সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

সম্পাদকীয়

মে ১, ২০২৩

‘এলেম আমি কোথা থেকে’

ধর্মের ইতিহাস নিয়ে চর্চার সময় সবাই লক্ষ্য করেছেন যে পৃথিবীর সব ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সৃষ্টিতত্ত্ব। প্রাচীন কাল থেকে দর্শন চর্চারও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সৃষ্টির রহস্য সন্ধান। ধর্মীয় বিশ্বাসের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সৃষ্টির রহস্য সন্ধানে যুক্তির ধারার অনুসারী প্রাচীন দার্শনিকদের পথ ধরেই বহু কাল যাবৎ বৈজ্ঞানিকরা পরীক্ষা আর প্রমাণের মাধ্যমে খুঁজে চলেছেন সেই প্রশ্নের উত্তর – ‘এলেম আমি কোথা থেকে?’ এককোষী প্রাণের উদ্ভব থেকে বহুকোষের জটিল সমন্বয়ে গঠিত জীবের উৎপত্তি আর প্রাণী জগতের বিবর্তনের ধারায় প্রাচীন মানব থেকে আধুনিক মানব পর্যন্ত বিবর্তনের ইতিহাস খুঁজে বার করা বিগত কয়েক শতকে বিজ্ঞানচিন্তার অগ্রগতির অন্যতম উল্লেখনীয় ফসল আর এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পথে এক উজ্জ্বল মাইলফলক ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’।

বিশ্বের ইতিহাসে মানুষের চিন্তনের উপর বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম, অর্থনৈতিক আধিপত্য অর্জনের সংগ্রামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। অনেক আধুনিক রাষ্ট্রে আজও ধর্মের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে শাসকদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মের অনুগামীদের চিন্তার উপর আধিপত্য, ঐ ধর্মের নিজস্ব সৃষ্টিতত্ত্বের প্রতি আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল। বিবর্তনবাদ ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বগুলির ঠিক বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। সেই কারণেই বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের শাসকরা অন্যান্য ক্ষেত্রে উদার হলেও, আজও এই এলাকায় বিজ্ঞানকে বিশেষ কাছে ঘেঁষতে দিতে চান না। অর্থনৈতিক লাভের জন্য যে নবীনতম প্রযুক্তির প্রয়োজন এ কথা সব শাসককুলই বোঝেন। তাই এই শাসককুল বংশগতিবিদ্যার চর্চাকে স্বীকৃতি দেন, কিন্তু তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিবর্তনকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করেন। আধুনিক বিশ্বের বেশ কিছু রাষ্ট্রে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় আদর্শ, এই সব রাষ্ট্রে ডারউইন ও তাঁর পরবর্তী বৈজ্ঞানিকদের বিবর্তন নিয়ে আবিষ্কারগুলিকে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার প্রয়াস আজও অব্যাহত। সেই কারণে, এই সব রাষ্ট্রে বিবর্তনের কথা বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের পাঠক্রম থেকে গায়েব অথবা নামমাত্র উল্লেখেই সমাপ্ত।

ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী ভাবনা উনিশ শতকের জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। স্বাধীনতার পরবর্তী কালে ভারতের শাসকরা সাংবিধানিক বা নাগরিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেও, তার ভিত্তি এখনও খুব একটা শক্তপোক্ত হয়নি। অন্য দিকে বিগত কয়েক দশকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ভারতের নাগরিকদের চিন্তনে বিপুলভাবে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। ভারতের বর্তমান শাসককুল যে পুরোনো শাসকদের সাংবিধানিক জাতীয়তাবাদের ধারণাকে প্রতিস্থাপিত করে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেই বিষয়ে কোনও দ্বিধার অবকাশ নেই। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে  রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে সুনিশ্চিত করতে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য অত্যন্ত প্রয়োজন। সেই আনুগত্যকে মজবুত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পর এবার তাঁদের নজর পড়েছে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের পাঠক্রমের দিকে। 

সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়সমূহের পাঠক্রম থেকে যৌক্তিককরণের নামে বিভিন্ন বিষয়ের যে অধ্যায়গুলিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেই অধ্যায়গুলির বিষয়বস্তু দেখলে বোঝা যায় এর পিছনে ভারতের নতুন শাসককুলের রাষ্ট্রীয় আদর্শ পরিবর্তনের জন্য এক সংগঠিত পরিকল্পনা কাজ করেছে। তাই, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উচ্চবর্গীয়দের ধর্মীয় ভাবনাকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসাবে নির্মাণের রাজনৈতিক প্রয়োজনে দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের পাঠক্রমের একটি অধ্যায় থেকে বিবর্তন বাদ দিলেও অর্থনৈতিক কারণে বংশগতিকে রেখে দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার পাঠক্রমের এই বদলের কারণ হিসাবে সরকারের ব্যাখ্যায় যে ‘যৌক্তিককরণ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শব্দটির প্রয়োগ প্রমাণ করে বর্তমান ভারতের শাসকদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ধারণা রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বজায় রাখার জন্য একটি সুচিন্তিত আধুনিক রাজনৈতিক মতবাদ। ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত যে রাজনৈতিক মতবাদগুলিকে সাধারণত ‘মৌলবাদ’ নামে অভিহিত করা হয়, সেই রকম কোনও প্রাগাধুনিক মতবাদ নয়। তাই ইতিহাসের ছাত্রদের ভারতের নতুন শাসকদের সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের পাঠক্রমের পরিবর্তনকে তাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে নেওয়া অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে একসঙ্গে যুক্ত করে দেখা দরকার। আজ ভারতের প্রত্যেক ইতিহাস সচেতন নাগরিকের শাসককুলের এই সাম্প্রতিক পাঠক্রমের ‘যৌক্তিককরণ’ করার পিছনে প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলি বিশ্লেষণ করে দেখার দরকার আছে।  

মন্তব্য তালিকা - “সম্পাদকীয়”

মন্তব্য করুন

আপনার ইমেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।