সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

নভেম্বর ১, ২০২৩

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ১০৬ তম জন্মবার্ষিকীতে ঘুরে দেখা

ভারতের প্রথম এবং অদ্যাবধি একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বেঁচে থাকলে এই নভেম্বর মাসের ১৯ তারিখ তাঁর বয়স হত ১০৬ বছর।

ইন্দিরা গান্ধীকে সামান্য জানতে ও বুঝতে হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর কিছু কার্যকলাপের বিশ্লেষণ করা দরকার।

তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একমাত্র কন্যা, কৈশোরের শেষে মাতৃহীন। তাঁর ছিল অস্থির শিক্ষা জীবন এবং পরবর্তীকালে অসুখী বিবাহিত জীবন।

১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম অর্ধে তাঁর পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেশের নিরাপত্তা এবং সীমান্ত প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা। ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে, পাকিস্তানের বিতর্কিত নির্বাচনের ফলে পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সেই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন ও সহিংসতা এক কোটি শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে, ভারত বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করার জন্য সংঘর্ষে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

সেই সময়ে পৃথিবীটা কেমন ছিল?

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক গ্যারি জে. বাস এখন প্রকাশিত হওয়া হোয়াইট হাউসের নথি থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ভারত এবং ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, “নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে অনাকর্ষণীয় মহিলা হল ভারতীয় মহিলারা”। আবার কিসিঞ্জার নিক্সনকে ভারতীয়দের সম্পর্কে বলেছেন, “ভারতীয়রা আসলে জারজ আর ইন্দিরা গান্ধী হল এক কুক্কুরী।” এই হল তখনকার ভয়াবহ জাতিভিত্তিক ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যে ভরা পৃথিবী, যেখানে অনায়াসে একজন নারী এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে সাধারণীকর করে এত বিষাক্ত কথা বলা যায়। অবশ্য এর পিছনে হয়তো ছিল ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের গভীর ও সুদৃঢ় সম্পর্ক।

আবার পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ গঠনের পরে দেশের মধ্যে কংগ্রেসের নেতারা বললেন, “ইন্দিরা ইস ইন্ডিয়া এন্ড ইন্ডিয়া ইস ইন্দিরা”, অথবা দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়, “এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধী যুগ যুগ জিও।“

এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৭৫ সালে তিনি সারা দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কেন তিনি এমার্জেন্সি ঘোষণা করেন? তখন বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য দেশের ভিতরে অর্থনৈতিক চাপ সাধারণ মানুষ অনুভব করছে, পাটনাতে ছাত্র আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে। এই সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ বিহার থেকে শুরু করেন ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি আন্দোলন’ যা প্রকৃতপক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর দেশীয় নীতির বিরোধিতা করে সারা উত্তর ভারতে সারা ফেলে দিয়েছিল। একই সময়ে শুরু হয় রেলকর্মীদের ধর্মঘট। দেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা একটি অস্থির পর্যায়ে পৌঁছেছিল—এক বিরোধী নেতা রাজ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের মামলার করেন এবং ১৯ সে জুন ১৯৭৫ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁর নির্বাচন আইনত অকার্যকর ঘোষণা করে।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পরে তিনি পরপর কিছু পদক্ষেপ নেন, তারমধ্যে সবচাইতে অপ্রত্যাশিত এবং অভূতপূর্ব পদক্ষেপ হল ২৬ শে জুন সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা। জরুরি অবস্থার দিনে সম্পূর্ণভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে, সংবাদপত্র ও বাক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। একটা উদাহরণ দিই, অতি মৃদু বিরোধী কণ্ঠ দমনের প্রচেষ্টার। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা কালে দেবানন্দের ফিল্ম নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন—অবস্থা তখন এমনই ভয়াবহ ছিল। কংগ্রেসের নির্লজ্জ ব্যক্তিপূজা, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ—দেশকে এক খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

ইন্দিরা গান্ধীকে ইতিহাস কীভাবে মনে রাখবে?

প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করে সাধারণ মানুষকে একটা স্থিতিশীলতা দিয়েছিলেন, আবার সেই জাতীয়করণের ফলে বিড়লা থেকে আজকের আদানিরা তার নিযুতগুণ সুবিধা আদায় করলেন।

একই নেত্রীর বিদেশ নীতি প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ে ভারতকে দিয়েছিল আশ্বাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ভূমিকা তিনি নিয়েছিলেন তাতে তাঁর সাহস ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বর প্রমাণ পাওয়া যায়। পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম জাতিগত নির্মূল অভিযান করবার পরে, ২ থেকে ৪ লক্ষ বাঙালি ধর্ষিতা হবার পরে, সেই ভূখণ্ডের মানুষকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছেন এই শ্রীমতি গান্ধী।

আবার তিনিই ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম অকংগ্রেসি রাজ্য সরকার, কেরালার বামপন্থী সরকারকে ভেঙে দেবার অন্যতম হোতা!

ইন্দিরা গান্ধীকে ‘এশিয়ার মুক্তি সূর্য’ বললে বিষয়টা যেমন একপেশে হয়, তেমনই বলতেই হবে তিনি কুকুর শ্রেণীর নন, তিনি একটা বিশেষ অংশের মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। ‘শান্তির জন্য’ ভারতের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিনি সংকেত দিয়েছিলেন যে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ, আবার সেই তিনিই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ছুতো দেখিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে দেশে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন ।

শুধু নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কোনো সময়কাল বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে বিশ্লেষণ করা যায় না। তার জন্য ইতিহাসকে বিবেচনা করবার নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়। প্রয়োজন হয় একটা সময়কালের দূরত্ব।

সশস্ত্র শিখ চরমপন্থীদের নির্মূল করতে পাঞ্জাবের একটি শিখ মন্দিরে সেনাবাহিনীর অভিযানের পরে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের রক্ষীদের হাতে নিহত হন ১৯৮৪ সালে। তাঁকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিল সেই সময়ে রক্ষী বাহিনীতে শিখ ধর্মের প্রহরী না রাখতে। অসাম্প্রদায়িক ও সাহসী এই নারী সেই কথা শোনেননি।

এই মৃত্যু তাঁর চরিত্রের মতোই ব্যঞ্জনাময়।

এই মাস তাঁর জন্মমাস, আসুন তাঁকে একবার স্মরণ করে তাঁর বহুমুখীন চরিত্রকে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করি, আজকের প্রেক্ষিতে ভারতের ইতিহাসে তাঁর গুরুত্বকে পুনর্মূল্যায়ন করি। 

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।