মুঘল ভারতের খোজা বৃত্তান্ত
আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরিতে লিখছেন, গোটা হিন্দোস্তান সমেত দেশ-বিদেশের দাস বাজার কিংবা আমির ওমরাহদের হারেমের জন্য সন্দলি বা আলতসি, বাদামি আর কাফুরি নামের তিন শ্রেণির খোজা’র যোগান আসত সুবা বাংলা থেকে। সন্দলি খোজাদের গোটা পুরুষাঙ্গ কাটা থাকত, বাদামি খোজাদের লিঙ্গ থাকত অর্ধকর্তিত আর কাফুরিদের অণ্ডকোষ দুটি কেটে বাদ বা অকেজো করে দেওয়া থাকত। দৈহিক বিকৃতি বাদে গায়ের রঙ দিয়েও সন্দলি, বাদামি আর কাফুরি খোজারা পরিচিত হতেন। সন্দলি আর বাদামি অর্থে ফর্সা আর মাঝারি গায়ের রঙের সুদর্শন খোজা আর কাফুরি বা কর্পূরের সাদা রং দিয়ে কালো খোজাদের বোঝানো হতো। গাত্রবর্ণ, শারীরিক গঠন, আর্থসামাজিক অবস্থান আর খোজার আদত মুলুকের ওপরও নির্ভর করত একজন বালক বা পুরুষের জন্য উপরোক্ত তিন ধরনের মধ্যে কোন খোজাকরণ পদ্ধতিটি নেওয়া হবে!
সুলতানি বা মুঘল ভারতীয় উপমহাদেশে ‘খোজা’ নামে কারা বা কেন পরিচিত হতেন তা নিশ্চিত এই নিবন্ধের সমস্ত পাঠক জানেন। কিভাবে তাদের খোজা করা হতো, সে বিষয়েও পাঠকের খানিক ধারণা আছে। তাঁরা জানেন যে জন্মাবধি উভলিঙ্গ না হলেও জোর করে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে লিঙ্গ কর্তন করার প্রচলন ছিল প্রাচীন ভারতে। প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের নানা লেখাতে প্রান্তিক এই মানুষদের কথা উঠে এসেছে বারবার। তবে বর্তমান নিবন্ধটি যেহেতু মুঘল আমলের খোজাদের নিয়ে লিখিত, তাই শুরুতে আমরা আইন-ই-আকবরির মুঘল আমলের অব্যবহিত আগের সুলতানি সময়কালের খোজাদের জীবনের দিকেও একবার সংক্ষেপে ফিরে তাকাব!
সুলতানি ভারতে খোজা ব্যবসা ও খোজাকরণ
পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপের পাশাপাশি গোটা হিন্দোস্তানেও মধ্যযুগ জুড়ে চলা দাস কেনাবেচার বাজারগুলোতে যুবতী নারীদের পর সবচেয়ে লাভজনক পণ্য ছিলেন খোজারা। পুরুষাঙ্গবর্জিত, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যৌন সংসর্গে অক্ষম অথচ শারীরিকভাবে শক্তসমর্থ খোজা বা কমনীয় শরীরের নারীসুলভ ব্যক্তিত্বের খোজা; উভয় গোত্রকেই অভিজাত সংসারের জেনানামহল পাহারা দেওয়া, সাংসারিক বিভিন্ন শ্রমসাধ্য কাজকর্ম করা আর ক্রেতা পুরুষদের যৌনসুখ দেওয়ার জন্য বিক্রি করা হতো নানা রকম দামে।
মার্কোপোলো, ইবন বতুতা, টোমে পিরেস, দুয়াৰ্তে বারবোসা, আব্দুর রাজ্জাক-এর মতো পর্যটকরা লিখছেন, ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতকে বাংলা আর মালাবার অঞ্চল ছিল আন্তর্জাতিক খোজা ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। বাংলা’র ক্ষেত্রে পূবপ্রান্তের সিলেট আর ঘোড়াঘাট অঞ্চলে মূলত মুসলমান ‘খোজাগর’ বণিকদের হাত ধরে চলত এই ব্যবসা। এঁরা স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে গরিব হতদরিদ্র পরিবারের কিংবা অনাথ ‘হিদেন’ শিশু/ বালকদের কিনিয়ে বা অপহরণ করিয়ে আনাতেন। এই শিশু/ বালকদের অতি অল্প সংখ্যকই জন্ম থেকে উভলিঙ্গ হতো। এরপর ‘হিন্দু বৈদ্য’ জাতির শল্য চিকিৎসকদের হাতে এদের খোজাকরণ করানো হতো। খোজাকরণ-এর পরবর্তী শারীরিক জটিলতায় এদের এক বড়ো অংশের মৃত্যু হলেও যারা বেঁচে থাকত তারা সুস্থ হয়ে ওঠার পর ‘খোজা ক্রীতদাস’ হিসেবে দাস ব্যবসায়ীদের ক্যারাভানের ধুলোয় ধুলোয় ছড়িয়ে পড়ত রাজধানী দিল্লি থেকে পারস্য, মিশর কিংবা আরও পশ্চিমে ইউরোপের দাস বাজারে। বাংলায় খোজা দাস যে ‘খুবই সস্তা আর সুলভ’ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইবন বতুতার লেখা থেকে। তবে সুলতান বা প্রশাসনিক শাসনকর্তার প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যের প্রকাশ হিসেবে বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষের নিজেকে খোজা করে দেওয়ার ব্যতিক্রমী ঘটনার উল্লেখও সুলতানি আর মুঘল – দুই আমলেই পাওয়া যায়।
খোজাকরণের পর এই ক্রীতদাসদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হতো। কমনীয় স্বভাবের খোজাদের রাখা হতো নতুন ‘মেয়েলি’ নামও। যেমন, লুলু বা মুক্তো, ফিরুজি বা নীলকান্তমণি, আলমাস বা হিরে, করণফিল বা লবঙ্গ, ইয়াকুত বা কার্নেলিয়ন, ফুল ইত্যাদি। পাশাপাশি সন্দলি, কাফুরি, বাদামি নামগুলিও প্রচলিত ছিল বেশ। পুরুষালি খোজাদের দেওয়া হতো ইসলামী পুরুষ নাম। এদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষেত্রে সফল হতেন তারা নিজেদের অভিজাত হিসেবে পরিচায়িত করার জন্য ‘মালিক’ শব্দটিকে নামের আগায় জুড়ে নিতেন। খোজাদের সাংসারিক নানা কাজে, যুদ্ধবিদ্যায়, প্রশাসনিক কাজে বা অভিজাত পরিবারের প্রাসাদ, অন্দরমহল কিংবা বাগানের পাহারাদার হিসেবে প্রশিক্ষিত ও বহাল করা হতো। তবে যৌন সম্পর্কে অক্ষম হলেও জন্মসূত্রে পুরুষ হওয়ার কারণে এই মানুষগুলি সাধারণত খাস মহিলামহলে প্রবেশের অধিকার পেতেন না। শেখ রিজকুল্লা মুস্তাকি রচিত মুঘল উত্তর-পূর্ব ভারতীয় সমাজ-জীবনের অনবদ্য সূত্র ওয়াকিয়াত-ই-মুস্তাকি জানাচ্ছে; সেকালে অভিজাতদের হারেম আর বাইরের মহলকে পৃথক করত কয়েকটি দরজা। বাইরের দরজায় পাহারায় থাকতেন একজন পুরুষ ‘হাজিব’ পাহারাদার, মধ্যে থাকতেন পুরুষ ‘পর্দাদার’ এবং হারেমের ঠিক বাইরের দরজায় পাহারা দিতেন বিশ্বাসভাজন প্রধান খোজা বা ‘খোজাসারা’। এই দরজার উল্টোদিকে হারেমের দোরগোড়ায় থাকতেন বৃদ্ধা কোনো ‘খবরি’, যিনি হারেম ও বাইরের মহলের মধ্যে খবর আদানপ্রদান করতেন। বলাই বাহুল্য আদতে ক্রীতদাস এই খোজাদের জীবনকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতেন এঁদের ক্রেতা অভিজাত পুরুষরা। তবে শেখ রিজকুল্লা বাদে সুলতানি আমলের বাকি সরকারি ঐতিহাসিকরা কিন্তু খোজাদের বিষয়ে পুরোপুরি নীরব! ইসলামে খোজাকরণ যেহেতু ঘোষিতভাবে একটি ধর্মবিরুদ্ধ কাজ; তাই হয়ত তাঁরা রাজকীয় ঘটনাপঞ্জির লেখক হিসেবে জিয়াউদ্দিন বরণীর মতো ঐতিহাসিকরা এক্ষেত্রে চুপ থাকাকে সমীচীন বলে মনে করেছেন। সুলতানিকালের খোজাদের কথা জানার জন্য তাই ভারতে আগত বিদেশি পর্যটকদের লেখা তথ্যের ওপরই পরবর্তী সময়ের গবেষকদের মূলত নির্ভর করতে হয়েছে।
সুলতানি আমলের ভারতীয় খোজা এবং আফ্রিকান ‘হাবসি’ খোজা
বাংলায় অভিজাত পরিবারগুলোতে শখ করে বড়ো সংখ্যক খোজাকর্মী রাখা, খোজাদের যৌনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার আগ্রহ, খোজার খোঁজে প্রতিবেশী অঞ্চলের আমির ওমরাহদের বাংলার দাসবাজারগুলোতে নিয়মিত টহল দেওয়া আর শিশু/ বালকদের জোর করে খোজা বানানোর নানা কথা উঠে এসেছে সুলতানি আমলে ভারতভ্রমণ করা বিদেশি পর্যটকদের লেখায়। তাঁদের লেখায় এসেছে যুদ্ধবন্দি আর অপরাধীদের শাস্তি হিসেবে খোজা করে দেওয়ার উল্লেখও, যেমন মার্কোপোলো লিখেছেন ‘এ দেশে প্রচুর খোজা বাস করে। জেলবন্দি সমস্ত পুরুষকে খোজা করা হয়েছে…’।
ত্রয়োদশ শতকে ‘খোজা নজর’ প্রথা বা বকেয়া রাজস্বের পরিবর্তে সুলতানদের বাংলা থেকে খোজা পাঠানোর ব্যবস্থার প্রচলিত থাকলেও সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে এটির বাড়বাড়ন্তের কথা জানা যায়, সমকালীন পর্যটকদের লেখা থেকে। মালাবারি খোজাদের উপঢৌকন হিসেবে পারস্য সম্রাটকে দেওয়া হতো বলে জানিয়েছেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যে ভ্রমণকারী আব্দুর রজ্জাক, তবে বাঙালি বা মালাবারি খোজা বাদে দেশের দাস বাজারগুলোতে বিক্রি হতেন মূলত আবিসিনিয়া থেকে আগত ‘হাবসি খোজা’ নামে পরিচিত বিপুল সংখ্যক আফ্রিকান খোজাও। নামের শুরুতে মালিক, সিদি বদর, আন্দিল, হাবসি ইত্যাদি শব্দ জুড়ে ভারতীয় খোজাদের থেকে আলাদা করে পরিচায়িত করার চল ছিল এঁদের মধ্যে। তবে উভয় ধরনের খোজাই দিল্লি হোক বা প্রাদেশিক প্রশাসন; সুলতানি যুগের রাজনৈতিক বৃত্তে বারবার উঠে এসেছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে। এক্ষেত্রে সুলতান বলবনের মন্ত্রী ইমাদউদ্দিন রাইহান, সুলতান আলাউদ্দিন খলজির ক্রীতদাস সেনাপতি মালিক কাফুর বা কাফুর হাজারদিনারি, কুতুবউদ্দিন মুবারক খিলজির প্রিয় খোজা খুসরো শাহের নাম যেমন সর্বজনবিদিত, তেমনই জৌনপুরের শার্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হাবসি খোজা মালিক সারওয়ারের কথাও ভোলার নয়। ব্যক্তিগত দক্ষতা আর প্রভু সুলতানদের মন জুগিয়ে চলার পুরস্কার হিসেবে এধরনের খোজাদের প্রশাসনের উচ্চপদে বহাল করার একের পর এক উদাহরণ পাওয়া যায় সুলতানি যুগ জুড়ে।
সুলতানি আমলে খোজা ব্যবসার প্রধানকেন্দ্র হিসেবে বাংলা সামনে আসতে শুরু হয়েছিল ১৩৩৮ নাগাদ সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের সময় থেকে। সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহ, শামসুদ্দিন য়ুসুফ শাহ এবং জালালুদ্দিন ফতেহ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় আর হাবসি খোজাদের রমরমা ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। এই ক্রীতদাসরা অভিজাত পরিবারগুলির খিদমতে তো বটেই প্রদেশের প্রশাসন আর রাজনীতিতেও সক্রিয় অংশ নিতে শুরু করেছিলেন। প্রশাসনে আসা হাবসি খোজারা ব্যাপক পরিমাণে সম্পদ আর ক্ষমতা সংহত করে বাংলার রাজনীতিতে নিজেদের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে আক্ষরিক অর্থেই এই খোজারা বাংলার রাজনীতির ‘কিং মেকার’-এ পরিণত হয়েছিলেন। বারবক শাহজাদা, মালিক আন্দিল, সিদি বদর প্রমুখ উচ্চাকাঙ্ক্ষী হাবসি নেতারা যে ন্যায়সঙ্গত শাসকদের সরিয়ে বড়ো বড়ো নাম আর উপাধি জুড়ে সুলতান হিসেবে বাংলার মসনদে নিজেদের বসান আর বাংলাময় তৈরি করেন তীব্র অরাজকতা; সেই ইতিহাস বহুচর্চিত! শেষ পর্যন্ত নিজের উজির সৈয়দ হুসেনের গোষ্ঠী দ্বারা সিদি বদর নিহত হওয়া তথা বাকি খোজাদের চূড়ান্তভাবে দমিত হওয়ার পর বাংলার রাজনীতিতে হাবসি প্রাধান্য বন্ধ হয়। তবে বাংলার গ্রামজীবনে জমিদার হিসেবে ছড়ি ঘোরানো হাবসি খোজাদের ত্রাস যে এরপরেও বজায় ছিল, সে কথা উল্লেখ করেছিলেন পর্যটক টোমে পিরেজ।
মুঘল আমলের খোজা বৃত্তান্তে বাবর ও হুমায়ুন পর্ব
মুঘল ভারতের হারেমের পাহারায়, রাজকীয় সভায় এবং সর্বোপরি জনসমাজে খোজা গোলামদের বিবর্তনকে জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে কেবল সে আমলের লিখিত উপাদানই নয়, সমকালীন শিল্পীদের আঁকা মিনিয়েচার চিত্রেরও বড়োসড়ো গুরুত্ব রয়েছে। মুঘল ছবিতে উপস্থিত বাকি পুরুষদের থেকে খোজাদের আমরা শুরু থেকেই আলাদা করতে পারি তাঁদের শ্মশ্রুগুম্ফহীন মুখ থেকে।
বাবর ও তাঁর বড়ো দিদি খানজাদা বেগমের দেখা হওয়ার দৃশ্য
বাবরনামা’য় বাবরের ভারত আগমনের শুরুর দিককার ছবিগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছিল মুঘল নারী-পুরুষের মধ্যে খোলামেলা মেলামেশা আর নারীদের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন জীবনের মধ্য এশিয় ঐতিহ্য। ফলত এসময় হারেমের পাহারাদার হিসেবে খোজাদের ব্যবহার তেমন দেখা যায় না। বাবর নিজেও তাঁর আত্মজীবনীতে কোনো খোজা গুলামের কথা উল্লেখ করেননি। তবে বাবরের কন্যা গুলবদন বেগম তাঁর রচিত হুমায়ুননামা’য় এবং বাদশাহ হুমায়ুনের বদনাধারক জৌহর আফতাবচি তাঁর তাজকিরাত-উল-ওয়াকিয়ত গ্রন্থে বাবরের খোজা ভৃত্য অম্বর নাজিরের (নাজির শব্দটি আকবরের আমলে উচ্চপদস্থ খোজাদের উপাধি হিসেবে ব্যবহৃত হতো) বিষয়ে লিখেছেন। এই অম্বর নাজিরকে কখনও হুমায়ুনের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি পরিদর্শনে, কখনওবা হারেমে সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী হামিদা বানু’র সন্নিকটে তাঁদের ব্যক্তিগত সহায়ক রূপে দেখা যায়। এদিকে আবার আকবরের ধাত্রী মা মহম অনাঘা’র সদলবলে কাবুল থেকে দিল্লি যাত্রার সময় রক্ষী হিসেবে কোনও অম্বর নাজির বা অন্য কোনো খোজার উল্লেখ নেই। যা থেকে বোঝা যায়, প্রথম দুই সম্রাটের সময় মুঘল বাদশাহী রোজনামচায় খোজাদের বিক্ষিপ্ত অস্তিত্ব ছিল। বাবর ও হুমায়ুন বাদে তাঁদের আত্মীয়দের সূত্রেও আমরা খোজাদের উল্লেখ পাই; যেমন, তাজকিরাত-উল-ওয়াকিয়াত জানায় শের শাহের বিরুদ্ধে হুমায়ুনকে সাহায্য করার বদলে তাঁর ভাই আসকারি উপহার হিসেবে খোজা, হাতি আর বহুমূল্য মণিরত্ন চাইছেন বা ১৫৪৬-এ মির্জা হায়দার দুঘলত-এর তারিখ-ই-রশিদি অনুযায়ী বাবরের ভাইপো আবু বকরের দরবারে উপস্থিত রয়েছেন ‘গুলাম-ই-আখতা’ নামক খোজারা।
আকবর পর্ব
অনেকটা সুলতানি আমলের রাজকীয় ঘটনাপঞ্জি লেখকদের মতোই সরকারি ঐতিহাসিক আবুল ফজল আকবরের রাজত্বের দ্বিতীয়বর্ষে কাবুল থেকে রাজমাতা মরিয়ম মকানি হিসেবে হামিদা বানু বেগমের সদলবলে আগ্রায় আগমনের বর্ণনায় অম্বর নাজিরকে নিয়ে নীরব ছিলেন। তবে তা সত্ত্বেও বাদশাহ আকবরের সময় থেকে মুঘল হারেমে বা রাজসভায় নিয়মিতভাবে যে খোজাদের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল, তা বোঝা যায় আকবরের রাজত্বকালের শুরুর দিকে অঙ্কিত একের পর এক ছবিতে হারেম সংলগ্ন এলাকায় প্রহরাদণ্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দাঁড়িগোফহীন সুগঠিত পুরুষদের অবয়ব থেকে। আকবরনামার একটি ছবিতে আকবরের ব্যক্তিগত খোজা নিয়ামতকে দেখা যায়, যেখানে তিনি আধম খানকে হারেমের ভেতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছেন!
আকবরের উদ্যোগে এসময় খোজাদের নামের সঙ্গে ‘খোয়াজা’ আর ‘নাজির’ উপাধি যোগ করে তাঁদের ডাকার রীতি যেমন চালু হয়েছিল, একই সঙ্গে সম্রাটের প্রধানতম খোজার জন্য নির্দিষ্ট হয় ‘অ্যায়েৎবার খান’ (বিশ্বাসী খান), ‘ইতিমদ খান’, ‘ইতিবর খান’ ইত্যাদি উপাধি। তাছাড়া উচ্চপদস্থ ও বিশ্বাসী অন্য খোজাদের ‘খোয়াজাসারা’ উপাধি দিয়ে সাধারণ খোজাদের থেকে আলাদাভাবে পরিচায়িত করা হয়েছিল। এসময় বিভিন্ন সুবা প্রশাসন থেকে পদোন্নতি পাওয়া দক্ষ খোজারা কেন্দ্রীয় রাজধানী আগ্রায় চলে আসছিলেন এবং হারেম পাহারার ছোটোখাটো কাজের গন্ডি ছাড়িয়ে প্রশাসনের নানা দায়িত্বেও বহাল হচ্ছিলেন। আকবরের রাজত্বের ষষ্ঠ বছরে যেমন মুঘল অর্থ দপ্তরের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন ‘খোয়াজা ইতিমদ খান’। সেলিম খানের দরবারের একজন সম্মানিত আমির ইতিমদ খান ১৫৭৬-এর বাংলা অভিযানে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন এবং ভক্করের সুবেদার নিযুক্ত হন। নিজের ‘বিশেষ বিশ্বাসভাজন’ ইতিমদ খানের সঙ্গে শাহী প্রশাসন থেকে হারেমের কাজকর্ম; সব ক্ষেত্রেই পরামর্শ করতেন আকবর। ১৫৬৫ সাধারণ অব্দে খান্দেশের রাজকন্যাকে শাহী হারেমে আনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন এই ইতিমদ খান। বাবর ও হুমায়ুনের আমলের বিশ্বস্ত খোজা অম্বর নাজিরকেও আকবর ‘খোয়াজা ইতিবর খান’ উপাধি দিয়ে দিল্লির মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরের শাসকের পদ দিয়েছিলেন। আগ্রায় উপপত্নীদের মহলের পরেই ছিল ইতিবর খানের প্রাসাদ। এই অবস্থান সন্দেহাতীতভাবে শাহী পরিবারে ইতিবর খানের সম্মান আর বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচায়ক। ইতিমদ ও ইতিবর খান বাদে বাদশাহ তাঁর অনুগত অপর দুই খোজা; ‘খোয়াজা খাস মালিক’ আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে এক হাজারি মনসবদারি দান এবং ‘খোয়াজা দৌলত খান’কে ‘ নাজিরউল্লাহ’ উপাধি দিয়ে খোজাদের বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন।
উচ্চপদে সসম্মানে অনভিজাত বংশোদ্ভূত খোজাদের নিয়োগের আকবরি নীতিকে ভালো চোখে দেখেননি সম্রাটের সমকালীন অনেকেই। যেমন নিজের ‘মুন্তাখাবু-ৎ-তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে মুঘল পঞ্জিকার রক্ষণশীল বদাউনি খোলাখুলি খোজাদের পুরুষাঙ্গহীনতা, দৈহিক বিকৃতি, নারীসুলভ চালচলনকে ‘অশ্লীল’ বলে দেগে দিয়ে শাহী পরিবারের সঙ্গে খোজাদের নৈকট্য আর উচ্চপদে তাঁদের ব্যবহারকে তিনি তীব্র ব্যঙ্গ করেছিলেন। খোজাদের নিষ্ঠুরতা আর দুর্ব্যবহারের বিষয়েও তিনি ফলাও করে বলতেন। প্রশাসনে খোজা নিয়োগের এই বিরোধিতার অপরপক্ষে আবার আকবরের নিকটজন আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরিতে সম্রাটের উদ্দেশ্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখছেন, অলস, ক্ষমতালোভী আর দুর্নীতিগ্রস্ত মুঘল আত্মীয় পরিজন আর অভিজাত পরিবারের আমিরদের মৌরসিপাট্টাকে দমন করে সৎ আর দক্ষ ব্যক্তিদের সাহায্যে মুঘল প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর আকবর নিচুতলার মুঘল প্রশাসন থেকে বেছে বেছে যোগ্য এই খোজাদের তুলে এনেছিলেন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ নানা দায়িত্বে। বিবাহে অক্ষম খোজাদের পারিবারিক দায়দায়িত্ব না থাকায় সাম্রাজ্যের যে কোনো প্রয়োজনে তাঁদের দিনের যে কোনো সময় কাজে লাগানো বা যে কোনো প্রান্তে পাঠানো যেত; উচ্চপদে খোজা নিয়োগের পিছনে এই সুবিধার দিকটিও প্রশাসক আকবরকে চালিত করেছিল। অন্যদিকে যুগপৎ সুলতানি আর মুঘল আমলে সম্রাটদের তরফে খোজারা নিজেদের কাজের বিনিময়ে যেহেতু বিপুল পরিমাণ অর্থ, জমিজমা ও সামাজিক সম্মান পেতেন, তাই তাঁরা সম্রাটদের প্রতি চূড়ান্তভাবে অনুগত থাকতেন। মধ্যযুগে পারস্যের সাফাভি বা তুর্কি উসমানীয় সাম্রাজ্যে যেমন খুব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ অভিজাতরা সম্রাটদের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে সজ্ঞানে নিজেদের খোজাকরণ করতেন, তেমন আকবরের ভারতেও শাহ কুলি নামক মধ্যবয়স্ক এক আমির নিজেকে খোজায় পরিণত করেছিলেন।
একদিকে যখন খোজারা প্রশাসনের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, তখন অন্যদিকে মুঘল শাহীহারেমে পুরুষের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হচ্ছিল এবং লিঙ্গবিচ্ছিন্ন হলেও জন্মসূত্রে পুরুষ খোজাদেরও হারেমের অন্দরমহল ও দরজার পাহারাদারের ভূমিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল। আকবরের রাজত্বকালের পরবর্তী বছরের ছবিগুলি থেকে নীতির এই বদল প্রতীয়মান হয়। পরিবর্তে আকবর হারেমের সুরক্ষায় ‘উর্দুবেগী’ নামক দক্ষ নারী প্রহরীরা আর দ্বাররক্ষক হিসেবে বিশ্বস্ত হিন্দু রাজপুত প্রহরীরা নিযুক্ত করেছিলেন। মহিলামহল থেকে খোজাদের একেবারে সরিয়ে নেওয়ার নীতি হয়ত খোজাদের প্রতি ‘পুরুষমানুষ’ আকবরের গোপন অবিশ্বাসকেই স্পষ্ট করে তোলে! অভিজাত খোয়াজাদের বাইরে হারেমের কাজ থেকে বের করে আনা এই সব সাধারণ খোজাদের অন্দর আর বহির্মহলের মধ্যবর্তী জায়গাটিতে ক্রীতদাসী আর নর্তকীদের পাশাপাশি যৌনসঙ্গী হিসেবে বা খাবার পরিবেশন সমেত শাহী সংসারের বহিরঙ্গের নানা কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল।
জাহাঙ্গীর পর্ব
১৫৮২ সাধারণ অব্দে আকবর বিপুল সংখ্যক সাধারণ ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিলেও সিলেট আর ঘোড়াঘাটের আন্তর্জাতিক খোজা ব্যবসা বা বকেয়া রাজস্ব পরিশোধে ‘খোজা নজর’ দান ইত্যাদি কুপ্রথা বন্ধে সফল হননি। এই ক্ষেত্রে কঠোরতর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন পরবর্তী সম্রাট জাহাঙ্গীর। নিজের আত্মজীবনী তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরী’তে বারবার বাদশাহ খোজাদের বিষয়ে তাঁর নীতি আর উদ্যোগগুলির কথা লিখেছেন। যেমন, ১৬০৮ সাধারণ অব্দে তিনি বাংলার সুবেদার ইসলাম খানকে সতর্ক করে দিয়ে জানাচ্ছেন, খোজা নজরের কুপ্রথা সাম্রাজ্যের অন্যান্য সরকারে একটি স্বাভাবিক প্রথা হিসেবে গণ্য হচ্ছে আর সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, কাজেই অবিলম্বে সার্বিকভাবে খোজা নজর দান ও খোজা ব্যবসাকে সিলেটে কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে জাহাঙ্গীর জোর করে শিশু/কিশোরদের খোজাকরণকে একটি ‘মৃত্যুযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ইসলাম খানকে উদ্ধার হওয়া শিশু/ কিশোর খোজাদের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়ার আদেশ দেন। ১৬১০-এ বিহারের সুবেদার আফজল খান শিশু/ কিশোরদের জোর করে খোজা করার অপরাধে কয়েকজন দাস ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে আগ্রায় পাঠান এবং বিচারে এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। তবে উদ্ধার হওয়া খোজাদের জীবনে যে যথার্থ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, তা বলাই বাহুল্য। কারণ তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরীতেই আমরা দেখি, ১৬০৮-এর বাদশাহী ফরমানের পর বাংলা সুবার বিভিন্ন অভিজাত পরিবার থেকে উদ্ধার করা পঞ্চাশ জন খোজাকে ১৬১৩-তে জাহাঙ্গীরের কাছে পাঠানো হয়েছিল! ১৬২১-এও পরবর্তী সুবেদার ইব্রাহিম খান ফতেহ জঙ্গ শাহী দরবারে দুজন খোজা আর একজন উভলিঙ্গ ব্যক্তিকে নজর হিসেবে পেশ করছেন!
জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলা ভ্রমণে আসা ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া পিরাদ লিখেছেন, দাস ব্যবসার রমরমা ছিল বাংলায়। ব্যবসায়ীরা অপহৃত বা দরিদ্র বালকদের খোজা করত। সম্রাটের নির্দেশে অনেক পিতাও পুত্রকে খোজা করতে বাধ্য হতেন। এই দুর্ভাগ্য-পীড়িত বালকদের অনেক সময় গোটা জননাঙ্গটিকেই কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হতো। কারো কারো দেহে প্রস্রাব করার একটি ছোটো ফুটো ছাড়া আর কিছু বাকি থাকত না! এদের অভিজাত পরিবারের হারেমের রক্ষী হিসেবে কাজে লাগানো হতো। মালিকরা এদের খুবই বিশ্বাস করতেন। তবে যৌনাঙ্গ উৎপাটনের পরেও হারেমের নারীদের সঙ্গে খোজাদের ঘনিষ্ঠতাকে পুরোপুরি আটকানো যে যেত না, তার প্রমাণও সমকালীন নানা লেখায় পাওয়া যায়। যেমন টমাস রো লিখেছেন, সম্রাট জাহাঙ্গীরের এক উপপত্নী আর এক খোজাকে চুম্বনরত অবস্থায় খুঁজে পাওয়ার পর খোজাটিকে ওই নারীর সামনেই হাতির দ্বারা পিষ্ট করে হত্যা করা হয়েছিল আর নারীটিকে হাত পা বেঁধে, খাদ্য পানীয় ছাড়া সূর্যালোকে দাঁড় করিয়ে রেখে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। খোজা আর হারেমের নারীদের দু’পক্ষকেই ভয় দেখিয়ে একে অপরের থেকে দূরে রাখার জন্য যে এই ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দেওয়া হয়েছিল, তা স্পষ্ট! তবে খোজা ব্যবস্থার প্রতি জাহাঙ্গীরের ঘৃণা আর এটি বন্ধ করার আইনি প্রয়াসের পরেও বাংলা থেকে তুমুল লাভজনক খোজাব্যবসার পাট যেমন ওঠেনি, তেমন মুঘল অভিজাতরা শাহী কায়দার আদলে নিজেদের সংসারে প্রচুর সংখ্যক খোজা রাখার অভ্যাস থেকেও সরে আসেননি। জানা যায় বাংলা, বিহার আর পাঞ্জাবের সুবেদার সৈয়দ খান চাঘতা নাকি নিজের প্রাসাদে কয়েক হাজার খোজার বিশাল এক ভৃত্য বাহিনী সামলাতেন।
মুঘল প্রশাসনের অন্যতম বৃহৎ দপ্তর শাহী হারেম চালনাতেও এসময় প্রধান খোজাদের নেতৃত্বে অসংখ্য খোজার ব্যবহার বজায় ছিল। ‘জাহাঙ্গীরনামা’ জানায়, জৌহর খান নামক এক একহাজারি মনসব প্রাপ্ত খোজাকে হারেমের সংসার চালনার প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের দুই খোজা সহায়কের কথাও সমকালীন লেখায় উঠে এসেছে। অন্যান্য কেন্দ্রীয় দপ্তরেও খোয়াজা হিলালের মতো উচ্চপদস্থ খোজারা এসময় নিযুক্ত হয়েছেন। হারেমের জীবন থেকে প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব; এমনকি যুবরাজদের বিদ্রোহের কঠিন সময়, বাদশাহীর সমস্ত ধাপেই বিশ্বস্ত খোজাদের পরামর্শদাতা, অনুচর আর দেহরক্ষী হিসেবে জাহাঙ্গীর সঙ্গে রাখতেন। যেমন সবচেয়ে বিশ্বস্ত খোজা খোয়াজা অ্যায়েৎবার খানকে বিদ্রোহী যুবরাজ খুসরোর পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। শাহী পরিবারের নিকটজন হওয়ায় এঁরা যে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন তা বোঝা যায়, পূর্বোক্ত সৈয়দ খান চাঘতা’র মতো শক্তিশালী অভিজাত’র সঙ্গে খোলাখুলি বিবাদের সূত্রে।
পরবর্তী বাদশাহ শাহজাহানের সময়কার গ্রন্থ ‘পাদশাহনামা’র একটি ছবিতে যেখানে জাহাঙ্গীর তাঁর দরবারে যুবরাজ খুররমকে স্বাগত জানাচ্ছেন, সেখানে সম্রাটের পিছনে দেখা যায়, দাঁড়িয়ে আছেন দাড়িগোঁফবিহীন ধূসর গায়ের রঙের তিন পুরুষ, মুঘল চিত্ররীতি অনুযায়ী এমন মুখমণ্ডলের পুরুষরা খোজা হিসেবেই পরিচায়িত হয়েছেন বাবরের ভারত আগমনের অনেক আগে থেকে (ওপরের ছবিটি)। ছবিটিতে এঁরা পরিচায়িত হয়েছেন ইতিবর খান, খিদমৎ খান আর ফিরুজ খান নামে। জাহাঙ্গীরের প্রশাসনে ইতিমদ খান জাহাঙ্গীরের বাল্যকাল থেকে তাঁর অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত ভৃত্য বা ‘ মুতামিদা’ ছিলেন, খিদমৎ খান এক হাজারি মনসবদার আর ফিরুজ খান তিন হাজারি মনসবদার ছিলেন। সম্রাটের গুসলখানার রক্ষী হিসেবে খোজাদের উপস্থিতি পাওয়া যায় ১৬২৬ সাধারণ অব্দে মহাবৎ খানের জাহাঙ্গীর বিরোধী অভ্যুত্থানের ঘটনাবলী আঁকা ছবিগুলিতে।
শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেব-পর্ব
সম্রাট শাহজাহান খোজা ব্যবসা বন্ধ করা নিয়ে আলাদা করে কোনো পদক্ষেপ নেননি। তার আমলেও হারেম আর মুঘল প্রশাসনের নিচুতলা থেকে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত নিযুক্ত খোজাদের আগেকার আমলের দায়িত্বগুলিই বহাল ছিল। শাহজাহানের ব্যক্তিগত খোজা শাবাজ় খান তাঁকে শাহজাদা আলমগীর সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন, এ তথ্য উঠে এসেছে। তার আরেক বিশ্বস্ত খোয়াজাসারা ছিলেন ফিরুজ খান। তার রাজত্বের শেষদিকে শাহী মসনদ দখলের কুখ্যাত যে যুদ্ধ শাহজাদা দারা, সুজা, মুরাদ আর আলমগীরের মধ্যে হয়েছিল; সেখানে উপরোক্ত শাবাজ় খান মুরাদের পক্ষে, খোয়াজা বসন্ত দারাশিকোহ’র পক্ষে, ইসরাত খান সুজাই সুজা’র পক্ষে ছিলেন এবং খোয়াজা বখতাওয়র খান খোলাখুলি আলমগীরের পক্ষ নিয়েছিলেন।
উত্তরাধিকারের যুদ্ধ চলাকালে শাহজাদা মুরাদকে বন্দি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন খোজা বশারত! অস্ত্র হাতে আলমগীরের তাঁবুতে ঢুকে আসা মুরাদকে তিনি পায়ে হাত বুলিয়ে কৌশলে ঘুম পাড়িয়ে দেন, যার ফলে ঘুমন্ত মুরাদকে নিরস্ত্র করে বন্দি করা সম্ভব হয়েছিল! ঔরঙ্গজেব আগ্রা দুর্গে বন্দি অপসারিত মুঘল সম্রাট শাহজাহানকে পাহারা দেওয়ার জন্য বিশ্বস্ত খোজা ইতিবর খানকে (খোজা ফুল) নিয়োগ করেছিলেন। নজরদারি ছাড়াও ইতিবর খানের কাজ ছিল শাহজাহানকে মানসিকভাবে চাপে রাখা আর তাঁর রোজনামচার প্রতিটি খুঁটিনাটি ঔরঙ্গজেবকে জানানো। বন্দি শাহজাহানের কাছে থাকা ধনরত্ন বাজেয়াপ্ত করার সময়, ১৬৮১-তে শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহ দমনে, ১৬৮৮ নাগাদ বন্দি অপর শাহজাদা মুয়াজ্জমকে খাদ্য পানীয় সরবরাহ করার সময়, সম্রাটের সঙ্গে তার যোগাযোগ রক্ষায়, এমনকি বন্দি মুয়াজ্জমকে ক্ষমা করা যায় কিনা তা পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ঔরঙ্গজেব নিজের বিশ্বস্ত খোজাদের বারবার কাজে লাগিয়েছিলেন। অর্থাৎ শেষ গুরুত্বপূর্ণ মুঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেব তাঁর শাসনকালের সমস্ত সময়েই খোজাদের সহায়তা ও আনুগত্য পেয়েছিলেন; যার বদলে তিনি পূর্বতন সম্রাটদের মতো এদের প্রতি বিপুল অর্থ, জমিজমা আর সম্মানসূচক দায়িত্ব, উপাধি আর পদোন্নতির মাধ্যমে সামাজিক সম্মান তো দিয়েইছিলেন, এমনকি দিয়েছিলেন হজে যাওয়ার অনুমতিও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুলতানি বা শাহী পরিবারের যত বিশ্বস্তই হোন; আকবরের সময় ইতিমদ খান ব্যতীত আর কখনও কিন্তু তৃতীয়লিঙ্গ হওয়ার কারণে খোজারা হজের অনুমতি পাননি! পিটার মুন্ডির তথ্য অনুযায়ী ঔরঙ্গজেবের সময়ে খোয়াজা ইতিবর খান, খোয়াজা আব্দুল হাসান, খোয়াজা তাহের এবং খোয়াজা মাহমুদ মক্কায় হজে গিয়েছিলেন!
শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের সময়ে মুঘল ভারতে আগত বিদেশি পর্যটকরা খোজাদের কাজকর্ম সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দিয়েছেন। যেমন ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের লিখেছেন, মুঘল পরিবারের প্রত্যেক সন্তানকে শিশুকাল থেকেই নারীদের, খোজাদের এবং ইউরোপ আর আফ্রিকা থেকে আগত ক্রীতদাসদের সম্মান করতে শেখানো হতো। ইংরেজ ব্যবসায়ী পিটার মুন্ডি-ও একই সময় লিখছেন, খোজারা হারেমের নারী আর ধনসম্পদ পাহারা দেওয়া থেকে শুরু করে বাদশাহের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তিগত সহায়ক, যুদ্ধক্ষেত্রের সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ সেনাপতি – প্রতিটি ভূমিকাই সফলভাবে পালন করতেন। ইতালীয় পর্যটক নিকোলো মানুচি তার ভ্রমণকথায় ঔরঙ্গজেবের আমলের চল্লিশজন উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাশালী খোজার তালিকা দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, প্রধান নাজিরকে বাদশাহ স্বয়ং সম্মান করতেন। প্রধান খোজাদের বহুতর দায়িত্বগুলি থেকেই শাহী পরিবারের কাছে তাদের গুরুত্ব ও বিশ্বস্ততার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। শাহী পরিবারের নিজস্ব অর্থভাণ্ডার, খরচাপাতি, উপঢৌকনে পাওয়া বহুমূল্য মণিরত্ন, গহনা বা দামি বস্ত্র রাজকোষে জমা করা, তাঁদের জামাকাপড়ের হিসেব রাখা, হারেমে আসা যাওয়ার অধিকার পাওয়া সমস্ত ব্যক্তির ওপর নজরদারি করা, বাদশাহী ‘সরপ’ বা বস্ত্র তৈরির নির্দেশনা দেওয়া, এমনকি শাহী গুসলখানার পাহারা ও তদারকির মতো খুবই গুরুত্বপূর্ণ অথচ একদম অন্তরঙ্গ কাজগুলির দায়িত্ব তারা পেতেন। মানুচি লিখেছেন হারেমের মহিলাদের ওপর নজরদারির কাজ খোজারা যেমন করতেন, তেমন ঘুষের বিনিময়ে হারেমে মদ বা অন্যান্য নেশার জিনিস, এমনকি বাইরের পুরুষদেরও ঢুকিয়ে দিতেন তারা। হারেমের নিচুতলার উপপত্নী বা নারী ভৃত্যদের এসব গোপন অ্যাডভেঞ্চারের খবর সাধারণত নিচুতলার খোজাদের কাছে সুরক্ষিত থাকত। কাজেই হারেমের আম-মহিলা আর তাদের নজরদারির কাজে নিযুক্ত খোজা; যৌন-আনন্দ বর্জিত এই মানুষগুলি প্রতিপক্ষ নয়; বরং কখনও সখনও যে তারা একে ওপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, এমনকি ‘পার্টনারস ইন ক্রাইম’-ও হয়ে উঠতেন; সমকালীন সূত্রগুলির ভিত্তিতে এটি বলাই যায়। ঔরঙ্গজেবের সময়কার শাহী দরবারেও আগেকার আমলের মতো খোজারা সম্রাটের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সম্রাটকে পাখার বাতাস দেওয়া, দরবারে আগত উপঢৌকন তার হাতে তুলে দেওয়া ও তারপর জমা করে নেওয়া, ঝরোখা দর্শনের সময় সম্রাটের পাশে থাকা, সেদিন আগত জনতার কাছ থেকে জমা পড়া বিভিন্ন অভাব অভিযোগের আবেদনগুলি সম্রাটকে দেওয়া ইত্যাদি বহির্মহলের কাজে তার বিশ্বস্ত খোয়াজাসারারা নিযুক্ত থাকতেন। তবে উপরোক্ত কাজগুলিতে ত্রুটি হলে সংশ্লিষ্ট খোজারা শাস্তি পেতেন। যেমন শাহজাদা মুয়াজ্জম বাদশাহের দুটি বিশেষাধিকারে হস্তক্ষেপ করায় তাঁর ওপর গুপ্তচরবৃত্তিতে নিযুক্ত খোজারা শাস্তি পেয়েছিলেন।
ঔরঙ্গজেবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত খোজা তথা নিকটজন ছিলেন বখতাওয়র খান। ১৬২০ সাধারণ অব্দ নাগাদ জন্মগ্রহণ করা এই খোজার শুরুর জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ১৬৫৪ নাগাদ শাহজাদা আলমগীরের অধীনে এক সাধারণ ‘খবরি’ হিসেবে কাজ শুরু করেন বখতাওয়র। ১৬৫৭-১৬৫৯ সাধারণ অব্দের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সময় থেকে শাহজাদার ব্যক্তিগত সহায়ক হিসেবে সামনে আসতে শুরু করেন। ধর্মাটের যুদ্ধ, খাজোয়ার যুদ্ধ, সামুগড়ের যুদ্ধ; সর্বত্র তিনি ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছেন। ১৬৭০-এ বাদশাহ তাঁকে ‘দারোগা-ই-খাওয়াসিস’ বা রাজ পরিবারের নিজস্ব উৎসব অনুষ্ঠানের প্রধান পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করে একটি ক্রিস্টালের হাতলযুক্ত ছোরা উপহার দেন। এই সময়কালে তিনি মুরাদ, দারা শিকোহ এবং ঔরঙ্গজেবের আপন পুত্রকন্যাদের নিকাহ্’র ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দীর্ঘ দুই দশকের একনিষ্ঠ আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে ঔরঙ্গজেব ১৬৭৪-এ বখতাওয়র খানকে অন্যতম প্রধান জায়গিরদারে উন্নীত করেন। ব্যক্তিগত জীবনে সুপণ্ডিত ও সুভদ্র বখতাওয়র খান ছিলেন ইতিহাস চর্চায় বিশেষ আগ্রহী। তিনি ‘মিরাৎ-উল-আলম’ নামক ‘পৃথিবীর একটি মহামূল্যবান ইতিহাস গ্রন্থ’ রচনা করেছিলেন। শিল্পকলা আর সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও তিনি উৎসাহী ছিলেন। ১৬৮৫-তে খোয়াজা বখতাওয়র খান এবং নাজির দরবার খান (হারেম দপ্তরের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত খোজা); ঔরঙ্গজেবের এই দুই নিকটজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু দুটিতে সম্রাট স্বজনবিয়োগের সমান কষ্ট পেয়েছিলেন এবং স্বয়ং ইমাম হিসেবে দুজনের পারলৌকিক ক্রিয়া পরিচালনা করেছিলেন। অজ্ঞাতকুলশীল দুঃখী খোজাদের এমনতর সম্মানদানের উদাহরণ কিন্তু মধ্যযুগের খোজাদের আন্তর্জাতিক ইতিহাসেও বিরল! ঔরঙ্গজেব; যাকে দীর্ঘ সময় ধরে ইউরোপীয় ও ভারতীয় ইতিহাসচর্চা শিল্পবিরোধী ও ধর্মান্ধ এক নিষ্ঠুর সম্রাটের তকমা দিয়েছে, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বৃত্তে খোজাদের এমন অনায়াস ও সম্মানিত বিচরণ বা খোজাদের শিল্পানুরাগের নিশ্চিন্ত নির্ভয় প্রকাশকে আমরা প্রিয়জনের প্রতি মানুষ ঔরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা ও সহনশীলতার এক অনন্য নজির হিসেবে দেখতে পাই।
ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের দ্রুত পতনের সময়েও বারবার আমরা খোজাদের শাহী দরবারে উপস্থিত দেখি। যেমন মহম্মদ খানের (১৭১৮-১৭৪৮ সাধারণ অব্দ) দরবারের অঙ্কিত চিত্রে সম্রাটের বাকি মন্ত্রী সান্ত্রী, পাহারাদার আর অনুচরদের পাশে রাজমহলের খোজা বা ‘মহলিয়া’ আর উচ্চপদস্থ খোয়াজা-নাজিরদের হাজিরা দেখা যায়। মুঘল চিত্ররীতির ঐতিহ্য মেনে অষ্টাদশ শতকের ছবিগুলিতেও খোজারা দাড়িগোঁফহীন কমনীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ চেহারায় চিত্রিত হয়েছেন;( যেমন এই নিবন্ধের শিরোনামের সঙ্গে থাকা সম্রাট বাহাদুর শাহের পছন্দের খোজা খাওয়াস খানের প্রতিকৃতিটি খোজা ব্যক্তিকে বোঝানোর ক্ষেত্রে গৃহীত মুঘল চিত্ররীতির একটি স্পষ্ট নিদর্শন) I মহম্মদ শাহের আমলে পারসিক খোজা জাভেদের দ্রুত উত্থান হয়েছিল। সম্রাটের মৃত্যুর পর সম্রাজ্ঞী উধম বাঈয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় জাভেদ পরবর্তী বাদশাহ আহমদ শাহের প্রতিনিধি হিসেবে মুঘল প্রশাসন চালনা করতেন। মধ্য ভারতের একমাত্র খোজা হিসেবে তিনি ছ’হাজারি মনসবদারী পান, দিল্লির প্রশাসক হন এবং নবাব বাহাদুর উপাধি লাভ করেছিলেন। তবে দিল্লির ক্ষমতার শীর্ষে উঠে আসা এই সময়কার খোজারা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের প্রতি আনুগত্যের খাতিরে বা বিশৃঙ্খল সাম্রাজ্যের হাল ধরার জন্য নয়, ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই সাম্রাজ্যের অরাজকতার সুযোগে সমকালীন রাজনীতির ঘোলাজলে নেমেছিলেন। তিন খোজা মিঞা আর্জমন্দ, মিঞা খুশফাহাহ্, মিঞা মহাবৎ ১৭৫৪-৫৬ নাগাদ বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরের হয়ে মুঘল প্রশাসন পরিচালনা করেছিলেন। এই সময়ে নব প্রতিষ্ঠিত আঞ্চলিক রাজ্যগুলিতে যেমন বাংলা, হায়দ্রাবাদ ও বিশেষত অযোধ্যায় খোজাদের শক্তিশালী উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল। তবে বাংলা তথা পূর্ব ভারতে ইংরেজ প্রাধান্য বিস্তৃত হওয়ার সময় থেকে ধীরে ধীরে বাংলা থেকে খোজা ব্যবসা লোপ পেতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের সময় লখনৌয়ের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ ক্ষমতাচ্যুত হলে ভারতের খোজা ব্যবসা এবং রাজ দরবার সমেত রাজ পরিবারগুলিতে খোজাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। কর্মচ্যুত এই খোজারা পেটের তাগিদে ব্রিটিশ ভারতের নতুন রাজধানী কলকাতা শহরে গজিয়ে ওঠা নবাবি ধাঁচে চলা বিভিন্ন নব্যধনী পরিবারে নানারকম খিদমত করে কোনোরকমে টিকে ছিলেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকের নানা লেখাপত্রের সাক্ষ্য থেকে সে আমলে বেঁচেবর্তে থাকা দু’একজন দেশি বিদেশি খোজার সন্ধান পাওয়া যায়।
শেষ কথা
যুগপৎ সুলতানি ও বাদশাহী দরবারে নিজের যোগ্যতা আর আনুগত্য প্রদর্শনের বিনিময়ে খোজারা সম্রাট বা প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও জমিজমা পেতেন। অথচ আপন সন্তান উৎপাদনে অক্ষম এই মানুষগুলির জন্য অর্জিত ধনসম্পত্তি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার কোনো অর্থ ছিল না। আবার ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র বাদে তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ার কারণে হজে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁদের ওপর থাকত শাসক বা উলেমার বাধানিষেধ। বখতাওয়র খানের মতো বিদ্যোৎসাহী দু’একজন খোজা বাদে বাকি প্রায় সমস্ত খোজাই অপার ভোগবিলাস, খানাপিনায় অবসর সময় যাপন করতেন, যাতে অর্জিত অর্থভাণ্ডারের বড়ো অংশ নিজের জীবদ্দশাতে তিনি ভোগ করে যেতে পারেন! ভোগবিলাসের পাশাপাশি ইতিমদ খান বা ফিরোজ খানদের মতো ধনী প্রভাবশালী খোজারা আগ্রা, দিল্লি সমেত বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের স্মৃতিসৌধ, জলাশয় ইত্যাদি নির্মাণ করিয়েছিলেন, যার অনেকগুলি আজও অক্ষত আছে।
দৈহিকভাবে অক্ষম হলেও খোজাদের মনের মধ্যে নারীর প্রতি আকর্ষণ, প্রেম, শরীরী চাহিদার নানা বিচ্ছিন্ন ঘটনা সমকালীন নানা লেখায় যেমন উঠে এসেছে, তেমনই বড়ো আকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে পালক পুত্রদের (অনেক সময় খোজা পিতা, কিশোর খোজাদের দত্তক নিতেন ও প্রশিক্ষণ দিতেন) প্রতি তাঁদের পিতৃস্নেহের একের পর এক উদাহরণ। মূল নিবন্ধে উক্ত যুগপৎ সুলতানি ও মুঘল আমলের অনেক খোজারই এমন পালক পুত্র ছিল। বিপুল ধনসম্পদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা সত্ত্বেও খোজাদের তাঁদের দৈহিক অপূর্ণতা তথা নারীসুলভ আচরণের জন্য প্রায় সময়ই বিদ্রূপ ও অপমানের সম্মুখীন হতে হতো। আবুল ফজল নিজেই খোজাদের সম্পর্কে ব্যঙ্গ করেছেন। গুজরাট প্রদেশের প্রশাসনে খোজাদের সর্বব্যাপী আধিপত্য থাকলেও খোজা হুজ্জৎ-উল-মুল্ককে “তুমি না পুরুষ, না নারী, কারণ তোমার মধ্যে দুয়ের ভাবই আছে” এমন সব কথার দ্বারা অপমান করা হয়েছিল। হারেমে সংঘটিত যে কোনো অপরাধকে চাপা দেওয়ার জন্য নির্দোষ কোনো খোজাকে শাস্তির সামনে এগিয়ে দেওয়া, বাদশাহের প্রতিনিধি হিসেবে বন্দি বা বিদ্রোহী রাজপুরুষদের নজরদারি বা তাঁদের সঙ্গে দরকষাকষিতে সামান্যতম ভুল হলে খোজাদের পদচ্যুত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটত আকছার। সুলতানি আর মুঘলযুগ জুড়ে গোটা দেশের রাজনীতি আর প্রশাসনের নানা বৃত্তে নিজেদের দক্ষতা আর কূটবুদ্ধির বলে বারবার উচ্চপদে উঠে আসলেও এ দেশের খোজারা সমকালের তিমুরিদ, সাসানিয় বা অটোমান সাম্রাজ্যের খোজাদের মতো চূড়ান্ত ক্ষমতাশালী কোনো ‘ দীর্ঘস্থায়ী কেন্দ্রীয় পাওয়ার লবি’ গড়ে তুলতে পারেননি,
এবার এই নিবন্ধ শেষ হোক ঔরঙ্গজেবের খোজা ইতিবর খানের কাহিনি দিয়ে। কোন এক আবছা ‘ ছেলেবেলায়’ ইতিবর খানের গরিব বাঙালি বাবা-মা তাকে বেচে দিয়েছিলেন খোজাগরদের কাছে। মধ্যে তারা একবারও ছেলের খোঁজ করেননি। একসময় লোকমুখে ক্ষমতার চুড়োয় ছেলের পৌঁছনোর কথা শুনে সুদূর পূব বাংলা থেকে ধনদৌলত পাওয়ার আশায় তারা আগ্রায় ইতিবরের প্রাসাদে এসে হাজির হন। ইতিবর খান তাদের অর্থ তো দেনইনি, বরং অত্যন্ত অপমান করে তাড়িয়ে দেন এবং বলেন জীবনের সর্বোচ্চ আনন্দ থেকে যে বাপমা অবোধ সন্তানকে নিষ্ঠুরভাবে চিরকালের মতো বঞ্চিত করতে পারেন, তারা সকল ক্ষমার অযোগ্য! উজ্জ্বল আলোর নীচে নিশ্চিত অন্ধকারের মতো এভাবেই শৈশবের স্বজনবিচ্ছেদ আর দৈহিক অক্ষমতার চিরচিহ্ন সয়ে, শান্তিহীন জীবনের অনপনেয় হতাশা, অভিমান আর যন্ত্রণাকে আমৃত্যু সঙ্গী করে, প্রাচীন বা মধ্যযুগের ভারত কিংবা গোটা দুনিয়ার সমস্ত রাজ্য- সাম্রাজ্য জুড়ে বেঁচে থাকতেন তাঁরা, সমাজের মধ্যে থেকেও আদতে ব্রাত্য তৃতীয় লিঙ্গের সেই লিঙ্গহীন মানুষরা; যাদের এই উপমহাদেশে আমরা খোজা/ কিন্নর/ খোয়াজাসারা বা হিজড়ে ইত্যাদি অবনামে চিনি আজও!
অন্যতম কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য সূত্র :
১. Tim Mackintosh-Smith (ed.), The Travels of Ibn Battuta, Picador Publication, 2003.
২. W. M. Jr. Thackston. The Baburnama: Memoirs of Babur, Prince and Emperor (Modern Library Classics), Modern Library Pbk. Ed Edition – 10 September 2002.
৩. Henry Beveridge, Rogers Alexander, (Edited and translated), The Tuzuk-i-Jahangiri; or, Memoirs of Jahangir, Emperor of Hindustan 1569-1627, London Royal Asiatic Society, 2018.
৪. Blochmann, H. (tr.), The Ain-I Akbari by Abu’l-FazlAllami, Vol. I, Calcutta: The Asiatic Society, 1927.
৫. Jarrett, H.S. (tr.), The Ain-I Akbari by Abu’l-FazlAllami, Vol. II and III Calcutta: The Asiatic Society, 1948 and 1949.
৬. Niccolo Manucci, William Irvine (ed.) Storia do Mogor; or, Mogul India 1653-1708 by Murray Publication, London, 1907.
৭. Bano Shadab, Eunuchs in Mughal Household and court, Proceedings of the Indian History Congress, Vol. 69, 2008, pp. 417-427.
৮. Bano Shadab, Eunuchs in Mughal Establishment, Aligarh Muslim University Journal, Academia.Edu
৯. Hambly Gavin, A Note on the Trade in Eunuchs in Mughal Bengal, Journal of the American Oriental Society, Vol. 94, No. 1 (Jan. – Mar., 1974), pp. 125-130.
১০. Irfan Lubna, ‘Third gender’ and ‘Service’ in Mughal Court and Harem, Posted on August 12, 2019. (Junior Research Fellow, Aligarh Muslim University)
১১. Basak Shreejita, Aurangzeb’s Eunuch Slave Bakhtawar Khan and His Passion for History, Centre for Historical Studies, Jawaharlal Nehru University,
১২. Kalb Emma, A eunuch at the threshold: mediating access andintimacy, Journal of the Royal Asiatic Society, Vol 33, Issue 3, published online by Cambridge University Press,
১৩. Lal Ruby, Harem and eunuchs : Liminality and networks of Mughal authority, Routledge, 2017
একেবারে অজানা না হলেও একটা নতুন দিক নিয়ে অত্যন্ত সুখপাঠ্য ও তথ্যবহুল রচনা।
বাংলায় সামাজিক ইতিহাস চর্চার দিক থেকে একটি ক্ষুদ্র মাইলফলক বলা যায় একে।
এই বিষয়টি নিয়ে বাংলায় এতো বিস্তারিত চর্চা এই প্রথম পড়লাম। খুব ভালো লাগল।
অসাধারণ লেখা, দুর্দান্ত গবেষণা। খোজাদের রাজনৈতিক অবস্থানের খুব বিশদ একটা ছবি পেলাম