![‘ফিল্ম সোসাইটি’, একটি আন্দোলনের নাম](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Cover-Photo-2.jpg)
‘ফিল্ম সোসাইটি’, একটি আন্দোলনের নাম
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষে স্থাপিত প্যারিসের সিনে ক্লাবগুলি দেশের জনসাধারণের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের শিল্পের পরিচয় করাতে চেয়েছিল। উদ্দেশ্য সফল হওয়া এই ক্লাবগুলি ফ্রান্সের সমাজজীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তারও করেছিল। এই ক্লাব থেকেই উঠে এসেছিল সমালোচক আঁন্দ্রে বাজাঁ, উঠে এসেছিল ফরাসি মাসিক চলচ্চিত্র পত্রিকা ‘Cahiers du Cinema’ ও ‘positive’। উঠে এসেছিল গদার, ক্রুফো, রোমার, রিভেত এর মত বিখ্যাত সমালোচক ও পরিচালক। এই সিনে ক্লাবগুলি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কলকাতার কিছু শিক্ষিত যুবক। তাঁরা কেউ সাংবাদিক, কেউ বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী, কেউ আর্ট ডিরেক্টর তো কেউ সাহিত্যিক ছিলেন। সাহিত্য, থিয়েটার ও অন্যান্য চারুকলার পাশে চলচ্চিত্রকে স্থান দিতে চলচ্চিত্র নিয়ে মননশীল চর্চার প্রয়োজন অনুভব করলেন। বিনোদন ও বাণিজ্যিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সুস্থ সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে এই যুবকরা ফিল্ম সোসাইটি স্থাপন করার কথা ভাবলেন। আর ভারত স্বাধীন হবার একমাস কুড়িদিন পর ১৯৪৭ সালের ৫ অক্টোবর খোদ কলকাতাতেই স্থাপন করলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-1.jpg)
সত্যজিত রায় – ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠাতা ও যুগ্ম সম্পাদক
শুধু ভালো সিনেমাও দেখার উদ্দেশ্যেই নয়, শিক্ষিত বৃহত্তর দর্শককুল গঠনের জন্য নয়, সমাজ গঠনের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করতে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি স্থাপিত হয়েছিল। রজার ম্যানভেলের একটি লেখাতে ফিল্ম সোসাইটি সম্পর্কে জেনে পূর্ণেন্দু নারায়ণ বন্ধু মনোজেন্দু মজুমদার ও চিদানন্দ দাশগুপ্তকে জানান এবং লেখাটি দেখান। তারা চিদানন্দ দাশগুপ্তের বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের কাছে প্রস্তাব দিলে তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে সোসাইটি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। সেই সময় সত্যজিৎ রায় ছিলেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি. জে. কিমারের প্রধান ভিজ্যুয়ালাইজার আর চিদানন্দ দাশগুপ্ত ছিলেন ঐ কোম্পানির একাউন্টস একজিকিউটিভ। তাঁদের শুভ উদ্যোগে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি স্থাপিত হলে সোসাইটির যুগ্ম সম্পাদক হলেন সত্যজিৎ রায় ও চিদানন্দ দাশগুপ্ত। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন পূর্ণেন্দু রায়, যিনি হলেন লাইব্রেরিয়ান আর কোষাধ্যক্ষ হলেন মনোজেন্দু মজুমদার। সোসাইটির উদ্বোধন হয়েছিল রাসবিহারী এভিনিউয়ের কাছে সত্যজিৎ রায়ের মাতুলালয়ে ১৬ m.m. প্রজেক্টর ভাড়া করে ‘দ্য গ্রেট ওয়াল্টেজ’ ছবির প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের কয়েকজন, চারজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও তাদের কয়েকজন বন্ধুস্থানীয় যুবক। সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যিক হিরণ সান্যাল, রাধামোহন ভট্টাচার্য্য, বংশীচন্দ্র গুপ্ত, রাম হালদার, গণনাট্য সংঘের চারুপ্রসাদ ঘোষ, মাধব দে প্রমুখ। পরে যোগ দিয়েছিলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। এটিই ছিল ভারতীয়দের দ্বারা স্থাপিত প্রথম ফিল্ম সোসাইটি। এর আগে অবশ্য বোম্বেতে ১৯৩৯ সালে ‘আমেচার ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ এবং ১৯৪৩ সালে ‘বোম্বে ফিল্ম সোসাইটি’ নামে দুটি ফিল্ম সোসাইটি তৈরি হলেও তা ছিল মূলত ব্রিটিশদের দ্বারা স্থাপিত এবং সেখানে বেশিরভাগ সদস্য ছিল সাহেব। তবে ১৯৩৫-৩৬ সালের দিকে জনৈক ভারতীয় কবিতা সরকার উত্তর ভারতের কোনো এক শহরে শিল্পসম্মত ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন ‘To Devolopomant Inteligent Interest in Cinema’এর উদ্দেশ্যে। তবে একে সেও অর্থে সিনেক্লাব বলা যায় না কারণ সেটি উচ্চবিত্তের একটি ক্লাব ছিল এবং সেখানে শিল্পসম্মত হলেও কমার্শিয়াল ছবি দেখান হত। অনেকে এই প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করে বলেছেন, এটি ভালো ছবি দেখার জন্য ভারতীয়দের প্রথম গোষ্ঠীবদ্ধ প্রচেষ্টা ছিল। তবে ভারতীয়দের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রথম ফিল্ম সোসাইটির সূচনার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনেরও সূচনা হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠাতা সত্যজিৎ রায় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি সম্পর্কে বলেছেন,
“In thes year of Indipendence, We formed the first film club in Calcutta thereby shacking ourselves Willingly to the task of disseminating film culture even amongst the inteligentia”
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-2.jpg)
চিদানন্দ দাশগুপ্ত – ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও যুগ্ম সম্পাদক
অর্থাৎ চলচ্চিত্র যে ভদ্র, শিক্ষিত সমাজের চর্চার বিষয় হতে পারে তা প্রথম দেখাল ক্যালকাটা ফিল্ম ক্লাব তার কর্মসূচীর মাধ্যমে। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক চিদানন্দ দাশগুপ্ত ‘চলচ্চিত্র সমীক্ষা’য় তাঁর ‘চলচ্চিত্র আন্দোলনঃ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি’ প্রবন্ধে বলেছেন,
“আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে শিল্প আর সামাজিক শক্তি হিসাবে চলচ্চিত্র সম্পর্কে লোককে সচেতন করে তোলা এবং তার মধ্য দিয়ে উন্নততর চলচ্চিত্র সৃষ্টিকে সাহায্য করা। সিনেমা যে বাগানবাড়ির ব্যাপার নয়, নুনের ব্যবসার মত আর একটি ব্যবসা নয় আজকের দিনে সবচেয়ে ব্যাপক এবং সমাজজীবনে রীতিমত প্রভাবশালী একটি শিল্প, কাজেই শিক্ষিত লোকের চরচারযোগ্য- এটা জোর গলায় প্রচার এবং প্রমাণ করা ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম কাজ”।
যদিও কাজটা খুব সহজ ছিল না। সেই সময় শিক্ষিত নাগরিককে বোঝাতে সময় লেগেছে। প্রথমদিকে এই সোসাইটির কর্মসূচী ছিল দেশ বিদেশের ভালো ছবি দেখান এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে রাখা। এছাড়া সোসাইটির পক্ষ থেকেও বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশিত হত। সেখানে ক্লাবের সদস্যরা চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখতেন তাদের বিভিন্ন মতামত। প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে কর্মসূচীর প্রাবল্য দেখা যায়। দেশ বিদেশের শিল্পগুণ সম্পন্ন বিখ্যাত ছবি দেখানোর পাশাপাশি দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করা, আলোচনা সভার আয়োজন করা ছিল তাদের কর্মসূচীর মধ্যে। প্রকাশিত হত চলচিত্র, মুভি মন্তাজ, চিত্রভাষ, চিত্রবীক্ষণ, চিত্রপট, প্রসঙ্গ চলচ্চিত্র, প্রতিবিম্বর মত পত্রিকা। পরবর্তীতে তাদের সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন মেটাল বক্স,শ ওয়ালেস, ইম্পেরিয়াল টোব্যাকোর মত কোম্পানির প্রধান, যাঁরা ব্রিটিশ হলেও স্বাধীনতার পরে ভারতে থেকে গিয়েছিলেন। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা প্রথমদিকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের লাইব্রেরি থেকে যেমন ছবি সংগ্রহ করতেন, তেমনি সঙ্গীত নাটক আকাডেমিকে চলচ্চিত্র আমদানি করতে অনুরোধও করতেন। বিদেশের দূতাবাস থেকে মূল্যবান ছবি সংগ্রহ করাও প্রথমদিকে তাঁদের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল। ব্রিটিশ কাউন্সিল ও আমেরিকান তথ্যকেন্দ্র থেকে ছবি সংগ্রহ করত সোসাইটি। পরে সত্যজিৎ রায় ভিজুয়াল আর্টের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি শিখতে কোম্পানির হয়ে ছয় মাসের জন্য ইংল্যান্ডে গেলে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটে যান। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির সম্পর্কে জানিয়ে ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ ছবিটি নিয়ে আসেন, যে ছবির জন্য তাকে শুল্ক দফতরের ঝামেলাতেও পড়তে হয়েছিল। প্রতিবেশী ও বাড়ির মালিকের ধমক খেয়ে চলতে লাগল সোসাইটির কাজ। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্ক ভালো থাকায় সেখানকার পুরোধা মারি সিটন ১৯৫৬ সালে কলকাতায় আসেন তাঁদের সোসাইটিকে উজ্জীবিত করতে। ধর্মতলায় নিবাসী রাশিয়ানরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন। তারা ভালো রাশিয়ান ছবি সরবরাহ করতেন, তাদের সঙ্গে সোসাইটির সদস্যদের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। সোসাইটি থেকে যেমন সব থেকে বেশি অভারতীয় ও অ-হলিউডিয় ছবি প্রদর্শিত হয়েছে তেমন তাঁদের আয়োজিত সভায় এসেছেন জঁ রেনোয়া, মারি সিটন, জেমস কুইন -এর মত বিখ্যাত চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকেরা। লাইট এন্ড সাউন্ড, মান্থলি ফিল্ম বুলেটিন, ফিল্ম কোয়াটার্লি, ফিল্ম পলস্কি, সোভিয়েত ফিল্ম, মুভি মন্তাজ, ইন্ডিয়ান ফিল্ম কালচার ইত্যাদি পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক থাকার কারণে পূর্ণেন্দু নারায়ণের দায়িত্বে থাকা লাইব্রেরি ভরে উঠেছিল। ১৯৬৪ সালের মধ্যে সোসাইটির সংগ্রহে প্রায় ৩০০টি বই ছিল যার সংখ্যা শেষ পর্যন্ত ২৫০০ এ দাঁড়িয়েছে। তত্কালীন সোসাইটির অন্যতম সদস্য রাম হালদার জানাচ্ছেন, তাঁকে মেম্বার করা হয়েছিল চাঁদার পরিবর্তে কিছু ভালো বই সংগ্রহ করে দেবার দায়িত্ব দিয়ে। রাম হালদার তাঁর ‘কথকতা কমলালয় ও প্রসঙ্গ ফিল্ম সোসাইটি’ নামক বইয়ে জানাচ্ছেন,
“ছুটির দিন বা কোনো হরতালের দিন আমি ও চিদানন্দ সাইকেল চেপে বালিগঞ্জ পাড়ায় পরিচিত লোকজনদের কাছে গিয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করতুম, ফিল্ম সোসাইটি কী ও তার কী উদ্দেশ্য”।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-3.jpg)
ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির ক্যাশিয়ার মনোজেন্দু মজুমদার
এই সময় ক্লাবে সদস্য পদ লাভের জন্য প্রবেশমূল্য ৫টাকা, সদস্য পদের জন্য ৩টাকা এবং অতিথি মূল্য ১টাকা দিতে হত। কোষাধ্যক্ষ মনোজেন্দু মজুমদারের দায়িত্ব ছিল অর্থ সংগ্রহ করে রাখা, যদিও অনেক সময় বকেয়া টাকা আদায় করা মুশকিল হত তাঁর পক্ষে। সত্যজিৎ রায় ক্লাবে সদস্য হবার যোগ্যতা নিয়ে খুব কঠোর নিয়ম করায় প্রথম দিকে সদস্য সংখ্যা কম ছিল কিন্তু পরে কাঠিন্যে কিছুটা শিথিলতা এনেছিলেন, যার ফলে ১৯৬০ সালে সদস্য সংখ্যা পৌঁছায় চারশোতে, যেখানে প্রথম তিন বছরে সদস্য হয়েছিল পঁচিশজন। সোসাইটির পক্ষ থেকে ১৯৪৮ সালে ‘চলচ্চিত্র’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, যদিও কিছুদিনের মধ্যেই পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় । তবে পরে ‘চিত্রপট’ নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু হয়। ফিল্ম সোসাইটি থেকে প্রকাশিত পত্রিকা থেকেই তাঁদের কর্মসূচী ও উদ্দেশ্য প্রকাশিত হয়। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকার মধ্য দিয়ে তারা প্রচার ও প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃ্ত্য, ভাস্কর্যের মতই চলচ্চিত্রও একটি শিল্প। সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে ‘চলচ্চিত্র’ পত্রিকায় চিদানন্দ দাশগুপ্ত বলেছেন,
“আমরা চলচ্চিত্রকে সুনীতিবোধ ও প্রেক্ষাগৃহকে পাঠশালায় পরিণত করার পক্ষপাতী”।
পাঁচের দশকেই কলকাতার বাইরে আরো কিছু ফিল্ম সোসাইটি গড়ে উঠেছিল। ১৯৫৯ সালে দিল্লি ফিল্ম সোসাইটি, মাদ্রাজ সোসাইটি, পাটনা ফিল্ম সোসাইটি, বোম্বে ফিল্ম সোসাইটি, রুরকি ফিল্ম সোসাইটি সম্মিলিত হয়ে ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া গড়ে ওঠে। সত্যজিৎ রায় ছিলেন এর সভাপতি এবং যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন শ্রীমতী বিজয়া মুলে ও চিদানন্দ দাশগুপ্ত। ভারতের বুকে চলচ্চিত্র আন্দোলন আর একটি ধাপ এগোল। ষাটের দশকে কলকাতার বুকে আরো কতগুলি ফিল্ম সোসাইটি স্থাপিত হবার মধ্য দিয়ে প্রসারিত হল চলচ্চিত্র আন্দোলন। নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি, সিনে সেন্ট্রাল অফ ক্যালকাটা, ক্যালকাটা সিনে ইন্সটিটিউট, সিনে সারকেল ইত্যাদি। এই সময় এই সমস্ত শহরের ফিল্ম সোসাইটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মফস্বলেও ফিল্ম সোসাইটি স্থাপিত হয়েছিল, নৈহাটি ফিল্ম সোসাইটি তার মধ্যে অন্যতম। পরে অবশ্য মফস্বলের আরো অন্যান্য জায়গায় ফিল্ম সোসাইটি গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে বহরমপুর ফিল্ম সোসাইটি, মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটি, শিলিগুড়ি ফিল্ম সোসাইটি, বালি সিনে গিল্ড প্রভৃতির নাম করা যেতে পারে। ফিল্ম সোসাইটির মেম্বার হবার কঠোরতা অনেকটাই কমেছিল এই সময়, তবে তার আগেই রাম হালদার মতপার্থক্যের কারণে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি ছেড়ে বেরিয়ে এসে ‘সিনে ক্লাব অফ ক্যালকাটা’ নামে অন্য একটি সোসাইটি তৈরি করেন। যদিও তাঁদের উদ্দেশ্য একই ছিল।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-4.jpg)
ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির মেম্বারদের সঙ্গে মৃণাল সেন
প্রথমদিকে ভালো ছবি দেখা, পত্রিকায় লেখা ও দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা পড়ে আলোচনা করা ছিল সোসাইটির কর্মসূচীর অন্তর্গত কিন্তু পরের দিকে এই কর্মসূচীর পরিবর্তন হয়েছিল। ষাট ও সত্তরের দশকে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রায় কর্মসূচী এগোতে শুরু করল। এই পর্যায়ে তাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয় হল চলচ্চিত্রে রাজনীতির প্রভাব কতটা রয়েছে তা বিচার করা অর্থাৎ নান্দনিকতার আলোচনা ছেড়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার নিরিখে চলচ্চিত্রকে বিচার করা শুরু হল। যে সমস্ত ছবিতে তত্কালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা প্রতিফলিত হয়েছে সেই সমস্ত ছবি দেখানোর প্রবণতা দেখা দিল। অর্থাৎ ফিল্ম সোসাইটি এবারে ‘ভালোছবি’র সংজ্ঞা বদলে ফেলল। প্রথম দশ বারো বছর যেমন উন্নত আঙ্গিক, উন্নত শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ছবিকে ভালো ছবি বলা হত, পরে ষাট-সত্তরের দশকে ছবির মূল বক্তব্যের রাজনৈতিক সারমর্মের উপর ছবির মূল্যায়ন করা শুরু করল।
দ্বিতীয় পর্যায়ের কর্মসূচীতে সত্তরের দশকে কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি ইউরোপের ছবি দেখাত, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের ছবি। অনেকে সদস্য হতে আসতেন পূর্ব ইউরোপের ছবি দেখার জন্যই। পোল্যান্ড, জার্মানি, চেকোশ্লভাকিয়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, ইতালির ছবি দেখান হত নিয়মিত। সেই সঙ্গে পত্রিকা প্রকাশ করেছে যেখানে দেশ বিদেশের বিখ্যাত পরিচালকদের যেমন গদার, ক্রুফো, রেনে, বার্গম্যান, আন্তনিওনি, পন্টিকোরভো, গ্লবের রোশা, সোলানাস প্রমুখের ছবির সমালোচনা, তাঁদের লেখা চলচ্চিত্র সম্পর্কিত প্রবন্ধের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেই সব পত্রিকায়। ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকায় জেমস মোনাকো’র প্রবন্ধের অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল একটি ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকা চিত্রবীক্ষণের বিশেষ একটি সংখ্যা যেখানে পোলিশ ফিল্ম সোসাইটির ইতিহাস, পোলিশ ফিল্ম সোসাইটি কীভাবে চলচ্চিত্রকে প্রভাবিত করেছে তার উপর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় চলচ্চিত্রের খবরাখবর, ছবির সমালোচনা, এবং পরিচালকদের পরিচালিত ছবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা গঠনমূলকভাবে সমালোচনা করা হত এখানে।
সত্তরের দশকের সারা বিশ্বের ফিল্ম সোসাইটিগুলি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চর্চা শুরু করেছিল যার প্রভাব ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের ফিল্ম সোসাইটিগুলোতেও পড়েছিল। এই সময় পরিচালক, সমালোচক ও চলচ্চিত্র কর্মীরা চলচ্চিত্র চর্চার সঙ্গে সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি অংশ নিত। সেই সমাজ ও রাজনীতিতে চলচ্চিত্রের ভূমিকা নিয়ে নতুন মতামত তৈরি হয়েছিল, উঠে এসেছিল চলচ্চিত্রের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও। যে আইজেনস্টাইন, পদুভকিনের ছবি দেখে এক সময় নান্দনিকতার দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করা হত, সেই আইজেনস্টাইন, পদুভকিনের ছবিকে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার বলে মনে করা হল। সত্তরের দশকে ফিল্ম সোসাইটিগুলিকে আইজেনস্টাইন ও পদুভকিনের ছবির শিল্পগুণের চেয়ে রাজনৈতিকপ্রকল্প বেশি করে প্রভাবিত করেছিল। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল শহর থেকে মফস্বলে। অর্থাৎ আর শুধুমাত্র শহরের শিক্ষিত মানুষ নয়, বৃহত্তর সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ফিল্ম সোসাইটির আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু হল। সেখানে পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন আলোচনা সভার রিপোর্ট, শর্টফিল্ম তৈরির রিপোর্ট থাকত, আর থাকত ফিল্ম সোসাইটিগুলির পত্রিকা পড়ার আবেদন। এর ফলে ফিল্ম সোসাইটিগুলি একে অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি চিত্রবীক্ষণ পত্রিকার প্রাপ্তিস্থানের নাম হিসবে মফস্বলের ফিল্ম সোসাইটির অফিসগুলির ঠিকানাও দেওয়া ছিল। ফিল্ম সোসাইটগুলির ঐক্যবদ্ধতা বেশ নজরকাড়ে। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিল সোসাইটির সেমিনারগুলি, যেখানে সকল ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা মিলিত হতে পারত। সিনেক্লাব অফ ক্যালকাটা সমাজ সচেতনতার জন্যও বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক কর্মসূচী পালন করেছিল। তারা মফস্বলের বিভিন্ন ফিল্ম ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিল যে চলচ্চিত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তারা প্রজেক্টর নিয়ে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে ছবি দেখাত। তাদের নির্বাচিত ছবির মধ্যে ছিল গৌতম ঘোষের ‘হাংরি অটম’, উত্পলেন্দু চক্রবর্তীর ‘মুক্তি’, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঢাকি’ প্রভৃতি। ফিল্ম সোসাইটিগুলি ফিল্ম প্রযোজনা করত না ঠিকই, কিন্তু ব্যতিক্রমী ছিল ক্যালকাটা সিনে ক্লাব, ‘উইমেন্স সিটিজেন’ নামে তারা একটি ছবি তৈরি করছিল বলে জানা যায়। সিনে ক্লাবের কর্মসূচীর মধ্যে যেমন ছিল ছবি নির্মাণ, তেমন ছিল দর্শকের কাছ থেকে ফিল্ম সোসাইটি নিয়ে সমীক্ষা গ্রহণ।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-5.jpg)
সিনে ক্লাবের সেমিনার
ধীরে ধীরে সোসাইটিগুলি ফিল্ম ইন্ডাসট্রির আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েছিল। এক সময় ‘বেঙ্গল মোশন পিকচার্স এমপ্লয়িজ ইউনিয়নে’র প্রায় আট হাজার সিনেমাকর্মী সম্পাদক হরিপদ চ্যাটার্জীর আহ্বানে আন্দোলন ও ধর্মঘটে সামিল হয়েছিল। ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রায় তিনমাস চলেছিল অনশন ও ধর্মঘট। যদিও প্রত্যেকটি ফিল্ম সোসাইটির মুখবন্ধ প্রকাশিত হত তবু নর্থ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির মাসিক পত্রিকা ‘চিত্রভাষ’ ও সিনে সেন্ট্রাল অফ ক্যালকাটার পত্রিকা ‘চিত্রবীক্ষণ’ এই দুটি পত্রিকাতেই সিনেমাহলের কর্মীদের দাবিকে ন্যায় ও যুক্তিসম্মত বলে সহমত দান করেছিল। যে দাবি আদায়ের জন্য কর্মীরা ধর্মঘট করেছিল তা হল-
ক) শ্রমিকদের সাহায্যের জন্য সরকারি অনুদান পঁচিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে।
খ) প্রগতিশীল বাংলা ছবির জন্য আরও পঁচিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে।
গ) সরকারি উদ্যোগে সিনেমা হল তৈরি করতে হবে।
-এই দাবিগুলো ফিল্ম সোসাইটি দায়িত্ব নিয়ে পত্রিকার মাধ্যমে শুধু প্রকাশই করেনি এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েও পড়েছিল। তাদের উদ্যোগে ‘চলচ্চিত্র প্রদর্শন আবশ্যিক হোক’ নামে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই আলোচনায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক সুভাষ মুখোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সকলের দাবি ছিল সরকার যেন দ্রুত অনশনরত কর্মচারীদের সমস্যা সমাধান করতে পদক্ষেপ নেয়।
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-6.jpg)
চিত্রবীক্ষণ পত্রিকা
আরো একটি সংগঠন ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্রশিল্প সংরক্ষণ সমিতি’ নামে চলচ্চিত্র শিল্পী, পরিবেশক, কর্মচারী-কলাকুশলীদের। এই সংগঠন বেশ কিছু দাবি নিয়ে আন্দোলনে এগিয়ে এল। তাদের দাবিকে পত্রিকা চিত্রবীক্ষণের মাধ্যমে প্রচার ও সমর্থন করে বলা হল-
ক) জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে আবশ্যিকভাবে বাংলা ছবির প্রদর্শনের জন্য আইন করতে হবে।
খ) সরকারি সাহায্যে নতুন সিনেমা হল নির্মাণ করতে হবে।
গ) প্রদর্শন কর উন্নয়ন কর এ পরিণত করতে হবে।
ঘ) সেই সঙ্গে তারা এও দাবি তোলে যে পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্র উপদেষ্টা কমিটি গড়ে তুলতে হবে।
এভাবে আন্দোলন আরো একধাপ এগিয়ে যায়। শুধু পত্রিকার মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানো নয়, ‘ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ অফ ইন্ডিয়া’ একটি সম্মেলনের ডাকও দিয়েছিল সেই সময়। কলকাতার তথ্যকেন্দ্র আয়োজিত এই সম্মেলনের বিষয় ছিল ‘চলচ্চিত্রের সংকট’। সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বেঙ্গল মোশন পিকচার্স এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সম্পাদক হরিপদ চ্যাটার্জী, পরিচালক মৃ্ণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, অজিত লাহিড়ী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজা মুখোপাধ্যায়। এই সম্মেলনের প্রস্তাবনাতেই ধর্মঘটকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের দাবিগুলিকে সমর্থন করা হয়েছিল। এই সম্মেলন সম্পর্কে ১৯৬৮ সালের চিত্রবীক্ষণ পত্রিকার নবম সংখ্যায় লেখা হল,
“এই সম্মেলন ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের আসন্ন পরিবর্তন ও সমাজ সচেতন মনোভাবের এক নতুন দিকচিহ্ন সূচিত করেছে। ধর্মঘটী সিনেমা কর্মচারীদের এই ঐতিহাসিক সংগ্রামকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন সমাজ সচেতনতার এক নব ঐতিহাসিক অধ্যায়কে সমাপ্ত করলেন। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন বৃহত্তর গণ আন্দোলন- এই আদর্শের পতাকা তুলে ধরে যে যাত্রা আজ শুরু হল, আশা রাখি যে এ যাত্রা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে”।
পরবর্তীতে সরকারেও পদক্ষেপ সম্পর্কেও খবর প্রকাশিত হতে থাকে, প্রকাশিত হয়, “সরকার রাজ্যের চলচ্চিত্রশিল্পের প্রতি কোন জোর দিচ্ছেন না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই রাজ্যের দরিদ্র কলাকুশলীরা।“
একটি দাবি পত্রিকার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল, তা হল, “আমরা ভালো ছবি দেখতে চাই। হলিউডের অপরাধ, রোমাঞ্চ, যৌনসর্বস্ব ছবির একচেটিয়া বাজার ভাঙ্গার জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম আমরা দাবি করি। পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি, কিউবা, ফ্রান্স, মেক্সিকো, জাপান ইত্যাদি সমস্ত দেশের ছবি ভারতে কেন দেখান হবে না?”
পত্রিকার এই বক্তব্য থেকেই প্রমাণ হয় যে ফিল্ম সোসাইটি কেবলমাত্র ভালো ছবি দেখা ও তা নিয়ে চর্চাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁরা তাঁদের কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিল এবং তাদের সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়েছিল। আবার মেট্রো সিনেমাহলের জাতীয়করণের পক্ষে আওয়াজ তুলেছিল ফিল্ম সোসাইটিগুলি। পরে মেট্রো সিনেমাহলের জাতীয়করণ হলে তাকে শুধু স্বাগত জানাইনি সেই সঙ্গে মেট্রো সিনেমাহলের পরবর্তীকালের সমস্যা ও তার সমাধানের জন্যও সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করেছিল।
১৯৭১ সালে চিত্রবীক্ষণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকে সার্বিকভাবে জাতীয়করণেরও দাবি তুলেছিল ফিল্ম সোসাইটি। এই দাবির পক্ষে পূর্ব ইউরোপের চলচ্চিত্র উন্নয়নের কথা তুলে ধরা হয়। দাবি জোড়াল ও যুক্তিযুক্ত করতে পোলিশ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রে ভাইদার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের একটি সাক্ষাতকারও প্রকাশ করা হয়, যেখানে উঠে আসে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের উত্তর, আশার কথা তিনি জানালেন চলচ্চিত্র জাতীয়করণের পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পীর স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব।
সত্তরের দশকের দেশ জড়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়েছিল শিল্পীরাও। সর্বজন বিদিত যে নাটক ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনেও কড়া বিধি নিষেধ শুরু হয়েছিল। উৎপল দত্তের নাটক ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করতে বাধা দেওয়ায় নিরুপায় হয়ে কার্জন পার্কে অভিনয় চালাত কয়েকটি দল, ‘সিল্যুয়েট’, ‘শ্রীবিদুষক’, ‘নটসেনা’রা। ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবসে কার্জন পার্কে অভিনয় চলার সময় পুলিশের আক্রমণে বন্ধ হয়ে যায় নাটক, আর স্তব্ধ হয়ে যায় কবি নাট্যপ্রেমী প্রবীর দত্তের জীবন। ফিল্ম সোসাইটির বেশির ভাগ সদস্য যেহেতু গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল সেহেতু এই নাট্য আন্দোলনের সঙ্গেও সোসাইটির অন্তরের যোগ ছিল। প্রবীর দত্তের মৃত্যু কাঁদিয়েছিল ফিল্ম সোসাইটির সকল সদস্যকে। প্রবীর দত্ত হত্যার প্রতিবাদ সভা করা হয়েছিল সেই কার্জন পার্কেই। উত্পল দত্ত, মৃণাল সেন ও অন্যান্য নাট্যব্যক্তিত্ব ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা উপস্থিত থেকে প্রতিবাদ করেছিলেন। তত্কালীন নাট্যকর্মী ও চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে নাট্যকর্মী দেবাশিস চক্রবর্তী জানিয়েছেন-
“সেই সময় থিয়েটারকর্মীদের মধ্যে, অন্য সাংস্কৃতিককর্মীদের মধ্যে অসম্ভব ভাব ভালোবাসা, একটা বন্ধুত্ব ছিল। কে প্রসেনিয়াম করছে, কে মাঠে করছে, কে যাত্রা করছে, কে ফিল্ম করছে- ও নিয়ে কোন বাধা নেই। আমরা সকলে কর্মী, সকলের মধ্যে একটা ভালোবাসা ছিল”।
শুধু সভা করে নয়, জোরালো প্রতিবাদ করে ফিল্ম সোসাইটির পত্রিকায় লেখা হল-
“কলকাতায় কার্জন পার্কে অভিনয় চলার সময় প্রবীর দত্ত পুলিশের আক্রমণে নিহত হয়েছে। উৎপল দত্ত’র দুঃস্বপ্নের নগরী নাটকের অভিনয় জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয়, মফস্বলের থিয়েটারের ওপরে এই ধরনের আক্রমণ চালান হয়েছে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা হরণের গভীর চক্রান্ত, গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক অধিকারের ওপরে এই হামলার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ জানাই।”
![](https://www.itihasadda.in/wp-content/uploads/2022/01/Photo-7.jpg)
কার্জন পার্কে নাট্যকর্মীদের উপর পুলিশের শাসানি
সিনে ক্লাব অফ ক্যালকাটা সমাজ সচেতনতার জন্যও বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক কর্মসূচী পালন করেছিল। তারা মফস্বলের বিভিন্ন ফিল্ম ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিল যে চলচ্চিত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তারা প্রজেক্টর নিয়ে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে ছবি দেখাত। তাদের নির্বাচিত ছবির মধ্যে ছিল গৌতম ঘোষের ‘হাংরি অটম’, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘মুক্তি’, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঢাকি’ প্রভৃতি। সিনে ক্লাবের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ছবি নির্মাণ ও দর্শকের কাছ থেকে ফিল্ম সোসাইটি নিয়ে সমীক্ষাগ্রহণ। এর ফল স্বরূপ ক্যালকাটা সিনে ক্লাব ‘উইমেন্স সিটিজেন’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করে।
এমন উজ্জীবিত ফিল্ম সোসাইটিগুলো পরবর্তীতে ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যায়। কিছুক্ষেত্রে ফিল্ম ডিভিশন সমাজের কাছে প্রয়োজন হারায়, এর মূল কারণ হল ভিডিও ও দূরদর্শনের আগমন ও জনপ্রিয়তা। তাদের কর্মসূচীও কমতে শুরু করে। তবে আটের দশকে সুপার এইট ফিল্ম আন্দোলনের সময় আবার ফিল্ম সোসাইটিগুলি জেগে ওঠে। যে সমস্ত চলচ্চিত্র পরিচালকরা চলচ্চিত্রকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সাংস্কৃতিক হাতিয়ার মনে করতেন তারা শুরু করলেন সুপার এইট আন্দোলন। সুপার এইট চলচ্চিত্রের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল সৌমেন গুহর ‘সাইলেন্ট ক্যালকাটা’, নীলাঞ্জন দত্তর ‘হিরসিমা দিবস, মৈনাক বিশ্বাসের নকশালবাড়ি আন্দোলনের স্মৃতি নিয়ে তৈরি ছবি ‘গ্রাফিত্তি’, দেবাশিস মৈত্রের সাঁওতাল বিদ্রোহের ওপর তোলা ছবি ‘হুল’ প্রভৃতি।
নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতা সৌমেন গুহর বোনের ওপর পুলিশের অত্যাচারের ঘটনা জড়িয়ে আছে এই সুপার এইট আন্দোলনের সঙ্গে। সৌমেন গুহ তাঁর বোনের চিকিত্সা করাতে গিয়েছিলেন ডেনমার্কে। অবশ্য তাঁর বোনের চিকিত্সার খরচ দিয়েছিল আমেনিষ্ট ইন্টারন্যাশন্যাল। এই ডেনমার্কে গিয়েই সৌমেন গুহ প্রথম সুপার এইট ছবি সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি ক্যামেরার সুপার এইট প্রকৌশল দিয়ে বোনের ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠা ক্যামেরাবন্দি করেন। পরে দেশে ফিরে এই সুপার এইট প্রকৌশল সম্পর্কে প্রচার শুরু করেন। ছাত্রদের ফিল্ম সোসাইটি ততদিনে সংগঠিত হয়ে গেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফেডারেশন স্বীকৃত ছাত্রদের প্রথম ফিল্ম সোসাইটি ‘চলচ্চিত্র সংসদ’ এবং ‘চিত্রচেতনা’ নামে একটি সংগঠন এই আন্দোলনে সামিল হলে তা প্রসারিত হয় দ্রুত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপার এইট ছবির যেমন উৎসব হয়েছিল তেমন ফিল্ম সোসাইটিগুলোতে এই ছবিগুলি প্রদর্শিত হয়েছিল। ছবিগুলির সঙ্গে কিছু অডিও ভিসুয়াল স্লাইড যেমন সরকারি সন্ত্রাস, বোবাযুদ্ধ, অশান্ত আসাম প্রদর্শিত হয়েছিল।
একদা সমাজে প্রভাববিস্তারকারী ফিল্ম সোসাইটিগুলো নব্বইয়ের দশক থেকেই কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল। নব্বইয়ের দশকে পূর্ব ইউরোপ বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ায় বিরাট রাজনৈতিক পরিবর্তন এলে ভালো ছবি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফিল্ম সোসাইটিগুলি ছবি দেখাতে পারছিল না। এই সময় বহু সিনে ক্লাব উঠে গিয়েছিল। রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন সেখানকার ফিল্ম সোসাইটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল যার প্রভাব পড়েছিল ভারতে তথা বাঙলায়। পরবর্তীতে সত্যজিৎ রায় সহ ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতাদের অনেকের মৃত্যু ও অনুপস্থিতি ফিল্ম সোসাইটিকে আরো কর্মহীন করে তুলেছিল। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের বাঙ্গালির জীবনযাপনেও এল বিপুল পরিবর্তন। পাঁচের দশকের আর্থ-সামাজিক পরিবেশও আর নেই। সোশাল মিডিয়ার দাপটে বর্তমানে ফিল্ম সোসাইটিগুলো প্রায় জীর্ণ বৃ্দ্ধের মত মৃত্যুমুখী। মফস্বলে কিছু ফিল্ম সোসাইটি তাঁদের কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাঁদের আগের মত জনপ্রিয়তা ও কর্মতত্পরতা নেই। বিখ্যাত চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ফিল্ম সোসাইটির অস্তিত্ব সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে বলেছেন,
“ফিল্ম সোসাইটিগুলি (বিশেষকরে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির মত) চলচ্চিত্রকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করার চেয়ে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করার কর্মসূচী গ্রহণ করলে এই আন্দোলন বেঁচে থাকত বহুদিন”।
শমিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ স্মরণ করে আরো বলা যায়, সিনে ক্লাবগুলি কখনোই সাধারণ মানুষের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি সামিল হয়নি। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় আরো বলেছেন, “ফিল্ম সোসাইটিগুলির সদস্যদের আন্দোলনের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব, সংগঠনের আদর্শগত দায়িত্বে দীক্ষিত করার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করলেন না। ফিল্ম সোসাইটিগুলির যে রাজনৈতিক মাত্রা তা হারিয়ে গেল। সদস্য সংখ্যা বাড়ল, কিন্তু ঐ সদস্যরা আন্দোলনের শরিক হল না। তাঁর ভাষায়, “সংস্কার আচ্ছন্ন এক সমাজের নিষেধের চাপে অসুস্থ কৌতূহলের ব্যাধিতে রুগ্ন মানুষ” সিনে ক্লাবের বিতির্কিত ছবি দেখার লোভে এলেন”।
অনেকের মতে, তখন ফিল্ম সোসাইটির বেশিরভাগ সদস্য নাট্যকর্মী থাকার ফলে নাট্যকর্মীদের নাট্য আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়েছিল এই সোসাইটি। মূলত তাদের আন্দোলন ছিল ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন, চলচ্চিত্র আন্দোলন ছিল না। আবার কেউ বলেছেন, ফিল্ম সোসাইটি উচ্চবিত্তের সংগঠন তাই তাঁরা তাঁদের আভিজাত্য বজায় রাখতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেনি। একথা বলা যায় কোনো একটি কারণ ফিল্ম সোসাইটির অস্তিত্ব সংকটের জন্য দায়ী নয়। দেশে কয়েক দশকের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, দূরদর্শন ও ভিডিওর আগমন ও জনপ্রিয়তা, বিকল্প সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অনুপস্থিতি, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট এসব কিছুই ফিল্ম ডিভিশনগুলির অস্তিত্ব সংকটের জন্য দায়ী। তবে কালের প্রয়োজনে সমাজ সচেতন গোষ্ঠীর প্রয়াসে যে সোসাইটি, যে আন্দোলন এক সময় খুব বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল তা আবার কালের নিয়মেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। হয়ত কালের প্রয়োজনেই আবার কোনো সমাজ সচেতন গোষ্ঠীর প্রয়াসে নতুন ভাবনায় নতুন মাধ্যমের সহায়তায় নতুন কোনও আন্দোলন শুরু হবে। আর সেইদিন ইতিহাস হয়ে ফিল্ম সোসাইটি তাদের অনুপ্রেরণা দেবে। জীবনের প্রয়োজনে চলবে আন্দোলনের পরম্পরা।
তথ্যসূত্র-
১) For the love of cinema- the story behind the Calcutta film Society—shubha dash Mollick, Silhouette Magazine…. 2nd may 2016.
২) বিশে জুলায়ের কথকতা… প্রবীর দত্তকে মনে রেখে…- দেবাশিস চক্রবর্তী, সহমন।- ১৯ জুলাই, ২০২০
৩) তথ্যচিত্রে ও কথকতা- ঋত্বিক সিনে সোসাইটি
৪) চলচ্চিত্র আর মননের সেতু, রোচনা মজুমদার, আনন্দ বাজার পত্রিকা।
৫) কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন, মৈত্রী দাস, সংবর্তক
৬) ফিল্ম সোসাইটি, পার্থ প্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবর্তক
৭) সিনেমার ইতিহাস, অমিয় সান্যাল
৮) বাংলা চলচ্চিত্রের কথা ও কাহিনি, সম্পাদক ঋতব্রত ভট্টাচার্য
৯) বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের ইতিহাস, কালীশ মুখোপাধ্যায়
আমার বাবা ছিলেন খুব involved এই মুভমেন্টে, নৈহাটি সিনে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। পড়ে ভাল লাগল
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ । আপনাকে পেয়ে খুশি হলাম । আমার সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগ করবেন প্লিজ।
আসলে ফিল্ম সোসাইটিগুলো আমজনতাকে টানতে পারেনি, কেননা সেখানে যাঁরা সদস্য হতেন তাঁরা সকলেই সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষ, এই প্রায় শিক্ষাহীন দেশের বৃহত্তর মানুষদের মধ্যে ঐ উচ্চতর মানুষ সম্পর্কে একটা ফল্গুর মতো বিরাগ এবং অপ্রীতি বহমান ছিল (এখনো আছে), ফলে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরও ঔৎসুক্য ক্রমশ স্তিমিত হয়ে গেল (সরাসরি এই চর্চায় যাঁরা থাকতে চাইলেন তাঁরা বাদে) – নতুন কেউ এলো না।
এটা একটা এলিট প্রাকটিসের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে শেষ হয়ে গেল।
কোচবিহার ফিল্ম সোসাইটির অবস্থাও সেই একইরকম অবস্থায়। যেখানে বৃহত্তর সাধারণ মানুষের আগ্রহ তৈরি করা যায় না, শিল্পবোধে আগ্রহি করা গেল না – তা যে মুখ থুবড়ে পড়বে সেটাই তো স্বাভাবিক।
নমস্কার নেবেন। লেখাটি ভালো লাগলো বলেই এতটুকু লিখলাম।
আপনার মন্তব্য আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। ধন্যবাদ নেবেন।
আইনি এবং বেয়াইনি পথে ডিভিডি, পরে সিডি এবং তারপরে ইন্টারনেট এ ভালো ছবুর সহজলভ্যতাও হয়ত এই সমবেত চর্চার উৎসাহ হ্রাস পাবার একটি কারণ। আমার মনে আছে নৈহাটী কিম্বা বালি গিয়ে সিনেমা দেখছি কেননা আর কোনো উপায় ছিল না। আমার ছেলেদের কাছে অনেক বিকল্প আছে।
অনেকগুলো কারণের মধ্যে এগুলিও অন্যতম কারণ