সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

ফ্রঁসোয়া ফুহ্রে ও ফরাসি ইতিহাস রচনার গতিপ্রকৃতি

ফ্রঁসোয়া ফুহ্রে ও ফরাসি ইতিহাস রচনার গতিপ্রকৃতি

কুন্তল রায়

অক্টোবর ৩০, ২০২১ ৫৪২ 0

১৯৯৭ সালে ফ্রঁসোয়া ফুহ্রের মৃত্যুর পর তার জীবন ও লেখাপত্র নিয়ে মিশেল মোসাহ্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিলেন। সেই লেখাটিতে বাকি সব কথার বাইরেও কেবল একটি বাক্যবন্ধে ফুহ্রের সারাজীবনের প্রচেষ্টার অনেকটা ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি, ‘Leader of The Exodus of French intellectuals from Marxism’. কলিন লুকাস তার সম্বন্ধে আর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘তিনি ইতিহাসকে সংকীর্ণ বৌদ্ধিকচর্চার সীমা থেকে বৃহত্তর শিক্ষিত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন’। ফুহ্রের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল, তিনি ছিলেন প্রথাগত ইতিহাস পঠনের বাইরের শিক্ষিত মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন লেখক এবং তার লেখার ও লেখার দর্শনের মাধ্যমে তিনি ঐ শিক্ষিত পাঠকের কাছে ইতিহাসের শোধনবাদকে জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন। তার শেষ লেখা গ্রন্থ অর্থাৎ ‘The Passing of an Illusion’ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল। এই বইটির বিষয় ছিল বিংশ শতকের কমিউনিজম দর্শনের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি। তিনি হয়তো এই বইটির জন্যেই পরবর্তীকালে, বিশেষ করে ফরাসি ইতিহাসচর্চায় মার্কসবাদী দর্শন থেকে নিষ্ক্রমণ করে সবথেকে শক্তিশালী চিন্তক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।

‘The Passing of an Illusion’ গ্রন্থটিতে ফ্রান্সে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকচর্চা, তার প্রভাব ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। ফ্রান্সে একটা সময় মার্কসবাদী ইতিহাস চর্চা কেন প্রসারিত হয়েছিল তার কারণও তিনি বর্ণনা করেছেন। ফুহ্রের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত যখন নাৎসিদের পরাজিত করে, তখন ফ্রান্সের কমিউনিস্টরা এতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। একদিকে কমিউনিজমের মতাদর্শ, অন্যদিকে ফ্রান্সের তৃতীয় ও চতুর্থ রিপাবলিকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, দুর্নীতিগ্রস্ত গণতন্ত্রের চেয়ে সরকারে এই দর্শনের শাসকের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। যুদ্ধ-পরবর্তীকালের উদ্ভূত এই কমিউনিস্ট উত্থানের পরিস্থিতিকে ফুহ্রে ব্যাখ্যা করেছেন ‘রিলিজিয়ান অফ হিস্ট্রি’ বলে এবং তিনি মনে করেছেন এই ভ্রান্ত ভবিষ্যত-দৃষ্টির পথেই তরুণ কমিউনিস্টরা ভেবেছিল আগামী সময় হতে চলেছে প্রলেতারিয়েতের সহস্রাব্দ।

ফ্রঁসোয়া ফুহ্রের সাথে কমিউনিজমের সম্পর্ক বুঝতে আমাদের খুব সংক্ষেপে তার শৈশবজীবন দেখে নিতে হবে একবার। ফুহ্রের জন্ম হয় ১৯২৭ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৪৫) তার একেবারেই শৈশব তাই চারদিকের পরিস্থিতি বোঝার মত বয়স নয়। বিশ্বযুদ্ধের পরের সময় থেকে রাজনৈতিক মনন একটু একটু করে তৈরি হতে শুরু হয়। সে সময় ফ্রান্সের সংবেদনশীল মানুষ তৃতীয় রিপাবলিকের পতনে খুশি ছিলেন এবং কমিউনিজমের বিস্তারে আগ্রহী হয়েছিলেন। এই কারণে তরুণ ফুহ্রের পরিচিত সমবয়সী ও সমাজের নতুন প্রজন্মের মধ্যে কমিউনিজমের আদর্শের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। তার চারপাশের বন্ধুরা সবাই ছিলেন আর্থিকভাবে সমৃদ্ধশালী (ফুহ্রের বাবা ছিলেন ব্যাংকের ডাইরেক্টর) এবং সবাই প্যারিসেই বসবাস করতেন। ফুহ্রেও তার শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটান প্যারিসে। তার প্রায় সব বন্ধু ও পরিচিতরা সে সময়ের প্যারিসের সম্ভ্রান্ত স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তারা বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে ঊচ্চশিক্ষার সুযোগ পায় ও দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে, শিক্ষাবিদ ও চিন্তক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, এদের মধ্যে একজন ছিলেন জঁ পল সার্ত্র। একটি সাক্ষাতকারে ফুহ্রে উল্লেখ করেন যে এই নব্যচিন্তায় প্রভাবিত হয়ে এবং এই ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের মাধ্যমে তিনি এই পথে চালিত হন। এছাড়া ফুহ্রের পরিবার খুব সচেতনভাবে তার শৈশবের সময় থেকেই উগ্র ক্যাথলিক সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখেন, যাতে তার ওপর ধর্মীয় সংকীর্ণতা প্রভাব ফেলতে না পারে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। তার ধারণা ছিল ফরাসি বিপ্লবের পরের অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের অসমাপ্ত দিনগুলি আবার ফিরে আসছে এবং সমগ্র পৃথিবী ক্রমশ বামপন্থী আদর্শের পথে চলা শুরু করেছে। তিনি সেই স্রোতের একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে চেয়ে এই দলে যোগদান করেছিলেন।

তার গ্রন্থ The Passing of an Illusion এর আগে, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তার একটি বড় সাক্ষাৎকার যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফুহ্রে, আইকনোক্লাস্ট’। সেখানে তার ঐতিহাসিক সত্ত্বা ও রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে একটি ভারসাম্য আনার চেষ্টা করা হয়। এই সাক্ষাৎকারে তার ব্যক্তিগত জীবনকে এমন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে দেখানো যায় তিনি সারাজীবন একটি প্রকৃত ইতিহাস-দর্শনের সন্ধান করে চলেছিলেন এবং বারবার একেকটা পথ থেকে ফিরে আসেন। আপনারা এই সাক্ষাতকারের সালটা খেয়াল করলেই এর প্রকৃত কারণ বুঝতে পারবেন। তার এই পথ অনুসন্ধানের চিত্রটি কল্পনা করা হয়েছে একেবারে তার ছাত্রজীবনের শুরুর সময় থেকে। যৌবনের সূচনায় তাকে L’Ecole normale supérieure এ ভর্তির প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন কোর্সে পড়ানো হয়। ফ্রান্সের এই প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত নামী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে তিনি এখানকার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তারপর কিছুদিন আইন পড়ার পরিকল্পনা করলেও তা ছেড়ে শেষে ইতিহাসে ভর্তি হন। ১৯৫৪ সালে তিনি এগ্রিগেশন লাভ করেন, যা এখনকার স্নাতকের সমসাময়িক ছিল। তার লেখা ‘দ্য নাইট অফ আগস্ট ফোর’ এর মাধ্যমে তিনি এই ডিগ্রী লাভ করেন এবং তার এই কাজের গাইড ছিলেন ফ্রান্সের আঁসিয়ে রেজিম-এর উপর বিখ্যাত গবেষক অধ্যাপক আর্নেস্ট লাব্রুস।

এই গবেষণা ফুহ্রের জীবনের ইতিহাসচর্চার দ্বার উন্মোচন করে। যদিও প্রথমদিকে তিনি কেবল তার ডক্টরাল পেপারটির কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, আর তেমনকিছু লেখেননি। ১৯৬০ সালে তিনি ইতিহাসচর্চার একটি ভিন্নতর প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। একজন রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে তিনি Haute école des sciences humaines-এ যুক্ত হন। এর ফলে তাকে হয়তো ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত ইতিহাসচর্চার বলয় থেকে অনেকটা ছিটকে যেতে হয়েছিল কিন্তু যারা সে সময় ফরাসি আনল ইতিহাসধারার প্রধান স্তম্ভ ছিলেন, তাদের সান্নিধ্য লাভ করেন। এমনকি ব্রদেল নিজে ফুহ্রেকে নিয়োগ করেন এই পদে। অপর এক আনল ঐতিহাসিক আদেলিনে দোমা-এর সাথে একত্রিতভাবে তিনি তার জীবনের প্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র ‘Structures and Social Relations in Paris in the Middle of the Eighteenth Century’ প্রকাশ করেন যোগদানের ঠিক পরের বছর।

এই সময়েও তার কর্মজীবন যে খুব থিতু হয়েছিল এমন নয়। ফুহ্রে তার জীবনের প্রথম গবেষণা দিয়ে ফরাসি পাঠকের কাছে মোটেই পরিচিতি লাভ করেননি। ১৯৫৮ সালে করা কিছু গ্রন্থ সমালোচনার মাধ্যমে তিনি তখন একটু একটু করে সমাদৃত হচ্ছেন। সেই সাথে ছিল ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে সে দেশের দূরদর্শনের ‘ফ্রেঞ্চ অভজারভেটর শো’-এর ভাষ্যকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এমনকি তিনি যতটা না একজন ঐতিহাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার এই পরিচিতি তৈরির পেছনে তিনি নিজেও সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে ফ্রান্সের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা প্রচলিত ধ্যান ধারণার ওপর মৌলিক সমালোচনা শুরু করেন, বা বলা ভাল অধিকাংশেরই লক্ষ্য সেদিকেই ছিল। ফ্রঁসোয়া ফুহ্রে টানা প্রায় ছয় বছর অব-উপনিবেশের পক্ষে বা অন্যান্য বামপন্থী পদক্ষেপগুলির সমর্থনে লেখনী ধারণ করেন। তার এই প্রচেষ্টার অভিমুখ বামপন্থী ছিল হয়তো। কিন্তু তিনি খুব স্পষ্টভাবে তার ছাত্রজীবনের বামপন্থী রাজনীতি থেকে খানিকটা সরে এসেছিলেন।

ফ্রঁসোয়া ফুহ্রের এই পরিবর্তন কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন। The Passing of an Illusion-এ তিনি উল্লেখ করেছেন তার এই সরে যাওয়ার সূচনা হয় যখন ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত রাশিয়া হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট-বিরোধী আন্দোলনকে দমন করে, সেই সময়ে। তবে এই ঘটনার পরের ফ্রেঞ্চ অভজারভেটর শো-তে তার কাজগুলো দেখে মনে হয়, তখনকার অনেক পরেও বামপন্থা সম্বন্ধে তার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। এমনকি তার মার্ক্সবাদকে প্রত্যাখ্যানের চিত্রটিও খুব স্পষ্ট ছিল না। তার মৃত্যুর পরে শোকজ্ঞাপন করতে গিয়ে  Le Monde পত্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ফ্রঁসোয়া ফুহ্রের সারাজীবনের কাজ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়েছে “a long, a very long history, not so much of the Revolution, properly speaking,” তা যেন আসলে “the destiny of the revolutionary passion.” এই মূল্যায়ন প্রমাণ করে যে তার ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি প্রকৃতপক্ষে তার সাংবাদিকসত্তার একটি অতীত অভিযানের অংশ এবং এই যে বলা হয় তিনি হলেন ‘The Exodus from Marxism’ সেটাও আসলে একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার কাজকে স্বীকৃতি চেষ্টা। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, ফুহ্রে তার জীবনে মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চার বিরুদ্ধে তুমুল সমালোচক হিসেবেই সফলতা পেয়েছিলেন, মার্কসবাদ থেকে বেরিয়ে আরও উন্নততর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য জনপ্রিয় হননি। তবুও আজ পর্যন্ত একশ্রেণীর শিক্ষিত পাঠক মনে করেন তিনি মার্কসবাদের ‘রক্ষণশীলতা’ থেকে ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসকে মুক্তি দিয়েছেন! এই ‘রক্ষণশীলতা’ বলতে তারা মনে করেন মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে ফরাসি বিপ্লব সামন্ততন্ত্র থেকে বুর্জোয়া ক্ষমতা গ্রহণের একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ এবং এর মধ্যে দিয়ে আসলে বুর্জোয়ারা সামন্তপ্রথার অবলুপ্তি ঘটান – এই ব্যাখ্যাকে ফুহ্রে বাতিল করতে পেরেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, ফুহ্রের সময় ফরাসি বিপ্লবের মার্কসবাদী ব্যাখ্যা প্রকৃতই কি এতটা সরল ছিল?

ফরাসি বিপ্লবের শোধনবাদী ধারার প্রবর্তনের জন্য ফ্রঁসোয়া ফুহ্রের সাথে আলফ্রেড কোবানকেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। ইংরেজ ঐতিহাসিক কোবানকেই ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসচর্চার শোধনবাদী ধারার প্রবর্তনের জন্য বিশেষভাবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, এমনকি ইংরেজি ভাষার পাঠকরা এও মনে করেন যে বিপ্লবের শোধনবাদী ধারা ফরাসি ঐতিহাসিকদের অনেক আগে ইংরেজরাই সূচনা করেন। তবে কোবানের আগে থেকেই ফ্রঁসোয়া ফুহ্রে শোধনবাদী ধারায় লেখা শুরু করে দিয়েছিলেন। কোবানের বই The Social Interpretation of the French Revolution প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ ও ৬৬ সালে ফুহ্রে ও তার শ্যালক দেনিয়ে ঋষে একসাথে দুই খণ্ডে প্রকাশ করেন La Révolution গ্রন্থটি, এখানে শোধনধারার চরিত্র স্পষ্ট।

ফুহ্রেদের লেখা এই বইটি বিশেষভাবে নজর কেড়েছিল কারণ এখানে বিপ্লব সম্বন্ধে একটি নতুন তত্ত্ব সংযোজন করা হয়। একে ফরাসি ভাষায় dérapage (দেহ্রাপাজ়) বলে, এর আভিধানিক অর্থ হল, হঠাৎ পিছলে যাওয়া (ইতিহাসে এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘the acceleration of revolutionary intensification’)।  এই তত্ত্ব অনুযায়ী ফরাসি বিপ্লবের সূচনাকালের প্রকৃতি ছিল লিবারাল-ডেমোক্রেটিক, কিন্তু ১৭৯০ এর শুরুর দিকে যখন বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে তখনই তা স্বৈরাচারী ও সন্ত্রাসের চরিত্র গ্রহণ করে। দেহ্রাপাজ় শব্দটি আসলে প্রয়োগ করা হয় রাজনীতির ক্ষেত্রে, ফুহ্রে তার গ্রন্থে এই শব্দের মাধ্যমে যা বোঝাতে চেয়েছেন সেটা হল সামাজিক পরিব্যক্তি (Social Mutation)। তার গ্রন্থে ফুহ্রে এই পরিব্যক্তির ধারণার মাধ্যমে বিপ্লবের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন, যা কোবান তার বিখ্যাত রচনা ‘Social Interpretation of French Revolution’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন। বিপ্লবের মার্কসবাদী তত্ত্ব সম্বন্ধে যে সাধারণ ধারণা অর্থাৎ পুঁজিবাদীরা বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করার মূল চালিকাশক্তি- ফুহ্রে এই প্রচলিত ভাবনার সমালোচনা করেন।  অর্থাৎ তিনি সমসাময়িক মার্কসবাদী ব্যাখ্যাকে না নিয়ে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের নামে দাগিয়ে দেওয়া ‘বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত পুঁজিবাদের জন্মের’ সনাতনী ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে তথ্য সাজালেন। ফুহ্রে বিপ্লবের সময়ের ব্যাংকারদের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে ১৭৮৯ সাল নাগাদ নতুন যে শ্রেণীর শিল্পপতিরা ফরাসি অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তাদের আর্থিক চরিত্র অনেক উন্মুক্ত ছিল। বরং এর পরের দশকে ক্রমশ পুরোনো আঁসিয়ে রেজিমের শিল্পপতিরা আর্থিকভাবে উন্নত হয়। তারা শাসকের দুর্বলতাকে হাতিয়ার করে অধিক উপার্জন করা শুরু করে। তার এই বক্তব্য, তার ছাত্রজীবনের শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী ঐতিহাসিক ঝঁ লেফেভারের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে, কারণ তিনি বলেছিলেন – বিপ্লব শিল্পায়নের সমস্ত বাধা দূর করেছে এবং পুঁজিবাদের পথ সুগম করেছে। ফুহ্রের মতে বিপ্লবের ফলে ফরাসি কৃষি অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে যে নতুন পুঁজিবাদী অর্থনীতির আগমনের পথ তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধ ও ফরাসি জনগণের পশ্চাদমুখীনতা সেই পথ বন্ধ করে দেয়। এমনকি অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সম্পদের হিসেবেও এই প্রমাণ মেলে যে আঁসিয়া রেজিম বা পুরাতনতন্ত্র আবার ফিরে এসেছিল। 

ফুহ্রের এই গবেষণাটি (Profit movement in Nineteenth century France) দুটো কারণে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথমত, এর মধ্যে দিয়ে ফুহ্রে পূর্ববর্তী মার্কসবাদী ব্যাখ্যার দুর্বলতা ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিপ্লবের ফলে ফরাসি অর্থনীতি কতটা পুঁজিবাদের অনুকূল হয়েছিল তা খুঁটিয়ে বিচার করেন ও এই লেখা থেকেই মার্কসবাদী ব্যাখ্যার সাথে তার মতবাদ ভিন্নতর হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, মনে করা হতো ফুহ্রে বিপ্লবের অর্থনৈতিক ইতিহাসকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে অধ্যয়ন করেননি, এই গবেষণার মধ্যে সেই ধারণাকে তিনি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

১৯৭১ সাল থেকে ফুহ্রের জীবনে খুব স্পষ্ট একটা নতুন ধরনের গবেষণার ধারা শুরু হয়, যা শেষদিন পর্যন্ত ছিল। সেটি হল, ফরাসি বিপ্লবের হিস্টোরিওগ্রাফি নিয়ে চর্চা। এর কারণ হিসেবে মনে হয় ফুহ্রে ও ঋষের লেখা (La Révolution) গ্রন্থের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছিল বিপ্লবের সামাজিক ও আর্থ-সামাজিক চর্চার ক্ষেত্রগুলি থেকে। এই কারণেই ফুহ্রে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Interpreting the French Revolution (১৯৭৮) লিখেন। এই বইটি কেবল যে ফুহ্রের একাডেমিক জীবনকে উচ্চশিখরে নিয়ে গিয়েছিল তাই নয়, ইউরোপের হিস্টোরিওগ্রাফি আলোচনাতেও নতুন ধারা সংযোজন করে। ফুহ্রে যে অর্থে মার্কসবাদী ইতিহাসকে অর্থোডক্সি বলতেন, এই বইতে তিনি সেই মত কেবল জারি রাখেননি, সেই সাথে অর্থোডক্সির ধারণা দৃঢ় করার চেষ্টা করলেন। এতদিন বিপ্লবকে ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ বলার প্রতি তার আপত্তি তো ছিলই, এই গ্রন্থে সেই তত্ত্বকে ‘Metaphysical Monster’ বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন। যদিও এটা উল্লেখ করা খুব জরুরি যে এই বইটি বিপ্লবের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার ওপরে নয়। এই বইটির  প্রচেষ্টা ছিল বিপ্লব সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের ধারণা ও সাধারণ মানুষের মনোভাবের চিত্রটি তুলে ধরা। ফুহ্রে বলেছেন এতদিন মার্কসবাদী ইতিহাসচর্চায় ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ছিল বিপ্লব আসলে সামন্ততন্ত্র ও আধুনিক সময়ের মধ্যেকার একটি জলবিভাজিকা। বিপ্লবের আগের সময় মানুষের প্রাচীন চিন্তাভাবনায় নিমজ্জিত ছিল ও বিপ্লবের পরেই আধুনিকতার সূচনা হয় – এই ধারণা থেকেই ফুহ্রে ফ্রান্সের মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছেন বিপ্লব মোটেই আধুনিকতা বহন করেনি, তাই আজকের সময়ে বিপ্লবের কোনও রেশ নেই বরং বিপ্লবের মৃত্যু হয়েছে।

এখানে আমাদের একটা দিক খেয়াল রাখতে হবে, ফুহ্রে যে Interpreting the French Revolution লেখেন, সেটা ঐতিহাসিকদের কথা মাথায় রেখে নয়, বরং সাধারণ শিক্ষিত মানুষের বিপ্লব সম্বন্ধে ধারণা পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, এই বইটি শিক্ষিত পাঠকের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এর মাধ্যমে ফুহ্রে তার অনুগামী ইতিহাসবিদদের ফরাসি বিপ্লব নিয়ে পূর্ববর্তী ধারণাগুলিকে নস্যাৎ করা ও নতুন ভাবে চিন্তা করার একটি পথ তৈরি করে দেন। তিনি এই ক্ষেত্রে একটি নতুন পরিকল্পনা করেন ফরাসি ভাষায় একে ‘reculer pour mieux sauter’ (বর্তমানকে নস্যাৎ করতে অতীতে ফিরে যাওয়া) বলে।

কি ছিল এই reculer pour mieux sauter’ তত্ত্ব? তিনি বিপ্লবের মার্কসবাদী ব্যাখ্যাকে সমালোচনা করতে গিয়ে আরো অতীত থেকে একজন ইতিহাস চিন্তককে তুলে এনে তার সম্বন্ধে আলোচনা করেন। একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝালে হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার হবে। তিনি যে সমস্ত ঐতিহাসিকদের লেখাকে তুলে এনে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন তকভিল (১৮০৫ – ১৮৫৯)। ফুহ্রে তার লেখাপত্রকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু করেন।  তকভিলকে খুব সুনিপুণভাবে অর্থোডক্স ধারার বাইরে রেখেছিলেন। তকভিলের থিসিসকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে আদপে নিজের মতামত প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তকভিল বলেছিলেন বিপ্লবের আগেই ফ্রান্সে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ফুহ্রে তার এই বক্তব্যকে গ্রহণ করে এমনভাবে দেখালেন যাতে মনে হয় বিপ্লবের আগের পরিবর্তনগুলি বিপ্লবের সময়ে এসে বন্ধ হয়ে গেল, তকভিলের এমনটাই বলার উদ্দেশ্য ছিল।

ফুহ্রের ইতিহাস চর্চার পরবর্তী অংশ বেশ জটিল ও বিতর্কিত। ফরাসি বিপ্লবের হিস্টোরিওগ্রাফি নিয়ে চর্চা করেন ও ১৯৮৩ Cসালে Marx and the French Revolution গ্রন্থটি লেখেন। এর পরে তার দ্বিতীয় বৃহত্তম লেখা The Passing of an Illusion: The Idea of Communism in the Twentieth entury (১৯৯৫) নামের বইটি, তবে এই আলোচনাতে আমরা এই লেখাটি দেখব না, কারণ সেখানে নানান অভিঘাত আছে। তবে এখানে এটুকু উল্লেখের প্রয়োজন, আমরা তিনটে ঘটনার সমাপতন দেখতে পাই। একদিকে সোভিয়েতের ভাঙ্গন, অন্যদিকে ফরাসি বিপ্লবের দ্বিশত বছর উৎযাপন এবং ফ্রান্সে বিপ্লবের মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনার ক্ষেত্রে একঝাঁক দেশিয় ও বিদেশি গবেষকদের আগমন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ফ্রান্সে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থান ছিল। তবে সেই চর্চা ছিল একেবারেই একাডেমিক স্তরে। ফুহ্রে এই চর্চাতে ইতিহাসের বাইরের শিক্ষিত মানুষকে যুক্ত করেন ও বিপ্লবের প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে বেরিয়ে আসেন যা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে। প্রশ্ন মূলত এটাই, ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে পেশাদারি ইতিহাস থেকে জনপ্রিয় ইতিহাসে পরিবর্তনের দিকে এই যে ঝোঁক, এর পেছনে আন্তর্জাতিক, রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, এমনকি একদল ইতিহাসবিদদের এত তৎপরতা কেন?

তথ্যসূত্র

১. Marvin R. Cox, François Furet (1927–1997), Philip Daileard & Philip Whalen, ed., French Historians (1900-2000), Blackwell Publishing Ltd., 2010. Page 271 – 284.

২. David Robin Watson, François Furet (1927–1997), Kelly Boyd, ed., Encyclopedia of Historians and Historical Writing, Vol-I, FITZROY DEARBORN PUBLISHERS, 1999, Page- 426-427.

৩. Michael Scott Christofferson, An Antitotalitarian History of the French Revolution: François Furet’s “Penser la Révolution française” in the Intellectual Politics of the Late 1970s, French Historical Studies, Vol. 22, No. 4, Duke University Press, Page 557-611.

৪. https://www.nybooks.com/articles/1997/11/06/francois-furet-19271997/

বিশেষ কৃতজ্ঞতাঃ সৌরভ মুখার্জী

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।