সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধ সাহিত‍্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধ সাহিত‍্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

কৃশানু নস্কর

আগস্ট ১৪, ২০২১ ১১৭৭ 4

এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে রাজ-উদ্যানে জন্মগ্রহণ করেন শাক্যবংশের এক রাজকুমার। এমন কত রাজবংশে কত রাজকুমারই তো জন্মান! বড় হয়ে ওঠেন, হয়তো রাজত্ব করেন এবং প্রকৃতির নিয়মে শেষ অবধি দেহরক্ষা করেন। ইতিহাস বইয়ের পাতায় রয়েছে এমন কত শত রাজপুত্র ও রাজাদের বৃত্তান্ত! ইতিহাসের ছাত্ররা বাদে কেউই তাঁদের কথা বিশেষরূপে মনে রাখে না। কালস্রোতে ভেসে যায় তাঁদের নাম, ধূসর হয়ে যায় তাঁদের স্মৃতি। হারিয়ে যান তাঁরা বিস্মৃতির অতলে।

কিন্তু যে রাজকুমারের কথা আমরা বলতে চলেছি, তাঁর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেনি। প্রায় আড়াই হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে তাঁর জন্মের পর। প্রকৃতির নিয়মেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর জীবন, তাঁর নাম আজও কোটি কোটি মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। না, প্রথাগত ভঙ্গিতে রাজদণ্ড হাতে রাজ্যশাসন করেননি তিনি। স্থাপন করেননি কোনো সাম্রাজ্য। উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে ধ্বংস করেননি নগর বা জনপদ। পরিবর্তে রাজ ঐশ্বর্য ত্যাগ করে ভিক্ষাপাত্র হাতে নেমে এসেছিলেন পথে। মিশে যেতে চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের ভিড়ে। খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন দুঃখ হতে মুক্তির পথ।

ভিক্ষাপাত্র ও কাষায় বস্ত্র মাত্র সম্বল করে সেই শাক্যবংশের রাজকুমার কিন্তু সাধারণ হতে পারেননি। সাধারণ হওয়ার চেষ্টায় তিনি ক্রমেই হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। আড়াই হাজার বছরের উপান্তে আজ অর্ধেক এশিয়ার মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করে তাঁর নাম। তাঁর সমসাময়িক সন্ন্যাসী, সাধক বা দার্শনিকরা সকলেই প্রায় বিস্মৃতির গভীরে লুপ্ত হয়েছেন। বেঁচে আছেন শুধু তিনি! মানব স্মৃতিতে মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো ভাস্বর, যিনি অতিক্রম করেছেন মৃত্যুকে, রাজপুত্র, রাজা, সম্রাট প্রভৃতি উপাধির গণ্ডি অতিক্রম করে যিনি পরিচিতি লাভ করেছেন ‘ভগবান’ নামে।

হ্যাঁ, বহু মানুষের চোখেই তিনি ভগবান। ভগবান বুদ্ধ। যাঁর পদতলে মাথা নত করেছেন বিম্বিসার, অজাতশত্রু বা প্রসেনজিতের মতো সম্রাটরা; অঙ্গুলিমালের মতো দুর্ধর্ষ দস্যু যাঁর প্রভাবে হয়েছে অহিংসা ধর্মে ব্রতী, সেই বুদ্ধদেবকে নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

কিন্তু না, বুদ্ধদেবের জীবন কথা বা তাঁর প্রচারিত ধর্ম বা দার্শনিক তত্ত্ব আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এ আলোচনা যথাযথরূপে বুদ্ধদেবকে নিয়েও নয়। তাঁর জীবন, ধর্ম, দার্শনিকতা ইত্যাদি বহুল আলোচিত। কিন্তু এছাড়াও আরো একটি বিষয়ে তাঁর প্রভাব সীমাহীন কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত, সেটি হল সাহিত্য।

বুদ্ধদেবের জীবন, উপদেশাবলি, তাঁর কথিত উপদেশমূলক কাহিনিসমূহ ইত্যাদি সব একত্রিতরূপে সৃষ্টি করেছে এক বিশাল সাহিত্য সম্ভার। কালে কালে বিভিন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিত ও দার্শনিক তাঁদের নিজস্ব অবদানের মাধ্যমে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছেন এই সাহিত্য সম্ভারকে।

পৃথিবীতে এই সুবিশাল সাহিত্যের উদাহরণ আর মাত্র একটিই আছে, তা হলো বৈদিক সাহিত্য। কিন্তু বৈদিক সাহিত্য এমনভাবে একটিমাত্র মানুষের প্রভাবে গড়ে উঠেনি। আসুন, বৌদ্ধসাহিত্যের এই সুবিশালতা ও বৈচিত্র্যের একটা সম্যক ধারণা লাভ করে বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় অভিভূত হই সেই মানুষটির কথা ভেবে, যিনি এ সমস্ত কিছুরই মূল প্রেরণা।

বৌদ্ধদের ধর্মশাস্ত্র বা মূল গ্রন্থ হলো ত্রিপিটক। পিটক কথার অর্থ হলো ঝুড়ি বা পাত্র। সুতরাং ত্রিপিটক কথার অর্থ তিনটি ঝুড়ি বা পাত্র অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র প্রধানত তিনটি ভাগে বিভক্ত – সুত্ত পিটক, বিনয় পিটক ও অভিধম্ম পিটক। পালি বা প্রাকৃত ভাষায় র-ফলা ও রেফ-এর ব্যবহার নেই, পরিবর্তে সেস্থানে পরবর্তী ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব-করণ হয়। ফলে সংস্কৃত ‘ধর্ম’ এখানে ‘ধম্ম’। অনুরূপে ‘সুত্ত’ অর্থে সংস্কৃত ‘সূত্র। তবে কেউ কেউ ‘সুত্ত’ শব্দটিকে বৈদিক শব্দ ‘সূক্ত’ হতে উদ্ভূত বলেও দাবি করেন। ধর্মানন্দ দামোদর কোসাম্বি অবশ্য প্রথম মতেরই সমর্থক। লেখকের মতও কোসাম্বির অনুসারী, তবে এ মত নিতান্তই ব্যক্তিগত।

সম্প্রদায় ভেদে বৌদ্ধদের ত্রিপিটকগুলি পৃথক এবং একই পিটকের ভিন্নতর পাঠ বর্তমান। ব্রাহ্মণ্যগ্রন্থ বেদ বা উপনিষদের সঙ্গে এক্ষেত্রে ত্রিপিটকের প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। বেদ বা উপনিষদের বহুতর শাখা থাকলেও, সে শাখাগুলির মধ্যে পাঠভেদ নেই। কেবলমাত্র মন্ত্র বা ঋকগুলোর সজ্জা বিভিন্ন। বর্তমানে কেবল স্থবিরবাদী বৌদ্ধদের ত্রিপিটকটি সম্পূর্ণরূপে পাওয়া গেছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের সম্পূর্ণ ত্রিপিটক এখনও পাওয়া যায়নি এবং সেসব ত্রিপিটক পালিভাষায় রচিতও নয়।

বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের ত্রিপিটক নামকরণ ও ত্রিধা বিভাজন বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণের বহু পরের ঘটনা। আদিতে অর্থাৎ বুদ্ধদেবের মহাপরিনির্বাণের অব্যবহিত পরেই রাজগৃহে মহারাজ অজাতশত্রুর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি বা তার একশো বছর বাদে রাজা কাকবর্ণ বা কালাশোকের উদ্যোগে বৈশালীতে আহুত দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির সময় কেবলমাত্র দুটি পিটক ছিল।

সুত্ত পিটক ধর্ম সংক্রান্ত বুদ্ধ বচনের সংকলন ও বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য আনন্দ কর্তৃক সংকলিত ও সংরক্ষিত। বিনয় পিটক ভিক্ষু ভিক্ষুণীদের আচার-ব্যবহারমূলক বুদ্ধ বচন সংগ্রহ ভিক্ষু উপালি কর্তৃক উদ্ধৃত ও সংরক্ষিত। প্রথম সঙ্গীতির সময়ই এ দুটি সংকলিত হয়।

মহারাজ অশোকের আহ্বানে পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির সময় মোগ্গলিপুত্ত তিসসের (মতান্তরে উপগুপ্তের) সভাপতিত্বে অভিধম্ম পিটকের উদ্ভব হয়। ধর্মবিষয়ক বুদ্ধবচন ও সূত্রের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং দর্শন এই পিটকে সংকলিত হয়।

এবারে পিটকগুলির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে। পূর্বেই বলা হয়েছে, সুত্ত পিটকে আছে ধর্মের অনুশীলন, বিনয় পিটকে আছে সংঘের নিয়মাবলি ও আচার ব্যবহারের বর্ণনা। অভিধম্ম পিটকে আছে ধর্মের বিশ্লেষণ ও দর্শন।

সুত্ত পিটকের মোট পাঁচটি প্রধান ভাগ যথা –

১. দীঘনিকায় – নিকায় শব্দের অর্থ আবাস বা শব্দাবলি। যে নিকায়ে দীর্ঘাকৃতির সূত্রসমূহ সংকলিত হয়েছে তা দীঘনিকায়। ব্রহ্মজালসুত্ত, সামঞঞফলসুত্ত ইত্যাদি ৩৪টি দীর্ঘপ্রমাণ সূত্রের সমাবেশ।

২. মজ্ঝিমনিকায় – ১৫২টি মধ্যমপ্রমাণ সূত্রের সমাবেশ।

৩. সংযুত্তনিকায় – ৫৬টি সূত্র আলোচিত।

৪. অঙ্গুত্তরনিকায় – ২৩০টি সূত্র আলোচিত হয়েছে।

৫. খুদ্দকনিকায় – উপরোক্ত চারটি নিকায় ৪টি পৃথক গ্রন্থ এবং এগুলোতে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি সূত্রই স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোনটির সঙ্গে কোনটির যোগসূত্র বা পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নেই। খুদ্দকনিকায় বলতে কিন্তু একটি নয়, পনেরোটি বিশেষ গ্রন্থের এক সংকলনকে বোঝায়। এগুলো নিম্নরূপ:

ক. খুদ্দকপাঠ – ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নয়টি সূত্রের সমাবেশে এক উৎকৃষ্ট হস্তপুস্তিকা। এর সাতটি সূত্র বৌদ্ধজগতে জাদুমন্ত্ররূপে পরিচিত।

খ. ধম্মপদ – বৌদ্ধদের গীতারূপে পরিচিত এ গ্রন্থটি ধর্ম ও নীতি সম্পর্কিত ৪২৩টি গাথার সংকলন। যমক, অপ্পমাদ ইত্যাদি ২৬টি বর্গে বিভক্ত।

গ. উদান – সৌমনস্য বা প্রসন্নতাসূচক ৮০টি সূত্রের সংকলন যার অধিকাংশই গাথায় রচিত। এগুলোতে কীর্তিত হয়েছে বৌদ্ধ জীবনের আদর্শ ও নির্বাণের মাহাত্ম‍্য।

ঘ. ইতিবুত্তক – গদ্যে ও পদ্যে সহজ সরল ভাষায় বুদ্ধদেবের উক্তিরূপে রচিত ২১২টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সূত্রে সংকলন ইতিবুত্তক, যাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রচারিত হয়েছে।

ঙ. সুত্তনিপাত – ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধিতা ও বৌদ্ধধর্মের জয়গাথা ঘোষিত হয়েছে এই গ্রন্থের ৭০টি সূত্রের মধ্যে।

চ. বিমানবত্থু – ৮৫টি গাথা সংকলিত, যাতে বৌদ্ধ দেবতাগণের দিব্যাবাসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

ছ. পেতবত্থু – ৫১টি গাথা সমন্বিত এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে প্রেত কাহিনি। অসৎ কর্মের ফলে মানুষের প্রেতরূপে জন্মগ্রহণ ও অশেষ দুঃখভোগের কাহিনি।

জ. থেরগাথা – বৌদ্ধ সাহিত্যে জ্ঞানবৃদ্ধ ভিক্ষুদের থের বা স্থবির বলে। এই থেরদের রচিত ১৩৬০টি গাথার সংকলন থেরগাথা।

ঝ. থেরীগাথা – কতিপয় পূতশীলা স্থবিরা রচিত ৫২২টি গাথার সংকলন থেরীগাথা।

ঞ. জাতক – ‘জাতক’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ, যে জন্মগ্রহণ করেছে কিন্তু বৌদ্ধসাহিত্যে জাতক বলতে বোঝায় গৌতমবুদ্ধের পূর্বজন্মবৃত্তান্ত। বৌদ্ধদের বিশ্বাস, এক জন্মে কেউ বুদ্ধের ন্যায় জ্ঞানী হতে পারে না বা বোধি লাভ করতে পারে না। বুদ্ধরূপে জন্মগ্রহণ করার পূর্বে বুদ্ধদেব আরও ৫৪৭ বার বোধিসত্ত্বরূপে আবির্ভূত হন। বুদ্ধদেবের এক একটি পূর্বজন্মবৃত্তান্ত নিয়ে এক একটি জাতক কাহিনি। প্রতিটি জাতক কাহিনির পাঁচটি করে অঙ্গ – প্রত্যুৎপন্ন বস্তু বা বর্তমান কাহিনি, অতীত বস্তু বা অতীত কাহিনি, গাথা বা শ্লোক, ব্যাকরণ বা টীকা এবং সমবধান বা সংযোগ অর্থাৎ বর্তমান কাহিনির নায়কদের সঙ্গে তাদের পূর্বজন্মের শনাক্তকরণ। জাতকে ভারতের যে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক চালচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে, তার কালসীমা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক হতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক অবধি বিস্তৃত।

ট. নিদ্দেস – এটি একটি টীকা বা ব্যাখানমূলক গ্রন্থ। সুত্ত নিপাতের কয়েকটি সূত্রের বিশেষ আলোচনা আছে এতে। এর দুটি ভাগ- মহানিদ্দেস ও চুল্লনিদ্দেস। কথিত আছে যে, সারিপুত্ত এই টীকা গ্রন্থটির রচয়িতা।

ঠ. পটিসম্ভিদামগ্গ – জ্ঞান, স্মৃতি, কর্ম, মৈত্রী ইত্যাদি বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কিত নানা বিষয়, প্রশ্নোত্তরছলে এই গ্রন্থে বিশ্লেষিত হয়েছে।

ড. অপদান – অপদান (পালি) বা অবদান (সংস্কৃত) কথাটির অর্থ মহৎ কর্ম বা কীর্তি। গাথাকারে রচিত এই গ্রন্থে বুদ্ধ ও বহু স্থবির-স্থবিরার কীর্তিকলাপ এবং বুদ্ধের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের কথা ব্যক্ত হয়েছে। সমগ্র অপদান ৫৯টি বর্গে বিভক্ত। প্রতি বর্গে ১০টি করে কাহিনি উপস্থিত। ৫৫টি বর্গ স্থবির সম্পর্কিত এবং বাকি ৪টি স্থবিরা সম্পর্কিত অর্থাৎ মোট ৫৫০ জন স্থবির এবং ৪০ জন স্থবিরার জীবনকাহিনি এতে পরিবেশিত।

ঢ. বুদ্ধবংস – গাথায় রচিত এই গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী ২৪ জন আদি বুদ্ধের জীবন বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। ২৬টি পরিচ্ছেদে সমাপ্ত এই গ্রন্থের অন্তিম পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে, গৌতম ও আদি বুদ্ধদের দেহাবশেষ বণ্টন কাহিনি।

ণ. চরিয়াপিটক – ৩৫টি জাতক কাহিনি এই গ্রন্থে কবিতার আকারে পরিবেশিত হয়েছে। এটি সম্রাট অশোকের পরবর্তীকালের রচনা।

বিনয়পিটক গ্রন্থটির মোট তিনটি ভাগ, যথা –

১. সুত্তবিভঙ্গ – বিভঙ্গের অর্থ ভেঙে ফেলা বা ভেঙেচুরে ব্যাখ্যা করা। বিনয়পিটকের যেটি প্রাণ বা মূল ভিত্তি, সেই প্রাতিমোক্ষ এই সুত্তবিভঙ্গেই সন্নিবিষ্ট। এখানে প্রাতিমোক্ষের অনুশাসনগুলো ভেঙেচুরে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পালি প্রাতিমোক্ষে মোট ২২৭টি সূত্র আছে। এক একটি সূত্র, এক একটি নিয়ম। বর্তমানে সূত্রসংখ্যা ২২৭ হলেও প্রথমে সম্ভবত ১৫২টি সূত্র ছিল।

২. খন্ধক – খন্ধক-এর দুটি ভাগ, মহাবগ্গ ও চুল্লবগ্গ। প্রথম ভাগে বর্ণিত হয়েছে ভগবান বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভ, সারনাথে প্রথম ধর্মপ্রচার, সংঘের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ও বহু নীতিকথামূলক আখ্যান। চুল্লবগ্গে লিপিবদ্ধ হয়েছে বুদ্ধের জীবনী, সংঘের ইতিবৃত্ত ও প্রথম এবং দ্বিতীয় বৌদ্ধ সঙ্গীতির ইতিহাস ও বিবরণ। তবে এই অন্তিম বিষয়টিকে অনেকে পরবর্তীকালের প্রক্ষেপ মনে করেন।

৩. পরিবার – সুত্তবিভঙ্গ ও খন্ধকের তুলনায় অনেক অর্বাচীন অর্থাৎ নবীন গ্রন্থ পরিবার। ২১টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত গ্রন্থটি সম্ভবত সিংহলে (অধুনা শ্রীলঙ্কায়) রচিত। বিনয়পিটকের অতি দুরূহ বিষয়গুলো অতি সুন্দর ও প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এতে।

অভিধম্মপিটকের মোট সাতটি ভাগ, যথা –

১. ধম্মসঙ্গণি – এই গ্রন্থে চিত্ত, চৈতসিক, রূপ, নির্বাণের মতো ধর্মের বিভিন্ন বিষয়, তাদের স্বরূপ, কৃত্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্লেষিত হয়েছে।

২. বিভঙ্গ – ধর্মের বিভিন্ন বিষয় বা পদার্থগুলিকে সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এ গ্রন্থে।

৩. কথাবত্থু – ২৩টি অধ্যায় জুড়ে বিস্তৃত এই গ্রন্থে বিভিন্ন বৌদ্ধ মতবাদ বিশ্লেষিত হয়েছে। এর সংকলক সম্ভবত মোগ্গলিপুত্ত তিসস।

৪. পুগ্গলপঞঞত্তি – সম্যক বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ, আর্যপুদগল ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা আছে এই গ্রন্থে।

৫. ধাতুকথা – ১৪টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত এই গ্রন্থে স্কন্ধ, ধাতু ও আয়তনের মতো বিষয়গুলি প্রশ্নোত্তরে আলোচিত। যে পাঁচটি উপাদান হতে ধর্ম বা বস্তুর উৎপত্তি, তাই হলো স্কন্ধ। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান- এই পাঁচটি হলো স্বন্ধ। ধাতু বলতে বোঝায় বস্তুর মূল সত্তা। আয়তনের অর্থ ইন্দ্রিয়।

৬. যমক – যমক শব্দের অর্থ যমজ বা যুগল। এই গ্রন্থে এমন সব শব্দের বিশ্লেষণ আছে যাদের ভিন্নার্থে পুনরাবৃত্তি হয়।

৭. পট্ঠান – বিশাল আয়তনের এই গ্রন্থটি মহাপ্রকরণ নামেও পরিচিত। প্রতীত্যসমুৎপাদের ১২টি নিদান এই গ্রন্থে ২৪টি প্রত্যয়ের আকারে সরলরূপে পরিবেশিত।

অভিধর্মের এই সাতটি ভাগ বৌদ্ধ শাস্ত্রে সপ্ত প্রকরণ নামে পরিচিত।

একটি সারণিতে সমগ্র বিষয়টি ছকের সাহায্যে দেখানো হল:

এই গ্রন্থগুলি ছাড়াও তিব্বতে ভারতীয় বৌদ্ধ শাস্ত্রের অনুবাদের এক বিরাট সংগ্রহ আছে। ১১০৮টি গ্রন্থ নিয়ে কাঞ্জুর এবং ৩৪৫৮টি গ্রন্থ নিয়ে তাঞ্জুর। প্রথমটি সাত ভাগে বিভক্ত – বিনয়, প্রজ্ঞাপারমিতা, বুদ্ধাবতংসক, রত্নকূট, নির্বাণ, সূত্র ও তন্ত্র। দ্বিতীয়টি দুই ভাগে বিভক্ত – তন্ত্র ও সূত্র।

চৈনিক ভাষাতেও অনুরূপ অজস্র অনুদিত গ্রন্থ বর্তমান, যেগুলিকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে – সূত্র, বিনয়, অভিধর্ম ও বিবিধ। এছাড়া হোবোগিরিন নামে একটি তালিকায় ২১৮৪টি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি বর্তমানে ৫৫ খণ্ডে মুদ্রিত হয়ে তাইশো সংস্করণ নামে প্রকাশিত হয়েছে।

(এই অন্তিম অনুচ্ছেদ দুটি রচনার উপযুক্ত তথ্যসুত্রের জন্য শ্রী কুন্তল রায় মহাশয়ের নিকট কৃতজ্ঞ)

তথ‍্যসূত্র:

১. ধর্মানন্দ কোসম্বী (অনু. চন্দ্রোদয় ভট্টাচার্য), ভগবান বুদ্ধ ; সাহিত্য অকাদেমি।

২. দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত ইতিহাসের সন্ধানে ; কলকাতা: সাহিত্যলোক।

৩. S.N. Das Gupta, A History of Indian Philosophy, vol 1–5; Delhi: Motilal Banarasidas.

৪. Winternitz, M. A History of Indian Literature; Delhi: Motilal Banarasidas.

৫. নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস ; কলকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স।

মন্তব্য তালিকা - “বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধ সাহিত‍্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়”

  1. শাক্যপুত্রের জন্ম, আর তারপর পটিকা থেকে নির্গত মতিমালার একেকটা টুকরোর ব্যাখ্যা। সংক্ষিপ্ত ও সমৃদ্ধ হবার মত লেখা।

    পালিগ্রন্থগুলি সম্বন্ধে আমাদের জানার সুযোগ কম, অথচ এর ধর্মীয়, দার্শনিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব যথেষ্ট। আপনার এই লেখাটা এই কারণে অত্যন্ত আগ্রহের।

  2. সমগ্র বৌদ্ধসাহিত্যকে এমন সুন্দর চোখের সামনে তুলে ধরেছেন তাতে আগ্রহী ব্যক্তি গবেষক সকলের ই খুব সুবিধা হবে।

  3. সীমিত পরিসরে বৌদ্ধ সাহিত্য নিয়ে গুছিয়ে বলা বেশ কঠিন ছিল। খুব সুন্দর ভাবে আমাদের কাছে তা পরিবেশিত হল। সংগ্রহে রাখার মত সুন্দর একটি প্রবন্ধ। লেখককে ধন্যবাদ ।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।