সূচী

ইতিহাস তথ্য ও তর্ক

লেখক: জয়ন্ত ভট্টাচার্য

জয়ন্ত ভট্টাচার্য
লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার স্নাতক এবং বিগত তিন দশক ধরে বিমান প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। ইতিহাস, বিশেষতঃ সামাজিক ইতিহাস ও মুদ্রাতত্ত্ব নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহী পাঠক। ইতিহাস নিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত সাম্প্রতিক।
বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের অধিকাংশ, পাঞ্জাব প্রদেশের কিছু অংশ এবং পূর্ব আফগানিস্তানের একটি অংশ বহু প্রাচীনকাল থেকে গান্ধার নামে পরিচিত ছিল, ঋগ্বেদেও (১.১২৬.৭) গান্ধারের উল্লেখ আছে। ষষ্ঠ শতক সাধারণপূর্বাব্দের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষার্ধে আলেকজান্ডারের অভিযান পর্যন্ত গান্ধার (প্রাচীন পারসিক ভাষায় গন্দার) অঞ্চল আকিমিনীয় সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চতুর্থ শতক সাধারণপূর্বাব্দের শেষে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই এলাকাকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। প্রথম সহস্রাব্দ সাধারণপূর্বাব্দের মাঝামাঝি থেকে প্রাচীন গান্ধারের দুটি মুখ্য নগর ছিল পুষ্কলাবতী (বর্তমান চারসদ্দা) ও তক্ষশিলা।
আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার পরিমণ্ডলে স্বাধীনতা-পূর্ব পশ্চিম ভারতের ভিল ও গরাসিয়া আদিবাসীদের একী আন্দোলন সম্বন্ধে খুবই কমই উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়।১ ‘একী’ কথাটির অর্থ একতা। বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের আদিবাসীরা দীর্ঘদিনের নির্যাতনের প্রতিবাদে মোতিলাল তেজাবতের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের শপথ নিয়েছিলেন বলে নিজেদের আন্দোলনকে তাঁরা ‘একী’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তৎকালীন রাজপুতানা এজেন্সির মেবাড় ও তার পার্শ্ববর্তী দেশীয় রাজ্যগুলির শাসকদের সাধারণ প্রজাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক করের বোঝা থেকে মুক্তি, বেগার শ্রমের অবসান ও অরণ্যের জমি থেকে উপজাত দ্রব্যের উপর অধিকার ছিল এই আন্দোলনের মুখ্য দাবি। এই সময় বর্তমান রাজস্থান ও গুজরাতে অবস্থিত মেবাড়, সিরোহি, দুঙ্গরপর, দাঁতা, পালনপুর, ইডর প্রমুখ দেশীয় রাজ্যগুলিতে পৃথক পৃথক কর ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। একী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম দাবি ছিল একই কর ব্যবস্থার প্রচলন। পশ্চিম ভারতের ভিল আদিবাসীরা মূলত উদয়পুর শহরের দক্ষিণে অবস্থিত ভোমট ও দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত মগরা নামের দুটি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতেন। সেই কারণে এই আন্দোলন ‘ভোমট ভিল’ আন্দোলন নামেও পরিচিত।
অন্ত মধ্যযুগ থেকে যে ভূভাগ বাঙ্গালা বা বাংলা নামে পরিচিত, আদি মধ্যযুগ থেকেই সেই ভূখণ্ডের ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির ক্রমশ একটি রাজ্যতন্ত্রের অধীনে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সাধারণাব্দের ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতকের মধ্যবর্তী কোনও সময় রচিত আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প গ্রন্থে (৫৩.৬৮৭) উল্লিখিত ‘গৌড়তন্ত্র’১ সম্ভবত এই পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। আদি মধ্যযুগে বাংলা বেশ কয়েকবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণাব্দের অষ্টম শতকে কাশ্মীরের শাসক ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় এবং একাদশ শতকে তামিল ভূমির শাসক রাজেন্দ্র চোলের সেনার আক্রমণে। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও উত্স থেকে আদি মধ্যযুগের এই দুই বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও আক্রমণের ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে প্রায় কোনও তথ্যই পাওয়া যায়নি।
বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলায় ভাগীরথী নদীর পুরোনো গতিপথের ধারে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার এক সমৃদ্ধ জনপদ রক্তমৃত্তিকার নাম আজ প্রায় বিস্মৃত। আদি মধ্যযুগে এই জনপদ যে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল, রক্তমৃত্তিকার প্রত্নক্ষেত্র থেকে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুসমূহের অধ্যয়নে পাওয়া গেছে তার অসংশয়িত প্রমাণ। এই জনপদে স্থাপিত বৌদ্ধ মহাবিহার যে প্রাচীন বাংলায় শাস্ত্রচর্চার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, চিনা পরিব্রাজক জুয়ানজ্যাং-এর বর্ণনায় তার প্রমাণও লিপিবদ্ধ। সম্ভবত বাংলায় গুপ্ত অধিকারের সময় রক্তমৃত্তিকার মহাবিহার প্রতিষ্ঠার কাল। সেই সময় থেকে অন্ত মধ্যযুগে ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত রক্তমৃত্তিকা জনপদের গুরুত্ব সম্ভবত কখনও একেবারে বিলুপ্ত হয়নি। আজও প্রাচীন রক্তমৃত্তিকা জনপদের স্মৃতি বহন করে চলেছে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর ব্লকের অন্তর্গত রাঙামাটি নামের একটি গ্রাম। এই নিবন্ধের চর্চার বিষয় এই প্রাচীন জনপদের গৌরবময় ইতিহাস।