to an ever wider periphery”। (পৃঃ ১২) ইউরোপের অধিকাংশ দেশ ছাড়াও উত্তর আমেরিকা এবং উত্তর আফ্রিকা থেকে ৩০০-র বেশি ছাত্র প্যারিসে উদীয়মান নতুন মেডিসিনের পাঠ নেবার জন্য এসেছিল – “to learn and practice stethoscopic observations under him (Laennec)”। (পৃঃ ১৩)

ষষ্ঠ, নতুন পর্যায়ের মেডিসিনের উদ্ভব হবার আগে হাসপাতালগুলো কেবল নিজেদের ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর সামাজিক প্রভাব অনুভূত হয়নি। রেনেসাঁ কিংবা আরও ভালো করে বললে প্যারিসে নতুন পর্যায়ের মেডিসিনের সূচনা এবং হাসপাতালগুলোতে যে প্র্যাকটিস করা হত তার সুদূরপ্রসারী সামাজিক ফলাফল ছিল। সামাজিকভাবে হাসপাতাল চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠা ছাড়াও হাসপাতালে প্রশিক্ষিত ছাত্রের দল ছড়িয়ে পড়েছে সমাজজীবনে। নতুন মেডিসিনের বোধ সঞ্চারিত হয়েছে। শুধু তাই নয় হাসপাতালের সাথে জুড়ে গেল জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথের প্রসঙ্গ। নতুন ধরনের পাবলিক হেলথের ধারণা মানুষকে জীবনচর্যার ক্ষেত্রে নতুন বোধ আয়ত্ত করতে শেখাল। এক নতুন “medical consciousness”-এর জন্ম হল।

আধুনিক রাষ্ট্রের গভার্নেন্সের নতুন চেহারায় একটি ধরন হিসেবে আবির্ভূত হল পাবলিক হেলথ – স্বাস্থ্যের এই নতুন রূপ চরিত্রে সেক্যুলার এবং এর আধুনিকতার বিভিন্ন টেকনিকের সাহায্যে জনসমাজে দেহকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রকরণে প্রশিক্ষিত করে তুলল। স্টিফেন জেসিনার (Stephen Jacyna)-র পর্যবেক্ষণে – “An essential aspect of these activities was, moreover, to instil the population at large with an adequate understanding of the principles of governing health and sickness … Medicine thus acquired a political status inasmuch as it gained a new relevance to the interests of the state.” (Stephen Jacyna, The Western Medical Tradition 1800 to 2000, 2006, p. 82)

হাইজিন এবং স্যানিটেশনের নতুন স্ট্র্যাটেজির সাফল্য নির্ভর করছিল আচার-আচরণ-ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মানুষ কত বেশি করে আত্মীকরণ (internalization) করছে তার ওপরে। পরিণতিতে, স্কল্যাস্টিক মেডিসিনের দুনিয়ায় টেক্সটের কর্তৃত্বকারী অবস্থান (text as authority) রূপান্তরিত হয়ে মেডিসিন মানুষের জীবনের কর্তৃত্বকারী অবস্থানে চলে এল। একে গবেষক এবং চিন্তাবিদেরা “medicalization of life” বলছেন।

হসপিটাল মেডিসিনের পরের ধাপটিকে বলা হয় “ল্যাবরেটরি মেডিসিন” – “In 1848, a new medicine, “laboratory medicine,” made its appearance in Paris under the leadership of Louis Pasteur, Claude Bernard, and the Societe de Biologie.”। (Erwin Ackernecht, Medicine at the Paris Hospital 1794-1848, p. xiii)

মেডিক্যাল কলেজে “ল্যাবরেটরি মেডিসিন”-এর যুগের সর্বোত্তম সন্তানদের মধ্যে পড়েন সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী, মহেন্দ্রলাল সরকার, কানাইলাল দে, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কিংবা শম্ভুনাথ দের মতো বিজ্ঞানসাধকেরা। এমনকি ব্যাক্টেরিওলজির জনক রবার্ট কখের কলেরার জীবাণু নির্ণয়ের কাজের সাথে জড়িয়ে আছে মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরি, এবং অবশ্যই গঙ্গার জল।

ভারতের ক্ষেত্রে মেডিসিনকে ইউরোপের মতো এতগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়নি। প্রায় ২০০০ বছর ধরে আয়ুর্বেদ-শাসিত এবং নির্ধারিত “স্কল্যাস্টিক মেডিসিন”-এর পরেই ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ (বা শুধুই মেডিক্যাল কলেজ) প্রতিষ্ঠার মধ্য (১৮৩৬) দিয়ে শুরু থেকেই হসপিটাল মেডিসিন এবং পরবর্তীতে “ল্যাবরেটরি মেডিসিন”-এর চর্চা ও প্রয়োগের সূচনা হল এদেশে। ভারতের ছাত্রসমাজ এবং জনসমাজ সোশ্যাল সাইকির ক্ষেত্রে এর জন্য প্রস্তুতির কোন সময় পায়নি – ভারতের ক্ষেত্রে এ ঘটনা প্রকৃত অর্থে “এনগ্র্যাফটেড” ছিল। ফলে এক অর্থে এটা এক ধরনের সাংস্কৃতিক “শক” ছিল ভারতীয় জনতার কাছে – অন্তত এর জন্মলগ্নে।

ভারতে যে “enfrafted modernity”-র যাত্রা মোটের ওপরে ১৮৩০-এর দশক থেকে শুরু হয়ে প্রায়-আধুনিক রাষ্ট্রের জন্ম হয় সে রাষ্ট্রের জন্মের জন্য ইউরোপের মতো কয়েক শতাব্দির সামাজিক মন্থনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়নি ভারতীয় জনসমাজকে। আধুনিক রাষ্ট্রে স্ব-নির্ধারক ব্যক্তির (the emergence of the individual in history) যে অভ্যুদয় হয়েছিল ভারতে সেটা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন চেহারায় এসেছে। বরঞ্চ, এদেশের তথা এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা ও আভ্যন্তরীন পরিমণ্ডলের নতুন টেকনিক এবং পদ্ধতি আধুনিক রাষ্ট্রের উপযোগী বাধ্য, অনুগত এবং সুশীল নাগরিকের জন্ম দিয়েছে – প্রজা সত্তা খসে গেছে আত্মপরিচয় থেকে।

এই অর্থে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের আধুনিকতা নির্মাণের যে প্রোজেক্ট মেডিক্যাল কলেজ তার সহকারী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

পেশায় চিকিৎসক। হিস্টরি অফ মেডিসিনে পিএইচডি। স্বাধীন গবেষক। জনস্বাস্থ্য কর্মী।

মন্তব্য তালিকা - “হাসপাতাল থেকে “হসপিটাল ও ল্যাবরেটরি মেডিসিন” – মেডিসিনের নতুন যুগ”

  1. রোগীর সেবা থেকে রোগভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করে রোগীর সেবাতে উত্তরণের ইতিহাস চমৎকার বুঝিয়েছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. অসাধারণ সুন্দর এবং প্রামাণ্য তথ‍্যসমৃদ্ধ একটি নিবন্ধ। আমার আশ্চর্য লাগছে আপনার গবেষণার ব‍্যপ্তি দেখে।
    এপিগ্রাফিকা ইণ্ডিকার কোন খণ্ডে কোথায় একটা হাসপাতালের বিবরণী আছে সেটাও আপনার চোখ এড়ায়নি। তথ‍্য সংগ্রহ ও তাকে স্বাদু ভাষায় পরিবেশন, দুটোই শিখলাম আপনার কাছ থেকে।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।