সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

ডিসেম্বর ৫, ২০২২

স্বাধীনতা, তোমার জন্যে

ধর্ম যতদিন দুঃখী মানুষকে বেঁচে থাকার সাহস দেয়, ততদিন

রাস্তা নিয়ে কারও সঙ্গে তার ঝগড়া থাকে না। রাস্তা কারও

একার নয়।

বরং তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়, যার স্পর্ধা আকাশ

ছুঁয়ে যায়।

ধর্মের পোশাকের আড়ালে জল্লাদের পোশাক গায়ে চাপায় যে শাসক তাকেও একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়। শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়।

শুরুটা হয়েছিল ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে মাসা আমিনি জেনির মৃত্যুর পর থেকে। ২২ বছর-বয়সী আমিনি ছিলেন একজন কুর্দি মুসলিম। নিজের রাজ্য কুর্দিস্তান থেকে তেহরান শহরে ভাইয়ের সঙ্গে এসেছিলেন, মাথায় ছিল আলগা করে বাঁধা হিজাব, তার কয়েক গোছা চুল দেখা যাচ্ছিল। আমিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ সে হিজাব ঠিকমত পরেনি, সেই অপরাধে ১৩ই সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রত্যেক্ষদর্শীদের বয়ান অনুসারে ইরানের নৈতিকতা পুলিশের ভয়ঙ্কর অত্যাচারে তিন দিন পরে আমিনির মৃত্যু হয়।

আমিনির মৃত্যুতে ইরানের শাসকগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া ছিল আমাদের অতি পরিচিত। কর্তৃপক্ষ দাবী করে যে আমিনি স্বাস্থ্যের কারণে হার্ট আটক হয়ে মারা গেছে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, পুলিশ যখন তাকে পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে যায় তখন সে সুস্থ ছিল। তাকে বারবার অফিসাররা মারধর করেছে। এমনকি দাফনের সময়েও তার বাবাকে আমিনির পা ছাড়া আর কিছুই দেখতে দেওয়া হয়নি।

কারাগারে আমিনির মৃত্যুর পর থেকে ইরান উত্তাল হয়ে উঠেছে। হাজার হাজার নারী পুরুষ একত্রিতভাবে প্রতিবাদ করছেন, মিছিল করছেন, প্রকাশ্যে হিজাব খুলে দিচ্ছেন, চুল কেটে নিয়ে নিশান উড়িয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে, বিচারের নামে হবে প্রহসন। হচ্ছেও তাই। ইরানের নৈতিকতা পুলিশ বাহিনী সমস্ত প্রতিবাদের সহিংস জবাব দিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলেছেন যে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে এখনও পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৪০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী নিহত এবং ১৬,৮০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অথচ আগে তো ইরানে নারীদের অন্তত এরকম অবস্থা ছিল না, তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো ঠিক করতেন মাথা ঢাকবেন কিনা। ইসলামি বিপ্লবের প্রাক্কালে আয়াতোল্লা খোমেইনী ফ্রান্সে নির্বাসিত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে শেষ রাজা মোহাম্মদ রেজা পাহলভি দেশ ছেড়ে মিশরে আশ্রয় নেবার পরে ফ্রান্স থেকে ফিরে আসেন খোমেইনী। গোটা আন্দোলন সংগ্রামে রাশিয়াপন্থি বামগোষ্ঠী ইরানের তুদে পার্টি খোমেইনীকে সমর্থন করেছে এবং বিপ্লবের পক্ষে থেকেছে। যে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে একত্রিতভাবে খোমেইনী অনুসারীরা রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ করেছিল বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তাদেরই ধ্বংস করতে রাষ্ট্রশক্তিকে তারা চূড়ান্তভাবে ব্যবহার করে। ১৯৮২ সাল থেকে তুদে পার্টিকে ইরানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপরে অধিকাংশ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে, হাজার হাজার পার্টি সদস্য ও সমর্থককে আটক করে তুদে পার্টিকে বিনাশ করা হয়।

আজকে, প্রায় বিরোধীহীন রাজনৈতিক পরিসরে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখতে এবং নারীদের ‘তাদের জায়গায়’ রাখতে সেই রাষ্ট্রশক্তিকেই প্রায় একইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিপ্লবোত্তর সময়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে, নয় বছরের শিশু থেকে কিশোরী, মহিলাদের আবশ্যিকভাবে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। দেশের জবরদস্তি হিজাব পরার আইনের প্রতিবাদে বহু আন্দোলন হয়েছে, বহু তরুণ-তরুণীর জীবন কেটেছে কারাগারে। এখনও বেশিরভাগ ইরানি ধর্মীয় বিধিবিধানের বাধ্যতামূলক প্রকৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে, হিজাব পরা নারীর ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করে। ২০২০ সালে একটি স্বাধীন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ৭২% মানুষ বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরোধিতা করেছে।

রাষ্ট্র সেকথা জানে, জানে ইরানের স্বাধীনতাকামী নারীরা জোর করে মাথা ঢাকা দেওয়া পছন্দ করে না। তাই মাসা আমিনির মৃত্যুর পরে স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সক্রিয় প্ৰচেষ্টা না নিয়ে তেহরান ও অন্যান্য শহরে সরকার আরও বেশি করে স্বাধীনতাকামী নারী ও পুরুষের বিরুদ্ধে বেপরোয়া দমনমূলক হিংস্রতা চালাচ্ছে। ভিন্নমতকে দমন করার জন্য, নিরাপত্তা বাহিনী নৃশংসভাবে বিক্ষোভকারীদের উপর অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে গুলি করছে। কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট অ্যাক্সেস বন্ধ করেছে, ইরানের যে সেলিব্রিটিরা বিক্ষোভকে সমর্থন করেছে তাদের শাস্তি দিয়েছে।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার পরে দুটি ১৬ বছর বয়সী কিশোরীর সাম্প্রতিক মৃত্যু জনসাধারণের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবাদী স্লোগান দিছে ‘নারী, জীবন এবং স্বাধীনতা’। তেহরানে বিক্ষোভকারীরা ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেইনীর পতন চেয়ে স্লোগান দিয়েছে। স্লোগানে তারা বলেছে, ‘স্বৈরশাসক নিপাত যাক।’ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর পৈতৃক বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা।

প্রতিবাদে পক্ষ নিচ্ছেন দেশের খেলোয়াড়রাও। তারা ব্যবহার করছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চকে। ১৪ই নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইরানের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ইরানের খেলোয়াড়রা তাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময়ে দেশের প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করতে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একটা শব্দও উচ্চারণ না করে নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন। যখন ফুটবলাররা নিঃশব্দ প্রতিবাদ করছিলেন, তখন দর্শকরা অবশ্য চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছেন। গ্যালারিতে তখন উঠেছিল উত্তাল ধ্বনি ‘জিন, জিয়ান, আজাদি’ মানে ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’।

এই বিক্ষোভ দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে ক’জনই বা আশা করেছিলেন? বাইরে থেকে সাহায্য না পেলেও তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদীরা জয়ের স্বাদ পাচ্ছেন। দীর্ঘ দুই মাসব্যাপী বিক্ষোভের পর নৈতিকতা পুলিশকে ইরানে বাতিল করেছে, এমন এক খবর প্রকাশিত হয়েছে। দেশের এটর্নি জেনারেল-এর বলা এই খবর অবশ্য সরকার এখনও নিশ্চিত করেনি। হয়তো তারাও একটি ছাড় দিয়ে দেখতে চাইছে প্রতিবাদ আন্দোলন বন্ধ হয় কিনা।

লড়াই চলছে। দেশের পুরুষরা পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন, হারানো স্বাধীনতা ফেরাবার প্রস্তুতি নিয়ে জীবন বাজি রেখে নারীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। জেলখানার নির্মম অন্ধকারে বসে বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার অপেক্ষায় এখনও স্বপ্ন দেখছে সে দেশের পুরুষ ও নারী।

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।