সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

জুন ২৭, ২০২২

প্রত্নতত্ত্ব ও প্রযুক্তি

বাংলার প্রাচীন বা মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা নদী আর মাটি। প্রাচীন কাল থেকে বাংলার নদীগুলি ক্রমাগত প্রবাহপথ পরিবর্তন করে চলেছে, আজ নদী যে খাত ধরে ভীমবেগে প্রবাহিত, কাল সেই খাত পরিত্যক্ত, বিস্মৃত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার জনপদ আর ধর্মীয় সৌধমালার উত্থান-পতনের সঙ্গে বাংলা থেকে নদীপথ হয়ে সমুদ্রে বাণিজ্যযাত্রা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ যখন প্রত্নতাত্ত্বিক মাটির গভীর থেকে বাংলার ইতিহাসকে সূর্যের আলোকে নিয়ে আসতে উত্সুক হন, তখন পলিমাটির গভীর থেকে সেই সত্যকে উদ্ধার করতে গিয়ে তাঁকে প্রথমে জানতে হয় বাংলার ভূতত্ত্বের সেই ইতিবৃত্ত – নদী আর মাটির কথা। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় ভূতত্ত্বের জ্ঞানের প্রয়োজন আজ বিশ্বজনীন, আর সেই কারণে বিকশিত হচ্ছে এক নতুন শাস্ত্র – ভূপ্রত্নতত্ত্ব। ইতিমধ্যেই বাংলার বেশ কয়েকজন তরুণ গবেষক এই নতুন পথে চলতে শুরু করেছেন। কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ভূতত্ত্বকে বাদ দিয়ে প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষাকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হবে।

মাটি খোঁড়ার আগে প্রত্নস্থল ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জরিপ ও অধ্যয়নের প্রথা দীর্ঘদিনের। এই কাজের জন্য কিছুকাল আগে পর্যন্ত ব্যবহৃত ভূমিভেদী রাডার (গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার), ম্যাগনেটোমিটার বা সোনারের মত যন্ত্রের পরিবর্তে আজকাল অপরিহার্য হয়ে পড়েছে এক নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ – মহাকাশ থেকে রিমোট সেন্সিং। মহাকাশের কৃত্রিম উপগ্রহের যে ক্যামেরার চোখ খুঁজে আনে মাটির বুকের মাঝে বন্দি জলের সন্ধান, সেই চোখই উদ্ধার করে আনছে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা অবশেষের অস্তিত্বের সংবাদ। নদীর প্রাচীন প্রবাহ পথ বা পলিমাটির স্তরগুলির ভূতাত্ত্বিক তথ্য নিপুণ ভাবে বিশ্লেষিত হয়ে উপস্থিত হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ববিদের সামনে। প্রত্নতত্ত্বের জগতে এক নতুন দিকচিহ্ন সৃষ্টি করেছে উপগ্রহ ও বিমান থেকে তোলা তাপীয় ও অবলোহিত চিত্রমালা। বিশ্বজনীন অবস্থান-নির্ণায়ক ব্যবস্থা (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) নিঁখুতভাবে জানিয়ে দিচ্ছে সম্ভাব্য প্রত্নস্থলের প্রকৃত অবস্থান।

প্রত্নক্ষেত্র খোঁজার কাজে আর এক নব দিগন্তের সৃষ্টি করছে ‘ড্রোন’ নামে জনপ্রিয় চালকহীন আকাশযান প্রযুক্তিবিদ্যা। মধ্য অ্যামেরিকার গভীর জঙ্গল বা আফ্রিকার মরুভূমির গহনে প্রত্নক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করতে আকাশ পথে ড্রোনের ক্যামেরার চোখ আজ হয়ে উঠছে প্রত্নতত্ত্ববিদদের তৃতীয় চক্ষু। স্পষ্ট রঙিন চিত্রের সাহায্যে পরিকল্পনা করা সম্ভব হচ্ছে ভবিষ্যতের উৎখননের। এই নতুন প্রযুক্তিবিদ্যার আগমনে দূর মহাকাশের পরিবর্তে ছবি তোলা সম্ভব হচ্ছে প্রত্নস্থলের একেবারে কাছ থেকে, প্রত্নতাত্ত্বিকের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণাধীনে।

প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে জীনবিদ্যার প্রবেশ ঘটেছে কয়েক দশক আগে। ‘ইতিহাস তথ্য ও তর্ক’ মুখপুস্তক গোষ্ঠী বা ‘ইতিহাস আড্ডা’ পোর্টালের পাঠকরা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এই প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচিত, অতএব এই বিষয়ে বিশেষ করে কিছু বলার নেই। ইতিহাস ও প্রাগিতিহাসের বিভিন্ন যুগে মানুষ, পশু, পাখি ও উদ্ভিদের মধ্যে সম্পর্ক এবং সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে জীনবিদ্যার প্রয়োগ প্রতিদিন উন্মোচিত করছে নতুন অজানা দিক। সাম্প্রতিক কালে মানুষের অসুখ-বিসুখের ইতিহাসও জীনবিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন করে দেখার চেষ্টা হচ্ছে।

ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রবিন্দু যেমন ক্রমশ ব্যক্তি থেকে সমষ্টির দিকে সরে আসছে, তেমনই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় অনিবার্য হয়ে পড়ছে নিত্য-নতুন প্রযুক্তিবিদ্যার প্রয়োগ। তাই, অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তিবিদ্যার শিক্ষাঙ্গণে প্রত্নতত্ত্ববিদকে দেখতে পেলে বিস্মিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরাও ‘ইতিহাস আড্ডা’ পোর্টালে প্রতিনিয়ত সচেতন থাকব প্রত্নতত্ত্ব ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনের সর্বশেষ তথ্য উপস্থাপনের।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।