সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

জুলাই ১, ২০২৩

অ-মানুষী ভাষার নতুন পর্ব ও আমাদের সমাজ সভ্যতা

বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা প্রযুক্তি উৎসুক কিছু মানুষের ছোট গণ্ডী ভেঙে সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে। এর ব্যাপক সম্ভাবনার নানা দিক যেমন আলোচনার মধ্যে আছে, তেমনি আছে একে নিয়ে নানা আশঙ্কাও।

বলা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনতি ভবিষ্যতেই ইতিহাসের গতিপ্রকৃতিকে ব্যাপকভাবে বদলে দেবে। এই বদল অবশ্যই শুধু মাত্রাগত হবে না, হবে গুণগত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যাবতীয় সম্ভাবনা বা তার চ্যালেঞ্জের নানা দিক নিয়ে নয়, এই লেখা কেবল একটি দিককে নিয়েই। সেটা হল ভাষার উৎপাদন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

সত্তর হাজার বছর আগে আধুনিক অর্থে ভাষার সৃষ্টির পর থেকে আমাদের সংস্কৃতির যাবতীয় দিককে সে প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি – সমস্ত কিছুই ভাষার দ্বারা নির্মিত। এই ভাষা এতদিন পর্যন্ত কেবল মানুষই উৎপাদন করে এসেছে। কিন্তু বিশ্বে এই প্রথম এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যখন ভাষার নির্মাণ হচ্ছে একটি অ মানুষী এজেন্টের দ্বারা।

এর আগেও ভাষার সংরক্ষণ বা বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু প্রিন্টিং প্রেস বা রেডিও বা টেলিভিশন – কোনও কিছুই নিজে ভাষা উৎপাদন করেনি। মানুষের তৈরি ভাষাকে তারা কেবল ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ আই বা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স নিজে ভাষা তৈরি করতে সক্ষম। সবচেয়ে বড় কথা যে কম্পিউটার কোডের মাধ্যমে এ আই তৈরি হয়, সেই কোডকেও এ আই নিজে লিখতে পারে, উন্নীত করতে পারে। এর ফলে এ আই এর হাতে আছে নিজেকে, নিজের ভাষা উৎপাদন ক্ষমতাকে খুব দ্রুত বহু পরিমাণে ও গুণগতভাবে উন্নীত করার চাবিকাঠি। কম্পিউটারের দাবা খেলার দক্ষতা প্রথমদিকে প্রাথমিক স্তরে এল, কিন্তু কয়েক দশক পরেই পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে বিশ্বের কোনও দাবা খেলোয়াড় বা তাদের কোনও সম্মিলিত টিমও আজ কম্পিউটারকে দাবায় হারানোর কথা ভাবতে পারেন না।

আজ এ আই এর অনুবাদ দক্ষতা বা কবিতা সৃজন দক্ষতা বা প্রবন্ধ লিখন দক্ষতা থেকে অনুমান করাই অসম্ভব কয়েক বছর পরে এটা কোথায় পৌঁছতে পারে।

আশঙ্কাটা শুধু এই জায়গায় নয় যে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এ আই ব্যবহার করে হোমটাক্সের প্রবন্ধ লিখে ফেলবে বা সংবাদ মাধ্যমের বিজ্ঞাপণ লেখক বা কপি রাইটারদের চাকরী সঙ্কটে পড়বে। এগুলো খুবই প্রাথমিক স্তরের আশঙ্কা। আগামী দিনে এ আই এমন আইডিওলজি তৈরি করতে পারে যা বিরাট বিরাট জনগোষ্ঠীকে নতুন ধর্মের মতো কোনও ধারণায় বশীভূত করতে পারে, নেশন স্টেটের যুদ্ধে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক আইডিওলজিতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এরকম পরিস্থিতি কোনও কষ্ট কল্পনা নয় যেখানে ২০২৮ সালের আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশান বা ২০২৯ সালের ভারতের লোকসভা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করছে এ আই নির্মিত প্রোপাগাণ্ডা। আমাদের গণতন্ত্র, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এর ফলে কীভাবে বদলে যেতে পারে – তার একটা ধারণা এ থেকে পাওয়া সম্ভব।

এ আই আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ও দুর্বল জিনিস – আমাদের আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এ আই এর নিজস্ব কোনও আবেগ নেই এটা কোনও বিষয় নয়। মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ আই এর নিজস্ব আবেগের কোনও প্রয়োজনই নেই। তার ভাষা নির্মাণের অমোঘ যে অস্ত্রটি আছে, তাই দিয়েই সে মানুষের আবেগকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারে।

এখনো অবধি যে সমস্ত সায়েন্স ফিকশান বা ডিসটোপিয়া নির্মিত হয়েছে, সেগুলি মূলত মানুষের বায়োলজিক্যাল অস্তিত্ত্বর চ্যালেঞ্জ সংক্রান্ত। যেখানে যন্ত্র বা ভিনগ্রহী অস্ত্রের প্রয়োগ মানুষকে ধ্বংস করে। এ আই এর হাত থেকে আক্রমণটা আসতে পারে অন্যভাবে। সে বৌদ্ধিক ও মনোজগতের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। অবশ্যই এ আই নিয়ন্ত্রিত মানুষ বা জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক বা দার্শনিক বা ধর্মীয়ভাবে প্রভাবিত হয়ে অন্য মানুষ বা জনগোষ্ঠীকে শারীরিকভাবে নিকেশ করতে পারে, কিন্তু সেটাই কেবল আশঙ্কার একমাত্র দিক নয়। ভাষা যা সভ্যতা বিকাশের নিয়ন্ত্রক ও চাবিকাঠি, সেটা এই প্রথম মানুষের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং মানুষের ভাষা উৎপাদন দক্ষতাকে ছাপিয়েও যেতে পারে অচিরেই – নানা সম্ভাবনার পাশাপাশি আশঙ্কার মেঘ মূলত এই জায়গাটা ঘিরেই।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।