সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

চর্যাগান থেকে ঢপ: বাংলা গানের পূর্বসূরিরা

চর্যাগান থেকে ঢপ: বাংলা গানের পূর্বসূরিরা

নবাঙ্কুর মজুমদার

অক্টোবর ২৮, ২০২৩ ৩১৮ 0

বাংলা গান। বাঙালির এক অপরিমেয় অহংকার। তার নিজস্ব রত্নভাণ্ডার। বাঙালির হাজারও দোষের চর্চা হলেও ভারত জুড়ে আজও তার কোকিলকন্ঠের প্রশংসা করার লোকের অভাব হয় না। চর্যাপদের গায়েন থেকে শুরু করে আজকের স্বনামধন্য গায়ক গায়িকা পর্যন্ত সংগীতের এক স্বপ্নিল উত্তরাধিকারের ধারক বাঙালির সংগীতপ্রেমের জুড়ি মেলা ভার।

শুরুর সেদিন থেকে বাঙালির সংগীত বহু ধারা উপধারায় বহমান। সমস্ত ধারাকে একসাথে এই ছোট্ট পরিসরে ধরা এক সুকঠিন কাজ। কারণ, বাঙালির সংগীতের সূচনালগ্ন থেকেই তাতে সমান্তরাল দুটি ধারা পরিপুষ্ট হয়ে চলেছে —লোকসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীত। আর গান মানে তাতে বিভিন্ন রাগ রাগিণীর ব্যবহার থাকবেই। বঙ্গাল, ভাটিয়ালি, গৌড় মল্লার, গৌড় সারঙ্গ ইত্যাদি রাগিণী যে এই পোড়া দেশের ছাই উড়িয়ে পাওয়া অমূল্য রতন তা তো ‘নাম দিয়ে যায় চেনা’। সূচনালগ্নের চর্যাগান থেকে কীর্তন ও ঢপ কীর্তন পর্যন্ত পারস্পরিক আত্মীয় সম্পর্কে বাঁধা কয়েকটি গানের ধারা কেবল আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব। তবে শুরুরও একটা শুরু থাকে। সেটা যদি হয় কোনও চর্যাগান দিয়ে তাহলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়ের দ্বিতীয় চর্যাগান এটি। রচয়িতা কুক্কুরীপাদ।

দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই।

রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ॥

আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী।

কাণেট চৌরি নিল অধরাতী॥

সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ।

কাণেট চোরে নিল কা গই মাগঅ॥

দিবস বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ।

রাতি ভইরে কামরু জাঅ॥

অইসনি চর্য্যা কুক্কুরী পাএঁ গাইউ।

কৈড়ি মঝেঁ একু হিঅহি সমহিউ॥

সহজ ভাষায় এর অর্থ হল, মাদি কচ্ছপকে দোহন করলে দুধের পাত্র ভরে না। গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়। হে প্রসূতি শোন, আঙিনাকে ঘর বানাও। মধ্যরাতে চোর কানের দুল চুরি করল। শ্বশুরকে ঘুম পাড়িয়ে বধুটি জাগে। চোর কানের দুল নিল, কোথায় গিয়ে চাওয়া যায়? দিনের বেলা বধুটি পুরুষের ছায়া দেখলেও ভয় পায়। রাতে কামনগরে যায়। কুক্কুরীপাদ এই চর্যা গান করেন, কোটির মধ্যে গুটিকে তা বোঝে।

কতগুলো পরস্পর বিরোধী বাক্যের সমাহারে মানেগুলো কেমন গোলমেলে ঠেকছে তাই না? একমাত্র শেষ বাক্যটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, পদটির সরল অর্থের বাইরে এর কোনো গূঢ় অর্থ আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, চর্যাপদ সিদ্ধাচার্যদের লেখা বৌদ্ধ দর্শন সম্বন্ধিত লেখা। গূঢ়ার্থ থাকবেই। আসলে ‘দুলি’ সন্ধ্যা শব্দ। সাধারণ অর্থে স্ত্রী কচ্ছপ, গূঢ়ার্থে নৈরাত্মা দেবী। সুকুমার সেনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নৈরাত্মা দেবীর সঙ্গে বজ্রচিত্তের মিলনে বোধিচিত্তের জন্ম হচ্ছে এবং বোধিচিত্ত নির্মাণকায়ে নেমে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। এটি দুলির দুধ দোওয়া। এরপর, গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়। কুমীর অর্থাৎ কুম্ভক যোগ। এই সমাধি যোগে বোধিচিত্তকে নিঃস্বভাবীকৃত করা হচ্ছে। ঘরের অর্থাৎ দেহের মধ্যেই রয়েছে সহজানন্দের উন্মুক্ত আঙিনা। বধু অর্থাৎ পরিশুদ্ধ অবধূতিকা। তার কানের অলংকার চোরে নিল অর্থাৎ সহজানন্দ প্রকৃতি দোষ হরণ করল। অপরিশুদ্ধা অবধূতিকা কালের ছায়া দেখে ভয় পায় এবং পরিশুদ্ধা হয়ে সময়কে অতিক্রম করে সহজানন্দে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করে। শ্বশুর অর্থাৎ শ্বাসবায়ু স্তব্ধ হলে অবধূতিকা জাগে।

এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য চর্যার অর্থ চর্চা নয়, ধারণা পাবার জন্য একটি মাত্র চর্যার অর্থ বিচার করা গেল। চর্যাগানের ধারাকল্প বোঝাই বরং উদ্দেশ্য।

চর্যাগুলি কোন রাগরাগিণীতে গাওয়া হবে তা নিশ্চিত করার জন্য চর্যাকারেরা প্রতিটি চর্যার উপরে রাগরাগিণীর নাম লিখে রেখেছেন। এগুলির মোট সংখ্যা উনিশ। তবে পাঠান্তরে শীবরী ও শবরী রাগিণী এবং গবড়া ও গউড়া রাগিণী সমার্থক হলে রাগরাগিণীর সংখ্যা দাঁড়ায় সতেরোটিতে। তার মধ্যে কয়েকটি হল — রামক্রী, মল্লারী, কামোদ, গউড়া (গৌড় থেকে কি?), মালসী, বরাড়ী, বঙ্গাল ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেকগুলি রাগিণীর আজ আর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, আর কয়েকটি বিবর্তিত হয়ে শাস্ত্রীয় সংগীতের কোলে আশ্রয় নিয়েছে। চর্যার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পদে ব্যবহার হয়েছে পটমঞ্জরী রাগিণী।

চর্যার পদগুলি সিদ্ধাচার্যরা নির্দিষ্ট রাগে সুর করে গাইতেন। এই গানগুলি ছিল বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনার অঙ্গ। সাধারণের মধ্যে এর গূঢ় তত্ত্ব প্রকাশ না পায় সেজন্য এক সরলার্থের আবরণে ঢাকা ছিল পদগুলি। তবে যেহেতু সাধারণ অর্থে চর্যাগানে সে যুগের সমাজের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে তাই এসব গান যে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল বোঝা যায়। চর্যাপদ যেমন বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন, তেমনই চর্যাগানও বাংলা গানের আদি উদাহরণ।

সেকালে গান ছিল সাধারণের ধর্মচর্চার অঙ্গ। তাই বেশিরভাগ প্রাচীন সংগীতই ধর্মসংগীত। ধর্মীয় অনুষঙ্গহীন সংগীতের চর্চা ছিল দূর্লভ। তবে উদ্দেশ্য যতই ধর্মচর্চা হোক না কেন, সাধারণ মানুষের সুখদুঃখ, আবেগ, সারল্য, লাম্পট্য সবের ছায়াই পড়ত সেযুগের গানে। তাই আজকের মত সেদিনও গান ছিল মানুষের আবেগের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম। পার্থক্য শুধু এটাই যে, সে সবে একটা ধর্মের আব্রু জোড়া থাকতো।

চর্যাগীতির পরে যা আমাদের চোখ টানে তা হল, সেনযুগের প্রখ্যাত কবি জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দ। গীতগোবিন্দ হল চব্বিশটি পদাবলির সমষ্টি যা বারোটি সর্গে বিভক্ত। এর ভাষা সংস্কৃত হলেও আদতে তা ভাবে, আবেগে, উপাচারে বঙ্গদেশের নিজস্ব গান।

“স্মরগরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং

দেহি পদপল্লবমুদারম্”

গীতগোবিন্দে সর্বভারতীয় রাগরাগিণীর প্রয়োগ অনেক বেশি হলেও মোট বারোটি মাত্র রাগিণী ব্যবহার করা হয়েছে। তালের সংখ্যা আরও কম। মাত্র পাঁচ। তবে প্রতিটি পদে তালের নাম উল্লেখ আছে। তালগুলি হল—একতাল, অষ্টতাল, যতি, রূপক ও নিঃসার। সুনির্দিষ্ট রাগরাগিণী ও তালের সমন্বয়ে গীতগোবিন্দ অনেক বেশি ছন্দবদ্ধ। পূর্বসূরি চর্যাপদের সাথে গীতগোবিন্দের চারটি রাগিণীর মিল রয়েছে। বরাড়ী, ভৈরবী, গুর্জরী বা গুঞ্জরী এবং দেশাখ। সর্বভারতীয় ও বঙ্গীয় রাগিণীর সমন্বয়ে সৃষ্ট মালবগৌড় নামে রাগিণীও নজর কাড়ে।

বাংলা গানের ইতিহাসে এর পরের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন। নাট্যগীতির আদলে লেখা শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন গীতগোবিন্দের আড়াইশো তিনশো বছর পরের সৃষ্টি।

সব দেবেঁ মেলি সভা পাতিল আকাশে।

কংসের কারণে হএ সৃষ্টির বিনাশে॥

ইহার মরণ হএ কমণ উপাএ।

সহ্মেই চিন্তিআঁ বুয়িল ব্রহ্মার ঠাএ॥

ব্রহ্মা সব দেব লআ গেলান্তি সাগরে।

স্তুতিএঁ তুষিল হরি জলের ভিতরে॥

তোহ্মে নানা রূপেঁ কইলেঁ আসুরের খএ।

তোহ্মার লীলা এ কংসের বধ হএ॥

হেন শুনী ঈসত হাসিআঁ ততিখণে।

ধল কাল দুই কেশ দিল নারায়ণে॥

এহি দুই কেশ হইবে বসুলের ঘরে।

হলী বনমালী নাম দৈবকী উদরে॥

তাহার হাথে হৈবে কংশাসুরের বিনাশে।

হেন বর পাআঁ সব দেব গেলা বাসে॥

সময় উপেখিআঁ রহিলা দেবাগণ।

গাইল বড়ু চন্ডিদাস বাসলীগণ॥

শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে যেসব রাগরাগিণীর ব্যবহার হয়েছেতা চর্যাপদ ও গীতগোবিন্দের প্রকৃত উত্তরাধিকার বলা চলে। রাগরাগিণীর নিরিখে চর্যাপদ, গীতগোবিন্দ ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের যদি তুলনা করা হয়, তবে দেখা যায়, চর্যাপদের পটমঞ্জরী, মল্লার, ভাটিয়ালি, বঙ্গাল, বরাড়ী, ভৈরবী, দেশাখ ও গুর্জরী শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে ব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যেকার কয়েকটি রাগিণী যে গীতগোবিন্দে ব্যবহৃত হয়েছে তা আমরা আগেই দেখেছি। আবার রামকিরি, বসন্ত, দেশবরাড়ী, বিভাস ও মালব রাগিণী গীতগোবিন্দ আর শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন উভয় গীতিকাতেই ব্যবহার করা হয়েছে। চিরাচরিত ধারা অনুসরণের পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন সংযোজনও চোখে পড়ে। যেমন — ধানুষী, আহের, ললিত, কোড়া, কেদার, শ্রী, পাহাড়ী, গৌরী, বেলাবলী ইত্যাদি। নতুন কিছু তালেরও সংযোজন ঘটেছে।

মোটামুটি দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে বঙ্গদেশে বিভিন্ন রাগরাগিণী, সুর-তাল-ছন্দের সমন্বয়ে সংগীত ঐতিহ্য এক সুগঠিত রূপ পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পাশাপাশি লোকসংগীতের বিস্তার বিষয়ে সঠিক তথ্যের অভাবে অনেকটাই ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। তবে একটা দূর্লভ হারানো যোগসূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় – ভাটিয়ালি। যেহেতু চর্যাপদেও ভাটিয়ালি নামে এক স্বতন্ত্র রাগিণীর উল্লেখ আছে, আর আজও ভাটিয়ালি এক বিশেষ ধরণের লোকসংগীত তাই মনে করা সঙ্গত যে, ভাটিয়ালি এমন এক লোকগীতি যা দৃঢ় প্রভাবের সাথে দক্ষিণ বঙ্গে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তার সুরেলা উচ্ছ্বাসে বহমান। এমন সুদৃঢ় ভিত্তি সুরকে অবলম্বন করে কোন এক কালে গুণীজন হয়তো ভাটিয়ালি রাগিণী তৈরি করেছিলেন। ভাটিয়ালির দুটি রূপ। একটায় খানিক লোকসুরের আভাস থাকলেও আজকের ভাটিয়ালি সুরের সাথে তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আর অপর ধারা অনেকটা বাউল সুরের মত। ভাটিয়ালি ছাড়া এমন আর কোন লোকগীতির সন্ধান পাওয়া যায় না যা কালের স্রোত উপেক্ষা করে এতদিন ধরে টিকে থাকার গৌরব অর্জন করতে পেরেছে। তবে বঙ্গাল, গৌড় ইত্যাদি নামের সূত্রে বঙ্গদেশের নিজস্ব সুরধারার শাস্ত্রীয় সংগীত ধারায় একাকার হওয়ার আভাস মেলে।

গানের ধারাপাতে এবারে এমন এক সংগীত ধারার কথা, যাতে বাঙালির নিত্য অবগাহন। বাঙালির একান্ত নিজস্ব কীর্তন গান। কীর্তনে বাঙালির প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ। শুরুর দিকে কীর্তন ও সংকীর্তন সমার্থক ছিল। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেবের সময় থেকে অর্থবদল ঘটতে থাকে। নির্দিষ্ট সুর-তাল-ছন্দে করতাল-মৃদঙ্গ যোগে ভগবানের নামগান বা কীর্তিগাথা অর্থে কীর্তন এবং বহু জনসমাগমে ও বিভিন্ন বাদ্যযোগে উৎসব মুখর পরিবেশে কীর্তন হলে তা সংকীর্তন নামে পরিচিতি পায়।

চৈতন্যদেবের হাত ধরে বঙ্গে সমাজ সংশোধন ও বৈষ্ণব ধর্মের যে নবজোয়ার এলো তার মূল অনুঘটক নগর সংকীর্তন। ভক্তির উচ্ছ্বাসে জাতি বর্ণ নির্বিশেষে একসুর একলয়ে হরিনাম সংকীর্তন বঙ্গীয় নিস্তরঙ্গ সমাজ জীবনে ঘূর্ণিঝড়ের মত ধেয়ে এসে জাতপাতের বেড়াজাল অনেকটা আলগা করে দিল। ভক্তিধর্মের প্রাবল্য ও বৈষ্ণব ধর্মের অভিঘাতে বহু সুরসাধকও চৈতন্যদেবের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। এদের হাত ধরেই কীর্তন এক নতুন মাত্রা পেল। বিভিন্ন রাগরাগিণীর সহযোগে কীর্তনগান এক পরিপূর্ণ সংগীতের আকার নিতে বেশি দেরি করল না।

প্রথমে কীর্তনের অনুসারী রূপে সংগীত আকাশে উদিত হল পদাবলি কীর্তন। বিশেষ সুর-যতি-লয়-ছন্দের সমাহারে পদাবলি কীর্তন এবারে নিজেই এক সুবদ্ধ সংগীতের রূপ নিল। সুকুমার সেনের ভাষায়, সিংহাসন হল পদাবলির আর সিংহাসনের আস্তরণ হল কীর্তনের।

কীর্তন গানের বিশেষ ভঙ্গিটি মধ্য বঙ্গ ও রাঢ় বঙ্গের দান, তবে এর সুর তালে উত্তর ভারতীয় প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই।

শ্রীচৈতন্য যে সংকীর্তনকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তা হল নৃত্য সংকীর্তন। তিনি সংকীর্তনে নাচতেন তো বটেই, সঙ্গে ধুয়া পদও গাইতেন। নাচের দুধরণের রকমফের ছিল। উদ্দণ্ড ও মধুর। চৈতন্যদেব মূল গায়েন হিসেবে গাইতেন না, তিনি মধুর নৃত্যের তালে পালি গায়েন হিসেবে ধুয়া গাইতেন। চৈতন্যযুগে অদ্বৈত আচার্য, মুকুন্দ দত্ত এবং স্বরূপ ছিলেন পদাবলি গানের দক্ষ শিল্পী। এদের প্রভাবে বৈষ্ণব সমাজে পদাবলি কীর্তন পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিল।

সেকালে বৈষ্ণব সমাজে করতাল ও মৃদঙ্গ সহযোগে নিয়মিত বৈঠকী কীর্তন চলত। নরোত্তম দাস এসব বৈঠকী কীর্তনকে সংকীর্তনে উন্নীত করলেন। তিনি দেববিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে বঙ্গদেশ ও অবশিষ্ট ভারতের সেরা সেরা গায়ক তথা বৈষ্ণব মণ্ডলীকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে রাজশাহীতে খেতুরী মহোৎসবের সূচনা করলেন। সময়কাল ১৫৮৫ সাধারণ অব্দের আশপাশ। কীর্তন গানের ইতিহাসে এই খেতুরী মহোৎসব এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সংগীত সম্মেলনেই প্রথম মৃদঙ্গের তাল পদ্ধতি ও পদাবলি গানের রীতি বিধিবদ্ধ হয়েছিল। এর কৃতিত্ব দুজনের। খেতুরী সম্মেলনের হোতা নরোত্তম দাস ও দেবীদাস। নরোত্তম দাস বা নরোত্তম ঠাকুর নিজে উত্তর ভারত থেকে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কীর্তন গানের গায়কীর কাঠামো প্রস্তুত করে দেন আর দেবীদাস মৃদঙ্গবোলের নিয়মকানুনকে সুগঠিত রূপ দেন। ইতিমধ্যে বেশ অনেকগুলি পদাবলি রচিত হয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গোবিন্দদাস বিরচিত ব্রজবুলি ভাষায় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক পদাবলি। এই বিশেষ পদাবলিটি দেবীদাসের হাতে পড়ে মৃদঙ্গের বোলের সাথে মিশে এক অন্য মাত্রা ধারণ করল। স্বভাবতই এর পর থেকে পদাবলি রচনাতেও জোয়ার এসেছিল। এভাবে খেতুরী সম্মেলন পদাবলি রচনাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

চৈতন্যদেবের জীবিতাবস্থায় বঙ্গদেশে তিনটি কীর্তন চর্চাকেন্দ্র তৈরি হয়েছিল—কুলীনগ্রাম, শান্তিপুর ও শ্রীখণ্ড। কিন্তু খেতুরী মহোৎসবের আগেই উপযুক্ত সংগঠকের অভাবে প্রথম দুটি কেন্দ্র জনপ্রিয়তা হারায়। খেতুরীতে যখন সম্মেলন চলছে, বিখ্যাত সংগীতজ্ঞরা উপস্থিত, স্বাভাবিকভাবেই সুর তালের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য হবেই। ফলাফল স্বরূপ কিছুদিনের মধ্যেই অন্তত পাঁচটি বিভিন্ন কীর্তন গানের ঘরানা তৈরি হয়। নরোত্তম দাস শাস্ত্রীয় সংগীতের আদলে যে ঘরানা প্রবর্তন করেন তা গরানহাটি ঘরানা নামে পরিচিতি পায়। চৈতন্যদেবের সময়কালীন বীরভূমের শ্রীখণ্ড ঘরানার সাথে নরোত্তম দাসের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। চৈতন্য পরবর্তী যুগে শ্রীখণ্ড ঘরানা যথেষ্ট প্রাধান্য বজায়ে রাখে। এই সম্প্রদায়ের কীর্তন গানের ঘরানা জ্ঞানদাস মনোহরের নাম অনুসারে মনোহরশাহী ঘরানা নামে পরিচিত হয়। একালের কীর্তনে এখনও মনোহরশাহী ঘরানার একাধিপত্যই চোখে পড়ে। বিপ্রদাস ঘোষ বর্ধমান অঞ্চলে রানীহাটী ঘরানা প্রবর্তন করেন। সরকার মন্দারনের ঘরানা হল মান্দারনী। এদের কেন্দ্র ছিল সম্ভবত বিষ্ণুপুর। বিষ্ণুপুরের রাজদরবারে কীর্তনের খুব কদর ছিল যা মান্দারনী ঘরানাকে পরিচিতি দেয়। ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ঝাড়খণ্ডী ঘরানা কীর্তন জগতে তার নিজস্ব ছাপ রাখতে পেরেছিল।

ধীরে ধীরে কীর্তন বাংলার এক মুখ্য সংগীত রীতি হয়ে উঠল। ছুট, তুক, আঁখর ইত্যাদি নানা বৈশিষ্ট্যে পূর্ণতা পেতে লাগলো কীর্তন গান। কীর্তন ও পদাবলি কীর্তনের ব্যাপারে শাক্তরাও বৈষ্ণবদের থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত চক্রবর্তীর হাত ধরে শ্যামা সংগীত প্রভূত জনপ্রিয়তা পেল। বিশেষ করে রামপ্রসাদী শ্যামাসংগীতে কীর্তন, বাউল সমেত বাংলার মাটির গন্ধ লেগে থাকায় তা এক অনন্য উচ্চতা লাভ করেছিল।

বাউলদের সাধনার মাধ্যম হল গান। তাঁরা বিশ্বাস করেন মানবদেহ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক অর্থাৎ সীমিত দেহের মধ্যেই অসীম বিরাজমান। তাঁদের এই ভাবনার প্রকাশ ঘটে গানের মধ্য দিয়ে। বাউল গান মূলত ভাটিয়ালি সুরের সাথে কীর্তনের সংমিশ্রণ। তবে বাউল গান বীরভূম ও কুষ্টিয়াতে বেশি জনপ্রিয় ছিল, তাই বাউল সংগীতে এই দুই অঞ্চলের লোকসুরের প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। এসব অষ্টাদশ শতকের কথা। এই সময় কীর্তন রীতিতে একটা বড়সড় পরিবর্তন চোখে পড়ে। এতদিনের পুরুষ আধিপত্য ভেঙে আবির্ভাব ঘটে নারী কীর্তনীয়ার। দ্বৈত কন্ঠে কীর্তন যেন অন্য মাত্রা পেল।

এদিকে কলকাতার নব্য বাবু সম্প্রদায় এতদিন বাইজি নাচে অভ্যস্ত ছিলেন। দোল, দুর্গোৎসব যে কোনও অনুষ্ঠানে দিল্লি, লখনউ নিদেন পক্ষে কলকাতার বাইজিদের নাচ গানের মনোরঞ্জন ছিল সেকালের স্বাভাবিক আমোদ। ক্রমশ ব্যাপারটা অতি ধনীদের কাছে একঘেয়ে হয়ে ওঠায় তারা নতুনত্বের খোঁজে ছিল। এবারে তাদের নারী কীর্তনীয়াদের দিকে নজর পড়ল। নতুন ধারায় লেখা এক ধরণের পদাবলি একশ্রেণির নারী কীর্তনীয়ার হাতে পড়ে চটুলতর এক কীর্তনের রূপ নিল। এর নাম ঢপগান। বাইজিদের ঠমক চমকের সাথে কীর্তনের মিশেলে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো ঢপ গান।

এমনভাবে চর্যাগানের শুরুর সেদিন থেকে বাংলা গানের যে বিকল্প ঘরানা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তা এগিয়ে চলল উজান বেয়ে। নানা উত্থান পতনকে সাক্ষী করে, উত্তর আধুনিকতার পথে। এগুলো ঢপ নয় কিন্তু! মাইরি!!

তথ্যসূত্র:

১. গোলাম মুরশিদ, ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’; অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা।

২. করুণাময় গোস্বামী, ‘সঙ্গীত কোষ’; বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫।

৩. উৎপলা গোস্বামী, ‘কলকাতায় সঙ্গীতচর্চা’; প. ব. রাজ্য সঙ্গীত একাডেমি।

৪. সুকুমার সেন, ‘প্রবন্ধ সংকলন ১’; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।  

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।