সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

ডিসেম্বর ১, ২০২৩

‘জাগিয়ে দে রে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন’

কয়েক দিন আগে আমাদের কুম্ভকর্ণের মতো দীর্ঘনিদ্রা ভঙ্গ হয়েছিল, সম্পূর্ণ ঐতিহ্যবিহীন সুরে কাজী নজরুলের ভাঙার গান ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানের এক নতুন সংস্করণ শুনে। কিন্তু তার আগের দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলিতে কাজী নজরুলের ভূমিকা কীভাবে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি, সেই লজ্জার কাহিনি স্বীকার করতে কেউ বোধ হয় রাজি হব না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাম্যবাদী ভাবনার ভাবুকদের অংশগ্রহণের উজ্জ্বল দিকচিহ্নগুলিকে সম্ভবত সচেতনভাবেই বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

উনিশশো বিশের দশকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজ্যান্টস পার্টি গড়ে তোলার যে প্রয়াস শুরু হয়, তার সুত্রপাত ঘটে বাংলায়, আর কাজী নজরুল ছিলেন এর অন্যতম পুরোধা। বাংলায় সাম্যবাদী আন্দোলনকে প্রসারিত করার জন্য মুজফফর আহমদের সঙ্গে তাঁর প্রয়াসের প্রতিফলন দেখতে পাই ‘লাঙ্গল’ ও ‘গণবাণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতাগুচ্ছে। এরই পাশাপাশি, তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হিসাবে সংগঠনকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে ব্যাপৃত হন। প্রথম থেকেই তাঁর তীক্ষ্ণ লেখনী ব্যস্ত ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রসারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে; ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ গানটি আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। উনিশশো কুড়ির দশকে তাঁর কবিতায় ও গানে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বাংলার একটি প্রজন্ম।

১৯২০ সালে আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে নজরুলের স্বাধীনতা সংগ্রামের হয়ে লেখার সুত্রপাত। ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নজরুলের স্পষ্ট ভাষায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের কাছে বিপজ্জনক বলে মনে হওয়ায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁকে ঐ বছরের শেষে কারারুদ্ধ করা হয় এবং এক বছর বাদে তিনি কারামুক্ত হন। হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের অধিকারের দাবিতে অনশন ধর্মঘট করেন। ১৯৩০ সালে তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থের জন্য আবার তাঁর কারাবাসের সাজা হয়, কিন্তু গান্ধি-আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে তাঁর আর কারাবাস হয়নি। বিশের দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের ভূমিকা কী করে আমরা ভুলে যেতে পারি?  

শারীরিক অসুস্থতার কারণে নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের মতো রাজনৈতিক জীবনও সংক্ষিপ্ত। কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ত কালপর্বেও তিনি যেভাবে অর্ধচেতন বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জাগরিত করার জন্য তাঁর দেহ ও মনকে নিয়োজিত করেছিলেন, সেই অধ্যায়ের নতুন করে চর্চার প্রয়োজন আছে। বিশ শতকের প্রথম দিক থেকে বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বিপ্লববাদী ধারার সূচনা ঘটে, সেই ধারার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই ছিলেন ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দ্বারা প্রভাবিত। এই ধারার বিপরীতে সাম্যবাদী ধারার সঙ্গে যুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ভারতের স্বাধীনতার লড়াইকে শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন; ধর্মীয় বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁদের কণ্ঠ ছিল সোচ্চার। ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ গোষ্ঠীর মঞ্চ থেকে কাজী নজরুল ইসলামের মতো বাংলার সাম্যবাদী পথের পথিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা তুলে ধরার সতত চেষ্টা করে যাব।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।