সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

বাংলার বর্ম রাজবংশ ও বহুত্ববাদের প্রতীক সেই শিলালিপিটি…

বাংলার বর্ম রাজবংশ ও বহুত্ববাদের প্রতীক সেই শিলালিপিটি…

নবাঙ্কুর মজুমদার

ডিসেম্বর ৬, ২০২০ ১৭০৭ 4

কিশোর বয়সে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম পরিচয় ঘটে বঙ্গাধিপ জাতবর্মা ও তাঁর পিতা বজ্রবর্মার সাথে। পরবর্তীতে যখন আরও পড়াশুনার সুযোগ এলো, দেখলাম প্রাচীন বাংলার ইতিহাস গৌড়েশ্বর শশাঙ্ককে দিয়ে শুরু হয়ে পাল-সেন যুগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে !  তবে কি জাতবর্মা – বীরশ্রী শুধুই ঔপন্যাসিকের কল্পনা? বইপত্র ঘাঁটতে শুরু করি। ক্রমশ জেনে আশ্চর্য হলাম, পাল, সেন রাজন্যদের বাদ দিয়েও চন্দ্র, বর্ম, খড়্গ, মল্ল, দেব, রাত কত কত রাজবংশের উত্থান পতনের সাক্ষী ছিল এ বাংলা। 

এভাবেই খোঁজাখুঁজি করে একদিন পাওয়া গেল জাতবর্মাকেও। কলচুরি বংশের চেদিরাজ কর্ণদেবের জামাতা জাতবর্মা (১০৫০-১০৭৫ সাধারণ অব্দ) বেলাব লেখ অনুযায়ী পাল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় (বঙ্গ) রাজত্ব করতেন। ভবদেব ভট্টের ভুবনেশ্বর লেখ থেকে জানা যায় বর্ম বা বর্মন রাজারা ছিলেন যাদব বংশীয়। 

এঁরা বাংলায় বহিরাগত হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে? বর্ম বংশের আদি বাসভূমি সিংহপুরের অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। উত্তরাখণ্ডের লাখামণ্ডলে সপ্তম শতাব্দীর যে শিলালেখ পাওয়া গেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের সিংহপুরে যাদব বংশীয় বর্ম রাজাগণ রাজত্ব করতেন। আবার কলিঙ্গের সিংহপুর নামে জায়গায় পঞ্চম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্মনদের রাজত্বের কথা জানা যায়। 

যদি তাঁরা কলিঙ্গের সিংহপুর থেকে এসে থাকেন তবে এমন হতেই পারে, কলচুরি রাজ কর্ণদেবের বাংলা আক্রমণ কালে আত্মীয় বজ্রবর্মা ও জাতবর্মা তাঁর সাথে বাংলায় এসে পরে সুযোগ বুঝে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। এমনতর সম্ভাবনার কারণ হলো, বাংলা এ সময় এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ছিল। এক দিকে কর্ণদেবের আক্রমণে পূর্ব বাংলায় চন্দ্র বংশের পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে, অপর দিকে উত্তর বাংলায় পাল সাম্রাজ্যের ভগ্নস্তূপকে চ্যালেঞ্জ করে কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিব্য বা দিব্যকের উত্থান হচ্ছে। কৈবর্তদের পরাজিত করতে রামপাল যে সামন্ত জোট বানালেন জাতবর্মা তাতেও থেকে থাকতে পারেন আবার আলাদা ভাবে দিব্যকের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করে থাকতে পারেন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জাতবর্মা যে দিব্যকের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন তা মোটামুটি নিশ্চিত।

কোটালীপাড়ার বৈদিক সমাজের ‘ভবভূমিবার্তা’ নামক কুলগ্রন্থ থেকে জানতে পারছি, পরবর্তী রাজা হরিবর্মার রাজত্বকালে দক্ষিণ দেশ থেকে মুহুর্মুহু আক্রমণ ধেয়ে আসছিল। এসব চিত্র দেখে মনে হয় সে সময়ের বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল মোটেই শান্ত ছিল না।  যাইহোক, এ বংশের আরো যে দুজন রাজা ছিলেন তাঁরা হলেন হরিবর্মার বৈমাত্রেয় ভাই সামল বা শ্যামলবর্মা ও ভোজবর্মা। বর্ম বংশ মূলতঃ পাল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ ও পূর্ব বাংলার চন্দ্র বংশের অবসানের সুযোগে দক্ষিণ পূর্ব বঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, ফলে তাদের মনে সবসময় একটা নিরাপত্তাহীনতা বোধ কাজ করে থাকবে।

সামলবর্মা মালব, কনৌজ, কান্যকুব্জ প্রভৃতি রাজবংশে বিবাহ করে বিবাহ কূটনীতিকে প্রাধান্য দেন।  সিংহলরাজ প্রথম বিজয়বাহুর সাথে নিজ কন্যার বিবাহ সম্ভবত বিবাহ কূটনীতিরই বহিঃপ্রকাশ। সবচেয়ে বড় কথা সমন্দর বন্দর (চট্টগ্রাম) এর মাধ্যমে ‘বঙ্গ’ সে সময় দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার সাথে সামুদ্রিক যোগাযোগ রাখতো। এত করেও শেষ রক্ষা হলো না। বাংলায় শক্তিশালী সেন বংশের উত্থান ও বিক্রমপুরে দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই বর্ম বংশ কালের করাল গ্রাসে পতিত হয়।

কয়েকটি শিলালেখ বা তাম্রশাসন, কুলপঞ্জিকা বা সামান্য কয়েকটি মুদ্রা দিয়ে একটা রাজবংশের সামগ্রিক শাসনকালকে তো ব্যাখ্যা করা যায় না, ফলে আসে অবজ্ঞা আর উদাসীনতা। বর্ম রাজাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তারপর একদিন হঠাৎ উদাসীনতার অন্ধকার ভেদ করে সামনে এলো ভোজবর্মার সুজানগর শিলালেখ। 

এখনও পর্যন্ত আমাদের জানা শেষ বর্ম রাজা হলেন ভোজবর্মা। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সুজানগরে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) ভোজবর্মার এক শিলালিপি আবিষ্কার হলেও তার ঠিক ঠিক পাঠোদ্ধার হয়নি।  ঢাকার বাংলাদেশ জাতীয় মিউজিয়ামের এককোণে পড়ে ছিল সেটি। শরিফুল ইসলাম আংশিক ভাবে পাঠোদ্ধারে সফল হলেও ২০১৯ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাচীন বাংলা’ বিশেষজ্ঞ রাইওসুকে ফুরুই এই লেখটির পূর্ণ অর্থ উদ্ধার করেন (প্রত্ন সমীক্ষা জার্নাল, দশম খণ্ড, ২০১৯)।

বিস্ময়ের শুরু এখানেই। বাংলায় তুর্কি আগ্রাসনের বহু পূর্বেও যে এখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বিদেশিদের বসবাস ছিল, মহারাজ ভোজবর্মার (সম্ভবত সাধারণ অব্দ ১১৩৭-১১৪৫) রাজত্বকালের সপ্তম বর্ষে উৎকীর্ণ এই শিলালিপি তার জ্বলন্ত প্রমাণ !!

শিলালিপিটিতে বলা হয়েছে—পরদেশিকা ও তাদের জ্ঞাতিদের অনুমতিক্রমে মহারাজ ভোজবর্মার মহাসামন্ত ও ‘পঞ্চকুলিকা’ হাসির পুত্র অবুদেবের উদ্যোগে বিহারটি নির্মিত হলো, যার রক্ষাকর্তা স্বয়ং আল্লাহাভট্টারকস্বামী।

মূল শব্দটি  ‘আল্লাহাভট্টারকস্বামীজনসীতাবিহার’।

আল্লাকে সংস্কৃত ভট্টারক ও স্বামী শব্দ দুটির মাধ্যমে পরম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হচ্ছে। তাঁর বিহার অর্থাৎ মসজিদ। তবে শুধুমাত্র মসজিদ নয়, বৌদ্ধ বিহারে যেমন উপাসনালয়ের সাথে সাথে শিক্ষাকেন্দ্রও থাকতো, একইভাবে এখানে বিহার বলতে ডঃ ফুরুই মসজিদ ও তৎসংলগ্ন মাদ্রাসা ধরণের কাঠামোর ধারণা করেছেন।

মহাসামন্ত অবুদেব যে আরবি উচ্চারণে আবু তাতে সন্দেহ নেই। সঙ্গে দেব শব্দ জুড়ে তার পদমর্যাদাকে সম্মানিত করা হচ্ছে। অবুদেবের বাবা হাসি হাসিম অথবা আসিফ হতে পারেন, এর নামের সাথে আবার পঞ্চকুলিকা শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে। এই শব্দটি প্রাচীন বাংলার আর কোনো লেখে পাওয়া না গেলেও গুজরাটের লেখে এর ব্যবহার ছিল। পঞ্চকুলিকা অর্থ বণিক বা শিল্পীদের গিল্ড, যা কোনো শহর বা বাণিজ্য কেন্দ্রে থাকতো। ডঃ ফুরুই এর মতে হাসি এ ধরণের কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ রাখতেন, আর তার ছেলে অবুদেব উচ্চতর প্রশাসনিক পদ (মহাসামন্ত) হাসিল করেছিলেন।  পরদেশিকা ও তাদের সমস্ত জ্ঞাতিদের সম্মতিক্রমে বিহারটি নির্মিত হয়। পরদেশিকা অর্থাৎ বিদেশি মুসলিম ব্যবসায়ীদের এক ক্ষুদ্র জনসমষ্টি সমন্দর বন্দর (চট্টগ্রাম) ও তার আশপাশে বসবাস করতেন যাদের কিছু অংশ ‘বঙ্গে’ (অধুনা ঢাকা বিক্রমপুর ফরিদপুর অঞ্চল) বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত ছিলেন। 

তুর্কি আক্রমণের বহু আগে বাংলায় এ ধরণের আরবি অথবা পারসিক মুসলিমদের উপস্থিতি আমাদের চমৎকৃত করে। শুধুমাত্র উপস্থিতি নয়, প্রশাসনিক কাজে অংশগ্রহণ ও ধর্মীয় আচার পালনের স্বাধীনতা দিয়ে বর্ম রাজারা যেভাবে ভিন ধর্মী বিদেশিদের আপন করে নিয়েছিলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বর্ম রাজারা নিজেরা ‘পরম বৈষ্ণব’ হলেও বৌদ্ধ মঠ মন্দিরেও দান-ধ্যান করতেন। কিন্তু ভোজবর্মার এই শিলালেখ সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে ধর্মীয় উদারতা ও সহনশীলতার এক চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ভারতের সামাজিক অনুশাসন যে শুধুমাত্র শ্রুতি-স্মৃতিশাস্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল না, বরং তা প্রয়োজনে বহুত্ববাদকে বরণ করে নিতে কখনো দ্বিধা করেনি এই শিলালেখ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। ফলত বহুত্ববাদের পৃষ্ঠপোষক রূপে আপাতভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বর্ম বংশ তথা বর্মরাজ ভোজবর্মা বাংলার ইতিহাসে চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবেন।

তথ্যসূত্র:

১/ “Sujanagar Stone Inscription of the Time of Bhojavarman, Year 7” by Ryosuke Furui in Pranta Samiksha: A Journal Of Archaeology, New Series, Volume 10, 2019, pp. 115-122.

২/ Ancient Indian History and Civilization by Sailendranath Sen; New Age International, 1999

৩/ Corpus of Bengal Inscriptions Bearing on History and Civilization of Bengal by Ramaranjan Mukherji and Sachindrakumar Maity; Calcutta: Firma K L Mukhopadhyay, 1967

৪/ বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (রাজন্য কাণ্ড) কায়স্থ কাণ্ডের প্রথমাংশ : নগেন্দ্রনাথ বসু সিদ্ধান্তবারিধি; কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং

৫/ বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস (ব্রাহ্মণ কাণ্ড) তৃতীয় অংশ : নগেন্দ্রনাথ বসু সিদ্ধান্তবারিধি; কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং

মন্তব্য তালিকা - “বাংলার বর্ম রাজবংশ ও বহুত্ববাদের প্রতীক সেই শিলালিপিটি…”

  1. প্রিয় নবাঙ্কুর মজুমদার বাবু,
    আপনি লিখেছেন, “পূর্ব্ব পাকিস্তানের সুজানগরে (বর্ত্তমানে মুন্সিগঞ্জ) — আমি প্রাক্তন মুন্সিগঞ্জী। গ্রাম পঞ্চসারের আমি নবম পুরুষ। আমাদের কুলপঞ্জীতে কোথাও সুজাপুর নেই।
    মুন্সিগঞ্জ কবে সুজাপুর ছিল জানতে আগ্রহী রইলাম।
    ভবদীয়
    ডাঃ নারায়ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    1. মুন্সীগঞ্জের রামপাল ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম সুজানগর। এখানে সুজাপুর নামে কোনো গ্রাম নেই।

  2. বাংলাদেশের উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের পঞ্চম গ্রাম নামক স্থানে ৬৮৯ খ্রিস্টাব্দের মসজিদ পাওয়া গেছে, শশাঙ্ক শাসনের কিছু কাল পরে, ফলক উঠে না এলে বিশ্বাস করা খুবই মুসকিল ছিলো

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।