সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

অথ ডেনিসোভান কথা

অথ ডেনিসোভান কথা

তুষার মুখার্জী

জুন ১৯, ২০২১ ১০৫৬ 8
প্রাথমিক কথন

নিয়েণ্ডারথালদের অনেক কথাই জানা গেছে। বিশেষ করে গত এক দেড় বছরে নিয়েণ্ডারথালদের নিয়ে গবেষণায় জোয়ার এসেছে। ফলে অনেক নতুন কথা জানা গেছে। তারই সাথে স্বাভাবিকভাবেই আগেকার অনেক ধারণা বাতিল হয়ে গেছে।

তুলনায় ডেনিসোভানদের বিষয়ে আমাদের জানার পরিমাণ একেবারেই অতি সামান্য ছিল এতকাল। কিন্তু সদ্য সদ্য একটি নতুন প্রত্ন ক্ষেত্রের নতুন করে যাচাই করা আর বিশেষ করে জেনেটিক তথ্যের নিত্য নতুন আবিষ্কার আমাদের খানিকটা হলেও চমক দেবে।

হাইডেলবার্জেনেসিসদের থেকে বিবর্তিত হয়ে স্যাপিয়েন্স, নিয়েণ্ডারথাল, ডেনিসোভান ও অজানা আরেকটি মানবগোষ্ঠী একসময় পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছে বারে বারে। তাদের মধ্যে জিন বিনিময় হয়েছে। যদিও বর্তমানে পৃথিবীতে নিয়েণ্ডারথাল, ডেনিসোভানরা নেই, নেই তাদের মিলনের সন্তান সন্ততিরা। তবু জেনেটিক্স জানাচ্ছে নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভানদের সন্তান ছিল। এবং আমরা স্যাপিয়েন্সরাও কোন নিখাদ মানুষ নই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বারে বারে মিলিত হয়েছিল অন্য প্রাচীন মানব শাখার সাথে, যারা রেখে গেছে তাদের জেনেটিক তথ্য আমাদের মধ্যে। ফলে স্যাপিয়েন্সদের কিছুটা হলেও সঙ্কর মানব বলা যেতেই পারে।

একসময় নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভান সন্তান, এবং ডেনিসোভান-স্যাপিয়েন্স সন্তান, নিয়েণ্ডারথাল-স্যাপিয়েন্স সন্তান ছিল। আমরা বর্তমান স্যাপিয়েন্সরা অনেকেই নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভান-স্যাপিয়েন্স মিশ্রিত ধারার লোক।

নিয়েন্ডারথল ডেনিসোভানরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এমন ধারণায় বদল আসছে। এখন বলা হচ্ছে সম্ভবত তারা কেউ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, সংখ্যাধিক স্যাপিয়েন্সদের সাথে মিলিত হতে হতে তাদের নিজস্বতা বাজায় রাখতে না পেরে স্রেফ অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আর সদ্য জানা গেছে নিয়েণ্ডারথাল, ডেনিসোভানদের থেকে স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্কেরর গঠনপ্রক্রিয়া একেবারেই ভিন্ন ছিল, এবং স্বভাবতই চিন্তাধারাও একেবারেই ভিন্ন থাকার সম্ভাবনা থাকছে।

জানা গেছে স্যাপিয়েন্সদের মধ্যে আছে এমন ২৬৭টি জিন যা স্যাপিয়েন্সদের সৃজনশীলতার মূল সহায়ক। এই জিনগুলো নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের মধ্যে না থাকায় সৃজনশীলতায় তারা স্যাপিয়েন্সদের থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে থাকবে।

নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের থেকে স্যাপিয়েন্সদের বিপাকক্রিয়া ভিন্ন হওয়ায় স্যাপিয়েন্সরা অর্জন করেছে ক্ষীণতর দেহাবয়ব, যা তাদের কর্মতৎপর হতে সাহায্য করেছে।

নিয়েণ্ডারথাল

নিয়েন্ডারথলদের ঘিরে যে গুহাবাসী-রোমশ-স্বল্পবুদ্ধি এমন সব ধারনা প্রচলিত ছিল তার বদল ঘটেছে গত তিন বৎসরে। এখন জানা গেছে নিয়েণ্ডারথালদের Y-ক্রমোজম আসলে স্যাপিয়েন্সদের Y- ক্রমোজম। ১ লক্ষ থেকে ২.৫ লক্ষ বছর আগে নিয়েণ্ডারথাল আর স্যাপিয়েন্সদের মিলনে নিয়েণ্ডারথালরা তাদের Y-ক্রমোজম হারিয়েছে, কারণ তাদেরগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল। আর আজ থেকে ১ লক্ষ বৎসর বা তার কিছু আগে নিয়েণ্ডারথালরা খুইয়েছে তাদের মাইটোকন্ড্রিয়া।

ফলে ৪০ – ৪৫ হাজার বছর আগের নিয়েণ্ডারথাল আর স্যাপিয়েন্সদের মিশ্রণকালে নিয়েণ্ডারথালদের নিজস্ব Y-ক্রমোজম ও মাইটোকন্ড্রিয়া বলে কিছু ছিল না। সেগুলো ছিল স্যাপিয়েন্সদের। তবে তাদের মস্তিষ্ক গঠন অবশ্য তাদের নিজস্ব ছিল। ফলে তাদের ভাবনা-চিন্তা সামাজিক আচরণ হবার কথা স্যাপিয়েন্সদের থেকে আলাদা।

কাজেই নিয়েণ্ডারথালদের শানদার কবরে ফুলের রেণু দেখে, আধুনিক কালের স্যাপিয়েন্সদের মতই তাদেরও পারলৌকিক ভাবনা ছিল বা ধর্ম বিশ্বাস ছিল, এমন ভাবনা ফিরে ভাবার সময় এসেছে। সহজ কারণ, তারা আমাদের মত করে ভাবতো না। হতে পারে তারা আমাদের চেয়ে কোটি গুন বেশি ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিল, অথবা ঈশ্বর আছে কি নেই তা নিয়ে তারা আদৌ মাথা ঘামাতো না। এর যে কোন একটা সত্যি হতে পারে।

মস্তিষ্কের গঠন প্রণালীর বিভিন্নতায় কারা বেশি বুদ্ধিমান তা বলা সম্ভব না। তবে অনুমান করা যেতে পারে, নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভানদের চিন্তাধারা সম্ভবত খানিকটা হলেও পূর্বতন প্রাইমেটদের মত ছিল। কিন্তু যেহেতু প্রাইমেট শিম্পাঞ্জিদের চেয়ে নিয়েণ্ডারথালদের মস্তিষ্কের আয়তন তিন গুণ তাই শিম্পাঞ্জিদের চেয়ে তাদের ভাবনা জটিলতর উন্নততর অথচ দ্রুততর ছিল এমনটা ভাবা যেতে পারে। প্রসঙ্গত ডেনিসোভানদের কোন খুলি পাওয়া যায়নি বলে তাদের মস্তিস্কের আয়তন জানা নেই।

যদিও প্রাইমটদের মস্তিষ্কের কার্যপ্রণালী এবং কিছু সামাজিক আচরণ থেকে একটা আন্দাজ করে ভাবা যেতে পারে যে, হয়ত, আবেগের ব্যাপারে প্রাইমেট নিয়েণ্ডারথাল⁄ডেনিসোভানদের সাথে স্যাপিয়েন্সদের হয়ত বিশেষ কোন তফাৎ ছিল না, তবু আধুনিকতম আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় স্যাপিয়েন্সদের সমকক্ষ সৃজনশীলতা অন্যদের মধ্যে ছিল না। ২৬৭টি বিশেষ জিন স্যাপিয়েন্সদের সৃজনশীলতার উৎস। এই জিন আর কারুর মধ্যে ছিল না। এগুলো একান্ত ভাবেই স্যাপিয়েন্সদের। এবং আমার ধরে নিতে পারি যে এই ২৬৭টি জিনই স্যাপিয়েন্সদের সাফল্যের ধারক বাহক।

ডেনিসোভানদের বিস্তার – মানচিত্রের মাধ্যমে

ডেনিসোভান

রাশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চলের আলতাই পর্বতমালার এক গুহা। ১৮ শতকের ডেনিস নামে একজন ধার্মিক সাধু ঐ গুহায় বাস করতেন। তাঁরই নাম থেকে গুহার নাম হয়ে যায় ডেনিসোভা। গুহাটির বিশেষত্ব হল সারা বছর এর গড় তাপমাত্রা থাকে শূন্য ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ফলে এই গুহার প্রাচীন দেহাবশেষের ডি.এন.এ সংগ্রহযোগ্য অবস্থায় থেকে যায়।

রাশিয়ার ডেনিসোভা গুহার কাছাকাছি দেশগুলো হল মঙ্গোলিয়া, চিন, কাজাখস্তান। লুপ্ত প্রায় ক্যানডিস (Candis) নামের সর্বভুক কুকুরজাতীয় প্রাণীর খোঁজ করতে করতে গুহাটি প্রথম নজরে আসে ১৯৭০ সালে, রাশিয়ার প্যালিওন্টোলোজিস্ট নিকোলাই ওভোডভের।

২০০৮ সালে রাশিয়ান সায়েন্স একাডেমির মাইকেল শুনকোভ (Michael Shunkov) ও আরো কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের সাথে একত্রে এই গুহাতে কাজ করার সময়ে পান একটি আঙুলের হাড়ের টুকরো। প্রথমে এর বয়স অনুমান করা হয় ৫০ থেকে ৩০ হাজার বৎসরের প্রাচীন বলে। পরবর্তী কালে আবার পরীক্ষার পরে এর বয়স বদলে ঠিক হয় ৭৬,২০০ থেকে ৫১,৬০০ বছর প্রাচীন। যেহেতু এই হাড়ের টুকরো থেকে সংগৃহীত মাইটোকন্ড্রিয়া ছিল নিয়েণ্ডারথাল আর স্যাপিয়েন্সদের থেকে আলাদা তাই তখন নাম রাখা হল X-মহিলা, বা অজানা গণের মহিলা।

আঙুলের হাড়


এই ডোনিসোভা গুহায় প্রাচীন মানবদের আরো কিছু হাড়ের অংশ পাওয়া গেছে। এগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে পাঁচজন আলাদা প্রাচীন মানবের অস্তিত্ব জানা গেল। এদের নামাকরণ হল ডেনিসোভা-২, ডেনিসোভা-৩, ডেনিসোভা-৪, ডেনিসোভা-৮, আর ডেনিসোভা-১৩, এদের মধ্যে ডেনিসোভা-২ প্রাচীনতম। তারপরেই আসবে ডেনিসোভা-৮। ডেনিসোভা-৩ ডেনিসোভা-৪ কমবেশি সমসাময়িক। গ্রীক বিজ্ঞানী ক্যাটেরিনা ডোকা (Katerina Douka) ডেনিসোভা-২ প্রাচীনত্ব নির্দ্ধারণ করেন ১,৯৫ হাজার থেকে ১,২২,৭০০ শত বছর। গুহায় প্রাচীন মানবদের বসবাসের সময় ধরা হল ২,৮৭ (±৪১) হাজার বছর থেকে ২,০৩ (±১৪) হাজার বছর আগে। নিয়েণ্ডারথালরা এখানে ছিল ১৯৩ (±১২) হাজার থেকে ৯৭ (±১১) হাজার বছর আগে।

এই গুহাতে পাওয়া গেছে ৪০ হাজার বৎসর আগেকার নানা হাতিয়ার-সরঞ্জাম। তবে এগুলো নিয়েণ্ডারথালদের তৈরি না ডেনিসোভানদের তৈরি তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। বেশ কিছু আছে স্যাপিয়েন্সদের তৈরিও হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত কয়েকটি উপাদান

ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া গেছে ৩২ হাজার বছর আগেকার লুপ্ত প্রজাতির ঘোড়ার হাড়। তাছাড়া প্রায় ২৭ রকমের ভিন্ন ভিন্ন এমন সব প্রাণীর হাড় যাদের অনেকই এখন লুপ্ত। এখানে নানা জন্তুর মধ্যে গুহাবাসী হায়না, গুহাবাসী সিংহ, এছাড়াও ৩৯ রকমের বিভিন্ন স্তন্যপায়ী জীবেরও বসবাস ছিল। আনুমানিক ৫৬ রকমের পাখিরও অস্তিত্ব ছিল।

গুহাতে পাওয়া গিয়েছে অলংকার হিসাবে ব্যবহৃত হতো এমন নানা জিনিষ। যেমন হাড়ের, ম্যামথের দাঁতের, উট পাখির ডিমের খোলার নানা জিনিষ, পাওয়া গিয়েছে নীলচে সবুজ পাথরের তৈরি করা বালার টুকরো, যার মধ্যে নক্সা হিসাবে করা আছে ছোট ছোট ফুটো। ফুটো করা পাথরের লকেট, আর ৭০মিলিমিটার লম্বা হাড়ের সূচ। ২০১৬ সালে পাওয়া এই সূচ, সম্ভবত প্রাচীনতম সূচ (আনুমানিক ৫০ হাজার বছর আগের)।

২০১৯ সালে সাইবেরিয়ান টাইমস জানাচ্ছে এই গুহায় পাওয়া গিয়েছে ম্যামথের দাঁতের থেকে বানানো গুহাবাসী সিংহের পুতুলাকৃতি মূর্তি। গুহার ১১তম স্তরের দক্ষিণাংশে, ৪২ মিমি লম্বা, ১১ মিমি উঁচু, ৮ মিমি পুরো এই পুতুলাকারের মূর্তির বয়স আনুমানিক ৪৫ হাজার বৎসর। পুতুলাকৃতি মূর্তিটির পেছনের পা, কোমর, পেটে ১৮ সারির খাঁজ কেটে কেটে করা অলঙ্করণ করা ছিল। সদ্য পাওয়া খবর, যদিও এখনো অনেক পরীক্ষা বাকি। যদি সঠিক বলে গৃহীত হয় তবে নিঃসন্দেহে এটি হবে পৃথিবীর প্রাচীনতম সিংহের মূর্তি।

ডোনিসোভান

২০০৮ সালে ডেনিসোভা গুহায় পাওয়া আঙুলের হাড়ের জেনেটিক তথ্য জানা গেল ২০১০ সালে। জানা গেল ডেনিসোভানদের অস্তিত্ব। ডেনিসোভা গুহাতে পাওয়া তাই অজানা গণটির নামাকরণ হল ডোনিসোভান। আনুমানিক ৭ লক্ষ বছর আগে, হাইডেলবার্জেনেসিস বা সমসাময়িক অন্য কোন আদিম মানব শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা, তাদের নিজেদের বিচ্ছেদের বয়স ছিল আনুমানিক চার লক্ষ বছর। আর ডেনিসোভান⁄নিয়েণ্ডারথাল শাখা থেকে আরেকটি শাখা ভাগ হয় ৫.৫ লক্ষ বছর আগে। এই শাখা থেকেই পরে আসবে স্যাপিয়েন্সরা।

যেহেতু উৎপত্তি এক তাই এই তিন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে শারীরিক মিলনে পরবর্তী প্রজন্মের সৃষ্টি হতে জেনেটিক সমস্যা থাকার কথা নয়। গুহাবাসের সময়সারণী দেখলে বোঝা সহজ যে নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভানরা একই সময়ে বসবাস করত। ফলে এদের মিশ্রণে সন্তান সন্ততির সম্ভাবনা থাকছেই এবং সেই সম্ভাবনাকে সত্যি প্রমাণ করে দেখা পাওয়া গেল ডেনির।

ডেনিসোভা গুহায় প্রাপ্ত কয়েকটি উপাদান


ডোনিসোভা-১১ বা ডেনি

২০১৬ সালে ডেনিসোভা গুহায় সংগ্রহ করা কয়েক হাজার বিভিন্ন প্রাণীর হাড়ের নমুনা নমুনা ঘাঁটছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এস.সি. ছাত্রী সামান্থা ব্রাউন। উদ্দেশ্য, হাড়ের কোলাজেন প্রোটিন থেকে প্রাণীর পরিচয় জানা। এই কাজ করতে করতে একটুকরো হাড়ের যে প্রোটিন পেলেন তা কোন প্রাণীর নয়, তা হোমিনিন প্রজাতির। হাড়ের ঘনত্ব দেখে সামান্থা অনুমান করলেন বয়স ১৩ বছর হবে। স্বভাবতই এবার গুরুত্বপূর্ণ নমুনাটি চলে গেল পরবর্তী বিশ্লেষণের জন্য ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটে।

সামান্থা ব্রাউনের এই আদিম মানবের প্রোটিন পাওয়ার ঘটনা নিয়ে হার্ভার্ড স্কুল অফ মেডিসিনের পপুলেশন জেনেটিস্ট (পরে লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্লার্ক ইন্সটিটিউটে চলে আসেন) Pontus Skoglund বলেনঃ- এমন সঙ্কর মানুষের খোঁজ পাওয়ার ঘটনা অসাধারণ ঘটনা। বিজ্ঞানের কীর্তি ছাড়াও কিছুটা ভাগ্যেরও ব্যাপার। এ একেবারে সোজাসাপটা তথ্য। শিগগিরই এ তথ্য পাঠ্য বইতেও সরাসরি স্থান পাবে।

শুরুতে চলিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই ১৩ বৎসর বয়সী কিশোরীর নামাকরণ হল ডেনিসোভা-১১, পরে তার একটি আদুরে ডাকনাম চালু হয়ে গেল “ডেনি”। ১৩ বৎসরের ডেনির হাড় থেকে সংগৃহীত ডি.এন.এ. বিশ্লেষণ করা হয় ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ফর ইভল্যুশনারী অ্যানথ্রপলজি, লিপজিগ, জার্মানিতে। নেতৃত্বে ছিলেন স্বান্তে পাবো আর ভিভিয়ান স্লন।

২০১৬ সালে বিশ্লেষণের ফল প্রকাশ পেল। ডেনি কিশোরী, কম করেও ১৩ বৎসর বয়স। তার মা নিয়েণ্ডারথাল, বাবা ডেনিসোভান।

বিজ্ঞানীদের কল্পনায় ডেনি

ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটে প্রথমে বিশ্লেষণ করা হয় ডেনির মাইটোকন্ড্রিয়া। দেখা গেল সে নিয়েণ্ডারথাল। স্বাভাবিক। কারণ তার মা ছিল নিয়েণ্ডারথাল। কিন্তু সংগৃহীত ডি.এন.এ. তে সমগ্র জেনোম বেশ ভালো অবস্থায় থাকায় বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন গোটা জেনোমটাই দেখা যাক। এবং তখনই পাওয়া গেল ডেনির বাবার খবর। তার বাবা ডেনিসোভান। খবরটা প্রথমে চমকে দেবার মতই ছিল, ফলে স্বান্তে পাবোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম নিরীক্ষার সময়ে নির্ঘাত কোথাও গোলমাল ঘটিয়েছে’।

তারপরে বিস্মিত স্বান্তে পাবো দেখলেন, প্রতিটি ক্রোমোজোমের জুড়িতে দেখা মিলছে একটি নিয়েণ্ডারথাল তো অপরটি ডেনিসোভান। সব সন্দেহের অবসান হল। নিশ্চিত ভাবে জানা গেল ডেনির মা নিয়েণ্ডারথাল বাবা ডেনিসোভান।

আরো জানা গেল যে, ডেনির জন্ম কোন আচমকা ঘটনা নয়। ডেনি প্রথম প্রজন্মের সঙ্কর সন্তানও নয়। ডেনির বাবাও ছিলেন নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভনের সঙ্কর। এরই সাথে আরেকটু খবর যোগ হল, ডেনির মা নিয়েণ্ডারথাল বটে কিন্তু স্থানীয় নয়, তার পূর্বপুরুষেরা এসেছিল সুদূর পশ্চিম ইয়োরোপ থেকে। নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভান জনক-জননীর সঙ্কর সন্তান যে কখনো না কখনো দেখা যাবেই তা বিজ্ঞানীরা আগেই অনুমান করেছিলেন।কাজেই সেই হিসেবে বিজ্ঞানীরা অবাক হবার বদলে স্বস্তির শ্বাস নিলেন। তাঁদের অনুমান অভ্রান্ত ছিল।

ডেনির জন্ম নেহাতই ঘটনাক্রমের বদলে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই স্বান্তে পাবো মনে করেন, (ডেনির খোঁজ পাওয়ায়) নিজেদের অতটা ভাগ্যবান না ভাবলেও চলবে। এই দুই শাখা মানবগোষ্ঠীর পরস্পরে দেখা হবার পরে তারা স্বচ্ছন্দে নিয়মিতই মিলিত হত।

তিব্বতে ডেনিসোভান

ডেনির মা-বাবা নিয়েণ্ডারথাল আর ডেনিসোভানরা পরস্পরের থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল ডেনির জন্মের প্রায় ৩৯০ হাজার বছর আগে। আর স্যাপিয়েন্সদের শাখাটি থেকে তারা আলাদা হয়ে গিয়েছিল আরো আগে, প্রায় ৫৫০ হাজার বছর আগে।

কিন্তু মানব প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন শাখা গণের মিলনের মাধ্যমে বংশধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম সুস্থ সন্তান জন্ম হতে পারে, এমন ধারণায় খানিক বাধো বাধো ঠেকবে। কারণ প্রচলিত ধারণায় একে সমর্থন করে না।এখানে স্বান্তে পাবোর মতে আমাদের প্রজাতি ভেদ ধারণা হয়ত সর্বাংশে সঠিক নয়। তবু প্রচলিত প্রজাতি ধারণাকে ভ্রান্ত বলার বদলে স্বান্তে পাবো প্রথম প্রজন্মের নিকট শাখাগুলোকে (ডেনিসোভান, নিয়েণ্ডারথাল, স্যাপিয়েন্স) প্রজাতি বা গণ বলার বদলে দল বা গোষ্ঠী বলে অভিহিত করতে চান। ওনার মতে এতে বিতর্ক এড়ানো যাবে।

কারণ ডেনিসোভান, নিয়েণ্ডারথাল, স্যাপিয়েন্স বাদেও আরেকটি বা আরো কয়েকটি অজানা শাখা যে পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেছে, পরস্পরের সাথে বহুবার মিলিত হয়েছে, তাদের বংশধারা বিস্তার লাভ করেছে, এইসবের ব্যাখ্যা আগেকার সরলরৈখিক অনুমানের চেয়ে বহু বহুগুণ জটিলতর। আধুনিক স্যাপিয়েন্সদের অতীত সরলরেখায় টানা দাগ নয়, তার মধ্যে বহু বাঁক আছে। ফলে আগেকার বিভিন্ন সংজ্ঞা হয়ত যথেষ্ট হবে না।

তিব্বতিদের মধ্যে ডেনিসোভান জিন আছে, সেটা আগেই জানা ছিল আমাদের। তার সাথে এটাও অনুমান করা হয়েছিল তিব্বতিদের অত স্বল্প অক্সিজেনের আবহাওয়ায় বাস করার ক্ষমতা এসেছিল ডেনিসোভান জিনের প্রোটিন EPAS1 থেকেই। কিন্তু একটা সংশয় ছিল, ডেনিসোভানরা তো সমতলের বাসিন্দা, তাহলে তাদের স্বল্প অক্সিজেনে বসবাসের সাহায্য করার মত জিনে EPAS1 থাকবে কেন? সেটা থাকার জন্য ডেনিসোভানদেরও তো কম অক্সিজেনের এলাকা তিব্বত মালভূমিতে অতি দীর্ঘকাল বসবাস করতে হয়। অথচ তাদের বাসস্থান বলতে একমাত্র জানা স্থান ছিল সাইবেরিয়ান সমতলের ডেনিসোভা গুহা। তিব্বতে মানুষদের বসবাসের প্রাচীনতম তথ্য বলে ৩০-৪০ হাজার বৎসর আগে সেখানে স্যাপিয়েন্সরা ছিল। কিন্তু ডেনিসোভানরাও ছিল এমন কিছু প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অবশেষে পাওয়া গেল ডেনিসোভানদের, তিব্বতেও, বাইশিয়া কার্স্ট গুহায় (Baishiya Karst Cave, Xiahe County, Gensu Province, China)।

বাইশিয়া গুহায় পাওয়া যায় একটি ডানদিকের নিচের চোয়ালের হাড়, সাথে দুটি দাঁত। পাওয়া গিয়েছিল অনেক আগে, ১৯৮০ সালে। তখনই আনুমানিক বয়স নির্ধারণ করা হয় ১,৬০ হাজার বৎসর আগেকার বলে। এটি রাখা ছিল চিনের ল্যানঝাউ বিশ্ববিদ্যালয়ে (Lanzhou University)।

এর ত্রিশ বৎসর পরে ২০১০ সালে ডংজু ঝ্যাং (Dongju Zhang) প্রথমবারের মত হাড়ের টুকরোটি ভালোভাবে পরীক্ষা করেন। সমস্যা হল গুহায় পাওয়া অন্য প্রাণীদের ডি.এন.এ. পেলেও চোয়ালের হাড় থেকে কোন ডি.এন.এ. পাওয়া যায়নি। অতএব এক অভিনব পন্থা নেওয়া হল। দাঁতের থেকে পাওয়া গেল প্রোটিন। সেই প্রোটিন মিলিয়ে দেখা হল বিভিন্ন প্রাইমেট, নিয়েণ্ডারথাল, ডেনিসোভানদের আর স্যাপিয়েন্সদের থেকে সংগৃহীত প্রোটিনের সাথে।


ডেনিসোভানদের একটি মোলার দাঁত

দেখা গেল বাইশিয়া গুহার দাঁতের প্রোটিন বহুলাংশে মিলে গেছে ডোনিসোভার ডেনিসোভানদের সাথে। অতএব বাইশিয়া গুহার প্রাচীন বাসিন্দা যে ডেনিসোভান তাতে আর কোন সন্দেহ থাকলো না। এই গবেষণা আর তার ফল প্রকাশেও লেগে গেল বেশ লম্বা সময়। ২০১৯-এ নেচার জর্নালে, ও কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের KAR জার্নালে ফল প্রকাশিত হল। পরীক্ষা হয়েছিল একাধিক প্রতিষ্ঠানে, যারমধ্যে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট ও ছিল।

একই সাথে প্রত্ন-বয়স বের করার জন্য আরেকটি পরীক্ষা করা হল। সেই ফলে জানা গেল হাড়টির বয়স ১৬৪.৫ (±৬) হাজার। যে স্তরে পাওয়া গেছে তার উপরের স্তরের বয়স ১৫৫ (±১৫) হাজার বছর আর নিচের স্তরের বয়স ১৬৩ (±১০) হাজার বছর। হিসেব প্রায় মিলেই গেছে। লম্বা সময়ের অনুপাতে প্রভেদ খুব বেশি না। তাই গড়ে হিসেব করে ধরা হল চোয়ালের হাড়ের বয়স ১৬০ হাজার বছর হবে। প্রথমে যা অনুমান করা হয়েছিল সেটাই বজায় থাকল।

বাইশিয়া গুহার এই চোয়ালের হাড় আর দাঁতের বাহ্যিক গঠনেরও তুলনামূলক যাচাই করে দেখা হল। দেখা গেল, এটি হোমো ইরেক্টাসদের গোত্রের হলেও ইরেক্টাসদের থেকে আলাদা। নিয়েণ্ডারথালদের সাথে খানিক মিল থাকলেও বেশি মিল পাওয়া গেল ডেনিসোভার ডেনিসোভানদের সাথে। স্যাপিয়েন্সদের সাথেও তেমন কিছু মিল নেই। আরেকটি তুলনীয় চোয়ালের হাড় দেখার ছিল, তা হল তাইওয়ানের পেনঘু-১ এর সাথে। তার সাথেও কিন্তু বেশ খানিক মিল পাওয়া গেল।

ডেনিসোভা গুহা ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭০০ মিটার উপরে আর বাইশিয়া গুহা ৩২৮০ মিটার উচ্চতায়। ফলে এটা পরিষ্কার যে এই উচ্চতায় বসবাসকারী ডেনিসোভানদের মধ্যেই কেবল প্রোটিন EPAS1 থাকা সম্ভব। কারণ ঐ প্রোটিন না থাকলে অত উচ্চতায় অত কম অক্সিজেনে দীর্ঘকালীন বসতি গড়া সম্ভব হত না।


এরই সাথে প্রাচীন মানুষদের খোঁজার গবেষণার পথে আরেকটি পথও খুলে গেল। ডি.এন.এ. না পেলেও দাঁতের বা হাড়ের গায়ের প্রোটিন থেকে সেই মানুষদের প্রাথমিক পরিচিতি অনুধাবন করা সম্ভব।

ডেনিসোভান চোয়ালের হাড়

বাইশিয়া কার্স্ট গুহায় ডেনিসোভান মাইটোকন্ড্রিয়াল অবশেষে এই বাইশিয়া গুহাতেও পাওয়া গেল ডেনিসোভান মাইটোকন্ড্রিয়াল। ২০২০ সালে চিনের বিজ্ঞানীরা Scienceবিজ্ঞান জার্নালে জানান চাইনিজ একাডেমি অফ সাইন্সের অধীন তিব্বেতান প্ল্যাটু রিসার্চের বিজ্ঞানী অধ্যাপক চেন ফাহু ঐ বাইসিয়া গুহায় নানা প্রাণীর প্রাচীন ডি.এন.এ. সংগ্রহ করার সময়ে ডেনিসোভান মাইটোকন্ড্রিয়ালও সংগ্রহ করতে পেরেছেন।

ঐ গুহার সর্বনিম্ন স্তরের বয়স ১৯০ হাজার বছর আর সর্বোচ্চ স্তরের বয়স ৪০ হাজার বা তার কিছু কম বছর। সেখানে তাঁরা পেয়েছেন বহু প্রাণীর দেহাস্থি, তাদের অনেকের হাড়ে এমন কাটা চিহ্ন ছিল যা কেবল মানুষই করতে পারে। এখান থেকে তাঁরা ২৪২ রকমের প্রাণীর অস্থি ও নানা প্রাণীর প্রাচীন মাইটোকন্ড্রিয়াল সংগ্রহ করেছেন, যার মধ্যে আছে ডেনিসোভান মাইটোকন্ড্রিয়ালও। ডেনিসোভান মাইটোকন্ড্রিয়ালটির বয়স বের করা হয়েছে ৬০ হাজার বৎসর। এবং সেটি ডেনিসোভাতে পাওয়া মাইটোকন্ড্রিয়ালের সাথেই মেলে। যেহেতু একেবারে উপরের স্তরে অনেক কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে আগেই, তাই ডেনিসোভানরা এখানে কতদিন ছিল সেটা বলা কঠিন।১৩

তাইওয়ানের পেনঘু-১১১

তাইওয়ানের পেনঘু দ্বীপে জলের তলায় ২০০৮ সালে পাওয়া যায় চোয়ালের হাড়, দাঁত সহ। এলাকাটি এখন জলের তলায় হলেও একসময় এটা মুল ভূমির সাথেই যুক্ত ছিল। ২০০৮ সালে পাবার পরে ২০১৫ তে তাইওয়ান, জাপান, ও অস্ট্রেলিয়ার একদল বিজ্ঞানী এটি ভালো ভাবে পরীক্ষা করেন। যে ভূমিস্তরে পাওয়া গেছে তার বয়স ৪৫০ হাজার বৎসরের থেকে কিছু কম। কিন্তু ঐ এলাকায় সমুদ্রের স্তর অনেকবার ওঠানামা করেছে। ফলে এর বয়স ১৯০ থেকে ১৩০ হাজার বছর, অথবা ৭০ থেকে ১০ হাজার বছর যা কিছু হতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা করা হল।

চোয়ালের গঠন থেকে অনুমান, এটির ধাঁচ খানিক মেলে হোমো-হ্যাবিলিসদের সাথে অথচ পুরো তাও না। হোমো-ইরেক্টাসদেরও সাথেও তেমন কোন মিল নেই যে বলা যাবে এ হোমো ইরেক্টাস। আবার স্যাপিয়েন্সদের সাথেও তো মিল নেই। নিয়েণ্ডারথালদের সাথেও না। তাহলে কাদের? প্রথমে ভাবা হল এরা জাভাদ্বীপে পাওয়া জায়গান্টিপিথেকাস ব্ল্যাকিদের গোত্রের, খানিক বদল হয়েছে ভূপ্রকৃতি অনুযায়ী। সেই মতবাদ খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে না হওয়ায় কিছু বিজ্ঞানী একে একেবারে নতুন গোষ্ঠী হিসাবে নাম দিয়ে দিলেন হোমো সাইচানজেন্সিস (Homo tchaichangensis)। ২০১৫-তে চিনা বিজ্ঞানী সিনঝি উ বললেন, কিস্যু না, এটি হল আদিম হোমো স্যাপিয়েন্স। কিন্তু ২০১৯ এ এসে সব হিসেব পাল্টে গেল, দেখা গেল, তিব্বতের বাইশিয়া গুহায় পাওয়া চোয়ালের হাড়ের সাথে এর মিল সবচেয়ে বেশি।১১ তবে কি পেনঘু-১ ও ডেনিসোভান? প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে ইশারা সেই দিকেই। ডেনিসোভানরা সমভূমিতে ছিল, সমুদ্র ঘেরা দ্বীপে ছিল, ছিল পৃথিবীর ছাদ তিব্বতেও।


তিব্বতে স্যাপিয়েন্সরা

তিব্বতে ডেনিসোভান থাকলেও তাদের সাথে কবে স্যাপিয়েন্সদের দেখা হল? উত্তর তিব্বতের এলাকা প্রায় ১২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার, গড় উচ্চতা ৪৫০০ মিটার। গরমকালে তাপমাত্রা ৫ থেকে ১০ ডিগ্রী আর শীতকালে (-)৪০ ডিগ্রী। বাৎসরিক গড় বৃষ্টি ২০০ মিলিমিটার। এমন চরম জলবায়ুর দেশে, যেখানে অক্সিজেনও খুব কম, সেখানে মানুষ বসবাস না করারই কথা, অথচ তিব্বতে আধুনিক মানুষেরা বাস করেছে ২০ থেকে ৪০ হাজার বৎসর আগেই।

লাসার থেকে ৩০০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে সিলিং কো বা সিলিং হ্রদ। সমুদ্রতল থেকে ৪৫৩০ মিটার উঁচুতে ১৮৬৫ বর্গকিলোমিটারের এই হ্রদ তিব্বতের দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ। হ্রদের পাড়ে ধাপে ধাপে উঁচু হয়ে আছে জমি। প্রতি ধাপে ভর্তি  অজস্র নুড়ি পাথর, চুনা পাথর, বালি পাথর, কোয়ার্টজ পাথর, আগ্নেয়শিলা, হরেক রকমের নুড়ি।

১৯৮৮ সালে চিন-জাপান যুগ্ম প্রত্ন অভিযানে এখানে পাওয়া গেল মানুষের তৈরি ও ব্যবহৃত পাথরের হাতিয়ার। মাত্র এক জায়গায় নয়, কুড়িটির বেশি প্রত্ন এলাকায় পাওয়া গেল এই পাথরের হাতিয়ার। হ্রদের জল মিশে থাকা নানা খনিজ শুকিয়ে নুড়ি এখনো তৈরি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন একেবারে হ্রদের গায়ের নিম্নতম ধাপের কার্বন ডেটিং হবে বর্তমান কালের বা শূন্য। কিন্তু সবাইকে চমকে বের হল সর্বাধুনিক নুড়ির বয়সও ৬.২ হাজার বৎসর।

স্বভাবতই উপরের ধাপের বয়স আরো বেশি হবেই। ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ ধাপের বয়স পাওয়া গেল চল্লিশ হাজার বছর। কিন্তু তিব্বত কি তখন আদৌ বসবাসের যোগ্য ছিল? সেই প্রথমদিককার মানুষের খাদ্য ছিল মরুভুমি প্রায় তিব্বতে? বিজ্ঞানীরা নানা এলাকায় ড্রিল করে মাটির নমুনা নিয়ে ফসিল হয়ে যাওয়া রেণু নিয়ে নানা পরীক্ষার শেষে জানালেন, আজ থেকে ৪০ হাজার বৎসর আগে তিব্বতের তাপমাত্রা এখনকার চেয়ে ৩-৪ ডিগ্রী বেশি ছিল। বৃষ্টিপাতও এখনকার চেয়ে অনেকটাই বেশি হত। আসলেই শুষ্ক আবহাওয়ার উপযুক্ত বনাঞ্চলও ছিল।

এই সব বদল হতে শুরু করে ৩১.৮ থেকে ২৩.৮ হাজার বছর আগে থেকে। তখন থেকেই বড় গাছ কমতে থাকে। শুরু হয় ঝোপঝাড়ের। তবে বড়গাছ তখনও অনেক ছিল, বিশেষ করে নদীর ধারগুলোতে। মোটকথা ৪০ হাজার বছর আগের তিব্বত বাসযোগ্যই ছিল। ২৩ হাজার বছর আগেও বসবাস একটু কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু ছিল না।

লাশার থেকে ৮৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আরেকটি প্রত্নক্ষেত্রে পাওয়া গেছে উনুন, হাতের-পায়ের ছাপ। সেই প্রত্ন ক্ষেত্রের বয়স বের হয়েছে ২১±২.১ হাজার ও ২০.৬±২.৯ হাজার বছর আগের।

এই বিজ্ঞানীদলের কাজের আগেই শিয়াও কাইডাম হ্রদ এলাকাতেও মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তখন ধরা হয়েছিল সেগুলো ২৩ হাজার বছর আগের। নতুন গবেষণা বলছে না এই সময় হবে অনেক আগের। প্রায় চল্লিশ হাজার বৎসর আগের।

সব সহ যে কথা পরিষ্কার বোঝা গেল যে প্রায় ৪০ হাজার বৎসর আগে থেকেই তিব্বতে মানুষের নিয়মিত বসবাস ছিল। আর সেই বসবাসের এলাকা ডেনিসোভানদের বাইশিয়া গুহার আশেপাশেই। কাজেই তাদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া, সামাজিক মিলন হওয়া খুব একটা অভাবনীয় নয়।

ডেনিসোভানরা দেখতে কেমন ছিল?

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই। নিয়েণ্ডারথালদের বহু দেহাবশেষ প্রায় সম্পূর্ণ কঙ্কাল হিসাবেই পাওয়া গেছে। এর সাথে তাদের জেনেটিক তথ্য মিলিয়ে নিয়েণ্ডারথালদের দেখতে কেমন ছিল তার মোটামুটি একটা ধারণা আমরা করতে পারি। কিন্তু ডেনিসোভানদের বেলা সেটা সম্ভব না। কারণ তাদের পূর্ণ দেহাবশেষ তো দুরের কথা তাদের করোটিও পাওয়া যায় নি। করোটি না পেলে সঠিক ধারণা করা প্রায় অসম্ভব।

নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভানদের সঙ্কর কিশোরী ডেনির জেনেটিক তথ্য বলছে তার ত্বক ও কেশ ছিল কৃষ্ণবর্ণ। চোখ ছিল বাদামী। কিন্তু সে তো সঙ্কর। তবু এটাও ঠিক যে ডেনিসোভান জিনও বলছে ডেনিসোভান ত্বক কৃষ্ণবর্ণ, তবে সেই কৃষ্ণ বর্ণের ভৌগোলিক এলাকা ভেদে তফাৎ ছিল।

ডেনিসোভান মুখমণ্ডল বাইশিয়া গুহার চোয়ালের হাড় থেকে খানিকটা অনুমান করা হয়েছে। তা হল ডেনিসোভানদের মুখমণ্ডল ছিল নিয়েণ্ডারথালদের চেয়ে চওড়া। তবে মুখ সামনের দিকে বের হয়ে থাকাটা নিয়েণ্ডারথালদের থেকে বেশি হলেও আমাদের থেকে কম ছিল। আর সম্ভবত তাদের কপাল নিয়েণ্ডারথালদের মত অতটা নিচু ছিল না। তবে সঠিক মাপজোক বলা কঠিন।

ডেনিসোভানদের বিভিন্ন শাখা

নিয়েণ্ডারথাল, ডেনিসোভান, স্যাপিয়েন্স – সকলেই একই মূল কাণ্ড থেকে বের হওয়া শাখা। অনুমান করা হয় চারটি শাখা বের হয়েছিল। যার মধ্যে একটি শাখার পরিচয় এখনো অজ্ঞাত। তারই মধ্যে প্রথমে জানা গেল ডেনিসোভানরা দুটো শাখায় বিভক্ত। তারপরে এখন জানা গেল ডেনিসোভানরা দুটো নয় তিনটে শাখায় বিভক্ত।

আগেকার মতানুযায়ী ডেনিসোভানদের দুটো, এখন তিনটি ঢেউয়ে মিশেছে স্যাপিয়েন্সদের সাথে।২,৩ বিজ্ঞানীরা এতকাল জানতেন ডেনিসোভানদের অস্তিত্ব কেবল ডেনিসোভা গুহাতে। তবে তারা যে শুধু সেখানেই আবদ্ধ ছিল না, তার জেনেটিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল পূর্ব-এশিয়া ও পাপুয়া নিউগিনির বাসিন্দাদের মধ্যে ডেনিসোভান জিনের অস্তিত্ব থেকেই। সবে আরো দুটো প্রত্নস্থল যোগ হল তিব্বতের বাইশিয়া আর তাইওয়ানের পেনঘু-১।

যদিও ডেনিসোভা গুহা থেকেই ডেনিসোভানদের প্রথম অস্তিত্ব আমরা জানতে পারি কিন্তু দেখা গেল ডেনিসোভানদের সর্বাধিক জেনেটিক বৈচিত্র্য আছে ডেনিসোভা গুহা থেকে ৮ হাজার কিলোমিটার দক্ষিণে, পূর্ব-ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়ানদের দেশ নিউগিনিতে। নিউগিনি সহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ এলাকা মানব সংস্কৃতির ও ভাষা বৈচিত্র্যের এক অনন্য সাধারণ এলাকা। এই এলাকাতেই হোমো-ফ্লোরোসিয়েন্সিসদের প্রায় আধুনিক মানুষদের বাসস্থান ছিল। এই এলাকাতেই ইন্দোনেশিয়ায়, ফিলিপিন্সে আছে নেগ্রিটোদের বাস। এলাকাটি নেহাত ছোট নয়, ভৌগোলিক এলাকার হিসাবে ইয়োরোপের চেয়েও বড়, অথচ এই এলাকার জেনেটিক তথ্য প্রায় কিছুই নেই।

আজ থেকে ৪৬ হাজার বৎসর আগে এখানে স্যাপিয়েন্সদের সাথে ডেনিসোভানদের প্রথম মিলন ঘটে। কিন্তু যে অবাক করার বিষয় তা হল প্রায় দশ হাজার বছর পরে, (এখন থেকে ৩৫ হাজার বছর আগে) আরেক বার নতুন করে স্যাপিয়েন্স আর ডেনিসোভানদের মিলন ঘটে এই নিউগিনিতে। এবং এই দুই ডেনিসোভান গোষ্ঠী কিন্তু ভিন্ন গোষ্ঠী।

নিউগিনি-প্রথম ঢেউ

কল্পনা করা যেতে পারে, ৭০ হাজার বৎসর আগে আফ্রিকা থেকে বের হয়ে আনুমানিক ৫০ হাজার বছর আগে আসা স্যাপিয়েন্সদের বসতি গড়ার সময়েই প্রথম দেখা ডেনিসোভানদের সাথে। দুটি ভিন্ন শিকারি-সংগ্রাহক জনগোষ্ঠী। এদের মিলনে ক্রমে একটি সঙ্কর জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। সেই সময়ে এক এলাকায় হয়ত ডেনিসোভানরা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু কতজন ছিল। জেনেটিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান ৩৫০ জনের এক একটি দল। যেহেতু তারা অনেক আগে থেকেই বসবাস করছে তাই তাদের জীবনধারণ-সামাজিক ব্যবস্থা অনেকটাই সংগঠিত ছিল। ফলে এমনও হতে পারে গোড়া তাদের মধ্যে সংঘর্ষের বদলে কিছুটা হলেও সহযোগিতাও গড়ে উঠেছিল। সেই থেকেই তাদের বাসস্থানে পরস্পরের আগমন।

নিউগিনি-দ্বিতীয় ঢেউ


এরপরে আরো দশ হাজার বৎসর পার হল। আজ থেকে ৩৫ হাজার বৎসর আগের কথা। যখন এই গোষ্ঠী খানিক থিতু হয়েছে, তাদের জনসংখ্যাও বেড়েছে, তখন আবার নতুন আরেকদল ডেনিসোভানের আগমন ঘটল। এরা সম্ভবত আগে থেকেই ভৌগোলিক ভাবে বিচ্ছিন্ন এলাকায় বাস করছিল। ক্রমে তাদের আগমন ঘটল মূল ভূমি নিউগিনিতে। এবং তারা আবার মিশে যেতে থাকল আগে থেকে বাস করা সঙ্কর লোকেদের সাথে।

নিউগিনি-তৃতীয় ঢেউ

নাহ্, এখানেই শেষ নয় আজ থেকে মাত্র ১৪.৫ হাজার বৎসর আগে আগমন ঘটল আরেকদল ডেনিসোভানের। তারা দ্বিতীয় পর্যায়ের সঙ্কর মানুষদের সাথে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করল তৃতীয় পর্যায়ের সঙ্কর মানুষদের। এই শেষতম ডেনিসোভানদের বসতি কোথায় ছিল সেটা হয়ত একটা রহস্য হয়েই থাকবে আরো বহুকাল। এই যে তিন তিনবারে ডেনিসোভানরা এলো নিউগিনিতে তার ফল হয়ত একটু বিচিত্র। নিউগিনির লোকেরা হল একেবারে রামধনু। কত যে বিভিন্ন চেহরার, আচরণের সংস্কৃতির উপজাতির দেখা মেলে এখান, বাইরের লোকের পক্ষে তার থই পাওয়া মুশকিল।

তবে এই বৈচিত্র্য আছে গোটা দক্ষিণপূর্ব এশিয়া জুড়েই। ফলে ধারণা করা যেতে পারে হয়ত ডেনিসোভানদেরই আরো শাখা ছিল, অথবা তাদের মত আরো একাধিক প্রাচীন জনগোষ্ঠী এই এলাকাতে স্যাপিয়েন্সদের সাথে ঘরকন্না করেছে।

নিয়েণ্ডারথালদের চেয়ে বেশিদিন টিকে ছিল ডেনিসোভানেরা?

এই শেষতম তথ্য, মাত্র ১৪.৫ হাজার বৎসর আগে পাপুয়ানদের সাথে ডেনিসোভানদের নতুন করে মিলন আরেকটি সত্য প্রতিষ্ঠা করে, তা হল নিয়েণ্ডারথালদের চেয়ে ডেনিসোভানরা অনেক বেশি কাল, ২৫হাজার বছর বেশি, এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল।

ডেনিসোভান জিনের বিস্তৃতি ও বৈশিষ্ট্য

ডেনিসোভান জিনের বিস্তৃতিতে পাপুয়া নিউগিনি ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ভবিষ্যতে এখান থেকেই ডেনিসোভানরাদের জিন চলে যাবে নিউ ব্রিটেন দ্বীপে, চলে যাবে অস্ট্রেলিয়ায়। কিন্তু তা ছাড়াও ওসানিয়ান দ্বীপগুলোতেও ডেনিসোভান জিন রয়েছে। আমরা এখনো জানি না সেই জিন তারা সরাসরি ডেনিসোভানদের থেকে পেয়েছে অথবা নিউগিনির লোকেদের থেকে পেয়েছে। যেভাবেই ডেনিসোভান জিন পাক না কেন, এই ওসানিয়া দ্বীপপুঞ্জ আর তার অস্ট্রোনেশিয়ান ভাষাভাষী লোকদের প্রাচীন কালেই নৌচালনার দক্ষতা অর্জনের বৈশিষ্ট্য তাদের নানা দ্বীপে তো বটেই একেবারে আমেরিকাতেও যেতে সুবিধা করে দিয়েছে। ফলে ল্যাটিন আমেরিকাতেও রয়েছে ডেনিসোভান জিন। খুব কম হারে, কিন্তু আছে।

ডেনিসোভান জিন রয়েছে গোটা দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে, বোর্ণিওতে তার মাত্রা খানিক বেশি। ডেনিসোভান জিন আছে ভারতেও। আছে আন্দামান-নিকোবরে, আছে মূল ভারত ভূমিতেও। এখানে জানতে ইচ্ছে হতে পারে বাঙালিদের মধ্যে আছে না নেই। দুঃখের কথা পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই উদ্দেশ্যে ডি.এন.এ. সংগ্রহ হয়নি। তবে বাংলাদেশ থেকে হয়েছে। দেখা গেছে অন্ধ্রের তেলেগুদের থেকে বাংলাদেশিদের মধ্যে ডেনিসোভান জিন কম হারে আছে, তবে পেরুর লোকেদের সাথে তুলনা করলে তাদের চেয়ে বেশিই আছে।

বিভিন্ন জায়গা পাওয়া ডেনিসোভান জিনের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছিল কিছু ফারাক। ফলে ডেনিসোভানরা দুই ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত এমন তত্ত্বের জন্ম হয়।২,৩ সেটাই সাম্প্রতিক কালে প্রমাণিত হলো যে দুই নয়, তিন তো বটেই হতে পারে আরো বেশি, আছে ডেনিসোভানদের শাখা।

প্রথমদিকে দুটো শাখা নিয়েই যখন বহু গবেষণা পত্র প্রকাশ পেতে থাকে তারই মধ্যে বাইশিয়া আর পেনঘু-র দুটি ডেনিসোভান চোয়ালও দুই শাখার ধারণা গুলিয়ে দিল। এই দুটি চোয়াল ডেনিসোভার ডেনিসোভানদের থেকে আলাদা। শুধু তাই নয়, বাইশিয়া আর পেনঘুর দুটি চোয়ালও নিজেদের মধ্যে আলাদা।

বিজ্ঞানীরা বুঝলেন এই জটিল ধাঁধার সমাধান আসলে সরল। মেনে নিতে হবে ডেনিসোভানরা তাদের কালে একাধিক শাখায় পৃথক হয়ে গিয়েছিল। এই পৃথকীকরণ ঘটেছিল ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা থেকে। হিমালয়ের উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণী উত্তরের থেকে দক্ষিণের ডোনিসোভানদের আলাদা করে রেখেছিল। আর ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝ খানের গভীর সামুদ্রিক এলাকা ওয়ালেস লাইনেও ডেনিসোভানদের বিভক্ত করে রাখে। ইয়োরোপে নিয়েণ্ডারথালদের কিন্তু এমন কোন ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতায় ভুগতে হয় নি।

ডেনিসোভানরা শুধুই তিন ভাগে ভাগ ভাবলেও পুরোটা বোঝা যাবে না, খেয়াল রাখতে হবে তাদের স্যাপিয়েন্সদের সাথে মিশ্রণের কালও ছিল বিভিন্ন। এবং কিছুটা এলাকা ভিত্তিক।

ডেনিসোভান- D2: ৪৬ ও ৩৫ হাজার বৎসর আগে। এলাকা পূর্ব-এশিয়া, দক্ষিণ-এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, নিউ ব্রিটেন দ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া, গোটা ওসানিয়া দ্বীপ সমূহ, ও সমগ্র অস্ট্রোনেসিয়ান ভাষা গোষ্ঠীর লোকের মাধ্যমে বিভিন্ন দ্বীপ সহ ল্যাটিন আমেরিকা। নিউগিনিতে নিয়েণ্ডারথাল জিন আসে ৫০-৬০ হাজার বছর আগে। ডেনিসোভান জিন ৪৪-৫৪ হাজার বৎসর আগে।এই তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা যেতে পারে সম্ভবত নিউগিনির প্রথম স্যাপিয়েন্স বাসিন্দারা এখানে আসার আগেই নিয়েণ্ডারথাল জিন বহন করছিল। তাই যদি হয়ে থাকে এটাও অনুমান যোগ্য যে যেহেতু তারা ভারত হয়ে এসেছে তাই ভারতের প্রথম বাসিন্দারাও ভারতে প্রবেশের আগে থেকেই সম্ভবত নিয়েণ্ডারথাল জিন বহন করছিল।

ডেনিসোভান-D1: ৩০ হাজার বৎসর ও ১৪.৫ হাজার বৎসর আগে। পাপুয়া নিউগিনিতে এই জিনের আগমন। এই ঘটনার কিছু আগে নিউগিনির পাপুয়ানদের সাথে একসাথে বাস করত বেইনিং উপজাতির লোকেরা। পরে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পাপুয়ানরা আর বেইনিংদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি কবে হয়েছিল? দুই ভিন্ন পদ্ধতিতে হিসেব করে দুটো সময় পাওয়া গেল ১৫৬৮০ আর ১৬২৮০ বৎসর। দুই ক্ষেত্রেই এক প্রজন্ম ধরা হয়েছে ২৯ বৎসর।

এই বেইনিংদের মধ্যে কিন্তু ডেনিসোভান-D1 জিন নেই। ফলে এটা সহজেই প্রমাণিত যে বেইনিংদের নিউগিনি ছেড়ে যাবার পরেই পাপুয়ানদের সাথে নতুন আরেকদল ডেনিসোভানদের বসতি শুরু হয়। কিন্তু এই নতুন দলের ডেনিসোভানরা এর আগে কোথায় ছিল তা বলা সম্ভব হয় নি।

ডেনিসোভান- D0:১০ হাজার বৎসরের বেশি আগে। এলাকা হল সাইবেরিয়া, আলাতাই পার্বত্য এলাকা-ডেনিসোভা গুহা-স্তেপ এলাকা, মঙ্গোলিয়া।

ডেনিসোভান জিনের ব্যাপ্তি স্বভাবতই নিউগিনির চেয়ে অস্ট্রেলিয়দের মধ্যে কম, আবার আদি আমেরিকানদের মধ্যে তার চেয়েও কম। ডেনিসোভা থেকে যতদূরে যাওয়া গেছে ততই এই হার কমেছে। সেই হিসাবে দেখলে মনে হবে ডেনিসোভা থেকে একটি ডেনিসোভান পরিযানই গোটা এলাকায় ডেনিসোভান জিন রেখে গেছে। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে ডেনিসোভানদের জিনের আনুপাতিক হার ও বৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি নিউগিনিতে।

ডেনিসোভান পূর্বপুরুষত্ব (ancestry) পশ্চিম-ইয়োরেশিয়ানেদর তুলনায় বেশি আছে পূর্ব-ইয়োরেশিয়ানদের মধ্যে। দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিম-ইয়োরেশিয়ানেদর উপস্থিতিতে ডেনিসোভান পূর্বপুরুষত্ব যতটা কমার কথা তার চেয়েও বেশি হারেই আছে। এই বাড়তি হার বজায় থেকেছে তিব্বতি, শেরপা, কুসুণ্ডা, হাজারা, ওঙ্গেদের হিসেবের বাইরে রাখলেও।

দক্ষিণ এশিয়াতে ডেনিসোভান জিনের আধিক্য দেখা গেছে হিমালয় নিকটবর্তী এলাকায়, মধ্য ভারতে, আর দক্ষিণ ভারতে, তবে সব চেয়ে বেশি শেরপাদের মধ্যে। যদিও তা হল গিয়ে নিউগিনির লোকেদের এক দশমাংশেরও কম।

শেরপাদের মধ্যে ডেনিসোভান জিনের আধিক্যের আরেকটি লক্ষণীয় দিক হল, যদিও আমরা ভাবতে পারি হিমালয় এলাকায় থাকার দরুন ডেনিসোভান জিন ও EPAS1 প্রোটিন তিব্বতিদের থেকেই তারা পেয়েছিল। আর তাই তারা হিমালয়ের গায়ে বসতি করতে পেরেছে। কিন্তু এখানে একটা রহস্য থেকে গেছে তা হল তিব্বতিদের ক্রমোজম-২ এ EPAS1 থাকে। অথচ শেরপাদের এই EPAS1 যুক্ত ক্রমোজম-২টাই নেই। ফলে ভাবতে হয় শেরপারা হয়ত ভিন্ন কোন ডেনিসোভানদের থেকে এই EPAS1 পেয়েছিল।  কিন্তু সম্ভবত সেটাও অবাস্তব ভাবনা। কারণ জেনেটিক তথ্য বলে শেরপারা এই EPAS1 পেয়েছে মাত্র ৩.৫হাজার বৎসর আগে। তাহলে বলতেই হয় তারা এটা পেয়েছিল তিব্বতিদের থেকেই। এবার ক্রমোজম-২ নিয়ে যে প্যাঁচ সেটা হয়ত পরে বোঝা যাবে।

তিব্বতে EPAS1

তিব্বতে ডেনিসোভানদের বসতি ছিল ১৬০ হাজার বৎসর আগে (বাইশিয়া গুহা)। আনুমানিক ৪৪-৪৫ হাজার বৎসর আগে তিব্বতে স্যাপিয়েন্সদের প্রবেশ ঘটে। তারপরে কোন একসময়ে ডেনিসোভান ও তিব্বতিদের মধ্যে মিশ্রণ ঘটে। এই সময়টা  হল মোটামুটি ৪৩ হাজার বৎসর আগে।১৪ কিন্তু প্রশ্ন থাকে যে যদিও স্যাপিয়েন্সদের তিব্বতে সম্ভাব্য উপস্থিতি ছিল ৪৩ হাজার বৎসর আগে, আর ডেনিসোভানরা তার বহু আগে থেকেই ছিল, এটা কি সম্ভব যে স্যাপিয়েন্সদের আগমনকাল ছোয়ার জন্য ডেনিসোভানরা অত দীর্ঘকাল তিব্বতে টানা টিকে ছিল?

অথবা স্যাপিয়েন্সরা ৪০-৪৩ হাজার বৎসর আগে তিব্বতে গেলেও তারা ধারাবাহিক বসবাস সেখানে করছিল কি? এই সব সম্ভব অসম্ভব শর্ত চিন্তা করে ভাবা হল তিব্বতের বাইরেই তাদের প্রথম মিলন ঘটে। প্রথম দেখা উভয়ের জন্য খানিক অনুকূল পরিবেশে। কারণ একটু মাঝারি লম্বা সময় তাদের পাশাপাশি থাকতে হবে, মিশ্রণ সফল হবার জন্য একাধিক জুটির বিভিন্ন কালে মিলন হতে হয়। তবেই কয়েকজনের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ে।

৪৩ হাজার বৎসর আগে প্রথম বারের মত EPAS1 হস্তান্তর হলেও আসলে তার বিস্তার হতে শুরু করে আনুমানিক বার হাজার বৎসর আগে। এই বিস্তারের পথ ছিল বাছাই। EPAS1 বাহকরা সন্তান উৎপাদনে অগ্রাধিকার পেতে শুরু করে।১৪  তিব্বতিদের মধ্যে শতকরা হারে ডেনিসোভান জিন খুব একটা বেশি নেই। অথচ EPAS1 পুরো জাতিটির ৪০ শতাংশের বেশি লোকের মধ্যে থাকায় অনুমান করতে হয় ডেনিসোভান জিন হিসাবে বাছাই ঘটে নি, বাছাই ঘটেছে কেবল EPAS1 আছে কি নেই সেই ভিত্তিতে।

আগে তিব্বতি ও হান চিনাদের একাংশ একই গোষ্ঠী ছিল। ২৭৫০ থেকে ৫৫০০ বৎসর আগে তারা বিভক্ত হয়। দেখা গেছে হান চিনাদের মধ্যে এই EPAS1 ভীষণ কম। কেন? অনুমান করা হয় যে যেহেতু হান চিনারা সমতলে চলে আসে তাই EPAS1 আর তাদের প্রয়োজন ছিল না। ফলে প্রাকৃতিক-সামাজিক নির্বাচনে হান চিনারা EPAS1 ত্যাগ করতে থাকে। কিন্তু তারই মধ্যে আরেকটি রহস্য, তা হল এই EPAS1 সকলের মধ্যে ছড়ানোর সময় মাত্র গত সাড়ে তিন হাজার বৎসর কাল। মাত্র সাড়ে তিন হাজার বৎসরে তিব্বতিদের ৪০ শতাংশের মধ্যে ডেনিসোভান জিন EPAS1 চলে গেছে। এত দ্রুত জাতিগত সত্ত্বার বদল খুব কমই হয়।এটা সম্ভব তখনই হতে পারে যখন গোটা জাতিটি কোন বিশেষ কারণে কেবল একটি বিশেষ জিনবাহকদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে। তিব্বতে অবশ্যই সেইরকমই কিছু ঘটেছিল। পক্ষপাতের দুটো সম্ভাব্য কারণ আমরা ভাবতে পারি, যেহেতু অক্সিজেনের অভাবে ক্লান্তিতে তারা ভুগবে না, তাই EPAS1 বাহক পুরুষেরা অধিকতর পরিশ্রমী হবে, ফলে অধিক সম্পদের অধিকারী হবে, এবং পরস্পরের সংঘাতেও তারাই জয়ী হবে। ফলে ক্ষমতা তাদের করায়ত্ত হবে। এরপরে দৈহিক-দলীয়-রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে নিজেদের বংশধারা অতি দ্রুত সম্প্রসারণ করবে। আবার EPAS1 বাহক নারীরাও পরিশ্রমী হওয়ায় তারা পুরুষদের প্রিয় হবে। তবে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নারীরা পাবে তাদের সন্তানের জন্ম হবে অপেক্ষাকৃত কম কষ্টকর ও নিরাপদ। মা ও সন্তানের জন্মকালীন মৃত্যুহার কমবে দ্রুত। ফলে জনসংখ্যাও বাড়বে দ্রুত।১২ নিয়মিত দীর্ঘকালীন ডেনিসোভান আর স্যাপিয়েন্সদের মিলিত বসবাসের বদলে স্বল্পকালের মিলিত বসবাসের জিনগত সুবিধা (EPAS1) স্যাপিয়েন্সরা ভোগ করে তাদের সামাজিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে।

ডেনিসোভান জিনের কিছু বৈশিষ্ট্য

তিব্বতিরা ছাড়া আন্দিজের লোকেরাও এমনি উচ্চতায় বসতি গড়েছে। তাদের যেহেতু EPAS1 নেই তাই তারা কম অক্সিজেনের আবহাওয়া টিকে থাকার জন্য নিজেদের অক্সিজেন বাহক লোহিত কণিকার সংখ্যা বাড়িয়ে সেই সমস্যার সমাধান করেছে। তাতে তাদের নানা রকম শারীরিক সমস্যাতেও ভুগতে হয়। তিব্বতিদের বেলা কিন্তু EPSA1 এর দৌলতে এই রক্তে বাড়তি লোহিত কণিকার দরকার পড়ে না। তারা স্বাভাবিক পরিমাণ লোহিতকণিকা দিয়েই কাজ চালায়। ফলে আন্দিজ পার্বত্য এলাকার লোকেদের মত তাদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগতে হয় না।১২

আফ্রিকান নন এমন ২৫৭জনের ডি.এন.এ বিশ্লেষণে দেখা পাওয়া গেল নিয়েন্ডারথল জিন শুন্য আছেন ১৮ জন। আর শুধু ওসানিয়ানদের মধ্যেই ডেনিসোভান জিন শূন্য ৬৩ জন। আর কিছু আছেন যাদের নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভান দুইরকমেরই জিন শূন্য।

কিছুক্ষেত্রে দেখা গেছে ক্রমোজম-৭ ডেনিসোভান বা নিয়েণ্ডারথাল কোন জিনেরই কিছুমাত্র অস্তিত্ব নেই বা ছিল না কখনো। প্রসঙ্গত ক্রমোজম-৭ এ মানুষের ভাষা গঠন ও কথা বলার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক বলে ধারণা করা FOXPO2 জিন। এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ বোঝা গেল যে নিয়েণ্ডারথাল বা ডেনিসোভান দের কোন প্রভাব ছিলনা FOXPO2 জিনে।

এর থেকে হয়ত আমরা ভাবতে পারি যে ডেনিসোভান ও নিয়েণ্ডারথালদের FOXPO2 জিন নেই মানেই তাদের ভাষা ছিল না। তবে এমন সহজ সরল সিদ্ধান্তে আসা খুব একটা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ মনে রাখতে হবে নিয়েণ্ডারথালরা ৪০ হাজার বছর আগেই স্যাপিয়েন্সদের সাথে বাস করেছে একই পরিবারে। ফলে তাদের মধ্য সাহিত্য চর্চা না হলেও জীবনধারণ সংক্রান্ত জরুরি ঘরোয়া কথাবার্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। আর নিয়েণ্ডারথালদের নিয়ে আরো বেশি ভাবতে হবে কারণ তারা মাত্র ১৫ হাজার বৎসর আগে স্যাপিয়েন্সদের সাথে পারিবারিক সম্পর্ক গড়েছে। পনের হাজার বৎসর আগে স্যাপিয়েন্সদের ভাষা কিছুটা হলেও সংগঠিত সামাজিক কাজের উপযুক্ত হয়ে ওঠেছিল।

কাজেই নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভানদের FOXPO2 জিন নেই মানেই তারা কথা বলতে পারতো না এমনটা ভাবার কোন যুক্তি নেই। তাছাড়া আমাদের আরেকটা সদ্য আবিষ্কৃত তথ্য মাথায় রাখতে হবে, তা হল, নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভানদের থেকে স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্ক গঠন প্রণালী, মস্তিষ্কের কর্মপ্রণালী আলাদা, ইলে ভাবনা চিন্তার ধরনধারনও আলাদা হতে পারে। আর তারই ফলে তাদের ভাষা সৃষ্টির জন্য FOXPO2 জিন হয়ত দরকারই ছিল না।

ডেনিসোভান জিন যে সব জিনে ছাপ রেখেছে তার মধ্যে আছে HLA-A রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধক জিন।
ডোনিসোভানদের থেকে প্রভাবিত স্যাপিয়েন্সদের জিন VN1R1, এই জিন অন্য প্রাণীদের বেলা ফেরোমন নিয়ন্ত্রক। আর মানুষের বেলায় সামাজিক-যৌন সম্পর্ক নিয়ন্ত্রকনিয়েণ্ডারথাল বা ডেনিসোভানদের জিন স্যাপিয়েন্সদের X-Chromosome এলাকাতেই বেশি পাওয়া যায়। অনুমান ডেনিসোভান পুরুষদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাসের লক্ষণ ছিল এটা। নিয়েণ্ডারথাল ও ডেনিসোভান জিনশূন্যতা। নিয়েণ্ডারথাল ও স্যাপিয়েন্সদের সঙ্কর প্রজন্মের পুরুষদের সন্তান জন্ম দেবার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল এমন ধারণা আগেই করা হত। এখন দেখা গেল একই কথা সত্য ডেনিসোভান ও স্যাপিয়েন্সদের পরবর্তী সঙ্কর প্রজন্মের পুরুষদের বেলাও। এরই ফলে হয়ত সঙ্কর প্রজন্মের সংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে।

আলতাই ডেনিসোভান থেকে D1 বিচ্ছিন্ন হয়েছে ২৬১ থেকে ২৯৭ হাজার বৎসর আগে। আর আলতাই ডেনিসোভান থেকে D2 বিচ্ছিন্ন হয়েছে ৩৩৪ থেকে ৩৭৭ হাজার বৎসর আগে। (অতটা আগে বিচ্ছিন্ন হবার ফলে কিছু বিজ্ঞানী বলছেন এই ডেনিসোভান-D2 দের আলাদা শাখা বলা যায় কিনা ভাবা দরকার। এই হিসাবে প্রতি প্রজন্ম ধরা হয়েছে ২৯ বছর।

একটি বিশাল ডেনিসোভান জনগোষ্ঠী টিকে ছিল কয়েক লক্ষ বৎসর ধরে, বিশাল এলাকা জুড়ে, স্যাপিয়েন্সদের সাথে মিলিত হবার আগে পর্যন্ত। কেমন ছিল তাদের পৃথিবী? যেটা অনুমান করা যায় তা হল ডেনিসোভানদের ছোট ছোট জনগোষ্ঠী বিভিন্ন এলাকায় ছিল। কত বড় হতে পারে এই আদিম জনগোষ্ঠীগুলো? গবেষকরা অনুমান করেন আনুমানিক ৩৫০জন হলেই তারা থেকে যেতে পারে, মুল ধারা থেকে সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েও। যখন স্যাপিয়েন্সদের সাথে ডেনিসোভানদের দেখা হয়, তখন ডেনিসোভানরা ছিল সংখ্যায় কম বিচ্ছিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট সংগঠিত জনগোষ্ঠী। এই সংখ্যায় কম বিচ্ছিন্ন হবার একটা বড় কারণ হয়ে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার, ছোট ছোট দ্বীপের ভৌগোলিক পটভূমি।

ডেনিসোভান-D1 নিউগিনি বাদে আর কোথাও না পাওয়ার কারণ হতে পারে প্রাচীন জিনের দুর্বল উপস্থিতি ধরা পড়েনি। সেই জন্য পাপুয়ান ও বেইনিংদের মধ্যে D1 উপস্থিতির পার্থক্য আলাদা করে আরেকবার বিচার করা দরকার। বিচার করা দরকার কাছাকাছি একাধিক দ্বীপেও। কারন প্রথম প্রশ্নই হলো ১৫ হাজার বৎসর আগে নিউগিনির স্যাপিয়েন্সদের সাথে মিলিত হবার আগে তারা কোথায় ছিল সেটা জানা।

আর্কিওলজিকাল প্রমাণ আছে যে নিউ ব্রিটেনে ৩৫.৫ হাজার বছর আগেই লোকবসতি ছিল। কাজেই সেখানে ডেনিসোভানেরা ছিল না। থাকলে বেইনিংদের সাথেই বা তাদের আগে থেকে বাস করা লোকেদের সাথে সেই ডেনিসোভানদের মিশ্রণ ঘটত। তবে একটা জিনিষ পরিষ্কার, তা হল ডেনিসোভান-D1 রা বহুকাল ধরেই মুল ডেনিসোভান দলের সাথে সম্পর্কহীন ভাবে ছিল। কাজেই তারা থাকতে পারে কেবল কোন দ্বীপেই।

নিয়েণ্ডারথাল-ডেনিসোভান-স্যাপিয়েন্সদের মিলিত বংশধর আমরা আধুনিক হোমো-স্যাপিয়েন্সরা। কোন সন্দেহ নেই। না আছে। আধুনিক হোমো-স্যাপিয়েন্সদের জিনে পাওয়া গেছে আরো কয়েকটি অজানা মানুষের জিন। তাদের খুঁজে বের করা বাকি। তবে অজানা উৎসের জিন আধুনিক মানুষের মোট জিনের এক শতাংশের বেশি না।

রামাপাসাসা, (এবং সিবল ও বেন) গ্রাম ফ্লোরেস গুহার (হোমো-ফ্লোরেসিয়েন্সিসদের বাসস্থান) কাছে। এখানে খুব বেঁটে মানুষদের বসবাস। এই গ্রামে নিয়েন্ডারথল ও ডেনিসোভান জিনের কোন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। যা অতি সামান্য পাওয়া গেছে তা প্রতিবশীদের চেয়ে কোনরকমেই ব্যতিক্রমী নয়। বদলে এমন জিনের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা নিয়েণ্ডারথাল বা ডেনিসোভান কারুরই নয়। সেই অজানা জেনেটিক উপস্থিতি অন্য কারুর, হয়ত হোমো-ইরেক্টাসদের।

তথ্যসুচীঃ-

1. Georgy Hadjasov et.al, Multiple Deeply Divergent Denisovan Ancestries in Papuans’, CELL, Feb.2019

2. Sharon R Browning, Brian L Browning, Ying Zhou, Serena Tucci, Joshua M Akey, Analysis of Human Sequence Data Reveals Two Pulses of Archaic Denisovan Admixture,’CELL, March 2018

3. Sriram Sankararaman, Swapan Mallick, Nick Patterson, Devid Reich, The combined Landscape of Denisovan and Neanderthal Ancestry in Present-day Humans,  CELL, May 2016

4. Debra Ruder, ‘Asia was settled in multiple waves of Migration, DNA study Suggests,’. Harvard Medical School, Science Daily, Sept. 2011

5. Nathaniel Scharping, ‘Denisovan Research Reveals That Early Humans were more complex Than We Thought,’.Science News, Dec 2019

6. Nathaniel Scharping, ‘The Denisovans may have more than a single species,’. Discovery Magazine,’ April 2019

7. Nathaniel Scharping., ‘Hybrid Hominin: This Girl’s Mother and Father came from two different species,’ Discovery Magazine, August 2018

8. Maya Wei-Haas, ‘Multiple line of Mysterious Ancient Humans Interbred with Us. Modern DNA Suggest Denisovans are surprisingly Diverse and may be the last Humans other than the Sapiens on Earth, National Geographic, April 2019

9. Dongju Zhang et. al.,A Middle Pleistocene Denisovan Mandible from the Tibetan Plateau,’ KAR, Kent University,

10. Youan Bao Yin, Huang Wei Wen, Zhang David, ‘New Evidence for Human occupation of the northern Tibetan Plateau, China during the late Pleistocene,. China Science Bulletin, Science in China Press, Oct. 2007, Springer

11. Wu XinZhi, Tong Haowen, ‘Discussion on the significance and Geologic Age of Penghu 1 Mandible,’ ACTA ANATHROPOLOGICA SINICA. Aug 2015

12. Ann Gibson, ‘Tibetans inherited high altitude gene from ancient human,’ Science News Magazine, July 2014

13. Ann Gibbons, ‘Denisovan DNA Recovered from Tibetan Plateau,’ Labroot, Via Eurekalert, source Chinese Academy of Science Headquarters, Science News Magazine, Nov.2020

14. Xinjun Zhang et al.,The History and Evolution of Denisovan EPAS1 Haplotype in Tibetans,’ BioRxiv and National Academy of Science, Oct.2020

মন্তব্য তালিকা - “অথ ডেনিসোভান কথা”

  1. তুষারদা,
    মন্ত্রমুগ্ধ। এক অনন্য, দীর্ঘ, গবেষণার ফসল। দম বন্ধ করে তত্ব ও তথ্যের সমাবেশে হারিয়ে গেলাম। প্রণাম।
    সংগ্রহে রাখার ও অন্যত্র উপস্থাপন করার অনুমতি প্রার্থনা করি।

    1. ধন্যবাদ। অন্যত্র উপস্থাপন সম্ভব কি না আমার জানা নেই। সেটা পোর্টালের অ্যাডমিন বলতে পারবেন।

    1. ধন্যবাদ। একটু বেশি বড়ই হয়ে গেল বোধহয়। রাত্রির ঘুমের ব্যাঘাতের জন্য দায়ী থেকে গেলাম।

  2. অসাধারণ শৈলীতে অসাধারণ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।অত্যন্ত পরিষ্কার ও স্বচ্ছ আত্মীকরণে দীর্ঘ ইতিহাস ও তথ্য সমুদ্র আলোকিত হয়ে উঠেছে ।
    কোথাও কোন না বোঝা বা প্রশ্নের অবকাশ নেই । এর উপর ভিত্তি করে এই বিষয়ে যে কোন দিকে এগিয়ে যেতে গেলে এটি আকরের কাজ করবে। লেখা টি পড়তে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।